সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।
    অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক’রে
    আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি-
    স্বদেশের সীমানায়।
    দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
    স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
    নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
    দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে;
    – ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।

    আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,
    হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
    রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
    আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
    আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
    স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
    চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ
    কিছুতেই বুঝি না কী ক’রে এড়াব তাকে?
    কী ক’রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?
    যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
    চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
    প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
    গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক,
    রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই।

    তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
    কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
    কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
    কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
    কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
    তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
    তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
    ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
    ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
    বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
    আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র।
    জানি না আজো, আছ কি নেই,
    দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
    জানি না তাও।

    তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায়
    ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।
    জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক’রে নেই
    মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;
    জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
    মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।
    তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
    সে তোমার হৃদয়।
    যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
    পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
    আর সামনে নয়,
    এবার পেছনে ফেরার পালা।

    পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
    এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
    প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী? উত্তর তার-
    তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
    ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
    ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
    আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।

    আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
    সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
    অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
    নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।

    টীকা