সীতেশের কথা

    তোমরা সকলেই জান, আমার প্রকৃতি সেনের ঠিক উল্টো।
    স্ত্রীলোক দেখলে আমার মন আপনিই নরম হয়ে আসে। কত সাল শরীরের ভিতর
    কত দুর্বল মন থাকতে পারে, তোমাদের মতে আমি তার একটি জজ্যান্ত উদাহরণ। বিলেতে আমি মাসে একবার করে নূতন করে
    ভালবাসায় পড়তুম; তার জন্য তোমরা আমাকে কত-না ঠাট্টা
    করেছ, এবং তার জন্য আমি তোমাদের সঙ্গে কত-না তর্ক করেছি। কিন্তু এখন আমি আমার নিজের
    মন বুঝে দেখেছি যে, তোমরা যা বলতে তা ঠিক। আমি যে সেকালে, দিনে একবার করে ভালবাসায়
    পড়িনি, এতেই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই! স্ত্রীজাতির দেহ এবং মনের ভিতর এমন একটি শক্তি আছে,
    যা আমার দেহ-মনকে নিত্য টানে। সে আকর্ষণী শক্তি কারও বা চোখের চাহনিতে থাকে, কারও বা
    মুখের হাসিতে, কারও বা গলার স্বরে, কারও বা দেহের গঠনে। এমন কি, শ্ৰীঅঙ্গের কাপড়ের
    রঙে, গহনার ঝঙ্কারেও আমার বিশ্বাস যাদু আছে। মনে আছে, একদিন একজনকে দেখে আমি কাতর হয়ে
    পড়ি, সেদিন সে ফলসাই-রঙের কাপড় পরেছিল—তারপরে তাকে আর একদিন অশমানি-রঙের কাপড় পরা দেখে
    আমি প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলুম! এ রোগ আমার আজও সম্পূর্ণ সারেনি। আজও আমি মলের শব্দ শুনলে
    কান খাড়া করি, রাস্তায় কোন বন্ধ গাড়িতে খড়খড়ি তোলা রয়েছে দেখলে আমার চোখ আপনিই সেদিকে
    যায়; গ্রীক Statueর মত গড়নের কোনও হিন্দুস্থানী রমণীকে পথে ঘাটে পিছন থেকে দেখলে আমি
    ঘাড় বাঁকিয়ে একবার, তার মুখটি দেখে নেবার চেষ্টা করি। তা ছাড়া, সেকালে আমার মনে এই
    দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, আমি হচ্ছি সেইজতের পুরুষমানুষ, যাদের প্রতি স্ত্রীজাতি স্বভাবতঃই
    অনুরক্ত হয়। এ সত্ত্বেও যে আমি নিজের কিম্বা পরের সর্বনাশ করিনি, তার কারণ Don
    Juan হবার মত সাহস ও শক্তি আমার শরীরে আজও নেই, কখন ছিলও না। দুনিয়ার যত সুন্দরী আজও রীতিনীতির কাঁচের আলমারির ভিতর পোরা রয়েছে, অর্থাৎ তাদের
    দেখা যায়, ছোঁয়া যায়
    না। আমি যে ইহজীবনে এই আলমারির একখানা কঁাচও ভাঙিনি, তার কারণ ও-বস্তু ভাঙলে প্রথমতঃ
    বড় আওয়াজ হয়—তার ঝন্ঝনানি পাড়া মাথায় করে তোলে; দ্বিতীয়তঃ তাতে হাত পা কাটবার ভয়ও আছে।
    আসল কথা, সেন eternal feminine একের ভিতর পেতে চেয়েছিলেন—আর আমি অনেকের ভিতর। ফল সমানই
    হয়েছে। তিনিও তা পাননি, আমিও পাইনি। তবে দুজনের ভিতর তফাৎ এই যে, সেনের মত কঠিন মন
    কোনও স্ত্রীলোকের হাতে পড়লে, সে তাতে বাটালি দিয়ে নিজের নাম খুদে রেখে যায়; কিন্তু
    আমার মত তরল মনে, স্ত্রীলোকমাত্রেই তার আঙ্গুল ডুবিয়ে যা-খুসি হিজিবিজি করে দাড়ি টানতে
    পারে, সেই সঙ্গে সে-মনকে ক্ষণিকের তরে ঈষৎ চঞ্চল করেও তুলতে পারে—কিন্তু কোনও দাগ রেখে
    যেতে পারে না; সে অঙ্গুলিও সরে যায়—তার রেখাও মিলিয়ে যায়। তাই আজ দেখতে পাই আমার স্মৃতিপটে
    একটি ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোকের স্পষ্ট ছবি নেই। একটি দিনের একটি ঘটনা আজও ভুলতে পারিনি,
    কেননা এক জীবনে এমন ঘটনা
    দু’বার ঘটে না।

    আমি তখন লণ্ডনে। মাসটি ঠিক মনে নেই; বোধ হয় অক্টোবরের
    শেষ, কিম্বা নভেম্বরের প্রথম। কেননা এইটুকু মনে আছে যে, তখন চিমনিতে আগুন দেখা দিয়েছে। আমি একদিন সকালবেলা
    ঘুম থেকে উঠে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি যে, সন্ধ্যে হয়েছে; যেন সূর্যের আলো নিভে গেছে,
    অথচ গ্যাসের বাতি জ্বালা হয়নি। ব্যাপারখানা কি বোঝবার জন্য জানালার কাছে গিয়ে দেখি,
    রাস্তায় যত লোক চলেছে সকলের মুখই ছাতায় ঢাকা। তাদের ভিতর পুরুষ স্ত্রীলোক চেনা যাচ্ছে
    শুধু কাপড় ও চালের তফাতে। যারা ছাতার ভিতর মাথা গুজে, কোনও দিকে দৃকপাত না করে, হহ
    করে চলেছেন, বুঝলুম তারা পুরুষ; আর যারা ডানহাতে ছাতা ধরে বাঁহাতে গাউন হাঁটুপর্যন্ত
    তুলে ধরে কাদাখোচার মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছেন, বুঝলুম তারা স্ত্রীলোক। এই থেকে আন্দাজ করলুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে; কেননা এ বৃষ্টির ধারা এত সূক্ষম যে তা চোখে দেখা যায় না, আর এত ক্ষীণ
    যে কানে শোনা যায় না।

    ভাল কথা, এ জিনিষ কখনও নজর করে দেখেছ কি যে, বর্ষার দিনে বিলেতে কখনও মেঘ করে না? আকাশটা শুধু আগাগোড়া ঘুলিয়ে যায়, এবং তার
    ছোঁয়াচ লেগে গাছপালা সব নেতিয়ে পড়ে, রাস্তাঘাট সব কাদায় প্যাচপ্যাচ, করে। মনে হয় যে,
    এ বর্ষার আধখানা উপর থেকে নামে, আর আধখানা নীচে থেকেও ওঠে, আর দুইয়ে মিলে আকাশময় একটা
    বিশ্র৷ অস্পৃশ্য নোঙরা ব্যাপারের সৃষ্টি করে। সকালে উঠেই দিনের এই চেহারা দেখে যে একদম
    মনমরা হয়ে গেলুম, সে কথা বলা বাহুল্য। এরকম দিনে, ইংরাজরা বলেন তাদের খুন করবার ইচ্ছে
    যায়; সুতরাং এ অবস্থায় আমাদের যে আত্মহত্যা করবার ইচ্ছে হবে, তাতে
    আর আশ্চর্য কি?

    আমার একজনের সঙ্গে Richmond-এ যাবার কথা ছিল, কিন্তু এমন দিনে ঘর থেকে বেরবার প্রবৃত্তি হল না। কাজেই ব্রেকফাষ্ট খেয়ে
    Times নিয়ে পড়তে বসলুম। আমি সেদিন ও-কাগজের প্রথম অক্ষর থেকে শেষ অক্ষর পর্যন্ত পড়লুম;
    এক কথাও বাদ দিই নি। সেদিন আমি প্রথম আবিষ্কার করি যে, Times-এর শাঁসের চাইতে তার খোস,
    তার প্রবন্ধের চাইতে তার বিজ্ঞাপন ঢের বেশী মুখরোচক! তার আর্টিকেল পড়লে মনে যা হয়,
    তার নাম রাগ; আর তার অ্যাড্‌ভার্টিস্‌মেন্ট পড়লে মনে যা হয়, তার নাম লোভ। সে যাই হোক,
    কাগজ-পড়া শেষ হতে-না-হতেই, দাসী লাঞ্চ এনে হাজির করলে; যেখানে বসেছিলুম, সেইখানে বসেই
    তা শেষ করলুম। তখন দুটো বেজেছে। অথচ বাইরের চেহারার কোনও বদল হয়নি, কেননা এই বিলাতী বৃষ্টি ভাল করে
    পড়তেও জানে না, ছাড়তেও জানে না। তফাতের মধ্যে দেখি যে, আলো ক্রমে এত কমে এসেছে যে,
    বাতি না জ্বেলে ছাপার অক্ষর আর পড়বার জো নেই।

    আমি কি করব ঠিক করতে না পেরে ঘরের ভিতর পায়চারি করতে সুরু করলুম, খানিকক্ষণ পরে তাতেও বিরক্তি ধরে এল। ঘরের গ্যাস জ্বেলে
    আবার পড়তে বসলুম। প্রথমে নিলুম আইনের বই—Anson এর Contract। এক কথা দশ বার করে পড়লুম,
    অথচ offer এবং acceptance-এর এক বর্ণও মাথায় ঢুকল না। আমি জিজ্ঞেস করলুম “তুমি এতে রাজি?” তুমি উত্তর করলে “আমি ওতে রাজি।”— এই সোজা জিনিষটেকে মানুষ
    কি জটিল করে তুলেছে, তা দেখে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হয়ে পড়লুম! মানুষে যদি
    কথা দিয়ে কথা রাখত, তাহলে এই সব পাপের বোঝা আমাদের আর বইতে হত না। তাঁর খুরে দণ্ডবৎ
    করে Ansonকে সেফের সর্বোচ্চ থাকে তুলে রাখলুম। নজরে পড়ল সুমুখে একখানা পুরনো Punch
    পড়ে রয়েছে। তাই নিয়ে ফের বসে গেলুম। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন Punch পড়ে হাসি পাওয়া
    দূরে থাক, রাগ হতে লাগল। এমন কলে-তৈরী রসিকতাও যে মানুষে পয়সা দিয়ে কিনে পড়ে, এই ভেবে
    অবাক হলুম! দিব্যচক্ষে দেখতে পেলুম যে পৃথিবীর এমন দিনও আসবে, যখন Made in Germany
    এই ছাপমারা রসিকতাও বাজারে দেদার কাটবে। সে যাই হোক, আমার চৈতন্য হল যে, এ দেশের আকাশের
    মত এ দেশের মনেও বিদ্যুৎ কালে-ভদ্রে এক-আধবার দেখা দেয়—তাও আবার যেমন ফ্যাকাসে, তেমনি
    এলো। যেই এই কথা মনে হওয়া, অমনি Punch-খানি চিমনির ভিতর খুঁজে দিলুম,—তার আগুন আনন্দে
    হেসে উঠল। একটি জড়পদার্থ Punch-এর মান রাখল দেখে খুসি হলুম!

    তারপর চিমনির দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে মিনিট দশেক
    আগুন পোহালুম। তারপর আবার একখানি বই নিয়ে পড়তে বসলুম। এবার নভেল। খুলেই দেখি ডিনারের
    বর্ণনা। টেবিলের উপর সারি সারি রূপোর বাতিদান, গাদা গাদা রূপোর বাসন, ডজন ডজন হীরের
    মত পল-কাটা চক্চকে ঝকঝকে কাচের গেলাস। আর সেই সব গেলাসের ভিতর, স্পেনের ফ্রান্সের জর্মানির
    মদ,—তার কোনটির রঙ চুনির, কোনটির পান্নার, কোনটির পোখরাজের। এ নভেলের নায়কের নাম
    Algernon, নায়িকার Millicent। একজন Duke-এর ছেলে, আর একজন millionaire-এর মেয়ে; রূপে Algernon বিদ্যাধর,
    Millicent বিদ্যাধরী। কিছুদিন হল পরস্পর পরস্পরের প্রণয়াসক্ত হয়েছেন, এবং সে প্রণয়
    অতি পবিত্র, অতি মধুর, অতি গভীর। এই ডিনারে Algernon বিবাহের
    offer করবেন, Millicent তা accept করবেন—contract পাকা হয়ে যাবে!

    সেকালে কোনও বর্ষার দিনে কালিদাসের আত্মা যেমন মেঘে
    চড়ে অলকায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, এই দুর্দিনে আমার আত্মাও তেমনি কুয়াসায় ভর করে এই নভেল-বর্ণিত
    রূপোর রাজ্যে গিয়ে উপস্থিত হল। কল্পনার চক্ষে দেখলুম, সেখানে একটি যুবতী,–বিরহিণী
    যক্ষ-পত্নীর মত —আমার পথ চেয়ে বসে আছে। আর তার রূপ! তা বর্ণনা করবার ক্ষমতা আমার নেই।
    সে যেন হীরেমাণিক দিয়ে সাজানো সোণার প্রতিমা। বলা বাহুল্য যে, চারচক্ষুর মিলন হবামাত্রই
    আমার মনে ভালবাসা উথলে উঠল। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে আমার মনপ্রাণ তার হাতে সমর্পণ করলুম।
    সে সস্নেহে সাদরে তা গ্রহণ করলে। ফলে, যা পেলুম তা শুধু যক্ষকন্যা নয়, সেই সঙ্গে যক্ষের
    ধন। এমন সময় ঘড়িতে টং টং করে চারটে বাজল,অমনি আমার দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। চোখ চেয়ে
    দেখি, যেখানে আছি সে রূপকথার রাজ্য নয়, কিন্তু একটা সঁতসেঁতে অন্ধকার জল-কাদার দেশ।
    আর একা ঘরে বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল; আমি টুপি ছাতা ওভারকোট নিয়ে রাস্তায়
    বেরিয়ে পড়লুম।

    জানই ত, জলই হোক, ঝড়ই হোক, লণ্ডনের রাস্তায় লোকচলাচল
    কখনও বন্ধ হয় না,—সেদিনও হয়নি। যতদূর চোখ যায় দেখি, শুধু মানুষের স্রোত চলেছে—সকলেরই
    পরণে কালো কাপড়, মাথায় কালো টুপি, পায়ে কালো জুতো, হাতে কালো ছাতা। হঠাৎ দেখতে মনে
    হয় যেন অসংখ্য অগণ্য Daguerrotype-এর ছবি বইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে, রাস্তায় দিশেহারা
    হয়ে ছুটোছুটি করছে। এই লোকারণ্যের ভিতর, ঘরের চাইতে আমার বেশি একলা মনে হতে লাগল, কেননা
    এই হাজার হাজার স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে এমন একজনও ছিল না যাকে আমি চিনি, যার সঙ্গে দুটো
    কথা কইতে পারি; অথচ সেই মুহূর্তে মানুষের
    সঙ্গে কথা কইবার জন্য আমার মন অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। মানুষ যে মানুষের পক্ষে
    কত আবশ্যক, তা এইরকম দিনে এইরকম অবস্থায় পূরো বোঝা যায়।

    নিরুদ্দেশ-ভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমি Holborn Circus-এর
    কাছাকাছি গিয়ে উপস্থিত হলুম। সুমুখে দেখি একটি ছোট পুরনো বইয়ের দোকান, আর তার ভিতরে
    একটি জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধ গ্যাসের বাতির নীচে বসে আছে। তার গায়ের ফ্ৰককোটের বয়েস বোধ হয়
    তার চাইতেও বেশি। যা বয়স-কালে কালো ছিল, এখন তা হলদে হয়ে উঠেছে। আমি অন্যমনস্কভাবে
    সেই দোকানে ঢুকে পড়লুম। বৃদ্ধটি শশব্যস্তে সসম্ভমে উঠে দাঁড়াল। তার রকম দেখে মনে হল
    যে, আমার মত সৌখীন পোষাক-পরা খদ্দের ইতিপূর্বে তার দোকানের ছায়া কখনই মাড়ায়নি। এ-বই
    ও-বই সে-বইয়ের ধূলো ঝেড়ে, সে আমার সুমুখে নিয়ে এসে ধরতে লাগল। আমি তাকে স্থির থাকতে
    বলে, নিজেই এখান-থেকে সেখান-থেকে বই টেনে নিয়ে পাতা ওল্টাতে সুরু করলুম। কোন বইয়ের
    বা পাঁচমিনিট ধরে ছবি দেখলুম, কোন বইয়ের বা দু’চার লাইন পড়েও ফেললুম। পুরনো বই-ঘাঁটার ভিতর যে একটু
    আমোদ আছে, তা তোমরা সবাই জান। আমি একমনে সেই আনন্দ উপভোগ করছি, এমন সময়ে হঠাৎ এই ঘরের
    ভিতর কি-জানি কোথা থেকে একটি মিষ্টি গন্ধ, বর্ষার দিনে বসন্তের হাওয়ার মত ভেসে এল।
    সে গন্ধ যেমন ক্ষীণ তেমনি তীক্ষ্ণ,এ সেই জাতের গন্ধ যা অলক্ষিতে তোমার বুকের ভিতর প্রবেশ
    করে, আর সমস্ত অন্তরাত্মাকে উতলা করে তোলে। এ গন্ধ ফুলের নয়; কেননা ফুলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে
    যায়, আকাশে চারিয়ে যায়; তার কোনও মুখ নেই। কিন্তু এ সেই-জাতীয় গন্ধ, যা একটি সূক্ষরেখা
    ধরে ছুটে আসে, একটি অদৃশ্য তীরের মত বুকের ভিতর গিয়ে বেঁধে। বুঝলুম এ গন্ধ হয় মৃগনাভি
    কস্তুরির, নয় পাচুলির,—অর্থাৎ রক্তমাংসের দেহ থেকে এ গন্ধের উৎপত্তি। আমি একটু ত্রস্তভাবে মুখ ফিরিয়ে
    দেখি যে, পিছনে গলা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া কালো কাপড় পরা একটি স্ত্রীলোক, লেজে ভর
    দিয়ে সাপের মত, ফণা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রয়েছি দেখে, সে চোখ
    ফেরালে না। পূর্বপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হলে লোকে যেরকম করে হাসে, সেইরকম মুখ-টিপেটিপে
    হাসতে লাগল,—অথচ আমি হলপ করে বলতে পারি যে, এ-স্ত্রীলোকের সঙ্গে ইহজন্মে আমার কস্মিকালেও
    দেখা হয়নি। আমি এই হাসির রহস্য বুঝতে না পেরে, ঈষৎ অপ্রতিভভাবে তার দিকে পিছন ফিরিয়ে
    দাঁড়িয়ে, একখানি বই খুলে দেখতে লাগলুম। কিন্তু তার একছত্রও আমার চোখে পড়ল না। আমার
    মনে হতে লাগল যে, তার চোখ-দুটি যেন ছুরির মত আমার পিঠে বি ধছে। এতে আমার এত অসোয়াস্তি
    করতে লাগল যে, আমি আবার তার দিকে ফিরে দাঁড়ালুম। দেখি সেই মুখটেপা হাসি তার লেগেই রয়েছে।
    ভাল করে নিরীক্ষণ করে দেখলুম যে, এ গসি তার মুখের নয়,—চোখের। ইস্পাতের মত নীল, ইস্পাতের
    মত কঠিন দুটি চোখের কোণ থেকে সে হাসি ছুরির ধারের মত চিকমিক্ করছে। আমি সে দৃষ্টি এড়াবার
    যত বার চেষ্টা করলুম, আমার চোখ তত বার ফিরে ফিরে সেইদিকেই গেল। শুনতে পাই, কোন কোন
    সাপের চোখে এমন আকর্ষণী শক্তি আছে, যার টানে গাছের পাখা মাটিতে নেমে আসে,–হাজার পাখা-ঝাপটা
    দিয়েও উড়ে যেতে পারে না। আমার মনের অবস্থা ঐ পাখীর মতই হয়েছিল।

    বলা বাহুল্য ইতিমধ্যে আমার মনে নেশা ধরেছিল,—ঐ পাচুলির গন্ধ আর ঐ
    চোখের আলো, এই দুইয়ে মিশে আমার শরীর-মন দুই-ই উত্তেজিত করে তুলেছিল। আমার মাথার ঠিক ছিল না, সুতরাং তখন
    যে কি করছিলুম তা আমি জানিনে। শুধু এইটুকু মনে আছে যে, হঠাৎ তার গায়ে আমার গায়ে ধাক্কা
    লাগল। আমি মাপ চাইলুম; সে হাসিমুখে উত্তর করলে—“আমার দোষ, তোমার নয়।” তার গলার স্বরে আমার বুকের ভিতর কি-যেন ঈষৎ কেঁপে উঠল,
    কেননা সে আওয়াজ বাঁশির
    নয়, তারের যন্ত্রের। তাতে জোয়ারি ছিল। এই কথার পর আমরা এমনভাবে পরস্পর কথাবার্তা আরম্ভ
    করলুম, যেন আমরা দুজনে কতকালের বন্ধু। আমি তাকে এ-বইয়ের ছবি দেখাই, সে আর-একখানি বই
    টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে আমি তা পড়েছি কিনা। এই করতে করতে কতক্ষণ কেটে গেল তা জানিনে। তার কথাবার্তায় বুঝলুম যে, তার পড়াশুনো আমার-চাইতে ঢের বেশি। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, তিন ভাষার সঙ্গেই দেখলুম তার সমান পরিচয় আছে। আমি ফ্রেঞ্চ জানতুম,
    তাই নিজের বিদ্যে দেখাবার জন্যে একখানি ফরাসী কেতাব তুলে
    নিয়ে, ঠিক তার মাঝখানে খুলে পড়তে লাগলুম; সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে, আমার কাঁধের উপর দিয়ে
    মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল, আমি কি পড়ছি। আমার কাঁধে তার চিবুক, আমার গালে তার চুল স্পর্শ
    করছিল; সে স্পর্শে ফুলের কোমলতা, ফুলের গন্ধ ছিল; কিন্তু এই স্পর্শে আমার শরীর-মনে
    আগুন ধরিয়ে দিলে।

    ফরাসি বইখানির যা পড়ছিলুম, তা হচ্ছে একটি কবিতা

    Si vous n’avez
    rien à me dire,
    Pourquoi venir auprès de moi?
    Pourquoi me faire ce sourire
    Qui tournerait la tête au roi?

    এর মোটামুটি অর্থ এই—”যদি আমাকে তোমার বিশেষ কিছু বলবার থাকে ত আমার কাছে
    এলেই বা কেন, আর অমন করে হাসলেই বা কেন, যাতে রাজারাজড়ারও মাথা ঘুরে যায়!”

    আমি কি পড়ছি দেখে সুন্দরী ফিক করে হেসে উঠল। সে হাসির
    ঝাটা আমার মুখে লাগল, আমি চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলুম। আমার পড়া আর এগোলো না। ছোট ছেলেতে
    যেমন কোন অন্যায় কাজ করতে ধরা পড়লে শুধু হেলে-দোলে বাঁকে-চোরে, অপ্রতিভভাবে এদিক ওদিক চায়, আর কোনও কথা বলতে পারে না, আমার অবস্থাও তদ্রুপ হয়েছিল।

    আমি বইখানি বন্ধ করে বৃদ্ধকে ডেকে তার দাম জিজ্ঞেস
    করলুম। সে বল্লে, এক শিলিং। আমি বুকের পকেট থেকে একটি মরক্কোর পকেট-কে বার করে দাম দিতে গিয়ে দেখি যে, তার ভিতর আছে শুধু পাঁচটি গিনি; একটিও শিলিংনেই। আমি এ-পকেট ও-পকেট খুঁজে কোথায়ও একটি শিলিং পেলুম
    না। এই সময়ে আমার নব-পরিচিতা নিজের পকেট থেকে একটি শিলিং বার করে, বৃদ্ধের হাতে দিয়ে
    আমাকে বললে—”তোমার আর
    গিনি ভাঙ্গাতে হবে না, ও-বইখানি আমি নেব।” আমি বল্লুম—”তা হবে না।” তাতে সে হেসে বললে—”আজ থাক, আবার যেদিন দেখা হবে সেইদিন তুমি টাকাটা আমাকে
    ফিরিয়ে দিয়ে।”

    এর পরে আমরা দুজনেই বাইরে চলে এলুম। রাস্তায় এসে
    আমার সঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করলে—”এখন
    তোমার বিশেষকরে কোথায়ও যাবার আছে?” আমি বল্লুম—”না।”

    –”তবে চল, Oxford Circus পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দাও। লণ্ডনের রাস্তায় একা
    চলতে হলে সুন্দরী স্ত্রীলোককে অনেক উপদ্রব সহ্য করতে হয়।”

    এ প্রস্তাব শুনে আমার মনে হল, রমণীটি আমার প্রতি
    আকৃষ্ট হয়েছে। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলুম-”কেন?”

    —”তার কারণ পুরুষমানুষ হচ্ছে বাঁদরের জাত। রাস্তায় যদি কোনও মেয়ে একা
    চলে, আর তার যদি রূপযৌবন থাকে, তাহলে হাজার পুরুষের মধ্যে পাঁচশ’জন তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাবে,
    পঞ্চাশজন তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসবে, পাঁচজন গায়ে পড়ে আলাপ করবার চেষ্টা করবে,
    আর অন্ততঃ একজন এসে বলবে, আমি তোমাকে ভালবাসি।”

    —”এই
    যদি আমাদের স্বভাব হয় ত কি ভরসায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছ?”

    সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে—
    “তোমাকে আমি ভয় করিনে।”

    —”কেন?”

    —”বাঁদর
    ছাড়া আর-এক জাতের পুরুষ আছে,যারা আমাদের রক্ষক।”

    —”সে
    জাতটি কি?”

    —”যদি রাগ না কর ত বলি। কারণ
    কথাটা সত্য হলেও, প্রিয় নয়।”

    -”তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার–কেননা তোমার উপর রাগ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

    —”সে হচ্ছে পোষা কুকুরের জাত। এ জাতের পুরুষরা আমাদের লুটিয়ে পড়ে, মুখের
    দিকে ফ্যালফ্যাল্ করে চেয়ে থাকে, গায়ে হাত দিলে আনন্দে লেজ নাড়ায়, আর অপর-কোনও পুরুষকে
    আমাদের কাছে আসতে দেয় না। বাইরের লোক দেখলেই প্রথমে গোঁ গোঁ করে, তারপর দাঁত বার করে,—তাতেও যদি সে পিঠটান না দেয়,
    তাহলে তাকে কামড়ায়।”

    আমি কি উত্তর করব না ভেবে পেয়ে বল্লুম—”তোমার দেখছি আমার জাতের উপর
    ভক্তি খুব বেশি।”

    সে আমার মুখের উপর তার চোখ রেখে উত্তর করলে—”ভক্তি না থাক, ভালবাসা আছে।” আমার মনে হল তার চোখ তার কথায় সায় দিচ্ছে।

    এতক্ষণ আমরা Oxford Circus-এর দিকে চলেছিলুম, কিন্তু
    বৈশীদূর অগ্রসর হতে পারি নি, কেননা দুজনেই খুব আস্তে হাঁটছিলুম।।

    তার শেষ কথাগুলি শুনে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলুম।
    তারপর যা জিজ্ঞেস করলুম, তার থেকে বুঝতে পারবে যে তখন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কতটা লোপ পেয়েছিল।

    আমি।—”তোমার সঙ্গে আমার আবার কবে দেখা হবে?”

    —”কখনই না।”

    -”এই যে একটু আগে বললে যে আবার যেদিন দেখা হবে…”

    —”সে তুমি শিলিংটে নিতে ইতস্ততঃ করছিলে বলে।”

    এই বলে সে আমার দিকে চাইলে। দেখি তার মুখে সেই হাসি–যে-হাসির
    অর্থ আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।

    আমি তখন নিশীতে-পাওয়া লোকের মত জ্ঞানহারা হয়ে চলছিলুম।
    তার সকল কথা আমার কানে ঢুকলেও, মনে ঢুকছিল না।

    তাই আমি তার হাসির উত্তরে বললুম—”তুমি না চাইতে পার, কিন্তু
    আমি তোমার সঙ্গে আবার দেখা করতে চাই।”

    —”কেন?
    আমার সঙ্গে তোমার কোনও কাজ আছে?”

    —”শুধু
    দেখা-করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই!—আসল কথা এই যে,
    তোমাকে না দেখে আমি আর থাকতে পারব না।”

    —”এ কথা যে-বইয়ে পড়েছ সেটি নাটক
    না নভেল?”

    —”পরের বই থেকে বলছি নে, নিজের মন থেকে। যা বলছি তা সম্পূর্ণ সত্য।”

    —”তোমার বয়সের লোক নিজের মন জানে না; মনের সত্য-মিথ্যা চিনতেও সময় লাগে।
    ছোট ছেলের যেমন মিষ্টি দেখলে খাবার লোভ হয়, বিশ-একুশ বৎসর বয়সের ছেলেদেরও তেমনি মেয়ে
    দেখলেই ভালবাসা হয়। ও-সব হচ্ছে যৌবনের দুষ্ট ক্ষিধে।”

    —”তুমি যা বলছ তা হয় ত সত্য। কিন্তু আমি জানি যে তুমি আমার কাছে আজ বসন্তের হাওয়ার মত এসেছ, আমার মনের মধ্যে আজ ফুল ফুটে উঠেছে।”

    —”ও হচ্ছে যৌবনের season flower, দুদণ্ডেই ঝরে যায়, —ও-ফুলে কোনও ফল
    ধরে না।”

    —”যদি তাই হয় ত, যে ফুল তুমি ফুটিয়েছ তার দিকে মুখ ফেরাচ্ছ কেন? ওর প্রাণ
    দুদণ্ডের কি চিরদিনের, তার পরিচয় শুধু ভবিষ্যৎই দিতে পারে।”

    এই কথা শুনে সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। পাঁচমিনিট চুপ
    করে থেকে বললে—”তুমি
    কি ভাবছ যে তুমি পৃথিবীর পথে আমার পিছু পিছু চিরকাল চলতে পারবে?”

    —”আমার বিশ্বাস পারব।”

    —”আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা না জেনে?”

    –”তোমার আলোই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।”

    —”আমি যদি আলেয়া হই! তাহলে তুমি একদিন অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে শুধু কেঁদে
    বেড়াবে।”

    আমার মনে এ কথার কোনও উত্তর জোগাল না। আমি নীরব হয়ে
    গেলুম দেখে সে বললে—”তোমার
    মুখে এমন-একটি সরলতার চেহারা আছে যে, আমি বুঝতে পাচ্ছি তুমি এই মুহূর্তে তোমার মনের কথাই
    বলছ। সেই জন্যই আমি তোমার জীবন আমার সঙ্গে জড়াতে চাইনে। তাতে শুধু কষ্ট পাবে। যে কষ্ট
    আমি বহু লোককে দিয়েছি, সে কষ্ট আমি তোমাকে দিতে চাইনে;—প্রথমতঃ তুমি বিদেশী, তারপর
    তুমি নিতান্ত অর্বাচীন।”

    এতক্ষণে আমরা Oxford Circus-এ এসে পৌঁছলুম। আমি একটু
    উত্তেজিত ভাবে বললুম—”আমি
    নিজের মন দিয়ে জানছি যে, তোমাকে হারানোর চাইতে আমার পক্ষে আর কিছু বেশী কষ্ট হতে পারে
    না। সুতরাং তুমি যদি আমাকে কষ্ট না দিতে চাও, তাহলে বল আবার কবে আমার সঙ্গে দেখা করবে।”

    সম্ভবতঃ আমার কথার ভিতর এমন একটা কাতরতা ছিল, যা
    তার মনকে স্পর্শ করলে। তার চোখের দিকে চেয়ে বুঝলুম যে, তার মনে আমার প্রতি একটু মায়া
    জন্মেছে। সে বল্লে—”আচ্ছা
    তোমার কার্ড দাও, আমি তোমাকে চিঠি লিখব।”

    আমি অমনি আমার পকেট-কেস্ থেকে একখানি কার্ড বার করে
    তার হাতে দিলুম। তারপর আমি তার কার্ড চাইলে সে উত্তর দিলে–“সঙ্গে নেই।” আমি তার নাম জানবার জন্য
    অনেক পীড়াপীড়ি করলুম, সে কিছুতেই বলতে রাজি হল না। শেষটা অনেক কাকুতি-মিনতি করবার পর
    বললে—”তোমার একখানি কার্ড
    দাও, তার গায়ে লিখে দিচ্ছি; কিন্তু তোমার কথা দিতে হবে সাড়ে-ছটার আগে তুমি তা দেখবে
    না।”

    তখন ছটা বেজে বিশ মিনিট। আমি দশ মিনিট ধৈর্য ধরে
    থাকতে প্রতিশ্রুত হলুম। সে তখন আমার পকেট-কেসটি আমার হাত থেকে নিয়ে, আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে, একখানি কার্ড বার
    করে তার উপর পেন্সিল দিয়ে কি লিখে, আবার
    সেখানি পকেট-কেসের ভিতর রেখে, কেসটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েই, পাশে যে ক্যাবখানি দাঁড়িয়ে
    ছিল তার উপর লাফিয়ে উঠে সোজা মার্বেল আর্চের দিকে হাঁকাতে বললে। দেখতে-না-দেখতে ক্যাবখানি
    অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি Regent Street-এ ঢুকে, প্রথম যে restaurant চোখে পড়ল তার ভিতর
    প্রবেশ করে, এক পাইন্ট শ্যাম্পেন নিয়ে বসে গেলুম। মিনিটে মিনিটে ঘড়ি দেখতে লাগলুম। দশমিনিট
    দশঘণ্টা মনে হল। যেই সাড়ে-ছটা বাজা, অমনি আমি পকেট-কেস্ খুলে যা দেখলুম, তাতে আমার
    ভালবাসা আর শ্যাম্পেনের নেশা একসঙ্গে ছুটে গেল। দেখি কাডখানি রয়েছে, গিনি কটি নেই!
    কার্ডের উপর অতি সুন্দর স্ত্রীহস্তে এই কটি কথা লেখা ছিল—

    “পুরুষমানুষের ভালবাসার চাইতে তাদের টাকা আমার ঢের বেশি আবশ্যক। যদি
    তুমি আমার কখনও খোঁজ না কর, তাহলে যথার্থ বন্ধুত্বের পরিচয় দেবে।”

    আমি অবশ্য তার খোঁজ নিজেও
    করি নি, পুলিশ দিয়েও করাইনি। শুনে আশ্চর্য হবে, সেদিন আমার মনে রাগ হয়নি, দুঃখ হয়েছিল,–তাও
    আবার নিজের জন্য নয়, তার জন্য।

    টীকা