Chapter Index

    পরিণতি – (ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মণেতর বর্ণবিন্যাস ইত্যাদি)
    পরিণতি
    ভিন্‌-প্রদেশী বর্মণ ও সেনাধিপত্য সূচনার সঙ্গে সঙ্গেই (তখন পাল পর্বের শেষ অধ্যায়) বাংলার ইতিহাস-চক্র সম্পূর্ণ আবর্তিত হইয়া গেল। বৈদিক, আর্য ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি বাংলাদেশে গুপ্ত আমল হইতেই সবেগে প্রবাহিত হইতেছিল, সে-প্রমাণ আমরা আগেই পাইয়াছি। তিনশত সাড়েতিনশত বৎসর ধরিয়া এই প্রবাহ চলিয়াছে। বৌদ্ধ খড়গ-পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের কালেও তাহা ব্যাহত হয় নাই; বরং আমরা দেখিয়াছি সামাজিক আদর্শ ও অনুশাসনের ক্ষেত্রে এইসব রাষ্ট্র ও রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য আদর্শ ও অনুশাসনকেই মানিয়া চলিত, কারণ সেই আদর্শ ও অনুশাসনই ছিল বৃহত্তর জনসাধারণের, অন্ততঃ উচ্চতর স্তর সমূহের লোকদের আদর্শ ও অনুশাসন। কিন্তু, বৌদ্ধ বলিয়াই হউক বা অন্য সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণেই হউক, পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শ ও অনুশাসনের একটা ওদার্য ছিল—তাহার দৃষ্টান্ত সত্য সত্যই অফুরন্ত– ব্রাহ্মণ্য সামাজিক আদর্শকেই একটা বৃহত্তর সমন্বিত ও সমীকৃত আদর্শের রূপ দিবার সজাগ চেষ্টা ছিল; অন্যতর সামাজিক যুক্তিপদ্ধতি ও আদর্শকে অস্বীকার করার কোনও চেষ্টা ছিল না, কোনও সংরক্ষণী মনোবৃত্তি সক্রিয় ছিল না। সেন-বর্মণ আমলে কিন্তু তাহাই হইল; সমাজ ব্যবস্থায় কোনও ঔদার্য, অন্যতর আদর্শ ও ব্যবস্থার কোনও স্বীকৃতিই আর রহিল না; ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং তদনুযায়ী সমাজ ও বর্ণ ব্যবস্থা একান্ত হইয়া উঠিল; তাহারই সবর্ণময় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হইল—রাষ্ট্রের ইচ্ছায় ও নির্দেশে।
    ফল যাহা ফলিবার সঙ্গে সঙ্গেই ফলিল। বর্ণবিন্যাসের ক্ষেত্রে তাহার পরিপূর্ণ রূপ দেখিতেছি সমসাময়িক স্মৃতি গ্রন্থাদিতে, বৃহদ্ধর্ম  পুরাণে, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে, সমসাময়িক লিপিমালায় এবং কিছু কিছু পরবর্তী কুলজী গ্রন্থমালায়।
     
    ব্রাহ্মণ 
    ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক বর্ণব্যবস্থার চূড়ায় থাকিবেন স্বয়ং ব্রাহ্মণেরা ইহা ত খুবই স্বাভাবিক। নানা গোত্র, প্রবর ও বিভিন্ন বৈদিক শাখানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণের যে পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই উত্তর ভারত হইতে বাংলাদেশে আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিয়াছিলেন, তাহা তো আমরা আগেই দেখিয়াছি। “মধ্যদেশ-বিনির্গত” ব্রাহ্মণদের সংখ্যা অষ্টম শতক হইতে ক্রমশঃ বাড়িয়াই যাইতে আরম্ভ করিল; ক্রোড়ঞ্চি-ক্রোড়ঞ্জ (= কোলাঞ্চ), তর্কারি (যুক্তপ্রদেশের শ্রাবস্তী অন্তর্গত), মৎস্যাবাস কুন্তীর, চন্দবার (এটোয়া জেলার বতর্মান চান্দোয়ার), হস্তিপদ, মুক্তাবাস্তু এমন কি সুদূর লাট (গুজরাত) দেশ হইতে ব্রাহ্মণ পরিবারদের বাংলাদেশে আসিয়া বসবাসের দৃষ্টান্ত এ যুগের লিপিগুলিতে সমানেই পাওয়া যাইতেছে। ইহার এদেশে আসিয়া পূর্বাগত ব্রাহ্মণদের এবং তাহাদের অগণিত বংশধরদের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া গিয়াছিলেন, এইরূপ অনুমানই স্বাভাবিক।
    ———–
    (১) Ep. Ind. XIII 292 p.; Insc of Bengal, 24, 67, 157, pp: গৌড়লেখমালা, ২৬-২৭, ৯৭ পৃ; Ep. Ind. XXII, 15P P; XV, 293 p, ভারতবর্ষ মাসিক পত্রিকা, ১৩৪৪, ১ম খণ্ড, ২৬৪ পৃ।
     
    গাঞী বিভাগ
    কুলজীগ্রন্থের আদিশূর-কাহিনীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া বর্ণকাহিনী রচনার প্রয়োজন নাই; লিপিমালা ও সমসাময়িক স্মৃতিগ্রন্থাদির সাক্ষ্যই যথেষ্ট। পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই দেখিতেছি ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য ইত্যাদি গ্রামের নামে পরিচয় দিবার একটি রীতি ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেখা যাইতেছে; নিঃসংশয়ে বলিবার উপায় নাই, কিন্তু মনে হয় গাঞী পরিচয় রীতির তখন হইতেই প্রচলন আরম্ভ হইয়াছে, কিন্তু তখনও বিধিবদ্ধ, প্রথাবদ্ধ হয় নাই। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে কিন্তু এই রীতি একেবারে সুনির্দিষ্ট সীমায় প্রথাবদ্ধ নিয়মবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। ভবদেব ভট্টের মাতা বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ কন্যা; “টাকাসর্বস্ব” গ্রন্থের রচয়িতা আর্তিহরপুত্র সর্বানন্দ (১১৫৯-৬০) বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণ(১) ভবদেব স্বয়ং এবং শান্ত্যাগরাধিকৃত ব্রাহ্মণ রামদেবশৰ্ম্মা উভয়েই সাবর্ণগোত্রীয় এবং সিদ্ধল গ্রামীয়;(২) বল্লালগুরু অনিরুদ্ধভট্ট চম্পাহিটী বা চম্পহট্টীয় মহামহোপাধ্যায়,(৩) মদনপালের মনহলি লিপির দানগ্রহীতা বটেশ্বরও চম্পহট্টীয়;(৪) জীমূতবাহন আত্মপরিচয় দিয়াছেন পারিভদ্রীয় বলিয়া।(৫) দশরথদেবের আদাবাড়ী লিপিতে দিণ্ডী, পালি বা পালী, সেউ, মাসচটক বা মাসচড়ক, মূল, সেহন্দায়ী, পুতি, মহান্তিয়াড়া এবং করঞ্জ প্রভৃতি গাঞী পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। হলায়ূধের মাতৃপরিচয় গোচ্ছাষণ্ডী গ্রামীয়রূপে,(৬) লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি শ্ৰীনিবাসের মহিন্তাপনীবংশ পরিচয়ও গাঞী পরিচয়।(৭) বরেন্দ্রীর তটক, মৎস্যাবাস; রাঢ়ার ভূরিশ্রেষ্ঠী, পূর্বগ্রাম, তালবাটী, কাঞ্জিবিল্লী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক গ্রামের (যথা, ভট্টশালী, শকটী, রত্নামালী, তৈলপাটী, হিজ্‌ জলবন, চতুর্থ খণ্ড, বাপডলা) ব্রাহ্মণদের উল্লেখ সমসাময়িক লিপি ও গ্রন্থাদিতে পাওয়া যাইতেছে।(৮) সংকলয়িতা শ্রীধর দাসের “সদুক্তিকর্ণামৃত” (১২০৬) গ্রন্থেও দেখিতেছি বাঙালী ব্রাহ্মণদের নামের সঙ্গে—বর্তমান ক্ষেত্রে নামের পূর্বে—গ্রামের নাম অর্থাং গাঞী পরিচয় ব্যবহারের রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, যথা, ভট্টশালীয় পীতাম্বর, তৈলপাটীয় গাঙ্গোক, কেশরকোলীয় নাথোক, বন্দিঘটীয় সর্বানন্দ, ইত্যাদি।(৯) এইসব গাঞী পরিচয় অল্পবিস্তর পরিবর্তিতরূপে কুলজীগ্রন্থমালার রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পঞ্চগোত্রে বিভক্ত ১৫৬টা গাঞী পরিচয়ের মধ্যেই পাওয়া যায়। কালক্রমে এই গাঞী পরিচয়প্রথা বিস্তৃত হইয়াছে, বিধিবদ্ধ হইযাছে এবং সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত হইয়াছে; এই সীমিত, বিধিবদ্ধ প্রথারই অস্পষ্ট পরিচয় আমরা পাইতেছি কুলজীগ্রন্থমায়।
    ———————
    (১) Insc. of Bengal, III, p. 37; Ëiŵ।RR®, Ed, Trivandrum, Sans. Ser. 4. Vols; also see JRAS., 1927, p. 472.
    (২) Insc. of Bengal, III, p. 36 and 24 respectively.
    (৩) JASB., 1912, 343 p.
    (৪) গৌড়লেখমালা, ১৫৪ পৃ।
    (৫) কালবিবেক গ্রন্থের পুম্পিকা; কালবিবেক, Bib, Ind. Intro. vii p.
    (৬) ব্রাহ্মণসর্বস্ব; Ind. Culture, I, 505 p.
    (৭) অদ্ভূতসাগর, Ind. Ant., 1922, 47 p.
    (৮) সদুক্তিকর্ণামৃত, Ed. by Ramavatara Sarma & Haradatta Sarma, Intro 44, 47, 58, 71, 81
    (৯) Ed. Ind. XV. 3o1 p, ন্যায়কন্দলী, Jour Andhra Hist. Sec 1V, 158-62; Ind. Off Cat. I, Part one, No. 450; D.U. Mss, no.
     
    ভৌগোলিক বিভাগ
    কিন্তু গাঞী বিভাগ অপেক্ষা ও সামাজিক দিক হইতে গভীর অর্থবহ বিভাগ ব্রাহ্মণদের ভৌগোলিক বিভাগ। এক্ষেত্রেও কুলজী গ্রন্থের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করিয়া লাভ নাই; কারণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক ও অন্যান্য শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব সম্বন্ধে এইসব গ্রন্থে যে বিবরণ পাওয়া যাইতেছে তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু হলায়ূধের “ব্রাহ্মণসর্বস্ব” প্রামাণ্যগ্রন্থ, এবং তাহার রচনাকালও সুনির্দিষ্ট। এই গ্রন্থে হলায়ূধ দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন যে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের যথার্থ বেদবিদ ছিলেন না; ব্রাহ্মণদের বেদচর্চার সমধিক প্রসিদ্ধি ছিল, তাঁহার মতে, উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশ সমূহে।(১) যাহাই হউক, হলায়ুধের সাক্ষ্য হইতে দেখিতেছি, দ্বাদশ শতকেই জনপদ বিভাগানুযায়ী ব্রাহ্মণদের রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে; এবং লিপিসাক্ষ্য হইতে জানা যায়, এই সব ব্রাহ্মণের রাঢ় ও বরেন্দ্রীর বাহিরে পূর্ব বঙ্গেও বসতি স্থাপন করিতেছেন। বরেন্দ্রীর তটক গ্রামীয় একজন ব্রাহ্মণ বিক্রমপুরে গিয়া বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন, অন্ততঃ একটি দৃষ্টান্ত আমরা জানি কুলজী গ্রন্থমালায় দেখা যায় কায়স্থ, বৈদ্য, বারুই প্রভৃতি অব্রাহ্মণ উপবর্ণদের ভিতরও রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র এবং বঙ্গজ প্রভৃতি ভৌগোলিক বিভাগ প্রচলিত হইয়াছিল, কিন্তু এসম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ কিছু নাই।
    ——————-
    (১) ব্রাহ্মণসরস্ব, বারাণসী সং, সংবৎ ১৯৩৫। তেজেশচন্দ্র বিদ্যানন সম্পাদিভ কলিকা • সং, বাং ১৩৩১ ৷
     
    বৈদিক ব্রাহ্মণ
    রাঢ়ীয় এবং বারেন্দ্র বিভাগ ছাড়া ব্রাহ্মণদের আর একটি শ্রেণী— বৈদিক—বোধ হয় এই যুগেই উদ্ভূত হইয়াছিল। কুলজী গ্রন্থমালায় এসম্বন্ধে দুইটি কাহিনী আছে; একটি কাহিনী মতে, বাংলাদেশে যথার্থ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ না থাকায় এবং যজ্ঞাগ্নি যথানিয়মে বক্ষিত না হওয়ায় রাজা শ্যামলবর্মণ (বোধ হয় বর্মণরাজ সামল বর্মণ) কান্যকুব্জ (কোনও কোনও গ্রন্থমতে, বারাণসী) হইতে ১০ ০১ শকাব্দে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন। অপর কাহিনী মতে সরস্বতী নদীতীরস্থ বৈদিক ব্রাহ্মণেরা যবনাক্রমণের ভয়ে ভীত হইয়া বাংলাদেশে পলাইয়া আসেন, এবং বর্মণরাজ হরিবর্মণের পোষকতায় ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায় বসবাস আরম্ভ করেন। উত্তর ভারত হইতে আগত এইসব বৈদিক ব্রাহ্মণেরাই পাশ্চাত্য বৈদিক নামে খ্যাত। বৈদিক ব্রাহ্মণদের আর এক শাখা আসেন উৎকল ও দ্রাবিড হইতে; ইঁহারা দাক্ষিণাত্য বৈদিক নামে খ্যাত। এই কুলজী কাহিনীর মূল বোধ হয় হলাপের ব্রাহ্মণসৰ্ব্বস্ব গ্রন্থে পাওয়া যাইতেছে। এই গ্রন্থ-রচনার কারণ বর্ণনা করিতে গিয়া হলায়ূধ বলিতেছেন, রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠ করিত না এবং সেই হেতু বৈদিক যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের রীতিপদ্ধতিও জানিত না; যথার্থ বেদজ্ঞান তাঁহার সময়ে উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশেই প্রচলিত ছিল। বাংলার ব্রাহ্মণেরা নিজেদের বেদজ্ঞ বলিয়া দাবি করিলেও যথার্থত বেদচর্চার প্রচলন বোধ হয় সত্যই তাঁহাদের মধ্যে ছিল না। হলায়ূধের আগে বল্লালগুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট ও তাহার “পিতৃদয়িতা” গ্রন্থে বাংলাদেশে বেদ চর্চার অবহেলা দেখিয়া দুঃখ করিয়াছেন।(২) যাহা হউক, পাশ্চাত্য বলিতে হলায়ূধ এক্ষেত্রে উত্তর ভারতকেই বুঝাইতেছেন, সন্দেহ নাই। বাংলাদেশে উৎকল ও পাশ্চাত্যদেশাগত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের বসবাস তখন করিতেছিলেন কি না এ সম্বন্ধে হলায়ূধ কোনও কথা বলেন নাই; তবু, সামলবর্মণ ও হরিবর্মণের সঙ্গে কুলজী কাহিনীর সম্বন্ধ, তাহাদের মোটামুটি তারিখ, অনিরুদ্ধ ভট্ট এবং হলায়ূধ কথিত রাঢ়ে-বরেন্দ্রীতে বেদচর্চার অভাব এবং সঙ্গে সঙ্গে উৎকল ও পশ্চিম দেশসমূহে বেদজ্ঞানের প্রসার, পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য এই দুই শাখায় বৈদিক ব্রাহ্মণের শ্রেণীবিভাগ, এইসব দেখিয়া মনে হয় সেন-বর্মণ আমলেই বাংলায় বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব দেখা দিয়াছিল।
    এই সব শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ ছাড়াও আরও দুই তিন শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের সংবাদ এই যুগেই পাওয়া যাইতেছে। গয়াজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে প্রাপ্ত একটি লিপিতে (১০৫৯ শক = ১১৩৭) দেখিতেছি, শাকদ্বীপগত মগব্রাহ্মণপরিবার সম্ভূত জনৈক ব্রাহ্মণ গঙ্গাধর জয়পাণি নাম গৌড়রাষ্ট্রের একজন কর্মচারীর কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন।(৩) এই লিপি এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণ গ্রন্থের সাক্ষ্য হইতে দেবল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পরিচয় জানা যায়। শেষোক্ত গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হইতেছে, দেবল ব্রাহ্মণেরা শাকদ্বীপ হইতে আসিয়াছিলেন, এবং সেই হেতু তাঁহারা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। বল্লালসেনের “দানসাগর” গ্রন্থে সারস্বত নামে আর এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণের খবর পাওয়া যাইতেছে। কুলজী গ্রন্থের মতে ইঁহারা আসিয়াছিলেন সরস্বতীনদীর তীর হইতে অন্ধ্ররাজ শূদ্রকের আহবানে। শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের উদ্ভব সম্বন্ধে কুলজী গ্রন্থে কিন্তু অন্য কাহিনী দেখা যাইতেছে; এই কাহিনী মতে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের পূর্ব পুরুষরা গ্রহবিপ্র নামে পরিচিত ছিলেন, এবং ইহারা বাংলাদেশে প্রথম আসিয়াছিলেন গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে, শশাঙ্কেরই আহবানে —তাহার রোগমুক্তি উদ্দেশে গ্রহযজ্ঞ করিবার জন্য। বৃহদ্ধর্মপুরাণে দেখিতেছি দেবল অর্থাৎ শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ পিতা এবং বৈশ্যমাতার সন্তানরা গ্রহবিপ্র বা গণক নামে পরিচিত হইতেছেন। যাহাই হউক ব্রহ্মবৈবর্ত পুবাণ গ্রন্থে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে গণক বা গ্রহবিপ্রর (এবং সম্ভবতঃ, দেবল-শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণরাও) ব্রাহ্মণ সমাজে সম্মানিত ছিলেন না; গণক-গ্রহবিপ্ররা তো ‘পতিত’ বলিয়াই গণ্য হইতেন, এবং সেই পাতিত্যের কারণ বৈদিক ধর্মে তাঁহাদের অবজ্ঞা, জ্যোতিষ ও নক্ষত্রবিদ্যায় অতিরিক্ত আসক্তি এবং জ্যোতির্গণনা করিয়া দক্ষিণা গ্রহণ। এই গণক বা গ্রহবিপ্রদেরই একটি শাখা অগ্ৰদানী ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত ছিলেন, ইঁহারাও ‘পতিত’ বলিয়া গণ্য হইতেন, কারণ তাঁহারাই সর্ব প্রথম শূদ্রদের নিকট হইতে এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দান গ্রহণ করিয়াছিলেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেই ভট্ট ব্রাহ্মণ নামে আর এক নিম্ন বা পতিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণের খবর পাওয়া যাইতেছে; সূত পিতা এবং বৈশ্য মাতার সন্তানরাই ভট্ট ব্রাহ্মণ, এবং অন্যলোকের যশোগান করাই ইঁহাদের উপজীবিকা, এ-সংবাদও এই গ্রন্থে পাওয়া যাইতেছে। ইহারা নিঃসন্দেহে বর্তমান কালের ভাট ব্রাহ্মণ। এখানেও পতিত ব্রাহ্মণদের তালিকা শেষ হইতেছে না। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে দেখিতেছি শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের উত্তম সঙ্কর পর্যায়ের ২০ বিশটি উপবর্ণ ছাড়া (ইঁহারা সকলেই শূদ্র) আর কাহাদেরও পূজানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করিতে পারিতেন না; মধ্যম ও অধর্ম সঙ্কর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের কাহারও পৌরোহিত্য করিলে তিনি ‘পতিত’ হইয়া যজমানের বর্ণ বা উপবর্ণ প্রাপ্ত হইতেন। মধ্যযুগের ও বর্তমান কালের ‘বর্ণ ব্রাহ্মণ’দের উৎপত্তি এইভাবেই হইয়াছে। স্মার্ত ভবদেব ভট্ট বলিতেছেন, এই সব ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য যথার্থ ব্রাহ্মণদের খাওয়া নিষেধ, খাইলে যে অপরাধ হয় তাহার প্রায়াশ্চিত্ত স্বরূপ কৃচ্ছ্রসাধনের বিধানও তিনি দিয়াছেন। এই বিধিনিষেধ ক্রমশঃ কঠোরতর হইয়া মধ্যযুগেই দেখা গেল, পতিত বৰ্ণব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে বৈবাহিক আদান প্রদান দূরে থাক্‌ তাঁহাদের স্পৃষ্ট জলও যথার্থ ব্রাহ্মণের পান করিতেন না। তাহা ছাড়া কতকগুলি বৃত্তি ছিল ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ; ভবদেব ভট্ট তাহার এক সুদীর্ঘ তালিকা দিয়াছেন। ব্রাহ্মণদের তো প্রধান বৃত্তিই ছিল ধর্ম কর্মানুষ্ঠান এবং অন্যের ধর্মানুষ্ঠানে পৌরোহিত্য, শাস্ত্রাধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা। অধিকাংশ ব্রাহ্মণই তাহা করিতেন, সন্দেহ নাই। তাঁহাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক রাজা ও রাষ্ট্র, ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের কৃপা লাভ করিয়া দান ও দক্ষিণাস্বরূপ প্রচুর অর্থ ও ভূমির অধিকারী হইতেন, এমন প্রমাণেরও অভাব নাই। আবার অনেক ব্রাহ্মণ ছোটবড় রাজকর্মও করিতেন; ব্রাহ্মণ রাজবংশের খবরও পাওয়া যায়। পাল আমলে দর্ভপাণি কেদারমিশ্রের বংশ, বৈদ্যদেবের বংশ, বর্মণরাষ্ট্রে ভবদেবভট্টের বংশ, সেনরাষ্ট্রে হলায়ূধের বংশ একদিকে যেমন উচ্চতম রাজপদ অধিকার করিতেন, তেমনই আর একদিকে শাস্ত্রজ্ঞানে, বৈদিক যাগযজ্ঞ আচারানুষ্ঠানে, পাণ্ডিত্যে ও বিদ্যাবত্তায় সমাজেও তাঁহাদের স্থান ছিল খুব সম্মানিত। ব্রাহ্মণেরা যুদ্ধে নায়কত্ব করিতেন, যোদ্ধৃ ব্যবসায়ে লিপ্ত হইতেন এমন প্রমাণও পাওয়া যাইতেছে। কিন্তু পূর্বোক্ত ভবদেবের তালিকায় দেখিতেছি, অনেক নিষিদ্ধবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণদের পক্ষে শূদ্রবর্ণের অধ্যাপনার, তাহদের পূজাতুষ্টানে পৌরোহিত্য, চিকিৎসা ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা, চিত্র ও অন্যান্য বিভিন্ন শিল্পবিদ্যার চর্চা প্রভৃতি বৃত্তিও নিষিদ্ধ ছিল; করিলে পতিত হইতে হইত। অথচ কৃষিবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল না; যুদ্ধবৃত্তিতে আপত্তি ছিল না; মন্ত্রী, সন্ধিবিগ্রহিক, ধর্মাধ্যক্ষ বা সেনাধ্যক্ষ হইলে কেহ পতিত হইত না! অথচ বর্ণবিশেষের অধ্যাপনা বা পৌরোহিত্য নিষিদ্ধ ছিল।
    —————–
    (১) Ep. Ind, xviI, 356 P.
    (২) পিতৃদয়িত, ৮ পৃ।
    (৩) Ep. Ind. II, 330 p.
     
    ব্রহ্মণেতর বর্ণবিন্যাস
    বৃহদ্বর্মপুরাণে দেখা যাইতেছে, ব্রাহ্মণ ছাড়া বাঙলাদেশে আর যত বর্ণ আছে, সমস্তই সংকর, চতুর্বর্ণের যথেচ্ছ পারস্পরিক যৌনমিলনে উৎপর্ন মিশ্রবর্ণ, এবং তাঁহারা সকলেই শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণদ্বয়ের উল্লেখই এই গ্রন্থে নাই। ব্রাহ্মণেরা এই সমস্ত শূদ্র সংকর উপবর্ণগুলিকে তিনশ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া প্রত্যেকটি উপবর্ণের স্থান ও বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। এই বর্ণ ও বৃত্তিসমূহের বিবরণ দিতে দিয়া বৃহদ্বর্মপুরাণ বেণ রাজা সম্বন্ধে যে-গল্পের অবতারণা করিয়াছেন কিংবা উত্তম, মধ্যম ও সংকর এই তিন পর্যায়-বিভাগের যে-ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহার উল্লেখ বা আলোচনা অবান্তর। কারণ, স্মৃতিগ্রন্থের বর্ণ-উপবর্ণ ব্যাখ্যার সঙ্গে বাস্তব ইতিহাসের যোগ আবিষ্কার কথা বড় কঠিন। যাহা হউক, এই গ্রন্থ তিন পর্যায়ে ৩৬ টি উপবর্ণ বা জাতের কথা বলিতেছে, যদিও তালিকাভুক্ত করিতেছে ৪১টি জাত। বাঙলাদেশের জাত সংখ্যা বলতে আজও আমরা বলি ছত্রিশ জাত। ৩৬টিই বোধ হয় ছিল আদি সংখ্যা, পরে আরও ৫টি উপবর্ণ এই তালিকায় ঢুকিয়া পড়িয়া থাকিবে।
     
    উত্তম-সংকর
    উত্তম-সংকর পর্যায়ের ২০টি উপবর্ণ:
    ১. করণ – ইঁহারা লেখক ও পুস্তককর্মদক্ষ এবং সৎশুদ্র বলিয়া পরিগণিত।
    ২. অম্বষ্ঠ – ইঁহাদের বৃত্তি চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদচর্চা, সেইজন্যে ইঁহারা বৈদ্য বলিয়া পরিচিত। ঔষধ প্রস্তুত করিতে হয় বলিয়া ইঁহাদের বৃত্তি বৈশ্যের, কিন্তু ধর্মকর্মানুষ্ঠানের ব্যাপারে ইহারা শুদ্র বলিয়াই গণিত।
    ৩. উগ্র –  ইঁহাদের বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, যুদ্ধবিদ্যাই ধর্ম।
    ৪. মাগধ – হিংসামূলক যুদ্ধব্যবসায়ে অনিচ্ছুক হওয়ায় ইহাদের বৃত্তি নির্দিষ্ট হইয়াছিল সূত বা চারণের এবং সংবাদবাহীর।
    ৫. তন্ত্রবায়  (তাঁতী)।
    ৬. গান্ধিক বনিক (গন্ধদ্রব্য বিক্রয় যে-বণিকের বৃত্তি; বর্তমানে গন্ধবনিক)।
    ৭. নাপিত।
    ৮. গোপ (লেখক)।
    ৯. কর্মকার (কামার)।
    ১০. তৈলিক বা তৌলিক – (গুবাক-ব্যবসায়ী)।
    ১১. কুম্ভকার (কুমোর)।
    ১২. কাংসকার (কাঁসারী)।
    ১৩. শাঙ্খিক বা শঙ্খকার (শাঁখারী)।
    ১৪. দাস – কৃষিকার্য ইঁহাদের বৃত্তি, অর্থাৎ চাষী।
    ১৫. বারজীবী (বারুই) – পানের বরজ ও পান উৎপাদন করা উঁহাদের বৃত্তি।
    ১৬. মোদক (ময়রা)।
    ১৭. মালাকার।
    ১৮. সূত – (বৃত্তি উল্লিখিত নাই, কিন্তু অনুমান হয় এরা চারণ-গায়ক)।
    ১৯. রাজপুত্র – (বৃত্তি অনুল্লিখিত; রাজপুত?)
    ২০. তাম্বলী (তামলী) – পানবিক্রেতা।
     
    মধ্যম-সংকর
    মধ্যম-সংকর পর্যায়ে ১২টি উপবর্ণ :
    ২১. তক্ষণ – খোদাইকর।
    ২২. রজক – (ধোপা)।
    ২৩. স্বর্ণকার – (সোনার অলংকার ইত্যাদি প্রস্তুতকারক)।
    ২৪. সুবর্ণবনিক – সোনা ব্যবসায়ী।
    ২৫. আভীর (আহীর) – (গোয়ালা, গোরক্ষক)।
    ২৬. তৈলকার – (তেলী)।
    ২৭. ধীবর – (মৎস্যব্যবসায়ী)।
    ২৮. শৌণ্ডিক – (শুঁড়ি)।
    ২৯. নট – যাহারা নাচ, খেলা ও বাজি দেখায়।
    ৩০. শাবাক, শাবক, শারক, শাবার (?) – (ইঁহারা কি বৌদ্ধ শ্রাবকদের বংশধর?)।
    ৩১. শেখর (?)
    ৩২. জালিক (জেলে, জালিয়া)।
     
    অধম-সংকর বা অন্ত্যজ
    অধম সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ে ৯টি উপবর্ণ; ইঁহারা সকলেই বর্ণাশ্রম-বহির্ভূত। অর্থাৎ, ইঁহারা অস্পৃশ্য এবং ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম-ব্যবস্থার মধ্যে ইঁহাদের কাহারও কোনও স্থান নাই।
    ৩৩. মলেগ্রহী (বঙ্গবাসী, সং: মলেগৃহি)।
    ৩৪. কুড়ব (?)।
    ৩৫. চণ্ডাল (চাঁড়াল)।
    ৩৬. বরুড় (বাউড়ী?)
    ৩৭. তক্ষ (তক্ষণকার?)।
    ৩৮. চর্মকার (চামার)।
    ৩৯. ঘট্টজীবী (পাঠান্তর ঘণ্টজীবী– খেয়াঘাটের রক্ষক, খেয়াপারাপারের মাঝি? বর্তমান, পাটনী?)।
    ৪০. ডোলাবাহী – ডুলি-বেহারা, বর্তমানে দুলিয়া বা দুলে (?)।
    ৪১. মল্ল (বর্তমানে মালো ?)।
     
    ম্লেচ্ছ
    এই ৪১টি জাত ছাড়া ম্লেচ্ছ পর্যায়ে আরও কয়েকটি দেশি ও ভিন্‌প্রদেশি আদিবাসি কোমের নাম পাওয়া যায়; স্থানীয় বর্ণ-ব্যবস্থার ইঁহাদেরও কোনও স্থান ছিল না, যথা, পুক্‌কশ, পুলিন্দ, খস, থর, কম্বোজ, যবন, সুহ্ম, শবর ইত্যাদি।
    ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও অনুরূপ বর্ণ-বিন্যাসের খবর পাওয়া যাইতেছে। ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ (উচ্চ ও নিম্ন) এই দুই পর্যায়ে শূদ্রবর্ণের বিভাগের আভাস বৃহদ্বর্মপুরাণেই পাওয়া গিয়াছে; করণদের বলা হইয়াছে ‘সৎশূদ্র’। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে সমস্ত সংকর বা মিশ্র উপবর্ণগুলিকে সৎ ও অসৎ শূদ্র এই দুই পর্যায়ে ভাগ করা হইয়াছে। সৎশূদ্র পর্যায়ে যাঁহাদের গণ্য করা হইয়াছে তাঁহাদের নিম্নলিখিতভাবে তালিকাগত করা যাইতে পারে। এই ক্ষেত্রেও সর্বত্র পৃথক সূচীনির্দেশ দেওয়া হইতেছে না। এই অধ্যায়ে আহৃত অধিকাংশ সংবাদ এই গ্রন্থের প্রথম অর্থাৎ ব্রহ্মখণ্ডের দশম পরিচ্ছেদে পাওয়া যাইবে; ১৬-২১ এবং ৯০-১৩৯ শ্লোক বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। ২/৪টি তথ্য অন্যত্র বিক্ষিপ্তও যে নাই তাহা নয়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের মিশ্রবর্ণেরও সম্পূর্ণ তালিকা এক্ষেত্রে উদ্ধার করা হয় নাই, করিয়া লাভো নাই; কারণ, এই পুরাণেই বলিতেছে, মিশ্রবর্ণ অসংখ্য, কে তাহার সমস্ত নাম উল্লেখ ও গণনা করিতে পারে (১।১০।১২২)? সৎশূদ্রদের তালিকাও যে সম্পূর্ণ নয়, তাহার আভাসও এই গ্রন্থেই আছে (১।১০।১৮)।
    লক্ষণীয় যে, এই পুরাণ বৈদ্য ও অম্বষ্ঠদের পৃথক উপবর্ণ বলিয়া উল্লেখ করিতেছে, এবং উভয় উপবর্ণের যে উৎপত্তি-কাহিনী দিতেছে, তাহাও পৃথক।
     
    সৎশুদ্র
    ১. করণ
    ২. অম্বষ্ঠ (দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান)
    ৩. বৈদ্য (জনৈক ব্রাহ্মণীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারের ঔরসে জাত সন্তান; বৃত্তি চিকিৎসা)
    ৪. গোপ
    ৫. নাপিত
    ৬. ভিল্ল (ইঁহারা আদিবাসী কোম; কি করিয়া সৎশদ্র পর্যায়ে পরিগণিত হইলেন, বলা কঠিন)
    ৭. মোদক
    ৮. কুবর  (?)
    ৯. তাম্বুলী (তাম্‌লী)
    ১০. স্বর্ণকার ও অন্যান্য বনিক (ইঁহারা পরে ব্রাহ্মণের অভিশাপে, ‘পতিত’ হইয়া ‘অসৎশূদ্র’ পর্যায়ে নামিয়া গিয়াছিলেন; স্বর্ণকারদের অপরাধ ছিল সোনাচুরি)
    ১১. মালাকার
    ১২. কর্মকার
    ১৩. শঙ্খকার
    ১৪. কুবিন্দক (তন্তুবায়)
    ১৫. কুম্ভকার
    ১৬. কাংসকার
    ১৭. সূত্রধার
    ১৮. চিত্রকার (পটুয়া)
    ১৯. স্বর্ণকার
    সূত্রধর ও চিত্রকর কর্তব্যপালনে অবহেলা করায় অপরাধে ব্রাহ্মণের অভিশাপে ‘পতিত’ হইয়া অসৎশুদ্র পর্যায়ে গণ্য হইয়াছিলেন। স্বর্ণকারও ‘পতিত’ হইয়াছিলেন, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে।
     
    অসৎশদ্র
    পতিত বা অসৎশূদ্র পর্যায়ে যাঁহাদের গণনা করা হইত তাঁহাদের তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়:
    স্বর্ণকার। [সুবর্ণ] বনিক। সূত্রধার (বৃহদ্বর্মপুরাণের তক্ষণ)। চিত্রকার।
    ২০. অট্টালিকাকার
    ২১. কোটক (ঘরবাড়ি তৈরীর মিস্ত্রী)
    ২২. তীবর
    ২৩. তৈলকার
    ২৪. লেট
    ২৫. মল্ল
    ২৬. চর্মকার
    ২৭. শুঁড়ি
    ২৮. পৌণ্ড্রক (পোদ?)
    ২৯. মাংসচ্ছেদ (কসাই)
    ৩০. রাজপুত্র (পরবর্তী কালের রাউত?)
    ৩১. কৈবর্ত (কলিযুগের ধীবর)
    ৩২. রজক
    ৩৩. কৌয়ালী
    ৩৪. গঙ্গাপুত্র (লেট-তীবরের বর্ণ-সংকর সন্তান)
    ৩৫. যুঙ্গি (যুগী?)
    ৩৬. আগরী (বৃহদ্বর্ম্পুরাণের উগ্র ? বর্তমানে আগুরী)
    অসৎশদ্রেরও নিম্ন পর্যায়ে, অর্থাৎ অন্তজ-অস্পৃশ্য পর্যায়ে যাঁহাদের গণনা করা হয় তাঁহাদের তালিকাগত করিলে এইরূপ দাঁড়ায়:
    ব্যাধ, ভড় (?), কাপালী, কোল (আদিবাসী কোম), কোঞ্চ (কোচ, আদিবাসী কোম), হড্‌ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগতীত (বাগদী), শরাক, ব্যালগ্রাহী (ব্রহ্মদ্বর্ম্পুরাণের মলেগ্রাহী?), চণ্ডাল ইত্যাদি।
    এই দুইটি বর্ণবিভাগের তালিকা তুলনা করিলে দেখা যায় প্রথমোল্লিখিত গ্রন্থের সংকর পর্যায় এবং দ্বিতীয় গ্রন্থের সৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু মগধ, গন্ধবণিক, তৌলিক বা তৈলিক, দাস, বারজীবি, এবং সূত দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে; পরিবর্তে পাইতেছি ভিল্ল ও কুবর এই দুইটি উপবর্ণের উল্লেখ, এবং বৈদ্যদের উল্লেখ। তাহা ছাড়া, প্রথম গ্রন্থের উত্তম সংকর বর্ণের রাজপুত্র দ্বিতীয় গ্রন্থের অসৎশূদ্র পর্যায় এক এবং অভিন্ন; শুধু ব্রহ্মদ্বর্মপুরাণের আভীর, নট, শাবাক (শ্রাবক?), শেখর ও জানিল দ্বিতীয় গ্রন্থের তালিকা হইতে বাদ পড়িয়াছে; পরিবর্তে পাইতেছি অট্টালিকাকার, কোটক, লেট মল্ল, চর্মকার, পৌণ্ড্রক, মাংশচ্ছেদ, কৈবর্ত, গঙ্গাপুত্র, যুঙ্গি, আগরী এবং কৌয়ালী। ইঁহাদের মধ্যে মল্ল ও চর্মকার বৃহদ্বর্মপুরাণের অধর সংকর বা অন্ত্যজ পর্যায়ের। বৃহদ্বর্মপুরাণে ধীবর ও জালিক, মৎস্য-ব্যবসাগত এই দুইটি উপবর্ণের খবর পাইতেছি; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পাইতেছি কেবল কৈবর্তদের। কৈবর্তদের উদ্ভব সম্বন্ধে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে: কৈবর্ত ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান; কিন্তু কলিযুগে তীবরদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ইঁহারা ধীবর নামে পরিচিত হন এবং ধীবর বৃত্তি গ্রহণ করেন। ভবদেব ভট্টের মতে কৈবর্তরা অন্ত্যজ পর্যায়ের। ভবদেবের অন্ত্যজ পর্যায়ের তালিকা উপরোক্ত দুই পুরাণের তালিকার সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে: রজক, চর্মকার,নট, বরুড়, কৈবর্ত, মেদ এবং ভিল্ল। ভবদেবের মতে চণ্ডাল ও অন্ত্যজ সমার্থক। চণ্ডাল, পুক্‌কশ, কাপালিক, নট, নর্তক, তক্ষণ (বৃহদ্বর্মপুরাণোক্ত মধ্যম সংকর পর্যায়ের তক্ষ?), চর্মকার, সুবর্ণকার, শৌণ্ডিক, রজক এবং কৈবর্ত প্রভৃতি নিম্নতম উপবর্ণের এবং পতিত ব্রাহ্মণদের স্পৃষ্ট খাদ্য ব্রাহ্মণদের অভক্ষ্য বলিয়া ভবদেব ভট্ট বিধান দিয়াছেন, এবং খাইলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, তাহাও বলিয়াছেন।
    দেখা যাইতেছে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে উল্লিখিত তিনটি সাক্ষ্যে অল্পবিস্তর বিভিন্নতা থাকিলেও বর্ণ-উপবর্ণের স্তর-উপস্তর বিভাগ সম্বন্ধে ইঁহাদের তিনজনেরই সাক্ষ্য মোটামুটি একই প্রকার। এই চিত্রই সেন-বর্মণদের আমলের বাঙলাদেশের বর্ণ-বিন্যাসের মোটামুটি চিত্র।
     
    করণ-কায়স্থ
    প্রথমেই দেখিতেছি করণ ও অম্বষ্ঠদের স্থান। করণরা কিন্তু কায়স্থ বলিয়া অভিহিত হইতেছেন না; এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বৈদ্যদের স্পষ্টতই অম্বষ্ঠ হইতে পৃথক বলিয়া গণ্য করা হইয়াছে। করণদের সম্বন্ধে পাল-পর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে, এবং করণ ও কায়স্থরা যে বর্ণহিসাবে এক এবং অভিন্ন তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে। এই অভিন্নতা পাল পর্বেই স্বীকৃত হইয়া গিয়াছিল; বৃহদর্মপুরাণে বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কেন যে সে ইঙ্গিত নাই তাহা বলা কঠিন। হইতে পারে, ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের তখনও তাহা সম্পূর্ণ স্বীকৃত হইয়া উঠে নাই।
     
    অম্বষ্ঠ বৈদ্য
    বৃহদ্বর্মপুরাণে বর্ণহিসাবে বৈদ্যদেরও উল্লেখ নাই, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আছে; কিন্তু সেখানেও বৈদ্য ও অম্বষ্ঠ দুই পৃথক উপবর্ণ এবং উভয়ের উদ্ভব-ব্যাখ্যাও বিভিন্ন। এই গ্রন্থের মতে দ্বিজ পিতা ও বৈশ্য মাতার সঙ্গমে অম্বষ্ঠদের উদ্ভব; কিন্তু বৈদ্যদের উদ্ভব সূর্যতনয় অশ্বিনীকুমার এবং জনৈকা ব্রাহ্মণীর আকস্মিক সঙ্গমে। বৈদ্য ও অম্বষ্ঠরা যে এক এবং অভিন্ন এই দাবি সপ্তদশ শতকে ভরতমল্লিকের আগে কেহ কহিতেছেন না; ইনিই সর্বপ্রথম নিজে বৈদ্য এবং অম্বষ্ঠ বলিয়া আত্মপরিচয় দিতেছেন। তবে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের উল্লেখ হইতে বুঝা যায়, দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈদ্যরা উপবর্ণ হিসাবে বিদ্যমান, এবং বৃহদ্বর্মপুরাণ ও সদ্যোক্ত পুরাণটির সাক্ষ্য একত্র করিলে ইহাও বুঝা যায় যে, অম্বষ্ঠ ও বৈদ্য উভয়েই সাধারণত একই বৃত্তি অনুসারী ছিলেন। বোধ হয়, এক এবং অভিন্ন এই চিকিৎসাবৃত্তিই পরবর্তীকালে এই দুই উপবর্ণকে এক এবং অভিন্ন উপবর্ণে বিবর্তিত করিয়াছিল, যেমন করিয়াছিল করণ ও কায়স্থদের।
     
    কৈবর্ত-মাহিষ্য
    পাল-পর্বে কৈবর্ত-মাহিষ্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি, তখন পর্যন্ত কৈবর্তদের সঙ্গে মাহিষ্যদের যোগাযোগের কোনও সাক্ষ্য উপস্থিত নাই এবং মাহিষ্য বলিয়া কৈবর্তদের পরিচয়ের কোনও দাবিও নাই স্বীকৃতিও নাই। সেন-বর্মণ-দেব পর্বেও তেমন দাবী কেহ উপস্থিত করিতেছেন না; এই যুগের কোনও পুরাণ বা স্মৃতিগ্রন্থেও তেমন উল্লেখ নাই। বস্তুত, মাহিষ্য নামে কোন উপবর্ণের নামই নাই। কৈবর্তদের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়া ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের সংকলয়িতা বলিতেছেন, ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যমাতার সঙ্গমে কৈবর্তদের উদ্ভব। লক্ষণীয় এই যে, গৌতম ও যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহাদের প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে মাহিষ্যদের উদ্ভব সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যাই দিতেছেন; ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের লেখক কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখ্যা কোথায় পাইলেন, বলা কঠিন; কোনও প্রাচীনতম গ্রন্থ কৈবর্ত সম্বন্ধে এই ব্যাখায় নাই, সমসাময়িক বৃহদ্বর্মপুরাণ বা কোনও স্মৃতিগ্রন্থেও নাই। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যা যদি বা পাইতেছি মাহিষ্য-ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কিন্তু কলিযুগে ইঁহাদের বৃত্তি নির্দেশ দেখিতেছি ধীবরের, মাহিষ্যের নয়। সুতরাং মনে হয়, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্যাখ্যার মধ্যেই কোনও গোলমাল রহিয়া গিয়াছে। দ্বাদশ শতকে ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অন্ত্যজ পর্যায়ে। বৃহদ্বর্মপুরাণ ধীবর ও মৎস্যব্যবসায়ী অন্য একটি জাতের অর্থাৎ জালিকদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন মধ্যম সংকর পর্যায়ে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ধীবর ও কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অসৎশূদ্র পর্যায়ে; এবং ইঁহাদের প্রত্যেকেরই ইঙ্গিত এই যে, ইঁহারা মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী নন। তবে, স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সংকলয়িতা ইঁহাদের উদ্ভব-ব্যাখ্যা দিতেছেন, এই জাতীয় ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়াই পরবর্তীকালে কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের এক ও অভিন্ন বলিয়া দাবী সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত হয়। যাহাই হউক, বর্তমানকালে পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাস এবং হুগলী-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের চাষী কৈবর্তরা নিজেদের মাহিষ্য বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। আবার পূর্ববঙ্গে (ত্রিপুরা, শ্রীহট্ট, মৈমনসিংহ, ঢাকা অঞ্চলে) মৎস্যজীবী ধীবর ও জালিকরা কৈবর্ত বলিয়া পরিচিত। বুঝা যাইতেছে, কালক্রমে কৈবর্তদের মধ্যে দুইটি বিভাগ রচিত হয়, একটি প্রাচীন কালের ন্যায় মৎস্যজীবীই থাকিয়া যায় (যেমন পূর্ববঙ্গে আজও), আর একটি কৃষি (হালিক) বৃত্তি গ্রহণ করিয়া মাহিষ্যদের সঙ্গে এক এবং অভিন্ন বলিয়া পরিগণিত হয়। বল্লালচরিতে যে বলা হইয়াছে, রাজা বল্লালসেন কৈবর্ত (এবং মালাকার, কুম্ভবকার ও কর্মকার)-দিগকে সমাজে উন্নীত করিয়াছিলেন, তাহার সঙ্গে কৈবর্তদের এক শ্রেণীর বৃত্তি পরিবর্তনের (চাষি-হালিক হওয়ার) এবং মাহিষ্যদের সঙ্গে অভিন্নতা দাবীর যোগ থাকা অসম্ভব নয়।

    টীকা