টুপুর ও এক শয়তান
শৈলেন ঘোষ দ্বারাটুপুর ও এক শয়তান
[চরিত্রলিপি : টুপুর, একটি সাত-আট বছরের মেয়ে কাঞ্চন: টুপুরের দাদা, অলি, চম্পা, পারুল, মিতা, রাজা, নাবিক, রাজার সিপাই, রাজার দূত, ভিনদেশির বেশে শয়তান, গ্রামের লোকজন, আকাশের তারাবেশী মেয়েরা, টুপুরের সিপাই-পুতুল।]
প্রথম দৃশ্য
[দেখা যাচ্ছে, নদীর স্রোতে একটি ময়ূরপঙ্খি নাও ভেসে যাচ্ছে। মাঝি-মাল্লার গলায় গান শোনা যাচ্ছে। দৃশ্যটিকে পেছনের পর্দায় নদীর জলের ওপর একটি ময়ূরপঙ্খির কাট-আউট দেখিয়ে করা যেতে পারে। অথবা যাদের পক্ষে সম্ভব তারা মঞ্চে ময়ূরপঙ্খির সেট তৈরি করে দেখাতে পারে।]
হেঁইও রে ভাই, হেঁইও!
নদী নাচে ঢেউ ভেঙে জলে তোলপাড়,
সেই ঢেউয়ে দুলে-দুলে নাও ভাসে কার!
হেঁইও রে ভাই, হেঁইও!
দেখো, দেখো রাজা যান ওই নায়ে বসে,
তাই মোরা গান ধরি দাঁড় টানি কষে।
হেঁইও রে ভাই, হেঁইও!
ভ্রমণে চলেন রাজা দূর কত দূর,
জলে তাই বাজে যেন নদীর নূপুর।
[এই গানটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ অন্ধকার হবে।]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[আলো জ্বলার পর দেখা যাবে, মঞ্চের ওপর এদিক-ওদিক কয়েকটি গাছ। গাছের আড়ালে একটি মাটির ঘর। সামনে দাওয়া। দূরে একটি ছোট্ট মেয়ের গলায় গানের সুর অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রাজা ও সঙ্গে ময়ূরপঙ্খির নাবিক মঞ্চে ঢুকবে। রাজা চারদিক দেখবে।]
রাজা : নাবিক, ময়ূরপঙ্খি নায়ে
আমি এলাম এ কোন গাঁয়ে?
নাবিক : রাজামশাই, এই গাঁয়ের নাম কাজলগ্রাম।
রাজা : কাজলগ্রাম? বা:! নামটি তো বেশ! (হঠাৎ সেই ছোটো মেয়ের গলার অস্পষ্ট গানের সুর কানে এল) কে গান গায় নাবিক?
[গান দূর থেকে কাছে ভেসে আসছে।]
রাজা : একটি মেয়ে গান গাইতে-গাইতে এদিকেই আসছে মনে হয়। এসো নাবিক, আমরা আড়াল থেকে দেখি।
নাবিক : মহারাজ, আপনি ওই গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ুন। আমি বরঞ্চ পালাই ওইদিকে।
রাজা : সেই ভালো।
[রাজা দ্রুত একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। নাবিক অন্যপথে ছুট দিল। তারপরেই দেখা গেল গাছের ছায়ায় দুলে-দুলে, গান গাইতে-গাইতে একটি ছোট্ট মেয়ে সেখানে এল। তার হাতে একটি খেলনা-পাখি। সে পাখিকে আদর করছে গান গাইতে গাইতে। মেয়েটির নাম টুপুর। বয়েস সাত-আট বছর। পরনে ডুরে শাড়ি। লালপাড়। হাতে বালা। পায়ে মল। গাছের আডালে মাটির ঘরটি তাদের।]
[টুপুরের গান]
মৌটুসকি পাখি রে তুই টুটুর-টুটুর ডাক না,
সোনার আকাশ মিঠে রোদের আলোয় ভরে যাক না।
তোর রঙিন-রঙিন ডানায়,
কার খুশির খবর জানায়;
হাওয়ায় হাওয়ায় ঝুমকোলতার রং-ছবিটি আঁক না।
[টুপুর গান গাইছে আনমনে। এমন সময় চুপিচুপি রাজা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। সেদিকে টুপুরের নজরই পড়ল না। কিন্তু গাইতে গাইতে রাজাকে হঠাৎ দেখে টুপুর থতোমতো খেয়ে গেল। থমকে গেল তার গান। সে ছুটে পালাল। রাজা তার পেছনে ছুটল। টুপুর মঞ্চে ঢুকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। রাজাও মঞ্চে ঢুকে তাকে খুঁজতে লাগল। দেখতে পেল না। রাজা খুঁজতে খুঁজতে বেরিয়ে গেল। টুপুর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। ভাবতে লাগল, কে লোকটি! কিন্তু লোকটিকে আর দেখতে না-পেয়ে, আবার গান গেয়ে উঠল টুপুর। আর একেবারে সঙ্গে সঙ্গে রাজা সেখানে ঢুকে পড়েছে। টুপুরও গান থামিয়ে পালিয়ে পালিয়ে রাজার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগল, আর থেকে থেকে দুষ্টুমি করে গানের একটা-একটা কলি গেয়ে উঠল। শেষে একবার যখন রাজা সত্যি সত্যি তাকে প্রায় ধরে ফেলে, তখন টুপুর প্রাণপণে ছুটে পালাল সেখান থেকে। রাজা তাকে ধরতে গিয়েও ধরতে না-পেরে হতভম্বের মতো মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক তক্ষুনি রাজার একজন সিপাই ঢুকল।]
সিপাই : (অবাক-স্বরে) এখানে কী খুঁজছেন রাজামশাই একা, কার পেয়েছেন দেখা?
রাজা : জানো সিপাই, ছোট্ট একটি মেয়ে,
নাচছিল গান গেয়ে।
আহা, এমন মিঠে গান,
আর কখনো শুনিনি তো,
শুনিনি এমন মধুর তান!
সিপাই : কোথায়? কোথায় সেই মেয়ে?
রাজা : ওই দিকে, ওই গাছ পেরিয়ে
ছুট দিল ঠিক ফুলটি,
দুলল কানের দুলটি!
সিপাই : মহারাজ, খোঁজ আনব?
রাজা : না, থাক। চলো, ফিরে যাই। (আপন মনে বিস্ময়ে) আমি কত দেশ ঘুরেছি, কত গান শুনেছি, কিন্তু এমন মিষ্টি গান তো কখনো শুনিনি! ওইটুকু মেয়ে, কে দিয়েছে ওর গলায় এমন মিষ্টি সুর! চলো সিপাই, রাজবাড়িতে ফিরে যাই। রাজবাড়িতে সোনার আসনে বসিয়ে আমি মেয়ের গান শুনব।
[রাজা ও সিপাই বেরিয়ে গেল। ঠিক তক্ষুনি আবার টুপুর সেখানে ঢুকল। অবাক হয়ে দেখতে লাগল। এমনই সময়ে টুপুরের বন্ধুরা সেখানে চুপিচুপি ঢুকল। একজন বন্ধু আলতো পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে টুপুরের চোখ টিপে ধরল।]
টুপুর : কে রে? কে?
[টুপুরের বন্ধুরা মুচকি-মুচকি হাসছে। চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।]
টুপুর : বুঝতে পেরেছি, চম্পা!
বন্ধুরা : হয়নি! হয়নি! (হাততালি দিয়ে নেচে উঠল। যে-বন্ধুটি চোখ টিপে ধরেছিল, সে ছেড়ে দিয়ে নেচে নেচে হেসে উঠল।)
টুপুর : (তাকে দেখে) ও, পারুল।
বন্ধুরা : কী হয়েছে টুপুর তোমার? এখানে কী দেখছ?
টুপুর : চম্পা, অলি, পারুল আমার মিতা,
বলতে আমার দিচ্ছে কাঁটা গায়ে,
দেখেছি একটু আগে কী তা!
অলি : কী দেখেছ?
টুপুর : দেখেছি, রেশমি পোশাক গায়ে,
চিনি না কে এসেছে গাঁয়ে।
চম্পা : কে এসেছে?
টুপুর : কী জানি।
তার গলায় দোলে, হিরা মোতির মালা,
যেন চাঁদের আলো ঢালা।
পারুল : কোথায় তাঁকে দেখতে পেলে?
টুপুর : এইখানে। গান গাচ্ছি আনমনে।
এমন সময় দেখি,
লুকিয়ে লুকিয়ে এ কী,
কে শুনছে আমার গান!
বন্ধুরা : তারপর? তারপর?
টুপুর : যেই দেখেছি, ছুট দিয়েছি।
মিতা : ওমা! ছুট দিতে হয়!
টুপুর : তবে?
চম্পা : গান শোনাতে হয়।
পারুল : শোনালে, হয়তো তিনি দিতেন মোতির মালা,
চাঁদের আলো ঢালা।
টুপুর : কী হবে তা নিয়ে! আমরা গরিব,
আমায় কি আর মানায় ওসব দিয়ে!
[বাইরে গান শোনা গেল। একটি ছেলের গলায় গান। ছেলেটির নাম কাঞ্চন। টুপুরের দাদা। বয়েস দশ-এগারো। সে পরেছে কাপড়। মালকোঁচা হাঁটুর নীচে অবধি। গায়ে জামা। তার গান শুনে সবাই থমকে গেল। টুপুরের মিষ্টি মুখখানি খুশিতে উছলে উঠল। কাঞ্চন গাইছে] :
ময়ূরপঙ্খি নায়ে, কে এল রে গাঁয়ে
গলায় মোতির মালা, হাজার মানিক জ্বালা।
[গাইতে-গাইতে কাঞ্চন ঢুকল। টুপুর ছুটে গেল দাদার কাছে।]
টুপুর : (দাদাকে আনন্দে জড়িয়ে) দাদা।
[টুপুরের বন্ধুরাও ছুটে গেল।]
বন্ধুরা : কাঞ্চনদাদা!
কাঞ্চন : ওমা, ওমা! সবাই যে আজ
চম্পা, পারুল, অলি,
সবাই আহা আলো করে
হাসছ কেন বলি?
টুপুর : হাসবেই তো। দাদাকে দেখে সবাই হাসে। তা তোমার এত দেরি হল যে?
কাঞ্চন : আমি যে নদীর ঘাটে গেছলুম। নদীর ঘাটে ময়ূরপঙ্খি নায়ে রাজা এসেছেন যে!
[টুপুর আর তার বন্ধুরা রাজার নাম শুনে অবাক হয়ে এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।]
সক্কলে : রাজা!
টুপুর : তা হলে কি রাজা আমার গান শুনেছেন?
কাঞ্চন : (চমকে উঠে) রাজা গান শুনেছেন! সে কী! কখন?
চম্পা : এই তো, একটু আগে। এইখানে।
অলি : গান শুনেছেন, নাচ দেখেছেন। আর করছেন খেলা, লুকোচুরি খেলা!
কাঞ্চন : (ভ্যাবাচাকা খেয়ে) রাজার সঙ্গে লুকোচুরি খেলা! দাঁড়াও, দাঁড়াও,! আমার যেন কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
পারুল : কাঞ্চনদাদা, আমরাও রাজাকে দেখব। চলো না।
[ঠিক এই সময়ে বাইরে কাদের যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল। কারা যেন আসছে।
সবাই সেই দিকে চমকে তাকাল। রাজার দূত ঢুকল। সঙ্গে দু’জন সেপাই।]
দূত : (গম্ভীর স্বরে) এ-বাড়ি কাদের?
কাঞ্চন : আমাদের।
দূত : কী তোমার নাম?
কাঞ্চন : কাঞ্চন।
দূত : এ-বাড়িতে গান গায় কে?
কাঞ্চন : এই তো, আমার বোন।
দূত : (টুপুরের কাছে গিয়ে) তোমার নাম কী?
টুপুর : টুপুর।
দূত : (একটি চিঠি বার করে টুপুরের দিকে হাত বাড়িয়ে) তোমাকে রাজামশাই একটি চিঠি দিয়েছেন।
সক্কলে : (অবাক হয়ে) চিঠি!
[টুপুর চিঠিটি হাতে নিয়ে দাদার দিকে এগিয়ে দিল। ছুটে এল পারুল, অলি, চম্পা আর মিতা। একপাশে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল টুপুর। ভয়ে তার চোখ দুটি কাঁপছে। বন্ধুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল কাঞ্চনের ওপর চিঠিতে কী লেখা আছে জানার জন্য। কাঞ্চন চিঠিটা চেঁচিয়ে পড়ল—‘ছোট্ট মেয়েটি, তোমার আমি নাম জানি না। তুমি কী সুন্দর গান গাও। তখন তুমি গাইছিলে, আমি শুনছিলাম। পালিয়ে গেলে কেন? একদিন তুমি আমার রাজাপ্রসাদে এসো না। আমি তোমার গান শুনব। নিমন্ত্রণ রইল। সাতদিন পরে পক্ষিরাজ পাঠিয়ে দেব। আসবে তো? এইসঙ্গে একটি মানিকের হার পাঠালাম। তোমার অমন মিষ্টি গানের জন্য আমার ছোট্ট উপহার। গলায় পোরো, কেমন?’
চিঠি-পড়া শেষ হতেই খুশিতে উছলে গেল সকলের মন। দূত কাঞ্চনের হাতে মানিকমালাটি তুলে দিল। কাঞ্চন সেই মালাটি টুপুরের গলায় পরিয়ে দিল। বন্ধুরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখল। তারপর খুশিতে হেসে উঠল।]
দূত : তা হলে, আমরা এখন যেতে পারি?
কাঞ্চন : আবার আসবেন।
দূত : ঠিক আছে, ঠিক আছে।
[বেরিয়ে গেল রাজার দূত। সঙ্গে সঙ্গে খুশির সুরে ভরে উঠল চারদিক। সবাই টুপুরকে আদর করে গান গাইল আর নাচল।]
[গান]
টুপুর যাবে গান করতে
অচিন রাজার দেশে,
পক্ষিরাজের ডানায় চড়ে
হাওয়ায় ভেসে-ভেসে।
একী! একী! একী!
এ যে আকাশ থেকে চাঁদ নেমেছে দেখি!
টুপুর যাবে গান করতে
তেপান্তরের শেষে,
অচিন দেশের রাজকন্যা
নাচবে হেসে হেসে।
একী! একী! একী!
এ যে তারার আলোয় আকাশ হাসে দেখি!
[গান শুনে নাচ দেখে গ্রামের অনেক লোক জমা হল সেখানে। তাদের গান শুনে নাচ দেখে ভারি খুশি সক্কলে। কেউ তাদের গানের সঙ্গে, কেউ নাচের সঙ্গে তাল দিল। কেউ-বা গেয়ে উঠল। হঠাৎ দেখা গেল একজন অচেনা লোককে। একটা চোখ তার কানা। একটা পা খোঁড়া। সবাই একে একে গান শুনতে-শুনতে আর নাচ দেখতে-দেখতে চলে গেলেও সে গেল না। সে এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। গান শেষ হলেও সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। টুপুরের বন্ধু অলি তাকে দেখতে পেল। ছুটে গেল তার কাছে।]
আলি : তুমি কে গো দাঁড়িয়ে কেন
নাচতে জানো না?
টুপুর যাবে রাজবাড়িতে,
গান করতে,
তাও কি জানো না?
লোক : আমি আর জানব কেমন করে,
আমি যে ভিনদেশি এক লোক!
আমি তো হাঁটতে পারি নাকো,
আমার যে একটা কানা চোখ!
চম্পা : টুপুরের গলায় দেখো
রাজার মানিক হার,
টুপুরের জন্য এ যে
রাজার উপহার।
ভিনদেশি : মানিক-গাঁথা হার!
দাম যে ভারি তার!
অলি : কত দাম হবে?
কাঞ্চন : কী হবে দাম জেনে?
ভিনদেশি : সে তো বটেই, সে তো বটেই,
কী হবে দাম জেনে?
আর কেই-বা মানিক চেনে! (তারপর টুপুরের কাছে এগিয়ে এল)
দেখি টুপুররানির মুখখানি দেখি! (টুপুরের চিবুকে হাত রেখে)
আহা লাগছে ভারি মিষ্টি, ঝরছে যেন মানিক-আলোর বৃষ্টি!
(টুপুরের পোশাকের ওপর ক্ষণেক চোখ বুলিয়ে) কিন্তু এ কী!
কাঞ্চন : (বিস্ময়ে) কী?
ভিনদেশি : শুধু মানিকের হার পরেই কি টুপুর রাজবাড়ি যাবে!
এ কী ছিরি পোশাকের!
কাঞ্চন : না, না, এমন পোশাক পরে আমার বোন রাজবাড়িতে যায় কখনো!
আমি কাল মেলায় যাব
আনব কিনে শাড়ি, শাড়িতে আনব দেখে
ঝুমকোলতার সারি।
[ছড়াটি সুর করে গাইতে গাইতে কাঞ্চন বেরিয়ে গেল। সবাই কাঞ্চনকে দেখতে দেখতে হাসিতে খুশিতে উছলে উঠল। ভিনদেশি লোকটা এদিকে কেমন যেন আড়চোখে টুপুরের গলার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ টুপুরের চোখে চোখ পড়ে যেতেই থতোমতো খেয়ে বলে উঠল]
ভিনদেশি : টুপুর, তোমার দাদা কী করে?
টুপুর : আমার দাদা পুতুল বিক্রি করে। আমাদের এক পুতুলদাদু আছে। পুতুলদাদু পুতুল তৈরি করে দেয়। আমার দাদা হাটে-গঞ্জে বেচে আসে।
পারুল : ভিনদেশিভাই, রাজারা বুঝি অনেক বড়োলোক?
ভিনদেশি : বড়োলোক বলে বড়োলোক!
মিতা : রাজার বাড়ি কোথায়, তুমি জানো?
ভিনদেশি : তা আর জানব না? রাজবাড়ি, সে অনেকদূর।
অলি : তুমি কোনোদিন গেছ?
ভিনদেশি : (হেসে) হা-হা-হা! কোনোদিন কী বলছ! কতদিন গেছি।
টুপুর : (অবাক হয়ে) রাজবাড়ির ভেতরে গেছ?
ভিনদেশি : হ্যাঁ গো টুপুররানি, আমি যে মিঠাই বিক্রি করি। আমি রাজবাড়িতে মিঠাই বিক্রি করতে যাই।
চম্পা : (খুবই আশ্চর্য হয়ে) তুমি রাজবাড়িতে মিঠাই বিক্রি করতে যাও?
ভিনদেশি : তবে আর বলছি কী।
টুপুর : কার জন্য? রাজার জন্য?
ভিনদেশি : রাজার জন্যে, রানির জন্যে,
আর যে রাজার কন্যে
মিঠাই সবার জন্যে।
টুপুর : (আরও অবাক) ভিনদেশিভাই, রাজকন্যাও মিঠাই খায়?
ভিনদেশি : আরে, বাবা, রাজকন্যা কেড়ে-কেড়ে খায়!
টুপুর : কেমন-কেমন দেখতে রাজকন্যাকে?
ভিনদেশি : যেমন-যেমন ফুল, যেমন-যেমন হাসি,
তেমন-তেমন রাজকন্যা দেখতে ভালোবাসি।
টুপুর : রাজকন্যার কেমনতর সাজ?
ভিনদেশি : ময়ূরকন্ঠি শাড়ি, তাতে সোনার জরি পাড়,
গলায় দোলে পান্নাচুনির রক্তমণিহার।
টুপুর : (মুখখানি শুকিয়ে গেল) ভিনদেশিভাই, আমার তো অমন শাড়ি নাই।
ভিনদেশি : অমন শাড়ি চাই তোমার? ঠিক আছে, আমি এনে দেব।
টুপুর : না, না, তুমি কেন আমায় শাড়ি দেবে! দাদা কিনে এনে দেবে মেলা থেকে। তার চেয়ে বরং রাজকন্যা যে মিঠাই খায়, একদিন সেই মিঠাই খাওয়াবে বলো?
ভিনদেশি : (খুশি হয়ে) মিঠাই খাবে? সে আর এমন কী কথা! কিন্তু তার বদলে আমায় কী দেবে?
টুপুর : পয়সা দেব।
ভিনদেশি : না, না, পয়সা আমার চাই না।
টুপুর : তবে?
ভিনদেশি : আমায় তোমার গান শোনাতে হবে।
টুপুর : গান শোনালেই হবে তো?
ভিনদেশি : হ্যাঁ গো টুপুররানি, গান শোনালেই হবে।
টুপুর : ঠিক আছে। গানই শোনাব।
ভিনদেশি : তা হলে কাল মিঠাই আনব। কালই গান হবে।
[টুপুর ও তার বন্ধুরা সবাই খুশিতে উছলে উঠে ছড়া বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।]
ছড়া
বেশ তাই, বেশ তাই,
মজা, মজা, মজা,
কাল হবে গান আজ
ঘরে চলি সোজা।
[সবাই বেরিয়ে গেলে শুধু দাঁড়িয়ে রইল সেই ভিনদেশি। তার চোখে লোভের আগুন। সে এখন একা। চারদিক নির্জন। হঠাৎ সে হেসে উঠল। সে এক ভয়ংকর হাসি। এক শয়তানের হাসি। এতক্ষণে বোঝা গেল সে এক লোভী শয়তান। এতক্ষণ মিথ্যে মিথ্যে সে টুপুর আর তার বন্ধুদের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছে। তার খোঁড়া পা, কানা চোখ আর তার পোশাক দেখে তারা বুঝতেই পারল না, লোকটা শঠ। তার হাসির সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেল!]
তৃতীয় দৃশ্য
[সকাল। আগের সেই দৃশ্যই। গাছের আড়ালে কাঞ্চন আর টুপুরের ঘর। কাঞ্চন মেলায় যাবে পুতুল বিক্রি করতে। একটা চুপড়িতে সে পুতুল সাজাচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।]
কাঞ্চন : আহা মজা, কী যে মজা
খুশি-খুশি মন,
রাজাকে গান শোনাবে, নাচ দেখাবে
ছোট্ট আমার বোন।
[এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে টুপুর বেরিয়ে এল। হাসিমুখে দাদাকে দেখল, তারপর কাছে এগিয়ে এল।]
টুপুর : দাদা!
কাঞ্চন : (পুতুল সাজাতে-সাজাতে) অ্যাঁ?
টুপুর : পুতুল বিক্রি কাজটা ভালো না।
কাঞ্চন : (অবাক হয়ে টুপুরকে দেখে) কেন?
টুপুর : সারাদিন পথে-পথে পুতুল বেচা, কত কষ্ট তোমার!
কাঞ্চন : আজ পথে-পথে নয় টুপুর, আজ আমি মেলায় যাব।
টুপুর : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আজ তো মেলা। আমি ভুলেই গেছি।
কাঞ্চন : মেলায় বিক্রি করব বলে আজ কত পুতুল এনেছি।
টুপুর : (হাতে পুতুল নিয়ে) ওমা! ওমা! এ যে হাতি,
এ যে বাঘ বাবা!
তুলে আছে থাবা!
কাঞ্চন : হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি আজ সব পুতুল বিক্রি করব।
টুপুর : (আবদার করে) দাদা, আমিও যাব।
কাঞ্চন : না, রোদ লাগবে।
টুপুর : তাতে কী হয়েছে! আমি তো আর ননির পুতুল নই যে, গলে যাব!
কাঞ্চন : আর তো ক-টা দিন। ক-দিন পরে রাজবাড়ি যাবে। একটু সাবধানে থাকতে হবে না?
টুপুর : দাদা!
কাঞ্চন : কী রে?
টুপুর : আমার গান শুনে সবাই ভালো বলে কেন?
কাঞ্চন : (আদর করল) টুপুর!
টুপুর : বলো না? (হঠাৎ দাদার চোখের দিকে নজর গেল) একী! তোমার চোখে জল কেন?
কাঞ্চন : (ধরা-ধরা গলায়) টুপুর তুমি তো মাকে দেখোনি। মাকেও না, বাবাকেও না। মা খুব ভালো গান গাইত। তুমিও গাও মায়ের মতো।
[হঠাৎ টুপুরের চোখের দিকে কাঞ্চনের নজর গেল]
কাঞ্চন : এ কী! ছি:! টুপুর কাঁদে না!
টুপুর : তুমি কাঁদছ কেন?
কাঞ্চন : (নিজের কান্না সামলে নিয়ে) কই আমি কাঁদছি! (হঠাৎ হেসে উঠে) এই তো আমি হাসছি হা—হা—হা! আমি হাসছি। (টুপুরকে কাছে টেনে) তুমিও হাসো! হাসো! (টুপুরও হাসল) এই তো, টুপুর আমার লক্ষ্মী বোনটি। (তারপর দুজনেই একসঙ্গে হাসল) তা হলে এবার আমি যাই?
টুপুর : তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু!
কাঞ্চন : যাব আর আসব। (কাঞ্চন পুতুলের চুপড়িটা মাথায় নিল। টুপুরের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। তারপর হাঁক দিল।)
কাঞ্চন : পুতুল, পুতুল চাই
পুতুল, পুতুল চাই, হাতি, ঘোড়া, উট,
থুপথুপি টগবগ খুট খুট খুট।
টুকটুকে বেনেবউ খিলখিল হাসি,
ঝুমঝুমি ঝুমঝুম পিউ-পিউ বাঁশি।
পুতুল, পুতুল চাই—
[ছড়ার সুর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। টুপুর ডাক দিল, ‘দাদা—আ—আ’। কাঞ্চনও দূর থেকে সাড়া দিল, ‘টুপুর—র—র’। কাঞ্চন চলে গেল। টুপুর চেয়ে রইল দাদার পথের দিকে। তারপর ফিরে দাঁড়াল। নিজের গলায় হাত দিয়ে রাজার দেওয়া মানিকমালাটি দেখতে লাগল। অবাক হয়ে। তারপর মালা থেকে চোখ তুলে সামনে চাইল। ভাবছে কিছু। তারপর গান গাইল।]
মৌটুসকি পাখি রে তুই টুটুর-টুটুর ডাক না,
সোনার আকাশ মিঠে রোদের আলোয় ভরে যাক না!
দাদা যে যাচ্ছে আমার মেলা—
সেখানে কাটবে সারাবেলা—
[গান তার গাওয়া হল না। কাকে দেখে সে যেন থমকে থামল। থামল, সে ভিনদেশিকে দেখে। ভিনদেশি ঢুকল। ছুটে গেল টুপুর তার দিকে। তার হাত ধরল খুশিতে।]
টুপুর : ভিনদেশিভাই!
ভিনদেশি : মিঠাই এনেছি!
টুপুর : সত্যি তুমি মিঠাই এনেছ?
ভিনদেশি : আনব না! তোমার যে গান শুনব।
টুপুর : আমি তা হলে আমার বন্ধুদের ডেকে আনি?
ভিনদেশি : (বাধা দিয়ে) না, বন্ধুদের এখন না। (মিঠাই বার করল) আগে তুমি খাও, তারপর বন্ধুরা। এই নাও!
টুপুর : বাবা! এ যে অনেক!
ভিনদেশি : (একটি মিঠাই হাতে নিয়ে টুপুরকে মুখের কাছে ধরে) খাও! (মিঠাইটি টুপুরের মুখে তুলে দিল)
টুপুর : বা:, কী ভালো খেতে! রাজকন্যে এই মিঠাই খায়?
ভিনদেশি : (আর-একটি মিঠাই বার করল) আর-একটা খাও!
টুপুর : (এই মিঠাইটিও খেল) এটা আবার অন্যরকম। এও রাজকন্যে খায়?
ভিনদেশি : (মুখে কপট হাসি) না গো টুপুর-কন্যে, এটা কেবল তোমার জন্যে। (তারপর হেসে উঠল)
টুপুর : (অবাক) হাসছ কেন?
ভিনদেশি : এবার আমায় গান শোনাও! (টুপুর লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল)
ভিনদেশি : উঁ-হুঁ! এখন লজ্জা পেলে চলবে কেন! কথা ছিল মিঠাই পেলে গান শোনাবে!
টুপুর : না, না, লজ্জা পাচ্ছি না। এক্ষুনি শোনাচ্ছি। (বলতে বলতে টুপুর এগিয়ে গেল একটি গাছের নীচে। গান ধরল)
মৌটুসকি পাখি—
[গাইতে গাইতে কেশে উঠল টুপুর। তার গলায় যেন লাগল। আবার চেষ্টা করল। গলা দিয়ে সুর বেরোল না।]
ভিনদেশি : (ব্যস্ত হয়ে, দুশ্চিন্তার ভান করে) কী হল টুপুর, কী হল?
টুপুর : (আবার গাইবার চেষ্টা করল। পারল না। কাশল) হঠাৎ এমন কেন হল ভিনদেশিভাই, আমার গলায় লাগছে কেন?
ভিনদেশি : (যেন খুবই অবাক হয়েছে সে) গান গাইতে গলায় লাগছে! সে কী কথা! আর-একবার চেষ্টা করে দেখো তো!
[টুপুর আবার চেষ্টা করল, পারল না। চোখে জল ছলছল করে উঠল।]
টুপুর : তোমার মিঠাই খেয়ে এ আমার কী হল!
তোমার মিঠাইয়ে কী ছিল তাই বলো!
ভিনদেশি : (থতোমতো খেয়ে) না, না, মিঠাই খেয়ে হবে কেন? মিঠাইয়ে অন্য কিছু থাকবে কেন? আমার মনে হয়, ব্যাপার কিছু ভয়ংকর!
টুপুর: (ভয়ে) ভয়ংকর! কীসের ভয়ংকর?
ভিনদেশি: সেইটাই তো ভাবছি! (ভাববার ছলনা করে হঠাৎ বলে উঠল) দোষ লাগেনি তো!
টুপুর: (চমকে) কীসের দোষ?
[ভিনদেশি টুপুরের গলায় ওই রাজার দেওয়া মানিকমালার ওপর নজর রাখল স্থিরচোখে।]
টুপুর : কী দেখছ?
ভিনদেশি : (টুপুরের কাছে এগিয়ে এসে) দেখি, দেখি, তোমার গলার ওই মানিকমালাটা দেখি! (টুপুরের গলায়-পরা মালাটা ভণিতা করে নেড়েচেড়ে দেখল) ঠিক বলেছি, দোষ তো এইখানে!
টুপুর : কী হয়েছে? (ভয়জড়ানো স্বরে)
ভিনদেশি : (ভয় দেখিয়ে) এ যে রক্তমানিক! শক্ত বড়ো গলায় পরে সহ্য করা! ঠিক বটে ঠিক। এই মানিকমালার দোষেই তোমার গলার গান হারাল!
টুপুর : (আরও ভয় পেয়ে) এই মালার দোষে?
ভিনদেশি : (গলায় ভয়ংকর গাম্ভীর্য এনে) হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই মালার দোষে!
টুপুর : রাজা তো নিজেই আমায় দিলেন মানিকমালা,
মানিকমালার সঙ্গে রাজার আদর আছে ঢালা।
ভিনদেশি : (কপট রাগ দেখিয়ে) অলক্ষুণে, অলক্ষুণে, অলক্ষুণে মালা, আদর আছে ঢালা, না, ছাই-ভস্ম আছে ঢালা!
টুপুর : রাজার মালা অলক্ষুণে?
ভিনদেশি : হ্যাঁ, হ্যাঁ।
এ-মালা মানিক দিয়ে গাঁথা
এ কি আর ফেলনা জিনিস যা-তা!
এ-মানিক সবার ধাতে সয় না,
এ-মানিক সবার কাছে রয় না!
টুপুর : (ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে) ভিনদেশিভাই, তা হলে কী হবে?
ভিনদেশি : (টুপুরের মুখখানা একবার চট করে আড়চোখে দেখে নিল) যা হয়েছে, এ আর এমন কী হয়েছে! বিপদ যে আরও বেশি হবে না, সে কে বলতে পারে! মালা এক্ষুনি খুলে ফেলো! ঘরে থাকলেও ক্ষতি! তোমার গান গেছে। তোমার দাদারও যদি কিছু হয়!
টুপুর : (ব্যস্ত হয়ে) না, না, দাদার কিছু হতে দেব না। কিছুতেই না। (বলতে বলতে মালাটা গলা থেকে খুলে ফেলল) কিন্তু মালা আমি রাখব কোথায়?
ভিনদেশি : যার মালা তাকে ফেরত দিয়ে দাও! (বলে কপট চোখে দেখল)
টুপুর : এ তো রাজার মালা! রাজাকে কেমন করে ফেরত দেব। রাজা থাকেন অনেক দূরে। কে তাঁকে দিতে যাবে?
ভিনদেশি : (তার শঠতা মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে) বলো তো আমি ফেরত দিয়ে আসতে পারি। আমাকে তো মিঠাই বিক্রি করতে রাজার বাড়ি যেতেই হয়।
টুপুর : (কাঁদতে কাঁদতে) তুমি যাবে? তাই এক্ষুনি যাও, নিয়ে যাও অলক্ষুণে মালা,
না, না, না, চাই না আমি, চাই না।
রাজার মিথ্যে আদর ঢালা।
রাজাকে বলবে গিয়ে,
টুপুর আর আসবে না তো,
টুপুর আর গাইবে না তো,
তোমার এই মালা পরে
সে যে গান গাইতে গেছে ভুলে!
[টুপুর মালাটা ভিনদেশির হাতে তুলে দিল। লোকটা চোখের পলকে টুপুরের হাত থেকে মালাটা ছিনিয়ে নিল। তারপর লাফিয়ে উঠে নিজমূর্তি ধরল। সে চিৎকার করে হেসে উঠল। তার বীভৎস মূর্তির ছায়া ঘরের দেওয়ালে নেচে উঠল। ভয় পেল টুপুর। ককিয়ে উঠল, ‘দাদা—আ—আ!’ মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেল।]
চতুর্থ দৃশ্য
[সন্ধে হয়ে আসছে। আগের সেই একই দৃশ্য। চারদিক নি:ঝুম, নিথর। বাইরে দূর থেকে টুপুরের নাম ধরে ডাকছে কাঞ্চন। ডাকতে ডাকতে, ছুটতে ছুটতে ঢুকল কাঞ্চন। তার মুখখানি হাসিখুশি। তার মাথায় আর নেই সেই পুতুল-ভরতি চুপড়ি। আছে, তার হাতে টুপুরের জন্য কিনে আনা শাড়ি। সে ডাকতে ডাকতে ঢুকল। টুপুরকে দেখতে না-পেয়ে থমকে দাঁড়াল। সে আবার ডাক দিল। তাদের ঘরের মধ্যে ঢুকল। সেখানেও টুপুরকে দেখতে না-পেয়ে বেরিয়ে এল। ভাবল, টুপুর নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করে লুকিয়ে আছে।]
কাঞ্চন : (ডাক দিয়ে) টুপুর! ওরে, লুকোচুরি খেলা হচ্ছে! টুপুর এই দেখো, তোমার জন্য মেলা থেকে কী এনেছি! শাড়ি এনেছি, মল—
[কাঞ্চনের কথা শেষ হল না। হঠাৎ টুপুর ঢুকল। ধীর পায়ে মুখখানি নীচু করে। চোখ দুটি ছলছল করছে। কাঞ্চন টুপুরকে দেখে আনন্দে ছুটে গেল। ডাকল ‘টুপুর।’ পরক্ষণেই টুপুরের মুখখানি দেখে থমকে গেল। অবাক হল।]
কাঞ্চন : (অবাক স্বরে)
কী হয়েছে টুপুর তোমার,
চোখ কেন ছলছল?
কী হয়েছে বল?
[টুপুর দুটি হাত দিয়ে তার মুখখানি লুকিয়ে ফেলল।]
কাঞ্চন : (ব্যস্ত হয়ে) কী হয়েছে বোনটি আমার
মুখ লুকোলে কেন?
কী হয়েছে যেন!
(হঠাৎ কাঞ্চনের নজর গেল টুপুরের গলার দিকে।)
কাঞ্চন : এ কী! তোমার গলায় রাজার মানিকমালা নেই যে! কোথায় গেল লক্ষ তারার আলোর মালা সেই যে?
[কাঞ্চন টুপুরের মুখটি তুলে ধরল।]
কাঞ্চন : কী হয়েছে বোন?
কোথায় গেল, রাজার দেওয়া ধন?
[টুপুরের চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে গাল বেয়ে।]
কাঞ্চন : অবাক কথা কাঁদছে কেন
বোনটি টুপুররানি,
কেন তার থমথমে মুখখানি!
টুপুর : (কেঁদে ফেলে) দাদা!
কাঞ্চন : (আদর করে) টুপুর, তুমি না বড়ো হয়েছ, নাচ শিখেছ, গান শিখেছ! ছি: ছি:, কাঁদতে আছে? এসো আমার কাছে!
[টুপুর কান্নাভরা চোখে দাদার দিকে তাকায়।]
কাঞ্চন : এই দেখো না তোমার জন্য
কী এনেছি কিনে,
অনেক দেখে চিনে।
ডুরে শাড়ি, রঙিন জামা,
পায়ের দুটি মল,
এই যে তোমার দুলবে কানে
দুল দুটি ঝলমল!
তুমি পরবে নতুন সাজ,
চড়বে পক্ষিরাজ,
পক্ষিরাজে চড়ে তুমি গান শোনাতে যাবে।
কাকে?
রাজাকে, রাজকন্যা আর কন্যার মাকে।
টুপুর : (হঠাৎ কান্নায় ভেঙে) না, না।
আমার আর হবে নাকো
পক্ষিরাজে চড়া,
নতুন সাজও পরা।
ওসব আমার আর কী হবে
আর কী হবে সাজ!
ওসবের ফুরিয়ে গেছে কাজ!
কাঞ্চন : (অবাক হয়ে) ফুরিয়ে গেছে! কী বলছ তুমি? কী ফুরোল? বলো, আমায় বলো।
টুপুর : বললে আমায় বকবে না তো?
কাঞ্চন : আহা!
টুপুর : করবে না তো দূর, মন চায় যদ্দূর?
কাঞ্চন : এসব কথা বলতে আছে, ছি: ছি:! বলো কী হয়েছে?
টুপুর : (উদবেল হয়ে) দাদা, গাইতে আমি ভুলে গেছি গান।
কাঞ্চন : (চমকে উঠে) ভুলে গেছ গান!
টুপুর : (কাঁদতে কাঁদতে) ভুলে গেছি গাইতে আমি। আমার হারিয়ে গেছে সুর!
কাঞ্চন : ছোট্ট আমার বোন, মিষ্টি আমার বোন,
অমন করে দেখাও কেন ভয়?
গান যে জানে, গান সে ভোলে
এও কখনো হয়!
টুপুর : হয় না তো আমার কেন হল? তুমি যেই মেলায় গেলে, ভিনদেশি সেই লোকটা এল। আমায় মিঠাই দিল। আমি মিঠাই খেলাম। আর ঠিক তক্ষুনি গান গাইতে ভুলে গেলাম!
কাঞ্চন : না, না, এ কখনো হয় না। তুমিও আমার সঙ্গে গাও! দেখি কেমন ভুলে গেছ!
(কাঞ্চন গেয়ে উঠল, ‘মৌটুসকি পাখি ও তুই…’ কিন্তু চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল টুপুর।)
কাঞ্চন : (টুপুরকে আদর করে) গাও টুপুর! আমার সঙ্গে গাও!
(কাঞ্চন আবার গান গাইল। কিন্তু টুপুর গাইতে পারল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কাঞ্চনের মুখের দিকে। কাঞ্চন টুপুরের মুখের দিকে চেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠল) গাও, গাও, টুপুর গাও!
[টুপুর অসহায়ের মতো দাদাকে জড়িয়ে ধরে আবার গাইবার চেষ্টা করল। আবার তার গলায় গান আটকে গেল। সে কেশে উঠল। এমন সময় টুপুরের কাশির শব্দের সঙ্গে ভয়ংকর হাসি শোনা গেল। হেসে উঠল সেই ভিনদেশি শয়তান। ‘দাদা—আ—আ—আ—আ,’ বলে চিৎকার করে ককিয়ে কেঁদে উঠল টুপুর। অন্ধকার হয়ে গেল মঞ্চ।]
পঞ্চম দৃশ্য
[অনেক রাত্রি। একই দৃশ্য। ঘরের দাওয়ায় শুয়ে আছে টুপুর। তার পাশে বসে আছে কাঞ্চন। চারদিক থমথম করছে।]
টুপুর : অনেক রাত হয়ে গেল। তুমি শোবে না দাদা?
কাঞ্চন : (মুখখানা ভাবনায় ছেয়ে আছে) ঘুমিয়ে পড়ো টুপুর!
টুপুর : তুমি জেগে থাকলে আমার কি ঘুম পায়! কী ভাবছ এত?
কাঞ্চন : (থতোমতো খেয়ে) কই না তো! কই? কিচ্ছু না!
টুপুর : (বিষণ্ণ-স্বরে) আচ্ছা দাদা, আমি আর কোনোদিনই গান গাইতে পারব না।
কাঞ্চন : কে বলেছে পারবে না, নিশ্চয়ই পারবে।
টুপুর : আর তো রাজার বাড়ি যাওয়া হবে না আমার। ক-দিন পরে রাজার পক্ষিরাজ আসবে। কী হবে? রাজা যখন শুনবেন আমি গান গাইতে ভুলে গেছি, তখন তিনি যদি বলেন আমার মানিকমালা ফিরিয়ে দাও! তখন কী বলব? কী লজ্জা!
কাঞ্চন : এখন ওকথা ভেবে কী হবে টুপুর, এখন ঘুমোবার সময়।
টুপুর : ঘুম না পেলে?
কাঞ্চন : আমি গান গাইলে ঘুম পাবে তো?
টুপুর : গাও!
[কাঞ্চনের গান]
এই রাতে নেই, চাঁদ জেগে নেই,
আকাশ কাজল ঢালা।
এই রাত কেন, খুশি-হারা যেন,
নিভু-নিভু দীপ জ্বালা।
এই রাতে নেই হাসি,
নেই নেই মিঠে বাঁশি।
নেই রাতে নেই, ফুল ফুটে নেই,
নেই গাঁথা ফুলমালা।
এই রাতে নেই, চাঁদ জেগে নেই,
আকাশ কাজল ঢালা।
[গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল টুপুর। টুপুরের ঘুমন্ত মুখখানির দিকে আবেগভরে তাকাল কাঞ্চন। উঠে দাঁড়াল। কাঞ্চনের চোখ দুটি ছলছল করে উঠল।]
কাঞ্চন : (আবেগে গলা জড়িয়ে আসছে) ছোট্ট বোনটি আমার, তুমি ঘুমোও! আমি এবার যাই। আমি সেই ভিনদেশি শয়তানটাকে খুঁজে বার করতে যাচ্ছি। যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বার করবই। তাকে জিজ্ঞেস করব, কেন তুমি আমার এই ছোট্ট বোনটিকে গান গাইতে ভুলিয়ে দিয়েছ! কেন রাজার দেওয়া মানিকমালা তুমি চুরি করেছ! যতদিন না সেই শয়তানটার খোঁজ পাই, ফিরব না টুপুর। (কাঞ্চন আবার বসল। সে কাঁদছে। টুপুরের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে) আর যদি কোনোদিন না ফিরি কেঁদো না। টুপুর, আমি যাই, যাই। (উঠেদাঁড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল।)
[কাঞ্চন বেরিয়ে গেলে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। একটানা ঝিঁঝির ডাক। তারপর শোনা গেল টুংটাং বাজনার শব্দ। যেন টুপুরের চোখ দুটিতে স্বপ্নের ছোঁয়া লেগেছে। আলোর রঙে উছলে উঠছে চারদিক। দেখা গেল সেই বাজনার তালে-তালে যেন আকাশের তারার মতো ঝলমল করে ক-টি মেয়ে ঢুকল। তারা গেয়ে উঠল সেই গান—‘টুপুর যাবে গান করতে, অচিন রাজার দেশে।’ গানের মাঝখানেই হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল কে যেন! সঙ্গে সঙ্গে আলোর রং অন্ধকারে ছেয়ে গেল! অন্ধকারে অট্টহাসি শোনা গেল। অন্ধকারে ছায়ার মতো দেখা গেল সেই কানা-খোঁড়া ভিনদেশি শয়তানটাকে। আচমকা ঘুম ভেঙে গেল টুপুরের। আঁতকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাদা—আ-আ’ সঙ্গে সঙ্গে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল, আবার সব স্বাভাবিক। আবার শোনা গেল ঝিঁঝির একটানা শব্দ। টুপুর ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। সে এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে ভয়-জড়ানো চোখে দাদাকে খুঁজতে লাগল। দাদাকে দেখতে না-পেয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক ছুটে গেল। দাদাকে ডাকতে লাগল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এমন সময় সে দাদার পুতুল-সাজানো চুপড়িটা দেখতে পেল। চুপড়ির ভেতর থেকে সে একটি সিপাই-পুতুল হাতে তুলে নিল আর কাউকে না-পেয়ে তাকেই আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল।]
টুপুর : (কান্না-জড়ানো গলায়)
পুতুল-পুতুল সিপাই,
বলতে পারিস কি তাই,
আমার দাদা গেছে কোথায়?
(কিন্তু মাটির তৈরি পুতুল সে আর সাড়া দেবে কেমন করে?)
টুপুর : (পুতুলের সাড়া না-পেয়ে, রেগে পুতুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে) চাই না আমার পুতুল!
[পুতুল মাটিতে ছিটকে পড়তেই ভয়ংকর একটা শব্দ শোনা গেল। নিমেষের মধ্যে সব অন্ধকার। পরক্ষণেই ধীরে ধীরে আলো জ্বলতেই দেখা গেল, যে-পুতুলটাকে টুপুর ছুঁড়ে ফেলেছিল, সে-পুতুলটা একটা সত্যিকারের জ্যান্ত মানুষের মতো সিপাই হয়ে গেছে! তার হাতে তরোয়াল। সে টুপুরের দিকে চেয়ে হাসছে। তাকে অবাক হয়ে দেখতে দেখতে আর-একটা সিপাই-পুতুল চুপড়ি থেকে তুলে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে দিল টুপুর। সেটাও একটা মানুষ-সিপাই হয়ে গেল। তার হাতেও তরোয়াল। সেও মুচকি-মুচকি হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে দুটো সিপাই-ই টুপুরকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে গেল টুপুর। মানুষের মতো জ্যান্ত সিপাই-পুতুল দুটো একতালে পা ফেলে তরোয়াল উঁচিয়ে, তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। টুপুরও তাদের পেছনে হাঁটতে-হাঁটতে তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। মঞ্চ অন্ধকার হল।]
ষষ্ঠ দৃশ্য
[অনেক দূরে চলে এসেছে কাঞ্চন। ঝোপ-জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে একটা গুহা। কাঞ্চন হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে বসল। হঠাৎ একটা বিকট হাসি।]
কাঞ্চন : (চমকে) কে! (উঠে পড়ল)
[হঠাৎ দেখা গেল, জঙ্গলের গাছের আড়াল থেকে দুটো হাত বেরিয়ে আসছে। দশটা আঙুলে খোঁচা-খোঁচা নখ।]
কাঞ্চন : (চাপাস্বরে) কে তুমি!
[দেখা গেল, সেই হাত দুটো দশটা আঙুলের খোঁচা-খোঁচা নখ নিয়ে তোলপাড় শুরু করে দিলে। কাঞ্চন পিছিয়ে গেল। পিছিয়ে যেতে দেখা গেল, সেই ভিনদেশি শয়তান জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।]
ভিনদেশি : (গর্জনের মতো শব্দ করে) হে—হে—হে! পালাচ্ছিস কোথা? সারাটা পথ আমি তোর পেছনে পেছনে এসেছি। তোর সাহস তো কম নয়! আমাকে মারতে চাস! হা—হা—হা!
[হঠাৎ কাঞ্চনের নজর পড়ে গেল শয়তানের গলার দিকে। সেই গলায় রাজার মানিকমালা।]
ভিনদেশি : কী দেখছিস আমার দিকে? হা—হা—হা! (গলার হারে হাত দিয়ে) এই হারটা দেখছিস? হ্যাঁ, এই সেই মানিকমালা! হে—হে—হে! এখন আমার!
[ভিনদেশি শয়তানের হাসি শেষ হতে-না-হতেই কাঞ্চন লাফিয়ে পড়ল শয়তানটার ওপর। মারামারি লাগিয়ে দিলে মালাটা ওই শয়তানের গলা থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। পারবে কেন কাঞ্চন। কিছুক্ষণ লড়াই করার পর যখন কাঞ্চন আর পারছে না, তখন হঠাৎই সিপাই-পুতুল দুটো সেখানে হাজির হল। ভিনদেশি শয়তান তাদের হাতে তরোয়াল দেখে কাঞ্চনকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এবার সিপাই দুজন শয়তানের সঙ্গে লাগিয়ে দিলে লড়াই। একদিকে কাঞ্চন আঘাতে আহত হয়ে লুটিয়ে আছে। আর, এদিকে সিপাই দুজন শয়তানকে শেষ করতে তরোয়াল চালাচ্ছে। শয়তান হেরে গেল। সিপাই দুজন তাকে তরোয়ালের আঘাতে আহত করে মেরে ফেললে। সে পড়ে রইল।
ঠিক এই সময়ে টুপুরের ডাক শোনা গেল। ‘দাদা—আ—আ—আ, দাদা—আ—আ—আ’ টুপুরের ডাক শুনে পুতুল দু’জন চটপট ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। ঠিক সেই সময়ে টুপুরের ডাক শোনা গেল, ‘দাদা—আ—আ—আ, দাদা—আ—আ—আ’ বলে চিৎকার করে কাঞ্চনকে জড়িয়ে ধরল। কাঞ্চন আদর করল টুপুরকে। টুপুরের চিবুকটি তুলে ধরল কাঞ্চন। টুপুরের চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর টুপুরকে ছেড়ে কাঞ্চন মৃত শয়তানটার কাছে ছুটে গিয়ে তার গলা থেকে মানিকমালাটা খুলে নিল। টুপুর দেখল অবাক হয়ে। সেই মালাটি খুলে নিয়ে আবার ছুটে এল টুপুরের কাছে। টুপুরের চোখে সেই মালার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। টুপুরের চোখে অবাক চাউনি। ধীরে ধীরে টুপুরের ঠোঁট দুটিতে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কাঞ্চন টুপুরের গলায় মালাটি পরিয়ে দিল। নির্বাক হয়ে দাদার মুখের দিকে টুপুর চেয়ে রইল ক্ষণেক। তারপর আপনা থেকেই গান গেয়ে উঠল, ‘মৌটুসকি পাখি রে তুই…’ দেখা গেল সেই সিপাই দুজন জঙ্গলের আড়াল থেকে মাথা নেড়ে-নেড়ে তাল দিচ্ছে। কাঞ্চন হাসছে। পর্দা নেমে এল। গানটুকু ছাড়া, গানের আগের সমস্ত ঘটনাটি ভাব এবং ভঙ্গিতে প্রকাশ করতে হবে। ইচ্ছে করলে গানের সঙ্গে সঙ্গে টুপুরের বন্ধুদেরও মঞ্চে আনা যেতে পারে। সক্কলে গান গাইতে পারে। সমস্ত মঞ্চটা আনন্দে উছলে উঠবে। শুধু পড়ে থাকবে শয়তান এককোণে।]