তার নাম ছিল তাক্কাদুম। তাক্কাদুম একজনই সেপাই। এইসা মোটা গোঁফ তার। ভাঁটার মতো চোখ তার। ইয়া পেল্লাই পেটখানা। হাঁড়ির মতো মুখখানা। তাকে দেখলে তুমি হাসতেও পারবে না, কাঁদতেও পারবে না। দেখলেই থমকে থমথম করবে তোমার চোখ। তাক্কাদুম সেপাই বলে বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করত গুড়ুম- গুড়ুম! আর বুঝতেই পারছ, যুদ্ধ করলে যা হয়, তাক্কাদুম যেন সবসময়ে রেগে আগুন, তেলে বেগুন। চোখ পাকিয়েই আছে। হাসির নাম যেন জন্মেও শোনেনি।

    হল কী, এই গাবদা-গাবুস সেপাই একবার যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণের ভয়ে এমন কান্ড করে বসল যে, বলতে আমারই গা শিরশির করছে!

    সেবার যুদ্ধ হচ্ছিল একটা জঙ্গল-ঘেরা পাহাড়ের গায়ে। আকাশ থেকে বোমা পড়ছে, বুম-বুম, কামান ছুটছে দ্রুম-দ্রুম। আর তাক্কাদুম করেছে কী, বোমা-কামানের ভয়ে দে চম্পট। যেখানে যুদ্ধ হচ্ছিল সেখান থেকে এর চোখে ধুলো দিয়ে, ওর চোখে ধোঁকা দিয়ে সেই পাহাড়টার উলটো দিকে একটা ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে চুপটি করে লুকিয়ে রইল। ও বাবা, এ কী সেপাই রে! এযে এক্কেবারে ভীতুরাম। ছি:! ছি:! রাম! রাম!

    ভীতুরাম তাক্কাদুম ঝোপের মধ্যেই বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর যুদ্ধটা যখন ঠাণ্ডা হয়ে এল, মানে যখন আর দুম-দাম, গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ শোনা গেল না, তখন নিশ্চিন্তি। তখন কেমন যেন খিদে-খিদে পেতে লাগল তাক্কাদুমের! আচ্ছা পেটুক তো! এ-পকেট হাতড়ে, ও-পকেট থাবড়ে ক-টা চিনে বাদাম বেরোল। তাক্কাদুম কুড়ুম-কুড়ুম করে সেই বাদাম খেতে শুরু করে দিলে। খেয়ে-দেয়ে বন্দুকটা কাঁধ থেকে নামিয়ে, পাশে রেখে, ঝোপের মধ্যেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। এ কী রে, শুয়েই দিব্যি যে নাক ডাকাতে শুরু করে দিলে। ভাবোতো, এই সময়ে যদি একটা বোমা আকাশ থেকে সটান তাক্কাদুমের পেটে এসে পড়ে তাহলে বাছাধনের কী হয়, একদম পটকা পটাস!

    চুপ, চুপ, চুপ! দেখতে পাচ্ছ?

    কী?

    তাক্কাদুম যেখানটা শুয়ে আছে সেই ঝোপের আশপাশটা কেমন ঝুপঝুপ করে নড়ছে!

    হ্যাঁ তো রে! কীরে বাবা, তাক্কাদুমকে কেউ দেখতে পেল নাকি! এইবার বুঝবে! যুদ্ধ করতে এসে বাদাম খেয়ে ঘুমোনো বেরিয়ে যাবে!

    দেখতে পাচ্ছ, ঝোপটা এখন কেমন জোরে-জোরে নড়ছে! এই বুঝি কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাক্কাদুমের ঘাড়ের ওপর। এই বুঝি তাক্কাদুম পড়ল ধরা।

    ই-ই-ই!

    কী-ই-ই?

    দেখতে পাচ্ছ না!

    কই না!

    ওমা, ওই তো!

    কই তো?

    একদম ল্যাবাকান্ত। ওই তো গোঁফ দেখা যাচ্ছে।

    হ্যাঁ-তো-রে! কার গোঁফ?

    ওই তো চোখ দেখা যাচ্ছে!

    তাইতো রে! কার চোখ?

    ল্যাজ দেখছ?

    ওরে বাবা—মানুষ নয়রে, মানুষ নয়, এ যে বেড়াল, বেড়াল, বেড়াল রে! বনবেড়াল একটা, দুটো, তিনটে!

    কী হবে?

    এবার বাছাধনের কম্ম শেষ হবে। দেখেছ, দেখেছ বেড়ালের নখগুলো। উরি বাবা! কেমন ওত পেতে বসেচে। এইবুঝি পড়ল ঝাঁপিয়ে! না! ওই দেখো একটা ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সুট করে তাক্কাদুমের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    এ ম্যা! কী ঘেন্না! কী ঘেন্না! বেড়ালটা তাক্কাদুমের গাল চাটতে শুরু করে দিলে! ওই দেখো আর একটা বেড়াল! তাক্কাদুমের জামাটা কামড়ে ধরে এই দিল টান! যা:! তাক্কাদুমের ঘুম গেছে ছিটকে। ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছে! চোখ খুলে তাকাতে-না-তাকাতে একটা বেড়াল তাক্কাদুমের পেটের ওপর লাফিয়ে উঠে তাকদুমাদুম নাচতে শুরু করে দিলে। তাক্কাদুমের তাই না দেখে চক্ষু কপালে। ‘ওরে বাবারে’ বলে চেঁচাতেই তিনটে বেড়াল তাক্কাদুমকে জাপটে ধরে লাগিয়ে দিলে ঝটাপটি! ঝোপের ভেতর সে কী কেলেঙ্কারি কান্ড। কোনারকমে ছাড়িয়ে-ছুড়িয়ে তাক্কাদুম ঝোপ ডিঙিয়ে মারলে ছুট। আরে করছ কী? করছ কী? বন্দুকটা যে পড়ে রইল। আর বন্দুক! ছুট-ছুট। ছুটতে-ছুটতে হোঁচট খাচ্ছে, টাল সামলাচ্ছে। পড়ছে, উঠছে, কাটছে, ছিঁড়ছে! শেষে ঘেমে-নেয়ে একাক্কার! আরে বাবা, একটু থামলেই তো হয়। কী উদো দেখেছ! বেড়ালের ভয়ে একেবারে চোখ-কান বুজে ছুট! চোখ খুলে দেখো না একবার—তোমার পেছনে বেড়ালও নেই, কিছু নেই। ফক্কা!

    তুমি বললেই কি আর থামবে তাক্কাদুম! না থামবে না! তাক্কাদুম তো আর মোটরগাড়িও নয়, উড়োজাহাজও নয় যে, ছুটলে দম ফুরোবে না, কি উড়লে হাঁফ ধরবে না। বাছাধন ছুটতে-ছুটতে নাস্তানাবুদ। দমও গেছে, হাঁফ ও ধরেছে। না থেমে উপায় আছে! বলতে বলতেই থামল তাক্কাদুম।

    উঃ বাবা, যেখানে থামল সেখানটা কী নিরিবিলি। এখানে যুদ্ধও নেই, জনমনিষ্যির গন্ধও নেই। থমথমে জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে একটা মস্ত গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল তাক্কাদুম। তারপর গাছটাকে আঁকড়ে ধরে ফুস-ফাস, ফুস-ফাস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল। একটু পরে যখন বুকের ধুকপুকুনিটা একটু কমল, যখন তার মনে হল, ভয় পাবার মতো তেমন আর কিছু নেই, তখনই বন্দুকের কথা মনে পড়ে গেছে। মনে পড়তেই তার মাথা ঘুরে গেছে! এই রে! বন্দুক কই? সেটা যে সে ফেলে এসেছে! আর যায় কোথায়! তাক্কাদুম আঁকপাঁক করে একবার বসে, একবার ওঠে। একবার ভাবে বন্দুকটা আনতে যাই। আবার ভাবে যদি বিপদ হয়! এই করতে করতে তাক্কাদুমের আবার খিদে পেয়ে গেল। কী খাই, কী খাই করে তাক্কাদুম আবার যেই পকেটে হাত পুরেছে, আর একেবারে ঠিক তক্ষুণি সেই বেড়াল! সেই মস্ত গাছটার মগডাল থেকে একটা বেড়াল মেরেছে এক লাফ একেবারে তাক্কাদুমের কাঁধের ওপর—ঝপাং। মেরেই তাক্কাদুমের মাথায় তবলা বাজাতে শুরু করে দিলে। ‘ওরে বাবারে’ বলে তাক্কাদুম যেই না পালাতে গেছে আর একটা বেড়াল কোত্থেকে ছুটে এসে একেবারে সটান তাক্কাদুমের পিঠের ওপর ড্রাম পেটাতে শুরু করলে। আর শেষ বেড়ালটা ঝোপের ভেতর থেকে ধাঁ করে বেরিয়ে এসে তাক্কাদুমের পেটের ওপর তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে এমন কাতুকুতু দিতে লাগল যে, বেচারা হাসতে হাসতে দম আটকে মরে বুঝি। হাসতে হাসতে কী লম্ফঝম্ফ। লম্ফঝম্ফ করতে করতে যখন আর পারল না, মারল ছুট! তখনও তার কাঁধে বেড়াল, পিঠে বেড়াল, বুকে বেড়াল। ওঃ, ছুটোছুটির সে কী আজগুবি দৃশ্য!

    ছুটতে ছুটতে পাহাড়ের মাথায় উঠে পড়ল তাক্কাদুম। কাতুকুতুর ঠেলায় ওপর থেকে আবার নামতে লাগল। আবার উঠতে লাগল। শেষমেশ মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে এমন স্লিপ কাটল যে, আর সামলানো গেল না। হল কী, পাহাড়ের ঠিক নীচেই ছিল একটা ঝিল। জল একেবারে থইথই করছে। পড়বি তো পড় ঝপাং! সেই ঝিলের জলে! পড়েই নাকে জল, মুখে জল। জল খেয়ে আই-ঢাই। এদিকে এ কী কান্ড! বেড়াল তিনটে? কোথা গেল? এ যে দেখি ফুস! মানে হাওয়া!

    তাক্কাদুমের দফা তো একেবারে রফা। ঠাণ্ডা জলে নাকানি-চোবানি খেয়ে, হি-হি করে কাঁপতে লাগল। আর একগলা জলে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক জুলক-জুলক দেখতে লাগল।

    দেখতে দেখতে হঠাৎ চমকে উঠেছে তাক্কাদুম। এ কী-রে, তার সামনে যে একটা ছেলে! শুধু ছেলে নয়, তার পেছনে একটা ঘোড়া। ছেলেটা ঘোড়ার লাগাম ধরে ঝিলের ধারে বসে আছে। বসে বসে তাক্কাদুমের দুর্দশা দেখে ফিক-ফিক করে হাসছে। তাকে দেখে তো তাক্কাদুমের লজ্জার একশেষ। লজ্জা যত পাচ্ছে, তার হাসি দেখে রাগও তত ধরছে। কোনো কথা না-বলে তাক্কাদুম ঝিল থেকে ওপরে উঠে এল। চোখ পাকিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়াল। ছেলেটা আরও জোরে হেসে উঠল।

    ‘এই!’ তাক্কাদুম মারল এক ধমক।

    ‘কে-ই?’ ছেলেটা হাসতে হাসতেই উত্তর দিল।

    ‘ঘুঁসি মেরে তোর নাকটা চ্যাপটা করে দেব!’ রেগে একেবারে কাঁই-কাঁই করছে তাক্কাদুম।

    ছেলেটা এবার হাসি থামিয়ে ঠোঁট উলটিয়ে জবাব দিল, ‘উঃ! বেড়াল দেখেই অক্কা যায়, আর নাক চ্যাপটা করবে।’

    একেই জলে পড়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল তাক্কাদুম। তার ওপর ছেলেটার মুখে এই কথা যেই না শোনা অপমানে তখন যেন ঠকঠকানি আরও বেড়ে গেল। ছেলেটাকে খপ করে খামচে ধরে কড়কে উঠল, ‘বেড়াল কোথায় দেখলি রে পুঁচকে ছেলে! বাঘ! বাঘ! বাঘকে বলিস বেড়াল!’

    ছেলেটা ওর সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে কেন। তাই তার সঙ্গে ধামসা-ধামসি না করে হি-হি করে হেসে উঠে বলে ফেলল, ‘কী হাঁদারাম লোক রে! বেড়ালকে বলে বাঘ!’ হি-হি-হি!

    তাক্কাদুম ছেলেটার কান পাকড়িয়ে ভেংচিয়ে উঠল, ‘হি-হি-হি, ফুক্কুড়ি হচ্ছে। দেখবি একবার, এই-ই-ই—’

    তাক্কাদুমের কথা শেষ হল না। ছেলেটা তাক্কাদুমের পেছনে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই-ই-ই—’ দেখো!’

    বলতেই তাক্কাদুম পেছন ফিরেছে। ফিরেই তো তার চক্ষু চড়কগাছ। দেখে সেই তিনটে বেড়াল। ঝিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে!

    তাক্কাদুম ছেলেটার কান ছেড়ে, ছেলেটার হাত থেকে ঘোড়ার লাগামটা ছিনিয়ে নিয়ে একেবারে ঘোড়ার পিঠে বসে পড়েছে। যেই না বসা, অমনি ঘোড়া চার-পা তুলে ধাঁই-ধপাধপ লাগিয়ে দিলে। তাক্কাদুম চেঁচায় হ্যা-ট-হ্যাট। ঘোড়া হাঁটেও না ছোটেও না। শুধু লাফায়! তাই দেখে ছেলেটার মজা দেখে কে! হেসে গড়িয়ে একেবারে লুটোপুটি। ছুটতে ছুটতে বেড়াল তিনটেও চোখের পলকে হাজির সেখানে। বেড়াল দেখে ভীষণ ভয়ে তাক্কাদুম ঘোড়ার পেটে যেই ক্যাঁত করে মেরেছে লাথি, ব্যাস! ঘোড়া এমন লাফান লাফাল যে তাক্কাদুম ঘোড়ার পিঠ থেকে ধপাস—একেবারে চিৎপটাং। উ-হু-হু-হু। তাক্কাদুমের পেটটা গেল বোধহয় ফেঁসে! নাক টিপে চিঁ চিঁ করতে লাগল। ছেলেটা তেমনি হাসতে হাসতেই বললে, ‘থাকো। ওইখানে চিৎপটাং! যুদ্ধ করতে এসে প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে থাকার কেমন শাস্তি।’ বলে নিজেই ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল ছেলেটা। ওমা! সঙ্গে সঙ্গে ওই দেখো, তিনটে বেড়ালও লাফ দিল তিড়িং! একেবারে ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়াটা অমনি ছুট দিল টগবগ, টগবগ।

    আর তাক্কাদুম হাঁদারামের মতো সেইদিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতে লাগল, আচ্ছা বজ্জাত ছেলে তো! ছেলে নয় তো, ভেলভেলে! ধুস!

    টীকা