রাজার ঘরে টিকটিকি
শৈলেন ঘোষ দ্বারামন্ত্রীর ডাক পড়ল।
কে ডাকলেন এই সাতসকালে?
কে আবার, যিনি মন্ত্রীকে ডেকে থাকেন যখন-তখন, এ-ডাক সেই রাজা কাক্কাবোক্কার।
যখন-তখন ডাকেন বলেই মন্ত্রীরও কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। আগে, অসময়ে রাজার ডাক শুনলেই, যেমন বুক ধড়ফড় করে উঠত, সব কিছু ফেলে-ছড়িয়ে ছুটতেন, এখন আর তা করেন না। এখন ধীরেসুস্থে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে রাজার সামনে হাজির হন, আর রাজা যা হুকুম করেন, শোনেন। অবাক হয়ে যাই দেখে, যে-মন্ত্রী এককালে রাজার সামনে কেঁচো হয়ে হাত কচলাতেন, এখন তিনি দিব্যি মুচকি মুচকি হাসেন! এত সাহস তাঁর হল কী করে?
অ্যাই, এইটিই হল কথা। আরে বাবা, তিনি হলেন মন্ত্রী। মন্ত্রী মানেই তো চালাকের এক খনি! তিনি যে তলে তলে রানিমাকে হাত করে ফেলেছেন, এ তো আর কেউ জানে না। এখন রাজামশাই মন্ত্রীমশাইকে বকাঝকা করলেই, মন্ত্রীমশাই ফাঁক পেলেই রানিমার কাছে গিয়ে একেবারে কেঁদে পড়েন। আর রাজা কাক্কাবোক্কা রানিমার কাছে গেলে, তিনি রাজার সঙ্গে কথাও বলেন না, হাসেনও না। মুখ ব্যাজার করে বসে থাকেন। তারপর, অনেক সাধাসাধি করার পর রানিমার মান ভাঙলে, তিনি রানির ব্যাজারের কারণ শোনেন। কথা দেন, আর কোনোদিন তিনি মন্ত্রীমশাইকে হেনস্থা করবেন না।
তা এমন কথা দিলে কী হবে, সাবধানে-অসাবধানে মন্ত্রীর সঙ্গে রাজা কাক্কাবোক্কার খিটিমিটি লেগেই আছে। তবে সে-খিটিমিটি আগে যেমন নিত্য হত, এখন অবশ্য অনেকটা কম হয়।
যাক, সে তবু মন্দের ভালো। কিন্তু আজ মন্ত্রীমশাই রাজামশাইয়ের ডাক শুনে হেলতে-দুলতে তাঁর সামনে হাজির হতেই মন্ত্রীমশাইয়ের চক্ষুস্থির।
তাইতো, রাজামশাইয়ের চোখদুটো অমন লাল টকটক করছে কেন! মনে হচ্ছে, চোখ যেন ছলছল করছে! রাজা রেগেছেন, না কেঁদেছেন! তাই দেখে আগ বাড়িয়ে তিনিই ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘কী হয়েছে আপনার?’
মন্ত্রীর কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি রাজা তিরিক্ষি মেজাজে ধমকে উঠলেন, ‘আপনাকে তো কিছু বলা যাবে না মশাই! বললেই তো রানিমার কাছে গিয়ে আমার নামে নালিশ করবেন। কিন্তু আমার ঘরে যদি একটি টিকটিকি ঢুকে সারারাত টকটক করে ডাকে, আর ঘরের দেওয়াল আঁকড়ে নেচে নেচে আমার ঘুম কেড়ে নেয়, তখন কী হয়? তখনও কি আপনাকে কিছু বলতে পারব না? তখনও কি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারব না, চারদিকে আমার এত মন্ত্রী-সান্ত্রি, সিপাই-সামন্ত থাকা সত্ত্বেও রাজবাড়িতে টিকটিকি ঢোকে কেমন করে? রাজবাড়িতে ঢোকে ঢুকুক, সে-ও না হয় মেনে নেওয়া গেল, তাই বলে লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাজার ঘরে ঢুকবে? রাতদুপুরে রাজার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে? শুধু ঘুমের ব্যাঘাত কেন, টিকটিকিকে আমার ঘর থেকে বার করে দেওয়ার জন্যে, সারারাত দেওয়াল ধরে সারাঘর ছোটাছুটি করেছি। ব্যাটা টিকটিকি এমনই ত্যাঁদড়, আমি রাজা, আমি হুকুম করছি, আমাকে তোয়াক্কাই করল না!’
এবার মন্ত্রী মুখ খুললেন। বেশ নরম গলায় বললেন, ‘আজ্ঞে মহারাজ, টিকটিকি ওসব রাজা-টাজা বোঝে নাকি! টিকটিকির কাছে রাজাও যা এঁটেলমাটিও তা! ফু:! ঝুটমুট সারারাত আপনি কষ্টই করলেন! আরে বাবা, টিকটিকিকে ঘর থেকে তাড়ানো সেকি রাজারাজড়ার কম্ম!’
‘তবে কার কম্ম?’
‘আজ্ঞে আরশোলার।’
‘সেডা আবার কেডা?’ রাজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
মন্ত্রী উত্তর দিলেন, ‘আজ্ঞে, সেটাকে আপনি পোকাও বলতে পারেন, আবার পাখিও বলতে পারেন! দেওয়ালে হেঁটে হেঁটে ঘুরতেও পারে, আবার ভয় পেলে উড়ে পালাতেও পারে। রাজবাড়ি-টাজবাড়ি তাদের পছন্দ নয়, তারা থাকে নোংরাগাদায়। এই আরশোলা খেতে টিকটিকিরা খুব ভালোবাসে। এখন এই আরশোলার লোভ দেখিয়েই যদি আপনার ঘর থেকে টিকটিকিদের তাড়ানো যায়। এর বাইরে তো আমার মাথায় আর কোনো মতলব খেলছে না।’
মন্ত্রীর কথা শুনে রাজা কাক্কাবোক্কা আনন্দে উছলে উঠে বললেন, ‘তাহলে তো ভালোই হল। এখন, আপনি এক কাজ করুন, আমার রাজ্যে যেখানে যত আরশোলা আছে ধরে এনে, আমার ঘরের বাইরে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। ব্যাটা টিকটিকি তাদের খাবার লোভে নিশ্চয়ই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। আহা! কী দারুণ মতলব ঠাউরেছেন আপনি! এই না হলে মন্ত্রী!’
রাজার কথা শুনে মন্ত্রীর তো চোখ কপালে! এ কী উদ্ভট কথা বলেন রাজামশাই! একটা আরশোলা ধরতেই মানুষ হিমশিম খায়, সে-জায়গায় সারারাজ্যের আরশোলা ধরে আনতে বলছেন রাজামশাই! মানুষটার কি একটুও জ্ঞানগম্যি নেই! তুমি বলতে যাও, এটা হয় না, তখন যদি তাঁর মূর্তি দেখো! যেন এই মারেন, তো সেই মারেন! এমন তাঁর জেদ! তবু মন্ত্রীমশাই তো আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। তাঁকে তো একটা কিছু বলতে হবে রাজামশাইকে। নইলে এক্ষুনি উলটোপালটা কান্ড করে বসবেন। এমনকী তাঁর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নিয়ে তাঁকে রাজবাড়ি থেকে বিদেয়ও করে দিতে পারেন।
সুতরাং মন্ত্রীমশাই কথা বললেন। কথা বলার আগে খুব জোরে হেসে উঠলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন, ‘এ কী কথা বলছেন আপনি! সারারাজ্যের আরশোলা কি ধরা যায়? তা ছাড়া একটা আদাড়ের আরশোলা ধরে এনে রাজবাড়িতে ছেড়ে দিন, দেখবেন দু-দিনেই রাজবাড়ি ছেয়ে গেছে আরশোলায়। তারপর সেই আরশোলা রাজবাড়িতে এমন গেঁড়ে বসবে, কার সাধ্যি তাদের তাড়ায়।’
রাজা কাক্কাবোক্কা এবার ভারি ভাবনায় পড়লেন। ভাবতে ভাবতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কী করা যায়?’
মন্ত্রী কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিলেন, ‘আমিও তো কিছু ভেবে পাচ্ছি না।’
হঠাৎ রাজার কী মনে হল, মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, একজন জাদুকরের সাহায্য নিলে হয় না?’
‘জাদুকর কী করবে?’ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রী।
রাজা উত্তর দিলেন, ‘শুনেছি জাদুকর এমন মন্ত্র জানে যে, মন্ত্রের জোরে বাঘকেও ছুঁচো করে দিতে পারে।’
মন্ত্রী বললেন, ‘শুনেছি তাই। কিন্তু টিকটিকি-আরশোলা কান্ডে জাদুকর কী করবে?’
রাজা উত্তর দিলেন, ‘তাহলে জাদুকরের মন্ত্রের বলে আপনি আরশোলা হবেন। হয়ে টিকটিকিটাকে আমার ঘর থেকে তাড়িয়ে, আবার জাদুকরের মন্ত্রে মানুষ হয়ে যাবেন। সেই ভালো। আপনি এখনই একজন জাদুকরকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন।’
মন্ত্রী রাজামশাইয়ের এমন ভয়ংকর ভাবনার কথা শুনে আঁতকে উঠেছেন। তিনি জানেন এ বাবা এমন একগুঁয়ে রাজা, একবার যা মাথায় ঢুকেছে, তা করে ছাড়বেন। তাই মন্ত্রী ভয়ে-ময়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘না, আমি আরশোলা হব না’ বলে ঘর থেকে দিলেন দৌড়। কিন্তু দৌড় দিলে হবে কী, রাজা খপ করে ধরে ফেলেছেন মন্ত্রীকে। ধমকে উঠলেন, ‘পালাচ্ছেন কোথায়?’
মন্ত্রীতে-রাজাতে লেগে গেল ধস্তাধস্তি। ধস্তাধস্তি করতে করতে রাজা যদি বলেন, ‘আপনাকে আরশোলা হতেই হবে’, মন্ত্রী বলেন, ‘হব না, হব না।’
একজন বলেন, ‘হতেই হবে।’
আর একজন বলেন, ‘না, না, কিছুতেই না।’
ওঃ, রাজবাড়ির রাজার ঘরে সে কী তুলকালাম কান্ড! বুঝি, ঘরের মধ্যে মন্ত্রী-রাজায় মারামারি লেগে গেছে! চিৎকার চেঁচামেচি শুনে তাইতো মনে হচ্ছে!
তো, রাজা-মন্ত্রীর ধস্তাধস্তি, মারামারি, চিৎকার, চেঁচামেচির এই ছি-ছি খবরটা কি আর শুধু রাজার ঘরেই আটকে থাকে? হাওয়ার আগেই যে-যেখানে ছিল সবার কানে পৌঁছে গেছে! এমনকী যে-মুহূর্তে রানিমার কানে পৌঁছে গেছে, তিনিও তখন কি আর স্থির হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারেন? এসেছেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে। ওমা! এ কী কান্ড! তাঁর চোখে ধাঁধা। দেখেন কী, রাজা আর মন্ত্রীতে হাতাহাতি হচ্ছে। ছ্যা, ছ্যা! দেখে তিনি লজ্জায় আধখানা। তিনি গলা ফাটিয়ে দিলেন ধমক, ‘কী হচ্ছে কী?’
এক ধমকেই রাজা আর মন্ত্রীর কম্ম সারা। দুজনেই থতোমতো খেয়ে চমকে ওঠেন। মন্ত্রীমশাই চোখের সামনে আর কিছু দেখতে না-পেয়ে তিড়িং করে মারলেন এক লাফ! একলাফেই একেবারে রাজার কাঁধের ওপর। বাবা রে বাবা! এ কী লাফ! রানিমার ভয়ে এমন বেসামাল হয়ে কেউ লাফায়! উফ! দেখো, অসাবধানে মন্ত্রীর মাথাটা কেমন কড়িতে ঠকাস করে ঠুকে গেল! ফাটল নাকি!
না, ফাটল না। কিন্তু একটা আজব কান্ড ঘটে গেল। হল কী, সেই যে ব্যাটা টিকটিকি এতক্ষণ কড়িতে বসে ছিল, রাজা-মন্ত্রীর লড়াই দেখছিল, সেটি এতক্ষণ কারও নজরে পড়েনি। মন্ত্রীর লাফের এত তেজ যে, ওই কড়ি অবধি তাঁর মাথাটা পৌঁছে গেছে। পড়বি তো পড় একেবারে টিকটিকির গায়ে। আচমকা মন্ত্রীর মাথাটা টিকটিকির গায়ে লাগতেই, টিকটিকিটা কড়ি থেকে মেরেছে লাফ। পড়বি তো পড় রানিমার গায়ের ওপর। রানিমা ‘ওরে বাবারে’ বলে ঘর থেকে সটান বাইরে। নিজের ঘরে। ঘরের কপাট এঁটে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন।
এদিকে টিকটিকিটাও রাজার ঘর থেকে ছুট দিল বাইরে। এতক্ষণ যারা বাইরে রাজা-মন্ত্রীর লড়াই দেখার জন্যে ভিড় জমিয়েছিল, টিকটিকিটা যেই তাদের পায়ের তলা দিয়ে পালাতে গেল, তখন ভিড় ভেঙে তছনছ। শুরু হয়ে গেল হট্টগোলের হট্টমেলা। অমনি রাজা আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘টিকটিকি পালিয়েছে! টিকটিকি পালিয়েছে!’ বলে নেচে উঠেছেন। মনে ছিল না, তাঁর কাঁধে মন্ত্রী! তিনি দু-পা তুলে একটু লাফ দিতেই মন্ত্রী তাঁর কাঁধ-ফসকে ঘরের মেঝেয় ধপাস! মানে, চিৎপটাং! পড়েই ভয়ে-ময়ে হাত-পা ছুড়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘রানিমা, আমায় বাঁচান! বাঁচান!’
আর রানিমা! তখন তিনি কোথায়! তখন তিনি নিজের ঘরে কপাট এঁটে ভাবছেন, রাজবাড়িতে টিকটিকি ঢুকল কেমন করে!
অবশ্য, টিকটিকি ছাড়া এর উত্তর কেউ জানে না।