পেট ফাঁপা রবারের হাঁস—প্যাঁক প্যাঁক। প্যাঁক-প্যাঁকের ফাঁপা পেট টিপলেই প্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ অ্যাঁক করে ডেকে উঠবে। উরি ব্বাস! বাছাধনের ফাঁপা পেটের ফাঁকে ফাঁকে কি যত রাজ্যের দুষ্টু মতলব? রাতের ঘুরঘুট্টি কেটে গেল, দিনের আলো ছড়িয়ে পড়ল—পুতুলদের সবার চোখে ঘুম এল। গাবদা-গাবুস হাতি ঘুমুল, ভুসি-ঠাসা পুষি ঘুমুল, খোকন-পুতুলসোনা ঘুমুল। ওমা! ওনার তখন চক্ষে ঘুম নেই গা! যাদু তখন মটকা মেরে জানলার ওপর বসে থাকবে। বসে বসে পিটপিট করে চেয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকবে। রোজ! রোজ! রোজ! পুকুরের ঝকঝকে জলে গাছের ছায়া পড়েছে। গাছের ডালে ডালে পাখি নাচছে, গান গাইছে, ফুড়ক ফুড়ক উড়ে বেড়াচ্ছে। পুকুরের বুকে শ্বেতপদ্মের কুঁড়ি ফুটেছে, হাওয়ায় হাওয়ায় দুলছে। ব্যাং-ব্যাঙাচি খেলা করছে, ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ ডাকছে, ড্যাডাং ড্যাডাং ডিগবাজি খাচ্ছে। জ্যান্ত হাঁসের কাচ্ছা-বাচ্ছা জলের ওপর ঘাড় দুলিয়ে বুক ফুলিয়ে সাঁতার কাটছে। প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক হাঁক দিচ্ছে, পদ্মপাতার এ-ধার ও-ধার ঘুরে-ফিরে লুকোচুরি খেলছে। পুকুর পাড়ের কাশফুলে, ঘাসে ঘাসে ফড়িং উড়ছে, ফুলে ফুলে প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে মধু খাচ্ছে—সব দেখবে। দেখবে আর ভাববে—দুর ছাই! কী যে সব কুনো পুতুলগুলো জুটেছে। ঘরের কোণটি ছাড়া কিচ্ছুটি জানে না। পুকুরপাড়ে খেলতে যেতে বলি—ভয়েই গেল! আমি হাঁস, শুকনো ডাঙায় কি আর রাতদিন ইদিক-উদিক করতে ভালো লাগে? আজ রাত হোক না—দেখাচ্ছি মজা!

    সেদিন রাতে পুতুলদের তখনও কারও ঘুম ভাঙেনি। গাবদা-গাবুস হাতি চোখ বুজে শুঁড় ঝুলিয়ে ঘুমুচ্ছে; পুষি ম্যাঁও ম্যাঁও ল্যাজ পাকিয়ে গোঁফ ফুলিয়ে ঘুমুচ্ছে ; আর খোকন-পুতুলসোনা তুলতুলে বিছানায় হাত ছড়িয়ে পাশ-বালিশটি পায়ে জড়িয়ে ঘুম দিচ্ছে। আর প্যাঁক-প্যাঁক কী করছে? ওমা! প্যাঁক-প্যাঁক ঠায় জেগে! জেগে জেগে উশখুশ করছে, ঘুসঘুস করছে। একবার সোনার মুখ দেখছে—খোকার ঘুম ভাঙল নাকি! একবার হাতির শুঁড় দেখছে, হাতির শুঁড় নড়ল নাকি! একবার পুষির ল্যাজ দেখছে—পুষির ঘুম টুটল নাকি! আরে ওরা জাগবে কী? এখনও তো পুতুলদের ঘুম ভাঙবার রাতই হয়নি। দেখছে, খানিক দাঁড়াচ্ছে, ভাবছে, খানিক বসছে, খানিক উঠছে, খানিক চলছে। তারপর! তারপর কী যে ভাবল, বলা নেই, কওয়া নেই চট করে মারলে ছুট পাঁই পাঁই। নর্দমার ফাঁদ দিয়ে গুঁড়ি মেরে বাগানে পড়ে ছুট-ছুট-ছুট। ফাঁপা-পেট নেড়ে নেড়ে, হাপুস-হুপুস হাঁপ ছেড়ে বাগান দিয়ে সটান একেবারে পুকুর পাড়ে।

    রাত দুপুরে পুকুর পাড়—চুপচাপ নি:সাড়! ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে জোনাক পোকা নিউজের মিট মিট আলো জ্বালিয়ে উড়ছে। ঝিঁঝি পোকা এ-ধার ও-ধার ঝিঁঝিঁঝিঁ ডাকছে। ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ—ব্যাং-ছানারা দু-চারটে জলের ওপর ছলাৎ ছলাৎ নাচছে। হুতোম পেঁচা ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ গাছের ডালে হাঁকছে, ঝট পট পট পাখার ঝাপট দিচ্ছে। তাই-না দেখে প্যাঁক-প্যাঁকের চক্ষুস্থির। বুক করছে দুরু দুরু মাথা ঘুরছে বোঁ বোঁ। এখন কী করবে সে?

    কী আর করবে! এখন তো আর ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। আর তার ভয় পাবারই বা কী আছে? পুকুরের জলে নেমে পড়লে তার কী হবে? সে তো হাঁস! কিন্তু জলে সে নামবে কেমন করে যদি ডুবে যায়! ধ্যাৎ, তাই আবার হয় নাকি? হাঁস হলেই তো সে সাঁতার জানবে। যদি কেউ খেয়ে ফেলে! অ্যা ম্যা, ওকে আবার খাবে কী। ওর তো শরীর রবার দিয়ে ঢালাই করা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমনি কত সাত-পাঁচ ভাবছে। ঘাড় ফিরিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে এধার-ওধার আড়ে আড়ে দেখছে। এমন সময় আচমকা ‘ঘ্যাঙ-ঙ-ঙ-ঙ!’

    ই-ই-ই-ই-ই-ই! একটা এত্ত বড়ো কটকটে ব্যাং! বিটকেল হাঁক পেড়ে থপথপিয়ে এক্কেবারে প্যাঁক প্যাঁকের পেছনে ধপাস। যেই না লাফিয়ে পড়া হাঁস বাছাধনের পিলে ছ্যাঁৎ করে চমকে উঠল। চমকে উঠে কী তাই মরি-বাঁচি ধাঁই করে একেবারে পুকুরের ডুবো জলে ঝপাং। কটকটে ব্যাংটা গ্যাঙ-ঙ-ঙ-ঙ করে কী জোর হেসে উঠল। উরি ব্বাস! বলব কী, সঙ্গে সঙ্গে অমন দশ-বিশ-তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ-এক-শোটা ব্যাং একসঙ্গে। গ্যাঙ-গোঙ-ঘিঙ-ঘ্যাঙ-প্যাঙ-ম্যাঙ-চ্যাঙ—চিৎকার শুরু করে দিলে। কানের পর্দা ফুটো হয়ে যাবার জোগাড়!

    প্যাঁক-প্যাঁক প্রাণটি নিয়ে আঁকপাঁকিয়ে জলে ভেসে তড়বড়িয়ে সাঁতার কেটে পালাতে যাবে কী—আর এক কান্ড। ফাঁপা পেট ভুড়-ড়-ড়ড়ড়ড় ভুড়-ড়ড়ড়ড় করে কেন? গা ভারী হয়ে সুড়সুড়িয়ে জলের মধ্যে ডোবে যেন! এই সেরেছে! হাঁদা প্যাঁক-প্যাঁক এক্কেবারে গাধা। বোকাটা জানে না—ওর পেটের মধ্যে ছেঁদা। ছেঁদায় আঁটা বাঁশি!

    তাইতো পেট টিপলে বাঁশি প্যাঁক-প্যাঁক করে। ঢক-ঢক-ঢক-ভুড়-ভুড়-ভুড়-গুড় গুড় করে পেটের মধ্যে জল সেঁদুতে সেঁদুতে যেই প্যাঁক-প্যাঁক ডুবুডুবু—অমনি একেবারে কেঁদে ককিয়ে উঠল! কটকটে ব্যাং তাই না দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ডুবল ডুবল! মার মার লাথি মার।’

    বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝটপট এক বাচ্ছা ব্যাং তড়াং করে লাফিয়ে পড়ে, ছুট্টে গিয়ে প্যাঁক-প্যাঁকের পেটের তলায় মারল ক্যাঁৎ করে এক লাথি! উঃ বাবা! খুব বেঁচেছে। মারা কী! তাই প্যাঁক-প্যাঁক চিৎপটাং। পেটের গর্ত ওপর দিকে, মাথার গর্ত নীচের দিকে। চিৎ হয়ে চোঁ-চোঁ পোঁ-পোঁ চরকিবাজি! প্যাঁক-প্যাঁক হাঁস-ফাঁস করতে লাগল, পা ছুঁড়তে লাগল।

    ওদিকে জলের ওপর প্যাঁক-প্যাঁক ডুবছে, এদিকে খেলাঘরে পুতুলদেরও তো ঘুম ভাঙছে। খোকন-পুতুলসোনার ঘুম ভাঙল, প্যাঁক-প্যাঁককে খেলতে ডাকল—সাড়া পেল না। পুষি ম্যাঁও-ম্যাঁও চোখ চাইল প্যাঁক-প্যাঁককে হাঁক পাড়ল—সাড়া পেল না। হাতি-গাবদা মুখ তুলল শুঁড় নাড়ল, প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক গেল কোথা? হাতির চোখে সোনা চায়, সোনার চোখে হাতি চায়। পুষির চোখে গাবদা চায়, গাবদার চোখে পুষি চায়। তিনজনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

    এমন সময় খুট খুট খুট। নর্দমার ইট নড়ছে না? বলতে বলতেই, চোখের পাতা পড়তে পড়তেই কালো কুচকুচে একটা এইস্যা বড়ো গেছো ইঁদুর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেখে শুনে ভয়ে-ময়ে পুতুলদের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সোনা তো হাতির পেছনে গিয়ে ল্যাজ জড়িয়ে চাপা গলায় কাঁপা সুরে চেঁচিয়ে উঠল—ওমা! ইঁদুর!

    ‘হুম!’ গেছো ইঁদুর একনিশ্বাসে বলে গেল, ‘আমি তোমাদের ভয় দেখাতে আসিনি। চুরি করতে আসিনি। তোমাদের গায়ের আটা খেতে আসিনি। তোমাদের হাঁস-বন্ধু পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে গিসল। ব্যাঙেরা তাকে লাথি মেরে জলের মধ্যে উলটে দিয়েছে। চিৎপটাং হয়ে জলের ওপর সে ভাসছে—সেই খবরটা দিতে এসেছি।

    ‘এক্ষুনি গিয়ে তাকে তোলবার ব্যবস্থা করো, নইলে তার আর টিকি দেখতে পাবে না। আমি ঘরে কোলের ছেলেকে একা রেখে এসেছি। আমায় না দেখতে পেলে হয়তো কাঁদবে। তার বাপ খাবারের জোগাড় করতে ভাঁড়ার ঘরে গেছে। আমি যাচ্ছি—’ বলে যেমন করে এসেছিল তেমনি করে চলে গেল।

    গাবদা বললে, ‘আমি জানি। পই পই করে বারণ করলুম যাস না। তা কানে নিলে? যাক, যা হবার হয়েছে। চলো পুকুর পাড়ে। যাহোক তো করতে হবে! একখান সেনা আমার পিঠে চাপো। এই ম্যাঁও ম্যাঁও আমার পিঠে চাপ—’ বলে হাতি হাঁটু গেড়ে বসল।

    সোনা কাঁচু-মাচু হয়ে বললে—‘ও বাবা! বাইরে যেতে হবে?’

    সোনার কথার সুর টেনে পুষিও বললে—‘অ্যাঁ, বাইরে যেতে হবে?’

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নইলে ওকে বাঁচাবে কী করে? ভয় পেলে চলবে না। আর আমি তো আছি।’

    খোকনসোনা সুড়সুড় করে হাতির ল্যাজ বেয়ে পিঠের ওপর চেপে বসল, পুষি ম্যাঁও ম্যাঁও হাতির শুঁড় বেয়ে মাথায় গিয়ে বসল। হাতি গলার ঘণ্টা ঠুংঠুঙিয়ে বাজিয়ে শুঁড় দিয়ে ঘরের দরজা ঠেলে, বাইরে বেরিয়ে, চলল পুকুর পাড়ে।

    পুকুর পাড়ে গিয়ে তো সব চক্ষু ছানাবড়া! যা বলা ঠিক তাই হয়েছে! প্যাঁক-প্যাঁক ঠ্যাং উঁচিয়ে মাঝপুকুরে জলের ওপর মুখ গুঁজড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে! এখন কী করে ডাঙায় তুলবে? ব্যাপার দেখে সবাই এক্কেবারে হতভম্ব! আরে ভাই কেউ কি সাঁতার জানে যে চটপট সাঁতরে তুলে আনবে। তাই তো! তাই তো! আচ্ছা, একটা উপায় করতে পারা যায় তো! হাতি অমনি গাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল—‘হয়েছে রে, হয়েছে! ঢিল নোঙর! এই পুষি, চট করে ঘরের লাটাই থেকে খানিকটা সুতো ছিঁড়ে আন দিকি নি।

    পুষি কিছু ভাবল না। পুষি কিচ্ছু জিজ্ঞেসও করল না। মারল টেনে চোঁ চোঁ ছুট। ঝটপট আনল ছিঁড়ে এত্ত সুতো। খোকা বাঁধল সুতোয় খোলামকুচি। সুতো ধরে সাঁই-ই-ই-ই করে উলটো হাঁসের পেটের দিকে ছুড়ল। যা:! সুতো পৌঁছোয় না। আরও জোরে ছুড়ল—এবারও না। শেষবার আরও জোরে, ছোট্ট হাতে যত জোর। যা:, ফসকে গেল। সোনার হাত টনটন ঝনঝন। আর কেই বা ছুড়বে? হাতি পারে না ছুড়তে, পুষিও পারে না ছুড়তে। শেষ অবধি ঢিল নোঙরে কাজ হল না। আবার সবাই ভাবতে বসল।

    এমন সময় সোনা ফিসফিসিয়ে বললে—‘আচ্ছা গাবদা-গাবুস, এক কাজ করলে হয় না? নৌকো করে পুকুরের মাঝখানে যদি যাওয়া যায়?’

    ‘নৌকো! নৌকো কোথায়?’

    ‘কেন ওই তো কাগজ পড়ে আছে? কাগজ দিয়ে নৌকো করতে আমি জানি।’ বলে ছুটে সোনা বাগানে পড়ে-থাকা একটা গোটা খবরের কাগজ নিয়ে এল। নৌকো করতে বসে গেল।

    হাতি বললে, ‘ঠিক! ঠিক!’

    ‘নৌকো হল, এবার চাপবে কে?’

    পুষি বললে, ‘গাবদা-দাদা তুমি বড়ো আছ, তুমিই চেপে যাও।’

    ‘আরে ধ্যাৎ, কাগজের নৌকো কখনো আমার ভার সইতে পারে?’ গাবদা বললে, ‘সোনা, তুমি মানুষ-পুতুল, তুমিই চেপে যাও।’

    ‘ওরে বাব্বা! আমি! একা! যদি ডুবে যাই।’

    ‘আরে তুমি ফুরফুরে হালকা পুতুল, তুমি ডুববে কী? যাও তাড়াতাড়ি!’

    নৌকোর ওপর জুজুর মতো সোনা চেপে বসল। হাতি শুঁড়ে করে নৌকো জলের ওপর ভাসিয়ে দিলে। ভাসিয়ে দিয়ে শুঁড়ে করে এমন ঠেলা দিলে যে নৌকো একেবারে যায় যায়। সোঁওঁ-ওঁ-ওঁওঁ-ওঁ করে তিরবেগে নৌকো এগিয়ে গেল। বেসামাল হয়ে কাৎ হয়েছে কি অমনি ছলাৎ করে একঝলক জল নৌকোর মধ্যে ঢুকেছে। আর কী! নৌকো ডুবু-ডুবু। উঃ-উঃ-উঃ গেল গে-ল! ওরে বাসরে বাস! কী ভাগ্যি! লাগবি তো লাগ নৌকো এক্কেবারে পদ্মপাতার গায়ে। খোকা অমনি ধড়মড়িয়ে টপাং করে লাফিয়ে পদ্মপাতা আঁকড়ে ধরলে। এক্কেবারে পাতার ওপর। ওঠা কী, তখনি নৌকো ডুব, জলে টুপুস। তখনি খোকা ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করে কেঁদে ফেললে। দেখেশুনে হাতিও ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করলে, পুষিও ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ। পুকুর-পাড়ে কান্নার গুলতান উঠল।

    এমন সময় থপাস থুপ! পদ্মপাতার ওপর—এত্তবড়ো ব্যাং। ব্যাং গলায় গমক দিয়ে ধমক দিলে— ‘কী হয়েছে অ্যাঃ! রাতদুপুরে পুকুরপাড়ে কী হচ্ছে! যত-সব—’

    ধমক খেয়ে খোকনসোনা আরও জোরে কেঁদে উঠল।

    ‘আবার কাঁদে! চুপ করলি? দেখবি এক্ষুনি কান মলে দেব।’

    ভয়ে-ময়ে সোনা কান্নার সুর নামিয়ে ফুঁস-স, ফুঁস-স করতে লাগল।

    ‘কী হয়েছে এ্যাকী। রাতদুপুরে পুকুর পাড়ে এক্কেবারে ছুঁচোর কেত্তন শুরু করে দিয়েছে। বল কী হয়েছে?’

    সোনা ভয়ে জুজু হয়ে গলা কাঠ করে বললে, ‘দেখো না আমাদের বন্ধু প্যাঁক-প্যাঁক জলে ডুবে গেছে। নৌকো চেপে তাকে তুলতে এসেছিলুম, আমার নৌকোও ডুবে গেছে। পুকুরপাড়ে হাতি আর পুষি কাঁদছে। আমি যেতে পারছি না।’

    ব্যাং ভেংচি কেটে বলে উঠল, ‘ন্যাকা! তা তোদের কেন জলের ধারে ঘুর ঘুর! পুতুল, পুতুলের মতো, থাকতে পারিস না। কই প্যাঁক-প্যাঁক কই?’

    ‘ওই যে—ওই! তুমি ওকে তুলে দাও না! আর কক্ষনো এমন কাজ করব না।’

    ‘বেশ, আমি তুলে দিচ্ছি। ফের যদি দেখি কোনোদিন পুকুর পাড়ে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না।’— বলেই ব্যাং গ্যাঙ করে জলের মধ্যে ডুব দিলে। ডুব-সাঁতারে প্যাঁক-প্যাঁকের কাছে গিয়ে ঠোঁট দিয়ে ল্যাজ চিপটে টেনে নিয়ে তুলল পদ্মপাতার ওপর। পদ্মপাতায় উঠেই প্যাঁক-প্যাঁক হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে কী—গতর ঠকঠকিয়ে কাঁপছে, বুক ধুকপুক নাচছে, পেট আইঢাই করছে!

    ব্যাং বললে, ‘না, আর বেশি দেরি করলে চলবে না। এক্ষুনি কবরেজখানায় যেতে হবে। পেটের ওপর নুনের বস্তা চাপাতে হবে।’

    সোনা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ‘কেমন করে ডাঙায় যাব?’

    ‘ব্যবস্থা করে দিচ্ছি!’ বলেই ব্যাং পদ্মপাতার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মুখ দিয়ে পদ্মপাতার ডাঁটি কুট কুট করে কেটে ফেললে। পদ্মপাতা ভেসে উঠল। ছুটে গাবদার কাছে ঢিল নোঙরের সুতোটা নিয়ে—পাতার ডাঁটিতে বেঁধে দিলে। হেঁকে বললে, ‘হাতি সুতো টানো।’ হাতি শুঁড়ে করে সুতো টানতে লাগল। পদ্মপাতার ওপর প্যাঁক-প্যাঁক আর খোকনসোনা বসে বসে ভেসে ভেসে চলল।

    পদ্মপাতা ডাঙায় লাগতেই সোনা-পুতু তরতরিয়ে নেমে গেল। প্যাঁক-প্যাঁক নড়তে পারে না, মুখ দিয়ে রা বেরোয় না।

    হাতি তাড়াতাড়ি শুঁড় দিয়ে আলতো করে প্যাঁক-প্যাঁককে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুললে। ব্যাংও ওপরে উঠে এল। তারপর ব্যাং চোখ পাকিয়ে বললে, ‘আর যদি কোনোদিন দেখি পুকুর পাড়ে তাহলে—’ কথা শেষ না হতেই—প্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁক—ফ্যাঁ-স-স-স-স ‘অ্যাঃ ম্যাগো ম্যা:’ ব্যাঙের ধমক খেয়ে হাতি চমকে উঠে যেই না প্যাঁক-প্যাঁককে শুঁড়ে করে বেসামাল চেপে ধরেছে—বলব কী—অমনি পিচকিরি দিয়ে হাঁসের পেটের যত রাজ্যের জল সব ছেঁদা দিয়ে এক্কেবারে ব্যাঙের মুখে! তখন রাগে টং ব্যাং প্রথমে হকচকিয়ে গিসল। তারপর ব্যাপার দেখে নিজেই ব্যাঙ-ঙ-ঙ-ঙ করে এমন হেসে উঠল যে, সেই হাসি দেখে গাবদা-হাতি, ম্যাঁও-ম্যাঁও পুষি, সোনা-পুতু কেউ না হেসে থাকতে পারল না। হো-হো-হি-হি! পেটের জল বেরিয়ে যেতে প্যাঁক প্যাঁক হাঁফ চেড়ে বাঁচল। হঠাৎ মুখে কথাও ফুটল। মুখ চুপসে বললে, ‘কবরেজখানায় আমি যাব না। নুনের বস্তা পেটে দেব না। আমি ভালো হয়ে গেছি।’ ব্যাং বললে, ‘কই দেখি।’ পেটটা টিপে-টাপে বললে, ‘হ্যাঁ, যাক খুব ভাগ্যি সব জল বেরিয়ে গেছে। এখন ঘরে চলো। চলো আমি তোমাদের পৌঁছে দিই। সোনা আমার পিঠে চাপো।’

    ব্যাঙের পিঠে সোনা চাপল, হাতির পিঠে ম্যাঁও ম্যাঁও, প্যাঁক প্যাঁক। ঘরে পৌঁছে ব্যাং বললে, ‘এবার যাই।’ খোকা বললে, ‘দাঁড়াও একটু।’ তারপর ছুট্টে গিয়ে পুতুলবাক্সের ডালা খুলে একটু রঙিন ছবি আঁকা কাগজ নিলে। নিয়ে কী লিখলে। তারপর ব্যাঙের হাতে দিলে। ব্যাং খুলে দেখলে—লেখা। ‘কাল আমাদের খেলাঘরে তোমার নেমন্তন্ন! আসবে কিন্তু।’ ব্যাং চুক করে সোনার মুখে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বলল—‘ঠিক আসব।’ তারপর ব্যাং থপথপিয়ে লাফ দিয়ে চলে গেল।

    টীকা