ফক্কাই-ফরফর
শৈলেন ঘোষ দ্বারাএকটা ছিল কাক। তার নাম কাকতু। কালো কুচকুচে। যেমন ছিরি, তেমনই ক্যারকেরে গলা। ডাকলে কান ঝালাপালা! তার ওপরে আবার এমন পেটুক, যেটি নজরে পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে সেটি মুখে পোরার জন্যে নোলা টসটস করবে! সে রসগোল্লাই হোক, কি মরা-পচা ইঁদুর। আরে ভাই, সেদিন হয়েছে কী, কাকতু খুকুর একবাটি দুধে মুখ ডুবিয়ে চোঁ চোঁ করে গিলতে শুরু করে দিয়েছে। ঠাম্মা দেখতে পেয়েছে। কিন্তু যখন দেখতে পেল তখন কাজ সারা। ‘গেল গেল’ বলে দিয়েছে তাড়া। কিন্তু তখন আর তাড়া দিলে কী হবে। দুধটা তো গেল! কাকের মুখের এঁটো দুধ সে তো আর অন্য কারো মুখে দেওয়ার নয়। ঠাম্মারই তো দোষ, তুমি একবাটি দুধ খোলা রেখে অমন অন্যমনস্ক হও কেন? বয়েস হলে মানুষের এই এক দোষ। সময় নেই, অসময় নেই যখন-তখন অন্যমনস্ক হয়ে যত রাজ্যের ফেলে-আসা দিনের কথা ভাবতে বসবে। আর সেই ফাঁকে কাকতুও দিয়েছে দুধে চুমুক। কী জানি বাবা, কাক যে কেমন করে বুঝতে পারে, কে কখন অন্যমনস্ক হয়ে অন্য কথা ভাবে, তা সে কাকই জানে!
সে না হয় হল, এদিকে কাকতু তাড়া খেয়ে চোখের পলকে হাওয়া। গিয়ে বসল পাঁচিলে। পাঁচিলে বসে ডানা ঝাপটে এমন নাচতে লাগল আর ডাকতে লাগল যে, দেখলে ঠিক মনে হবে ঠাম্মাকে ভ্যাংচাচ্ছে! ঠাম্মাও কম যায় না, চিল চেঁচিয়ে পাড়া মাত করল, এই বুঝি দলে দলে পাড়ার লোক ছুটে আসে! পাড়ার লোক অবশ্য ছুটে এল না, কিন্তু চেঁচামেচির সময় ঠাম্মার মুখ দিয়ে যেসব কথা ছিটকে বেরিয়ে এল, তাতেই কাকতুর নাচ মাথায় উঠল! সত্যি কথাই তো, তুমি যদি রেগেমেগে নাচিয়েকে চিৎকার করে বলো, হ্যাংলা-কেলে, চোরচোট্টা, ছ্যাঁচোড়, বাটপাড়, তখন কার আর নাচের মেজাজ থাকে! নাচ থামল বটে, কিন্তু কাকের মন গেল চুপসে। মন বলল, সত্যিই কি সে চোর! সত্যিই তো সে কালো! সে অন্যসব পাখির মতো সুন্দর নয়! অন্যসব পাখির রঙের কত বাহার তাদের নরম তুলতুলে পালকে! অবশ্য কোকিলও মিশকালো, কিন্তু তাদের কী মিষ্টি গলা। কোকিলের ডাক শুনলে, সবার মুখে হাসি ফোটে। কাকতুর ডাক শুনলে সবাই দুরদুর করে তেড়ে আসে! আসলে, সে-ও তো পাখি। অন্য পাখিদের মতো তাদের কেন ভালোবাসে না কেউ!
না, সে আর একমুহূর্তও পাঁচিলে বসে ডাকল না, নাচলও না। একটু দূরে তাদের অশত্থগাছের বাসায় উড়ে এসে বসল। মন খারাপ হলে মানুষের যেমন হয়, কাকদেরও তেমন হয় কি না কে জানে! তবে একথাটা ঠিক, এখন কাকতুকে দেখলে তোমার মনে হবেই হবে মুখখানা যেন ভার করে সে বাসায় বসে আছে। অবিশ্যি, তার সেই ভারমুখ এখন অন্য আর কে দেখতে যাচ্ছে!
আরে বাবা, অন্যকে দেখতে হবে না। ওই দেখো, যার দেখার সে ঠিক দেখতে পেয়েছে। সে আর কেউ নয় যার ডালের কোলে কাকতুরা বাসা বেঁধেছে সেই কাকতুর দাদু অশত্থগাছ। কাকতু তাকে ‘অশথদাদু’ বলেই ডাকে। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ গাছ বলে উঠল, ‘কী রে কাকতু, অমন মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?’
আচমকা অশথদাদুর গলা শনে কাকতুর বুকটা ছাঁৎ করে উঠেছে। উঠতেই পারে। সেটা এমন কিছু আশ্চর্যের নয়। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের সেটা হল, কাকতুর মনটা যে সত্যিই খারাপ সেটা অশথদাদু বুঝল কেমন করে! বুঝবে না? এ তো খুব সহজ। এই অশথদাদুর ঘাড়ে-গর্দানে উড়ে-বসে-শুয়ে সারাদিন কি কম দস্যিপনা করে কাকতু। কাকতু যেমন ছোট্ট, তেমনই তার একটা পুঁচকে কাঠবেড়ালি বন্ধুও আছে। গাছের ডালে লাফিয়ে ছুটে দুটিতে যখন খেলা করে, তখন যে অশথদাদু চটেমটে একেবারে তুলকালাম শুরু করে দেয়, তা যেন ভেব না। বরং খেলাধুলো না করলেই দাদুর মন খুঁতখুঁত করে। ভাবে কাকতুর কিছু হল নাকি! অশথদাদু বড্ড ভালোবাসে কাকতুকে।
তাই প্রথমবার কথার উত্তর না পেয়ে দ্বিতীয়বার দাদু যখন আবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘কী রে কাকতু, কথা বলছিস না কেন?’ তখন কাকতু একটু বিরক্ত হয়েই উত্তর দিল, ‘বলতে ইচ্ছে করলে তবে তো বলব!’
‘কেন, রে, ইচ্ছে করছে না কেন?’
‘কেমন করে ইচ্ছে করবে। কেউ যদি তোমাকে মুখ খিঁচিয়ে বলে, ‘হ্যাংলা-কেলে, চোর-ছ্যাঁচোড়, তখন কারোর মুখ দিয়ে কথা বেরোয়?’
এতক্ষণে অশথদাদু বুঝতে পারল, কাকতুর মন খারাপের আসল রহস্য। তাই, খুব উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এমন কথা তোকে কে বলেছে?’
‘কেন, যার বলার কথা সে-ই বলেছে। বলেছে ওই পাশের বাড়ির ঠাম্মা। দোষের মধ্যে কী, না আমি খুকুর দুধের বাটিতে একটুখানি মুখ ডুবিয়ে চুমুক দিয়েছি, তাতেই বুড়ি রেগে টং। চোখ পাকিয়ে সে কী মুখঝামটা! তা-ও না হয় সহ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে তুমি আমায় হ্যাংলা-কেলে বলে গাল পাড়বে!’
অশথদাদু কাকতুর কথা শুনে সারাগাছের পাতা কাঁপিয়ে, একেবারে হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘দুর বোকা, এর জন্যে তোর মন খারাপ! আরে বাবা, ভগবান যাকে যেমন করেছে সে তো তেমনই হবে। ভগবান কাক-বংশকে কালো করেছে। এই যে, আমি গাছ, দেখ না, আমার যেমন ডালপালা, তেমনই আমার গা-ভরতি সবুজ পাতা! বাঘেদের দেখ, হলুদ গায়ে কেমন ডোরা ডোরা দাগ। আরে বাবা, মানুষের কথাই ধর না! তাদের কতরকমের রঙের ছিরি। কোনো মানুষ কেলে কুচকুচে, কোনো মানুষ রঙে টুকটুকে। আরে বাবা, আমি তো পাশের বাড়ির ঠাম্মাকে দেখেছি। একবার না, কতবার দেখেছি। তারই-বা কী এমন রঙের বাহার যে, তোকে কেলে বলে গাল দেয়! যাকগে যাক, ছেড়ে দে। মানুষ তো আর আমাদের কথা বোঝে না যে, দুটো কথা শুনিয়ে শোধ নিবি।’
অশথদাদুর কথা শুনে কাকতু উত্তর দিল, ‘আমি ছেড়ে দেব না। আমি শোধ তুলে তবে ছাড়ব।’
‘তুই একটা বদ্ধ পাগল। মানুষের সঙ্গে পারা যায়! কী করে শোধ তুলবি? খাবারে ছোঁ মেরে? দুর! ক-দিন ছোঁ মারবি তুই? মারলে একদিন, দু-দিন। তিনদিনের দিন আর হচ্ছে না। তোমার নষ্টামি ঠিক ধরে ফেলবে।’
অশথদাদুর কথা শুনে কাকতু উত্তর দিল, ‘আরে বাবা, খাবারে ছোঁ মারার কথা আমি ভাবছি না, আমি ভাবছি অন্য কথা।’
‘অন্য আবার কী কথা ভাবছিস?’’
‘ভাবছি, যেমন করে হোক আমাকেও কেলে বদনাম ঘুচিয়ে মানুষের মতো টুকটুকে রং হতে হবে।’
কাকতুর কথা শুনে অশথদাদু গাছের পাতা কাঁপিয়ে আবার হেসে উঠল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘তোকে তাহলে তো ফক্কাই-ফরফরের দেশে যেতে হয়।’
ফক্কাই-ফরফর নামটা শুনে কাকতু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। তাই আমতা আমতা করে বলল, ‘এমন অদ্ভুত নাম তো এর আগে কখনো শুনিনি।’
অশথদাদু বলল, ‘শুনবি কী করে। তুই তো সেদিন জন্মালি। দুনিয়ার সব কিছু এখনই শুনে ফেলবি, সে-বয়েস এখনও কি হয়েছে তোর! যখন বয়েস হবে, তখনও দেখবি, সব শুনেও তোর মনে হবে কিচ্ছু শোনা হয়নি। এই আমার যেমন হয়েছে, এ বড়ো মস্ত ধাঁধা।’
কাকতু বলল, ‘আমার অবাক লাগছে ভাবতে, তুমি তো হাঁটতেও পারো না, ছুটতেও পারো না। তোমার পা-ও নেই, হাতও নেই। একজায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছ। তুমি ফক্কাই-ফরফরের নাম জানলে কী করে?’
অশথদাদু হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ‘ঠিক ধরেছিস। বলতে কী এ-ও এক মস্ত ধাঁধা। একে বলতে পারিস আমার বরাতজোর। তোর নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে, রোজ রোদ-দুপুরে কত ক্লান্ত মানুষ আমার গাছের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেয়। এইরকমই একজন, একদিন আমার গাছের ছায়ায় তার বন্ধুকে শোনাচ্ছিল ফক্কাই-ফরফরের কথা। সে নাকি এক মস্ত জাদুকর। তার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ালেই হল। তোকে কিছু বলতে হবে না। দেখলেই সে বুঝে নেবে তুই কী চাস! চোখের পলকে তাই পেয়ে যাবি!’
কাকতু খুব উন্মুখ হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার গায়ের রং-ও?’
‘আলবাত, তবে আর বলছি কী!’ অশথদাদু উত্তর দিল।
‘তুমি তাহলে বলে দাও ফক্কাই-ফরফর কোথায় থাকে। আমি তার কাছে যাব।’
‘দেখ, আমি যতদূর শুনেছি ফক্কাই-ফরফর উত্তরেও থাকে না, দক্ষিণেও থাকে না। না পুবে, না পশ্চিমে।’
কাকতু অশথদাদুর কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা! সে আবার কী?’
‘আরও শোন ফক্কাই-ফরফরের দেশে, আলোও নেই, আঁধারও নেই। ভালোও নেই, মন্দও নেই। শেষও নেই শুরুও নেই। তুই জানতেও পারবি না, অজান্তে কখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিস। কেন-না, তাকে দেখাও যায় না, তার কথা শোনাও যায় না। তোকে দেখলেই সে গপ করে গিলে ফেলবে। তারপর যখন চোখের পলকে উগরে দিয়ে পেট থেকে বার করে দেবে, তখন দেখবি তোর গায়ের রং পালটে গেছে! এই যে এতগুলো কান্ড একসঙ্গে হয়ে গেল, তুই তার নাড়ি-নক্ষত্র কিছুই জানতে পারবি না। দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবি, তোর পালকের রং একেবারে মানুষের গায়ের রং হয়ে গেছে!’
কাকতু আনন্দে কঁকিয়ে উঠল, ‘সত্যি?’
‘তবে আর বলছি কী?’
‘তবে তো আমাকে ফক্কাই-ফরফরের দেশটা যেমন করে হোক খুঁজে বার করতে হয়।’
অশথদাদু উত্তর দিল, ‘দেখ, যদি খুঁজে পাস।’
অশথদাদুর কথা শুনে কাকতুর আর তর সইল না। সঙ্গে সঙ্গে সে বেরিয়ে পড়ল। কোথাও যেতে গেলে মানুষের যেমন সাতপাঁচ ভেবে, বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে, মনের মতো পোশাক বার করে, পরে, তবে বাইরে বেরোতে হয়, পশুপাখিদের তো আর ওসব ঝামেলা নেই। যেমনটি সেজে জন্মেছ তেমনটিই তোমার সাজ। তাই কাকতুর দেরি হল না। আকাশপথে পাড়ি দিয়ে চলল উড়ে।
অনেকক্ষণ উড়ল। উড়তে উড়তে অনেকটা এসে, শূন্যপথে, কাকতু যখন ভাবছে এবার সে কোনদিকে যাবে, অদ্ভুত কথা— ঠিক তখনই কোথাও কিছু নেই, কোনদিক থেকে যে কে বলে উঠল, ‘সামনে শূন্য, পেছনে ধু-ধু। ডাইনে খাঁ-খাঁ, বাঁয়ে ফক্কা।’
‘ফক্কা’ শব্দটা শুনে কাকতুর বুকটা ধড়াস করে উঠল। কে কথা বলল না-বলল, সেসব কথা না ভেবে, কাকতু নিমেষে নিজের বাঁদিকে পাঁই পাঁই করে উড়তে শুরু করে দিল। তাকে উড়তে দেখে সেই অদৃশ্য কন্ঠস্বর হা-হা করে হেসে উঠল। সে হাসি কাকতুর কানেও গেল না।
বাতাসে একটানা ডানা ঝাপটে ঝাপটে উড়ে, দেখো, এখন যেন মনে হচ্ছে কাকতু একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু কেন, দেখে তো মনে হচ্ছে, বেশ ভালোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
এখন কী হবে?
ভাবনা তো সেইটাই। বাঁদিকে তো এসেও পড়েছে বেশ খানিকটা।
আর ঠিক তক্ষুনি ঘটল আবার সেই আশ্চর্য ঘটনা। কোথা থেকে কে যেন আবার কয়ে উঠল, ‘সামনে ভোঁ-ভাঁ পেছনে নির্জন, বাঁয়ে নি:সাড়, ডাইনে ফক্কা।’
এতক্ষণ তো কাকতু তার বাঁয়েই উড়ছিল। এখন আবার তাকে ডাইনে যেতে হবে! এ তো ভারি গোলমেলে কান্ড। তার চোখের আড়াল থেকে কে তাকে এমন গন্ডগোলের চক্করে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে! জিজ্ঞেস করে দেখতে হয় তো!
তাই কাকতু এইবার একটু ধীরে ধীরে উড়তে লাগল। উড়তে উড়তে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুমি? আমার চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছ?’
‘আমি? তুই যেমন তোর মতো, আমিও তেমনই আমার মতো।’
কাকতু বলল, ‘এটা কি একটা উত্তর হল?’
‘তাহলে, কী উত্তর দেব বল? কী উত্তর শুনবি তুই?’
‘তোমার মুখে আমি উত্তর শুনতে চাই না। তোমাকে আমার চোখে দেখতে চাই!’
‘দুর বোকা, আমাকে চোখে দেখা যায় নাকি! আমি যে মরীচিকা। আমি গর্জন নই, বর্ষণ নই, আমি ফক্কা!’
চমকে উঠল কাকতু। শূন্যে থমকে গেল তার ডানার ঝাপটানি। আনন্দে চিৎকার করে সে এমন কক কক করে উঠল যে, সে আর সামলাতে পারল না নিজেকে। বেসামাল হয়ে এই শূন্য আকাশ থেকে গোঁত খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। ভীষণ যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে সে কান্না জুড়ে দিল। ক্লান্ত কাকতু আর্তনাদ করে ককিয়ে উঠল। আহত ডানা দুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে প্রচন্ড ধড়ফড় করতে লাগল। আর কতক্ষণই-বা পারবে এমন ধড়ফড় করতে। ধড়ফড় করতে করতে থিতিয়ে এল তার গলার স্বর, ডানার ঝটপটানিও। তারপর ধীরে ধীরে নিশ্চল হয়ে গেল তার সারাদেহ। মনে হয়, তার ধড়ে আর প্রাণ নেই!
সে এখন যেখানে পড়ে আছে, সেটা একটা বালুচর। শোনা যাচ্ছে, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ-এর গর্জন। আর দেখা যাচ্ছে, একটি মানুষকে নি:সঙ্গ একা। তার ছিরিও নেই, ছাঁদও নেই। ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল মাথায়। এলোমেলো। ছেঁড়া-খোঁড়া ময়লা পরনের পোশাক। কেমন যেন অদ্ভুত, আধ-পাগল একটা মানুষ। বালুচরে বসে বসে যেন সাগরের ঢেউ গুনছে, আর মুখে বাদাম চিবোচ্ছে! সে আচমকা দেখতে পেয়েছে কাকতুকে আকাশ থেকে পড়তে। দেখেছে, কাকটা বালির ওপর পড়ে চিৎপাত। খানিক ঝটপট করে, এখন আস্তে আস্তে থিতিয়ে গেছে।
রোগাপটকা লোকটা তড়বড় করে ছুটে এল কাকতুর কাছে। হাতের বাদাম পকেটে পুরে কাকটাকে তুলে নিল নিজের হাতে। না, মরেনি। এখনও প্রাণটা ধুকধুক করছে। কাকতুকে মুঠোয় ধরে তিরবেগে ছুটে গেল সমুদ্র কিনারে। কাকতুর চোখে-মুখে মৃদু মৃদু জলের ঝাপটা দিল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল কাকতু। তারপরেই চমকে লোকটার মুঠির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ঝটাপটি শুরু করে দিল। মুঠি খুলে দিল সেই মানুষটা। কিন্তু হলে কী হবে, কাকতু শত চেষ্টা করেও, ডানা মেলে আকাশে উড়তে পারল না। বারবার চেষ্টা করেও হার মানতে হচ্ছে বারবারই।
শেষমেশ সেই মানুষটি স্নিগ্ধ চোখে তাকাল কাকতুর চোখের দিকে। মুখে হাসি। জামার ছেঁড়া পকেট থেকে, যে-কটা বাদাম ছিল, সব ক-টা বার করল। তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকল কাকতুকে। বলল, ‘আয় আমার কাছে। খাব দুজনে একসঙ্গে। তোর মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ তুই খাসনি, তোর খিদে পেয়েছে। আয়, আয়!’
কাকতু মানুষটার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল খানিক। মনে মনে ভাবল, এই কি সেই ফক্কাই-ফরফর!
না, হঠাৎ তার মনে হল, এ কখনোই ফক্কাই-ফরফর হতে পারে না। সে তো ফক্কা? শূন্য। এ একজন মানুষ। দুঃখী। এই মানুষটার মনে দয়া আছে, মায়া আছে। এ নিশ্চয়ই আমার কোনো ক্ষতি করবে না। ভালোবাসবে! এই কথা ভাবতে ভাবতে সে আহত পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটা হাতের মুঠি খুলে দিল। কাকতু একটু দোনামনা করে ঠোঁট ঠেকাল তার হাতে। তুলে নিল বাদাম। লোকটাও একটুকরো বাদাম নিজের মুখে দিয়ে, খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে কাকতুকে তুলে নিল নিজের কোলে। তারপর কাকতুর কপালে একটা চুমু দিয়ে আদর করল। বলল, ‘তুই আমার কালো সোনা’।
কাকতু কেঁদে ফেলল।