ফাটিস
শৈলেন ঘোষ দ্বারামিম আর ম্যাম এইটুকুনি পুঁচকে দুই বেড়ালছানা। দুই ভাই। মিম বড়ো, ম্যাম ছোটো। তাও কী, মাত্তর দেড় মিনিটের ছোটো-বড়ো। যাকগে, সে তো অন্য কথা। কিন্তু যে-কথাটা নিয়ে আজ দু-ভাই সকাল থেকে ভীষণ ভাবনায় পড়েছে, সেটাই আসল কথা। কী, না মা দু-ভাইকে বলেছে, ‘তোমরা বড়ো হচ্ছ। আর নেচেকুঁদে বেড়ালে চলবে না। এবার থেকে একটু একটু কাজ করতে হবে, বুঝলে!’
দু-ভাই একসঙ্গে একেবারে উপচে পড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কাজ মা, কী কাজ?’
‘বেড়ালদের যা কাজ, নেংটি ধরতে হবে!’
বাবা, নেংটি ধরা কি সহজ কাজ! ধুমসো ধুমসো হুলোবেড়ালই নেংটি ধরতে হিমশিম খেয়ে যায়, তো সেখানে মিম আর ম্যাম তো ফুটকড়াই! কাজেই দু-ভাই যে ভাবনায় পড়বে এ আর এমন কী নতুন কথা। অগত্যা মিম ছোটোভাই ম্যামকে বলল, ‘আর ভেবে কী করবি? ভয় পেলে তো চলবে না। চ, দুজনে নেংটির গর্তের সামনে গিয়ে বসি। দেখি বরাতে নেংটি জোটে কি না!’
‘তাই চ।’ বলে দু-ভাই নেংটির গর্ত খুঁজতে বেরোল। ভাঁড়ারঘরের দেরাজের পেছনে একটা গর্ত পেয়েও গেল। দুটিতে গর্তের দিকে ঠায় তাকিয়ে বসেও রইল। কিন্তু কোথায় কী! নেংটির দেখা তো মিললই না, এমনকী আরশোলারও টিকিটি পর্যন্ত নজরে পড়ল না। অথচ একটু একটু করে রাতও বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে খিদেও পাচ্ছে। তখন আর কী করা! ম্যাম বলল, ‘মিমদাদা, চলো, মায়ের কাছে ফিরে যাই। আবার কাল চেষ্টা করব।’
মিম বলল, ‘না ম্যাম, আজ আমাদের নেংটি ধরতেই হবে। নেংটি ধরে, মাকে দেখিয়ে তবে অন্য কথা। তুই বরং এক কাজ কর, তুই এই ঘরেই নেংটির খোঁজ কর। আমি যাই খুকুর পড়ার ঘরে। শুনেছি, খুকুর পড়ার ঘরে নেংটি আসে বইয়ের পাতা কাটতে। দেখি ধরতে পারি কি না। দুজনে একজায়গায় বসে থাকার চেয়ে সেটা ভালো না?’
ম্যাম বলল, ‘কিন্তু আমায় একলা পেয়ে নেংটি যদি কামড়ে দেয়!’
‘দুর, তুই ছাড় তো! নেংটি কখনো বেড়ালকে কামড়ায়। তোর কিচ্ছু ভয় নেই। উলটে নেংটিই তোকে দেখে ভয়ে পালাবে।’
হলও তা-ই। মিম খুকুর পড়ার ঘরে চলে গেল। পড়ার ঘরে টেবিলের নীচে ঘাপটি মেরে বসে রইল। আর, ভাঁড়ারঘরে ম্যাম গর্তটা তাক করে নেংটি ধরার জন্যে ওঁত পেতে রইল।
এমন সময় যা ভাবা তা-ই ঘটল বুঝি! পড়ার ঘরে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন মিমের মনে হল, টেবিলের ওপর কী একটা খসখস করে নড়ছে! টেবিলের নীচ থেকে উঁকি মেরে দেখেই তার মনে হয়েছে এ নির্ঘাত নেংটি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আলতো পায়ে ছুট দিয়ে একেবারে ম্যামের কাছে।
ম্যাম ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী? কী? ব্যাপার কী?’
মিম গলার স্বর নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘নেংটি!’
‘কোথায়?’
‘খুকুর পড়ার টেবিলে।’
‘চ, চ,’ বলে দু-ভাই ছুটল খুকুর পড়ার ঘরে। পড়ার ঘরে পৌঁছে, মিম ম্যামকে ইশারায় দেখাল টেবিলের ওপরটা। হ্যাঁ, সত্যিই তো বটে টেবিলের ওপর কী যেন খসখস করছে! মিম ম্যামকে বলল, ‘তুই এখানে দাঁড়া।’
তারপর মিম নি:শব্দে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেল। চেয়ারের ওপর মারল লাফ! চেয়ারের ওপর থেকে টেবিলে উঠেই ধরেছে কামড়ে নেংটিটাকে! আর কী, শিকার এখন মিমের মুখে!
হায় কপাল! এটা নেংটি কোথায়?
তবে?
ওই শোনো কে চেঁচাচ্ছে, ‘উঁ:! হু-হু-হু! পুষি, ছাড়! ছাড়! আমি নেংটি নই, নেংটি নই, নেংটির বদলে তুই আমার ল্যাজ কামড়ে ধরেছিস। আমি খুকুর খেলনা ভেড়া।’
বলার সঙ্গে সঙ্গে মিম নিজের মুখ সরিয়ে নিয়েছে খেলনা ভেড়ার ল্যাজ থেকে। ছি: ছি:, কী লজ্জা! কী লজ্জা! প্রথম দিনই নেংটি ধরতে গিয়ে শেষে কিনা ভেড়ার ল্যাজ কামড়ে ধরল! মিম-এর যেমন লজ্জা হচ্ছিল, রাগও হচ্ছিল তেমনই। রাগটা গিয়ে পড়ল ভেড়ার ওপর। তিরিক্ষি মেজাজে ভেড়াকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এত রাত্তিরে খুকুর বই-এর টেবিলে উঠেছিস কেন? চুরি-চামারি করার অভ্যেস আছে বুঝি? তুই চোর। আমি চেঁচাব। চেঁচিয়ে সব ফাঁস করে দেব।’
ভেড়া ভাবল, এই রে, যা:! সব বুঝি ‘উলটা বুঝিলি রাম’ হয়ে গেল! তাই সে বলল, ‘আমার সব কথা না-শুনে তুই ঝুটমুট আমাকে চোর বলছিস। জানিস তো, পুজো আসছে। কাল মহালয়া। সবাই খুকুকে কত উপহার দিচ্ছে। অথচ, যে-খুকু আমাদের এত ভালোবাসে, এত আদর-যত্ন করে, তাকে আমরা কিছুই দিতে পারি না। তাই আমি ঠিক করেছি, এবার আমি খুকুকে একটা কিছু উপহার দেব।’
ভেড়ার কথা শুনে মিম বলল, ‘তোর শখটা নেহাত মন্দ নয়। তবে তার জন্যে এই রাতদুপুরে চুপিসাড়ে টেবিলে উঠে কী ঘাঁটাঘাঁটি করছিস?’
‘রঙের বাক্স খুঁজছি।’
‘রং কী হবে?’
ভেড়া উত্তর দিল, ‘সাধ করে কি আর রঙের বাক্স খুঁজছি।’
মিম জিজ্ঞেস করল, ‘সেটা না হয় বুঝলুম, সাধ করে খুঁজছিস না। কিন্তু খুঁজছিস কেন?’
‘জানিস আমি একটু-আধটু ছবি আঁকতে পারি।’ উত্তর দিল ভেড়া।
উত্তর শুনে মিম বলল, ‘বলিস কীরে! তার মানে তুই ফাটিস।’
এই নির্জন রাতদুপুরে মিমের কথা শুনে ভেড়া আর একটু হলে সত্যিই হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। খুব সামলে গেছে। সামলে গিয়ে মিমকে বলল, ‘আমি ফাটতে যাব কোন দুঃখে!’
‘তবে যে বললি তুই একটু-আধটু ছবি আঁকতে পারিস। আমি তো জানি যারা ছবি আঁকতে পারে তাদের ফাটিস বলে।’
মিমের উত্তর শুনে ভেড়া চেপেচুপে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘তোর মুন্ডু। তাদের ফাটিস বলে না। বলে আর্টিস্ট!’
এতক্ষণ ম্যাম চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কথা কয়ে উঠল, ‘এ আবার কোন-দিশি কথা?’
ভেড়া উত্তর দিল, ‘বিদিশি।’
‘বিদিশি কথা তুই জানিস?’ আবার জিজ্ঞেস করল ম্যাম।
এবার ভেড়া বেশ মেজাজি গলায় উত্তর দিল, ‘তা না হলে তোদের ভুল ভেঙে ফাটিসকে আর্টিস্ট বললুম কী করে?’
ভেড়ার কথা শুনে-টুনে মিম বলল, ‘তোর তো তাহলে অনেক গুণ। তুই বিদিশি কথাও জানিস, আবার ছবিও আঁকতে পারিস। তা কী ছবি এঁকে খুকুকে উপহার দিবি?’
‘দেখি। আগে তো রঙের বাক্স খুঁজে বার করি, তারপর ভাবব কী ছবি আঁকব।’
তখন মিম আর ম্যাম দুই পুষি বেড়ালও ভেড়ার কথায় সায় দিয়ে, ভেড়ার সঙ্গে বাক্সের খোঁজ-তালাশি শুরু করল।
এই ভালো যে তাদের বেশিক্ষণ মেহনত করতে হয়নি। একটু পরেই ভেড়া নিজেই খুঁজে পেল রঙের বাক্স। নিজেই একটা খুকুর সাদাপাতার খাতা খুঁজে বার করে নিয়ে জানলার ধারে গিয়ে বসল। জানলা দিয়ে খুকুর পড়ার ঘরে চাঁদের আলো আসছে। সেই চাঁদের আলোয় ভেড়া খুকুর খাতায় ছবি আঁকতে শুরু করল। মিম আর ম্যাম ভেড়ার পাশে বসে ভেড়ার ছবি আঁকা দেখতে লাগল।
দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল।
দেখতে দেখতে খুকুর খাতার পাতায় একটা পাখি আঁকা হয়ে গেল ভেড়ার।
দেখতে দেখতে এ-রংটা সে-রংটা পাখির গায়ে বুলিয়ে রাঙিয়ে দিতেই ঝলমল করে উঠল পাখি!
আর এদিকে দেখতে দেখতে চাঁদের আলো ভোরের আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শুরু করেছে। অমনি গাছের পাখি গাছে গাছে ডেকে উঠেছে!
ওমা, হঠাৎ এ কী কান্ড হল!
কী হল? কী হল?
ভেড়ার আঁকা পাখির চোখ দুটো যেন পিটপিট করে উঠল।
ওমা! ওই তো দেখছি, পাখির ডানাদুটোও যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে!
ওরে বাবা! এ কী অদ্ভূতুড়ে কান্ড! পাখিটা যে খাতা থেকে জ্যান্ত পাখির মতো উঠে দাঁড়াল! ধর! ধর!
এ কী রে! সত্যি সত্যি ধরবে বলে পুষি-ম্যাম যেই-না তেড়ে মেরেছে লাফ, অমনি, চোখের পলকে পাখি জানলা গলে ফুড়ুৎ! একেবারে শূন্যে, আকাশে। ম্যাম, মিম আর ভেড়া ছুট্টে এসেছে জানলার ধারে ধরবে বলে!
আর ধরবে। কাকে ধরবে? যাকে ধরবে, সেই পাখি তো এখন ভোরের আকাশে ডানা ছড়িয়ে দোল খাচ্ছে! আহা! দেখো দেখো, ডানায় রঙের বাহার দেখো! ভোরের আলোয় কেমন ঝলক দিচ্ছে। কে বলবে, এ এক ভেড়া-পুতুলের আঁকা ছবি! আহা রে, এই পাখিটাই যদি খুকুর পুজোর উপহার হত! তা হলে ভারি মজা হত!
আর এদিকে পুষি-ম্যাম ভাবছে, নেংটির বদলে পাখিটাকে ধরতে পারলে মা না-জানি কত খুশি হত! ফসকে গেছে। ফসকে গেছে ভালোই হয়েছে। ধরলে তো আমরা ভোরের আলোয় পাখির এমন চোখ-ঝলসানো রঙের দোলন দেখতে পেতুম না। পাখির রঙের কী বাহার! এবারে বুঝতে পারছি, ভেড়াটা সত্যিই ফাটিস নয়, আর্টিস্ট!