নাচন-নাচন বেড়ালছানা
শৈলেন ঘোষ দ্বারানাচন-নাচন বেড়ালছানা
ছেলেটির নাম বাদাম। খুব বেশি হলে আট বছর বয়েস। কাপড়টা ছেঁড়া—কোমরে বাঁধা। জামাটা ছেঁড়া-ময়লা, গায়ে। মাথায় টুপি—তালপাতার। টুপি খুললে একমাথা চুল উশকোখুশকো। ডাগর চোখ—বড্ড ক্লান্ত। মিষ্টি নিটোল মুখ—যত্ন নেই, শুকিয়ে গেছে। কেউ নেই তার। একা একা ঘুরে বেড়ায়—পাহাড়ে, শালবনে। আপন মনে গান গায়।
একদিন একা-একা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে পথের ধারে। কারা যেন আকাশে নানা রঙের পতাকার ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে এদিকে! হ্যাঁ, কত লোক। অনেক অ-নে-ক লোক। আসছে বাদ্যি বাজিয়ে বাজনদাররা। ঘোড়ার পিঠে ঘোড়সওয়ার। তার পেছনে হাতির পাল। তকমা এঁটে সিপাই-সেনা। বাব্বা কত কীরে! এ কি গোনা যায়!
ঘোড়া দেখে বাদামের মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। আহা রে! তার যদি ওই অমন নীলচে একটা ঘোড়া থাকত!
ওমা! কোথায় ছিল একটা বেড়ালছানা, বাদামের পেছনের পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ডেকে উঠল, মিঁউ!
চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল বাদাম। দেখে তার পায়ের কাছে একটা বেড়ালছানা। রাস্তার কুকুরের মতো, এটাও বোধহয় রাস্তার বেড়াল। বাদাম তাড়া দিল, ‘যা-যা!’ বলে আবার হাঁটতে শুরু করল।
বেড়ালছানা শুনলই না। সে-ও বাদামের পিছু নিল।
বাদাম বিরক্ত হল। মনে মনে ভাবল, আচ্ছা পাজি তো বেড়ালছানাটা। বাদাম রেগেমেগে রাস্তা থেকে একটা এইটুকুনি খোলামকুচি তুলে নিয়ে দিল ছুড়ে। পড়ল বেড়ালটার গায়ে। আঘাত লাগল কি না কে জানে! একবার শুধু মিউ-উ-উ করে ডেকে উঠল। সে-ডাকটা বেড়ালছানার কান্নার শব্দ, না আবদারের সুর, কে বলবে! তবে বেড়ালছানাটা আর বাদামের পিছু নিল না। যেখানে তার গায়ে খোলামকুচি ছুড়ে বাদাম তাকে মারল, সেখানেই সে বসে থাকল। বাদাম আবার হাঁটতে শুরু করল।
সত্যি কথা বলতে কী, একটুখানি হেঁটেই বাদামের মনটা ভারি খুঁতখুঁত করে উঠছে! মনে হচ্ছে ছানাটাকে খোলামকুচি দিয়ে মারাটা বোধহয় ঠিক হল না। খানিকটা পথ এসে বাদাম দাঁড়াল। পিছু ফিরে দেখল, ছানাটা যেখানে বসেছিল সেখানেই বসে আছে। বসে বসে জুলজুল করে তার দিকে তাকাচ্ছে। তার মুখখানা দেখে বাদামের কেমন যেন মায়া লাগছে। মন কেমন করে উঠল তার। সে ছুটল ছানাটার কাছে। তাকে তুলে নিল কোলে। কোলে নিয়ে বলল, বুঝতে পেরেছি, আমার মতো তোরও কেউ নেই। আমার তবুও একটা নাম আছে, তোর তাও নেই। চ, আজ থেকে তুই আমার কাছে থাকবি। আমার থাকা তো সেই পথেঘাটে। তুইও পথে পথে ঘুরিস, আমিও তাই। ভালোই হল, আমার একটা সঙ্গী পাওয়া গেল। আমি তোর নাম রাখলাম মিম। কী, পছন্দ তো?
খুশিতে বেড়ালছানার ল্যাজটা ঢেউ খেলছে!
বাদামও খুশি হয়ে, বেড়ালছানাটাকে বুকে জড়িয়ে ছুটল ওই মস্ত উঁচু পাহাড়টার দিকে।
বেড়ালছানাটাকে একথা-সেকথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেল। পাহাড়ের পায়ের কাছে, মিমকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বাদাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই সে এক কান্ড! সকালের রোদ লাগছে গাছের পাতায়। পাতা নাচছে হাওয়ায় হাওয়ায়। আর এদিকে বেড়াল নাচছে দু-পা তুলে বাদামের চোখের সামনে। অবাক বাদাম! সে তো বেড়ালের নাচ কোনোদিন দেখেনি, তাই অবাক হওয়ারই কথা। সে আনন্দে উছলে উঠে বেড়ালছানাকে তুলে নিল কোলে। এদিক ওদিক যেদিক যায়, বেড়ালছানার নাচ দেখায় সবাইকে। পয়সা পায়। একটি একটি করে অনেক পয়সা জমে গেল তার।
তাই বাদাম মিমের জন্য ঝুন-ঝুন-ঝুন ঝুমুর কিনে আনল। মিমকে নিয়ে শহরে গেল। শহরে নাচ দেখায় মিম। শহরের মানুষ বাঁদরের নাচ দেখেছে, ভালুকের নাচ দেখেছে কিন্তু বেড়ালছানার নাচ তো কোনোদিন দেখেনি, তাই দেখে শুনে সবাই থ। খবর গেল এপাড়া থেকে ওপাড়া। এর মুখ থেকে তার কানে। এ কান থেকে আর এক কানে। শেষপর্যন্ত খবরটা পৌঁছে গেল রাজবাড়িতে।
রাজবাড়িতে রাজকন্যা। ছোট্টটি। বাদামের চেয়েও ছোট্ট। রাজকন্যা বায়না ধরল, ‘মা গো, বেড়ালছানার নাচ দেখব!’
রানি ছুটলেন রাজার কাছে। হুকুম শুনে সেপাই ছুটল বাদামের কাছে। বাদামের কাঁধে চেপে মিম এল রাজবাড়িতে। বাজনা বাজে তাক দুম তাক দুম। মিম নাচে ঝুনঝুন।
নাচ দেখতে দেখতে রাজকন্যা মাকে জড়িয়ে ধরল।
‘কী হয়েছে মা?’ রানিমা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।
রাজকন্যা আবদার করল, ‘আমার চাই।’
‘কী চাই?’
‘ওই বেড়ালছানাটা।’
রানিমা ফিসফিস করে কী যেন বললেন রাজার কানে।
রাজা ফিসফিস করে কী যেন বললেন মন্ত্রীর কানে।
মন্ত্রী হাসি হাসি মুখ করে বাদামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ছেলেটা, তোর বেড়ালছানাটা দিবি?’
নাচ থেমে গেল। বাদাম মিমকে কোলে তুলে নিল চোখের পলকে। উত্তর দিল, ‘দেব না।’
‘দু-বেলা খেতে পাবি।’
‘না, না।’
‘রাজবাড়িতে থাকতে পাবি।’
‘না, না, না।’
চুপ করে গেলেন মন্ত্রী।
গম্ভীর গলায় রাজা বললেন, ‘সোনা দেব ঘড়া ঘড়া।’
‘না চাই না।’
‘রাজ্য দেব একটি জোড়া।’
‘চাই না, চাই না, চাই না।’
রাজার চোখ লাল — অপমানে। গর্জে উঠলেন, কী সাহস! একফোঁটা ছেলে রাজার মুখের ওপর কথা বলে! হাঁক পাড়লেন, ‘সিপাই!’
ছুটে এল সিপাই। একজন-দুজন করে অনেক জন। বাদামের হাত থেকে কেড়ে নিল বেড়ালছানাটা। বাদাম কেঁদে উঠল। টানতে টানতে তারা বাদামকে নিয়ে গেল বন্দিঘরে। তাকে বন্ধ করে রাখল।
বাদামের কান্না দেখে রাজকন্যার চোখও ছলছল করে ওঠে। পালাল সে নিজের ঘরে। মুখ গুঁজে শুয়ে রইল সোনার খাটে। আহা! বেড়ালছানাটাকে না চাইলে তো এমন হত না।
এখন বেড়ালছানা রাজার কোলে। রাজা হাসিহাসি মুখ করে বেড়ালছানার গালে একটা টুসকি মেরে রাজকন্যাকে ডাক দিলেন, ‘কন্যা, রাজকন্যা!’ অমনি বেড়ালছানা রাজার কোল থেকে লাফিয়ে দে ছুট! রাজা ধরতে গেলেন। রাজার মুকুট গেল ছিটকে! মাটিতে গড়াগড়ি!
বেড়ালছানা ছুটল, রাজাও ছুটলেন।
বেড়ালছানা এঘর-ওঘর ছুটতে ছুটতে একেবারে রাজার ঘরে।
লাফিয়ে উঠল সোনার খাটে।
রাজাও লাফিয়ে ওঠেন। ধরতে গেলেন ছানাটাকে।
রাজা ধরার আগে ছানাও দিল লাফ সোনার খাট থেকে মাটিতে।
রাজাও পড়লেন পা ফসকে—ধপাস! পড়েই চিৎকার করে উঠলেন,
‘রানি, ধরো ধরো।’
বেড়ালছানার পেছনে রানি ছুটলেন!
তাই না দেখে ছুটে এলেন মন্ত্রী। ঢং ঢং করে পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠল। সিপাই এল, সান্ত্রি এল দলে দলে। এল না শুধু রাজকন্যা। রাজকন্যা এল না তো কী হয়েছে, এত বড়ো রাজবাড়িতে একটা পুঁচকে বেড়ালছানা ধরার জন্য তুলকালাম শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ধরা গেল না। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেড়ালছানা ভোকাট্টা। কিন্তু ভোকাট্টা হল কোথায়?
ভোকাট্টা হল সোজা রাজকন্যার ঘরে। রাজকন্যা তখন নিজের ঘরে সোনার খাটে শুয়ে আছে মন খারাপ করে! বেড়ালছানা ছুটতে ছুটতে এসে রাজকন্যার জামায় মুখ ঠেকিয়ে টান দিল। রাজকন্যার চমক ভাঙল। রাজকন্যার মনে হল, বেড়ালছানাটা যেন তাকে কোথাও যেতে ডাকছে। রাজকন্যা ধড়ফড় করে নেমে পড়ল সোনার খাট থেকে। ছুটল ছানাটার পেছনে। চেঁচিয়ে উঠল, ‘কোথায় যাব রে? কোথায়?’
বেড়ালছানা দাঁড়াল বাদামের বন্দিশালার সামনে। রাজকন্যা পলকে কোলে তুলে নিল বেড়ালছানাকে! প্রহরীকে হুকুম করল ‘বন্দিশালা খুলে দাও!’
ঝন-ঝন-ঝনাৎ! বন্দিশালার ফটক খুলে গেল। বাদাম দেখল সামনে তার মিমকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজকন্যা। রাজকন্যার মুখে হাসি।
হাত বাড়াল রাজকন্যা। রাজকন্যার হাত ধরে বেরিয়ে এল বাদাম। সঙ্গে সঙ্গে রাজকন্যার কোল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল মিম। আনন্দে ছুট দিল।
ছুট দিল বাদামও।
বাদামের হাত ধরে ছুট দিল রাজকন্যাও। ছুট দিল রাজবাড়ির সিং দরজা পেরিয়ে বাইরে। খোলা আকাশের নীচে। ছুট-ছুট-ছুট।
রাজার চোখে অবাক চাউনি। দেখতে দেখতে রাজার চোখে হাসি ফুটল। রানিকে বললেন, ‘দেখো, দেখো, সবুজ ঘাসের ওপর আমার মেয়ে কেমন ছুটছে! ঠিক যেন রুপো-ঝরা ঝরনা!
রানি রাজার মুখে হাসি দেখে বললেন, ‘দেখো, দেখো, ছেলেটিকে সোনার রোদে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! ঠিক যেন সবুজ বনের ছোট্ট হরিণ।’
মন্ত্রী কাঁচুমাচু হয়ে মাথা চুলকোন। মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন,
‘আজ্ঞে, বেড়ালছানাটা জাদু জানে!’
মন্ত্রীর কথা শুনে রাজা হাসেন হো-হো! রানি হাসেন হি-হি-হি-হি!
রাজা, রানির হাসি শুনে কেমন বোকার মতন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন মন্ত্রীমশাই!