কাক্কাবোক্কার মুখে হাসি
শৈলেন ঘোষ দ্বারাঅবাক কান্ড! কেন অবাক কান্ড? কান্ডটা কীসের? রাজা কাক্কাবোক্কার মুখে হাসি দেখা গেছে! অ্যাঁ! সে কী কথা? রাজা কাক্কাবোক্কার মুখে হাসি! রাজাকে তো কেউ কোনোদিন হাসতে দেখেনি। রাজার মুখে হাসি দেখে ছেলে, বুড়ো একেবারে থ! তা রাজার হাসির কথা এ-কান সে-কান করতে করতে একেবারে রানিমার কানে গিয়ে পৌঁছোল, রাজার মুখে হাসি দেখা গেছে! রাজা হাসছেন! রানিমা শুনে বললেন, ‘সে কী কথা! এ খুব আনন্দের কথা! তাহলে তো দেখতে হয় কেন তিনি হাসছেন।’
এই বলে রানিমা ছুটতে ছুটতে রাজার ঘরে হাজির। এসে দেখেন, রাজা সত্যিই তো হাসছেন এবং রানিমাকে দেখে তিনি হো-হো করে হেসে উঠলেন। রানিমা অবাক হয়ে রাজাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনি হাসছেন?’
রাজা কাক্কাবোক্কা বললেন, ‘হাসির কারণ আছে বলেই তো হাসছি। হা-হা-হা-…।’
কী কারণ— কারণ আমরা জানি, কালকে রাজার জন্মদিন ছিল। রাজার জন্মদিনে আম-দরবার, দলে দলে মানুষ আসছে, দেখছে। রাজা বসে আছেন সিংহাসনে। যে যা-পারছে রাজাকে উপহার দিচ্ছে।
একটি ছোট্ট ছেলে রাজাকে একটা সৈনিক-পুতুল উপহার দিয়ে অবাক হয়ে বলল, ‘রাজামশাই, আপনার মুখখানি কখনোও দেখিনি। আজ প্রথম দেখছি। কী সুন্দর মুখ আপনার! রাজামশাই, আপনি কোনোদিন যুদ্ধ করেছেন? যুদ্ধ করেননি তো। তাই আমি যুদ্ধের সৈনিকের এই পুতুলটা আপনাকে উপহার দিলাম।’
রাজা তখনই মুচকি হাসি হাসলেন। উনি ভাবলেন তাঁর মুখখানা যে সুন্দর, এমন কথা কেউ কোনোদিন বলেনি তো। আজ একটা বাচ্চা ছেলে আমাকে বলল আমি খুব সুন্দর দেখতে। রাজা হেসে ফেললেন, হা: হা: হা:…। হাসতে হাসতে রাজা মন্ত্রীকে ডাকলেন। রানিমা তখনও দরবারে এসে হাজির হননি। মন্ত্রী এলেন। রাজা বললেন,
‘ডাকো রানিকে।’
রানিও এসে হাজির।
‘আমার মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ মহারাজ, আপনার মুখে হাসি! কী হয়েছে মহারাজ!’
‘হবে আবার কী? একটা ছোট্ট ছেলে আমাকে বলেছে, আমার মুখখানা খুব সুন্দর। তাই, আমার খুব আনন্দ। আমি খুশিতে হাসছি। কিন্তু সে আমাকে একটি কথা জিজ্ঞেস করেছে, আমি কোনোদিন যুদ্ধ করেছি কি না। কিন্তু আমি তো কোনোদিন যুদ্ধ করিনি। এবার আমি যুদ্ধ করব।’ তারপর মন্ত্রীকে বললেন,
‘আপনি সেনাপতিমশাইকে ডাকুন। ডেকে বলুন, যুদ্ধের ব্যবস্থা করতে। আমি যুদ্ধ করব।’
মন্ত্রী বললেন, ‘রাজামশাই, আপনি যুদ্ধ করবেন কার সঙ্গে? কীসের জন্য যুদ্ধ করবেন?’
‘অ্যাঁ! সে তো জানি না। আমি যুদ্ধ করব। যার সঙ্গেই হোক যুদ্ধ করব।’
সেনাপতি তো একথা শুনে হতবাক! সবাই ভাবল, রাজা বোধহয় পাগল হয়ে গেছেন। না হলে যুদ্ধ করতে চান! আর যুদ্ধ করবেনই বা কার সঙ্গে! মন্ত্রী বললেন,
‘ঠিক আছে, আমরা তাহলে দেখি। সেনাপতির সঙ্গে আলোচনা করে কার সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় কাল ভেবে আপনাকে জানাব।’
এই বলে রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মন্ত্রী সেনাপতির সঙ্গে রাজার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং রানিমা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন—সত্যিই তো, রাজা যুদ্ধ করবেন কার সঙ্গে! রাজার শত্রু কে! ভাবতে ভাবতে তিনিও তাঁর ঘরে চলে গেলেন।
রাজার রাত্রে ভালো ঘুম হল না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবলেন, হাতি-ঘোড়া না থাকলে, যুদ্ধ হবে কেমন করে! আমি ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করব। কাল সকালে মন্ত্রীকে বলব যে, যুদ্ধের হাতি-ঘোড়া জোগাড় করতে। সৈন্যসামন্ত ঠিক ঠিকভাবে তৈরি রাখতে। যুদ্ধ আমায় করতেই হবে।
মন্ত্রী এখন কী করবেন! রাজা কার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন তা তিনি নিজেই জানেন না। মন্ত্রীও জানে না, সেনাপতিও জানে না। কিন্তু রাজা যখন একবার গোঁ ধরেছেন, ‘ঘোড়া নিয়ে এসো, ঘোড়ার সওয়ারি হব আমি। আমি ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতে যাব’, তখন ঘোড়া জোগাড় করতেই হবে। মন্ত্রী ঘোড়ার খোঁজে এখানে ওখানে কিছু ঘোড়া জোগাড় করে আনলেন ও ছুটলেন। তারপর রাজাকে বললেন,
‘মহারাজ, ঘোড়া তো জোগাড় হয়েছে। সেনারা তৈরি হয়েছে। এবার বলুন, কোথায় যাবেন আপনি যুদ্ধ করতে?’
‘সেটা তো আমি জানি না। আপনি মন্ত্রী। আপনিই বলুন আমি কার সঙ্গে যুদ্ধ করব?’
মন্ত্রী বললেন, ‘আজ্ঞে মহারাজ, আপনার তো কোনো শত্রুই নেই। যুদ্ধ করতে হলে তো শত্রু চাই। শত্রু নেই, আপনার দেশের আশেপাশে কোনো রাজাও নেই। সবাই তো আপনার প্রজা। কার সঙ্গে আপনি যুদ্ধ করবেন?’
‘সে আমি জানি না। আমি আমার প্রজাদের কাছে যাব, তাদেরই জিজ্ঞেস করব, আমি কার সঙ্গে যুদ্ধ করব। ঘোড়া আস্তাবলে রাখুন।’
তারপর কী হল! রাত্রিবেলা সবাই ঘুমোচ্ছে যখন তখন আস্তাবলে কী হল কে জানে! একটা করে ঘোড়া ছাড়া পায় আর পালায় এমনি করে এক এক করে সব ক-টা ঘোড়াই পালাল। কেমন করে ছাড়া পেল, কে ছেড়ে দিল—কেউ টেরই পেল না। আস্তাবল ফাঁকা!
পরের দিন মন্ত্রী আর সেনাপতি আস্তাবলে গিয়ে দেখে, আস্তাবলে একটা ঘোড়াও তো নেই, গেল কোথায়! কী করে ছাড়া পেল! তক্ষুনি রাজার কাছে মন্ত্রী সেনাপতি দুজনেই ছুটল।
‘মহারাজ, আপনাকে কী বলব, আমরা বলেছিলুম আপনার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শত্রু আছে। আপনার আস্তাবলের সব ঘোড়াও উধাও হয়ে গেছে। কে তাদের বাঁধন খুলে দিয়েছে জানি না! সব ক-টা পালিয়ে গেছে!’
রাজার মুখের হাসি তো গেল! কাল থেকে এতক্ষণ তো হাসছিলেন। যেই একথা শুনেছেন সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীকে তেড়ে উঠলেন,
‘কে আমার ঘোড়া চুরি করেছে? কে আমার আস্তাবলে ঢুকেছে? খুঁজে বের করুন।’
রাজার হুকুম, খুঁজে বার করতেই হবে। এদিক-ওদিক চারদিকে লোক পাঠানো হল। ঘোড়াও খুঁজে পাওয়া গেল না। আর যে খুলে দিয়েছে তাকেও পাওয়া গেল না। তখন রাজামশাই ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে মন্ত্রীকে ধমকালেন। আর ধমকালে কী হবে, ঘোড়া তো খুঁজে পাওয়া গেল না, কে তাদের বাঁধন খুলে দিয়েছে তাকেও ধরা গেল না। সুতরাং খুব রেগে মেগে রাজা রাত্রিবেলা ঘুমোতে যান। সারারাত্রি তাঁর চোখে একফোঁটা ঘুম নেই। কিন্তু তাঁর মনে হল, তাঁর ঘরের ভেতর কে যেন উশখুশ করছে। কিন্তু তিনি কাউকেই দেখতে পেলেন না। পরের দিন তিনি মন্ত্রীকে ডাকলেন। সেনাপতিকে ডাকলেন। ডেকে বললেন,
‘আমার ঘরে শত্রু ঢুকেছিল। কাল আমার ঘরে আমি সারারাত্রি ঘুমোতে পারিনি। কে উশখুশ করেছে তাকে আপনারা খুঁজে বার করুন।’
‘মহারাজ, এ তো এক বিপজ্জনক ব্যাপার হল! আপনার ঘরে কে ঢুকবে? এত প্রহরী রয়েছে চারদিকে। রাজার ঘরে কে ঢুকবে? দেখুন, কোনো আরশোলা-টারশোলা ঢুকতে পারে।’
‘অ্যাঁ! আরশোলা! রাজার ঘরে আরশোলা! কোথা থেকে এল?’
‘হজুর, আসতেই পারে তো। সেদিন আপনার জন্মদিনে কত লোক এসেছিল আম-দরবারে।’
‘যাই হোক—সারারাত্রি আমার ঘর পাহারা দেবার ব্যবস্থা করুন আপনারা।’
পাহারা বসল। রাজা কখনো ঘুমোচ্ছেন। কখনো জাগছেন। হঠাৎ কী হল, কেউ দেখতে পেল না, কে যেন রাজার মাথার বালিশটা উলটে দিল। রাজা মাথায় বালিশ দিতে গিয়ে দেখেন, বালিশ উলটে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে রাজা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘আমার বালিশটা ওলটাল কে?’
কে ওলটাল সে আর কে জানে। আর কাউকে দেখতে না পেয়ে তিনি প্রহরীদের ধমকে বললেন,
‘তাহলে একাজ তোমরাই করেছ।’
তারা তো হাঁ! বলল,
‘মহারাজ, আমরা তো কেউ একাজ করিনি। আমরা তো আপনার ঘরে ঢুকিনি। আমরা তো আপনার ঘরের বাইরে থেকে ঘর পাহারা দিচ্ছি।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে তো জানি না হুজুর কী হয়েছে।’
রাজা তখন হুকুম করলেন,
‘প্রহরী, তোমরা ঘরের মধ্যেও থাকবে এবং আমি দেখব আজকের রাত্তিরে কী হয়।’
এই বলে রাজা আবার শুয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারলেন না। তারপর একটু যখন ঝিমুনি এসেছে, রাজার যখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে, প্রহরীরাও যখন আর দাঁড়াতে পারছে না, বসে পড়েছে, ঠিক তখন ঘটল আর এক ঘটনা। রাজার মুকুট যেটা ছিল রাজার ঘরে আয়নার সামনে সাজিয়ে রাখা, সেই মুকুটটা কে যেন ফেলে দিল। রাজা ঘুম ভেঙে চমকে উঠে বললেন,
‘মুকুটটা কে ফেলে দিল? দেখ দেখ দেখ!’
দেখা গেল, রাজা জন্মদিনে যেসব উপহার পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সেই সৈনিক-পুতুলটা। রাজা অবাক হয়ে দেখেন, সে চুপটি করে ঘরের এককোণে বসে আছে। তিনি ধরতে গেলেন, কিন্তু ধরতে পারলেন না। সে সুট করে সরে গেল। সেখানে ছুটে গিয়ে রাজা আবার হাতটা বাড়িয়ে ধরতে গেলেন। সৈনিক-পুতুল রাজার হাতে চিমটি কেটে সেখান থেকে দে-ছুট! কোথায় পালাল দেখা গেল না! প্রহরীদের রাজামশাই বললেন,
‘ধরো সৈনিক-পুতুল, কোথায় গেল দেখো দেখো।’
ঠিক এই সময়ে রাজা দেখলেন কী, সৈনিক-পুতুলটা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে ছুটল। প্রহরীদের তিনি বললেন,
‘বাইরে যাও, বাইরে যাও, ছোটো।’
তারা ছুটল। তাদের সঙ্গে রাজাও ছুটলেন। ছুটে তাকে ধরার জন্য চ্যাঁচামেচি লাগিয়ে দিলেন। চ্যাঁচামেচিতে সবার ঘুম ভেঙে গেল। সবাই উঠে পড়ল। উঠে পড়ে সেই সৈনিক-পুতুলটাকে ধরার জন্য তুলকালাম শুরু করে দিল! শেষে ধরা পড়ল পুতুলটা। রাজা হাঁক পেড়ে বললেন,
‘দে পুতুলটাকে জলে ডুবিয়ে। ব্যাটা জলে ডুবে মরুক।’
তারপর সেই ঘুমন্ত রাতে সবাই যে-যার ঘরে ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। রাজাও আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন তাঁর বিছানায়।
সকালবেলা সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়তেই রাজার ঘুম ভাঙল। রাজা এপাশ-ওপাশ করে যেই উঠতে গেছেন তখনই তাঁর চক্ষুস্থির! চমকে দেখেন, তাঁর পাশে শুয়ে আছে সেই সৈনিক-পুতুলটা। সে ঘুমোচ্ছে। আশ্চর্য! তার কোমরে আঁটা সেই তরোয়ালটা তো তার কোমরে দেখা যাচ্ছে না! গেল কোথায়? কোমরে তরোয়াল না-ই থাকুক, কিন্তু এখন দেখো, কী সুন্দর দেখতে লাগছে ওই ঘুমন্ত পুতুলটাকে। দেখতে দেখতে রাজা ভাবছেন, পুতুলটা যেন বসন্তের আকাশ! আবার কখনো ভাবছেন, ফুলবাগানের রঙিন গোলাপ! যুদ্ধের পোশাকে কী মানায় ওকে! আহা! ঘুমোক এখন। বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছে তখন ছুটোছুটি করে। ঘুম ভাঙলে ওকে আমি রাজপুত্রের পোশাকে সাজিয়ে দেব। ওর কোমরে তরোয়াল থাকবে না। থাকবে কোমরবন্ধনে সোনার ঝালর। বলে রাজা কাক্কাবোক্কা আলতো ঠোঁটে পুতুলের কপালে একটা চুমো দিলেন। তারপর আবার হাসলেন। তবে খুব নরম সে হাসি। কেন-না, জোরে হাসলে পুতুলের ঘুম ভেঙে যাবে যে!