ভারি আশ্চর্য আমার জীবন। আমার সেই জীবনের কথা শুনলে ভাববে, বুঝি মনগড়া গল্প। হ্যাঁ, গল্পই বটে! গল্প না হলে বনের অন্ধকারে আমি কি খুঁজে পাই একটা—না, থাক। সে গল্পটা আগে বললে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে।

    আসলে আমি একটি বাপ-মা হারা ছেলে। মানুষ হয়েছি দিদার কাছে ছোট্ট একখানা মাটির ঘরে। দিদা আনাজ বেচত বাজারে। আর, আমি পড়তুম ইশকুলে। আজ আমার ন-বছর বয়েস। আমি এই বছরে ক্লাস ফাইভে উঠেছি। আমার স্কুলের মাস্টারমশাইরা আমাকে খুব ভালোবাসেন। বলেন, ‘একদিন তুই নিশ্চয়ই খুব বড়ো হবি।’

    তা, কী বলব, মাস্টারমশাইদের কথা ফলল না। কেন-না, গঙ্গার রোষে আমাদের মাটির ঘরখানা ভেসে গেল। তার সঙ্গে দিদাও। গেল ইশকুলবাড়িটাও গঙ্গার পেটে। সেইসঙ্গে গোটা গ্রামখানাও গিলে ফেলল গঙ্গা। কাজেই আমার লেখাপড়াও খতম। আমি আর পাঁচটা লোকের মতো বেঁচে গেলুম বটে, কিন্তু আমার দিদা নিজের হাতে সাজানো ছোট্ট ঘরখানার মায়া ছাড়তে পারল না। আমাকে ঘর থেকে বার করে নিজে ঘরের সঙ্গে গঙ্গায় তলিয়ে গেল চিরদিনের জন্য। আমি যে কী করব, কোথায় থাকব, সে নিয়ে দিদা ভাবল না একবিন্দুও। এখন তোমরাই বলো, আমি কী করি!

    আমি জানতুম, গঙ্গার জলে তলিয়ে যাবে আরও দু-পাঁচটা গ্রাম। সেই ভয়ে লোকে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। যার যেটুকু সম্বল সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও পালাচ্ছি। তবে, আমার তো আর সম্বল বলে কিছু নেই। যা আছে এই গায়ে, জামা আর প্যান্ট। পালাচ্ছি বটে, কিন্তু জানি না কোথায় পালাচ্ছি। সুতরাং, যেদিকে চোখ যায় হাঁটি সেইদিকেই।

    অনেকটা হেঁটে যখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লুম, তখন কোথাও একটু না বসলেই নয়। কিন্তু ‘কোথায় বসি, কোথায় বসি’ করতে করতে আরও খানিকটা পথ পেরিয়ে এসেছি, তখন সামনেই চোখে পড়ল একটা ছোট্টমতো বাড়ি। খুব পুরোনো বলা যাবে না। আবার নতুন ঝকঝকেও বলতে পারব না। দরজা বন্ধ। জানলা খোলা। দরজার পাশে রক। এই রকেই বসে পড়লুম। আঃ! ভারি আরাম লাগল!

    খানিকটা বসতেই বোঝা গেল, জায়গাটা খুবই নির্জন। এমনকী, যে-বাড়ির রকে বসে আছি, সেই বাড়ির ভেতর থেকে সাড়া-শব্দও শোনা যাচ্ছে না। কেমন যেন সন্দেহ হল। মনে হল, তবে কি বাড়িতে কোনো মানুষজন থাকে না! অথচ জানলাটা তো খোলাই আছে। উঁকি মেরে একবার দেখা তো যায়। কিন্তু অন্যের বাড়ির খোলা জানলায় উঁকি মারাটা কি ঠিক হবে! ঘরে যদি সত্যিই কেউ থাকে, আর আমাকে জানলায় উঁকি মারতে দেখলে যদি চোর ঠাওরায়!

    যা হয় হবে! আমি থাকতে পারলুম না। জানলায় দিলুম উঁকি। দিয়েই থমকে গেছি। দেখি, একজন বুড়োমানুষ একা বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘুমোচ্ছেন কি না বোঝা গেল না। আমি যেমন তাঁকে নি:শব্দে দেখলুম, তেমনই নি:শব্দে জানলা থেকে সরে এসে আবার রকে বসে পড়লুম। ভাবতে লাগলুম, ঘরের ভেতর অন্য আর কাউকে তো দেখা গেল না। তবে কি মানুষটি একা থাকেন!

    এইসব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুবই আনচান করতে লাগল। মন বলল, মানুষটি যদি একা হন, তবে আমিও তো একা। দুজনেই যখন একা, তবে দুজনেই তো দুজনের সঙ্গী হতে পারি! অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে দু-একটি কথা বলে আলাপও তো করতে পারি! কিন্তু মানুষটি যদি আমার মতো একটি বাচ্চা ছেলেকে পাত্তা না দেন! অবিশ্যি আমার দুর্দশার কথা শুনলে তাঁর দয়াও তো হতে পারে।

    যা থাকে কপালে, আমি দিলুম দরজার কড়াটা নেড়ে!

    ‘কে র‌্যা?’ মানুষটি ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠলেন।

    ‘আমি।’

    মানুষটি তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠলেন, ‘পৃথিবীর সব মানুষই নিজেকে ‘আমি’ বলে। তোমার নামটা জানতে পারি কি?’

    আমি নাম না বলে উত্তর দিলুম, ‘আজ্ঞে আমার বড়ো বিপদ।’

    ‘আমি দরজা খুললে তোমার বিপদ কি দূর হবে? আমায় বিরক্ত করিস না। এখান থেকে কেটে পড়। নইলে পুলিশ ডাকব।’ বলে তিনি গজগজ করতে লাগলেন।

    তিনি যখন এতই বিরক্ত হচ্ছেন, তখন কথা বাড়িয়ে আর যে কোনো লাভ নেই, সেটা বুঝতে পারলুম। সুতরাং, আবার চুপচাপ বসে পড়লুম রকে। আবার চারদিক নি:ঝুম হয়ে গেল।

    কিছুক্ষণ বসার পর, যখন ভাবছি উঠি উঠি, তখনই একটি ছেলে এল। মনে হল, এ বাড়িরই ছেলে। হয়তো বুড়ো মানুষটিরই কেউ হবে। সে আমাকে কটমট করে দেখল। তারপর মুখ ভেংচে বলে উঠল, ‘তুই কী করছিস এখানে?’

    আমি উত্তর দিলুম, ‘কিছু করছি না, হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা করছে, তাই একটু বসে জিরিয়ে নিচ্ছি।’

    ‘এটা কি তোমার জিরোবার জায়গা? দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি একটি আস্ত চোর।’ সে চোটপাট করে উঠল।

    আচমকা সে যে আমায় চোর বলবে, এটা আমি একেবারেই ভাবতে পারিনি। মনটা ভীষণ কষ্টে গুমরে উঠল। আমি থাকতে না পেরে রুখে দাঁড়ালুম। বললুম, ‘তুমি আমায় চোর বলছ কেন?’

    সে তেমনই মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘তুই চোরই তো! তুই আমার টুপিটা চুরি করার জন্যে এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছিস। যা:! এখান থেকে কাট!’ বলে সে আমায় ধাক্কা মারল।

    আমি আকাশ থেকে পড়লুম! কীসের টুপি, কার টুপি আমি কিছুই জানি না। অথচ ছেলেটা মিথ্যে মিথ্যে আমার গায়ে হাত তুলল। যদিও আমি জানি, ছেলেটার সঙ্গে গায়ের জোরে আমি পারব না, তবুও আমি রোখ দেখাতে ছাড়লুম না। বললুম, ‘তুমি আমার গায়ে হাত তুললে কেন?’

    সেও তেমনি তড়পে উঠল, ‘বেশ করেছি! কী করবি কী তুই? এই তো আবার গায়ে হাত দিয়েছি।’ বলে, সে এবার আমায় বেশ জোরেই একটা ধাক্কা মারল। আমি টাল সামলাতে পারলুম না। পড়ে গেলুম ধুলোর ওপর।

    তা, আমি ছোটো হতে পারি, তুমি আমার চেয়ে বড়ো ; কিন্তু তাই বলে তুমি আমায় ঠেলে ফেলে দেবে! তুমি কে লাটসাহেব! আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলুম না। রাস্তা থেকে একটা ইট তুলে দিলুম ছুড়ে। সিধে ছেলেটার গায়ে। ভাগ্য ভালো যে তার কপালে লাগেনি। আর বলব কী, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা হুংকার ছেড়ে আমার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল। একটা দুটো কিল-চড়ও ততক্ষণে আমার ঘাড়ে-পিঠে পড়েও গেছে। আমিও যে দু-চার ঘা দিচ্ছি না, তেমন না। কিন্তু তার সঙ্গে পেরে ওঠা আমার কম্ম নয়! আমি বোধহয় কিল-ঘুষি খেতে খেতে দম আটকে মরেই যাই!

    আর, ঠিক তখনই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনাটা। এতক্ষণে ঘরের দরজা বন্ধ করে যে-মানুষটি বিছানায় শুয়েছিলেন, তিনি ধড়ফড় করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। চিৎকার করে ওই ছেলেটিকে ধমক দিলেন। তারপর তার কবল থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিলেন।

    ‘না, তুমি ওকে ছেড়ে দাও!’ ছেলেটা রাগে ফেটে পড়ে চিৎকার করে উঠল। আমাকে নিয়ে টানটানি করতে লাগল। বুড়ো মানুষটিও আমাকে ছাড়ে না, সেও নাছোড়বান্দা। অগত্যা বুড়ো মানুষটি আমাকে আগলে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। ঘরের দরজায় আগল দিয়ে দিলেন।

    ছেলেটা চেঁচায়।

    বুড়ো মানুষটিও ধমক মারেন।

    ছেলেটা ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়!

    মানুষটিও দরজা খোলেন না।

    আমি বেদম হয়ে হাঁপাই। ছেলেটা দরজায় ঠেলা মারে, ‘খুলবে কি না!’

    বুড়ো বলেন, ‘না, এমন একটা নিষ্পাপ ছেলের গায়ে তোকে হাত তুলতে দেব না!’

    ছেলেটা আরও অনেকক্ষণ দরজায় ধাক্কা মেরে চেঁচাল।

    বুড়ো মানুষটিও ছেলেটা যতক্ষণ চেঁচাল, ততক্ষণ ধমকাতে লাগলেন।

    আমি বে-বাক হয়ে সিঁটিয়ে দেখতে লাগলুম।

    শেষমেষ ছেলেটা তড়পাতে তড়পাতে দমে গেল। সে যে ঘরের জানলা দিয়ে দেখবে, তাও হল না। সেই জানলাও একফাঁকে বন্ধ করে দিয়েছেন বুড়ো মানুষটি। অগত্যা, ছেলেটা সেখান থেকে হটেই গেল বোধহয়! না কি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল আমাকে ধরবে বলে! বোঝা গেল না। তাই খটকা লাগছে! এখন আবার সেই আগের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেল চতুর্দিক।

    আমাকে ঘরের মধ্যে অমন করে সিঁটিয়ে থাকতে দেখে বুড়ো মানুষটি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। মুখে একটিও শব্দ না করে ইশারায় আমায় বসতে বললেন বিছানার ওপর। আমি চুপচাপ বসে পড়লুম। তারপর অনেকক্ষণ তিনিও কথা বললেন না, আমিও। তিনি কথা না বললেও আমাকে দেখতে লাগলেন কেমন গম্ভীর হয়ে। আমিও ভয়ে ভয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম।

    একটু পরেই তাঁর গম্ভীর মুখটা কেমন যেন শান্তমতো দেখতে লাগল।

    আমার কিন্তু ভয় ভাঙল না। আমি ভয়ে আরও কুঁকড়ে গেলুম।

    আর একটু পরে তাঁর সেই শান্ত মুখে কেমন যেন আলতো হাসির ছোঁয়া লাগল।

    আমি অবাক হয়ে গেলুম তাঁর সেই আলতো-হাসিমুখ দেখে।

    তারপর তাঁর সেই আলতো-হাসিমুখখানা হঠাৎ নি:শব্দে মিষ্টি হাসিতে উছলে উঠল।

    আমি হাঁ হয়ে গেলুম।

    তিনি আমায় আদর করে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর খুব নীচু স্বরে বললেন, ‘তোর খুব লেগেছে না রে?’

    আমি উত্তর দিতে পারলুম না।

    তিনি বললেন, ‘ও আমার ছেলে। ভারি দজ্জাল। তুই কিছু মনে করিস না।’

    সত্যি বলতে কী, তখন আমার অন্য আর কিছু মনে করার কথাই নয়। শুধু মনে হচ্ছে, নিজের ছেলেকে এইভাবে ঘরেই ঢুকতে দিলেন না তিনি? ভারি আশ্চর্য লাগল। কেন এমন করলেন তিনি? একথা আমিই বা কেমন করে জিজ্ঞেস করি তাঁকে! কাজেই তাঁর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলুম।

    ঠিক তখনই তিনি আচমকা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর নাম কী?

    এবার আমায় কথা বলতেই হল, ‘সাগর।’

    ‘কোথায় থাকিস?’

    ‘আমাদের বাড়িটা গঙ্গার জলে তলিয়ে গেছে।’

    ‘এঁ:!’ চমকে উঠলেন মানুষটি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাই তোর মুখখানা অমন শুকনো! কিছু খেয়েছিস?’

    আমার মুখে আবার কথা আটকে গেল।

    তিনি বললেন, ‘ইস, দেখ দিকিনি, তোর এই বিপদের সময় ছেলেটা তোকে মারল!’ বলে, সেই মানুষটি তাঁর তক্তপোশের নীচ থেকে একটা পাত্র টেনে বার করলেন। তার থেকে ক-খানা রুটি আর খানিকটা তরকারি অন্য আর একটা পাত্রে সাজিয়ে আমায় বললেন, ‘আয়, এখানে বোস! খেয়ে নে।’

    খিদে আমার পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে জানি না, শুনি না কোনো মানুষের ভাগের রুটি হ্যাংলার মতো খাওয়াটা কি ভালো দেখায়! তাই আমি শুধুই মাথা নাড়লুম।

    তিনি বললেন, ‘ছি:, অমন না বলতে নেই। বড়োদের কথা শুনতে হয়। নইলে লোকে নিন্দে করবে। তোর কি এখন খালিপেটে থাকার বয়েস? যত খাবি, ততই দেহে তাকত বাড়বে।’

    এতক্ষণে আমার মুখে কথা ফুটল। আমি সাহস করে বলে ফেললুম, ‘এ খাবার তো আমার খাওয়ার কথা নয়। আমার জন্যে রান্না করাও হয়নি। তোমাদের খাবার, আমার কি খাওয়া ঠিক?’

    তিনি বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস, এ খাবার তোর জন্য কেউ তৈরি করেনি। খাবার তৈরি করার কোনো মানুষ নেই এ বাড়িতে। যে ছিল, সে কবেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এ দোকান থেকে কিনে এনেছি বাপে-ছেলেতে খাব বলে। তার থেকে একটা ছোট্ট উপোসি ছেলেকে ভাগ দিলে কেউ অনাহারে মরে যাবে না। এ তো মানুষেরই কাজ রে! নে, বোস!’

    আমি দোনোমনো করতে লাগলুম। তিনি বুঝতে পেরে আমাকে জোর করে বসিয়ে দিলেন। অগত্যা আমায় মুখে দিতেই হল।

    ‘বাহ! এই তো লক্ষ্মী ছেলের কাজ।’ আমি খাচ্ছি, তিনি আমায় দেখছেন। দেখতে দেখতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন তুই কোথায় যাবি?’

    ‘জানি না।’ কেমন হতাশ গলায় বলে ফেললুম।

    ‘তোকে যে আমার কাছে থাকতে বলব, তারও উপায় নেই।’ বলে, বুড়ো মানুষটি খুব জোরে একটা নিশ্বাস ফেললেন।

    আমি চমকে তাকালুম তাঁর মুখের দিকে।

    তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ রে, উপায় নেই আমার ওই ছেলেটার জন্যে। ছেলেটা আমার মানুষ নয় রে, একটা শয়তান। লেখাপড়া করে না, আমার কথা শোনে না। সবসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে টো টো করে ঘুরে বেড়াবে, আর তিরিক্ষি মেজাজে আমাকে মুখ করবে, খেতে দাও, না হয় পয়সা দাও। পয়সা দিতে দিতে তো আমার ভাঁড়ার ফাঁকা হয়ে গেল। ছেলেকে যদি বলি, পয়সা দিতে পারব না, অমনি গোঁ ধরবে, তবে টুপি দাও!’ বলে একটু দম নিলেন মানুষটি। তারপর বললেন, ‘কী আস্পর্ধা ছেলের! জানিস, সে-টুপির কত দাম! জানিস সে-টুপিতে ক-টা হিরে গাঁথা আছে! দাও বললেই তোমার হাতে সে-টুপি দেওয়া যায়!’ বলতে বলতে আবার দম নিলেন তিনি। আমি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম।

    বোধহয় আমার মুখ দেখে তিনি বুঝতে পারলেন আমার মনের কথা। ঠিক বটে, ওই হিরে-গাঁথা টুপিটার সব গল্প শোনার জন্যে আমার মন ভীষণ উশখুশ করছে তখন। আর বলব কী, তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবার শুরুও করলেন টুপির গল্প। বললেন, ‘টুপিটা আমায় বাবা দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, এই দামি টুপিটার কত বয়েস কেউ জানে না। এই টুপি আমাদের সাতপুরুষের ধন। আমাদের খুব বিপদের বন্ধু। বিপদ মানে তো গরিব হয়ে পড়া। গরিব হলে মানুষের কষ্টের তো শেষ থাকে না। দু-বেলা দু-মুঠো খাবারও জোটে না অনেক সময়। তখন, এই দামি টুপিটা বেচে দিলে লক্ষ লক্ষ টাকা এসে যাবে তোর হাতে। তোর দুঃখ ঘুচতে পারে। কিন্তু শুনে রাখ, যারা নিষ্কর্মা, কুঁড়ে, যারা মুখ্যু, গায়ে-গতরে খেটে যারা বাঁচতে জানে না, ঘরের ধন তারাই বাজারে বেচে দেয়। সেই বেচার পয়সায় ক-দিন হেসেখেলে বেশ ভালোই কাটবে। কিন্তু তারপর? পয়সা শেষ হলে আবার যে কে সেই। কাজেই খুব বিপদে না পড়লে ঘরের ধন নষ্ট করতে নেই। খেটে বাঁচতে হয়। আর তাই বলি, টুপিটা আমাদের সাহস জোগায়। আয়াস যে করে, তার বিপদ আসে না। বন্ধুকে হারাবার ভয়ও থাকে না।’ আবার থামলেন মানুষটি। আমার মুখের দিকে চকিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বুঝলি কিছু?’

    আমি তাঁর মুখের ওপর থেকে আমার চোখ নামিয়ে নিলুম। তখন তিনি রাগত গলায় বলে উঠলেন, ‘বল, আমার মুখ্যু ছেলেকে এই টুপি কেমন করে দিই! দিলে যে টুপির কী অবস্থা হবে, কে না জানে!’

    আমি বুড়ো মানুষটির কথা শুনতে শুনতে তাঁর দেওয়া ক-খানা রুটি প্রায় শেষ করেই ফেলেছি। ঠিক এই সময়ে আবার দরজায় কড়া নড়ে উঠল। আবার বুড়ো মানুষটির ছেলের গলার শব্দ শোনা গেল, ‘দরজা খোলো।’

    ভয় পেলেন বুড়ো মানুষটি। বললেন, ‘এই রে! আবার এসেছে! কী হবে! তোকে যদি মারধর করে! না, দরজা খুলব না।’

    আমি তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে নিজেই দরজাটা খুলে দেবার জন্যে এগিয়ে গেলুম।

    তিনি আতঙ্কে চাপা গলায় বলে উঠলেন, ‘এই, কী করছিস? না, না, খুলিস না!’

    আমি তাঁর কথা শুনলুম না। দেখি না কী হয়! দরজা খুলেই দিলুম।

    দরজা খুলতেই সে হুড়মুড় করে ঠেলে-মেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমাকে দেখেই কটমট করে উঠল তার চোখ। তিরিক্ষি মেজাজে সে বাবাকে তড়পে উঠল, ‘ছেলেটাকে এখনও ঘরে আগলে রেখেছ?’

    বুড়ো মানুষটি গর্জে উঠলেন, ‘বেশ করেছি।’

    তারপর হঠাৎ-ই তার, আমি যে-পাত্রে রুটি খাচ্ছিলুম, সেই শূন্য পাত্রটার দিকে নজর পড়ে গেল। ভীষণ রেগে সে চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি বুঝি ওকে খেতেও দিয়েছ?’

    বুড়ো মানুষটি গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ।’

    ‘কার খাবার ওকে দিয়েছ?’

    ‘তোর খাবার ওকে দিয়েছি। ও আমার ছেলে।’ তেমনই গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন মানুষটি।

    আর, বলব কী, চোখের পলকে ছেলেটা খাবারের সেই শূন্য পাত্রটা তুলে নিয়ে আমার দিকে ছুড়ে দিল। আমার বুকে লাগল। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলুম আমি। বুড়ো মানুষটি ছুটে এলেন আমার কাছে। ছেলে তার বাবাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে, আমার গলায় ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বার করে দিল। আমি হুমড়ি খেতে খেতে বেরিয়ে এলুম। তারপর ছেলেতে আর বাবাতে লেগে গেল কান ফাটানো চেঁচামেচি। আমি আর কিছু জানি না। কেন না, যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আমি হাঁটতে লাগলুম রাস্তা ধরে। আর ভাবতে লাগলুম, এমন একজন দয়ালু মানুষের ছেলে কেন এমন নির্দয়! আমার এত কষ্টের মধ্যেও মানুষটার জন্যে আমার মন এমন ভার হয়ে উঠল যে, আমি আমার চোখের জল সামলাতে পারলুম না।

    আবার আমি হাঁটছি একা একাই। কোথায় যাব, কী করব জানি না। পাত্রের আঘাতে আমার বুকের যন্ত্রণাটা এখনও মালুম দিচ্ছে। তবে, অনেকটা কম। পেটে কিছু পড়েছে, এই যা রক্ষে। অন্তত একটা-দুটো ঘণ্টা খিদের জ্বালা আমায় কষ্ট দেবে না। তারপর যা হবার হবে।

    কত কী এলোমেলো ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটছি। পথের শেষ নেই। কিন্তু সময়, সেও তো বয়ে চলেছে আমার সঙ্গে। তাই কখন যে সূর্য ডুবেছে, তারা ফুটেছে, সন্ধে নেমেছে; কিছুই খেয়াল করিনি। খেয়াল করিনি, আনমনে কোথায় চলে এসেছি আমি। এ যে অরণ্য!

    তাই তো! গাছে গাছে ছেয়ে আছে চারদিক। তারই ফাঁকে ফাঁকে ভাঙা চাঁদের নরম আলো ছড়িয়ে আছে চারদিকে! গা-ছমছম আলো-আঁধারে আমি যেন হারিয়ে গেছি! কী করব এখন?

    ওটা কী!

    কই?

    ওই যে!

    মনে হচ্ছে, একটা যেন চৌকোমতো ছোট্ট বাক্স! জঙ্গলে পড়ে আছে!

    তাই তো!

    হ্যাঁ, আমি বাক্সটা তুলে নিলুম মাটি থেকে। এ কী! এ তো কাঠের তৈরি বাক্স নয়, তবে কি রুপোর!

    কে জানে! কে চিনবে এই আলো-আঁধারে!

    ওমা! মনে হচ্ছে বাক্সের গায়ে এ যেন কী সব লেখা! কী লেখা? পড়ি কেমন করে এই আলো-আঁধারে!

    তবু চেষ্টা করি। চাঁদের ওই আবছা আলোতেই আমি কড়া চোখে ঠাওর করার চেষ্টা করি। অনেকক্ষণ ধরে দেখতে দেখতে চোখ টনটন করে উঠল। তবু হাল ছাড়লুম না। সবটাই পড়তে পারলুম। বাক্সের গায়ে লেখা আছে :

    মুখ্যু নয় যে পড়তে জানে,

    সেই সে সুজন ভাগ্যবানে,

    বাক্সটা এই খুলবে যখন,

    জাদুর আলোয় ভাসবে তখন।

    আমি চাঁদের আবছা আলোয় বাক্সের গায়ের লেখাগুলো পড়ে প্রথমটা কেমন যেন হকচকিয়ে গেলুম। জাদুর কথা শুনলে কার না গায়ে কাঁটা দেয়! আমারও গা শিউরোতে লাগল। দোনোমনো করে ভাবতে লাগলুম, এ জাদু যদি ভয়ংকর হয়! বাক্স খুললেই যদি হিংসুটে কোনো দানব বেরিয়ে পড়ে! না, তাই বা হবে কেন! লেখা তো আছে, যে পড়তে জানে সে ভাগ্যবান। সে বাক্স খুললে জাদুর আলোয় ভেসে যাবে। তাই মনটা আমার একটু কী করি, কী করি, করলেও বাক্সটা আমি খুলেই ফেললুম। আর, তোমাদের বলব কী, সঙ্গে সঙ্গে সারাবনটা আলোয় আলো হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেই আলোর ভেতর উছলে বেরিয়ে এল একটি ছোটো মেয়ে। সারাগায়ে তার মণিমাণিক্যের অলংকার। যেমন পোশাক তার ঝলমলে, হাসিতে মুখখানিও তার তেমনই উচ্ছল। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম।

    সে হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘তুমি অমন অবাক হয়ে দেখছ কী? আমার নাম মুক্তা। বলো আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি?’

    তার কথা শুনে অস্ফুট স্বরে আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘মানে’!

    সে এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, ‘মানেটা বুঝতে পারছ না? মানে, তুমি এখন আমার কাছে যা চাইবে, আমি তোমায় তাই এনে দেব।’

    ‘আমি যদি সোনার কলম চাই?’

    ‘এনে দেব।’

    ‘আমি যদি হিরে-চুনি-পান্না চাই?’

    ‘এনে দেব।’

    ‘আমি যদি একটা মস্ত বাড়ি চাই?’

    ‘গড়ে দেব।’

    ‘তুমি সব পারো?’

    ‘পারি।’

    ভাবলুম তখন, আমি এমনই গল্প শুনেছি কত, পড়েছি রূপকথায়। আজ বুঝি আমি নিজেই সেই গল্পের একজন দোসর। সেই আলো-ঝলমল অরণ্যে রূপের বাহার ছড়ানো সেই জাদুকন্যাটি এখন যে আমার সব ইচ্ছা পূরণ করবে রূপকথার মতোই, এটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। তাই, এখন আমি কী চাইব তার কাছে, এই ভাবনার যখন কূলকিনারা কিছুই করতে পারছি না, সে তখন আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি চমকে উঠলুম। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি জানি, তুমি ভেবে পাচ্ছ না, কী চাইবে। তুমি তো সবই চাইতে পারো। আমি তো তোমায় সবই এনে দিতে পারি। আর এখন যদি সব না চাও, বাক্সটা তো এখন তোমার। তুমি সঙ্গে রাখবে। তোমার যখন যা দরকার, তখন বাক্স খুলবে। আমি আসব। এনে দেব। তবে হ্যাঁ, এই বাক্স দিনের আলোয় খুললেই বিপদ। কাজেই সাবধান। দিনের আলোয় কক্ষনো যেন বাক্স খুলো না।’

    ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল সেই বুড়োমানুষটি আর তার ছেলের কথা। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘ওগো জাদুকন্যা, যদি কোনো ছেলে তার বাবাকে অমান্য করে, কষ্ট দেয়, তবে কি তার জন্যে তোমার জাদু কিছু করতে পারে? সে-ছেলে কেমন করে ভালো হবে, তার হদিশ কি দিতে পারে তোমার জাদু?’

    ‘পারে।’

    ‘কেমন করে?’

    সে উত্তর দিল, ‘সে যদি জানতে পারে, তোমার ওই বাক্সের মধ্যে সব পাওয়ার জাদু লুকোনো আছে, সেই লোভে সে যদি দিনের আলোয় বাক্স খোলে, তখনই সে পড়বে বিপদে। বিপদে পড়লেই তার ফিরে আসবে সুবুদ্ধি আর সুমতি। সে ভালোবাসতে শিখবে বাবাকে।’

    আমি তখন আকুল হয়ে বললুম, ‘ওগো জাদুকন্যা, তোমার কাছে অন্যকিছু চাইবার আগে, এই কাজটিই যে আমায় প্রথম করতে হবে। ওগো জাদুকন্যা, আমার যে আর তর সইছে না। একটি দয়ালু বুড়ো মানুষ ছেলের জন্যে এমনই কষ্টে যে দিন কাটাচ্ছেন। আমায় যে এখনই তাঁর কাছে যেতে হবে। তুমি আমায় নিয়ে চলো!’

    ‘এখন, এই রাত্রে তুমি কোথায় যাবে? আজ রাতটা তুমি এই অরণ্যেই থাকো। আমি তোমার জন্যে একটি কুটির বানিয়ে দিচ্ছি। তোমার মুখ দেখে বুঝছি, অনেকক্ষণ তুমি কিছু খাওনি। আমি তোমার জন্যে খাবার এনে দিচ্ছি। খেয়ে-দেয়ে, রাতটুকু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাল সকালে তুমি সেখানে যেয়ো।’

    তার মুখের কথা শেষ হতে-না-হতেই সত্যি সত্যি একটি কী সুন্দর কুটির গড়ে উঠল চোখের পলকে। আমি হতবাক! দেখি, আমি বসে আছি তার ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল কত খাবার! নরম তুলতুলে একটি বিছানায় শুয়ে পড়লুম পেট ভরে খেয়ে-দেয়ে। শোবার সময় বন্ধ করে দিলুম সেই বাক্স। হারিয়ে গেল সেই মেয়ে। হারিয়ে গেল উজ্জ্বল আলো। শুধু বাক্সের গা থেকে একটা আবছা আলো স্বপ্নের মতো ভেসে রইল সারাকুটিরে।

    পরের দিন খুব সকাল সকাল আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই দেখি, সেই কুটিরও নেই, কিচ্ছু নেই। আমি গাছের তুলতুলে পাতার ওপর শুয়ে আছি। আর আমার পাশে রয়েছে সেই জাদুবাক্স।

    আমি ধড়ফড় করে উঠে পড়লুম। হতভম্ব হয়ে গেলুম দেখে যে, আমি তো আর সেই অরণ্যে নেই! আমি তো শুয়ে আছি সেই বুড়ো মানুষটির বাড়িরই কাছাকাছি একটি বাগানে! তবে এ কি সেই জাদুকন্যার জাদুর খেলা?

    আমি ছুটে গেলুম সেই বুড়োমানুষটির বাড়ির দোরগোড়ায়। না, দরজায় কড়া নাড়লুম না। জানলায় মুখ বাড়ালুম। হ্যাঁ, তাঁর চোখে চোখ পড়ে গেল আমার। তিনি আঁতকে উঠলেন, ‘তুই? আয়! আয়!’ বলে ব্যস্ত হয়ে ঘরের দরজা খুলে দিলেন। আমার মনে হল, মানুষটির ছেলে বোধহয় ঘরে নেই। তাই এত সাহস। আমাকে ডাকছেন। আমিও ঘরে ঢুকে পড়লুম।

    তিনি ভীষণ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই আবার এলি যে?’

    আমি উত্তর দিলুম, ‘তোমার জন্য।’

    ‘আমার জন্য!’

    ‘হ্যাঁ, এই দেখো তোমার জন্য কী এনেছি।’ বলে বাক্সটা দেখালুম।

    তিনি দেখলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস ‘কীসের বাক্স এটা?’

    আমি বললুম, ‘জাদুর।’

    তিনি আরও অবাক হলেন। বললেন, ‘দুর, জাদু আবার কী! দেখি, কেমন জাদু! তিনি আমার হাত থেকে বাক্সটা নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন।

    আমি বললুম, ‘না এখন আমি তোমায় দেব না। রাত্রি হলে তোমায় দেখাব জাদু কাকে বলে! এই বাক্স খুলে তুমি যা চাইবে, তখন তাই পাবে।’

    কে জানত তখন, বুড়ো মানুষটির ছেলে কোন ফাঁকে আমায় দেখতে পেয়েছে। জানলায় কান পেতে আমার সব কথা শুনছে। দরজাটা যে খোলা ছিল এতক্ষণ, তাও তো খেয়াল ছিল না। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সেটা যেমন কে তেমনই খোলা আছে। আর সেই সুযোগে বুড়ো মানুষটির ছেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে তুলকালাম শুরু করে দিল। আমাকে দিল দু-চার ঘা। আমার হাত থেকে কেড়ে নিল বাক্সটা। আবার চেঁচাল, ‘মিথ্যে জাদুর লোভ দেখিয়ে টুপিটা হাতাবার ধান্দায় ফের এসেছিস! চোর ছেলে কোথাকার।’ বলে আমার চুলের মুঠি ধরে নুড়োনুড়ি করে দিল। তারপরেই বলে উঠল, ‘দাঁড়া দেখি, কেমন তোর জাদু!’ বলে চোখের পলকে বাক্সটা খুলে ফেলেছে।

    আর বলব কী, কোথায় সেই জাদুকন্যা আর কোথায় কী! আচমকা বাক্সের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ঝলক ঝলক কুচকুচে কালো ধোঁয়া। সারাঘর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তারপর শোনা গেল একটা প্রচন্ড শব্দ! কান যেন ফেটে যায়। দেখা গেল, সেই কালো ধোঁয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এক ভয়ংকর চেহারার অপদেবতা। সে গর্জন করে উঠল কর্কশ গলায়। তার গর্জনে কেঁপে উঠল ঘরের দরজা, জানলা। ঝনঝন করে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল দেওয়ালে টাঙানো বাঁধানো ছবি। কাচের আয়না। তার সেই ভয়ংকর মূর্তি দেখে আমিও ভয়ে ঠকঠক করছি। ছেলেটা ‘বাবা রে’ বলে লাফ দিয়ে পালাতে গেল! আর অমনি সেই অপদেবতা খপ করে তার গলাটা খামচে ধরে দাবড়ে উঠল, বজ্জাত ছেলে, তোর আর নিস্তার নেই। শুনে রাখ, যারা আবাধ্য, একগুঁয়ে, একলষেঁড়ে, ভালো কথা কানে নেয় না, বাবা-মার কথা শোনে না, তারাই গাজোয়ারি করে দিনের বেলায় এই জাদুবাক্স খুলে আমার ঘুম ভাঙায়। আর আমি তাদের ঘাড় মটকে রক্ত খাই। আয়, আজ তোর পালা।’ বলে সেই অপদেবতা ছেলেটার ঘাড় মটকাবার জন্যে জোরসে টান মারল। আর ছেলেটা চিলচেঁচিয়ে কেঁদে উঠল, ‘আমায় বাঁচাও। আমায় বাঁচাও।’ তার হাত থেকে বাক্সটাও পড়ে গেল। গড়িয়ে গেল মেঝের ওপর।

    সেই দৃশ্য দেখে ভয়ে কুঁচকে গেছি আমি। কিন্তু ছেলেটার কান্না শুনে আমি আর থাকতে পারলুম না। কে যে আমার মনে সাহস জোগাল বলতে পারি না। আমি পড়িমড়ি করে ছুটে গিয়ে মেঝে থেকে ধাঁ করে জাদুবাক্সটা তুলে নিয়েছি। ঝট করে বন্ধও করে দিলুম। বলব কী চোখের পাতা পড়ার আগেই সেই অপদেবতা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল। আর ছেলেটা মাটিতে পড়ে গোঙাতে লাগল।

    তারপর?

    তারপর সেও এক জাদু। সেই অবাধ্য ছেলে বাবার পা-দুটো জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে লাগল। আর বলতে লাগল, ‘বাবা, আমাকে বাঁচাও! আমি আর কখনো অবাধ্য হব না। তুমি যা বলবে তাই শুনব।’

    বাবা ছেলেকে তুলে নিলেন বুকে। তাঁর চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ জাদুর ঝলকানিতে নিমেষে সব কেমন যেন পালটে গেল। চকিতে যেন আনন্দে ভরে গেল সারাঘর। বাবার এতদিনের দুঃখে- ভরা মুখখানা যেন আলোয় ঝলমল করে উঠল মুহূর্তের মধ্যে।

    আর আমার কী হল? বুড়ো মানুষটি আমাকেও কত আদর করলেন। আমাকেও জড়িয়ে ধরে বললেন, তুইও আমার আর এক ছেলে। তুই থাক আমার কাছে।

    আমি কোনো উত্তর দিতে পারলুম না। শুধু হাসলুম।

    টীকা