হাঁ-চন্দর
শৈলেন ঘোষ দ্বারাবাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাবার সময় ফুলটু রাস্তার ফিরিওলার কাছ থেকে একটা স্প্রিং-আঁটা নাচন-নাচন পাখি কিনেছিল। স্প্রিংটা পিঠের সঙ্গে আঁটা। টানলেই পাখিটা তিড়িং তিড়িং করে লাফায় আর ধিনিক ধিনিক করে নাচে। ভারি মজাদার দেখতে লাগে। এমন একটা পাখি হঠাৎ যদি হাত ফসকে হারিয়ে যায়, কার না মন খারাপ হয়ে যায় বলো? পাখিটা যে ঠিক হারিয়ে গেল, তা বলা যাবে না। বরং বলি, পাখিটা স্প্রিং-এর টানে নাচতে নাচতে হঠাৎ ফুলটুর হাত থেকে ফস করে উড়ে গেল আকাশে। আকাশ থেকে পড়তে পড়তে স্প্রিংটা গেল আটকে একটা গাছের ডালে। পাখিটা মাটিতে পড়তেই পারল না। গাছের ডালে ঝুলে ঝুলে নাচতে লাগল, আর ফুলটুর দিকে চেয়ে চেয়ে ভ্যাংচাতে লাগল। ফুলটু গাছের দিকে খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে, বাবার সঙ্গে বাঘের খাঁচার দিকে এগিয়ে গেল নিরাশ মনে।
নাচন-নাচন পাখিটার মন কিন্তু একটুও খারাপ হয়নি। ও একটা খেলনা-পাখি, কিন্তু মনটা তার জ্যান্ত পাখির মতো। তাই গাছের ডালে, ফুরফুরে হাওয়ায় দোল খেতে তার খুব মজা লাগছে। জ্যান্ত পাখি- গুলো ইচ্ছে করলেই কেমন গাছের ডালে দোল খায়, নেচে বেড়ায়!
নাচন-নাচন পাখিটা অনেকক্ষণ ধরে দোল খেতে খেতে তার কেমন যেন ঘুম-ঘুম পায়। সত্যি সত্যি তার চোখ বুজে গেল। গাছের কোলে দুলতে দুলতে সে ঘুমিয়েই পড়ল।
পাখিটা কতক্ষণ যে ঘুমিয়ে ছিল কে জানে। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। চোখের সামনে ওটা কী রে বাবা! জলে ডুব দিয়ে মুখ তুলে তার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। ওমা! শুধু তাকিয়েই নেই, ওই তো মুখখানা উঁচু করে দাঁত বার করে আছে। উরি বাবা, মুখের ভেতরটা যেন একটা গুহা। কী সাংঘাতিক!
তুমি সাংঘাতিক বললে কী হয়েছে। নাচন-নাচন পাখিটার কিন্তু একটুও সাংঘাতিক লাগছে না। তার মনে হচ্ছে আহা রে। ওই হাঁ-মুখে দুলে দুলে যদি নেচে আসতে পারি।
নাচন-নাচন পাখিটা যেই না মনে মনে এই কথা ভেবেছে, অমনি সেই হাঁ-চন্দরের হাঁ-টা, আগুন-জ্বালানো হাপরের মতো একবার উঠছে, একবার পড়ছে! আর সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে, ‘আয় খাঁই, আয় খাঁই!’ কী বিটকেল খ্যানখ্যানে গলা রে বাবা!
পাখিটা অমনি ভয়ে ভয়ে, না আনন্দে কে জানে গাছের ডালে জোরে জোরে দোল খেতে লাগল, আর গলা বাড়িয়ে বলতে লাগল, ‘ডানা নাই, পাখা নাই, এখানেতেই দোঁল খাঁই।’
পাখিটার কথা শুনে হাঁ-চন্দর আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আয় খাঁই! নইলে জঁলে তুলব হাঁই। জঁলের তোঁড়ে ছিটকে নীচেয় পঁড়বি। তখন হাঁয় হাঁয়।’
ওমা! এদিকে হয়েছে কী, নাচন-নাচন পাখিটার দুলতে দুলতে স্প্রিং-এর প্যাঁচটা আলগা হয়ে গেল। পড়ল গাছ ফসকে। পড়বি তো পড় একবারে হাঁ-চন্দরের নাকের ডগায়। আর দেখতে হয়, হাঁ-চন্দরের নাকে লেগে গেছে সুড়সুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে হাঁচি দিয়েছে, এক বাজখাঁই হাঁচি—ফ্যাঁচ্ছো-ছো-ছো। হাঁ-চন্দর যেই হেঁচেছে অমনি নাচন-নাচন পাখিটা হাঁ-চন্দরের নাক থেকে বন্দুকের গুলির মতো ছিটকে আকাশে উড়ে গেল! উড়তে উড়তে ঝিঁঝিপোকা না জোনাকি, জোনাকি না আকাশের তারা, কী হয়ে যে কোথায় হারিয়ে গেল, আর দেখা গেল না।
এরই ফাঁকে হাঁ-চন্দর জলের ভেতর নিজের নাকটা ক-বার চুবিয়ে নিয়ে মনে মনে ভাবল, যাক বাবা, তার নাকটা নাকেই আছে, উড়ে যায়নি!
আরে বাবা উড়বে কেমন করে! এ যে জলহস্তীর নাক। সহজে উড়ে যায়! হায় সত্যি বটে, হাঁ-চন্দর যে একটি জলহস্তী!