আমার নাম সায়ন। বাবা আমায় বলেন ‘দিগগজ’। আসলে বলেন ঠাট্টা করে। অবশ্য ঠাট্টা করার কারণও আছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ‘সায়ন’ নামের তাঁর এই ছেলেটি লেখাপড়ায় কোনোদিনই দিগগজ হয়ে উঠতে পারবে না। হলে, হবে একটা আস্ত গাধা।

    ঠিকই বুঝেছিলেন। কারণ, কোনো বছর আমি ক্লাসে ফেল করিনি ঠিকই, তবে ঝুলিভরতি গাদাগাদা নম্বরও জোটেনি একবারও, এমনই আমার বরাত। তার জন্যে স্কুলের মাস্টারমশাইরা কম কথা শোনান না আমায়। সুযোগ পেলেই আমায় খোঁটা দেন, বলেন, ‘অমন বাবার কেমন অখাদ্য ছেলে দেখেছ!’ অবশ্য, অখাদ্য না বলে যদি ওঁছা বলতেন তবে বলাটা আরও জোরদার হত!

    হ্যাঁ, মাস্টারমশাইদের মুখে এমন কথা শুনলে কার না জানতে ইচ্ছে করে, অমন বাবা তাহলে আমার কেমন বাবা! সেটা তো আগেই বলে রাখা ভালো।

    আমার বাবা হলেন, একজন জাঁদরেল আই এ এস অফিসার। বড়ো বড়ো কেষ্টবিষ্টুদের নিয়ে তাঁর কাজের সংসার। আজ এখানে যাচ্ছেন। কাল ওখানে যাচ্ছেন। সাহেবসুবো মুলাকাতের জন্যে ধরনা দিয়ে বসে আছেন। ঘরের দরজায় পাহারা বসিয়ে গোপনে কথাবার্তা বলছেন। হরদম টেলিফোন বাজছে। চা-কফি আসছে। সকাল থেকে সে এক এলাহি ব্যাপার। তো, এমন বাবার ছেলেকে লেখাপড়ায় চৌকস হতে না দেখলে লোকে তো ছ্যা ছ্যা করবেই। ষাঁড়ের গোবর বলে না যে, এই যথেষ্ট।

    অথচ বাবা আমার জন্যে কী না করছে। আমি তো সবে ক্লাস এইট-এ পড়ি। কিন্তু সকাল থেকেই আমার ঘানি টানা শুরু। স্কুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত পরপর দুজন মাস্টারমশাই বাড়িতে আমার পড়াশোনার দেখভাল করতে আসবেন। মধ্যিখানে স্কুল। স্কুল থেকে ফিরলে আবার দুজন। বলতে কী, বাড়িতে বই ছাড়া আর আমার কোনো সঙ্গী নেই। এমনকী সারাদিনে হঠাৎ যদি একবার বাবার মুখখানা দেখতে পাই, সে আমার ভাগ্য।

    অবশ্য না বললেও যাঁর মুখ দেখতে পাই উঠতে-বসতে, তিনি আমার মা। তিনিই আমার লেখাপড়া সামলান। আমাকে চোখে চোখে রাখেন। আর স্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্ট হাতে পেলেই মুখখানা হাঁড়ি করেন। আমার ভালো লাগে না।

    সত্যি বলছি, আমার একদম ইচ্ছে করে না বাবার মতো হতে। আমার ইচ্ছে করে বাবার কাছে কাছে থাকতে। বাবার সঙ্গে গল্প করতে। শুনতে ইচ্ছে করে, বাবার সাহসের গল্প। শুনতে ইচ্ছে করে, সেই পাগলাঘোড়ার গল্পটা। তার পিঠে চড়ে ছুটতে গিয়েই তো বাবা হাত ভাঙেন। আর শুনতে ইচ্ছে করে পাহাড়ের খাদে পিছলে পড়া একটা ছেলের গল্প। তবে কেমন করে বাবা খাদ থেকে তাকে তুলে এনেছিলেন সেই গল্প যখনই মনে পড়ে, গায়ে কাঁটা দেয়। হাজার বার শুনেও আমার আশ মেটে না। মনে হয়, আমিও পাহাড়ে উঠি। পা পিছলে গড়িয়ে পড়ি খাদে। বাবা আমায় তুলে আনুন খাদ থেকে। কিন্তু এখন তা তো হবার নয়। বাবার সময় কোথায়! আমারই বা সময় কই যে, পাহাড়ে উঠি! মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা আর আমি দুজনেই বন্দি। বাবা কাজের চাপে আর আমি বইয়ের পাতায়। আমার এমনই দুর্দশা, একা একা রাস্তাতেও বেরোবার জো নেই। আমার দৌড় সেই বাড়ির ছাদ, নয়তো বাইরের বারান্দা। খুব বেশি হলে বাড়ির পেছনের বাগান।

    বাগান বলতে একটা কদমফুলের গাছ। একটা জামরুল আর দেবদারু গাছ। সেই সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলার মতো খানিকটা ফাঁকা জায়গা। আগে অনেক পাখি আসত জামরুল খেতে। এখন পাখি দেখি না। একেবারেই যে দেখি না, তেমন নয়। মাত্তর দু-একটা চোখে পড়ে। বাগানটা আসলে ফাঁকাই পড়ে থাকে। কখনো-সখনো মাকে বলি, ‘চলো না, ব্যাডমিন্টন খেলি!’ মা গ্রাহ্যই করে না। আমি বড়ো একা!

    বাড়ি থেকে আমাদের স্কুলটা একেবারেই কাছে। তবু একা হেঁটে আমার স্কুলে যাওয়ার হুকুম নেই। আধুনিককালের নামকরা ঝকমকে মোটরগাড়ি। ঠিক দশটায় গাড়িটা বাবাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে, আমাকে স্কুলে পৌঁছে দেবার জন্যে। গাড়িতে চেপে দু-তিন মিনিটের মধ্যেই আমি পৌঁছে যাই স্কুলে। বুঝতে পারি না, এটুকু রাস্তা আমি হেঁটে গেলে কী এমন অশুদ্ধ হয়ে যায় মহাভারত! সবাই বলে, অমন একজন গণ্যমান্য লোকের ছেলের পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া সাজে না। তাতে নাকি বাবার মানহানি হবে!

    এসব কথার আমি মানে বুঝি না। যখন দেখি, বিকেলে স্কুলের ছুটির ঘণ্টা পড়লে আমার বন্ধুরা আনন্দে চিৎকার করে স্কুলের গেট পেরিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, তখন তাদের দেখে আমার ভারি হিংসে হয়। আমি তখন গাড়িতে ঠেসান দিয়ে বাড়ি ফিরি।

    আমাদের স্কুলের ক্লাসটাও যেন চিড়িয়াখানার মতো ভাগ করা খাঁচা। চিড়িয়াখানায় যেমন বাঘের খাঁচা আছে, বাঁদরের খাঁচা আছে, ভালুকের খাঁচা আছে, তেমনই আমাদের ক্লাসেও তাই। এই বেঞ্চগুলো ভালো ছেলেদের জন্যে। ওইখানে বসবে বড়োলোকের ছেলেরা। ওইগুলো গরিবদের। বাকিগুলো খারাপ ছেলেদের। কে যে ভাগ করে দেয়, কে জানে বাবা!

    আমি কিন্তু কোনোদিনই ভাগাভাগির মধ্যে থাকিনি। সে তোমার খারাপ ছেলেই হোক, কি ভালো, গরিব হোক, কি বড়োলোক সবার সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব। কী জানি কেন, সবাই আমায় ভালোবাসে। খুব হোমরাচোমরা বাবার ছেলে বলে কেউ আমায় কোনোদিন এড়িয়ে চলেনি। স্কুলের মাস্টারমশাইরা যতই আমার নিন্দেমন্দ করুন, স্কুলে আসতে আমার দারুণ ভালো লাগে। স্কুল যেন আমার হাঁপ ছাড়ার জায়গা। কত বন্ধু আমার। কত খেলা। কত হাসি-আনন্দ। আর টিফিনের সময় তপনের গান।

    কী চমৎকার গলা তপনের। বলব কী, হেন গান নেই, তপন জানে না। তুমি বলো হেমন্তের একটা গান শোনা, সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দেবে। বলো সুমন, নচিকেতা, শ্রীকান্ত, লোপামুদ্রা, এমনকী কোনো ব্যাণ্ডের গান গাইতে, নিমেষে গলা গেয়ে উঠবে তপনের। আর আমিও মহাফুর্তিতে টেবিল চাপড়ে তার গানের সঙ্গে তাল দিই। তখন আমায় দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না, এই ছেলেটাই বাড়িতে এমন শুকিয়ে থাকে। এই ছেলেটার বাবাই আই এ এস অফিসার। মাস্টারমশাইরা যতই আমার লেখাপড়া নিয়ে ছি ছি করুন, কিন্তু কেউ কোনোদিন আমাকে দেমাকি বলে অপবাদ দিতে পারেননি। এই যা একটু সান্ত্বনা।

    এরই মধ্যে একটা কান্ড হয়েছে। আজ নিয়ে ঠিক দু-দিন তপন স্কুলে আসছে না। দু-দিন তপনের গান শোনা হয়নি। দু-দিন টেবিলের তবলায় হাত পড়েনি আমার। দু-দিন টিফিনের সময় ফাঁকা ফাঁকা গেল! বারবার তপনের কথা মনে হয়েছে। তাকে বড়ো একটা কামাই করতে দেখি না কোনোদিন। তবে?

    তিনদিনের দিন স্কুলে গিয়ে জানা গেল, তপনের জ্বর হয়েছে। সে আর এমনকী! ঠাণ্ডা লাগলে একটু-আধটু জ্বর সবারই হয়। এ নিয়ে কে আর ভেবে নাওয়া-খাওয়া ভোলে! ওষুধ তো আছে। ভয় পাবার কী আছে। দু-চারদিন আমার হাতটাই যা একটু অকেজো হয়ে থাকবে। তপনের গানের সঙ্গে টেবিল চাপড়ে তাল দিতে পারব না। তার আর কী করা!

    তবে, একটা সত্যি কথা বলি! তপনের গান শুনতে শুনতে এখন আমার ফিনফিনে গলাটা মাঝে মাঝে খুসখুস করে ওঠে। তাই বলে যেন ভেবে বোসো না, আমি গাইয়ে হয়ে উঠেছি। একদম না। গলাটা খুসখুস করে বলেই একটু গুনগুন করি। সে তো আমাদের ক্লাসের আরও অনেকে করে। কেউ কেউ তো বেসুরে গেয়েও ওঠে। তবে বাবা, আমি খুব হুঁশিয়ার। আমার গুনগুনানি কেবল আমিই শুনি, অন্য কারও কানে যায় না।

    সে নয় অন্য কথা। কিন্তু আজ নিয়ে ঠিক সাতদিন হয়ে গেল, তবুও তপনের দেখা নেই যে! তবে কি তপনের বেশি কিছু হয়েছে। তাকে যে দেখতে যাব, তেমন সুযোগও তো আমার নেই। গাড়ি করে স্কুলে যাও, গাড়ি করে ফিরে এসো। মাকে বললেও যে মা রাজি হবে না, একথা বাজি রেখে বলা যায়। কাজেই তপনকে দেখতে যাওয়ার চিন্তা মনে না আনাই ভালো। মন কেমন করলেও কিচ্ছু করার নেই।

    এমন সময়েই ঘটে গেল সেই ভয়ংকর কান্ডটা। যে-কান্ডটা বলার জন্যেই এত কথা বলা হয়েছে। হয়েছে কী, একদিন মধ্যিখান থেকে আমাদের গাড়িটাই একটা দুর্ঘটনায় পড়ে গেল। আসলে কিন্তু, আমাদের ড্রাইভারের কোনো দোষ ছিল না। বাবাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ফিরে আসছিল বাড়িতে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দেবার জন্যে। মাঝখান থেকে একটা মিনিবাস খেই হারিয়ে হুড়মুড় করে মারল ধাক্কা গাড়ির পেছনে। ব্যাস! কম্ম সারা। শুরু হয়ে গেল হাঙ্গামা। থানা-পুলিশের ঝামেলায় নাস্তানাবুদ। কাজেই, সেদিন আমার স্কুলে যাওয়া চুকে গেল। ভাগ্য ভালো এই যে, সেই সময় ড্রাইভার ছাড়া গাড়িতে আর কেউ ছিল না। ড্রাইভার থাকলেও তার আঘাত লাগল না। ধাক্কাটা লেগেছে সোজা গাড়ির পেছনদিকে। সামনে লাগলে বেচারা ড্রাইভারের যে কী হত, ভগবানই জানেন। পেছনটা তেবড়ে-তুবড়ে একেবারে ছত্রাখান হয়ে গেছে। উফ! দেখলেই শিউরে উঠতে হয়।

    যাকগে, সে না হয় হল। কিন্তু কাল থেকে আমার স্কুল যাওয়ার কী হবে?

    বোধহয়, কাল থেকে ক-দিন আমায় পায়ে হেঁটেই স্কুলে যেতে হবে। গাড়িটার এই দুর্দশা দেখে দুঃখ হলেও মনে মনে কিন্তু আনন্দ হচ্ছিল। যাক, যদ্দিন না গাড়িটার হিল্লে হচ্ছে তদ্দিন আর সবার মতো আমিও পায়ে হেঁটে স্কুলে যাব একা একা। ফিরবও একা একা হইহই করে। এখন আমি স্বাধীন।

    হ্যাঁ, পরের দিন আমি হেঁটে হেঁটেই স্কুলে গেলুম, তবে একা নয়। আমার পেছনে জুড়ে দেওয়া হল দরোয়ানজিকে। ভেস্তে গেল আমার একা একা স্কুলে যাওয়ার রোমাঞ্চকর স্বপ্ন। রেগে, জ্বলে গুমরে উঠল আমার মন। মনে হল, আমার বাবা অমন নামকরা মানুষ না হলেই ভালো ছিল। ভালো হত, যদি না থাকত গাড়ি, বাড়ি, টাকার জাঁক, আর এই দরোয়ানজি। কাকে, কেমন করে বোঝাব, আমি আমার বন্ধুদের মতো হতে চাই। পেতে চাই বাড়ির জেলখানা থেকে ছুটি। আমার যে ভারি কষ্ট হয় বন্দি থাকতে!

    ঠিক তখন থেকেই আমার মাথায় একটা জেদ চেপে বসল। আমি ঠিক করলুম, আমি আর কিছুতেই কারও কথা শুনব না। আমি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যেখানে খুশি চলে যাব, একা একা।

    এই জেদ মাথায় নিয়ে আকাশ-পাতাল কত কী ভাবতে ভাবতে একদিন আমি হাঁপিয়ে উঠলুম। রাতের অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে ছটফট করি আর ভাবি, আমি পালাই, এখনই।

    কিন্তু আমি জানি এটা নেহাতই আজগুবি ভাবনা। কেন-না, এই গভীর রাতে বাইরের গেট খোলা নেই, তালা ঝুলছে। যেতে হলে গেট টপকাতে হবে। নয়তো, ভাঙতে হবে তালা। কোনোটাই আমার সাধ্যে কুলোবে না। এসব না ভেবে বরং অন্যকিছু বুদ্ধি বার করতে হবে। কী বুদ্ধি, বুঝতে পারি না। শূন্য মনে খালি ভাবি।

    বুদ্ধির কথা ভাবতে ভাবতে একদিন কখন যে ঘুমিয়ে পড়লুম জানি না। রাত ভোর হয়ে গেল আমার ঘুমের মধ্যে। ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেল দিনের কাজ। একঘেয়ে।

    কিন্তু আমার যেন আজ কেমন অন্যরকম লাগছে দিনটা। পড়ছি, পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি। কিছুই ঢুকছে না মাথায়। আজ নির্ঘাত বকা খাব স্কুলে। বকা খাই খাব। তবু আমায় যেতে হবে স্কুলে। কারণ, স্কুলই তো আমার হাঁফ ছাড়ার জায়গা। বন্ধুদের সঙ্গ পাব। তপনের গান না হোক, সবার সঙ্গে গল্প তো হবে।

    স্কুলে যাবার জন্যে যখন আমার তোড়জোড় চলছে, তখন মা হঠাৎ বললেন, ‘আজকের দিনটা কোনোরকমে কষ্ট করে যা, কাল থেকে আর কষ্ট করতে হবে না। অন্য গাড়ির ব্যবস্থা হচ্ছে।’

    মায়ের কথা শুনে আমার মুখ চুন হয়ে গেল। আমি থাকতে পারলুম না। মাকে বলেই ফেললুম, ‘কই আমার তো কোনো কষ্ট হচ্ছে না। গাড়ি ছাড়াই তো আমি দিব্যি হেঁটে স্কুলে যেতে পারছি। কী দরকার গাড়ির!’

    মা আমার কথা শুনে বকে দিলেন। বললেন, ‘বেশি পাকামো করতে হবে না। রাস্তাঘাটে কখন কী বিপদ হয়, কে বলতে পারে!’

    মায়ের কথা আমার কানে ঢুকল বটে, কিন্তু মন মানল না। বললুম, ‘বিপদ গাড়িতেও হতে পারে। দেখলে তো আমাদের গাড়ির কী হল!’

    মা এবার বেশ চটে গেলেন। একটু গলা চড়িয়ে বললেন, ‘মুখে মুখে উত্তর দেওয়া তোমার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা যা বলব, তোমাকে তাই করতে হবে।’

    আমি আর কথা বাড়ালুম না। ভালো কথাই মাকে বললুম। মা ‘উলটা বুঝিলি রাম’! মানে কাল থেকে গাড়ির ব্যবস্থা পাকা। সুতরাং, পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার মজা আজই আমার শেষ। এ-মজাটা যে কেমন মজা তা আমি মাকে কেমন করে বোঝাব। সঙ্গে দরোয়ানজি যদি না থাকত, মজার আনন্দে আমি আকাশটাকেও ছুঁয়ে ফেলতে পারি!

    না, তা হবে না। আমাকে বন্দিই থাকতে হবে। সুতরাং, দরোয়ানের সঙ্গে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার আজ আমার শেষদিন। শুধু শেষদিনই নয়, ভয়ংকর বিপদের দিনও বটে।

    হয়েছে কী, রোজ যেমন দরোয়ানজি আমার স্কুলব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যান, তেমন আজও চলেছেন। চলেছেন আমার পিছু পিছু। আমি চলেছি আগে আগে। আর কিছুটা গেলেই স্কুলবাড়ি। হঠাৎ কী হল, পেছনে একটা দারুণ চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। আমি চমকে উঠেছি। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, একটা ষাঁড় গোঁয়ারের মতো গোঁত মেরে তেড়ে আসছে। যে-যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। একটা সাইকেল উলটে পড়েছে। সাইকেল-চালিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে পা ছুড়ছে। সে এক উৎকট ভড়কানির দৃশ্য। ওমা! দেখি পেছনে দরোয়ানজিও নেই। লোকটা যে ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিয়েছেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অগত্যা আমিও স্কুলের দিকে না গিয়ে উলটো দিকে ছুটতে লাগলুম।

    ছুটতে ছুটতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। মনে হচ্ছে ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে যে পারল সে পালাল, আমি কিন্তু মুক্তি পেয়ে গেছি! পথের মাঝে এমন একা আমাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি। আমিও যে এমন সুযোগ পেয়ে যাব স্বপ্নেও ভাবিনি। ষাঁড়টা যতই দজ্জাল হোক, এখন তাকেই মনে হচ্ছে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।

    আমি জানি, খানিক পরে, আমাকে দেখতে না পেলে, তুলকালাম শুরু হয়ে যাবে। চারদিকে পড়ে যাবে খোঁজ খোঁজ রব। তখন যদি ধরা পড়ে যাই! আবার যে বাড়িতে আটকা পড়ব! তাই তো! তাহলে কী করা যায়! সারাক্ষণ রাস্তায় তো ঘুরঘুর করা যাবে না।

    ঠিক এই সময়ে আচমকা মনে পড়ে গেল তপনের কথা। হায় রে, তপনের বাড়ির রাস্তাটা যদি আমার জানা থাকত। চলে যেতুম ওর বাড়িতে। দেখে আসতুম তপনকে। তাও হবে না। কিন্তু তারপরেই মনে হল খুঁজে দেখা তো যেতে পারে।

    তা পারে। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে কেউ আমায় দেখেও তো ফেলতে পারে। তাও পারে। দেখলে আর কী করা যাবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাব। আসলে, ষাঁড়ের তাড়ায় যে সব ছত্রাকার হয়ে গেছে, এটা তো মিথ্যে নয়। আমার বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দরোয়ানজিও যে আপন প্রাণ বাঁচাতে পিটটান দিয়েছেন, সেটাও তো সত্যি। সুতরাং কেউ আমায় দেখতে পেলে, তাকে এসব কথা বলতেই পারি। বলতেই পারি, আমি বাড়ি যাবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, খুঁজছি।

    আর, বলতে না বলতেই ঘটে গেল সেই কান্ডটা। আমার একেবারে মুখোমুখি এক চেনামুখ। আমায় দেখতে পেয়েছে! আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। এই চেনামুখটাকে দেখে আমার যে খুব ভাবনার কিছু আছে তেমন না। মুখখানা একজন মেয়েমানুষের। একসময়ে আমাদের বাড়িতে কাজ করত। আমি মাসি বলে ডাকতুম। এখন আর কাজ করে না। সুতরাং তাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও, পাশ কাটিয়ে চলে গেলুম না। তার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। সে আমাকে খুব অবাক চোখে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘দাদাবাবু, তুমি এখানে? একা একা কোথায় যাচ্ছ? তোমার গাড়ি কই?’

    আমিও তেমনই অবাক স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি বুঝি এদিকে থাকো?’

    সে উত্তর দল, ‘হ্যাঁ’।

    আমি বললুম, ‘আমাদের গাড়িটা ধাক্কা লেগে ভেঙে গেছে। আমার এক বন্ধুর খুব অসুখ। তাই আমি হেঁটে হেঁটে বন্ধুর বাড়ি খুঁজছি।’

    ‘তোমার বন্ধু এদিকেই থাকে?’ সে জিজ্ঞেস করল।

    ‘সেটা তো জানি না।’ আমি উত্তর দিলুম।

    সে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, ‘সে কী কথা! না জানলে খুঁজবে কোথায়?’

    আমি বললুম, ‘দেখি।’

    সে এবার একটু বেশ অস্থির হয়েই বলল, ‘না দাদাবাবু, এমন কাজ কোরো না। তুমি যখন বন্ধুর বাড়ির ঠিকানাটাই জানো না, তখন এমন মতিছন্ন হয়ে রাস্তায় ঘোরাফেরা করলে বিপদ হতে পারে। রাস্তাঘাটে বদলোকের তো অভাব নেই। তার চেয়ে বরং চলো আমার সঙ্গে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’

    যা:! মাসির কথা শুনে আমি ভাবি, আমার মতলব বুঝি গেল ভেস্তে। আমি তখন খুবই ব্যস্ত হয়ে বললুম, ‘না, না, তুমি কেন কষ্ট করতে যাবে! আমি নিজেই বাড়ি যেতে পারব। তবে, বন্ধুকে একবার দেখে যাব।’

    ‘বন্ধুর বাড়ি জানো না। তার ঠিকানা জানা নেই। কেমন করে বন্ধুকে দেখতে যাবে? তোমার বন্ধুর নাম কী?’ সে জিজ্ঞেস করল।

    আমি বললুম, ‘তপন চৌধুরি।’

    সে হঠাৎ বলল, ‘চলো আমার সঙ্গে।’

    আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি জানো?’

    সে বলল, ‘আমি না-জানলেও, আমি এখানে এক বাড়িতে কাজ করি। সে-বাড়ির যিনি মালিক তিনি জানতে পারেন। তিনি এখানকার আদি-বাসিন্দা।’

    তার কথা শুনে আমার মনটা আনন্দে এমন আকুল হয়ে উঠল যে, আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলুম। আমি আর সাতপাঁচ কিছু না ভেবে হনহনিয়ে তার সঙ্গে হাঁটা দিলুম। হাঁটতে হাঁটতে এ-গলি সে-গলি করে ক-টা গলি যে পার হয়ে এলুম হিসেব রাখতে পারলুম না। শেষমেশ যে গলিটায় পড়লুম, সেটা এমন সুনসান, এই ভরদুপুরেই আমার গা ছমছম করতে লাগল। এই গলিটা ধরে আরও খানিকটা হাঁটতেই একটা মস্ত গেটওয়ালা বাড়ির সামনে হাজির হলুম। মাসি সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, বলল, ‘এই বাড়িটা।’ বলতে বলতে গেট ঠেলে ঢুকে আমায় বলল, ‘এসো!’

    আমি ঢুকব, কি ঢুকব না, এমনই যখন দোনোমনো করছি, তখনই সে আবার আমায় ডাক দিল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন, এসো!’

    আমি আর ইতস্তত করলুম না, ঢুকে পড়লুম।

    বাড়িটা দেখেই বুঝেছি, খুব বড়ো। কিন্তু কেমন যেন ঘুপচি মতো। কাজের মাসির পেছনে পেছনে আমি সেই ঘুপচির মধ্যেই হাঁটা দিলুম। কিন্তু ভেতরে কোনো কিছু সাড়াশব্দ পেলুম না। এত বড়ো বাড়ি। লোকজন কোথায় হইহই করবে, সেসব কিছু নেই। কেমন একটা নাক-শোঁকা সোঁদা সোঁদা গন্ধ নিশ্বাসে ঢুকতেই আমার গা ঘিনঘিন করে উঠল। তা আর কী করা যাবে! মনকে সান্ত্বনা দিয়ে ভাবলুম, আমাদের বাড়ির মতো সব বাড়িই যে ঝকঝকে তকতকে হবে, তেমন কোনো কথা নেই। তবে বাড়ির ভেতরে যতই ঢুকছি, গা-টা কেমন যেন শিরশির করছে। ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে আলো। যেন দম আটকে যায়!

    আমি আর থাকতে পারলুম না। অতিষ্ঠ হয়ে মাসিকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কার কাছে নিয়ে যাচ্ছ আমায়? কই, কাউকে দেখতে পাচ্ছি নাতো?’

    মাত্র এই দুটি কথাই তাকে জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু তার উত্তর শোনার আগেই বাড়ির আলো-আঁধারে সে যে টুক করে কোথায় গা ঢাকা দিল আমি টেরই পেলুম না! সোজাকথায় একদম বুদ্ধু বনে গেলুম! হাঁকপাক করে এপাশ-ওপাশ খুঁজতে লাগলুম, আশ্চর্য তার একটুকরো ছায়াও নজরে পড়ল না। শেষমেশ খুব আলতো গলায় ডাক দিলুম, ‘মাসি!’ সাড়া পেলুম না। এমনই আলতো স্বরে আরও তিন-চারবার ডাকাডাকি করলুম, কোথায় মাসি! অগত্যা, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলুম, ‘মাসি-ই-ই-ই!’

    আমার গলার শব্দে বাড়িটার কোণে কোণে প্রতিধ্বনি উঠল, কিন্তু সে প্রতিধ্বনি মাসির কানে ঢুকল না। যেমনকে তেমন চুপচাপ। আমি তখন ভীষণ ভয় পেয়ে গেছি। বলতে পারো ভয়ে কাঁপছি। মনে হল, আমি বোধহয় কোনো ঠগবাজের পাল্লায় পড়ে গেছি। আর আমার রক্ষে নেই।

    এই ভয়ংকর ভাবনাটা আচমকা আমার মনে ঘুরপাক খেতেই আমি আতঙ্কে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি।

    মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই আমার মনে হয়েছে আমাকে পালাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছি ছুট। ছুটলুম সেইদিকেই, যেদিক দিয়ে এসেছি।

    কিন্তু কী আশ্চর্য, আনতাবড়ি ছুটতে গিয়ে আমার চোখে এমন ধাঁধা লেগে গেল যে, আমি বেরিয়ে যাবার রাস্তাটাই গুলিয়ে ফেললুম। আটকে পড়লুম গোলকধাঁধায়। অনেক চেষ্টা করেও গেটটা কোনদিকে হদিশ করতে পারলুম না। বাড়ির ভেতরেই হন্তদন্ত হয়ে পাক খেতে লাগলুম।

    আমি জানি এখন বাড়িতে আমার জন্যে হুলুস্থুলু শুরু হয়ে গেছে। তপনকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছেটা না জানি কী কুক্ষণেই আমার মাথায় চেপে বসেছিল। বললে বিশ্বাস করবে কি না জানি না, এখন সেই কাজের মাসির মুখখানা আমার চোখে এক ভয়ংকর রাক্ষুসির মতো ভেসে উঠছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।

    আমি আর পাক খেতে পারলুম না। বসে পড়লুম মেঝের ওপর। বসে বসে ভয়ে হাঁপাতে লাগলুম। তারপর কখন যে চোখে অন্ধকার নেমে এল, একেবারেই খেয়াল করতে পারলুম না।

    মনে হয়, অনেকক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরেছিল। কেন-না, এখন দিনের আলোর লেশমাত্র চোখে পড়ছে না। গাঢ় অন্ধকার। কিছুই ঠাওর করা যায় না। মনে হয় রাত হয়েছে। আচমকা বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসলুম। মাথাটা টাল খেয়ে গেল। সামলে নিলুম। ঘুরে গেল মুখখানা পেছনদিকে। চমকে উঠেছি। আমার চোখের ওপর ভেসে উঠল একটুকরো আলোর আভাস। মনে হল, কেউ-না-কেউ আছে কাছেপিঠে। আর আমিও বসে আছি একটা বিছানার ওপর। এতক্ষণ শুয়েছিলুম এই বিছানাতেই। বুঝতে পারলুম এটা একটা ঘর।

    ওই আলো দেখেই আমার সাহস বাড়ল। আমি টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়ালুম। ঘরের দরজা ডিঙিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলুম। খুব আলতো পায়ে এগিয়ে চললুম, ওই আলোর দিকে। সত্যি বলতে কী, পায়ে জোর পাচ্ছি না। সেই কোন সকালে খেয়ে বেরিয়েছি। তারপর থেকে একফোঁটা জলও পেটে পড়েনি। বইয়ের ব্যাগে টিফিনের বাক্সটা রয়ে গেছে। সেও তো দরোয়ানজির হাতে। কাজেই উপোস করে আছি তখন থেকে। এত ধকল সহ্য করার পরেও যে পা হাঁটছে এই যথেষ্ট।

    হাঁটছি যখন, তখনই কে যেন পেছন থেকে আমার জামায় টান মারল। আমি ভয়ে ‘আঁক’ করে আঁতকে উঠেছি। পেছনে তাকাতেই দেখি একটি মেয়ে। আবছা আলোয় চিনতে পারি। বুঝতে পারি আমার চেয়ে ছোটো। আমি তার দিকে তাকাতেই তার একটা হাত ঝড়ের ঝাপটার মতো ছিটকে আমার মুখটা চেপে ধরল। সে নিজের মুখেও কোনো শব্দ করল না। ব্যস্ত হয়ে চোখের ইশারায় কথা বলতে বারণ করল।

    যে আমার মতো এমন অবস্থায় কোনোদিন পড়েনি, তার জানার কথা নয়, তখন আমার বুকের ভেতরে কী তোলপাড় কান্ড চলছে। সে চট করে আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে, আমার হাতটা ধরে ফেলল। তারপর হিড়হিড় করে টানতে লাগল। আমার তখন বাকবুদ্ধি সব হারিয়ে গেছে। আমি ঘোরলাগা মানুষের মতো হাঁকপাক করতে করতে তার সঙ্গে অন্ধকারে ঢুকে পড়লুম। সে যে কোথায় আমায় নিয়ে এল, আমি একদম বুঝতে পারলুম না।

    মেয়েটি এবার কথা বলল। প্রথম যে কথাটি বলল, সেই কথা শুনে আমি আর আমাতে নেই। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। সে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘তুমি এখন বন্দি। যেমন বন্দি আমিও। তুমি বন্দি হয়েছ আজ, আমি হয়েছি অনেকদিন আগে। এটা হল গাব্বুগাগ্গার ডেরা। সে একটা কুহকী শয়তান! কখনো তাকে দেখা যায়, আবার কখনো তাকে দেখা যায় না! অন্ধকারের ভেতর অন্ধকার হয়ে সে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আবার কখনো নিজের চেহারাটাই পালটে ফেলে।’ বলতে বলতে সে থমকে গেল। হয়ে গেল একদম স্পিকটি নট। কান পেতে রইল মুহূর্ত। তারপর চোখের পলকে আমার হাত ধরে টান মারল। বলল, ‘চলো, এখান থেকে পালাই!’

    ‘কেন?’ আমি ভয় পেলুম।

    সে আমার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে বলল, ‘মনে হচ্ছে সেই শয়তান এদিকেই আসছে!’

    আমি উত্তর দিলুম, ‘এই অন্ধকারে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না কোথায় যাবে?’

    ‘আমার ঘরে!’

    আমি বললুম, ‘অন্ধকারে কোনদিকে তোমার ঘর, তুমি চিনবে কেমন করে?’

    সে উত্তর দিল, ‘অন্ধকারে থাকতে থাকতে অন্ধকারেই আমি সব কিছু দেখতে পাই।’ বলতে বলতে সে যে আমায় কোথা দিয়ে কোথায় নিয়ে এল, আমি একেবারেই বুঝতে পারলুম না। তারপর যখন সে থামল, থেমে বলল, ‘এইটাই আমার ঘর,’ আমি তো হতবাক। কোথায় ঘর, কোথায় কী, আমার কিছুই ঠাওর হল না। ভয়ে হাঁপাচ্ছি। সেও হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে আমায় বসতে বলল।

    কোথায় বসব জানি না। দোনোমনো করার আগেই সে আমার হাতটা ধরে বলল, ‘এইখানে বোসো।’

    আমি বসে পড়লুম। বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল যার ওপর বসলুম, সেটা একটা গালিচা। নরম তুলতুল করছে। তখনই কেমন একটা সন্দেহ মনের মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠল। তবে কি মেয়েটা শয়তানের চেলা? অন্ধকারে আমি যেখানে কিছুই দেখতে পাই না, সেখানে মেয়েটা সবকিছু কেমন করে দেখতে পাচ্ছে? গালিচাটা যে ঘরের এইখানে পাতা আছে, আমার চোখের দৃষ্টি তার সামান্যও আঁচ পেল না। অথচ মেয়েটাকে এদিক-ওদিক হাঁটকাতে হল না একচুলও। এ কেমন করে হয়!

    এইসব কথা ভাবছি যখন, তখনই মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখানে এলে কেমন করে? কে তোমায় নিয়ে এল?’

    আমি আশ্চর্য হয়ে গেলুম তার কথা শুনে। কেন-না, সে বলে গেল একই কথা, যা আমার ঘটেছে। বলল, ‘আমি স্কুলে যাচ্ছিলুম। রাস্তায় একটা ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে পথ হারিয়ে ফেলি। তারপর যখন পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি, আমার কাকুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কাকু মানে আমার বাবার বন্ধু। কাকু আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে চললেন। আসলে নিয়ে এলেন এই বাড়িতেই। আমি তো কাকুর বাড়ি আগে কোনোদিন যাইনি, তাই ভাবলুম, এটাই বুঝি তাঁর বাড়ি। কিন্তু সবটাই মিথ্যে। যিনি আমায় এখানে নিয়ে এলেন, তিনি আমার বাবার বন্ধুও নন, আমার কাকাও নন। তোমাকে একটু আগে বললুম না, কুহকী শয়তান অন্ধকারের সঙ্গে অন্ধকার হয়ে ঘুরে বেড়ায় যেমন, তেমনই নিজের চেহারাটাও সে পালটে ফেলতে পারে যখন-তখন। ওই ষাঁড়টা আর কেউ নয়, এই শয়তানই। আমায় তাড়া করে বিপথে নিয়ে এসেছিল সে। আমি যখন পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখনই সে আমার বাবার বন্ধু সেজে আমাকে এখানে ধরে আনল। সে-ই আমাকে বলেছে, তার নাম গাব্বুগাগ্গা। ঘটনাটা ঘটেছে ক-দিন হয়ে গেল। সেই থেকে এখানে বন্দি আছি।’

    তার কথা শুনতে শুনতে ভয়ে নিথর হয়ে গেলুম। মনে মনে ভাবলুম, তবে কি একই ঘটনা ঘটল আমার বেলাতেও। আমার স্কুল যাওয়ার পথেও তো একটা ষাঁড় লঙ্কাকান্ড বাধাল। তার তাড়া পেয়েই তো আমি পথ হারিয়ে বিপথে চলে আসি। মেয়েটির বেলায় যে বাবার বন্ধু সেজেছিল, আমার বেলায় সেই তো তা-হলে কাজের মাসি সেজে আমায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে!

    মেয়েটির কথা শুনে আমি থ হয়ে ভাবতে লাগলুম। মুখে কথা সরল না। শুধু আমার চোখের ওপর ভেসে উঠল বাবা আর মায়ের মুখ দু-খানি। আমি ধড়ফড় করে গালিচা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম।

    সে আমায় ধরে ফেলল। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘উঠছ কেন?’

    আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘এবার কী হবে?’

    বলতে-না-বলতেই ঘরের মধ্যে কী যেন পড়ল। শব্দ উঠল ধপাস! আমি চমকে উঠলুম। কিছুই দেখতে পেলুম না। মেয়েটি বলল, ‘আমাদের খাবার। দুজনের জন্যে দু-প্যাকেট। ওরই মধ্যে খাবার জলের বটল আছে। খাবে?’

    আমি রাগে ফেটে পড়লুম। বললুম, ‘না’।

    সে বলল, ‘আমিও প্রথম যেদিন ধরা পড়ে এখানে আসি, রাগ করে কিছু খাইনি। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! থাকতে পারিনি। মুখে কিছু দিতেই হল। তোমাকেও দিতে হবে।’

    আমি ক্ষিপ্ত গলায় উত্তর দিলুম, ‘না খেয়ে মরি, সেও ভালো। তবু শয়তানের খাবার মুখে দেব না!’

    মেয়েটি আমার চেয়ে ছোটো হলেও একটি ভারি ভালো কথা বলল, ‘এমন অবস্থায় পড়লে মরতে পারে যে-কেউ। কিন্তু তাকেই তো বলে বুদ্ধিমান, যে বিপদে পড়েও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষার উপায় বার করতে পারে। তুমি শয়তানের হাতে ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত আমি এখানে ছিলুম একা। এখন আমরা দুজন। চেষ্টা তো করতে পারি দুজনে একসঙ্গে বাঁচার একটা রাস্তা বার করার।’

    তার কথা শুনে আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকালুম। কিন্তু অন্ধকারে তার সে মুখ ঝাপসা। সেই ঝাপসা মুখের দিকে তাকিয়ে, তাকে কিছু বলার আগে সে-ই আমায় বলল, ‘তুমি কী ভাবছ, আমি কি শুধুই কেঁদে হা-হুতাশ করেছি একা একা? মোটেই না। আমি শয়তানের নাড়িনক্ষত্র সব জানবার চেষ্টা করেছি। আমি দেখেছি অন্ধকারে সে লুকিয়ে থাকলেও, তার নিশ্বাসের শব্দটাকে সে লুকোতে পারে না। যখনই সে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে এদিক-ওদিক করে তখনই আমি বুঝতে পারি সে কোথায় আছে। এখন সে যে কাছেপিঠে কোথাও নেই, এটা আমি হলপ করে বলতে পারি।’

    ‘কিন্তু একদিন এমন একটা কান্ড ঘটে গেল, সেইদিনই প্রথম সে আমার চোখে পড়ে গেল। স্পষ্ট। সে একটা ভয়ংকর কুৎসিত দেখতে মানুষ। প্রথম দেখেই আতঙ্কে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যায়। মাথা ঘুরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই আমি। আমার পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে চোখের পলকে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সে চিৎকার করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে খেঁকিয়ে উঠল, ‘তুই যখন আমায় দেখেই ফেললি, তখন বলেই দিই, আমি এক কুহকী। আমার নাম গাব্বুগাগ্গা। আমার এমন শক্তি যে আমি হাসতে হাসতে যখন-তখন নিজের রূপ পালটে ফেলতে পারি। কিন্তু সে মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে। তারপরে আবার আমার এই আসল কুৎসিত চেহারাটা বেরিয়ে পড়ে। তাই আমার প্রচন্ড হিংসে তোদের ওপর। ইচ্ছে যায় তোদের মতো আমি সুন্দর হই। পারি না বলেই তোদের আমি ধরে আনি আমার এই ডেরায়। তোদের সঙ্গে খেলার ছলে, তোদের হাত-পাগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলে লোফালুফি করি। তারপর তোদের গলা টিপে মেরে আমি আনন্দে নাচি। এবার তোর পালা। তুই তৈরি থাক।’ বলে হাসতে হাসতে শয়তানটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।’

    তার কথা শুনে নিমেষের মধ্যে কেমন যেন সাহসী হয়ে উঠল আমার মন। আমি জানি, এই মেয়েটিকে যেমন ধরে এনেছে কুহকী শয়তান মারার জন্যে, তেমনই আমাকেও। আমাকে মারে মারুক, কিন্তু মন বলল, মেয়েটিকে মারতে দেব না। যেমন করে হোক মেয়েটিকে বাঁচাব আমি। শায়েস্তা করব এই ভয়ংকর কুৎসিত শয়তানটাকে। শয়তানের সঙ্গে গায়ের জোরে পারব না ঠিকই, কিন্তু একটা বুদ্ধি তো বার করতে পারি। আমি তাই সমস্ত ভয়-ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘আচ্ছা, শয়তান যখন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন তোমার কি মনে হয় সে হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়?’

    মেয়েটি উত্তর দিল, ‘না, সে ভোল পালটাতে পারে, কিন্তু হাওয়ার মতো অদৃশ্য হতে পারে না। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে।’

    ‘এই অন্ধকারে তুমি কি খুঁজে বার করতে পারো, বাইরে যাবার গেটটা?’

    ‘পারি। কিন্তু তাতে লাভ কী? গেটে তালা দেওয়া। চাবি তো শয়তানের কাছে।’

    আমি বললুম, ‘বাঁচতে হলে শয়তানকে বন্দি করে চাবি খুঁজে বার করতে হবে।’

    মেয়েটি উত্তর দিল, ‘দুটো কাজই অসম্ভব শক্ত। তুমি কেমন করে বন্দি করবে, এমন একটা দশাসই কুৎসিত মানুষকে? আর কেমন করেই বা তুমি তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেবে গেটের চাবি?’

    আমি মেয়েটিকে বললুম, ‘তুমি আমার সঙ্গে থাকলে পারব। তুমি জানো কি এই বিশাল বাড়ির কোন কামরাটায় শয়তান থাকে? রাতে ঘুমোয়?’

    মেয়েটি উত্তর দিল, ‘একদিন দেখেছি। তারপরে আর দেখার সুযোগ হয়নি। রাত্রিবেলা শোওয়ার জন্যে আমি ঘরে ঢুকলেই, সে বাইরে থেকে আমার ঘরের দরজায় শেকল তুলে দেয়। সারারাত আমি বন্দি হয়ে থাকি।’

    বলতে বলতে মেয়েটি আচমকা চুপ করে গেল। কান পেতে কী যেন শোনার চেষ্টা করল। ঝট করে আমার মুখটা চেপে ধরে তার ঘর থেকে আমাকে বার করে আনল। আমি বুঝতে পারলুম, সে শয়তানের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়েছে। আমাকে টানতে টানতে সে লুকিয়ে পড়ল একটা ঘুপচির মধ্যে। সে আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘শয়তান আমাদের খুঁজছে!’

    তার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। মেয়েটি যখন রাত্রে শোয়ার জন্যে ঘরে ঢোকে তখন বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে তাকে বন্দি করা হয়। তাহলে এমন সুযোগ এলে আমরাও তো শয়তানকে বন্দি করতে পারি। এই ভেবে তাকে আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘শয়তান এখন কোনদিকে আমাদের খুঁজছে?’

    সে বলল, ‘মনে হচ্ছে আমার ঘরে ঢুকবে।’

    আমি বললুম, ‘একদৃষ্টে নজর রাখো। দেখো, নজরের বাইরে না চলে যায়।’

    সে উত্তর দিল, ‘একবার টের পেলেই শেষ করে ফেলবে!’

    আমি উত্তর দিলুম, ‘আমরা তো শেষ হয়েই আছি। তবে, যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ শত্রুকে ঘায়েল করার জন্যে সুযোগ তো খুঁজতে হবে। কে আর বেঘোরে মরতে চায় বলো!’

    আমার কথা মেয়েটি মানল। তারপর আমার হাতটা চেপে ধরে বলে উঠল, ‘শয়তান আমার ঘরেই ঢুকল।’

    আমিও সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ধরে টান মেরে বললুম, ‘এসো।’

    সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’

    আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে বললুম, ‘তোমার ঘরের দিকে।’

    ‘কেন?’

    ‘শয়তানকে বন্দি করব।’

    ‘কেমন করে?’

    ‘তোমাকে যেমন করে বন্দি করে রাখে তোমার ঘরে, তেমন করে। বাইরে থেকে ঘরের দরজায় শেকল তুলে দেব।’

    সে বলল, ‘অসম্ভব। ঘরের দরজা এত উঁচু আমাদের হাত যাবে না শেকলে।’

    আমি উত্তর দিলুম, ‘ঠিক যাবে। তোমাকে আমি কাঁধে নেব। তুমি হাত বাড়ালেই শেকলের নাগাল পেয়ে যাবে। চলো শিগগির।’

    বলতে নেই, বুদ্ধিটা ঠিক খেটে গেল। খেটে গেল চোখের পলকে। মেয়েটি আমার কাঁধে ঝটপট উঠে দরজার পাল্লায় তুলে দিল শেকল। সব কাজটা এমন নি:সাড়ে হয়ে গেল যে, শয়তানের কিছুই করার থাকল না। সে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। ঘরের দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে লাগল। সে কি আর খোলে! এ বন্দিশালা তোমারই হাতে তৈরি। এমন শক্তপোক্ত, কেউ পালাতে পারে না, দরজা ভেঙে। তাই তোমারও সাধ্যি নেই দরজা ভাঙার। ওই ঘরে পড়ে পড়েই তোমাকে মরতে হবে।

    আমি আমার কাঁধ থেকে মেয়েটিকে চটপট নামিয়ে গলা ফাটিয়ে বলে উঠলুম, ‘তুমি নিয়ে চলো আমায় শয়তানের ঘরে। গেটের চাবি নিশ্চয়ই পেয়ে যাব সেখানে। তারপর আমাদের মুক্তি।’

    হ্যাঁ, ঠিক তাই, গেটের চাবিও পেয়ে গেছলুম। পেয়ে গেছলুম মুক্তিও। যখন গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এলুম তখন সকাল হয়ে গেছে। আঃ! বাঁচলুম যেন!

    কিন্তু সে তো হল, আমার বাড়ির রাস্তা তো আমি চিনি না। কেমন করে বাড়ি যাব!

    মেয়েটি বলল, ‘ঠিকানা তো জানো।’

    ‘তা জানি।’

    মেয়েটি বলল, ‘ঠিক আছে। আমার বাড়ির রাস্তা আমি জানি! এখন তুমি আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে চলো। তারপর আমার বাবা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।’

    শেষপর্যন্ত সেই ব্যবস্থাই হল। তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, কী সাংঘাতিক চিন্তায় পড়ে গেছলেন এই দুই বাড়ির মানুষ। তাঁরা আমাদের মুখে শুনছেন আমাদের গল্প, আর আতঙ্কে শিউরে উঠছেন। এই গল্পের যেন শেষ নেই, তবে ফিরে যে এসেছি, এই তাঁদের স্বস্তি। কিন্তু আশ্চর্য কী জানো, শত চেষ্টা করেও শয়তানের সেই ডেরার আমরা কেউ আর হদিশ করতে পারিনি।

    কিন্তু আনন্দেরও খবর আছে। স্কুলে গিয়ে দেখি তপন এসেছে। তার অসুখ ভালো হয়ে গেছে। আমার স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে আমার আর-এক নতুন বন্ধু বাড়ল। সেই নতুন বন্ধুর নাম পিউলি।

    টীকা