এক বুড়ো আর একটি পাখি

    এক ছিল বুড়ো-মানুষ। ভারি একা-একা বয়েসের ভারে নুয়ে পড়েছে মানুষটি। তবুও ওই সকালের আলো দেখে দেখে তাকে পথ হাঁটতে হয়। নয়তো সন্ধ্যার তারা দেখে দেখে তাকে ভাবতে হয়, আঃ! কী সুন্দর এই পৃথিবী।

    সুন্দর এই পৃথিবীর চারিদিকে চোখ মেলে এখন দেখতে খুব ভালো লাগে ওই বুড়ো মানুষটির। ভালো লাগে আকাশ আর ওই আকাশের আলো। নয়তো পাখি আর ওই পাখির গান। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, বুড়োর এত আপন হয়ে উঠেছে ওরা। বুড়োর ইচ্ছে করে ওই আলো ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ঘুরে বেড়াতে। কিংবা পাখির রং দেখে-দেখে ছুটে বেড়াতে। কিন্তু না, এখন আর পারে না। পারত, তখন পারত, যখন এই সাদা ধবধবে মাথার চুলের গোছা কালো কুচকুচে ছিল। যখন এই কোঁচকানো-মোচকানো গায়ের চামড়া টান-টান হয়ে লাল-টুকটুক আভা দিত! তখন বুড়ো বর্ষার বৃষ্টির মতো ঝমঝমিয়ে নাচতে পারত। কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের মেঘের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে লড়তে পারত।

    হ্যাঁ, কত লড়াই না করেছে মানুষটি। সেবারে, সেই যখন ভূমিকম্প হল, মাটির নীচের পাথরের স্তর ভেঙে ভেঙে যখন আরও নীচে পাথরে গিয়ে ধাক্কা মারল, সেই ধাক্কায় ওদের বাড়ির চারপাশের মাটি প্রচন্ড কেঁপে, চৌচির হয়ে দু-ফাঁক হয়ে গেছল। এক ভয়ংকর অন্ধকার পাতাল সেই ফাঁকে! বাড়িটা মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে সেই অন্ধকার পাতালে মুখ গুঁজড়ে হারিয়ে গেছল। সেই সঙ্গে, হারিয়ে গেছল তার বউ-ও।

    হ্যাঁ, মানুষটির আপন বলতে শুধু বউ-ই ছিল। রুপোয় গড়া মল পরে সে পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়াত। আসল চাঁদির বালা দুলিয়ে সে এ-ঘর ও-ঘর কাজ করত। আর নয়তো সন্ধ্যারাতে তারা উঠলে, সে গুনগুনিয়ে গান শোনাত। কী ভালোই না ছিল সে। তার বউটি।

    যদিও মানুষটি প্রাণপণ লড়াই করেছিল ভূমিকম্পের সঙ্গে, কিন্তু তবুও পারেনি। কারণ ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া ওদের বাড়িটা আর কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়ায়নি। তার বউও আর কোনোদিনই সেই বাড়িতে, সন্ধ্যারাতে গুনগুনিয়ে গান শোনায়নি। সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটিও।

    তারপর কতদিন কেটে গেছ। নিশ্চুপ মানুষটি একাকী এতদিন রাত আর দিনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এতখানি বয়েস পেরিয়ে এসেছে। হয়তো আর ক-টা দিন। হয়তো আর ক-দিন পরে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে ও স্বর্গে যাবে!

    বুড়ো জানে না স্বর্গ কোথায়। কেউ-ই জানে না স্বর্গ কোথায়। তবু বুড়ো ভাবে ওখানে গেলে সব পাবে সে। ও ভাবে, এই পৃথিবীর একটি রঙিন ফুল ফুটতে ফুটতে ঝরে গেলে, স্বর্গে সে আবার নতুন রঙে ফুটে ওঠে। এই পৃথিবীর দিনের আলো, রাতের কালোয় হারিয়ে গেলে ওই স্বর্গে, ভোরের আলোয় জেগে ওঠে। এই পৃথিবীর একটি পাখির গানের সুর ফুরিয়ে গেলে, ওই স্বর্গে আর এক সুরে সে গেয়ে ওঠে। আর তাই বুড়ো ভাবত তার বউ-ও বোধহয় সেই স্বর্গেই গান গাইছে, এখনও। যেমন গাইত সে গুনগুনিয়ে সাঁঝেরবেলায়, এখানে।

    বুড়োর তাই স্বর্গে যাবার জন্যে মন কাঁদত। মন বলত, আর কত দিন? ভাবতে ভাবতে বুড়ো পথ হাঁটত। হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে ভাবত, সামনের ওই পথটাই কি স্বর্গে গেছে! তাহলে আর কতটা যেতে হবে? আর কতটা পথ?

    আর বেশিদূর যেতে হয়নি তাকে। একদিন শীতের সকালে, শিশিরে-শিশিরে গাছের পাতারা যখন ঝলমল করছে, কুয়াশার গায়ে গায়ে সূর্যের আলো যখন চুইয়ে পড়েছে, সেদিন পথ হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মানুষটি। দাঁড়িয়ে পড়তেই বুকটা তার চমকে উঠেছে! শিশিরভেজা মাটির ওপর কী যেন পড়ে আছে! ছুটে গেল বুড়ো সেইদিকে।

    দেখল, একটি আহত পাখি। হ্যাঁ, তখনও পাখিটির ছোট্ট ঠোঁট দুটি একটু জলের জন্য ছটফট করছে। রঙে বোনা পাখা দুটি তার ভয়ে কুঁচকে বুকের প্রাণটাকে যেন আঁকড়ে ধরে আছে। তির তির করে কাঁপছে তার ছোট্ট দেহটা। ভারি আড়ষ্ট তার ছোট্ট পা-দুটি।

    চটপট পাখিটিকে তুলে নিয়েছিল বুড়ো ওই ঠাণ্ডা মাটির ওপর থেকে। ছুটে গেছল একটা গাছের নীচে। গাছের যে পাতা বেয়ে শিশিরের ফোঁটাগুলি টুপটাপ মাটিতে পড়ছে, সেখানে পাখির ঠোঁট দুটি মেলে ধরেছিল। আঃ! পাখির মুখের মধ্যে শিশির পড়ে বুকের মধ্যেটা বুঝি ঠাণ্ডা হয়! তারপর বুড়ো তাকে নিজের চাদরের আড়ালে ঢেকে নিলে। নিজের দেহের তাপে, তার দেহটাকে তপ্ত করে দিলে। পাখিটা বুড়োর চোখের দিকে চাইল। ভারি করুণ সে চাউনি। চাইতে-চাইতে ঘুমিয়ে পড়ল। বুঝি-বা ভালো লাগছে তার ওই বুড়োর আদরের ছোঁয়াটুকু!

    ছুটে এসেছিল বুড়ো তার সেই ভাঙা আস্তানাটায়। ছোট্ট একটা ঘর। ফুটো ছাদের গর্ত দিয়ে এক- ফোঁটা আকাশ বেয়ে একটুকরো আলো দেখা যাচ্ছে। বিছানার ছেঁড়া মাদুরটা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর নিজের গায়ের চাদরটা পাট করে বিছিয়ে দিল। তারপর শুইয়ে দিল পাখিটাকে তার ওপর। নরম চাদরের ওপর ঘুমিয়ে রইল পাখিটা অনেকক্ষণ।

    ঘুমন্ত পাখির মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে বুড়ো। বসে বসে দেখছে, তার ছোট্ট বুকের একটুখানি প্রাণ কেঁপে কেঁপে থিরথির করছে, দেখছে, তার নরম পালকের ফুলকিতে কত রঙের বাহার ফুটে উঠেছে। তার গায়ে হাত দিল বুড়ো। তার বুকে হাত রাখল। চমকে উঠল পাখি। তারপর নরম সুরে ডাক দিল। ভারি কষ্টের সে ডাকে পাখির গলা কাঁপছে।

    এমনি করে একদিন, দু-দিন কতদিন বুড়ো ওই পাখিটার নরম পালকের ফুলকিতে, তার হাড়-জিরজিরে হাতের আঙুল বুলিয়ে আদর করেছে। কিংবা তার কাঁধের ওপর বসিয়ে-বসিয়ে আকাশটা দেখিয়েছে।

    অনেকদিন পর পাখিটা যেদিন তার রঙিন ডানা দুটি হাওয়ায় দুলিয়ে ওই আকাশে নাড়তে পারল, বুড়ো সেদিন বুঝল, ও এবার উড়তে পারবে।

    অনেকদিন পর পাখিটা যেদিন তার ছোট্ট পা দুটিতে নরম মাটির ওপর তুড়ুক-তুড়ুক নেচে হাঁটতে পারল, বুড়ো সেদিন বুঝল, পাখি এবার আকাশটাকে চিনতে পারবে। তাই সেদিন বুড়ো তার দু-হাতের মুঠি আকাশের আলোয় আলতো করে মেলে ধরলে। পাখিটা বুড়োর হাতের ওপর নাচল। তার মুখের দিকে চাইল। তারপর একটি মিষ্টি সুরে ডেকে উঠে, ওই শূন্য আকাশে উড়ে গেল।

    আঃ! মনটা জুড়িয়ে গেল বুড়োর। একটা পাখির প্রাণ সে ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। একমুঠো রং ছড়িয়ে, একটুখানি পাখি অত বড় আকাশটাকে খুশির গানে ভরিয়ে দিয়ে উড়ে গেল। কান পেতে রইল বুড়ো। পাখির গানের কথা তো বোঝে না বুড়ো। তাই জানতেও পারল না, পাখির সেই খুশির গানে আকাশ-হাওয়ায় ছড়িয়ে যায় বড়োরই জয়গান।

    হারিয়ে গেল পাখি ওই আকাশে, একটু একটু করে। যেমন করে দিনের আলোয় হারিয়ে যায়, গভীর রাতের একটি একটি তারা।

    মন খারাপ লাগছে বুড়োর। যে মানুষটা এতদিন একা ছিল, ক-দিন তো তবু একটা প্রাণীকে সে কাছে পেয়েছে, হলই বা পাখি! সে-পাখির চোখ দুটি যে তার চোখেও চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কিংবা অবাক হয়ে ভেবেছে, কে এই মানুষটা! বুক-ভরতি এত ভালোবাসা!

    তারপর অনেকদিন আকাশে-আকাশে চোখ রেখে বুড়ো খুঁজেছিল পাখিটাকে! সে যদি আসে! সামনে ওই সবুজ গাছটায় বসে সে যদি ডাকে! সে আসেনি। সেই চেনা-সুরে সে আর ডাকেনি! সে যেন হারিয়ে গেছে, কে জানে কোথায়!

    এক শীত পেরিয়ে আর এক শীত এসে গেল। বুড়ো আরও বুড়ো হল। তবু এতদিন এক-পা এক-পা করে হাঁটত বুড়ো। এখন পারে না। তবু এতদিন মুঠো মুঠো আলো এসে ছড়িয়ে পড়ত বুড়োর চোখে, এখন পড়ে না। অস্পষ্ট চোখের চাউনি তার ধীরে ধীরে যেন নিভে আসছে। যেন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে বুড়ো।

    একদিন আর উঠতে পারল না বুড়ো। একাকী সেই নিস্তব্ধ ঘরে শুয়ে শুয়ে বুড়ো ভাবতে লাগল, এবার বুঝি তার সময় হয়েছে। শীতের হাওয়ায় কেঁপে ওঠে বুকের ভেতরটা। ভারি কষ্ট তার। আহা! এই সময় কেউ যদি তার বুকে একটু হাত রাখে! কেউ যদি তার গায়ের গরম রক্তের উত্তাপ দিয়ে, বুড়োর বরফ-ঠাণ্ডা দেহটাকে একটু আরাম দেয়!

    যেদিন একথা ভেবেছিল বুড়ো, সেইদিনই বুড়োর ভাঙা ঘরের চালে একটি পাখি ডেকে উঠেছিল। হ্যাঁ, আহত সেই পাখিটি, যে-পাখিটির প্রাণ বাঁচাতে বুড়োর বুকের আদর উপছে পড়েছিল, সেই পাখিটি আজ এসেছে। সে আজ ডাক দিয়েছে।

    তার ডাক শুনে, সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি পাখি উড়ে এসেছিল সেই ভাঙা চালে।

    তারপর অসংখ্য পাখি।

    তাদের নরম পালকের ছোটো ডানাগুলি বিছিয়ে দিয়েছিল ভাঙা ঘরের চালে। ফুটো দেওয়ালের ফাঁকে। আর বিছিয়ে দিয়েছিল বুড়োর বরফ-ঠাণ্ডা দেহটার ওপর। যে-মানুষ একটি পাখির প্রাণ বাঁচাল, অসংখ্য পাখি আজ সে-কথা ভুলবে কেমন করে? তাই ওরা আজ ছুটে এসেছে এই বুড়ো মানুষটির প্রাণ বাঁচাতে। ওই শীতের সঙ্গে আজ তারা লড়াই করবে। লড়াই করতে করতে ওরা যদি মরে, মরবে। মরার সময় নিজেদের ডানার পালকের গুচ্ছগুলি বুড়োর সারাদেহে ছড়িয়ে দেবে। রঙিন পালকের নীচে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে থাকবে বুড়ো। তারপর শীতের খোঁচা-খোঁচা নখগুলো যেদিন ভোঁতা হয়ে যাবে, যেদিন বুড়োর গায়ে আর ফুটিয়ে দিতে পারবে না, সেদিন বুড়ো আবার উঠবে। আবার হাঁটবে। আবার নিস্তেজ চোখের আলোয় মিটমিট করে দেখবে সবুজ ঘাসের ওপর বসন্তের হাওয়া বইছে। ফুলের গন্ধ ভাসছে সেই হাওয়ায়। আর নয়তো ভ্রমর, অলি গুনগুন করে উড়ে উড়ে, দূরে দূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

    না, শীত গেল না। ওই রঙিন ছোটো পাখির দল পারল না শীতের সঙ্গে লড়াই করতে। পারল না তারা বুড়োর বুকের প্রাণটি তাদের ডানার আড়াল দিয়ে আগলে রাখতে। চলে গেল বুড়ো!

    শেষ নিশ্বাসের শব্দটুকু যখন শেষবারের মতো থেমে গেছল বুড়োর, তখন সেই পাখিটিই কেঁদে উঠেছিল সর্বপ্রথম। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে কী যে বলেছিল পাখিটি, পাখি ছাড়া সে-কথা কে জানবে? সেই পাখির কান্না শুনে অসংখ্য পাখি একই সঙ্গে ডুকরে উঠেছিল। অসংখ্য পাখির ছোটো চোখের মণিগুলি মুক্তোর মতো ঝলসে উঠেছিল। তারপর ওরা কাঁদতে কাঁদতে একসঙ্গে উড়ে গেছিল আকাশে। উড়তে উড়তে ওদের রঙিন ডানাগুলি গায়ে-গায়ে ছুঁয়ে যায়। ছন্দে-ছন্দে দোল খায়। দূর আকাশে একটি যেন রঙের স্রোত দোলনার ঢেউ তুলে উড়ে চলেছে।

    চেয়ে দেখো, আরও ভালো করে চেয়ে দেখো, কী দেখছ? দেখতে পাচ্ছ না, পাখিদের রঙিন ডানার রঙে রঙে কে যেন বুড়োর মূর্তিখানি কত যত্ন করে সাজিয়ে, ওই দোলনায় বসিয়ে দিয়েছে। দেখতে পাচ্ছ না, সেই আহত পাখিটি তার কপালে রঙের ফোঁটা এঁকে দিচ্ছে? ওদের ডানার দোলনায় বসিয়ে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুড়োকে?

    কে জানে স্বর্গ কত দূর! দূর পৃথিবীর কোন পারে! ওরা কি সেই স্বর্গেই নিয়ে যাচ্ছে বুড়োকে? হবেও বা!

    কিন্তু চেয়ে দেখো ওই পাখিগুলির দিকে, কান পেতে শোনো, ওদের গলার সুর কেমন গান হয়ে গেয়ে উঠেছে! ও গান শুনলে কে বলবে, স্বর্গ দূর, অনেক দূর!

    টীকা