ছুম আর ছবি
শৈলেন ঘোষ দ্বারাছুম ছবি আঁকতে পারে।
অবিশ্যি ছুম যে খালি ছবিই আঁকে, তা নয়। ও যেমন ছোট্ট, তেমনি ওর একটা ছোট্ট ঘোড়া আছে, টুট্টু। যখনই মন চায় ও টুট্টুর পিঠে চাপে। তারপর টগবগ টগবগ ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যায়। ওই যেখানে আকাশটা মাটিতে এসে মিশেছে, আকাশের নীল আর মাটির সবুজ এক হয়ে গেছে, ওর ভারি ইচ্ছে ওইখানে যায়। আকাশটা ছুঁয়ে আসে। দাদু কত বলবে, ‘যাস না যাস না ছুম।’ ছুম শুনবেই না।
যখন বেলা বাড়ে, একলা দাদু ঘরে বসে বসে আনচান করে আর মোটা কাচের চশমাটা চেখে লাগিয়ে মাঠের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তখনও ছুম ফিরবে না। ফিরবে, যখন সাঁঝ নামবে, একটু একটু আঁধার আসবে। আঁধার নামলে তো আর পথ চেনা যায় না। অগত্যা ফিরে আসতেই হয়। ভারি রাগ ছুমের ওই সাঁঝের ওপর। ও-ই তো যত নষ্টের গোড়া। কোনোদিনই ও ছুমকে আকাশের কাছে যেতে দেবে না।
কেমন করে যে ছুম ছবি আঁকতে শিখেছিল, তা ও নিজেও জানে না। খুব সকালে ঢেউ-ঝিলমিল নদীর ওপারে আকাশ ভরে যখন সোনা ছড়িয়ে পড়ত, ওর চোখ দুটি নেচে উঠত দেখতে দেখতে। ও বলত, ‘ছবি আঁকি।’
মস্ত গাছটার সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে, তুকতুকে ছানা-পাখিগুলো যখন কিচমিচ করে ডাকত আর মায়ের মুখ থেকে ঠুকরে ঠুকরে খাবার খেত, দেখতে দেখতে খুশিতে ওর ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠত, মন বলত, ‘ছবি আঁকি।’
শিউলি গাছের নীচে নীচে, খুব সকালে, ঝুম-ঝুম-ঝুম মল বাজিয়ে ফুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা যখন আঁচল ভরে শিউলি কুড়োত, তখন ওর চোখ বলত, ‘ছবি আঁকি।’
ছুম কোনোদিন মাকে দেখেনি। ‘মা’ বলে কাউকে ডাকেওনি। তবু সেদিন অবধি বাবাকে দেখেছে। তারপর বাবা যে সেই সওদাগরের জাহাজে চেপে বাণিজ্য করতে গেল, আর ফিরল না। সেদিন থেকে দাদুও কেমন যেন অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। এই অ্যাত্তখানি চওড়া বুক, ভেঙে বেঁকে গেছে। নইলে ছুম দেখেছে, দাদু সারাদিন রোদে রোদে খেতে খেতে ঘুরেছে আর ফসল ফলিয়েছে। সবুজের ছোঁয়ায় উপচে গেছে ওদের ছোট্ট মাটির ঘর, দালান, উঠোন। আজ আর কিচ্ছু নেই।
কিচ্ছু নেই দাদুর, আছে শুধু ছুম। ছুমকে নিয়েই দাদুর যত ভাবনা, যত কল্পনা। কিন্তু ও যে এখনও ছোট্ট। দাদু তো বুড়ো হয়েছে। ক-দিন বাঁচবে আর? কেমন করে ছুমকে মানুষ করে যাবে দাদু? শরীর যে ভাঙছে। ভাঙতে ভাঙতে একদিন শেষ হয়ে গেলে?
না, শেষ হবে না। শেষ হতে দেবে না দাদু। একটা করে বছর কাটে, একটা করে শীত যায়, আর দাদু ভাবে, আহা! আর একটা শীত যেন কাটে!
এমনি করে কত বছর কেটে গেছে। আর এখন? শরীর যেন বইতে চায় না। ভয় লাগে!
একদিন ঘুম আসছিল না দাদুর চোখে। দাদুর পাশে ছুমও শুয়ে। ছুমের চোখেও ঘুম নেই। ছুম আজ শুয়ে শুয়ে ভাবছে, একদিন না, দু-দিন পরে রাজার জন্মদিন। রাজার জন্মদিন তো ছুম কখনো দেখেনি। শুনেছে সে নাকি এক এলাহি ব্যাপার। রাজধানী-শহরে উৎসব আর আনন্দ। কত আলো, কত রং। হাসি আর মজা। আহারে! একবার যদি রাজধানী যেতে পায় ছুম।
‘ছুম’, আচমকা দাদু ডাকল।
‘অ্যাঁ!’ ভাবতে ভাবতে চমকে সাড়া দিল ছুম।
‘ঘুম পাচ্ছে না?’ জিজ্ঞেস করল দাদু।
‘ঘুম আসছে না।’ উত্তর দিল ছুম। তারপর দাদুর বুকের মধ্যে একটি ছোট্ট পাখির মতো কুঁকড়িয়ে লুকিয়ে পড়ল। দাদু জড়িয়ে ধরল ছুমকে। আদর করল দাদু। জিজ্ঞেস করলে, ‘তুই কবে বড়ো হবি ছুম?’
ছুম উত্তর দিলে কেন আমি তো বড়ো হয়ে গেছি। আর তো ক-দিন পরে আমি দশ-এ পা দেব। এখন আমি সব বলতে পারি। বলো না, কী করতে হবে!
দাদু বললে, ‘দেখছিস তো, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। খাটতে পারি না। পয়সা নেই। তোকে কী খেতে দেব?’
ছুম দাদুর গলাটি জড়িয়ে ধরলে। বললে, ‘সে তুমি ভেব না দাদু। আমি টুট্টুর পিঠে চেপে রাজধানী থেকে ঘুরে আসি, তারপর দেখবে কী করি!’
‘রাজধানী!’ চমকে উঠল দাদু।
‘হ্যাঁ। রাজার জন্মদিনের উৎসব দেখতে যাব। জানো দাদু, আমি রাজার জন্যে একটা ছবি এঁকেছি।’
‘কী ছবি?’ দাদু যেন একটু ব্যস্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলে।
ছুম বললে, ‘মাছ। কাল তোমায় দেখাব। শুনেছি রাজা নাকি মাছ ভালোবাসে।’
যেটুকু ঘুম দাদুর চোখে ছুঁইছুঁই করছিল, তাও যেন হারিয়ে গেল। বে-বাক হয়ে গেল দাদু। একটা ভাবনাই মনকে ছেয়ে ফেললে। ভাবনা, ছুম যা ভেবেছে তা তো করবেই!
ছুম জিজ্ঞেস করলে, ‘দাদু, বলছ না কিছু?’
দাদু বললে, ‘ছুম, আমি ভাবছি টুট্টুকে বেচে দেব।’
‘অ্যাঁ!’ আঁতকে উঠল ছুম। তারপর দাদুর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠল, ‘না-আ-আ।’
দাদু আবার বললে, ‘কী করি বল? পয়সা নেই, ঘরে খাবার নেই। কাল সকালে লোক ডাকব। এক-শোটা টাকা পেলেই বেচে দেব।’
ছুমের মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না। টুট্টুকে ছেড়ে ছুম যে কেমন করে থাকবে, ভাবতেই পারে না। টুট্টু যে ওর বন্ধু। ওর ওই ছোট্ট ঘোড়াটাই যে সব। দাদুর কাছে ছুম কত রাজারাজড়ার গল্প শুনেছে। শুনেছে ঘোড়ার পিঠে চেপে তারা কত যুদ্ধ জয় করেছে। ছুমও ভেবেছে, একদিন সেও টুট্টুর পিঠে চেপে, তরোয়াল ঘুরিয়ে লড়াই করবে। রাজ্য জয় করবে। তারপর রাজপুত্তুরের মতো মাথায় পাগড়ি এঁটে, গলায় পান্না-চুনির মালা পরে, নাম-না-জানা রাজকন্যার খোঁজে বেরুবে। কোথায় থাকে সে-রাজকন্যা? সে-দেশ কোথা? কে জানে কোথা! হয়তো কত পাহাড় ডিঙোতে হবে। কত নদী পেরুতে হবে। মরুর দেশে পাড়ি দিতে হবে। আ! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। ছুম আর ছবিটা।
না, না, সে কিছুতেই টুট্টুকে বেচতে দেবে না। কিছুতেই না।
দাদু ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম পাচ্ছে না ছুমের। ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের আকাশটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছুম। রাতের আকাশে ছোট্ট ছোট্ট তারার টিপ পরিয়ে কে যেন অবাক-অবাক ছবি এঁকে রেখেছে। আকাশটা যেন আশ্চর্যের হাতছানি। আকাশের বুকে যেন লুকিয়ে আছে কত গল্প, কত অজানা কাহিনি।
দাদু এখন নিশ্চিন্তে ঘুমুক। খুব চুপিসাড়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল ছুম। না, টের পায়নি দাদু। অন্ধকার ঘরে আকাশ থেকে আলোর ছায়া যতটুকু নুয়ে পড়েছে, তাতেই ও নিজের জামাটা দেখতে পেলে। গায়ে দিল। মাছের ছবিটা জামার পকেটে রাখল। নি:সাড়ে ঘরের দোর ঠেলে বেরিয়ে পড়ল ছুম। ছুটল টুট্টুর কাছে। ওর পিঠে চাপল, বলল, ‘চ।’
রাত অন্ধকার। কোথা যাবে ছুম জানে না। তবু ছুটল টুট্টু, টগবগ, টগবগ।
গাছে গাছে পাখিগুলো ঘুম দেয়।
টগবগ, টগবগ।
ডালে ডালে ফুলকুঁড়ি দোল খায়।
টগবগ, টগবগ।
দূরে দূরে শেয়ালেরা হাঁক দেয়।
টগবগ, টগবগ।
তারাগুলো মিটিমিটি চোখে চায়।
টগবগ, টগবগ।
ছুটতে ছুটতে কখন যে তারাগুলো টুপ টুপ নিভে গেল, খেয়াল করতে পারল না ছুম।
শেয়ালেরা হেঁকে হেঁকে কখন যে চুপ করে গেল বুঝতে পারল না ছুম।
ডালে ডালে ফুলকুঁড়ি কখন যে দুলে দুলে ফুটে উঠল, দেখতে পেল না ছুম।
পাখিগুলো ঘুম ভেঙে কখন যে গাছে গাছে গেয়ে উঠল, জানতে পারল না ছুম।
সোনা-সোনা ভোরের আকাশ। ঝুরু ঝুরু মিষ্টি হাওয়া। আঃ! সকাল হয়ে গেছে। তবু টুট্টু ছুটছে, টগবগ, টগবগ।
আর ছুটতে হবে না। রাজধানী এসে গেছে। আঃ! কী সুন্দর! চোখ ধাঁধিয়ে গেল ছুমের। মস্ত মস্ত বাড়ি। হাজার রকম গাড়ি! নানান সাজের মানুষ।
কী সুন্দর সাজিয়েছে আজ রাজধানীকে। যেদিকে চাও, দেখবে রঙিন-রঙিন পতাকা। আকাশে বেলুন। ইয়া বড়ো বড়ো পুতুল, রাক্ষস-খোক্ষস, বাঘ-সিংহী। রাস্তায় সকালের রোদ ঝিলমিল করছে। কেন এত সাজের ঘটা! আজই তো রাজার জন্মদিন! একটু পরে রাজার মিছিল বেরুবে। রাজা মিছিল করে মন্দিরে যাবেন। ঠাকুরকে প্রণাম করে আসবেন। বলে নাকি সে-মিছিল দেখলে চোখ ঝলসে যায়। মিছিল দেখার আগেই ছুমের যা অবস্থা! দেখলে না-জানি কী হয়।
ছুমের তো বুকখানা খুশিতে ভরে গেল। কোথা যেতে কোথায় এসে পড়েছে। ভালোই হয়েছে। ভাগ্যিস বেরিয়ে পড়েছিল! তা না হলে রাজার মিছিল দেখাই হত না। যখন মিছিল বেরুবে, একটা বেশ জুতসই জায়গা দেখে দাঁড়াবে ছুম। একটা উঁচু জায়গা যেখান থেকে সব দেখা যাবে। তারপর যেই রাজা তার সামনে দিয়ে যাবে, ও ছুট্টে গিয়ে রাজার হাতে ছবিটা—
থমকে গেল ছুম। ছবিটা আছে তো! বুকটা ধক করে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি জামার পকেটে হাত দিলে। উঃ! খুব রক্ষে! আছে! একদম মনে ছিল না ছুমের।
ছুম টুট্টুর পিঠে বসে বসেই হাঁটছিল। হাঁটছিল, দেখছিল। আর ভাবছিল। মনে হচ্ছে টুট্টুর একটু একটু কষ্ট হচ্ছে। টুট্টুর আর দোষ কী। সারারাত ছুটছে। কষ্ট তো হবেই। না, একটু জিরিয়ে নেওয়া ভালো।
হাঁটতে হাঁটতে টুট্টু যেদিকটা এল সেখানটা যে একেবারে নিরিবিলি, নিঝুম, তা নয়। তবে লোকজন অনেকটা কম। টুট্টুর পিঠ থেকে নেমে পড়ল ছুম। সামনে একফালি সবুজ ঘাসভরতি মাঠ। বেশ খোলামেলা। ছেড়ে দিল টুট্টুকে সেখানে। খিদে পেয়েছে টুট্টুর। ঘাস চিবোতে লাগল সে।
ছুম কী করবে? ওই নরম ঘাসের ওপর শরীরটা একটু এলিয়ে দেবে, না ঘুরে ঘুরে দেখবে? দেখতেই ইচ্ছে করছে। বললেই তো আর শহরে আসা যায় না! সব দেখে নেওয়াই ভালো।
আরে! সামনে ও আবার কে? রাস্তায় বসে বসে যেন কী করছে। এগিয়ে গেল ছুম। সত্যিই তো! দেখে, বসে বসে রাস্তার ওপর খড়ি দিয়ে ছবি আঁকছে! কী ছবি দেখি তো! একটা কুকুর! কী সুন্দর!
আঁকা দেখতে দেখতে তার সামনে বসে পড়ল ছুম উপুড় হয়ে। অবাক চোখে দেখতে লাগল। ছবিও দেখছে, লোকটাকেও দেখছে। লোকটা যেন কেমন কেমন! কাপড়টা ছেঁড়া ছেঁড়া। ফতুয়াটা ময়লা ময়লা। পাশে একটা পুঁটুলি। তাতে সাত-সতেরো ভরতি কী সব।
হয়তো ওর সম্পত্তি। পুঁটুলিটার পাশে ক-টা রঙের খড়ি। একটা লাল, একটা নীল, একটা বাদামি, একটা কালো। ছড়িয়ে ছড়িয়ে এদিক-ওদিক পড়ে আছে। ছুম ভাবলে আঁকা শেষ হলে নিশ্চয়ই রং করবে। তখন কুকুরটা আরও সুন্দর দেখতে লাগবে। দেখি না কী করে!
একটু পরেই তো আঁকা শেষ হল। কই রং তো দিল না। ও কী! এঁকেজুকে, পুঁটুলিটা মাথায় দিয়ে, দিব্যি শুয়ে পড়ল লোকটা টান টান হয়ে। ছুমের একবার মনে হল জিজ্ঞেস করে, কই রং দিলে না? সাহস হল না। কিন্তু ছুমের মনটা বড়ো ছুঁক ছুঁক করছে। মনে হচ্ছে কুকুরের গা-টা যদি বাদামি হত আর গা ভরতি কালো কালো ছোপ, ভারি মানাত। ছুমের হাত নিশপিশ করছে! করলেই বা কী! ছবিটা তো ওর নয়। রংগুলোও নয়। পরের জিনিসে হাত দিয়ে কাজ কী বাবা!
হঠাৎ যেন বাজনা শোনা যাচ্ছে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাজার মিছিল বেরিয়েছে। এদিক দিয়েই যাবে। এগিয়ে আসছে। কিন্তু লোকটার যেন কোনো গ্রাহ্যই নেই। চোখ বুজে কেমন পড়ে আছে দেখো! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!
ছুম একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল লোকটার দিকে। হ্যাঁ, ঘুমিয়েই পড়েছে। কেমন ফুরফুর করে নাক ডাকাচ্ছে! ছুমেরও মন ছটফট করে উঠল। ও আর থাকতে পারল না। বাজনার শব্দ ওর মনকে যেন খুশিতে ভরিয়ে দিল। হাত বাড়াল ছুম। চট করে বাদামি খড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে, কুকুরের গায়ে বুলিয়ে বুলিয়ে ভরিয়ে দিলে। কালো রঙের খড়ি নিয়ে বাদাম-গায়ে ছোপ দিলে। ভারি সুন্দর দেখতে হয়েছে! কিন্তু চোখ দুটো! তাই তো! চোখে কী দেয়, কোন রংটা! নীল রংটা।
আর দেখতে! যেই-না দুটি চোখে নীল পড়েছে, আর অমনি কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠেছে। ছুম একেবারে থতোমতো খেয়ে গেছে! কুকুরটা ডেকে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়েছে! কী কান্ড! ছবির কুকুর জ্যান্ত হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে আর জিব ভেঙাচ্ছে।
ছুম একেবারে হাঁদারাম! কী করব, কী করব ভাবতে ভাবতেই কুকুরটা মারলে দৌড়, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ।’ ছুমও কিছু ভেবে না-পেয়ে দৌড় দিলে পেছনে পেছনে।
কুকুরটা দৌড়োচ্ছে, ‘ঘেউ, ঘেউ।’
আর ছুম ডাকছে, ‘কুকুর, কুকুর, দাঁড়া, তুতু।’
কিন্তু কুকুরের তো ঘুমের ডাক শুনতে বয়ে গেছে।
রাজার মিছিল দেখতে রাজপথে লোক গিজগিজ। কুকুরটা ছুটতে ছুটতে, ডাকতে ডাকতে একেবারে ভিড়ের মধ্যে সেঁদিয়ে পড়েছে। এই রে! তাড়া লাগিয়ে ডেকে উঠল, ‘ঘেউ ঘেউ’। ব্যাস! ছুট, ছুট, ছুট! যে যেদিকে পারল একেবারে দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে ধাক্কাধাক্কি। কেউ পড়ল, কেউ উঠল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, ‘পাগলা কুকুর, পাগলা কুকুর।’
ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলিতে ছুমও নাস্তানাবুদ। লোকে চেঁচায়, ‘পাগলা কুকুর, পাগলা কুকুর।’
ছুম চেঁচায়, ‘কুকুর, কুকুর, আঃ তুতু!’
কে শুনছে! সামনে ছোটে লাল-শাড়ি মেয়েটা। কুকুর ছুটল তার পেছনে। মেয়েটা ‘মা গো’ বলে ভ্যাঁ!
ডাইনে ছোটে মেজোপিসির ছেলেটা। কুকুর ডাকল তার পেছনে। ছেলেটা ‘বাবা গো’ বলে চিৎপটাং।
ছুটোছুটিতে ঠেলাঠেলিতে যেন কুরুক্ষেত্র!
এদিকে রাজার মিছিল এগিয়ে এসেছে। এইরে! কুকুরটা সব ছেড়ে এবার মিছিলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কী হবে?
বাজনদার বাজনা ফেলে দে চম্পট।
ঢাকি ঢাক ছেড়ে পগারপার।
হাতিগুলো ভয়ে ভয়ে নাচছে। উটগুলো ছুটছে। ঘোড়াগুলো ডাকছে আর পল্টনগুলো এদিক-ওদিক কাটছে!
কুকুর ডাকছে, ‘ঘেউ ঘেউ।’
ছুম ছুটছে, ‘আঃ তুতু।’
রথের চাকা ছিটকে গেল। এক্কাগাড়ি উলটেB গেল। বীর সেনারা পালিয়ে গেল।
মিছিলের পিছু পিছু ঘোড়ার পিঠে রাজা আসছিলেন। খোশমেজাজে। হঠাৎ রাজার চমক ভাঙল। ভুরু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? এত হইচই কেন?’
একজন হন্তদন্ত হয়ে বললে, ‘আজ্ঞে, পাগলা কুকুর তাড়া করেছে।’
বলতে বলতেই কুকুরটা একেবারে রাজার পেছনে। ‘ঘ্যাঁক’ করে ঘোড়ার পায়ে কামড়ে দিয়ে, ‘ঘেউ, ঘেউ’ করে ডেকে উঠল।
রাজা ভয়ে চমকে উঠে, ‘কে-ও কে-ও’ বলে হাঁক দিলেন। ব্যাস! তারপর ঘোড়ার কী তিড়িং বিড়িং লাফানি। লাফাতে লাফাতে জোর কদমে ছুট।
কুকুরও ছাড়বে না। ঘোড়া ছোটে, সে-ও ছোটে। তাই না দেখে রাজা চেঁচায়, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’
কে বাঁচাবে? কোথায় পল্টন আর কোথায় সিপাই! রাজার যেন কান্না পেয়ে গেল! বাবা! আচ্ছা রাজাতো! কুকুরের তাড়া খেয়েই এই দশা! না-জানি বাঘ-ভালুক হলে কী হত!
দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, এ-কুকুরটা বাঘ-ভালুকের বাড়া। ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ’, ডাকছে, আর রাজার ঘোড়ার পায়ে আবার বুঝি কামড়ে দেয়!
‘ঘ্যাঁক!’ কী হল? কামড়ে দিল?
না, না, লাফ দিল। এই সব্বনাশ! লাফ দিয়ে ঘোড়ার ল্যাজটা কামড়ে ধরে ঝুলে পড়েছে যে! বাপরে! বাপরে! কী কান্ড! ঘোড়ার ল্যাজে কুকুর ঝোলে!
অমনি ঘোড়াটা চিৎকার শুরু করে দিলে, ‘চিঁ হিঁ হিঁ।’ চার পা তুলে লম্ফঝম্ফ লাগিয়ে দিলে।
যতই লাফাও আর যতই চেঁচাও, কুকুর কিন্তু ল্যাজ ছাড়ছে না। ঠিক ঝুলছে।
দেখে তো রাজার চক্ষু চড়কগাছ। রাজা ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেললেন। হাত ফসকে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে ধপাস!
ঘোড়াটা চার পা তুলে লাফাচ্ছে।
মাটিতে পড়ে রাজা কোঁকাচ্ছে।
আর কুকুরটা ল্যাজ কামড়ে হাঁপাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে ছুমও সেখানে হাজির। ছুম ঘোড়ার লাফানি আর কুকুরের হাঁপানি দেখে না-পারছে এগোতে, না-পারছে পেছোতে। সব্বনাশ! কী হবে এখন? ছুম ভাবলে নিশ্চয় কুকুরটা খেপে গেছে। খ্যাপাকে ঠাণ্ডা করি কেমন করে? কাছেপিঠে লাঠিও দেখছি না, বাড়িও দেখছি না যে দু-ঘা বসিয়ে দিই।
কী বরাত! ঠিক সেই সময়, জলভরতি কলসি কাঁখে, সেখান দিয়ে একটা বুড়ি ছুটে পালাচ্ছিল। ছুম এদিক ওদিক দেখে, ছুটে গিয়ে, বুড়ির কাঁধ থেকে কলসিটা ছিনিয়ে নিলে। নিয়ে জলসুদ্ধ কলসিটা হুড়-হুড় করে কুকুরের গায়ে উলটে দিলে।
‘যা: চলে! এ কী হল?’
কী হল?
কোথায় কুকুর!
মানে?
একেবারে চক্ষের নিমেষে কুকুর উধাও। না, উধাও না। তবে? মাথায় জল পড়তেই কুকুরটা হুস করে গলে গেল! ওই তো, ঘোড়ার ল্যাজ থেকে টুপ টুপ করে রং ঝরছে! বাদামি-বাদামি রং, কালো কালো রং, নীল-নীল রং। মাটি দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
ছুমের চক্ষু কপালে! ছুম গালে হাতে দিয়ে দেখছে আর ভাবছে, এ-কী হল! ছবির কুকুর জ্যান্ত হল, আবার জল ঢালতে গলেও গেল! তাজ্জব কান্ড তো!
কুকুরটা জলে ধুয়ে যেতেই, ঘোড়াটার চিৎকার থামল। ঘোড়ার চিৎকার থামতে রাজারও কান্না বন্ধ হল। তাড়াতাড়ি মাটি থেকে ঝেড়েঝুড়ে উঠে পড়লেন রাজা। এদিক-ওদিক দেখলেন। কেউ কোত্থাও নেই। যাক, কেউ দেখে ফেলেনি এই রক্ষে! কেবল দেখলেন, ছুম দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়ার ল্যাজ দিয়ে তখনও টুস টুস করে রং গড়িয়ে পড়ছে। সেই রং দেখতে দেখতে ছুমের কাছে এগিয়ে এলেন রাজা। ছুম তো ভয়ে কাঠ! রাজা ছুমের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এমন আচমকা হেসে উঠলেন হো-হো-হো করে যে চমকে উঠল ছুম। হাসতে হাসতেই ছুমকে দু-হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সাবাস!’
দেখতে দেখতে পল্টনগুলো কোত্থেকে আবার ছুটে এল। সেপাইগুলো পড়ি-মরি দৌড়ে এল। আবার ভেঁপু বাজাল। ঢাকে কাঠি পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে রাজা গর্জে উঠলেন, ‘বাজনা বন্ধ করো, এ-মিছিল আর চলবে না।’ বলে রাজা ছুমকে কোলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। ঘোড়া রাজবাড়ির দিকে ছুট দিল।
রাজার কোলে বসে বসে ছুম ভাবছে, ‘বেশ তো মজা!’
রাজবাড়িতে এসে, ছুমকে নিয়ে দরবার-ঘরে হাঁটা দিলেন রাজা। হুকুম দিলেন, ‘এখনই সভা বসবে।’
তক্ষুনি পাত্র-মিত্র, মন্ত্রী-অমাত্য সবাই হন্তদন্ত হয়ে হাজির। নিজের পাশে ছুমকে বসিয়ে, রাজা রাজ-সিংহাসনে বসলেন। ছুম তো অবাক! শুধু ফ্যালফ্যাল করে সোনার সিংহাসন আর রাজার ঝলমলে পোশাকের দিকে দেখতে লাগল হাঁ করে।
একটু পরেই দরবার-ঘর লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। রাজা তখন সিংহাসন ছেড়ে উঠলেন। বললেন, ‘আজ আমার বেশ শিক্ষা হয়েছে। যে-দেশের সেপাই-সেনা, পল্টন-পেয়াদা কুকুর দেখে ভয় পায়, সে-দেশের সেনাদের যে কত মুরোদ, তা আমি আজ নিজের চোখে দেখেছি। এই যে ছেলেটিকে দেখছেন, এই ছেলেটি আজ অসাধ্য সাধন করেছে। আমার রাজ্যে সবচেয়ে সাহসী যদি কেউ থাকে, তবে সে এই ছেলেটি। নিজের জীবন তুচ্ছ করে, এই ছোট্ট ছেলেটি আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে। সুতরাং আমার জন্মদিনে এই ছেলেটিকে আমি সবচেয়ে বড়ো খেতাব ‘বীরচক্র’ দান করছি।’ বলে রাজা ছুমের জামায় একটি সোনার তকমা এঁটে দিলেন। নিজের গলার সবচেয়ে দামি মণি-মুক্তোর মালাটি খুলে ছুমের গলায় পরিয়ে দিলেন। তারপর ছুমকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটি সোনার বাক্স হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই বাক্সে লক্ষ মোহর আছে। আজ থেকে আমার রাজত্বে তোমার কোনো দুঃখ থাকবে না। তোমার জন্যে আমার ভান্ডার সবসময় খোলা।’
ছুমের হাত দুটি কেঁপে উঠল। হতভম্বের মতো চেয়ে রইল সোনার বাক্সটার দিকে।
রাজা ওর কপালে একটি চুমু দিলেন। বললেন, ‘তুমি কিছু বলো।’
ছুম একেবারে থ হয়ে গেছে। কী বলবে, কী না-বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তাইতো! তার পকেটে মাছের ছবি আছে। সোনার বাক্সটা নামিয়ে রেখে, চট করে ছবিটা পকেট থেকে বার করল ছুম। কিন্তু লজ্জা করছে। কেমন করে এই বিচ্ছিরি ছবিটা রাজাকে দেয় সে!
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ওটা?’
অত লজ্জাতেও ছুম রাজার দিকে হাতটি বাড়িয়ে দিল। ভয়ে ভয়ে ধরা ধরা গলায় বললে, ‘রাজামশাই, আপনার জন্মদিনে আমার উপহার। আমি এঁকেছি।’
‘মাছের ছবি।’ রাজা খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন। মাছের ছবি হাতে নিয়ে হেসে উঠলেন, ‘হো-হো-হো।’
রাজার হাসি দেখে ছুমও হেসে উঠল। খুশিতে ভরিয়ে দিল রাজদরবার। তারপর সোনার বাক্সটি হাতে তুলে নিল ছুম। পা-দুটি ওর নেচে উঠল। হাসতে হাসতে রাজদরবার থেকে বাইরে ছুট দিল ছুম।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথা যাও? কোথা যাও?’
ছুম বললে, ‘আসছি রাজামশাই।’
মন্ত্রী চেঁচালেন, ‘ওকে আটকাও, ওকে আটকাও।’
রাজা হুকুম করলেন, ‘না, ওকে যেতে দাও!’
ছুটতে ছুটতে ছুম একেবারে রাস্তায়। এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে সটান টুট্টুর কাছে। টুট্টু এখনও ঘাস চিবুচ্ছে। দেখতে পেয়ে আনন্দে টুট্টুর গলাটি জড়িয়ে ধরল ছুম। ওকে আদর করতে করতে লুটোপুটি খেতে লাগল। হাসতে হাসতে টুট্টুর পিঠে লাফিয়ে বসল। না, আর দেরি নয়। এক্ষুনি ঘরে ফিরে যেতে হবে। দাদু বুড়ো মানুষ, নিশ্চয়ই খুব ভাবছে ছুমের জন্যে। আহা! এতদিন ছুমের জন্যে কত কষ্ট করেছে দাদু। আর এখন? আর কোনো কষ্ট থাকবে না। একদম না। আজ থেকে দাদুর ছুটি!
চোখ দুটি ছলছল করে উঠল ছুমের। প্রথম, আজই প্রথম দাদুর জন্যে ওর চোখ দুটি কেঁদে ফেলেছে।
রাজার মুক্তোর মালাটা ছুমের গলায় দুলছে আর রোদের ছোঁয়ায় ঝিকমিক করছে। ভালো লাগছে না দেখতে?
আর?
দাদুর জন্যে ছুমের চোখ দুটো আজ ছলছলিয়ে টলমল করছে। কী সুন্দর লাগছে বলোতো?
কিন্তু কোনটি সবচেয়ে সুন্দর লাগছে? রাজার মালাটি, না ছুমের জল-টলমল চোখ দুটি? কে বলতে পারে?
কেউ না, কেউ না।