বন্ধুর নাম কালো-সোনা আর আলো-সোনা
শৈলেন ঘোষ দ্বারাএকটা ছিল কালো-কুচকুচে কাগের ছানা, আর একটা ছিল সাদা-ধবধবে বকের ছানা। কী ভাব দুই ছানার! দেখে হেসে মরি। একই গাছে বাড়ি হলে যা হয় তাই আর কী।
কিন্তু একদিন কালোর সঙ্গে সাদার হঠাৎ ঝগড়া হয়ে গেল। দেখে তো সবাই থ! ঝগড়া কেন হবে না? হয়েছে কী, সাদার মা গাছের বাসায় সবে একটা ডিম পেড়েছিল। সেই সময়ে কালোর বাড়িতে বেড়াতে এল ওর এক পিসির ছেলে। বকের বাসায় ডিম দেখে তার মাথায় এমন দুষ্টুমি চাগাড় দিল যে, ফাঁকতালে সে ডিমটা গাছের বাসা থেকে মাটিতে ফেলে দিল। তখন দেখতে হয়, ডিম পড়ল ফটাস! পড়েই চৌচির। কাছেই ছিল বকের ছানা। সে দেখে ফেলেছে। দেখে রেগে আগুন, তেলে বেগুন! দেখেই, কালোর পিসতুতো ভাই-এর পেটে দিল ক্যাঁত করে এক লাথি। তারপর লম্বা ঠোঁট দিয়ে মাথায় মারল জোরসে এক ঠোক্কর। বাছাধন লাথি আর ঠোক্কর খেয়ে একেবারে কাত। গাছ থেকে পড়ল ধপাস, মাটিতে!
কোথায় ছিল কালো-কুচকুচে। তার পিসতুতো ভাই-এর ওই দুর্দশা দেখে, ভাইকে বাঁচাতে উড়ন্ত চরকির মতো ধেয়ে এল। সাদা ছানার সঙ্গে তেড়েমেড়ে লাগিয়ে দিল নোখোনুখি আর ঠোঁটোঠুঁটি লড়াই. রক্তারক্তি কান্ড।
যখন ঝগড়া থামল, তখন এর চোখে চোট। ওর ভোঁতা-ঠোঁট। কালোর পালক ছেঁড়া। সাদার ঠ্যাং নড়নড় করে। সেই যে কালোর সঙ্গে সাদার ঝগড়া হল, সেই থেকে আর মুখ দেখাদেখি নেই।
কিন্তু হলে কী হবে, কালোকাকের ছা বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে কেমন যেন মুষড়ে পড়ল। সবসময় মুখ চুপসে বাসায় বসে থাকে। খায় না, শোয় না, ঘুমোয় না। মা বললে, ‘কালো, বাইরে যে এত আলো একটু ঠোঁট ঠ্যাং নেড়ে, পাখনা-ডানা ঝেড়ে খেলেধুলে আয় না।’ কালো কেলে হাঁড়ির মতো মুখ করে বলল, ‘না, ভাল লাগে না।’
ছেলের এমন অবস্থা দেখে মায়ের যেন কেমন মনে হল। কাক-কর্তাকে কানে কানে বলল, ‘কালোর কী হল বলোতো? ক-দিন ধরে দেখছি কারও সঙ্গে কথা বলে না। খায় না। বেড়ায় না। একবার কাগা-বদ্যিকে ডাকলে হয় না?’
মায়ের কথা শুনে কালোর বাপ হন্তদন্ত হয়ে ছুটল কাগা-বদ্যির কাছে। বদ্যি এল। কালোর গলা পেট টিপেটাপে দেখে বলল, ‘ছেলের তোমার অসুখ বড়ো সোজা নয়। ওর কাকদেহে কাক্কুস রোগের পাক ধরেছে। চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছি বড্ড কঠিন অসুখ। যাক, আমি যেমন যেমন দাওয়াই লিখে দিচ্ছি, তেমন তেমন করলে তাতে রোগী সারলেও সারতে পারে, সরলেও সরতে পারে।’ বলে কাগা-বদ্যি গাছের পাতায় ঠ্যাং-এর আখরে লিখল : একটি কচি ব্যাঙের বাচ্ছা ধরে এনে, ভোরবেলা বাসিমুখে সেই বাচ্চা ব্যাঙের ঝোল খাওয়াতে হবে রুগিকে।
দাওয়াই বাতলে কাগা-বদ্যি রুই-কানকোর কাঁটা আর তিনটে ঝাঁটাকাঠি মজুরি নিয়ে চলে গেল।
ব্যাং-এর ছা মিলবে কোথায় সে কি আর কাগা-মা জানে না! ওদের গেছো-বাসার ধারে ওই যে ডোবাটা আছে, সেই ডোবায় কত ব্যাং। ছোটো ব্যাং, বড়ো ব্যাং, কচি ব্যাং, ধেড়ে ব্যাং, সোনা ব্যাং, কোলা ব্যাং জলে ডুব দিচ্ছে, তালে তালে ডাক পাড়ছে। দেখতে দেখতে এক বাছাধন ব্যাং-এর ছানা পোকা খাওয়ার জন্যে যেই পাড়ে উঠেছে, অমনই কালোর মা মেরেছে ছোঁ। মেরেই ডানা ঝাপটে শূন্যে পোঁ! ব্যাং-ছানা ককিয়ে উঠেছে মরাকান্না কেঁদে।
ছেলের কান্না শুনে ব্যাং-মা তো শিউরে উঠল। চোখে পড়ল কাকের মা তার ছেলেকে ঠোঁটে নিয়ে পালাচ্ছে! ব্যাং-মাও জুড়ে দিল কান্না। ‘ওরে, আমার কী হল রে!’ কাঁদলে আর কী হবে। ততক্ষণে কালোর মা হাওয়া।
ব্যাং-ছানার মা একবার লাফিয়ে ছোটে, একবার হাঁফিয়ে থামে। একবার জলের ভেতর, একবার ডাঙার ওপর। ব্যাং-এর মায়ের কান্না শুনে চ্যাঙা-ব্যাঙা কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে এল না। কান্ড দেখে সবাই হতভম্ব। জলের ভেতর ডুব মেরে সবাই চুপ। ব্যাং-ছানার মা কেঁদে কেঁদে সারা হল। সকাল কাটল কেঁদে, দুপুর কাটল কেঁদে। কাঁদতে কাঁদতে রাত গড়াল। ঘুরঘুট্টি রাত। তবু কান্না থামল না।
ঠিক সেই সময়ে সেই ডোবার পাড়ের খুকুমণিদের বাড়ির জানলা খুলে কে যেন সরু গলায় চেঁচিয়ে ধমকে উঠল, ‘এই ব্যাং অমন ঘ্যাং ঘ্যাং করে চেঁচাচ্ছিস কেন রে! আমরা যে একটু শান্তিতে গান গেয়ে খেলা করব, তার উপায় নেই।’
কে ধমকালে?
তাই তো। দেখি দেখি! ওমা, ও যে খুকুমণির ছেলে-পুতুল। তা কে কার কথা শোনে! ব্যাং-মা কেঁদেই চলেছে।
পুতুল আবার ধমকাল, ‘চুপ করবি, না মজা দেখবি?’ বলতে বলতে তার কাঠের ঘোড়ার পিঠে বসে, জানলার গরাদ গলে ডোবার পাড়ে লাফিয়ে পড়ল।
তখন ব্যাং-মা ফুঁ পিয়ে ফুঁ পিয়ে বলে উঠল, ‘বাছা চুপ করব কী, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
‘তোমার আবার কী সর্বনাশ হল।’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল পুতুল।
‘ওই গাছের কাগ-মা আমার ছেলেকে খাবে বলে ছোঁ-মেরে নিয়ে গেছে।’
ব্যাং-মায়ের কথা শুনে পুতুল-ছেলে চমকে উঠল। মনটা তার দুঃখে ভরে গেল। একটু ভেবে বলল, ‘ব্যাং-মা আর কেঁদে কী করবে বলো? যা হবার সে তো হয়েই গেছে। আমি বরং দেখি তোমার ছেলের যদি খোঁজ আনতে পারি।’ বলে পুতুল-ছেলে যেমন করে ঘোড়ার পিঠে চেপে জানলা টপকে এসেছিল, ঠিক তেমন করেই ঘরে ফিরে গেল। ঘরে গিয়ে সেই যে গ্যাসভরতি বেলুনটা সুতোয় বাঁধা, উড়ে উড়ে ঘরের আচ্ছাদে মাথা ঠুকছে, সেইটা নিল। নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে কাগেদের গেছোবাড়ির তলায় গিয়ে হাজির হল। তারপর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ঘোড়ার নাম ধরে ডেকে বলল, ‘এই খটখট আমি এই উড়ন্ত বেলুনের পিঠে চেপে কাগের বাসায় যাচ্ছি। তুই সুতোটা ঠোঁটে চেপে ধর। যখন বলব তখন টেনে নামাবি। ছেড়ে দিস না যেন! তাহলে আকাশে উড়ে হারিয়ে যাব।’
ঘোড়া বলল, ‘ভয় নেই কিচ্ছু। আমার নাম খটখট—হবে না নটঘট!’
অমনি সঙ্গে সঙ্গে বেলুনের পিঠে বসে, পুতুল-ছেলে হুস হুস করে ওপরে উঠে গেল। সটান ছানা-কাগের বাসার সামনে হাজির। হাজির হয়ে দেখে কী সেই ব্যাং-এর ছা আর কাগের ছা দিব্যি বসে বসে গল্প করছে! পুতুল তো থ! আরও একটু ভালো করে দেখার জন্যে সে দ্বিগুণ উৎসাহে ঘোড়াকে ডেকে ফেলেছে, ‘এই খটখট, আরও একটু সুতো ছাড়।’
আর দেখতে হয়। কাগ-ছানা কালো হতে পারে, কিন্তু সে তো আর কালা নয়। সে শুনে ফেলেছে পুতুলের গলা। অন্ধকারে কঁকিয়ে উঠেছে, ‘কক, কক, কে রে?’
পুতুল থতোমতো খেয়ে গেছে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে কাগ-ছানাকে বললে, ‘আমি পাশের বাড়ির খুকুমণির পুতুল-ছেলে। জিজ্ঞেস করতে এসেছি ব্যাং-ছানাকে ধরে এনেছ কেন? গিলবে বুঝি? ওদিকে যে ওর মা কেঁদে কেঁদে আধমরা হয়ে গেল। ভালো চাও তো ব্যাং-ছানাকে ফিরিয়ে দাও। ওকে আমি নিতে এসেছি।’
পুতুলের কথা শুনে কাগ-ছানা বলল, ‘ওমা সে কী কথা! কে বলেছে আমি ব্যাং-ছানাকে খাব? আমাকে কাগা-বদ্যি বলেছিল বটে কচি ব্যাং-এর ঝোল খেতে। আমার দেহে নাকি কাক্কুস রোগ বাসা বেঁধেছে। আরে, বদ্যি আমার আসল রোগটাই ধরতে পারেনি। আসল রোগটা কী জানো, আমার কোনো বন্ধু নেই। আমি কারও সঙ্গে খেলা করতে পারি না। তাই ব্যাং-ছানাকে মা যখন নিয়ে এল, তখন থেকেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। তবে একথা কিন্তু আমার মা, বাবা কেউ জানে না। ওরা ওপরের ডালে ঘুমোচ্ছে। না, না, আমি ব্যাং-ছানাকে কিছুতেই মারতে দেব না। যার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তাকে মারতে আছে? ছি:। তার আবার ঝোল খায় কেউ? তা, তুমি যখন এসেছ, ভালোই হয়েছে। তুমি ব্যাং-ছানাকে নিয়ে ওর মায়ের কাছে পৌঁছে দাও। নইলে কাল সকালেই মা ব্যাং-ছানার ঝোল রেঁধে ফেলবে। আমি তো রাতে দেখি না। বরং কাল সকালে গিয়ে ওকে দেখে আসব।
কালোর কথা শুনে পুতুল তো অবাক। ভাবল, কালো কুচকুচে কাগের ছানা এত ভালো। পুতুল-ছেলে কালোর গালটা টিপে আদর করে বলল, ‘কালো, তুই এত ভালো।’ তারপরে ব্যাং-ছানাকে বেলুনে বসিয়ে গাছের গোড়ায় দাঁড়ানো ঘোড়াকে হাঁক দিল ঘোড়া তুই বেলুনের সুতো ধরে টান এবার।
পুতুল-ছেলে ব্যাং-এর ছেলেকে নিয়ে নেমে এল। ব্যাং-ছেলে মায়ের কাছে পৌঁছে গেল।
পরের দিন সকালবেলা কালোর মা ব্যাং-ছানার ঝোল রাঁধবার জন্যে কচ্ছপের খোলার তৈরি কড়াটা, গাছতলার পাথুরে উনুনে চাপিয়ে ব্যাং-এর ছানাটাকে আনতে গিয়ে দেখে গাছে ব্যাং-ছানাও নেই, কাগ-ছানাও নেই! গেল কোথায়? কালোর বাবা-মা দুজনেরই চোখ কপালে। দেখে কী, কাশবনে তাদের ছেলে ব্যাং-এর ছেলের সঙ্গে খেলা করছে আপনমনে। একটা যদি হয় কালো-সোনা, তবে আর একটা দেখতে যেন ঠিক আলো-সোনা।