বন্ধু বটে
শৈলেন ঘোষ দ্বারাভোর হচ্ছে। রোদ উঠছে। সন্ধে নামছে। রাত গভীর হচ্ছে। আমরা ঘুমিয়ে পড়ছি। এই চলছে নিয়মমাফিক রোজ। এমনি করে নি:সাড়ে যেমন কাটছে দিন, তেমনই বাড়ছে বয়েস। বাড়ছে যেমন তোমার, তেমনই আমার। ওই পাখিরও। গাছেরও। সুতরাং, বেড়েছে ওই ঘোড়াটারও।
কোন ঘোড়াটার কথা বলব?
ওই যে বুড়ো ঘোড়াটা রাস্তায় একা-একা ঘুরছে, ওর কথা বলছি। আসলে কী জানো, বুড়ো হওয়ার অনেক জ্বালা। এই ঘোড়াটার কথাই ধরো না। যখন ওর কম বয়েস, তখন কী চনমনেই না ছিল সে। দেখতেও ছিল তেমনি। গায়ের রং ছিল বাদামি। ঝকঝকে। তাই সবাই ওকে ‘বাদাম’ বলে ডাকত। বাদাম ছিল একটা এক্কাগাড়ির ঘোড়া। কী তেজিয়ান। ছুটত যেমন টগবগ করে, এক্কাগাড়ির মালিকের পকেটও তেমন ভারি হত ঝনঝনিয়ে। তখন কী আদর বাদামের। দু-বেলা যেমন চলছে দলাই-মলাই, তেমন জুটছে লাগসই খানাপিনা। তারপরে, এই যে দিনের পর দিন যায়, বয়েস বাড়ে। বাদাম বুড়ো হয়, মালিকের পকেটও হালকা হয়। বাদাম আর তেমন পারে না গাড়ি টানতে। কে আর এখন বুড়ো ঘোড়াকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবে? সুতরাং, পথ দেখো।
এখন বাদাম তাই সত্যিসত্যি পথ দেখছে। বলিহারি যাই মালিককে। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যে তাকে একদিন খাওয়াল, তুই তাকে তাড়িয়ে দিলি! ছি:!
তো, একদিন হল কী, খাবার খুঁজতে খুঁজতে বাদাম হঠাৎ একটা কুকুরকে দেখতে পেল। দেখে মনে হল, কুকুরটাও কিছু খোঁজাখুঁজি করছে। বাদামের আন্দাজটা একদম ঠিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, অজানা একটা কুকুরকে হুট করে না-জানা কথা জানার জন্য আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে? শুধু তা-ই নয়, এটাও তো দেখতে হবে, কোথায় ঘোড়া আর কোথায় কুকুর! বয়েসের কথা ছেড়ে দাও, আকার-প্রকারে কত তফাত বলো। কথা বলতে গেলে কুকুরটা যদি দুম করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়! তখন ঘোড়ার মানমর্যাদা কোথায় যাবে বলো!
ঘোড়া নিজের মানমর্যাদার কথা ভাবলে কী হবে, কুকুরটাই ফস করে বলে বসল, ‘এ কী খুড়ো, তুমি যে একেবারে বুড়ো হয়ে গেলে!’
কুকুরের কথা শুনে বাদাম বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ারই কথা। কেন না, কুকুরটা ডাকল তাকে ‘খুড়ো’ বলে। চেনে নাকি! চিনুক, আর নাই চিনুক বাদাম ভাবল, কুকুরের সঙ্গে তো আর কাঁচুমাচু হয়ে কথা বলা যায় না। তাই ভারিক্কি চালে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কেমন করে বুঝলি আমি বুড়ো হয়ে গেছি?’
কুকুরটা হাসতে হাসতে বলল, ‘এতে আর বোঝাবুঝির কী আছে, এ তো খুব সোজা। তোমার আগাপাছতলা দেখলেই তো বোঝা যায়, তুমি বুড়ো, না জোয়ান?’
বাদামের নজরটা এতক্ষণ মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। কুকুরের কথা শুনে হঠাৎ কেমন যেন তেরছা হয়ে গেল দৃষ্টি। এবার গুরুগম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তোর নাম কী রে?’
‘জিপসি।’
বাদাম উত্তর দিল, ‘বাহ, নামটা তো বেড়ে বাগিয়েছিস।’
কুকুর জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, তোমার কোনো নাম নেই?’
ঘোড়া উত্তর দিল, ‘কেন থাকবে না। আমার নাম বাদাম।’
ঘোড়ার নাম শুনে কুকুর হেসে বলল, ‘এ বাবা! বাদাম আবার কারও নাম হয় নাকি? বাদাম তো ভেজে খায়।’
কুকুরের হাসি দেখে বাদাম দিল এক ধমক, ‘থাম! তুই তো ভারি অসভ্য কুকুর। আমার নাম শুনে আমার সামনেই তুই খিকখিক করে হাসছিস। ঠিক আছে, আমার নামটা না-হয় ভেজে খায়, কিন্তু তোর ওই জিপসি নামটা তো নেচে খায়!’
কুকুর বলল, ‘হতে পারে, তবে খুড়ো, যাই বলো আর তাই বলো, এটা তোমায় মানতেই হবে, ভেজে খাওয়ার চেয়ে নেচে খাওয়া অনেক ভালো। একটা দেখে মন ভরাতে হয়, আর একটা খেয়ে পেট ভরাতে হয়।’
ঘোড়া কুকুরের কথা শুনে বলে উঠল, ‘অ্যায় ধরেছি, এবার বল কোনটা আগে দরকার? মন ভরিয়ে পেট ভরানো, না পেট ভরিয়ে মন ভরানো?’
ঘোড়ার কথা শুনে কুকুর এবার একটু প্যাঁচে পড়ল। আর তক্কাতক্কি না-করে খোলাখুলি বলল, ‘দেখো খুড়ো, তোমার একথাটার সিধে উত্তর একটু ভেবে বলতে হবে। তবে, এটাও ঠিক বাদাম ভাজতেও হবে, জিপসিকে নাচতেও হবে। যার যা চরিত্তির, বুঝলে না!’
ঘোড়া বলল, ‘বাবা, তোর তো দেখি খুব টনটনে জ্ঞান। এই বয়েসে কার কী চরিত্তির সব জেনে ফেলেছিস! তা, এখানে কী কারণে ঘুরঘুর করা হচ্ছে?’
কুকুর উত্তর দিল, ‘অ্যাই, এতক্ষণে আসল কথাটা তুমি তুললে। ব্যাপারটা কী জানো, আমিও তখন থেকে ভাবছি, কথাটা তোমায় জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কিছুতেই ফুরসত পাচ্ছিলুম না। আমার মনে হয়, উত্তরটা তুমি আগে দিলে সবদিক থেকে সেটা মানানসই হয়। কেন-না, আমার চেয়ে তুমি বয়েসেও বড়ো, দেহ-গতরেও লম্বা-চওড়া।’
‘আর মানমর্যাদায়?’ ঘোড়া জিজ্ঞস করল।
কুকুর বলল, ‘সেটা নিয়ে অবশ্য এককথায় কিছু বলা যাবে না। কারণ এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত।’
ঘোড়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘সে কী রে! ঘোড়ার সঙ্গে কুকুরের মানমর্যাদা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোথাকার মুনির কথা বলছিস তুই? কোথায় থাকে তারা? তুই কি পাগল হয়ে গেলি? জানিস আমি জাতে যেমন বড়ো, কাজেও তেমন দড়!’
কুকুর বলল, ‘বুঝেছি, তবে জাতের বড়াই না-করাই ভালো। কেন-না, জাতে তুমিও জন্তু, আমিও জন্তু। জাত নিয়ে মারামারি করে মানুষে। আমাদের ওসব দরকার পড়ে না। কিছু যদি মনে না-করো অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘কী কথা?’ ঘোড়া জিজ্ঞেস করল।
‘ওই যে বললে না, তুমি কাজে দড় ছিলে, তা তুমি কী কাজ করতে?’
‘আমি এক্কাগাড়ি টানতুম।’ ঘোড়া যেন বুক ফুলিয়ে উত্তর দিল।
‘ধুস-স-স-স।’ বলে কুকুর এমন তাচ্ছিল্য করে উঠল যে, ঘোড়ার মান-ইজ্জত যায় আর-কী!
ঘোড়া রেগেমেগে কুকুরকে তেড়ে উঠল, বলল, ‘তুই তো আচ্ছা ত্যাঁদড় কুকুর। তুই তো ঘরে-পোষা কুকুর রে! তু-তু করে ডাকলে তোর তো কাজ ল্যাজ নাড়ানো! তুই আমাকে হেলাফেলা করিস!’
কুকুর খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছ। আসলে কী জানো, ল্যাজ যেমন আমার আছে, তেমনি তোমারও আছে। আমিও নাড়াই, তুমিও নাড়াও। কাজেই ল্যাজ নিয়ে টানাটানি না-করাই ভালো। বলতে চাই, তুমি যে কাজটা করতে তার চেয়ে আমার কাজঢাB ছিল অনেক সম্মানজনক। আমি কাজ করতুম একটা সার্কাস পার্টিতে। আমি সার্কাসে নাচ দেখাতুম। তোমার পিঠে পড়ত কোচোয়ানের চাবুক। আর সার্কাসে আমার নাচ দেখে তালি পড়ত শ-য়ে শ-য়ে মানুষের। হইহই করে আনন্দে চিৎকার করত তারা আর ডাক দিত, জিপসি জিপসি। সে কী আদরের ডাক। কিন্তু তারপর? বয়েস বাড়ল। বাতে ধরল। আমার নাচও গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমার কাজটাও খতম। আমার কথা বিশ্বাস না-করলে তোমাকে একটু-আধটু আমার সেই নাচ দেখাতেও পারি। কী বলো, দেখবে?’
‘তোর কষ্ট হবে না?’
‘না, আর কষ্ট হবে না। কেন-না, এতদিন ছিলুম একদম একা। আজ পেয়েছি তোমাকে। আমিও যেমন, তুমিও তেমন। দুজনায় পেয়েছি দুই সঙ্গীকে। কী খুশির খবর বলো।’
ঘোড়া বলল, ‘তবে তুই নাচ। আমি দেখি।’
কুকুর নাচ ধরল, বুড়ো বয়েসে সে কী খুশির নাচ। কুকুরের নাচ দেখে ঘোড়া মনে মনে ভাবল, কুকুরটা মন্দ নাচে না তো! এতদিন পরে একজন ভালোই সঙ্গী পাওয়া গেল। পেট না-ভরুক, মন তো ভরবে!ভ