বন-সবুজের আয়নায়
শৈলেন ঘোষ দ্বারাবন-সবুজের আয়নায়
একটা বাগান। বাগানটা যে খুব বড়ো তেমন না। আবার খুব যে ছোটো তা-ও নয়। সেই বাগান জুড়ে কত গাছ। ফুলগাছের তো ছড়াছড়ি। তার ওপর আছে একটা আমগাছ আর একটা কদমগাছ। দুটিতে খুব বন্ধুত্ব। তারা তো আর হাঁটাচলা করতে পারে না। কেমন করে করবে? তাদের পা থাকলে তবে তো! তাই তাদের খুব দুঃখ। দুনিয়াটা যে কেমনতর তার ছিটেফোঁটাও তারা জানে না। তাহলে আর কী করা, গল্প করা আর গান গাওয়া। আর দেখা, পাখি উড়ে আসছে। তাদের ডালে বসছে। বাসা বাঁধছে। বাসায় ডিম পাড়ছে। ডিম ফুটে ছানা জন্মাচ্ছে। বড়ো হচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে।
তো একদিন হয়েছে কী, দুটিতে গান গাইছিল। সে-গান শুনে হেসে মরি। কী ছিরি শোনো-না গানের :
আতাপাতা
শ্যালের মাথা,
ফুল ফুটেছে ডালে,
ওই দেখো না প্রজাপতি
নাচছে তালে তালে।
সেজোমামা,
ঘসছে ঝামা,
গাল পুড়েছে ঝালে—
উঃ বাবারে,
কী জ্বালা রে,
বাঘ পড়েছে পালে!
এমন সময় হল কী, কদমগাছটার নজর পড়ল একটা শুঁয়োপোকার দিকে। কী বিচ্ছিরি! কী বিচ্ছিরি! তাকে দেখে তখন কি আর গান গাইতে ইচ্ছে করে! আমগাছ দিল ধমক, ‘এই শুঁয়োপোকা, এখানে কী করছিস ঘুরঘুর করে?’
শুঁয়ো বললে, ‘আমার খিদে পেয়েছে। আমি কচিকচি ঘাস খাচ্ছি খুঁজে খুঁজে।’
কদমগাছ বলল, ‘খাচ্ছ খাও, কিন্তু কি শুনতে পাচ্ছ ব্যাং আসছে ঘ্যাঙর ঘ্যাং? মাথায় ছাতা?’
‘ব্যাং আসছে ঘ্যাঙর ঘ্যাং, তো আমার কী!’
আমগাছ বলল, ‘দেখতে পেলে চটকে দেবে! ঘাড়-মাথা সব মটকে দেবে!’
শুঁয়ো বলল, ‘অত আর না। দেখো না, ব্যাঙের ছাতা আমি কেমন করে হাতিয়ে নিই!’
শুঁয়োর কথা শুনে আমগাছ আর কদমগাছ মাথা ঝাড়া দিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতে-হাসতে আমগাছ কদমগাছকে বললে, ‘পুঁচকে শুঁয়ো কী বলে শুনছ! শুঁয়োর কী দাপট!’
ওদের কথা শেষ হতে-না-হতেই ব্যাং তো সেখানে হাজির। পড়বি তো পড় একেবারে শুঁয়োপোকাটার সামনে। খুব রক্ষে, আর একটু হলেই দিয়েছিল শুঁয়োপোকার ঘাড়ে পা! সামলে গিয়েও চিৎকার করে উঠল, ‘হেই দাদা গো, এইটা এ কে?’ শুঁয়ো দেখেই দিতে গেছে লাফ মেরে ছুট, ভয়ে-ময়ে। ব্যাঙের লাফ দেখেই তো শুঁয়োপোকা হেসে কুটোপাটি।
ব্যাং থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মনে মনে ভাবল, সত্যিই তো, কী লজ্জার কথা! সে একটা লিকলিকে, প্যাংলা শুঁয়োর ভয়ে পালাচ্ছে! তাই ব্যাং বুক ফুলিয়ে শুঁয়োকে ধমক দিল, ‘এই শুঁয়ো হাসছিস কেন রে?’
শুঁয়ো বলল, ‘কই, হাসিনি তো! তুমি একটা খুব সুন্দর ছাতা মাথায় দিয়ে লাফালাফি করছ দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগল। তাই আমি একটু ফিক করে হেসে ফেলেছি। একটা কথা বলব রাখবে?’
ব্যাং জিজ্ঞেস করল, ‘কী কথা? ব্যাঁকা কথা? না, সোজা কথা?’
‘ব্যাঁকা বলতে যাব কেন, সোজা কথাই বলব। বললে রাগ করবে না তো?’
‘কথাটাই শুনলুম না, আগেই রাগারাগির কথা তুলছিস কেন?’
শুঁয়ো একটু দোনোমনো করে বলল, ‘তোমার ছাতাটা আমায় প্রেজেন্ট করবে?’
ব্যাং তো শুঁয়োর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চটিতং! রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল,
ইস—
ইনতি-বিনতি কড়ার খুন্তি
কেরে আনার আবদারে,
ফের যদি চাস ছাতা আমার
চাপব তবে তোর ঘাড়ে।
এটা আমার বাবার বাবা
তার যে বাবার পিসে,
তাড়া খেয়ে তড়তড়িয়ে
জলেই গেল মিশে!
যাবার সময় দিয়ে গেল
একটা টাকা সিসে!
শুঁয়ো তো ব্যাঙের কথা শুনে হেসেই মরে। হাসতে হাসতে বলে, ‘তুমি তো আচ্ছা বোকা। চাইছি ছাতা, উলটে বলছ আলতু-ফালতু যা-তা।’
ব্যাং তো বিগড়েই ছিল। শুঁয়োর কথা শুনে আরও একটু রেগে বলল, ‘কান মলে দেব।’
‘কী দুঃখে?’
‘তুই আমায় বোকা বললি কেন?’
শুঁয়ো উত্তর দিল, ‘বোকাকে বোকা বলবে না তো কি ঢ্যাঁড়স বলবে?’
ব্যাস! শুঁয়ো যেই না ঢ্যাঁড়স বলেছে, ব্যাংবাবাজি রেগে আগুন হয়ে, ছাতাটা ফেলে লাফিয়ে পড়েছে শুঁয়োর গায়ে! আর যাবে কোথায়! শুঁয়োর গায়ের শোঁয়া ফুটে গেছে ব্যাঙের গায়ে। শোঁয়ার কুটকুটনির জ্বালায় ব্যাং মারল লাফ, মেরেই পগারপার! লাফাতে লাফাতে বলে গেল, ‘দাঁড়া, আমি আসছি। তোর পিন্ডি চটকাব!’
ঠিক সেই সময়ে বাগানে ঢুকল একটি ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে। তার হাতে ফুলের সাজি। সে ফুল তুলছে আর গান গাইছে। তার নাম টুসটুসি :
বড়ো পাতা ছোটো ফুল
মেজোদিদির বিয়ে
নাক খ্যাঁদা ট্যারা বর
আহা ছিরি কী এ!
গোঁফখানা ঝোলা ঝোলা
মাথাভরা টাক,
কান দুটো কুলো যেন
পেট ফোলা ঢাক!
গান গেয়ে, ফুল তুলতে-তুলতে টুসটুসি পড়বি তো পড় একেবারে শুঁয়োপোকাটার সামনে। টুসটুসি থমকে গেছে। টুসটুসির গান থমকে থেমে গেল। থামতেই শুঁয়োপোকাটা কেঁদে উঠেছে!
টুসটুসি তো শুঁয়োর কান্না শুনে থ! এ বাবা, শুঁয়োপোকাও কাঁদে! কাঁদে যখন, তখন কথাও বলতে পারে নিশ্চই। এই ভেবে টুসটুসি শুঁয়োকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই শুঁয়ো, কাঁদছিস কেন?’
শুঁয়ো সত্যিই কথা বলতে পারল। টুসটুসিকে বলল, ‘আমি কাঁদছি এই ছাতাটার ভয়ে!’
টুসটুসি তো অবাক, অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘ছাতা! কই ছাতা?’
শুঁয়ো ছাতাটা দেখিয়ে বলল, ‘ওই ছাতা।’
টুসটুসি ছাতাটা দেখে বলল, ‘এটা তো ব্যাঙের ছাতা!’
শুঁয়ো বলল, ‘দোষের মধ্যে কী, না আমি ব্যাঙের কাছে ছাতাটা চেয়েছি। তাতেই ব্যাং খাপ্পা। আমাকে মারতে এল। আমাকে মারতে গিয়ে তার গায়ে আমার শোঁয়া ফুটে গেল। শোঁয়ার জ্বালায় সে পালাল। পালাতে পালাতে বলে গেল, সে আমার পিন্ডি চটকাবে।’
টুসটুসি শুঁয়োর কথা শুনে হি-হি করে হেসে ফেলল।
শুঁয়ো বলল, ‘এ কী কথা! আমি কাঁদছি, আর তুমি হাসছ!’
টুসটুসি বলল, ‘তুই ভয়ে কাঁদছিস, আর আমি খুশিতে হাসছি।’
‘ব্যাংকে কেমন করে ঢ্ঢিB করতে হয়, আমার জানা আছে। এই দেখ না, এখন ছাতাটা নিয়ে আমি নাচব।’ বলে ছাতাটা হাতে নিয়ে গান গেয়ে নাচতে শুরু করল:
ঝুম ঝুম ছাতা নাচে,
গাছে গাছে পাতা নাচে,
ঝিকি মিকি আলো নাচে,
হাওয়ায় নাচে ফুল—
তাই না দেখে খুশির দোলায়
দুলছে কানের দুল।
ঝুরু ঝুরু হাওয়া নাচে
ফুলে ফুলে ভোমরা নাচে,
খুকুর চোখে স্বপ্ন নাচে,
মিষ্টি রঙিন ঘুম,
তাই তো নাচে পিউ-পাপিয়া
রুম ঝুম রুম ঝুম।
গান শেষ হতে-না-হতেই শোনা গেল একটা ঘড়ঘড়ানি শব্দ। টুসটুসি চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুঁয়োকে জিজ্ঞেস করল, ‘কীসের শব্দ শোনা যাচ্ছে রে?’
শুঁয়ো বলল, ‘ওই তো ব্যাং আসছে একটা বাক্স ঠেলতে ঠেলতে। এখন আমি কী করি?’
টুসটুসি বলল, ‘শুঁয়ো তুই পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়। আমি দেখতে পাচ্ছি তোর খোলস খুলে পড়ছে। তোর গায়ে রং ধরছে। একটু পরেই তোর রূপের বাহার ফুটে বেরোবে। ব্যাঙের ছাতাটা নিয়ে আমিও আড়ালে লুকিয়ে পড়ছি। দেখি, ব্যাং কী করে। বলে, টুসটুসিও লুকোল আর শুঁয়োপোকাও গাছের পাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে রইল।
চোখের পলকে ব্যাং তো হাজির। সে ঠেলে আনল একটা বাক্স। বাক্সটা এককোণে রেখে, খুঁজতে লাগল শুঁয়োপোকাটাকে, এধারে-ওধারে। শুঁয়োটাকে আর দেখতেই পেল না। ব্যাং তখন হতাশ হয়ে বাক্সটার কাছে গিয়ে মন্ত্র পড়ে চেঁচাল :
খাটা মাটা চিনি চাটা
চেটে চেটে ফুটি ফাটা
নাকে ফুটো কানে কাটা
ছু: ছু: ছু:।
তারপর বাক্সটার কাছে মুখ এনে চিৎকার করে উঠল, ‘দমদমবাবাজি-ই-ই-ই!’
বাক্সের ভেতর থেকে গলা শোনা গেল, ‘কি উ-উ-উ?’ বোঝা গেল, বাক্সের মধ্যে কেউ আছে।
ব্যাং জিজ্ঞেস করল, ‘ত্যাঁদড় শুঁয়োটা গেল কোথায়?’
ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘যাবে আর কোথায়, তোর চোখের সামনেই তো আছে!’
ব্যাং বলল, ‘চোখের সামনে ওটা তো একটা প্রজাপতি দেখছি দমদমবাবাজি।’
এতক্ষণ টুসটুসি যে কোথায় লুকিয়েছিল কে জানে। আচমকা ছুটে বেরিয়ে এসে সুর চড়িয়ে বলল,
বোকা বোকা বোকা
একটু আগে ওটাই ছিল
দেখতে শুঁয়োপোকা।
সাত-রঙা রোদ লাগল গায়ে,
ঘুম ঢুলঢুল আলো-ছায়ে,
তারপরেতেই হঠাৎ,
শুঁয়োর গায়ের খোলস ছিঁড়ে,
নি:শব্দে ধীরে ধীরে,
রং-ঝলমল বেরিয়ে এল,
প্রজাপতির খোকা।
ব্যাং তো একেবারে হাঁ! প্রজাপতির কাছে গিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রজাপতি, কথাটা কি সত্যি?’
প্রজাপতি উত্তর দিল, ‘যেমন সূর্য সত্যি, চাঁদ সত্যি, যেমন দিন সত্যি, রাত সত্যি, তেমনই সত্যি কথাটাও।’ তক্ষুনি টুসটুসি আনন্দে নাচতে শুরু করল। প্রজাপতিও উড়তে উড়তে রঙিন সুরে গেয়ে উঠল :
এসো এসো খেলবে এসো আমরা সবাই সাথি
সবাই মিলে সবুজ-বনে খুশির খেলায় মাতি।
বন-সবুজের আয়না
আর তো কিছুই চায় না।
তার আঙিনায় খেলবে সবাই
সবুজ রেখে তা-ই না?
এই সঙ্গে চুপি চুপি বলি, গান শুনে বাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছিল দমদমবাবাজিও। সে আর কেউ নয়, একটা জাদুকর-পুতুল। যেমন তার গোঁফ, তেমনই তার দাড়ি। ব্যাংটা তাকে টেনে এনেছিল টুসটুসির খেলাঘর থেকে! দমদমবাবাজি যখন গানের সঙ্গে নাচছিল, তখন তাকে দেখে, না হেসে কে থাকতে পারে! তখন যদি তাকে দেখতে, তার আর গোঁফের নাচ দেখে হেসে কুটোপাটি খেতে!