[চরিত্রলিপি: বাগডুম সিং, পুতুল-পরি, অন্যান্য পুতুল, ঘড়ি, রাজা-পুতুল, রাজা-পুতুলের সেপাই, প্যাঁচা, ছাগল, কাকতাড়ুয়ার দল, বুড়ি।]

    প্রথম দৃশ্য

    [পর্দা উঠলে দেখা যাবে একটি পুতুলের ঘর। অনেক পুতুল সাজানো ঘরের এপাশে ওপাশে। তারই মধ্যে দেখা যাবে, বাগডুম সিং নামে এক পল্টন-পুতুলকে, একটা পরি-পুতুল ও ঘড়ি-পুতুলকে। একটি মিষ্টি বাজনার সুর। ধীরে ধীরে পুতুলরা সেই বাজনার সুরে সুরে দুলে উঠছে। দেখা যাচ্ছে বাগডুম সিং রাগে ফুঁসছে। তাই দেখে হঠাৎ পরি-পুতুল হেসে উঠল।]

    [পরি-পুতুলের হাসি]

    বাগডুম সিং : কে রে মেয়েটা!

    পরি : (হাসতে হাসতে) দেখতে পাচ্ছেন না, আমি পুতুল-পরি।

    বাগডুম : অমন খিল খিল করে হাসছ কেন?

    পরি : আপনাকে দেখে হাসি পাচ্ছে। আপনি বুঝি পুতুলঘরে নতুন এলেন!

    বাগডুম : (গম্ভীরভাবে) হ্যাঁ। আমি বাগডুম সিং। আমি একজন ফৌজি পল্টন। আমাকে দেখে হাসি পাচ্ছে মানে, আমাকে অপমান করা হচ্ছে!

    পরি : বা:, আপনার নামটা তো বেশ, বাগডুম সিং! কী পেল্লাই গোঁফ আপনার! (জোরে হাসতে থাকে) আপনি কথা বলছেন আর আপনার গোঁফটা কেমন নাচছে বাগডুম সিং।

    বাগডুম : (রেগে) আমার গোঁফ নাচবে, এক-শোবার নাচবে। তাতে তুমি হাসবে কেন? নিয়ম করে হাসতে পারো না?

    পরি : বা-রে, নিয়ম করে কেউ হাসে নাকি!

    বাগডুম : আলবাত! আমি হাসি। আমার খুব হাসি পেলে আমি ফিক করে একবার হাসি। আমার খুব খুব হাসি পেলে আমি ফিক ফিক করে দু-বার হাসি। আমার খুব খুব খুব হাসি পেলে আমি ফিক ফিক ফিক করে—

    [হঠাৎ ঘড়ির ঘণ্টা বেজে উঠল]

    বাগডুম : বাজলটা কী?

    পরি : ঘড়িদাদুর ঘণ্টা বাজল।

    বাগডুম : আচ্ছা অসভ্য তো। কথার মাঝখানে ঢং করে একটা ঘণ্টা মেরে বসল।

    ঘড়ি : টেপে যা, টেপে যা, টক টক, বুড্ডির ঢেঁকিটা কোত্থেকে এল রে, টক টক, টক টক।

    বাগডুম : (গম্ভীরভাবে) এই ঘড়ি, আমায় বুদ্ধির ঢেঁকি বললি কেন, এ্যাঁ!

    ঘড়ি : টোর ঘটে যডি না বুড্ডি ঠাকে টবে কি টোকে বুড্ডিমান বলব—টক টক, টক টক!

    বাগডুম : (রেগে) আমার যথেষ্ট বুড্ডি আছে, জানিস আমি রসগ্লোলা খেতে পারি! আমার হাতে রস লাগে না।

    ঘড়ি : কে ডিচ্ছে ডে খাবি! টক টক! (ভেংচি কেটে)

    বাগডুম : তবে রে, আমায় ভেংচি কাটা, তোকে আজ মেরেই ফেলব।

    [তেড়ে এসে মারবে। ঘড়ি ঘুরে ঘুরে ছুটবে]

    ঘড়ি : টক টক টক টক আমায় মারটে, আমায় মারটে।

    [ঘড়ি ও বাগডুম সিং-এর মারামারি]

    পরি : (চেঁচিয়ে) মারামারি করবেন না, থামুন! থামুন! এক্ষুনি রাজামশাই এসে পড়বেন, থামুন!

    [সঙ্গে সঙ্গে রাজা পুতুলের ভেঁপু বেজে উঠবে। ভেঁপুর শব্দ শুনে একটু থেমেই ঘড়ি আর বাগডুম সিং আবার মারামারি শুরু করবে।]

    [রাজা-পুতুল আগে ও পেছনে ক-জন সিপাই-পুতুলকে নিয়ে ঢুকবে। বাগডুম ও ঘড়ির লড়াই দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ধমক দিল।]

    রাজা : এই, কী হচ্ছে কী? এই দেখো দেখো পড়ে যাবে, পড়ে যাবে।

    [মারামারি করতে করতে বাগডুম সিং পড়ে গেল]

    রাজা : (মজা করে) এই যা:! পড়ে গেল!

    পরি : (এগিয়ে গিয়ে বাগডুমকে উঠতে সাহায্য করতে করতে) পড়ে গেলেন তো, লেগেছে?

    ঘড়ি : (মজা করে) লেগেটে, লেগেটে। টক টক টক টক। পল্টনটাই পা পিটলে আলুর ডম।

    [বাগডুম উঠে দাঁড়াল। রাগে ফুঁসছে।]

    রাজা : হ্যাঁরে, এই খোকাটি বুঝি নতুন এসেছে?

    পরি : হ্যাঁ রাজামশাই। ওর নাম বাগডুম সিং।

    রাজা : বাগডুম সিং! বাব্বা! জব্বর নামটি তো!

    বাগডুম : আপনি আমায় খোকা বললেন কেন? জানেন আমি যুদ্ধ করি।

    ঘড়ি : ডুড্ড করি, গুঁপোটা আমার টঙ্গেই পারে না আবার ডুড্ড করবে।

    রাজা : বাব্বা:! কত বড়ো গোঁফ রেখেছিস রে!

    ঘড়ি : অত বড়ো গোঁফ রেখেছিস, কত টাকা ট্যাকসো ডেছিস?

    বাগডুম : বা: বা:—গোঁফ রাখলুম আমি আর ট্যাকসো তুলবে তোমরা? বা: বা:—ট্যাকসো দেব না।

    রাজা : (রেগে) কী বললি! ট্যাকসো দিবি না! (সেপাইদের আদেশ করে) এই সেপাই ওকে আমার কাছে ধরে আনতো।

    [সেপাইরা বাগডুমকে ধরে টানতে টানতে রাজার কাছে নিয়ে এল]

    রাজা : (বাগডুমকে) পকেটে কী আছে?

    বাগডুম : (রেগে) পকেট নেই।

    রাজা : ট্যাঁকে কী আছে?

    বাগডুম : ট্যাঁক নেই।

    রাজা : তবে দে, মাথার পাগড়িটা দে।

    বাগডুম : না দেব না! রাজার কী ছিরি! রাজা না কড়াইভাজা!

    রাজা : (রেগে) কী আমায় কড়াইভাজা বলা! (সেপাইদের আদেশ করে) এই ওর মাথার পাগড়িটা কেড়ে নে!

    [মাথার পাগড়ি কাড়াকাড়ি]

    বাগডুম : এই, ভালো হবে না বলছি! আমার মাথায় হাত দিবি না, ভালো হবে না!

    ঘড়ি : (পাগড়ি খুলে নিয়ে) রাজামটাই, এই যে পাগড়ি!

    রাজা : দে আমায়!

    বাগডুম : আমার পাগড়ি খুলে নিল। এত বড়ো আস্পর্ধা!

    ঘড়ি : রাজামটাই, রাজামটাই! লোকটার মাটায় কট বড়ো টাক ডেকেছেন, যেন ফুটবল খেলার মাঠ!

    বাগডুম : (আরও রেগে ঘড়িকে তেড়ে গিয়ে) তোকে আজ মেরেই ফেলব। আজ তোর পিন্ডি চটকাব।

    ঘড়ি : টক টক—আমায় মারটে—রাজামটাই! আমায় মারটে, আমায় মারটে।

    রাজা : (ধমক দিয়ে) এই, কী হচ্ছে কী! খবরদার বলছি, মারবি না। এই—

    বাগডুম : (এবার রাজাকে তেড়ে গিয়ে) তবে রে, রাজার নিকুচি করেছে! মুকুট পরে রাজাগিরি ফলানো!

    পরি : বাগডুম সিং, রাজামশায়ের মাথায় হাত দেবেন না, হাত দেবেন না!

    [রাজা ও বাগডুম সিং-এর মধ্যে ধস্তাধস্তি হতে থাকে।]

    বাগডুম : (মুকুট খুলে নিয়ে) এবার! অভদ্র রাজা কোথাকার! এ মুকুট আমার!

    রাজা : (কাঁদো-কাঁদো) এই—আমার মুকুট খুলে নিল।

    [বাগডুম সিং মুকুট নিয়ে ছুটে পালাল]

    ঘড়ি : রাজামটাই-এর মুকুট টুরি করে পালাট্টে, পালাট্টে! ধর ধর ধর—

    পরি : বাগডুম সিং দাঁড়ান! বাইরে যাবেন না! দাঁড়ান। বাইরে বিপদ! বাগডুম সিং!

    [বাগডুম সিং-এর পেছনে ছুটতে ছুটতে পরিও চলে গেল]

    রাজা : এই যা:। আমার মাথার মুকুট গেল, পরিটাও চলে গেল! (কান্না) এঁ!! এঁ!

    দ্বিতীয় দৃশ্য

    [গভীর জঙ্গল। রাত। ঝিঁঝিঁর ডাক। শেয়ালের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একটা প্যাঁচা খাবার খুঁজছে।]

    প্যাঁচা : হল কী মশাই, হল কী! কখন থেকে খিদের চোটে একটা ইঁদুর খুঁজে বেড়াচ্ছি। তা মশাই, ইঁদুর কোন ছার, একটা ফড়িং-এর ঠ্যাং পর্যন্ত নজরে পড়ছে না। ছ্যা:! ছ্যা:! ছ্যা:!

    [এমন সময় বাগডুম সিং সেই জঙ্গলে ছুটতে ছুটতে ঢুকল। তার মাথায় রাজার মুকুট। প্যাঁচা তাকে দেখেই, ঝট করে আড়ালে চলে গেল। বাগডুম একবার এদিক আর একবার ওদিক দেখে আবার ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল।]

    প্যাঁচা : (অবাক হয়ে) কে রে বাবা! রাতদুপুরে বনের মধ্যে ছোটাছুটি করছে! চোর বটে নাকি!

    [ঠিক সেই সময়েই পরি-পুতুল বাগডুম সিংকে ছুটে ডাকতে ডাকতে সেখানে এল। খুঁজতে লাগল।]

    পরি : (ডাক) বাগডুম সিং, বাগডুম সিং!

    প্যাঁচা : খুকিটি কে বটে!

    [পরি প্যাঁচাকে দেখে ভয় পেল।]

    প্যাঁচা : না, না, ভয় পাবার কিছু নাই। বলে ফেলো!

    পরি : (আমতা-আমতা করে) আমি—

    প্যাঁচা : আমি বললে, আমি আমিকে চিনব কেমন করে?

    পরি : আমি, মানে পুতুল।

    প্যাঁচা : হচ্ছেটা কী, অ্যাঁ? বে-পাড়ার লোক এ-পাড়ায় এসে ঝামেলা পাকাচ্ছ!

    পরি : আজ্ঞে বাগডুম সিংকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়েছি।

    প্যাঁচা : কী সিং?

    পরি : বাগডুম সিং। আপনি তাকে দেখেছেন কি?

    প্যাঁচা : না বাপু, কোনো সিং-ফিংকে দেখিনি। একাট মস্ত গোঁফওলা বাচ্চা, এইমাত্তর ইদিক দিয়ে ছুটে গেল।

    পরি : গোঁফ দেখেছেন? ঠিক হয়েছে। তিনিই বাগডুম সিং। তিনি বাচ্চা নন, গ্যাঁড়া।

    প্যাঁচা : (হেসে) গ্যাঁড়া! কিছু গেঁড়িয়ে পালাচ্ছে বুঝি?

    পরি : কোনদিকে গেলেন তিনি?

    প্যাঁচা : এইদিকে। তুই বরঞ্চ এক কাজ কর, এখান থেকে সামনে চলে যা। নাক বরাবর সামনে গিয়ে, সামনে দাঁড়ালেই দেখতে পাবি, তোর সামনে বাগডুম সিং!

    পরি : এই সামনে ছুটব?

    প্যাঁচা : এক্ষুনি ছোট! নইলে আর দেখতে পাবিনি! ছোট!

    পরি : (ডেকে উঠল) বাগডুম সিং, বাগডুম সিং—

    [ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল। প্যাঁচা হেসে উঠল। হঠাৎ একটা ছাগল ডাকতে ডাকতে ঢুকল]

    ছাগল : (ছড়া)

    ব্যাব্যারে, ব্যাব্যারে ব্যাব্যা

    ভারি গন্ডগোল নেগেছে

    একটা পরি উড়ি উড়ি

    ইদিক দিয়ে ভেগেছে!

    প্যাঁচা : মিয়াসাহেবের অত ফুর্তি কেন? চাঁদ দেখে মনে গান জেগেছে বুঝি?

    ছাগল : তা লয় গো পাঁচুকাকা, তুমি দ্যাখলে না, একটা পরি ইদিক দিয়ে উড়ে গেল?

    প্যাঁচা : তোমার মুন্ডু উড়ে গেল!

    ছাগল : (চট করে নিজের মুন্ডুতে হাত দিয়ে) কই গো পাঁচুকাকা, আমার মুন্ডু তো আমার মুন্ডুতেই আছে। উড়ে তো যায়নি। উড়ে তো গেল একটা পরি। (খুশি) আমি সেটারে ধরতে যাচ্ছি। ব্যাব্যারে, ব্যাব্যারে ব্যাব্যা!

    প্যাঁচা : (বিরক্ত হয়ে) বাবারে, বাবারে, বাবা! রাতদুপুরে কী চেঁচাচ্ছে দেখো!

    [ঠিক এই সময় বাগডুম সিং ঢুকবে। তাকে দেখে ছাগল, প্যাঁচা চুপ করে থমকে দাঁড়িয়ে থাকবে। বাগডুম সিং এদিক-ওদিক দেখে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তক্ষুনি ছাগল ডাক দিল। ]

    ছাগল : গোঁফওলা বাবুটি কে বটে?

    বাগডুম : (চমকে দেখে, রেগে) ইস্টুপিট!

    ছাগল : (থতোমতো খেয়ে) অ্যাঁ!

    বাগডুম : ইস্টুপিড! তুই আমাকে গোঁফওলা বলছিস কেন?

    ছাগল : তা আপনার যখন গোঁফ—

    বাগডুম : পাঁঠা!

    প্যাঁচা : বলি ওহে ছোকরা, অকথা, কুকথা কইছ কেন?

    ছাগল : ত্যাঁদড়া!

    প্যাঁচা : বাঁদরা!

    বাগডুম : তবে রে, আমায় বাঁদর বলছিস—

    [বাগডুম ছাগল আর প্যাঁচার সঙ্গে মারামারি লাগিয়ে দিলে। চেঁচামেচি। ছাগল আর প্যাঁচা হেরে পালাল]

    বাগডুম : আরে ব্যাটারা আমায় চিনিস না? আমার সঙ্গে লড়াই করতে আসিস! আমি রাজাকে ঘায়েল করে মাথার মুকুট কেড়ে নিয়ে এসেছি, দেখতে পাচ্ছিস না! তোরা তো ছাগল-প্যাঁচা, ফু:! আমার সঙ্গে লড়তে আসিস!

    [হঠাৎ শোনা গেল একদল কাকতাড়ুয়ার গলার স্বর। দেখা গেল একজন কাকতাড়ুয়া একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসছে! তার গলার শব্দ একটা অদ্ভুত ধরনের টানা সুরে বেজে উঠছে, বা-আ-আ! বা-আ-আ!]

    কাকতাড়ুয়া : (ঢুকতে ঢুকতে) বা-বা-আ!

    বাগডুম : (চমকে) কে! কীসের শব্দ!

    কাকতাড়ুয়া : বা-আ-আ—(কাকতাড়ুয়া এগিয়ে এল)

    বাগডুম : (ভয়ে) কে? কে আপনি?

    কাকতাড়ুয়া : আমি, আমি একজন অত্যন্ত পরিচিত ব্যাক্তি। কাকতাড়ুয়া। আপনি?

    বাগডুম : আমি রাজা বাগডুম সিং।

    কাকতাড়ুয়া : আপনি এ কেমন রাজা! একা একা বনে-জঙ্গলে ঘুরঘুর করছেন? মশাই-এর রাজত্বটা কোথায়?

    বাগডুম : কেন, এটাই আমার রাজত্ব।

    কাকতাড়ুয়া : ও, এটাই আপনার রাজত্ব! তা কাছে-পিঠে রাজপ্রাসাদ তো নজরে পড়ছে না!

    বাগডুম : রাজপ্রাসাদ কী হবে? রাজপ্রাসাদ আমার নেই।

    কাকতাড়ুয়া : সেকী মশাই! রাজা হয়েছেন রাজপ্রাসাদ নেই? রাজসিংহাসন?

    বাগডুম : তাও নেই।

    কাকতাড়ুয়া : ও, হ্যাঁ হ্যাঁ—কেমন করে থাকবে! এতক্ষণ আপনাকে তো ভালো করে দেখিনি। আপনি তো পুতুল-রাজা।

    বাগডুম : মুখ সামলে কথা বলবে! দেখতে পাচ্ছ না, আমার মাথায় রাজার মুকুট!

    কাকতাড়ুয়া : (হাসি) ও আমি জানি, ওটা তো পুতুল-রাজার মুকুট। আপনি তো মশাই পুতুল হয়েও দেখছি ভীষণ ধড়িবাজ। মুকুটটা চুরি করে ভাগছেন, আর মনে করছেন আমি কিচ্ছু জানি না, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার সব কথা শুনে ফেলেছি।

    বাগডুম : কী? কী বললি?

    কাকতাড়ুয়া : হ্যাঁ মশাই, আমি ঠিকই বলেছি, আপনি রাজা নন, আপনি তো মশাই চোর!

    বাগডুম : (তেড়ে এগিয়ে যায়) তবে রে, আমায় চোর বলছিস! তোকে আজ মেরেই ফেলব।

    [মারবার জন্যে তেড়ে গেল]

    কাকতাড়ুয়া : (চিৎকার করে) খবরদার, আমায় মারবেন না বলছি। আপনার এত গা-জোয়ারি ভালো নয়। আমি একজন কাকতাড়ুয়া। আমার দেহ খড়কুটো দিয়ে তৈরি। আমায় মারবেন না!

    [চিৎকার, চেঁচামেচি, মারামারি। বাগডুম সিং-এর তরোয়ালের ঘায়ে কাকতাড়ুয়া চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল।]

    বাগডুম : (হাসতে হাসতে) বা:! একঘায়েই খড়ের ভুঁড়ি ফেঁসে গেল!

    [হঠাৎ দেখা গেল একদল কাকতাড়ুয়া বিকট চিৎকার করতে করতে বাগডুম সিংকে মারতে আসছে]

    কাকতাড়ুয়ারা : বা-আ আ! ধর-ধর-ধর!

    বাগডুম : (ভয়ে চিৎকার করে) কে, একী! এত কাকতাড়ুয়া কোথায় ছিল!

    কাকতাড়ুয়ারা : তোর পিন্ডি চটকাব।

    বাগডুম : কেন?

    কাকতাড়ুয়ারা : আমাদের বন্ধুকে তুই কেন মারলি? বল, কেন মারলি? এই, ওর তরোয়ালটা কেড়ে নে!

    [সবাই দল বেঁধে তরোয়াল কাড়তে যাবে]

    বাগডুম : না-না। আমার তরোয়ালে হাত দেবে না বলছি! খবরদার!

    [কাকতাড়ুয়ার দল চিৎকার করে বাগডুমের দিকে এগোবে, তারপর ধস্তাধস্তি করে

    তরোয়াল কেড়ে নেবে। কেড়ে নিয়ে হেসে উঠবে।]

    কাকতাড়ুয়ারা : এবার ওর মুকুটটা কেড়ে নে!

    বাগডুম : না আমি মুকুট দেব না!

    [কাকতাড়ুয়ার দল চিৎকার করে বাগডুমের মুকুট কেড়ে নেবে, তারপর হেসে উঠবে।]

    কাকতাড়ুয়ারা : এবার তোকে নখ দিয়ে খামচে খামচে মারব!

    [কাকতাড়ুয়ার দল বাগডুমের দিকে এগিয়ে যাবে, ঘিরে ধরে নখ দিয়ে খামচাবে। বাগডুম চিৎকার করতে করতে যন্ত্রণায় কাতরাবে।]

    বাগডুম : (পড়ে গিয়ে কাতরাতে কাতরাতে) আমায় বাঁচাও! আমায় বাঁচাও!

    কাকতাড়ুয়ারা : থাক। এখানে পড়ে পড়ে মরুক। চ, আমরা পালাই।

    [কাকতাড়ুয়ারা চিৎকার করে পালিয়ে যাবে। বাগডুম যন্ত্রণায় পড়ে পড়ে কাতরাবে।]

    তৃতীয় দৃশ্য

    [গভীর বন, ওই রাত। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। প্যাঁচার ও অন্যান্য জন্তুর ডাক শোনা যাবে। তার ফাঁকে বাগডুম সিং-এর আর্তনাদ]

    বাগডুম : আঃ আঃ, আমায় বাঁচাও, কে আছ আমায় বাঁচাও।

    [এমন সময়ে একটি বুড়ির কাশি শোনা যায়, সে ছদ্মবেশী ডাইনি, বাগডুমকে দেখে কাছে এল]

    বুড়ি : (কাশতে কাশতে) তুমি কে গো বাছা? এই বন-বাদাড়ে পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছ?

    বাগডুম : বুড়িমা, আমায় একটু ধরো না!

    বুড়ি : কী হয়েছে গো তোমার?

    বাগডুম : বুড়িমা, দেখো না, ওই কাকতাড়ুয়াগুলো আমায় মারল।

    বুড়ি : মারল! কেন গো বাছা, কী করেছ তুমি?

    বাগডুম : আমি কিছু করিনি, আমাকে ওরা শুধুমুধু মারল।

    বুড়ি : ওঠো, ওঠো! এই নাও, আমার হাতটা ধরো।

    [বুড়ির হাত ধরে বাগডুম কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায়]

    বুড়ি : কোথায় লেগেছে তোমার?

    বাগডুম : আমার সারাগায়ে ওরা খিমচে দিল। এই দেখো!

    বুড়ি : আহা, সব কালশিটে পড়ে গেছে গো! তা বাছা তুমি থাকো কোথায়?

    বাগডুম : আমি কোথাও থাকি না। আজকের রাতটা তোমার বাড়িতে আমাকে একটু থাকতে দেবে বুড়িমা?

    বুড়ি : আমার যা ঘর, তুমি কি থাকতে পারবে বাবা?

    বাগডুম : হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা রাত আমি খুব থাকতে পারব।

    বুড়ি : তবে আমার কোনো আপত্তি নেই।

    বাগডুম : তাহলে আমায় নিয়ে চলো।

    বুড়ি : এসো আমার সঙ্গে।

    [চলে যায়]

    [হঠাৎ পরি-পুতুল দূর থেকে ডাকতে ডাকতে ঢুকবে]

    পরি : বাগডুম সিং, আপনি কোথায়? আমি পুতুল-পরি। আমি আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি আপনার বন্ধু। বাগডুম সিং!

    [কাকতাড়ুয়ার দল চিৎকার করে উঠবে]

    কাকতাড়ুয়া : সে নেই নেই। আমাদের বন্ধুকে সে মেরেছে। ডাইনি বুড়িটা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

    পরি : কোথায়?

    কাকতাড়ুয়া : ডাইনি বুড়ির ঘরে। এবার সে ডাইনির হাতে মরবে।

    পরি : কোনদিকে গেছে?

    কাকতাড়ুয়া : এই পথ দিয়ে সে গেছে।

    পরি : বাগডুম সিং— (ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে গেল)

    কাকতাড়ুয়া : (চিৎকার করে) যেয়ো না, যেয়ো না, যেয়ো না!

    পরি : বাগডুম সিং—

    কাকতাড়ুয়া : বা:! চলে গেল, বা-আ-আ!

    চতুর্থ দৃশ্য

    [ডাইনি বুড়ির ঘর। বাগডুমকে নিয়ে বুড়ি ঢোকে]

    বুড়ি : ও বাছা, এসো এসো। এটাই আমার ঘর। দেখো বাছা, দোরে যেন হোঁচট খেয়ো না।

    বাগডুম : বুড়িমা, তুমি এখানে থাকো? তোমার আর কে আছে?

    বুড়ি : হায় কপাল, আর কে থাকবে গো! তিনকুলে আমার কেউ নেই।

    বাগডুম : (চুপিচুপি নিজের মনে) তাহলে তো ভালোই হল, এখানে লুকিয়ে থাকলে কেউ আমায় দেখতে পাবে না।

    বুড়ি : অ্যাঁ কিছু বলছিলে বাবা?

    বাগডুম : (থতোমতো খেয়ে) অ্যাঁ! হ্যাঁ মানে—বলছিলুম কী—বুড়িমা তোমার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ওই বন্দুকটা কার গো?

    বুড়ি : ওটা আমারই বন্দুক। ওই নাতি-নাতনিদের ছিল। এখন পড়ে পড়ে মরচে ধরছে। তা, তুমি ওটা নেবে?

    বাগডুম : হ্যাঁ, তুমি যদি দাও তো নিতে পারি।

    বুড়ি : তবে দাঁড়াও, আমি পেড়ে আনি। (বন্দুক পাড়ার পর) এই নাও।

    বাগডুম : বুড়িমা, তুমি কী ভালো!

    বুড়ি : (হাসি) হি:, হি:, হি:, তুমিও খুব সুন্দর। তা বাছা, তোমার মাথায় অত বড়ো একটা টাক কেন?

    বাগডুম : আর বোলো না, টাক আমার ছিল না, আমার মাথায় একটি সোনার মুকুট ছিল।

    বুড়ি : তা বাছা, মুকুট গেল কোথায়?

    বাগডুম : ওই যে হিংসুটে কাকতাড়ুয়াগুলো আমাকে মেরে মুকুট কেড়ে নিয়ে পালাল।

    বুড়ি : ইস, তোমার এত সুন্দর মুখখানি এত বড়ো একটি টাকের জন্য কী কুচ্ছিত দেখাচ্ছে।

    বাগডুম : খুব কুচ্ছিত দেখাচ্ছে? কী করবে হবে বলো তো বুড়িমা? তুমি আমার টাকটা ঢেকে দিতে পারো না?

    বুড়ি : টাক ঢেকে দেব? (একটু ভেবে) আচ্ছা, রোসো, রোসো। আমি তোমাকে একটি সোনার মুকুট এনে দিচ্ছি। আমি লুকিয়ে রেখেছি। তুমি দাঁড়াও আমি এক্ষুনি আনছি।

    [বুড়ি বাইরে চলে গেলে বাগডুম সিং নিজের মনেই বকতে লাগল]

    বাগডুম : বুড়িটা মুকুট আনতে গেল, ভালোই হল। এবার দেখা যাক বুড়ির ঘরে কিছু ধনরত্ন লুকোনো আছে কি না। সত্যিই তো, আমার একটা মস্ত বড়ো রাজপ্রাসাদ না থাকলে, লোকে রাজা বলে মানবে কেন? দেখি তো, ঘরে আর কিছু আছে কি না! (ঘরের এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল) আরে ব্বাস, দুটো পেল্লাই-পেল্লাই ঘড়া দেখছি! দেখি, দেখি! ওরে বাবা, যার ভেতরে এত সোনা, মুক্তো, হিরে, জহরত, এগুলো সব আমি নেব। সব! (আনন্দ) এই তো আমার হাতে বন্দুক! এবার বুড়িকে মারব ব্যাস, তারপর এসব কিছু আমার হয়ে যাবে।

    [হঠাৎ বুড়ির ডাক শোনা যাবে]

    বুড়ি : এই যে গো বাবা, মুকুট।

    বাগডুম : ও বুড়িমা, তুমি সত্যিই মুকুট এনেছ?

    বুড়ি : হ্যাঁ গো বাছা, এই নাও, এসো, আমি তোমার মাথায় পরিয়ে দিই। (মুকুট পরিয়ে দিয়ে) বা:! টাক ঢেকে তোমার মুখখানা কী সুন্দর লাগছে গো!

    বাগডুম : খুব সুন্দর লাগছে? এবারে রাজার মতো লাগছে, তাই না বুড়িমা?

    বুড়ি : হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব সুন্দর। একটি চমৎকার পুতুল-রাজা।

    বাগডুম : (রেগে) কে বলেছে আমি পুতুল-রাজা, দেখতে পাচ্ছ না, আমি মানুষ!

    বুড়ি : (হাসি) তুমি কী বোকা গো বাবা! তুমি মানুষ কোনখানটায়? তোমার শরীরটাতো কাপড় দিয়ে মোড়া। পেটের মধ্যে সব কাঠের গুঁড়ো পোরা। তুমি তো বাবা পুতুল-রাজা।

    বাগডুম : বুড়ি, সাবধান! আমায় পুতুল বোলো না। আমি রাজা, মানুষ রাজা। তুমি আমার দাসী।

    বুড়ি : মানুষ বললে কি আর মানুষ হওয়া যায় গো বাছা! ছি:! ছি:! ছি:! তুমি জঙ্গলে পড়ে ছিলে, তোমায় আমি বাড়িতে নিয়ে এলুম, সোনার মুকুট পরিয়ে দিলুম, হাতে বন্দুক দিলুম, আর এখন তুমি বলছ, আমি তোমার দাসী। ছি:! ছি:! ছি:!

    বাগডুম : হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি আমার দাসী। এ ঘর এখন আমার। আমি দেখেছি, ওই ঘড়া দুটোর মধ্যে সোনা, জহরত সব লুকোনো আছে। ওগুলো সব আমার।

    বুড়ি : (হাসি) না, না তুমি ভুল করছ বাবা, ও ঘড়া দুটো আমার।

    বাগডুম : না, তুমি ঘড়ার সামনে থেকে সরে যাও।

    বুড়ি : (হাসি) না, আমি সরব না, তুই কী করবি র‌্যা?

    বাগডুম : দেখছ, আমার হাতে বন্দুক।

    বুড়ি : হ্যাঁ, আমি দিয়েছি।

    বাগডুম : বুড়ি, তোমায় শেষবারের মতো বলছি ঘড়ার সামনে থেকে সরে দাঁড়াও।

    বুড়ি : তা না হলে ওই বন্দুক দিয়ে মারবি? মার মার, যত খুশি মার আমি সরছি না!

    বাগডুম : বুড়ি—(বুড়ির হাসি) বুড়ি—(আবার হাসি) বুড়ি—

    [বুড়ির হাসি, বন্দুকের আওয়াজ, বুড়ি ডাইনির রূপ নেবে]

    বুড়ি : হি:! হি:! হি:! এবার কী হবে? ওই বন্দুকে গুলি নেই, আমি কেমন বোকা বানালুম। আমি ডাইনি। তোর লোভ আমি শেষ করব, শেষ করব! তোকে এবার গলা টিপে মারব।

    [বাগডুম আর বুড়ির মধ্যে মারামারি, বুড়ি বাগডুমকে কাবু করে ফেলবে বাগডুম আর্তনাদ করে পড়ে যায়।]

    বাগডুম : আঃ—আঃ—আঃ!

    বুড়ি : থাক তুই এখানে পড়ে! হতচ্ছাড়া! আমি ওই কাকতাড়ুয়াগুলোকে ডেকে আনি। তারপর তোর ছেরাদ্দ করব।

    [বুড়ি হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়]

    পঞ্চম দৃশ্য

    [সেই ডাইনির ঘর। পরি ঢুকল, ক্লান্ত]

    পরি : বাগডুম সিং, আপনি কোথায়? আমি আপনাকে খুঁজতে খুঁজেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর পারছি না। (হঠাৎ ডাইনির ঘর নজরে পড়তে) একী! জঙ্গলের মধ্যে এই ঘরটা কার? দেখি তো, ঘরে কে আছে!

    [বাগডুমের আর্তনাদ জোর হবে]

    পরি : একী! বাগডুম সিং!

    বাগডুম : কে?

    পরি : আমি পুতুল-পরি, কী হয়েছে আপনার? আপনি এখানে এলেন কী করে?

    বাগডুম : ওই ডাইনি বুড়িটা আমায় এখানে ধরে এনেছে।

    পরি : চলুন, তাড়াতাড়ি চলুন, আমরা ঘরে ফিরে যাই। নইলে ডাইনিটা আবার এসে পড়বে।

    বাগডুম : কোথায় ফিরে যাব আমি?

    পরি : আমাদের সেই ছোট্ট পুতুল-ঘরে।

    বাগডুম : কেমন করে ফিরে যাব? ফিরে যাবার মুখ তো আমার নেই। ডাইনিটা আমায় মারল। ডাইনির হাতের কালি আমার মুখময় লেগে গেল।

    পরি : ওই কালি মুছিয়ে দিয়ে, আবার আপনাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেব, বাগডুম সিং।

    বাগডুম : কী বলছ তুমি পুতুল-পরি!

    পরি : আমি ঠিকই বলছি বন্ধু। আমরা পুতুল। আমাদের লোভ করতে নেই। আমরা সবাইকে আনন্দ দিই। আমাদের সবাই ভালোবাসে, আদর করে। চলুন, আমরা ফিরে যাই।

    বাগডুম : হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ পুতুল-পরি। আর আমি কোনোদিন লোভ করব না। আমি খেলাঘরে পুতুল হয়েই থাকব।

    টীকা