প্রথম দৃশ্য

    [গ্রামের রাস্তা। অনেক মানুষের জটলা। সম্ভবমতো মানুষের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। তাদের সংলাপের সংখ্যাগুলিই নীচে দেওয়া হল। মুখে বসিয়ে নিতে হবে।]

    ১ : ক-দিন ধরে একনাগাড়ে ঝড়বৃষ্টি চলছে। এখন একটু থেমেছে এই যা।

    ২ : (আকাশের দিকে তাকিয়ে) তবে, এখনও আকাশের মুখ ভার।

    ৩ : আবার নামলে আশ্চর্যের কিছু নেই।

    ৪ : একে এই দুর্যোগ, তার ওপর একটা উটকো ছেলেকে নিয়ে আমাদের দুর্ভোগ। সে যে কোত্থেকে এল আমাদের গ্রামে কে জানে!

    ৫ : ভয়টা কোথায় জানো, সবাই বলছে ছেলেটা ডাকাত দলের গুপ্তচর!

    ৬ : তাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না।

    ৭ : ধরা দূরে থাক, তাকে তো দেখাই যাচ্ছে না।

    ৮ : অবশ্য ছেলেটার নাম আমরা জানতে পেরেছি—কুয়াশা।

    ৯ : তাকে ধরতেই হবে। নইলে কার বাড়িতে কখন ডাকাত পড়বে কেউ জানি না।

    ১০ : শোনা যাচ্ছে, সে গভীর রাতে ঘুরঘুর করে।

    ১১ : তবে তো ভালো কথাই। একটা রাত জেগে আমরাও তো লুকিয়ে ছাপিয়ে তার সন্ধান করতে পারি।

    ১২ : ঠিক কথা, দেখতে পেলেই খপাৎ! (হাতের মুঠোয় খপাৎ করে ধরার ভঙ্গি)

    [সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। আবার আলো জ্বললে দেখা যাবে একই দৃশ্য। মেঘের গর্জন। বিদ্যুতের চমক। রাতের রহস্য। সেই রহস্যময় অন্ধকারে রাতের মেয়েরা গান গায়। সম্ভব হলে নাচে।]

    [রাতের মেয়েদের গান]

    ঘুটঘুটে রাতে হাওয়া হুসহাস
    আমরা রাতের মেয়ে,
    চুপচাপ শোন নিশ্বাস শ্বাস
    কোথা থেকে আসে ধেয়ে!
    হাঁসফাঁস বুক ভীতু তোরা ধুস
    শুনশান চারদিক,
    উঁকিঝুঁকি দেয় কার দুটো চোখ
    ড্যাবড্যাবে যেন ঠিক!
    হাড় জিরেজিরে ভূত ওটা কি রে
    দেখে ভীতু মরে কেশে,
    লুটোপুটি খেয়ে নেচেকুঁদে গেয়ে
    মরি খিলখিল হেসে!

    [গাইতে গাইতে রাতের মেয়েরা বেরিয়ে গেল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারদিক। শুধু শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝির শব্দ। হঠাৎ একক ওই গানেরই সুর শোনা গেল গুনগুন করে একটি ছেলের গলায়। দূর থেকে ভেসে আসছে। এমনই সময়ে গ্রামের সেই লোকেরা চুপিসাড়ে ঢুকল পায়ে ডিঙি মেরে। কথা বলল নীচু গলায় ফিসফিস করে।]

    ১ : কে যেন গুনগুন করে গান গাইছে!

    ২ : বোধ হয় সেই ছেলেটার গলা।

    ৩ : তোর মুন্ডু! যে ডাকাতের গুপ্তচর সে গান গাইবে রাতদুপুরে গুনগুন করে! তার প্রাণে ভয় নেই! অন্য কেউ হবে।

    ৪ : দেখতে তো পাচ্ছি না অন্য কাউকে!

    ৫ : এ যেন গন্ধের মতো—নাকে সেঁধুচ্ছে, অথচ চোখে ঠাহর হচ্ছে না। (চাপা হাসি)

    [ঠিক এই সময়ে একজন গ্রামবাসী সেখানে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। সে খুবই উত্তেজিত।]

    গ্রামবাসী : আমি দেখতে পেয়েছি।

    ১ : কী দেখতে পেয়েছ?

    গ্রামবাসী : বলতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

    ২ : ওকে ধরো ধরো! ও ভয়ে টলছে।

    গ্রামবাসী : না, আমায় ধরতে হবে না। আমি টলছি না। আমি টলছি না। আমি সেই ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছি।

    ৩ : দেখতে পেয়েছ?

    গ্রামবাসী : হ্যাঁ, ডাকাতের গুপ্তচর কুয়াশা নামের ছেলেটাকে।

    ৪ : (সকলে সমবেতভাবে) অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ!

    ৫ : কোথায়?

    গ্রামবাসী : নদীর ঘাটে। হাঁসেদের গুগলি খাওয়াচ্ছে, আর গুনগুন করছে!

    ৬ : এই রাতদুপুরে?

    গ্রামবাসী : তবে আর বলছি কী! চলো, ছেলেটাকে ধরতে হবে, নইলে পালাবে।

    সকলে : (ব্যস্তসমস্ত হয়ে) তবে চলো চলো! (সবাই বেরিয়ে গেল)

    দ্বিতীয় দৃশ্য

    [নদীর ঘাট। হাঁসেরা জলে ভাসছে। একটি ছেলে একলা বসে গুনগুন করছে। গ্রামবাসীরা দল বেঁধে চুপচাপ মঞ্চে ঢুকল। ছেলেটা আনমনা। কিছুই দেখতে পেল না। হঠাৎ একজন গ্রামবাসী ছেলেটাকে জাপটে ধরল।]

    ছেলেটা : (চমকে) মরে গেলুম! মরে গেলুম!

    ১ : (খেঁকিয়ে) মরে গেলুম! পাজি হতচ্ছাড়া!

    ২ : কী তোর নাম?

    ছেলেটা : বাদল।

    ৩ : বাদল! মিথ্যুক! নাম ভাঁড়াচ্ছিস? তোর নাম তো কুয়াশা।

    বাদল : না, আমি কুয়াশা নই। আমার নাম বাদল। আমার একটা সাদা রঙের হাঁস আছে। একটা কালো রঙের ব্যাগ আছে। একটা নীল রঙের জামা আছে। একটা ছবির বই আছে। আমার বাড়ি ভিন গাঁয়ে। বাড়িটা আগুন লেগে পুড়ে গেছে। হাঁসটা নদীর জলে ভেসে এসেছে।

    ৪ : চপ! মিথ্যে বলার জায়গা পাসনি! (গ্রামবাসীদের উদ্দেশে) এই হাঁক পাড়ো তো কোতোয়ালকে!

    সকলে : কোতোয়াল কোতোয়াল খবরটা জব্বর,

    ধরা গেছে কুয়াশাকে দিতে হবে কববর!

    [মজাদার বাজনার সঙ্গে কোতোয়াল ঢুকবে]

    কোতোয়াল : কই কই, গেল কই, এই বুঝি শয়তান,

    মারো মারো কিল-চড় দাও ছিঁড়ে দুটো কান।

    বাদল : (রেগে মেগে) হ্যাট, কান ছিঁড়বে! (ঘুসো পাকিয়ে) আমিও একখানা দেব এক্ষুনি! বলছি আমি কুয়াশা নই, আমি বাদল, তা কারও কানে ঢুকছে না!

    ৫ : এই ছেলে ধমকাচ্ছিস কেন রে?

    বাদল : বেশ করব! বেশি ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে পেট ফুটো করে চটকাব!

    ৬ : অ্যায়!

    বাদল : ভ্যাট!

    ৭ : (চোখ পাকিয়ে) আমাদের সঙ্গে দাঙ্গাবাজি করতে চাস?

    বাদল : করবই তো। আমার সঙ্গে লাগলে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেব।

    ৮ : সাহস দেখো, আমাদের বলে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেবে! কোতোয়াল ছেলেটাকে ধরো তো! (কোতোয়াল ধরতে গেল)

    বাদল : খবরদার, গায়ে হাত দেবে না বলে দিচ্ছি!

    কোতোয়াল : কেন, কী করবি?

    বাদল : কামড়ে দেব!

    কোতোয়াল : চপ! (ধমক)

    বাদল : (একই ভাবে) চপ!

    কোতোয়াল : তবে রে! (তেড়ে গেল)

    [কোতোয়ালের সঙ্গে বাদলের চোর-পুলিশ খেলা শুরু হয়ে গেল। শেষমেশ সবাই মিলে বাদলকে ধরে ফেলল। বাদল চেঁচাতে লাগল। বাদলকে চ্যাংদোলা করে ধরে বেরিয়ে গেল। দুজন দাঁড়িয়ে থাকল। মেঘ ডাকল।]

    ৯ : না-ও দেবতা ডাক ছেড়েছে!

    ১০ : বৃষ্টি নামল বলে!

    ১১ : চলো, পালাই। (সক্কলে বেরিয়ে গেল।)

    তৃতীয় দৃশ্য

    [দেখা যাচ্ছে কোতোয়ালের আস্তানা। একখানা ঘর। বাইরে থেকে শেকল তোলা। এই ঘরেই বাদলকে আটকে রাখা হয়েছে। ঘরের ভেতরে বাদল চেঁচাচ্ছে। কোথাও জনমনিষ্যি নেই। নির্জন। আবছা আলোয় হঠাৎ দেখা গেল, কে যেন ঘরের শেকল খুলে দিল। দরজাটাও খুলে গেল। বাদল অবাক হয়ে মুখ বাড়াল। কাউকে দেখা গেল না।]

    বাদল : (ভয়ে, অস্পষ্ট গলায়) কে?

    [যে দরজা খুলল, তারই নাম কুয়াশা। সে দরজা খুলে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। সেখান থেকেই সে উত্তর দিল।]

    কুয়াশা : এরা আমার নাম দিয়েছে কুয়াশা। আমি সব দেখেছি। এখন তোকে উদ্ধার করতে এসেছি। কথা বলিস না। এক্ষুনি বেরিয়ে আয়। ওই দেখ, কোতোয়াল পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

    [বাদল বেরিয়ে আসতে ইতস্তত করছিল।]

    কুয়াশা : (ব্যস্ত হয়ে) দেরি করিস না। কোতোয়ালের ঘুম ভেঙে গেলেই বিপদ।

    বাদল : তোমার নামই কুয়াশা? তুমিই ডাকাতের গুপ্তচর?

    কুয়াশা : সব কথা পরে বলব। শুধু শুনে রাখ আমি তোকে চিনি। তোর নাম বাদল। তোদের বাড়িটা আগুনে পুড়ে গেছে। তোর কেউ নেই। আমি তোর পথের বন্ধু হতে চাই। এখন তোকে পালাতে হবে আমার সঙ্গে।

    বাদল : আমি তো তোমায় দেখতে পাচ্ছি না!

    কুয়াশা : আমি গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছি। বেরিয়ে আয় তা হলেই দেখতে পাবি।

    বাদল : আলতো পায়ে বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ ঠোক্কর খেল। শব্দ উঠল। কোতোয়ালের ঘুম ভেঙে গেল। দেখতে পেল বাদল ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে।

    কুয়াশা : (চেঁচিয়ে) বাদল, কোতোয়ালের ঘুম ভেঙে গেছে। তোকে ধরবে। পালা!

    [বাদল ছুটল। কোতোয়ালও ছুটল। বাদল পালাল। কোতোয়াল বাদলকে ধরার আগেই গাছের আড়াল থেকে কুয়াশা বেরিয়ে এসে তাকে বাধা দিল। কুয়াশার সঙ্গে কোতোয়ালের ধস্তাধস্তি। ঠিক সেই সময়েই মেঘ গর্জন করে বৃষ্টি নামল। কোতোয়ালকে কাবু করে কুয়াশাও পালাল সেখান থেকে।]

    চতুর্থ দৃশ্য

    [দুর্যোগের ঘনঘটা। একটা ভাঙা মন্দির। বাদল ছুটতে ছুটতে এই মন্দিরেই ঢুকে পড়ল। হাঁপাচ্ছে বেদম। সে দেখতে পেল, মন্দিরের ভেতরে একটি মেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কী করবে ভেবে না পেয়ে সে মেয়েটার কানের কাছে তালি বাজিয়ে তার ঘুম ভাঙাল। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, তার শব্দ।]

    মেয়ে : (ঘুম ভেঙে চমকে) কে?

    বাদল : আমি।

    মেয়ে : (ধমক দিয়ে) আমি মানে?

    বাদল : বাদল।

    মেয়ে : তুই মিথ্যে বলছিস। তোকে তো দেখিনি আমাদের এই গ্রামে কোনোদিন! তোর নাম বাদল নয়, তুই নিশ্চয়ই ডাকাতের গুপ্তচর কুয়াশা!

    বাদল : না, না, আমি…

    মেয়ে : (কথার মাঝখানে আচমকা চিৎকার করে) ডাকাত! ডাকাত! (বাদল ভ্যাবাচাকা খেয়ে কী করবে ভেবে না পেয়ে পালাতে গেল।)

    মেয়ে : (তার জামাটা ধরে ফেলে) পালাচ্ছে! পালাচ্ছে!

    বাদল : (ছাড়াবার চেষ্টা করে) এই মেয়ে ছাড় বলছি। ছাড়! ছাড়! ছাড়! আমার জামা ছিঁড়ে গেলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি! নতুন জামা কেনার পয়সা নেই আমার।

    মেয়ে : (ধাতানি দিয়ে) করিস ডাকাতি, পয়সা নেই। মিথ্যে বলার জায়গা পাসনি।

    বাদল : কে বলেছে, আমি ডাকাতি করি?

    মেয়ে : কে জানে না, তুই ডাকাতি করিস!

    বাদল : যে বলে আমি ডাকাত, সে জানে না আমার একটা সাদা রঙের হাঁস আছে।

    মেয়ে : ডাকাতের হাঁস থাকতেই পারে।

    বাদল : আমি গান গাইতে পারি।

    মেয়ে : (হেসে) ডাকাতও পারে।

    বাদল : আমি লিখতে পড়তে পারি, তুই পারিস?

    মেয়ে : আলবাত পারি।

    বাদল : তার মানে, আমি লিখতে পড়তে পারি, তুইও পারিস। আমাকে ডাকাত বলছিস, তা হলে তুইও তো ডাকাত!

    মেয়ে : মুখ সামলে কথা বলবি!

    বাদল : যদি না বলি?

    মেয়ে : আমি ‘ডাকাত’ ‘ডাকাত’ বলে চেঁচাব।

    বাদল : আমি তোর গলাটা টিপে ধরব!

    মেয়ে : ধরতেই পারিস, আমার যে কেউ নেই!

    বাদল : (থতোমতো খেয়ে) মানে?

    [মেয়ের মুখে কথা নেই। এতক্ষণ এত তর্ক করার পর স্তব্ধ হয়ে যায় মেয়েটার মুখ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে থমকে চেয়ে থাকে বাদল তার মুখের দিকে।]

    বাদল : (খানিক নিশ্চুপ থাকার পর) তুইও যা, আমিও তাই। আমারও কেউ নেই।

    মেয়ে : (চমকে) তোরও কেউ নেই?

    বাদল : না।

    মেয়ে : কেন?

    বাদল : জানি না। (আবার ক্ষণেক নিস্তব্ধতা) তোর নামটা এখনও জানতে পারিনি।

    মেয়ে : রেহানা। কিন্তু তোর নামটা আমি জানি!

    বাদল : বাদল।

    রেহানা : ওটা তোর লুকোনো নাম। আসলে তুই কুয়াশা।

    বাদল : বিশ্বাস কর, আমি কুয়াশা নই। আমি বাদল।

    রেহানা : সত্যি তুই ডাকাতের গুপ্তচরগিরি করিস না? তবে কী করিস তুই?

    বাদল : কিচ্ছু না!

    রেহানা : আমিও তাই—কিছুই করি না।

    বাদল : তোর খিদে পায় না? আমি গান গাই। পয়সা পাই।

    রোহানা : আমি গান জানি না।

    বাদল : শিখবি?

    রেহানা : কে শেখাবে?

    বাদল : আমার সঙ্গে গা।

    রেহানা : পারি না।

    বাদল : চেষ্টা কর না।

    রেহানা : গা দেখি!

    [গানটা বাদল শুরু করল। রেহানা তাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করল। কখনো গাইছে কখনো থামছে। গান শেখবার সময় যে পদ্ধতি নেওয়া তেমনভাবেই শেখার চেষ্টা।]

    [গান]

    আকাশটা যত বড়ো মনটাকে তত বড়ো
    করতে কি পারো না?
    সাগরের ঢেউ যত স্নেহমায়া দাও তত
    হিংসাকে ছাড়ো না!
    গগনে গগনে তারা ছড়ানো যে ভালোবাসা
    বুকে গেঁথে রাখো না,
    গাছে গাছে ফুলে ফুলে কত রং তুলতুলে
    তারই ছবি আঁকো না!
    বৃষ্টির ফোঁটা যত ঝরে পড়ে অবিরত
    মমতায় তেমনই
    মনটাকে ভরে দাও টুপটাপ শুনে তার
    ঝংকার যেমনি।

    বাদল : বা: বা:! আমার সঙ্গে এই তো বেশ গাইতে পারলি!

    রেহানা : তা বলে তোর মতো পারিনি! (হেসে ফেলল) তুই কী সুন্দর গাস! কার কাছে শিখেছিস?

    বাদল : নিজের কাছে। (হেসে উঠল) (দুজনেই হাসছে. বাইরে অবিরাম বৃষ্টি ঝরেই চলেছে)

    বাদল : মুশকিল হল। বৃষ্টির থামবার নাম নেই। এখন কী করে তার সঙ্গে দেখা হবে?

    রেহানা : কার সঙ্গে?

    বাদল : কুয়াশার সঙ্গে।

    রেহানা : (চমকে) কুয়াশা!

    [ঠিক এই মুহূর্তে আর্তনাদ শুরু হয়ে গেল। নদীতে বান আসছে। বিপদগ্রস্ত গ্রামবাসীরা চেঁচাচ্ছে : ‘বান আসছে! বান আসছে! বাঁচাও! বাঁচাও!’ রেহানা আর বাদল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল।]

    রেহানা : (আতঙ্কে) কী হবে? আমরা কেমন করে বাঁচব?

    বাদল : (উত্তেজিত স্বরে) তুই সাঁতার জানিস? জলে ভাসতে পারবি?

    রেহানা : হ্যাঁ পারব।

    বাদল : তবে আয়! আমরা বানের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচবার চেষ্টা করি!

    [রেহানার হাত ধরে বেরিয়ে গেল। মঞ্চ অন্ধকার হল]

    [সম্ভব হলে এখানে একটি বন্যা দৃশ্য দেখানো যেতে পারে। নইলে বন্যার জলোচ্ছ্বাসের শব্দের সঙ্গে দৃশ্যান্তর ঘটাতে হবে।]

    পঞ্চম দৃশ্য

    [গভীর জঙ্গল। চারদিক শুনশান। দেখা যাচ্ছে দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে ইতস্তত এদিক-ওদিক পড়ে আছে। তাদের জ্ঞান নেই। মঞ্চে আলো জ্বালার মুহূর্ত পরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত একটি ছেলে টলমল করতে করতে প্রবেশ করল। দেখা গেল, মেয়েটির জ্ঞান ফিরছে। শোনা গেল মেয়েটির গলায় কষ্টের ক্ষীণ শব্দ। চেনা গেল মেয়েটি রেহানা। দূরে পড়ে আছে বাদল জ্ঞান হারিয়ে। অন্য আর একটি ছেলেকে চেনা গেল না। তারও জ্ঞান নেই। রেহানার গলায় কষ্টের শব্দ শুনে এই মুহূর্তে যে ঢুকল, সে ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল রেহানার কাছে। রেহানার মাথায় সে হাত রাখল।]

    রেহানা : (ক্ষীণ ক্লান্ত গলায়) কে? বাদল?

    ছেলে : না, আমি।

    রেহানা : (শুয়ে শুয়েই তার মুখের দিকে চমকে তাকাল) তুমি? কে তুমি?

    ছেলে : তোমার মতোই বানের জলে ভেসে এসেছি।

    রেহানা : (ধড়ফড় করে উঠে বসল) বাদল কই? বাদল?

    ছেলে : সে-ও ভেসে এসেছে।

    রেহানা : (ব্যস্ত স্বরে) কই?

    ছেলে : ওই তো!

    রেহানা : হ্যাঁ। ওই তো বাদল। অনেক কষ্ট করে আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি তো ভেসেই যাচ্ছিলুম। ও কি অজ্ঞান হয়ে গেছে? আমি দেখি। (ঘষটে ঘষটে বাদলের কাছে এগিয়ে গেল, গায়ে-মাথায় হাত দিল) এখন কী হবে? যদি বাদলের জ্ঞান না ফেরে! (আর একটি ছেলেকে দেখে) ও কে?

    ছেলে : ওকে আমি চিনি না।

    রেহানা : দেখো, ওর হাতের আঙুল কাঁপছে!

    ছেলে : বোধহয় জ্ঞান ফিরছে। আমি ওকে দেখছি! তুমি বাদলকে দেখো!

    [ছেলেটি অন্য আর-একটি ছেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় বাদল আচমকা চিৎকার করে উঠল।]

    বাদল : রেহানা, আমার কোমরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধর! (তারপরেই ক্ষীণ হয়ে গেল কন্ঠস্বর) আঃ আঃ!

    [চমকে তাকাল রেহানা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটিও তাকাল বাদলের দিকে। সেই সময়ে অন্য আর যে ছেলেটি পড়েছিল সে এবার চিৎকার করে উঠল। তারও জ্ঞান ফিরছে।]

    অন্য ছেলেটি : (আতঙ্কে চিৎকার করে) বান আসছে! বান আসছে! বাঁচাও!

    বাদল : (শুয়ে শুয়েই) বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

    অন্য ছেলেটি : আমি ভেসে যাচ্ছি!

    ছেলে : (অন্য ছেলেটির কাছে ছুটে গেল) ভয় নেই। আমি আছি। তুমি ভেসে যাচ্ছ না।

    রেহানা : (বাদলের কাছে ব্যস্ত হয়ে গিয়ে) বাদল, আমি রেহানা।

    বাদল : রেহানা? আমি কোথায়? আমি বসব।

    অন্য ছেলেটি : আমিও বসব।

    [রেহানা ও ছেলেটির সাহায্যে দুজনেই উঠে বসল। সংলাপ স্বাভাবিক হওয়ার আগে সংলাপে কষ্টের শব্দ শোনা যাবে।]

    বাদল : (চারদিক তাকিয়ে) এ কোথায় এসেছি!

    রেহানা : জঙ্গল।

    অন্য ছেলেটি : আমি তোমাদের কাউকে চিনি না!

    বাদল : আমার নাম বাদল। (ছেলে ও অন্য ছেলেটিকে) আমি শুধু রেহানাকেই চিনি। তোমাদের দুজনকে তো চিনি না!

    অন্য ছেলেটি : আমার নাম জোসেফ!

    বাদল : (ছেলেকে) আর তুমি?

    ছেলে : আমি তোমাদের বন্ধু। আমাকে বন্ধু বলেই ডেকো! (ধীরে ধীরে সবারই কন্ঠস্বর স্বাভাবিক হবে। চারজনই এখন উঠে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছে।)

    জোসেফ : এই নির্জন জঙ্গলে এখন আমাদের কী হবে?

    বন্ধু : ফিরে যাবার রাস্তা খুঁজতে হবে।

    বাদল : কোথায় ফিরে যাব?

    বন্ধু : যে যার বাড়িতে।

    রেহানা : আমার তো বাড়ি নেই।

    জোসেফ : আমারও।

    বাদল : আমিও একা। বন্ধু, তুমি?

    বন্ধু : আমিও তোদের মতো। তোদের মতো আমারও বিপদ। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখ, নাম আমাদের সবার আলদা আলাদা, কিন্তু বিপদ যখন আসে সে নাম দেখে আসে না। সে বিপদ যেমন আমার, তেমনই রেহানা, বাদল, জোসেফেরও। বিপদকে তখন এককাট্টা হয়ে রুখতে হয়। তখন নামগুলো আর আলাদা থাকে না। তখন আমাদের একই নাম। আমরা সবাই মানুষ।

    [বন্ধুর কথা শুনে তিনজনেই অবাক চোখে তাকাল তার দিকে।]

    রেহানা : আশ্চর্য! আমরা তো ভাবতেই পারি না এসব কথা।

    জোসেফ : তুমি ভাবলে কেমন করে?

    বন্ধু : আসলে, আমি তো তোদের সকলের চেয়ে বড়ো। (হঠাৎ রেহানার চোখ কী যেন দেখে থমকে গেল। সেইদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।)

    বাদল : অমন করে কী দেখছিস?

    রেহানা: ঝোপের আড়ালে ওটা কী বল তো? (সবাই সেইদিকেই তাকাল।)

    বন্ধু : মনে হচ্ছে একটা মস্ত ভাঙা বাড়ি।

    জোসেফ : কোনো প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ নাকি!

    বন্ধু : হতে পারে।

    রেহানা : যাওয়া যায় না?

    বন্ধু : চল দেখি, একটা আশ্রয় মিলে যেতে পারে।

    সবাই : সেই ভালো। চলো দেখি! (চারজনেই বেরিয়ে গেল)

    [দেখা যাচ্ছে ঘুটঘুটে অন্ধকার, একটা পাতালঘর। সেই অন্ধকারে তারা খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলে ঢুকছে।]

    রেহানা : বাব্বা! কী অন্ধকার!

    বাদল : মনে হচ্ছে পাতালে প্রবেশ করছি!

    জোসেফ : দম আটকে আসছে।

    বন্ধু : ঠিক বলেছিস। অন্ধকারে থাকা যায় না। এক কাজ কর, তোরা এখানে বিশ্রাম নে। আমি দেখি আলোর ব্যবস্থা করা যায় কি না! (বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ বাদল বলে উঠল)

    বাদল : দাঁড়াও! একা যেয়ো না। আমিও যাই।

    রেহানা : আমিও যাব।

    জোসেফ : আমি কী দোষ করলুম।

    বন্ধু : সবাই যাচ্ছি যখন তুইও যাবি! আয়!

    [চারজনেই বেরিয়ে গেল। তারপর কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। আচমকা সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে অদ্ভুত যত ভয়ের শব্দে সারাঘর কেঁপে উঠল। একটা ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হল।]

    [কিছুক্ষণ পরেই শোনা গেল বাদলদের এই ঘরে ফেরার কন্ঠস্বর। এতক্ষণ ভয়ংকর শব্দ আর আলোর সঙ্গে যে-দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল, চকিতে তা স্তব্ধ হয়ে গেল। ওরা ঢুকল গাছের শুকনো ডালপালা নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে এল দুটো পাথরের টুকরো। সেই পাথরের টুকরো ঠুকে আগুনের ফুলকি দিয়ে তারা গাছের শুকনো ডালে আগুন ধরাবে।]

    জোসেফ : (জোসেফের কাঁধে ডালপালা) কোথায় রাখব?

    বন্ধু : এই কোণে রাখ! পাথর দুটো কই?

    বাদল : এই নাও।

    বন্ধু : দে!

    [পাথর দুটো ডালপালার কাছে ঠুকতে লাগল। আগুন জ্বলে উঠল। এখানে আলোর কারসাজি প্রয়োগ করতে হবে।]

    জোসেফ : এবার আমরা কী করব?

    বন্ধু : এবার সবাই শুয়ে পড়ব।

    বাদল : হ্যাঁ, সারাদিন ধকলটা কম যায়নি।

    রেহানা : আমরা যে বেঁচে আছি এইটাই আশ্চর্য!

    জোসেফ : এখন বোধহয় অনেক রাত। (হাই উঠল)

    বাদল : সে তোর হাই তোলা দেখেই বুঝতে পারছি। (বাদলেরও হাই উঠল)

    বন্ধু : নে, শুয়ে পড়!

    রেহানা : তুমি?

    বন্ধু : আমি কি আর বসে থাকব! আগুনটা এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে। নিভে গেলেই শুয়ে পড়ব! নে, তোরা শো! (বন্ধু বসে রইল। সবাই শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়েও পড়ল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারদিক। হঠাৎ একটা দামামার শব্দে ভেঙে গেল নিস্তব্ধতা, কিন্তু অন্য কারও ঘুম ভাঙল না। শুধু জেগে রইল বন্ধু। সে শব্দ শুনে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল।)

    বন্ধু : (আতঙ্কিত) কে?

    (দামামার শব্দটা কমল)

    নেপথ্যে : (অস্বাভাবিক ভয়ংকর কন্ঠে) আমি জানি, আমি ‘কে’ এই কথাটাই তুই জিজ্ঞেস করবি। তবে শোন, তোরা এখন যে ঘরটায় ঢুকেছিস, এটা হল ধসে-পড়া এক রাজপ্রাসাদের গুমঘর। আমি হচ্ছি এই গুমঘরের আত্মা। এর দেওয়াল হচ্ছে আমার পেট, পিঠ। এবড়ো-খেবড়ো মেঝেটা হল আমার বুকের পাঁজর। এই ঘরে আমার সঙ্গে বাস করে আমার বন্ধু অন্ধকার। এককালে এই ঘরে বন্দি করে রাখা হত তস্কর, জালিয়াত, লুঠেরাদের। তা সে হল কত বছর আগেকার কথা। সেই থেকে অন্ধকার বন্ধুর গলা জড়িয়ে নিশ্চিন্তে কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিন। কেউ কোনোদিন এই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে আমার বন্ধু অন্ধকারকে উত্যক্ত করেনি। আমার বুকের পাঁজর দলে কেউ কোনোদিন চলাফেরাও করেনি। কিন্তু এখানে হঠাৎ ঢুকে তোরা আমাকে যেমন অতিষ্ঠ করছিস, তেমনি আগুনের তাপ ছড়িয়ে অন্ধকারকেও দগ্ধ করছিস। তোরা এক্ষুনি দূর হয়ে যা এখান থেকে।

    বন্ধু : (প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে) তাই নাকি! তুমি বললেই আমরা দূর হয়ে যাব! জেনে রাখো, এই প্রাসাদ আমরা দখল করেছি।

    নেপথ্যে : (তাচ্ছিল্যের হাসি) বলিস কী রে, তোর বুকের পাটা তো কম নয়। দখল কথাটা এই বয়েসে শিখলি কোত্থেকে! জানিস, আমার বন্ধু অন্ধকার ক্ষিপ্ত হলে তোদের অতলে তলিয়ে দিতে পারে!

    বন্ধু : ফু:! সে তো ফাঁকাফুঁকো ফোপরা! তাকে থোড়াই কেয়ার!

    নেপথ্যে : (হেসে) তুই কে রে ছেলে, অন্ধকারকে তাচ্ছিল্য করিস! আমি যদি অন্ধকারকে একবার বলি তোর বন্ধুদের বুকের মধ্যে ঢুকে পড়তে তখন তোর মালুম হয়ে যাবে অন্ধকার ফাঁকা না, ফোঁপরা! জেনে রাখ, অন্ধকার একবার ওদের বুকে ঢুকলে, ওরা আর বন্ধু থাকবে না। বোধবুদ্ধি সব লোপাট হয়ে যাবে। মরবে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। সুতরাং মানে মানে এখান থেকে সরে পড়! নইলে মরবি তুইও!

    বন্ধু : শোনো গুমঘরের আত্মা, আমাদের বন্ধুত্ব অত ঠুনকো নয়। বিপদের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আমি এই জেগে বসে রইলুম, দেখি অন্ধকার কেমন করে ঢোকে বন্ধুদের বুকে!

    নেপথ্যে: ঠিক আছে, দেখ তবে!

    [হঠাৎ দেখা গেল একটা আলোর ছায়া ঘুমন্ত জোসেফ, রেহানা আর বাদলের গায়ের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়েই অন্ধকার হয়ে গেল সারামঞ্চ। ইতিমধ্যে সেই শুকনো ডালপালার আগুনও নিভে গেছে। সুতরাং মঞ্চে গাঢ় অন্ধকার।]

    ষষ্ঠ দৃশ্য

    [একই দৃশ্য। রাত কেটেছে, সকালের আভাস গুমঘরে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বন্ধু ঘরের এককোণে বসে আছে। দেখে মনে হয় যেন সে সারারাত বসে বসে রেহানা, জোসেফ আর বাদলকে পাহারা দিয়েছে। বাদল, জোসেফ, রেহানার ঘুম ভাঙল। তিনজনের মুখের দিকে চাইলেই বোঝা যায়, কালকের মতো তারা হাসিখুশি নয়। কেমন যেন বিরক্তিতে ভরা সেই মুখগুলি। তারা যখন একে অন্যকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছিল, তখন বন্ধু উঠে দাঁড়াল। তাদের কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল]

    বন্ধু : কী রে, কেমন ঘুম হল?

    [বন্ধুর কথার উত্তর না-দিয়ে আচমকা বাদল ক্ষিপ্ত গলায় চেঁচিয়ে জোসেফের গলাটা খামচে ধরল।]

    বাদল : (ক্ষিপ্ত গলায় জোসেফকে) কাল সারারাত তোর জন্যে আমার ঘুম হয়নি। শুয়ে শুয়ে তুই আমাকে সারারাত লাথি মেরেছিস!

    জোসেফ : (ঝটকা মেরে বাদলের হাতটা সরিয়ে) মিথ্যুক! কে লাথি মেরেছে? আমি, না তুই? আমার গায়ে হাত তুলিস! ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব তোর হাত!

    [দুজনের আচমকা হাতাহাতি লেগে গেল।]

    বন্ধু : (ধমক দিয়ে) এই, এ কী করছিস তোরা? (এগিয়ে গেল ওদের থামাবার জন্যে)

    রেহানা : (হঠাৎ চিৎকার করে) এই হতচ্ছাড়ার দল, আর জায়গা পেলি না? শুনে রাখ, এটা আমার বাড়ি। মারামারি করতে হয় আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কর!

    বন্ধু : (বিস্ময়ে) এ কী বলে রেহানা!

    [রেহানার কথা শুনে থমকে গেল জোসেফ আর বাদলের হাতাহাতি। চকিতে তেড়ে এল রেহানার দিকে দুজনেই। বন্ধু হতবাক।]

    বাদল : (রেহানাকে তড়পে) মানে?

    জোসেফ : তোর বাড়ি! কে বলেছে তোর বাড়ি?

    রেহানা : আমারই তো! আমি প্রথম দেখতে পেয়েছি।

    বাদল : (ঝগড়ার স্বরে) প্রথম দেখতে পেয়েছিস বলে তোর হয়ে গেল!

    জোসেফ : বেশি ট্যাণ্ডাইম্যাণ্ডাই করলে ঘাড় ধরে এখান থেকে বার করে দেব!

    রেহানা : দে তো দেখি! দেখি তোর মুরোদ!

    বাদল : শুনে রাখ এ বাড়ি আমার!

    জোসেফ : (বাদলকে ধাক্কা দিয়ে) গাজোয়ারি নাকি! এ বাড়ির মালিক আমি।

    [তিনজনের মধ্যে তুমুল কথাকাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আবার লেগে গেল বাদল আর জোসেফের মধ্যে। বন্ধু চিৎকার করে ছুটে গেল তাদের থামাতে। বাদলকে টেনে নিল। বাদল মানল না বন্ধুকে। তাকে ঠেলে দেয়। ছিটকে পড়ে বন্ধু।]

    বন্ধু : (ছিটকে পড়ে) ছি ছি! এ কী করিস তোরা!

    বাদল : (বন্ধুকে) তুমিই যত নষ্টের গোড়া। তুমিই ফন্দি করে আমাকে এখানে বন্দি করেছ।

    বন্ধু : ভুল করছিস বাদল, আমরা কেউ কাউকে বন্দি করিনি। আমরা বন্ধু। (উঠে বাদলকে ছাড়িয়ে নিয়ে)

    কীসের বন্ধু! বন্ধু-টন্ধু আমি মানি না। আমার এককথা, বাড়ি আমার!

    রেহানা : (ক্ষিপ্ত স্বরে) আমি বলছি আমার।

    জোসেফ : আমিও বলছি আমার।

    [তিনজনেই ক্ষিপ্ত হয়ে এ ওকে মারতে যায় ও তাকে মারতে উদ্যত হয়। চিৎকার করে ঝগড়া করে।]

    বন্ধু : (স্তম্ভিত হয়ে) তবে কি সত্যিই অন্ধকার সকলের বুকে বাসা বেঁধে সর্বনাশ করল! ওরে তোরা শোন, এ-বাড়ি কারও একার নয়, আমাদের সকলের।

    জোসেফ : বুঝতে পেরেছি, তুমি রেহানা আর বাদলের হয়ে দালালি করছ। (ঝট করে ভাঙা গুমঘরের মেঝে থেকে একটা ঢিল তুলে, ছুড়ে মারল বন্ধুকে) এ-বাড়ি আমার!

    [ইটটা আঘাত করল বন্ধুর কপালে। বন্ধু লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। রক্ত গড়াল কপাল থেকে। জ্ঞান হারাল। আচমকা এই ঘটনায় থমকে গেল রেহানা, বাদল, জোসেফ। চকিতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল গুমঘর। তিন বন্ধুর মুখ থমথম করতে লাগল। সেই থমথমে মুখে নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। মুখের ওপর ছায়া দেখা দিল অপরাধবোধের। জোসেফ যে-হাতে ইট ছুড়েছিল সেটা পেছনে লুকিয়ে ফেলল। কয়েক মুহূর্ত এমনই স্তব্ধতা। তারপরেই জ্ঞানহারা আহত বন্ধুর কাছে ছুটে গেল রেহানা। বন্ধুর রক্তাক্ত কপালে হাত দিয়ে হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠল।]

    রেহানা : (কাঁদতে কাঁদতে জোসেফকে) এ কী করলি জোসেফ!

    জোসেফ : ভুল করে ফেলেছি।

    রেহানা : একটু জল নিয়ে আয়! দেরি করিস না, তাড়াতাড়ি যা!

    [বাদল আর জোসেফ জল আনতে ছুটল। রেহানা বন্ধুর শুশ্রূষা করতে লাগল। কয়েক মুহূর্তেই তারা জল নিয়ে এল একটা ভাঙা পাত্রে। রেহানা বন্ধুর চোখেমুখে ছড়িয়ে দিল। বন্ধুর ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরল। উঠে বসল। জোসেফের দিকে তাকাল। বন্ধুর মুখ আলোয় ঝলসে উঠল। তিন বন্ধু অপরাধীর মতো উঠে দাঁড়াল একপাশে। বন্ধুও উঠে দাঁড়াল। টলোমলো পায়ে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। তারপর বলল]

    বন্ধু : আমি কিছু মনে করিনি। তোদের কোনো দোষ নেই। এই গুমঘরের আত্মাটাই যত নষ্টের গোড়া। সে তোদের মনের মধ্যে অন্ধকারের বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল। মন বিষিয়ে গেলেই বোধহয় আমরা বন্ধুকে মারি। নিজেরা মারামারি করি।

    সবাই : আমরা ভুল করে ফেলেছি!

    বন্ধু : না, তোরা কিছু ভুল করিসনি। আসলে কী জানিস, আমি প্রথম বাদলের দেখা পাই যে গ্রামে, সেই গ্রামের রাস্তা ধরে আমি যাচ্ছিলাম অন্য আর-এক গ্রামে। এমন সময় তুমুল বৃষ্টি নামল। আটকে পড়ে আমি যখন এখানে-ওখানে আশ্রয়ের খোঁজ করছি, তখন সেই গ্রামের মানুষ ভাবল, আমি ডাকাতের গুপ্তচর। সেটাও ভুল। আসলে আমি—

    বাদল : কুয়াশা।

    বন্ধু : না, তোদের বন্ধু। কুয়াশা গ্রামের মানুষের দেওয়া। কুয়াশা নামটা দেওয়ারও কারণ আছে। কেননা, তারা যখন ভাবল, আমি ডাকাতের গুপ্তচর, তখন আমি সাহস হারিয়ে ফেলি। গ্রামের মানুষের সামনে গিয়ে, এটা যে ঠিক নয় একথাটা বলতে পারিনি। উলটে লুকিয়ে চুরিয়ে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াই। তখনই তারা আমার নাম দিল কুয়াশা।

    জোসেফ : তবে তো, এই গুমঘর থেকে এখনই আমাদের অন্য কোথাও চেলে যাওয়া উচিত। অন্ধকার আমাদের মন যদি আবার বিষিয়ে দেয়!

    বন্ধু : তা হলে তো আমরা হেরে গেলুম। আমরা এবার লড়াই শুরু করব এই গুমঘরের সঙ্গে। এই গুমঘরের অন্ধকারকে আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে এখানে আমরা গড়ে তুলব আলোর সৌধ। এখানে একসঙ্গে থাকব আমরা সবাই—রেহানা, বাদল, জোসেফ আর আমি। পারবি না?

    সবাই : নিশ্চয়ই পারব।

    বন্ধু : তবে আয়, গুমঘরে জঙ্গল সরিয়ে ফেলে, এখনই এখানে আলোর সৌধ গড়তে শুরু করে দিই!

    [বন্ধু গান ধরল। সেই গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারা আলোর সৌধ গড়ার কাজে লেগে পড়ল।]

    [গান]

    এসো ভাই লড়ে যাই
    হাতে হাত ধরে তাই
    ঝেড়ে-মুছে ফেলে দাও জঞ্জাল,
    পায়ে পায়ে ফেলে পা
    ভেঙে দাও মেরে ঘা
    বিপদ যে ভারি পাজি দজ্জাল।
    জয় হয় তাদেরই তো
    ভয়ে নয় যারা ভীত
    সাহসের বলে তারা বলীয়ান,
    রাগ দ্বেষ দূরে ঠেলে
    গড়ে তুলি অবহেলে
    আলোর সৌধ এক মহীয়ান।

    টীকা