এটাকে ঠিক শহর বলি না। বলতে গেলে শহরতলি বলাই ভালো। আবার অনেকে বলে শহরতলি নয়, এটা একটা ছোট্ট নগর। সত্যি, তাই নামও এই নগরের ছোট্টিপুর। সেই ছোট্টিপুরে থাকত একটি ছোট্ট মেয়ে। তার নাম জোনাকি। থাকত মা আর বাবার সঙ্গে। বাবাকে খুব খেটেখুটে পয়সা উপায় করতে হত। নইলে সংসার চলবে কী করে! আর জোনাকি ইশকুলেই বা পড়বে কেমন করে! তা মিথ্যে বলব না, বাবা যেমন খাটতে ভালোবাসেন, মেয়েরও তেমন লেখাপড়ায় মন। দোষের মধ্যে কী, না মেয়ের নামটি জোনাকি। হলে কী হবে, উড়ন্ত জোনাকির গায়ে যেমন আলো, মেয়ের গায়ে তেমন আলো কই! তাই বলে এটাকে তুমি দোষ বলতে পারো না। হ্যাঁ, মেয়েটা একটু কালো ঠিকই, কিন্তু মনটা কত ভালো বলো!

    এই ধরো সেদিনের কথা, ঝড় উঠল কী ভীষণ। বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙে। তখন রাস্তার সেই পুঁচকে কুকুরছানাটার কথা ভাবোতো একবার। আহা, রাস্তার এককোণে পড়ে পড়ে ভিজে নেয়ে যায়-যায় অবস্থা! কিঁউ কিঁউ করে কাঁদছে, আর ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে দেখে কারও দয়াও নেই, মায়াও নেই। ভাগ্যিস ওই ছোট্ট মেয়ে জোনাকি দেখতে পেয়েছিল। ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে এল। তারপরে ছানাটার সারা-গা বেশ করে মুছে দিয়ে মাকে বলে গরম দুধ খাওয়াল। শেষমেশ ছানাটা যখন চাঙ্গা হল জোনাকি তখন ছানার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে এল। মেয়ের গায়ের রং তেমন ঝকমকে না হলেও, বলো, মনটি কেমন মমতায় ঝলমলে। এটা কেউ দেখে না। উলটে তার গায়ের রং নিয়ে গঞ্জনা দেবে। ছি:!

    তুমি ‘ছি:’ বললে কে কানে নিচ্ছে! ঝুটমুট গায়ে পড়ে নিন্দে করার লোকের কি আর অভাব আছে! যার নিন্দে করার মন্দ অভ্যাস, তাকে হাজারবার ‘ছি:’ বলে ধাতানি দিলেও তার বয়ে গেছে। কিন্তু গায়ের রং নিয়ে খোঁটা দিলে জোনাকির তো কষ্ট হয়। মনে তো তার হতেই পারে উড়ন্ত জোনাকির গায়ে এত আলো, তার নেই কেন? জোনাকি নামটাই তার মিথ্যে।

    ও মা! এ আবার কী আশ্চর্য কান্ড! পরের দিন দেখি, সেই কুকুরছানাটা একা একা জোনাকিদের বাড়িতে হাজির। শুধু হাজির নয়, দেখো কোলে ওঠার জন্যে জোনাকির পায়ে-পায়ে কেমন ঘুরঘুর করছে! জোনাকিও তাকে দেখে খুশিতে উছলে উঠেছে! কেমন আদর করে তাকে কোলে তুলে নিল! একগাল হেসে বলল, ‘ওরে দুষ্টু, মাকে ছেড়ে আমার কাছে পালিয়ে আসা হয়েছে!’

    সেই হল শুরু। ছানাটার সঙ্গে জোনাকির এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল, সে কী বলব। জোনাকির সঙ্গে খেলছে, ছুটছে, জোনাকির কোলে উঠছে। জোনাকিও তাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে মেতে উঠছে, সে একটা দেখার মতো ব্যাপার বটে। জোনাকি তার একটা নামও রাখল। সে-ও ভারি মজার নাম—ছৌ!

    জোনাকির এক মাসি আছেন। তিনিও খুব ভালোমানুষ। জোনাকিরা যেমন শহরতলিতে থাকে, তেমনি তিনি থাকেন গ্রামে। মাসির কেউ নেই। জোনাকি ছুটি-ছাটায় প্রায়ই মাসির কাছে যায়। মাসি জোনাকিকে এত ভালোবাসেন কী বলব। বলতে নেই, জোনাকি কালো বলে মাসি তাকে কোনোদিন হেলা করেননি। বরং মেয়েটাকে কাছে পেলে তাঁর যদি আনন্দ দেখো! এটা খাওয়াচ্ছেন, ওটা খাওয়াচ্ছেন। এপাড়া যাচ্ছেন, ওপাড়া ঘুরছেন। কী হইহইটাই না করেন। দেখলেই বুঝবে, তিনি এত খুশি যে, মেয়েটাকে নিয়ে কী যে করবেন, ভেবেই পান না।

    মাসিদের গ্রামটাও বেশ মনের মতো। মস্ত মস্ত ধানখেত। কখনো সে খেত ধানের চারায় সবুজ। হাওয়ায় দুলছে। আবার সময় হলে সেই সবুজ হয় সোনার রঙে ঝলমলে। হাওয়ায় উথাল-পাথাল। চতুর্দিকে ছোটো-বড়ো কত গাছ। ফুলে ফলে ভরন্ত। কত কাঠবিড়ালি। কত পাখি। ভোরের আলোয় ঘুম ভাঙলে পাখির গান শুনতে কী যে ভালো লাগে! একটা নদীও আছে, সে অবশ্য গ্রাম থেকে বেশ দূরে। নদীর ওপারে গভীর বন। সবাই বলে সেই বনে নাকি একজন কুহকিনী থাকে। তাকে দেখা যায় না। সবাই বলে, সে এমন জাদু জানে যে, কেউ একটু দুষ্টুমি করলেই কুহকিনী তাকে হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া করে দিতে পারে! নয়তো রোদের তেজে ছাই! আবার যারা লক্ষ্মী, তাদের কিন্তু ভালোবাসে। তারা যা চায় কুহকিনীর কাছে, তা-ই পায়। কে জানে এটা গল্পকথা কি না! আজগুবি গল্প বানাতে মানুষের মতো আর কে আছে!

    যাক, সে তো অন্য কথা। আসল কথায় আসি। সেবারও ক-দিন ইশকুলের ছুটিতে জোনাকি মাসির বাড়ি গেছিল। প্রতিবার যেমন, এবারও তেমন মাসি জোনাকিকে পেয়ে আনন্দে হুল্লোড় শুরু করে দিলেন। খাওয়ানোর বহর তো আছেই, তার সঙ্গে এ-গল্প সে-গল্প, যেন গল্পের শেষ নেই। যত গল্প মাসির, তত গল্প জোনাকির। তার সঙ্গে এবার ঘটল একটা মজার ব্যাপার। কী, না মাসি বললেন, ‘আয় জোনাকি তোর সঙ্গে একটু খেলা করি!’

    মাসির কথা শুনে জোনাকি তো হেসে লুটোপুটি। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমার সঙ্গে খেলবে? কী খেলবে? লুডো?’

    মাসিও হাসতে হাসতে বললেন, ‘না রে, আয়, লুকোচুরি খেলি! সেই কবে, ছোটোবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে খেলেছি, আজ তোর সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করছে।’

    কথার পিঠে কথা বলতে বলতে দুজনের যদি হাসির ধুম দেখতে! সেই দৃশ্য দেখলে, তোমরাও হেসে কুটোপাটি খেতে। তো, সে যাই হোক, লুকোচুরি খেলার কিন্তু এইটাই জুতসই সময়। সন্ধে-সন্ধে হচ্ছে। আকাশ থেকে দিনের আলো মুছে যাচ্ছে। একটি-দুটি তারা ফুটছে। পাখিরা যে যার বাসায় ফিরছে। গাছে গাছে পাখিদের সে কী কলকলানি!

    যাই বলো আর তাই বলো, এই বয়েসেও কিন্তু জোনাকির মাসির উৎসাহ দেখলে অবাক হতে হয়! তিনি বললেন, ‘দেখ জোনাকি, তুই যদি রাজি থাকিস তবে আমি প্রথমে লুকোই, তুই আমায় খুঁজে বার করবি। তারপরে তুই লুকোবি, আমি খুঁজব।’

    জোনাকি বলল, ‘বেশ তো, তা-ই হোক।’

    মাসি বললেন, ‘তা হলে আমি তোর চোখ বেঁধে দিই?’

    ‘দাও।’

    মাসি একটা রুমাল দিয়ে জোনাকির চোখ বাঁধতে বাঁধতে কেমন ছেলেমানুষের মতো বললেন, ‘আমি যতক্ষণ না টুকি বলছি তুই কিন্তু চোখ খুলবি না!’ বলে, মাসি জোনাকির চোখ বেঁধে লুকিয়ে পড়লেন। তারপর টুকি বলে হাঁক দিতেই, জোনাকি চটপট চোখ থেকে রুমাল খুলেই থমকে গেল! দেখতে পেল, তার চোখের সামনে আলো পিটপিট করে একটা জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে! আমাদের ছোট্ট মেয়ে জোনাকি, থমকে দাঁড়িয়ে, উড়ন্ত জোনাকিটাকে অবাক চোখে দেখে। দেখতে দেখতে ভুলে যায় লুকোচুরি খেলার কথা। ভুলে গেল মাসিকে! ধরতে গেল সেই উড়ন্ত জোনাকিটাকে। সে ধরা দেয় কখনো! উড়ে পালায়। আমাদের জোনাকিও তাকে ধাওয়া করে। ওই আলোর জোনাকিকে সে ধরবেই। এখন মাসির বাড়ি ছেড়ে মেয়েটা উড়ন্ত জোনাকিটাকে লক্ষ করে যে কোথায় ছোটে খেয়ালই করে না।

    অদ্ভুত কথা কী, ছুটতে ছুটতে এখন যে সন্ধে গিয়ে রাত নামছে, আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে চরাচর সেটাও তো দেখবে! চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকালেই তো দেখা যাচ্ছে, কত তারা ঝলমল করছে. আমরা সবাই তো জানি, আকাশের কোনো অন্ত নেই। সব শূন্য। অথচ ওই শূন্যে কেমন ভেসে ভেসে অসংখ্য তারা আমাদের চোখে অবাক আলোর কাজল পরিয়ে দেয়! কিন্তু ভয়ংকর কথা কী, অসংখ্য তারার আলো দেখে নয়, উড়ন্ত জোনাকির আলো দেখতে দেখতে আমাদের ওই ছোট্ট মেয়ে জোনাকি এ কোথায় চলে এসেছে! এখন যে রাত অন্ধকার। স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যায়, এ যে নির্জন এক ঘন জঙ্গল। হ্যাঁ, বলতে পারো, সেই উড়ন্ত জোনাকিটা তাকে যেন কোন এক জাদুর মায়ায় মুগ্ধ করে এখানে ধরে এনেছে! এখন তার কিছুই মনে নেই। মনে নেই মাসির কথা। মনে নেই মায়ের কথা, বাবার কথা। তাই বিপদে ভরতি এই ঘন জঙ্গলের গভীরে সে ওই উড়ন্ত জোনাকির পিছু ধাওয়া করে ছুটছে। ডিঙোচ্ছে ঝোপ। ডিঙোচ্ছে জঙ্গল। ডিঙোচ্ছে সাপখোপের গর্ত, না হয় খানাখন্দ। কিন্তু এরপর সে কী করবে!

    কেন?

    সামনে যে নদীর স্রোত! এই অন্ধকারে নদীর স্রোত তুমি পার হবে কেমন করে!

    এ যে দেখি মেয়েটা পার হওয়ার জন্যে সত্যি সত্যি নদীর জলে পা ডোবায়! তবে কি ওই উড়ন্ত জোনাকিটা তাকে বিপদে ফেলার জন্যে এখানে নিয়ে এসেছে!

    ডুবিয়ে দেবে তাকে নদীতে! এখন কে তাকে সাবধান করে বলবে, ‘ওরে মেয়ে, এই অন্ধকারে নদীর জলে নামিস না, স্রোতের টানে ভেসে যাবি!’

    কিন্তু কে আর বারণ করে, আর কে-ই বা কার কথা শোনে!

    ওমা! হঠাৎ এ কী দেখি! কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি আলোর ঢেউ তুলে, নদীর ঢেউ-এর কাছে পৌঁছে যায়! দেখো, দেখো, অন্ধকারে জোনাকির আলোর ছটা দেখো! আশ্চর্য, মেয়েটা যেখানে নদীর জলে নেমেছে, সেই আলোর ছটা কেমন ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে! সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নদীর এখানে ওখানে পাথর ছড়ানো। নদীর জল সেই পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্রোত হয়ে। সেই রাশি রাশি পাথর কোনোটা উঁচু, কোনোটা নীচু। কোনোটা ঢাপ্পুস, কোনোটা এইটুকুস। ওই পাথরের ওপরে পা ফেলে স্বচ্ছন্দে এপার থেকে ওপারে যাওয়া যায়। নদীটা তেমন চওড়া নয়। তার ওপর ঝাঁক ঝাঁক জোনাকির আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। সুতরাং পাথরে পা ফেলে তুমিও যেতে পারো, আমিও যেতে পারি, এমনকী ওই ছোট্ট মেয়ে জোনাকিও।

    আরে! দেখো, দেখো, তুমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা নিজেই কেমন পাথরে পা ফেলে ওপার থেকে ওপারে চলে যাচ্ছে। দেখো, একঝাঁক উড়ন্ত জোনাকি কেমন আলো ছড়িয়ে ওকে পথ চিনিয়ে দিচ্ছে! এ তো ভারি আজব কান্ড!

    হ্যাঁ, নির্বিঘ্নেই সে নদী পার হয়ে গেল। কিন্তু যে পাড়ে উঠল সে, সেই পাড়টা গভীর জঙ্গলে ঢাকা। শুনশান। ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ছোট্ট মেয়েটা সেসব কিছু তোয়াক্কা না করে, আপন মনেই হেঁটে চলেছে জোনাকিদের গা থেকে ছড়িয়ে পড়া আলো দেখে দেখে। তবে কি সত্যিই মেয়েটা জোনাকিদের জাদুর জালে জড়িয়ে পড়েছে!

    হঠাৎ এ কী হল?

    কী হল?

    মেয়েটাকে আলো দেখাতে দেখাতে আচমকা জোনাকির ঝাঁক পালায় কেন? মুহূর্তে জঙ্গলে নেমে এল অন্ধকার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ছোট্ট মেয়ে ভয়ে। হঠাৎ যেন জাদুর মোহ ভেঙে গেল তার। জমাট অন্ধকারে সে এদিক-ওদিক তাকায় অবাক চোখে। তাই তো, আনমনে সে এ কোথায় চলে এসেছে! সে যে আর এগোতে পারে না, পিছোতেও পারে না! এমনকী সেই যে একা উড়ে উড়ে যে জোনাকিটা তাকে সব ভুলিয়ে এখানে নিয়ে এল, তাকে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ভারি ভাবনার কথা তো! চোখ তার অস্থির হয়ে অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই উড়ন্ত জোনাকির খোঁজে।

    এমন সময়ে হঠাৎ যেন একটা আবছা আলোর আভাস মেয়েটার চোখের ওপর ঝলসে উঠল! ভয়ে থতোমতো খেয়ে সে চিৎকার করে উঠল, ‘কে ওখানে?’

    কেউ সাড়া দিল না।

    আবার চেঁচাল সে, ‘আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দয়া করে আমাকে দেখা দাও! আমার বড্ড ভয় করছে!’

    তবুও কেউ উত্তর দিল না। অগত্যা জোনাকি নিজেই দুরুদুরু বুকে ওই আলোর আভাসের দিকে এগিয়ে চলল। আশ্চর্য, যতই সে এগোয় সেই আলোর আভাস ধীরে ধীরে ততই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আরও ক-পা এগোতেই সেই উজ্জ্বল আলোয় সে দেখতে পেল, এ একটা মস্ত ভাঙা ঘর। দেখে আরও আশ্চর্য হয়ে গেল, কে যেন সেই ঘরে খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে অসংখ্য জোনাকি। তাদেরই আলোয় উছলে আছে ঘরটা। আরও দেখল, সেই অসংখ্য জোনাকির দল খাঁচার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে কী ভীষণ হাঁকপাক করছে। আহা রে!

    তার নিজের এত বিপদের মধ্যেও জোনাকিদের এই কষ্ট দেখে স্থির থাকতে পারল না মেয়েটা। সাত- পাঁচ কিচ্ছু না ভেবে ছুট্টে ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। টেনেটুনে খুলে দিল বন্দি খাঁচার দরজা। সঙ্গে সঙ্গে বন্দি জোনাকির দল মুক্তি পেয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে পালাল। চোখের পলকে গাঢ় অন্ধকারে আবার ডুবে গেল ভাঙা ঘরটা। তারপই ঘটল সেই ভয়ংকর ঘটনা। ছোট্ট মেয়েটা চমকে তাকিয়ে দেখে, অন্ধকারে কার যেন দুটো চোখ কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট মেয়ে জোনাকি আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠল, ‘কে—!’

    সে-ও তেমনই খ্যাঁকখ্যাঁক করে খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমি কুহকিনী।’

    তবে কি জোনাকি যে কুহকিনীর কথা শুনেছে, এ কি সেই কুহকিনী? কিন্তু মেয়েমানুষের গলা যে এমন ক্যারকেরে আর খিনখিনে হয়, এটা তো জানা ছিল না ছোট্ট মেয়ে জোনাকির! সে ভয়ে কাঠ হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।

    সেই কুহকিনীই আবার বিটকেল গলায় খিঁচিয়ে উঠল, ‘তুই খাঁচা খুলে জোনাকিদের উড়িয়ে দিলি কেন?’

    তবুও মেয়েটার মুখে কথা নেই!

    মেয়েটাকে অমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুহকিনী মুখ ঝামটা দিয়ে তেড়ে উঠল, ‘কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? তুই কি বোবা! কেন উড়িয়ে দিলি বল! নইলে আমিই তোকে বন্দি করব!’

    জোনাকি এবার ভয়ে ঠকঠক করছে। কথা না বলে আর উপায় নেই। তাই, আমতা আমতা করে বলল, ‘ওদের খাঁচায় বন্দি দেখে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। জোনাকি তো বনের আলো। বন তো ওদের মায়ের মতো। মায়ের কোল থেকে কেউ যদি ছেলেকে কেড়ে নেয়, খাঁচায় বন্দি করে রাখে তবে মা যে কাঁদে!’

    মেয়েটার মুখে মন কেমন-করা ওই কথা শুনে, অমন রেগে আগুন কুহকিনী ফস করে কেমন যেন চুপসে গেল। তার ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো যেন আদরে উছলে উঠল। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তোর নাম কী রে?’

    ‘জোনাকি।’

    কুহকিনী অন্ধকারে এবার যেন মুচকি হাসল। বলল, ‘এখন তোর কথা শুনে বুঝতে পেরেছি, তুই খুব লক্ষ্মী মেয়ে। তোর ওই হাসিমাখা মুখখানির মতো চোখ দুটিও ভারি মিষ্টি। নামটিও বেশ ভালো, জোনাকি। তবে বড্ড বেমানান। জোনাকির মতো তোর গায়ে একফোঁটাও আলো নেই। তুই কালো। কিন্তু তোর মনটা দয়া-মায়ায় ঝলমল করছে। আমি দেখেশুনে অবাক হয়ে যাচ্ছি, তুই এখানে এলি কেমন করে?’

    জোনাকি জবাব দিল, ‘একটা উড়ন্ত জোনাকির আলো চোখ ভরে দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে যে, আমার কেন অমন আলো নেই। আমি কেন কালো! এখন তুমিও বললে। কিন্তু সেই উড়ন্ত জোনাকিটা আমায় আনমনা করে তোমার কাছে কেমন করে নিয়ে এল, তা আমি একদমই খেয়াল করতে পারছি না। তবে কেন নিয়ে এসেছে, সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি, ওই যে তুমি তোমার অন্ধকার ঘর আলো করার জন্যে অসংখ্য জোনাকি খাঁচায় বন্দি করে রেখেছিলে, তাদের মুক্ত করে দেবার জন্যে। কে বলতে পারে ওই বন্দি খাঁচায়, তার মা ছিল কি না। ছিল কি না, তার বাবা, ভাই-বোন!’

    কুহকিনী উত্তর দিল, ‘ঠিক বলেছিস, এটা আমি ভয়ংকর অন্যায় করেছি। এমন অন্যায় কাজ আমি জীবনে আর করব না।’

    জোনাকি বলল, ‘কিন্তু, তুমি আমার জন্যে তো একটা ভালো কাজ করতে পারো!’

    কুহকিনী একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘তোর জন্যে আবার কী কাজ?’

    জোনাকি উত্তর দিল, ‘শুনেছি তুমি জাদুমন্ত্র জানো। সেই জাদুমন্ত্রে তুমি তো আমার সারা-গা জোনাকির মতো আলোয় উছলে দিতে পারো। তখন তো আমাকে কেউ আর কালো বলতে পারবে না। বলতে পারবে না, আমার নামটা বেমানান।’

    কুহকিনী উত্তর দিল, ‘শোন রে জোনাকি, তুই আমর মেয়ের মতো। তোকে সত্যি কথাটাই বলি, জাদুমন্ত্র বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। জাদুর নাম করে হাতের কারসাজিতে আমরা মানুষকে দু-টুকরো করে আবার জুড়ে দিতে পারি। ‘ফুস’ বলে চোখের পলকে, হাতের মুঠোয় রসগোল্লা এনে খাওয়াতে পারি। কিন্তু তোর গায়ের কালোকে মুছে দিতে পারি না।’

    ‘তা হলে!’ কেমন যেন হতাশ শোনাল মেয়েটার গলার স্বর।

    কুহকিনী বলল, ‘শোন মেয়ে, হতাশ হোস না। তোর মনে আছে দয়া-মায়া, বুকে ভালোবাসা। ওই ভালোবাসাই তো আলো রে। এমনটা ক-জনের থাকে! ওই আলোর রঙেই তুই সুন্দর। আর আমি কি নিষ্ঠুর দেখ, এই অন্ধকার মোছার জন্যে নিরীহ জোনাকিদের ধরে এনে খাঁচায় বন্দি করেছি। আমার মনে দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। ছি:! আর আমি কোনোদিনও অসংখ্য জোনাকি বন্দি করে আমার ঘর আলো করব না!’

    বলতে বলতে কুহকিনীর চোখ ছলছল করে উঠল। তারপর কী আশ্চর্য, ঠিক সেই মুহূর্তে চোখের পলকে কোত্থেকে আবার হাজার হাজার জোনাকি উড়ে এসে সেই অন্ধকার ঘরটা আলোয় উছলে দিল— সেটাই যেন এক জাদু। সেই আলোতে স্পষ্ট ভেসে উঠল কুহকিনীর মুখখানা। ভেসে উঠল চোখ দুটি। সে চোখ আর কটমটে নয়। চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে। আরও আশ্চর্য কী, সেই আকাশে উড়ন্ত জোনাকির ঝাঁক জঙ্গলের ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে আমাদের জোনাকিকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিল মাসির কাছে। মাসির চোখ তখন হারিয়ে যাওয়া জোনাকির জন্যে কান্নায় ভেজা। কিন্তু ছোট্ট মেয়ে জোনাকির মুখখানি হাসি-হাসি। সে মাসিকে দেখে হাসছে! হাসি-কান্নার সে এক মজার দৃশ্য!

    টীকা