ভূমিকা (দীনহীন)

সুমনকুমার দাশ

‘দীনহীন’ শব্দবন্ধটি বাউলগানের ভণিতায় আমরা প্রায়শই শুনতে পাই। দীনহীন রচিত গান বেশ জনপ্রিয়ও বটে। ‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম’[১]সহ তাঁর কিছু গান রীতিমতো আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে গত কয়েক দশক ধরে কিছু ব্যক্তি অন্যায্যভাবে দীনহীনের প্রকৃত নাম, ধাম ও পরিচিতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ বিতর্ক, সমালোচনা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

দীনহীনের[২] (১৮৫৪-১৯২০) বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামে। তাঁর আসল নাম শাহ মুনশি জহির উদ্দিন। দীনহীন নামে তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। দীনহীন শব্দের অর্থ অত্যন্ত দরিদ্র বা অতিশয় নিঃস্ব। বাউল বা ফকিরি গানে আলোচ্য পদকর্তা নিজেকে আড়াল করতে কিংবা বিনয় প্রকাশ করতে ‘দীনহীন’ নাম ধারণ করেছেন। মূলত শাহ মুনশি জহির উদ্দিনই ‘দীনহীন’ নামে গান লিখেছেন। ১৯৫৬ সালে দীনহীন সঙ্গীত[৩] প্রথম খণ্ড নামে তাঁর একটি গানের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ১৩৩টি গান স্থান পায়।

দীনহীন সঙ্গীত প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ ৩১ বছর পর ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে হবিগঞ্জের সুলতানসী হাবিলীর সৈয়দ হাসান ইমাম হোছেনী চিশতী[৪] তাঁর রচিত তরফ-এর ইতিকথা শীর্ষক গ্রন্থে জানান :

সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী সাহেব ‘দীনহীন’ ছদ্মনাম দিয়ে কয়েক হাজার আধ্যাত্মিক সংগীত রচনা করে গিয়েছেন। ‘দীনহীন’ শব্দটি সংগীত জগতে প্রথম প্রচলন করেন সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী সাহেব।

লেখকের উপর্যুক্ত তথ্যের পরই মূলত শুরু হয় দীনহীন-বিতর্ক। এর আগে যাঁরা স্নানঘাটের শাহ মুনশি জহির উদ্দিনকে দীনহীন অভিধায় চিহ্নিত করে কলম ধরেছিলেন, এঁদের মুষ্ঠিমেয় দু-একজন বোল পালটে সুলতানসীর সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীকে নতুনভাবে দীনহীন অভিধায় চিহ্নিত করতে লাগলেন। এতে করে তাঁরা মোটামুটি দীনহীন বিতর্ক উসকে দিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি করেন। এ প্রেক্ষাপটে তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত তাঁর হবিগঞ্জের মরমী সাধক বইয়ে লিখেছেন :

আমাদের মরমী সংগীতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সাধক সৈয়দ জহুরুল হোসেন (সাং-মধুপুর) তাঁর ২১টি গানে ‘দীনহীন জহুরে বলে’ উল্লেখ করেছেন (জাওয়াহীর বহি)। পুড়াসুন্দা নিবাসী কলমন্দর ফকির তিনিও দীনহীন ভণিতায় অনেক আধ্যাত্মিক গান লিখেছেন। তা ছাড়া আরও অনেকেই হয়তো এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তাই বলে কিন্তু তাঁরা ‘দীনহীন’ বলে পরিচিত নন। নিজ নিজ নামেই পরিচিত ও খ্যাত।
আমাদের মরমী আসরে ‘দীনহীন’ নামে এখনও পল্লি গ্রামবাসীর মনে যিনি আসন করে বসে আছেন, তিনি মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন মরহুম।

একইভাবে সুলতানসী হাবেলী থেকে ১৯৮০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত সৈয়দ গোলাম নবী কাদেরী চিশতী প্রণীত তত্ত্বসঙ্গীত শীর্ষক বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন :

দীনহীন সংগীত রচয়িতা মরহুম শাহ জহির উদ্দিন সাহেব মলাই মিয়া[৫] সাহেবের হস্তে মুরিদ হইয়া আমাদের পুরাতন বাড়িতেই আমার পিতামহের সঙ্গে তাহার জীবনের অধিকাংশ সময়ই অতিবাহিত করিয়া অন্তিম মুহূর্তে তাহার নিজ গ্রামে ইন্তেকাল ফরমান। আমাদের এখানে থাকাকালীন দাদা সাহেবের অনুপ্রেরণায় সংগীত রচনা আরম্ভ করেন। সংগীতের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন ও তত্ত্বমূলক কথা সংযোজন এবং সুরদান প্রভৃতিতে দাদা সাহেবের দান চির অক্ষয়। তাহাদের সময় সংগীতের পুস্তক প্রকাশ করিবার প্রয়োজন দেখা দেয় নাই। বহুদিন পর জহির উদ্দিন সাহেবের নাতি আবুল মিয়া নানান জায়গা হইতে তাহার পিতামহের রচিত সংগীতগুলি সংগ্রহ করিয়া ১৩৬৩ বাংলায় দীনহীন সঙ্গীত নামে একখানি বহি প্রকাশ করেন […]। তত্ত্বসঙ্গীত বইটিতে মোট ১২০টি গানের মধ্যে ৭২টি দীনহীনের গান রয়েছে।

১৯৮২ সালে অধ্যাপক মো. আসাদ্দর আলীর রচিত এবং সৈয়দ মোস্তফা কামাল[৬] সম্পাদিত সিলেটের মরমী সাহিত্যের অব্যাহত ধারা শীর্ষক স্মারক গ্রন্থে একইভাবে দীনহীনের প্রকৃত পরিচয়সহ ‘সাধক কবি দীনহীন ওরফে মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন’ শিরোনামে একটি লেখা মুদ্রিত হয়। এতে ‘সৈয়দ মোস্তাফা কামাল (মশাজান নিবাসী) সাহেবের বদৌলতে দীনহীনের ভণিতাযুক্ত একখানা ছেঁড়া গানের বই পাওয়ার প্রেক্ষিতে দীনহীন সঙ্গীত-এর একখানা গান ছাপানো হয়েছে। একই স্মারকগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছিল :

কে এই দীনহীন যিনি তাঁর প্রাণের কথাকে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে অগণিত মানুষকে আকুল করে গেছেন। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, দীনহীন ছদ্মনামের এই সুফি কবির প্রকৃত নাম মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন।

সৈয়দ মোস্তফা কামালের লেখা দীনহীন ঐতিহ্য উত্তরাধিকার শীর্ষক যে বইটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়, সেটির ‘পরিশিষ্ট’ বিভাগে হারুন আকবরের একটি লেখা মুদ্রিত হয়। সেখানে হারুন আকবর ‘দীনহীন : অহেতুক বির্তকের অবসান’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করেছেন :

[…] কাজীর বাড়ির কামলাও বিচার জানে। সে হিসাবে জহির উদ্দিনও সংগীত রচনা করে থাকতে পারেন। এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় দীনহীন রচনাবলী প্রথম খণ্ডের সম্পাদক সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতীর বক্তব্যেও। তিনি বলেন, ‘মুন্সি জহির উদ্দিন গান গাইতেন। সৈয়দ আব্দুনুর হোছেনী চিশতী (র.)-এর সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। হয়তো বা তিনি নিজেও কোনো কোনো গান রচনা করেছেন।’ এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় কোন গানগুলি তাঁর রচিত? এর কোনো জবাব সম্পাদকের বক্তব্যে নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে মনে হয় দীনহীন ভণিতাযুক্ত গানগুলি সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনীর রচিত হলেও ‘দীনহীন’ ভণিতার বাহিরের গানগুলি রচক হবেন মুন্সি জহির উদ্দিন।[৭] […]

২০১০ সালে দীনহীন রচনাবলী প্রথম খণ্ড শীর্ষক সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতীর সম্পাদনায় যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে সেটিতে দীনহীনের পরিচয় জানানো হয়েছে এভাবে :

[…] সৈয়দ সুলতানেরই অধঃস্তন বংশে ‘দীনহীন’ ভণিতায় যিনি অসংখ্য আধ্যাত্মগীতি, মুরছিয়া, নাত ও কছিদা রচনা করে গিয়েছেন তিনি হলেন সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী। তাঁর রচিত উর্দু ও ফারসি মুরছিয়ার পাণ্ডুলিপি মুরছিয়ায়ে হোছাইন আমাদের কাছে রক্ষিত আছে। […]।

কিন্তু সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী বর্ণিত ওই কথিত ‘দীনহীন’ ব্যক্তিটি যে সুলতানসীর ছিলেন না সেটা ওই সংকলনভুক্ত ৮ নম্বর গানটি পাঠেই বোঝা যায়। গানটির শেষ অন্তরা এ রকম : ‘বসতি ছিনান ঘাটে আমার ছিনান না হইল/ভবনদীর পাড়ে কেবল রে তোমার দীনহীন রইল।’ অর্থাৎ গীতিকার আফসোস প্রকাশ করছেন, স্নানঘাটে (আঞ্চলিক উচ্চারণ হচ্ছে : ছিনান ঘাট) বসতি সত্ত্বেও স্নান (আঞ্চলিক উচ্চারণ হচ্ছে : ছিনান) করতে পারছেন না। সে কারণেই ভবনদীর পাড় অর্থাৎ পৃথিবীর মায়াজালে বন্দি রয়ে গেছেন।

সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী দীনহীন রচনাবলী সম্পাদনার সূত্রে আরও লিখেছেন :

[…] যুগ-যুগান্তর ধরে ইতিহাসের প্রগতিকে একটির পর একটি অতীতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করে উন্নততর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রয়াস অব্যাহত গতিতে চলেছে। দীনহীন-এর ইতিহাসও এ রকম অনেক বিকৃতি ও বিভ্রান্তির অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। অতীতের এ বিভ্রান্তি থেকে দীনহীন-এর মূল ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজনীয়তা দারুণভাবে দেখা দেওয়ায় এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দীনহীনের ‘মূল ইতিহাস ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার’ করতে গিয়ে সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী একের পর এক নির্জলা অসত্য তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে ‘দীনহীন বিতর্ক’ উস্কে দিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে দীনহীন সঙ্গীত প্রকাশিত হওয়ার ৩১ বছর পর কেন নতুনভাবে ভিন্ন এক ব্যক্তিকে দীনহীন হিসেবে পরিচিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে? এটিই বরং খতিয়ে দেখার বিষয়।

শাহ মুনশি জহির উদ্দিন রচিত দীনহীন সঙ্গীত বইটির প্রকাশক হচ্ছেন শাহ আশরাফ উদ্দিন শামীম। ১৯৫৬ সালে বইটির প্রথম প্রকাশের পর তিনি ১৯৮৬ সালে এটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় প্রকাশক জানাচ্ছেন, […] হজরত শাহ মুন্সি জহির উদ্দিন (র.)-এর লিখা প্রায় পাঁচশত ফকিরি কালাম সম্বলিত একখানা বৃহৎ বহি ছিল। ঐ বহিখানা পরস্পর হস্তগত হইয়া কোথায় কাহার কাছে লোপ হইল তাহা ধরিতে পারিতেছি না।’

পাঁচশত গানের এই ‘বৃহৎ বহি’ মানে পাণ্ডুলিপিটি তাহলে কার কাছে? সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী মুরছিয়ায়ে হোছাইন শীর্ষক যে পাণ্ডুলিপিটি তাঁদের কাছে রক্ষিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, তাহলে এটিই কী সেই ‘পরস্পর হস্ত গত’ হওয়া পাণ্ডুলিপি, যে ‘বৃহৎ বহি’টির সন্ধান পাচ্ছেন না শাহ আশরাফ উদ্দিন শামীম। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে এ পাণ্ডুলিপিটি তাঁদের কাছে গেলই বা কীভাবে?

পাণ্ডুলিপিটি সুলতানসীতে যাওয়ার একাধিক কারণও রয়েছে। শাহ মুনশি জহির উদ্দিন ওরফে দীনহীন হবিগঞ্জের সুলতানসীর সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনীর মুরিদ ছিলেন। সে সুবাদেই দীনহীনের বিচরণক্ষেত্রের প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই ছিল সুলতানসী। সে সময়েই ঘনিষ্ঠতা হয় জহির উদ্দিনের মুর্শিদের ছেলে সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর সঙ্গে। যেহেতু মুর্শিদের কাছে জহির উদ্দিন ‘আত্মনিবেদন’ করেছেন, তাই তাঁর একমাত্র সহায়-সম্পত্তিতুল্য ‘গানের বহি’টিও তিনি মুর্শিদের বাড়িতেই রক্ষিত রেখেছেন বলে অনেকেই অনুমান করে থাকেন। গত বছর পঁচিশেক ধরে বিভিন্ন লেখা ও সংকলনে সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীকেও ‘দীনহীন’ অভিধায় পরিচিত করানো হচ্ছে। এখন মুরছিয়ায়ে হোছাইন পাণ্ডুলিপিটি প্রকৃতই কার প্রণীত—সে বিতর্ক কিন্তু রয়েই গেল।

পাণ্ডুলিপি-বিতর্কের অবসান তখনই ঘটে যখন শাহ মুনশি জহির উদ্দিনের ছেলে শাহ সুরুজ মিয়ার একটি কথোপকথন পাই তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল প্রণীত হবিগঞ্জের মরমী সাধক গ্রন্থে। সেখানে সুরুজ মিয়া জানাচ্ছেন :

মুন্সী [শাহ মুন্সি জহির উদ্দিন] সাহেবের দাফন কাজে মরহুমের পির বাড়ি [সুলতানসী হাবেলী] হইতে তিনজন পিরভাইসহ বহু মুরিদ, ভক্ত ও গ্রামবাসী যোগদান করেছিলেন। তখন আগন্তুক পির ভাইদের অনুরোধে ও গানগুলির বহুল প্রচারের স্বার্থে তাঁদের হাতে মুন্সি সাহেবের গানের খাতাটি তুলে দেওয়া হয়। আমরা তখন এর মর্ম বা গুরুত্ব বুঝতে পারি নাই। […] মূল বহিটি পির সাহেবের বাড়ি সুলতানসীতে থাকতে পারে।

.

শাহ সুরুজ মিয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যাচ্ছে, শাহ মুনশি জহির উদ্দিন প্রণীত একটি পাণ্ডুলিপি সুলতানসীতে রয়েছে। তাহলে কী সেই পাণ্ডুলিপিটির নতুন নামকরণ মুরছিয়ায়ে হোছাইন? এ ধারণার স্বপক্ষে তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইলের স্বচক্ষে দেখা একটি উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। মুহাম্মদ ইসমাইল হবিগঞ্জের মরমী সাধক বইয়ে সুলতানসীতে একটি পুরোনো পাণ্ডুলিপি দেখার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন এভাবে :

দীনহীন সঙ্গীতের একখানা বড় রকমের হাতের লেখা পুস্তক বাঁধানো অবস্থায় এনে আমাকে দেখালেন [সৈয়দ হাসান ইমাম হোছেনী চিশতী]। অত্যন্ত পুরাতন কাগজে বাঁশের কলম অথবা নিব-হেন্ডেলের কলমের লিখা ৩৭০ পৃষ্ঠার এই গানের বইটিতে অনুমানিক প্রায় পাঁচশত গান রয়েছে। গানগুলির শেষ পদে ‘দীনহীন বলে’ বা ‘দীনহীন পাগল’ অথবা ‘দীনহীন হইল’ ইত্যাদি লেখা আছে। কতকগুলি গান, গজল আরবি ভাষায় লেখা রয়েছে দেখতে পাই। বইটির কোথাও রচয়িতা হিসাবে কারো নাম লেখা আমার নজরে পড়ে নাই। তবে ২৩৩ পৃষ্ঠায় ২৯৪নং ‘হাবিব ভোল না অভাগীরে’ এই গানটির ডান পাশে ‘জহির উদ্দিন মুন্সি’ লেখা আছে।

এসব তথ্যাবলীতে জহির উদ্দিনই আসল দীনহীন হিসেবে প্রমাণিত হয়। তাই এটি নিয়ে অহেতুক বিতর্কের কোনো সুযোগও নেই। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে এখনও হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট নিবাসী শাহ মুনশি জহির উদ্দিন প্রণীত গানগুলোই দীনহীনের সংগীত হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে। তাঁর গান রচনা ও সাধনতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয়-আশয় প্রবীণদের কাছে এখনও জীবন্ত। হুট করে অন্য ‘দীনহীন’-এর উদয় জনমনে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।

সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী দীনহীন রচনাবলী প্রথম খণ্ড সম্পাদনা সূত্রে একটি গান উল্লেখপূর্বক সেটির বিশ্লেষণ করে সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীকে প্রকৃত ‘দীনহীন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে তাঁর এই বিশ্লেষণ মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়, সেটি তাঁর লেখার মধ্যেই কিছুটা আঁচ করা সম্ভব। তবে সে বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আমরা বরং পুরো গানটি শুরুতেই উদ্ধৃত করতে পারি :

কাঙালের বন্ধু ও, এক বিন্দু মোরে করো দান,
আমি আনন্দে আনন্দে দিব প্ৰাণ ॥

বন্ধু ও, চান্দ মুখে মধুর বাণী, জীবজন্তু যত প্ৰাণী,
সব জানে মহিমা তোমার।
আকাশেতে চন্দ্র ছিল, আদেশে দুই ভাগ হইল,
আবার মিলাইলায় করিয়া সন্ধান, কাঙালের বন্ধু ও ॥

বন্ধু ও, তুমি নয়ন তুইলে চাও যার পানে,
মরা হইলে বাঁচে প্রাণে, ভেদ বিধি তাহারই প্রমাণ।
তোমার করুণা বলে, মৃত্তিকায় মানুষ সৃজিলে
ওই মানুষে মানুষের দেহা প্রাণ, কাঙালের বন্ধু ও ॥

বন্ধু ও, কহে পাগল দীনহীনে, তোমার দয়া বিতরণে,
হইল প্রকাশ এই ত্রিভুবন।
আদি অন্তে তুমি একা, গোপনে জাহিরে দেখা,
তব পঞ্চগুণে টানে দেহা প্রাণ, কাঙালের বন্ধু ও ॥

উল্লিখিত গানটির শেষ অন্তরার তৃতীয় পঙ্ক্তিটি পরিবর্তন করে সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী কর্তৃক সম্পাদিত দীনহীন রচনাবলী বইয়ে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে : ‘আদি অন্তে তুমি একা, গোপনে জহিরের দেখা/পঞ্চগুণে টানে দেহা প্রাণ, কাঙ্গালের বন্ধু ও।।[৮] এইভাবে গানটি উল্লেখ করে সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী লিখেছেন :

[…] এই পদটিতে দুটি নাম পাওয়া যায়, একটি দীনহীন এবং অন্যটি জহির। একই গানের একই পদে একজনেরই দুটি নাম অর্থাৎ একবার ছদ্মনাম আর একবার নিজ নাম কেউ কোন সময়েই দেননি, এ রকম কোন সময়েই হয় না এবং হতে পারেও না। তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এ গানের এই পদে দুইটি নামে দুইটি পৃথক সত্তার অবস্থান নির্দেশ করছে। সবশেষে এইটুকু আরজ করতে চাই। ঘটনা এবং বিষয়ের যথাযথ প্রেক্ষিতে এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পদটিতে একটি ছদ্মনাম এবং আর একটি নিজ নাম অর্থাৎ একটি নাম দীনহীন এবং আর একটি নাম জহির। এ গানের এ পদটিতেই সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী (র.) নিজেই এর চূড়ান্ত ফায়সালা দিয়েছেন যে দীনহীন সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী (র.) এর সংগীত জগতের ছদ্মনাম এবং জহির শব্দের অর্থ মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন সাহেব।

দীনহীন রচিত ‘কাঙালের বন্ধু ও’ শীর্ষক গানটির শেষ অন্তরা ভুলভাবে উদ্ধৃত করে বিশ্লেষণ করেছেন সৈয়দ হাসান ইমাম সাহেব। সৃষ্টিকর্তার বন্দনাসূচক এ গানটির শেষ অন্তরায় প্রকৃতপক্ষে গীতিকার ‘আদি অন্তে তুমি একা’ বলে সৃষ্টিকর্তাকে এবং ‘গোপনে জাহিরে দেখা’ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার গোপনে ও প্রকাশ্যে অবস্থানে থাকার বিষয় বুঝিয়েছেন।

সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী আরও লিখেছেন :

মুন্সি জহির উদ্দিন গান গাইতেন। জনাব হোছেনী চিশতী (র.)-এর সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্বও ছিল। হজরত বা তিনি নিজেও কোনো কোনো গান রচনা করছেন। এমনকী হোছেনী চিশতী (র.) সাহেবের ‘দীনহীন’ ভণিতার পাশে তিনি নিজের নামও যোগ করে নিতে পারেন। এর অর্থ এটা নয় যে দীনহীন জহির উদ্দিন।

সৈয়দ হাসান ইমাম তাঁর লেখায় একদিকে শাহ মুনশি জহির উদ্দিনের গান লেখার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। আবার অন্যদিকে আব্দুন্নুর চিশতীর গানে মুনশি জহির উদ্দিন ‘নিজের নামও যোগ করে নিতে পারেন’ বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁর এই সংশয়ের সত্যতা কতটুকু? প্রমাণই বা কী? এটা নিছক তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত, এ সম্পর্কিত কোনো সঠিক তথ্য-উপাত্ত তিনি তাঁর লেখায় পরিস্ফুট করতে পারেননি। ফলে এটিই ‘দীনহীন’ বিভ্রান্তি দূরীকরণের শেষকথা, তা বলা যাবে না। বরং এ ধরনের প্রচারণা দীনহীনের সঠিক পরিচিতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক রূপে গণ্য করা যায়।

দীনহীন বিতর্কের প্রকৃত রহস্য খুঁজে বের করার জন্য হবিগঞ্জের মরমী সাধক গ্রন্থের লেখক তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল ১৯৮৯ সালে সরেজমিনে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সে সময় তরফদারের কাছে হবিগঞ্জের প্রখ্যাত গবেষক দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা বলেছিলেন, ‘আমার সত্তর বৎসর বয়সে লোকতত্ত্বের যে গবেষণা করেছি, আমাদের মরমী সংগীতে দীনহীন সঙ্গীত- এর রচয়িতা মুন্সি জহির উদ্দিন বলেই জেনেছি। এছাড়া তরফদার ইসমাইলকে অভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন তৎকালীন ৮০ বছর বয়সী মুড়ারবন্দ দরগা শরীফের খাদেম সৈয়দ আহমদ পির, শাহ মুনশি জহির উদ্দিনের ছেলে তৎকালীন নব্বই- ঊর্ধ্ব শাহ সুরুজ মিয়া এবং তত্ত্বসঙ্গীত বইয়ের প্রণেতা, সুলতানসী হাবেলীর বাসিন্দা সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর ভ্রাতৃপুত্র সৈয়দ গোলাম নবী হোছেন চিশতী ওরফে দুলাল মিয়াও।

সিলেট অঞ্চলের হবিগঞ্জের সুলতানসী, বালাগঞ্জ উপজেলার ওসমানীনগর, ব্রাহ্মণগাঁও, এওলাতৈল, নিজ করনসি পূর্ব পাড়া, কামারগাঁও, কুনাপাড়া, ইছুরপুর সাববাড়ি, মাটিয়াল আওলি, বেড়ায়ায়, মাঝপাড়া, গজিয়া, মোতিয়ারগাঁও, থসোরতৈল, জয়পুর, চাতোলপাড়া, বড়ই শিবপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মহররম উৎসবে দীনহীন রচিত অসংখ্য গান পরিবেশিত হয়। এসব আসরের অসংখ্য ব্যক্তিদের কাছে দীনহীনের পরিচিতি জানতে চাইলে অনেকেই প্রকৃত তথ্য দিতে পারেন নি। তবে অনেকেই দীনহীনের বাড়ি ‘স্নানঘাট’’ আবার দু-একজন ‘সুলতানসী’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী কোনো গান রচনা করেন নি—সেটা আমরা বলছি না। তবে দীনহীনের নামে প্রচলিত গানগুলো যে তাঁর রচিত নয়, সেটা অন্তত বলা যায়। আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী মুরছিয়া, গজল, মারফতি গান রচনা করে থাকতে পারেন, এ নিয়ে আমাদের কোনো দ্বিধাও নেই। কারণ তিনি সে রকম ঐতিহ্যবাহী পিরবেষ্টিত পরিবেশেই বড়ো হয়েছেন। তবে ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত শাহ মুনশি জহির উদ্দিন প্রণীত দীনহীন সঙ্গীত বইয়ের গানগুলো আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর নামে চালিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা বা কৌশল চলছে সেটা নিঃসন্দেহে ঘোরতর অন্যায়। বলা যায়—অনেকটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে দীনহীনের পরিচিতি ভিন্ন দিকে নিতে ক্রমশ বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বাউলগানের প্রকৃত ইতিহাস রচনার স্বার্থে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন দূরীভপূত করা উচিত।

সুমনকুমার দাশ

.

টীকা

১.

‘আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম’ এটির পঙ্ক্তিগুলো এ রকম :

আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম তোমার সনে
একেলা পাইয়াছি তরে এই নিগুর বনে
আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম ॥

একেলা পাইয়াছি হেথা, পলাইয়া যাবে কোথা
ঘিরিয়া লইব আমার সব সখিগণে
আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম ॥

আতর গোলাপও চন্দন মারো বন্দের গায়ে
ছিটাইয়া দেও চোয়া চন্দন ওই রাঙা চরণে
আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম ॥

দীনহীন আর যাব কোথায় বন্ধুর চরণ বিহনে
রাঙাচরণ মাথায় নিয়ে কান্দে দীনহীনে
আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম ॥

২. হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের ফকিরবাড়িতে দীনহীন অর্থাৎ শাহ মুনশি জহির উদ্দিন জন্মগ্রহণ করেন। শাহ করম আলী নামে তাঁদের এক পূর্বপুরুষ পিরস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য লোক তাঁর মুরিদান ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি শিষ্যদের বাড়ি ঘুরে বেড়াতেন। একবার ঘুরতে ঘুরতে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লা মহকুমায় যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমান কুমিল্লা জেলার জগন্নাথপুর গ্রামে তাঁর নামখচিত একটি সমাধিও রয়েছে। এসব কারণেই হবিগঞ্জের স্নানঘাটের তাঁর গ্রামের বাড়িটি ‘ফকিরবাড়ি’ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি পায়। শাহ করম আলীর অপর ভাই শাহ বদর উদ্দিন স্নানঘাটেই বসবাস করতেন। শাহ বদর উদ্দিনের ছিল এক ছেলে, তাঁর নাম শাহ সফর উদ্দিন। শাহ সফর উদ্দিনের দুই ছেলে জন্ম নেয়। এঁরা হচ্ছেন যথাক্রমে শাহ আরব উদ্দিন ও শাহ মুনশি জহির উদ্দিন। এই শাহ মুনশি জহির উদ্দিনই দীনহীন নামে গান রচনা করে পরিচিতি পান। দীনহীনের পাঁচ ছেলে ও তিনি মেয়ে ছিল, এঁরা প্রত্যেকেই এখন প্রয়াত। তাঁর ছেলেদের নাম হচ্ছে : শাহ গোলাম নবী, শাহ গোলাম হায়দর, শাহ গোলাম হোসেন, শাহ চান মিয়া ও শাহ সুরুজ মিয়া।

৩. গানের সংকলনটির প্রকাশকের ঠিকানা ছিল এ রকম : ‘প্রকাশক—শাহ গোলাম মরতুজা উপে আবু মিয়া, সাং স্নানঘাট, পো. পুটিজুরী, হবিগঞ্জ, সিলেট, পূর্ব পাকিস্তান।’ গ্রন্থটির প্রকাশক গোলাম মোর্তুজা ওরফে আবুল মিয়া ছিলেন সম্পর্কে দীনহীনের নাতি। এই সংস্করণে প্রকাশক গোলাম মোর্তুজারও তিনটি গান সংকলনভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে এটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ওই পরিবারেরই সদস্য শাহ আশরাফ উদ্দিন শামীম। দ্বিতীয় সংস্করণে দীনহীনের জনৈক এক ভক্তের কাছ থেকে আরও একটি গান উদ্ধার করে সেটিও সংকলনভুক্ত করা হয়। গোলাম মোর্তুজার তিনটি ছাড়া সর্বশেষ প্রকাশিত সংস্করণ অনুযায়ী দীনহীনের গানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৪টি।

৪. সৈয়দ হাসান ইমাম হোছেনী চিশতী হচ্ছেন সুলতানসীর সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর অধস্তন পুরুষ। তাঁর সম্পাদনায় ১৪১১ হিজরীর ১লা মহররম (১৯৯০ ইংরেজি) দীনহীন রচনাবলী প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এ গানের সংকলনটির প্রকাশক হিসেবে নাম উল্লেখ ছিল : ‘মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ, “দরবার-এ-মোস্তাফা”, সুলতানসী হাবিলী, ডাক—সুঘর, জেলা—হবিগঞ্জ-৩৩০১’। বইটির মূল্য ছিল সাদা প্রিন্ট ৬০ টাকা এবং নিউজ প্রিন্ট ৫০ টাকা। পরে ঢাকার রোদেলা প্রকাশনী থেকে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় ২০১০ সালের ২৬ মার্চ।

৫. মলাই মিয়াব পুরো নাম সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী। তিনি ছিলেন সুলতানসী হাবেলীর গদীনশীন এবং বেলায়াতের ভারপ্রাপ্ত পির। মলাই মিয়ার সঙ্গে স্নানঘাটের শাহ মুনশি জহির উদ্দিনের সাক্ষাতের বিষয় সম্পর্কে তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল তাঁর হবিগঞ্জের মরমী সাধক গ্রন্থে লিখেছেন :

বড়ো ছেলে শাহ আরব উদ্দিনকে সাংসারিক ঝামেলার মধ্যে আবদ্ধ করে পিতা ছোটো ছেলে শাহ জহির উদ্দিনকে লেখাপড়া করতে দিলেন। পাঠশালায় বাংলা পাঠ শেষ করে ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চঞ্চল মতিগতির জন্য মাদ্রাসা পাঠে মনোযোগ কম দেখে পিতা একদিন শাসন করলে মন খারাপ করে হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হন। ঘুরাফিরা করে সুলতানসী গ্রামে আসেন।

মহররমের জারি মর্সিয়ার প্রচলন ছিল সুলতানসীতে। পাক-পাঞ্জাতনের এস্কমত লাভে মহরম চান্দে গম (দুঃখ ক্ষোভ) করা হয়ে থাকে। এমনই এক অনুষ্ঠানে যুবক জহির উদ্দিন অংশগ্রহণ করে হজরত ইমাম হাসান-হোসেন (রা.) সাহেবের মহব্বতে জারি মর্সিয়া পরিবেশনে শরিক হন। তখন সুলতানসী হাবেলীর গদীনশীল এবং বেলায়েতের ভারপ্রাপ্ত পির ছিলেন সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী ওরফে মলাই মিয়া সাহেব। যুবকটির সুমধুর কণ্ঠ, আবেগ, সুরবোধ ও উপস্থাপনের ভঙ্গি দেখে পির সাহেব অভিভূত হন এবং তাঁর পরিচয় গ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যে সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী পির সাহেবের অধ্যাত্মবাদ ও কামালিয়াতের নিদর্শন পেয়ে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় জগতের পথ প্রদর্শক হিসাবে তাঁর নিকট বয়াত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তরিকতের একজন আবেগে আপ্লুত ভক্তের পরিচয় পেয়ে সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী ওরফে মলাই মিয়া সাহেব তাঁকে মুরিদ করেন। মুরিদ হয়ে খোদার রাস্তায় পিরের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেন। মুরিদ জহির উদ্দিন স্নানঘাট ছেড়ে সুলতানসী পির সাহেবের সান্নিধ্যে বাস করতে লাগলেন আর মুর্শিদের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। মুরিদ জহির উদ্দিন তাঁর মঞ্জিল মকছুদে পৌঁছার জন্য মুর্শিদের এজাজ ব্যতীত এক পা-ও অগ্রসর হন নাই।

৬. সিলেটের মরমী সাহিত্যের অব্যাহত ধারা স্মারক-গ্রন্থে সৈয়দ মোস্তফা কামাল ‘অনুসন্ধান’পূর্বক স্নানঘাটের শাহ মুনশি জহির উদ্দিনকে দীনহীন হিসেবে স্বীকার করে নিলেও পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালে তিনি সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী সম্পাদিত দীনহীন রচনাবলী-এর ভূমিকায় আগের মতামত পালটে লিখেছেন :

আমি যখন রাজারবাজার সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতায় কর্মরত তখন দীনহীন সঙ্গীত নামে একটি চটি গানের বই আমার হাতে আসে। বইটি এমন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল যে, এর ভূমিকা অংশের সবকিছু পাঠোদ্ধার করাও অসম্ভব ছিল। যদিও ইতিপূর্বে আমি ‘দীনহীন’ ভনিতাযুক্ত মরমী সংগীতের সাথে যৎকিঞ্চিত পরিচিত ছিলাম কিন্তু এই ‘দীনহীন-ছদ্মনামের আজ্বালে যে কোনো মরমি কবি রয়েছেন এ সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য আমার কাছে ছিল না এবং তা অনুসন্ধান করে জানারও কোনো প্রয়োজন হয় নাই। পরবর্তী পর্যায়ে যখন এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার, পর্যালোচনার প্রয়োজন হয় এবং সৈয়দ হাসান ইমাম হোছেনী চিশতীর তরফ-এর ইতিকথা গ্রন্থটি আমার হাতে আসে তখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, দীনহীন সঙ্গীত রচয়িতা মহাকবি সৈয়দ সুলতানের অধঃস্তন পুরুষ মরহুম সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী (র.) ওরফে ছগীর মিয়া সাহেব। যাঁর মাধ্যমেই দীনহীন ভণিতাযুক্ত মরমী সংগীত ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

সৈয়দ মোস্তফা কামালের উপর্যুক্ত কথাগুলো লেখার আট বছর আগের করা বিশ্লেষণের বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তখন সিলেটের মরমী সাহিত্যের অব্যাহত ধারা সম্পাদনা সূত্রে তাঁরা অভিমত দিয়েছিলেন, ‘অনুসন্ধান করে জানা গেছে, দীনহীন ছদ্মনামের এই সুফি কবির প্রকৃত নাম মুন্সি শাহ জহির উদ্দিন।’ আট বছর আগে- পরের কোনটা ঠিক আর কোনটা যে বেঠিক—সে বিভ্রান্তিও কিন্তু ওই দুটি গ্রন্থের পাঠকদের কাছে খটকা থেকেই যাবে। তবে পাঠকদের সেই খটকা দূরীকরণের জন্যই সৈয়দ মোস্তাফা কামাল ২০০০ সালের ২১ আগস্ট তাঁর লেখা দীনহীন ঐতিহ্য উত্তরাধিকার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ […] ইদানিং কেউ কেউ তাদের কোনো কোনো লেখায় দীনহীন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে যেয়ে আমার আগের একটি লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে সঠিক তথ্য উদ্ধার করে আমি অনেক লেখা লিখেছি, এগুলোকে বেমালুম চেপে যান। […]’ এরপর ওই গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীই যে ‘দীনহীন’ তার স্বপক্ষে চারটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :

ক. বাল্যকালেই মুন্সি জহির উদ্দিন তাঁর নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে সুলতানসী হাবেলীতে চলে আসেন এবং জীবনের অধিকাংশ সময় সেখানেই অতিবাহিত করেন।

খ. তিনি [মুন্সি জহির উদ্দিন] জীবিতকালে কিংবা তাঁর কোনো পুত্রও তাঁর নামে কোনো গ্ৰন্থ প্রকাশ করেন নাই। তাঁর বাড়িতেও কোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নাই। তাঁর মৃত্যুর অনেক পর তাঁর জনৈক নাতি লোকমুখে শোনা কিছু গায়কের কাছ থেকে কয়েকটি গান সংগ্রহ করে এবং নিজের কিছু গানসহ দীনহীন সঙ্গীত নামে প্রকাশ করেন।

গ. একজন সংগীত রচয়িতার সংগীত অন্যজনের নামে প্রচারিত ও প্রকাশিত হওয়ার অসংখ্য প্রমাণ ওই যুগেও ছিল আর এখনও আছে। কারণ মূল পদকর্তার বা পির কেবলার রচিত সংগীত তাঁর ভক্তজনরা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে গেয়ে থাকে। অনেকের কাছে গানের খাতাও (হাতের লেখা) ছিল এবং আছে। উল্লেখ করা আবশ্যক, অধিকাংশ মরমী সংগীতই রচিত হয়েছে মূল পদকর্তা ও ভক্তজন পরিমণ্ডলের সংগীতের আসরে। দীনহীন সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী ও তাঁর পিতার দরবারে মুন্সি জহির উদ্দিন ছিলেন একজন মুর্শিদ অনুগত ভক্তজন।

ঘ. সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর পরিবারটাই গান-গজল-জারি-মুর্সিয়া রচনার জন্য দেশ- বিদেশে বিশেষভাবে পরিচিত।

উপর্যুক্ত চারটি তথ্যের মাধ্যমে সৈয়দ মোস্তফা কামাল সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীই যে ‘দীনহীন’, সে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছেন। আমাদের মনে হয়, এটি অত্যন্ত খোড়া যুক্তি। শাহ মুনশি জহির উদ্দিন সুলতানসীতে অবস্থান করেছেন বলেই এই গানগুলো তাঁর নয়—এটি কোনো বিবেচনাপ্রসূত কথা হতে পারে না। এছাড়া জহির উদ্দিনের জীবিতাবস্থায় কিংবা তাঁর কোনো পুত্র গানের সংকলনটি প্রকাশ করেননি বলেই যে, এ গান তাঁর লেখা নয় সেটিও হতে পারে না। লালনের গান তো তাঁর জীবদ্দশায় বের হওয়ার তেমন কোনো নজির নেই। এছাড়া আলোচনার খাতিরে যদি বলি, সৈয়দ আব্দুন্নুরের জীবদ্দশায় কিংবা তাঁর কোনো পুত্রও তো সেই গানের সংকলন প্রকাশ করেননি। বরং সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর উত্তরাধিকাররা শাহ মুনশি জহির উদ্দিনের দীনহীন সঙ্গীত প্রকাশের ৩১ বছর পর কেন সংকলনটি প্রকাশ করলেন? সেটা কোন উদ্দেশ্যে-এ নিয়ে তো কেউ কেউ প্রশ্নও তুলতেই পারে !

৭. সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতীর পূর্বপুরুষেরা সুলতানীর মহররম উৎসবের প্রচলনকারী। এঁদের পারিবারিক ঐতিহ্যের বিষয়টি সুবিদিত। এক্ষেত্রে ধারণা করা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষ ও উত্তরাধিকাররা জারি ও মর্সিয়া ধরনের গান রচনা করে থাকতে পারেন। কিন্তু দীনহীন ভণিতাযুক্ত গানগুলো শাহ মুনশি জহির উদ্দিনের রচিত বলেই অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।

৮. এ গানটির পদের সত্যতা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে একটি জাল ও বানানো গল্পের মিথ্যে প্রচারণাও চালানো হয় বলে একাধিক ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন। ‘ভুল গল্প হিসেবে প্রচারিত’ এ সম্পর্কিত একটি তথ্য সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী সম্পাদিত দীনহীন রচনাবলী শীর্ষক বইয়েও পাওয়া যায়। এটি এ রকম :

সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী চিশতী (র.)-এর কাছে মুরিদ হওয়ার জন্য তদীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী সাহেব যখন আবদার জানালেন তখন সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী চিশতী (র.) তদীয় খাদেম ছদই উল্লার কাছে বললেন, “মিয়াকে বল হালাল রুজি করে কিছু নযরানা তৈরি করতে।’ এরপর সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী সাহেব জামা সেলাই, টুপি সেলাই ইত্যাদি করে এক বছরে দশ টাকা যোগাড় করে পিতার কাছে জানালেন। ইতোপূর্বেই মুন্সি জহির উদ্দিন সাহেব স্নানঘাট থেকে বাড়ি-ঘর, সংসার সবকিছু ছেড়ে সুলতানসীতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপর সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী চিশতী (র.) সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী সাহেবকে নিয়ে মসজিদে গেলেন। মুন্সি জহির উদ্দিন সাহেব ওই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার জন্য গোপনে গিয়ে মসজিদের দরজার ফাঁকে লুকিয়ে ছিলেন। বয়াত গ্রহণ করার কাজ শেষ করে তিনি মুন্সি জহির উদ্দিন সাহেবকে লুকিয়ে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। মুন্সি জহির উদ্দিন সাহেবও তাঁর কাছে মুরিদ হওয়ার বাসনা আরজ করলে তাঁকেও তিনি মুরিদ করলেন। এরপর সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী সাহেব কয়েকদিন যাবত এক ‘হাল’-এর মধ্যে নীরবে কাটালেন এবং চিন্তা করলেন যে, এই ঘটনাটিকে তিনি একটি সংগীতে ধরে রাখবেন কিন্তু তাঁর নিজের নাম না লিখে একটি ছদ্মনাম দিয়ে লিখবেন। কিন্তু ছদ্মনামটি কি হবে? শেষ পর্যন্ত তাঁর মনে আসলো একটি শব্দ যার চাইতে বিনয় এবং নম্র আর কোনো শব্দ বাংলাতে নেই। তা হলো ‘দীনহীন’। কিন্তু পিরের ইজাজতের প্রয়োজন। সে জন্য তিনি তাঁর পিতা এবং পির সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী (র.)-এর কাছে আরজ করলেন যে, এই ‘দীনহীন’ ছদ্মনামে তিনি আধ্যাত্মিক সংগীত রচনা করতে চান। সৈয়দ আবদুর রহিম হোছেনী চিশতী (র.) বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, এই ছদ্মনামে সংগীত রচনা করতে পার।’ সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী সাহেব গান রচনা করতে আরম্ভ করলেন এবং এই দীনহীন ছদ্মনাম দিয়ে তাঁর জীবনের প্রথম ঘটনাটির ইঙ্গিত দিয়ে জীবনের প্রথম আধ্যাত্মিক সংগীত রচনা করলেন।

যদিও উপর্যুক্ত লেখায় বলা হয়েছে, দীনহীন ভণিতায় সৈয়দ আব্দুন্নুর হোছেনী চিশতী ‘আধ্যাত্মিক সংগীত রচনার আরজ’ তাঁর পিরের কাছে করেছেন। কিন্তু তাঁর গান পাঠে কিন্তু সেটা মনে হয়নি। কারণ এসব গান যেমন পির-মুর্শিদের বন্দনাসূচক রয়েছে, তেমনি অসংখ্য প্রেম-বিচ্ছেদের গানও রয়েছে।

.

তথ্যসূত্র

১. মুন্সী শাহ জহির উদ্দিন, দীনহীন সঙ্গীত ১ম খণ্ড (হবিগঞ্জ : স্নানঘাট, ১৯৮৬ ইংরেজি দ্বি. সং.);

২. তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল, হবিগঞ্জের মরমী সাধক (হবিগঞ্জ : ১৯৮৯);

৩. সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী (সম্পা.), দীনহীন রচনাবলী ১ম খণ্ড (১০-১২ হবিগঞ্জ : দরবার-এ-মোস্তাফা, ১৯৯০);

৪. সৈয়দ হাসান ইমাম হোছাইনী চিশতী (সম্পা.), দীনহীন রচনাবলী ১ম খণ্ড (ঢাকা : রোদেলা প্রকাশনী, ২০১০);

৫. সুমনকুমার দাশ, বাংলাদেশের বাউল-ফকির : পরিচিতি ও গান (ঢাকা : অন্বেষা প্রকাশন, ২০১২)।

অধ্যায় ১ / ২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন