পরিক্রমা – ১

শক্তিপদ রাজগুরু

জন্মের প্রথম লগ্নে মানুষ এই পৃথিবীতে আসে—আর সেই দিন থেকেই শুরু হয় তার পথচলা। জীবনের প্রথম দিন থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি তার এই পরিক্রমা চলে প্রতিনিয়ত। 

অন্তহীন এই পথ চলার শেষ হয় তার জীবন নাট্যের শেষ দৃশ্যে। জীবন মঞ্চে যবনিকা পড়ে—তারও পথ পরিক্রমা শেষ হয়। 

এই পথচলার মধ্য দিয়েই ঘটে মানুষের মানসিক রূপান্তর, ঘটে তার চেতনার উন্মেষ। পৃথিবীর পথে, জীবনের পাঠশালায়, প্রতি প্রত্যহের পাঠ তার মানসিক সম্পদকে বাড়িয়ে তোলে, জীবনের একটা ছন্দ ফুটে ওঠে এই চলার মাধ্যমে। 

গতিই জীবন, গতিপথে ধ্বনিত হয় জীবনের বহু সুর, বহু বৈচিত্র্য। তাই প্রয়োজন হয় এই পরিক্রমার। 

জীবনভোর এই পরিক্রমার একটি খন্ডাংশকে নিয়েই এই কথা প্রসঙ্গ। এই খন্ডাংশগুলো জীবনই। মানুষের ইতিহাসেরই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সভ্যতা-ধর্ম-চেতনা-অনুভূতি-ভবিষ্যৎ চিন্তা সবকিছুই এই ধারাতেই চলে। 

তাই একে এড়ানোও সম্ভব নয়। 

এই চেতনা আমাদের জীবনে নিশ্বাস বায়ুর মতো মিশিয়ে গেছে। 

কথাটা বলে ভুবন ঘোষ। 

ভুবন ঘোষকে এই অঞ্চলের বহু মানুষ এককথায়—এক ডাকে চেনে। বিচিত্র ধরনের মানুষই। সাধারণ মানুষের হিসাবের সঙ্গে ওর জীবনযাত্রা—মতবাদ এর কোনো হিসাবই মেলে না। 

ভুবনবাবুর অতীতের ইতিহাস একটা অবশ্য আছে। তিনি ছিলেন বহরমপুর কলেজের নামকরা বাংলার অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন।

চৈতন্য দেবের আবির্ভাব, তাঁর ভাবধারা বিশেষ করে ভুবনবাবুকে অনুপ্রাণিত করেছিল, ক্রমশ চৈতন্য চরিতামৃত-চৈতন্য ভাগবত—এসব তো পড়েনই, সেই সঙ্গে বৈষ্ণব মহাজনদের রচনা, ভক্তিবিনোদ রূপ সনাতন গোস্বামী প্রভৃতির রচনাও তাঁকে ভগবত পাঠে উৎসাহিত করে। 

ক্রমশ ভুবনবাবু যেন এক রত্ন খনির সন্ধান পান ওই অফুরান বৈষ্ণব সাহিত্যের মধ্যে, যত পড়েন ততই আকৃষ্ট হতে থাকেন। 

কলেজে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যের একনিষ্ঠ ছাত্রও হয়ে ওঠেন। কলেজের অধ্যাপনা, নিজের পড়াশোনা-গবেষণা ছাড়াও সংসারের দিকেও নজর দিতে হয় ভুবনবাবুকে। 

বহরমপুরেই সপরিবারে থাকেন ভুবনবাবু, তবু তিনি গ্রামের বাড়িতেও আসেন, এখানে তাঁদের পৈতৃক জমিজমা কিছু এখনও রয়েছে, আর রয়েছে তাঁর পিতামহের প্রতিষ্ঠিত মদন মোহন বিগ্ৰহ 

এই অঞ্চলের এককালে বনেদি জমিদার ছিলেন ভুবনবাবুর পূর্বপুরুষ। জমিদারির অঙ্গ হিসাবে ছিল এই মদনমোহন বিগ্রহের সেবা পূজাও। 

এখন জমিদারি চলে গেছে, তবু ভুবনবাবুর মতো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি দেবসেবার কোনো কার্পণ্য করেননি। 

ভুবনবাবুর জীবনে হঠাৎ একটা চরম বিপদই ঘনিয়ে এলো। আর এত বড় বিপর্যয় এলো এতটুকু জানান না দিয়ে—একেবারে অতর্কিতে। 

দু’দিনের এনকেফেলাইটিস রোগে ভুগে তাঁর একমাত্র সন্তান মারা গেল, ঠিকমতো চিকিৎসা করানোর সময়ও পাননি, ডাক্তাররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। এই চরম বিপদে ভুবনবাবুর স্ত্রী একেবারে ভেঙে পড়লেন। ভুবনবাবু পন্ডিত ব্যক্তি, চিরকাল ধর্ম পথে থেকেছেন, জীবনের অনিত্যতাকে অনুভব করার চেষ্টাও করেছেন, তাই এতবড় শোকটা কিছুটা সামলান, কিন্তু তাঁর স্ত্রী এই আঘাতে একেবারে ভেঙে পড়েন। 

নানা ব্যাধিও জোটে। 

চিকিৎসার চেষ্টাও হয়, কিন্তু তেমন কোনো ফলই হয় না। কয়েক মাস ভুগে ভদ্রমহিলা ও চলে গেলেন। ভুবনবাবু এতবড় সংসারে পড়ে রইলেন একা—স্ত্রী-পুত্রও চলে গেল। 

এর কিছুদিন পরই ভুবনবাবু কলেজ থেকে অবসর নিলেন। বন্ধু-বান্ধবরা বলেন,

—সময় কাটবে কী করে? এখানে থেকে কিছু ছাত্র পড়াও তবু একটা কাজের মধ্যে থাকবে, সময় কেটে যাবে, নাহলে বাঁচবে কী করে? 

ভুবনবাবু অবশ্য এ নিয়ে আগেই ভেবেছেন। 

স্ত্রী-পুত্র চলে যাবার পর তার মনেও জেগেছিল একটা নিঃস্তব্ধতার হাহাকার। নিজেকে মনে হয়েছিল একক—নিঃসঙ্গ একটি প্রাণী। এই জগতে আর তার করার কিছুই নেই। 

কিন্তু মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সেই দুই বিঘা জমির কয়েকটা লাইন। 

—মনে ভাবিলাম, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে, 

তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দু বিঘার পরিবর্তে। 

ভুবনবাবুর মনে হয় ঈশ্বর যেন তাঁকে ওই স্ত্রী-পুত্রকে কেড়ে নিয়ে সংসারের কঠিন আবর্ত থেকে মুক্তিই দিয়েছেন। ওই দুজনকে নিয়ে সীমিত পরিসরে বাঁচার পরিবর্তে বহুজনকে নিয়ে বাঁচার পথই দেখিয়েছেন। 

ভুবনবাবু এর পরই বহরমপুর থেকে নিজের বাড়ি কৃষ্ণনগর অঞ্চলেই এসে বসেন। কৃষ্ণনগরের লাগোয়া তাঁর গ্রাম—সেখানেই এবার পূজাপাঠ আর পড়াশোনার মাঝেই ডুবে যান তিনি। 

ক্রমশ ওই বৈষ্ণবশাস্ত্র পাঠ তাঁর জীবনচর্যাকেই বদলে দেয়। 

নাটমন্দিরের একপাশে বসে তিনি ভাগবত পাঠ না হয় চৈতন্যচরিতামৃত পাঠ করেন, কোনোদিন গীতা পাঠও করেন। আর সারা গ্রামের মানুষ আসে তাঁর কাছে। ওই পাঠ—শাস্ত্ৰ আলোচনার মধ্যে তারাও যেন নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পান। 

ভুবনবাবু ক্রমশ এই অঞ্চলের বহু মানুষের মনে একটি নতুন চেতনার সাড়া এনেছেন। যার জন্য বহুজনই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। এখন ভুবনবাবু সাধন ভজন আর পূজা পাঠ নিয়ে এই মন্দিরেই থাকেন বেশি সময়। বৈকালে সারা এলাকার বহু ধর্মপ্রাণ নরনারী আসে ভুবনবাবুর পাঠ শুনতে। এইসব কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন ভুবনবাবু নিজের ব্যক্তিগত সব দুঃখ, শূন্যতাকে ভুলে কি যেন অন্যবস্তুর স্বাদ পেয়েছেন তিনি, তাই নিয়েই তৃপ্ত রয়েছেন। 

ভুবনবাবু সংসার ত্যাগ করেননি, সংসারেই রয়েছেন কিন্তু সংসারের পাঁকে জড়াননি নিজেকে কথাটা ভুবনবাবু তাঁর বন্ধু শশীকান্ত বাবুকেও বলতেন। শশীকান্ত রায়চৌধুরী ছিলেন এই নারিট কৃষ্ণনগরের পাঁচ আনির জমিদার। ভুবনবাবুদের সঙ্গে লতায়-পাতায় কি একটা সম্পর্ক ও ছিল। শশীকান্ত অবশ্য ভুবনবাবুর থেকে বয়সে বেশ ছোটই ছিলেন। তেমন লেখাপড়ার ধার ধারতেন না তিনি। 

সেকেলে জমিদারদের মতো দুদে অত্যাচারীও ছিলেন না শশীকান্ত, মোটামুটি ভদ্রলোক, সজ্জন ব্যক্তিই ছিলেন। সাদাসিধে ভালোমানুষ 

স্ত্রী ললিতা আর ছেলে গোকুলকে নিয়েই বেশি সময় কাটত তাঁর। 

আর জমিদারির কাজকর্ম দেখাশোনা করত নরহরি বিশ্বাস তাঁর সদর নায়েব। 

নরহরি বিশ্বাস অমায়িক সজ্জন, নরম বৈষ্ণব-এর বেশ তার অঙ্গে। গলায় কণ্ঠি, কপালে বাহুতে তিলক সেবা। আর জিভ দিয়ে যেন মধু ঝরছে, অহরহ নামজপই চলেছে। 

লোকের দুঃখে বিপদে যেন নিজেই কেঁদে ফেলবে। 

—আহা। এত কষ্ট তোর। গৌর হে—এদের সুখী কর গৌর। 

তারপরই বেশ ধমক দিয়ে আওয়াজ তুলত—জয় নিতাই, জয় গৌর। 

—তাকেই ডাক বাবা, তিনিই বিপদতারণ। 

তারপরই মৃদু কণ্ঠে বলতেন। 

—জমিদারের খাজনা আর পারের কড়ি ঠিকঠাক দিয়ে যাবি, বাবা নাহলে গৌরও দয়া করবে না। আর আমার পার্বণীটাও! 

কাছারিতে নরহরি আসে সকাল বেলাতেই। 

প্রজাপাটকদের ভিড়ও বাড়তে থাকে। জমিদারি চলে যাচ্ছে—বাজারে খবরটা চাউর হয়ে গেছে। 

শশীকান্তবাবুও শুনেছেন খবরটা। 

এতদিনের জমিদারি এত সম্পদ, বাগান-মহাল জমি জলকরের বিস্তীর্ণ বিল কি নেই তাঁদের। রোজগারের জন্য ভাবতে হতো না। 

কিন্তু এবার সরকারই সব নিয়ে নেবে। 

তাদের জন্য থাকবে মাত্র সত্তর বিঘে জমি। কি হবে ওতে? 

শশীকান্তবাবু এতদিন ধরে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্রও ভাবেননি, ভাববার প্রয়োজনও হয়নি। চলমান ঘড়ির কাঁটার মতো সব ঠিকঠাক চলেছে। নরহরি বিশ্বাসও বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি এইটাই দেখায়। 

ঠিকঠাক টাকা-পয়সা এসেছে তহবিলে এমনি ভাব নিয়ে চলে। 

অবশ্য ললিতা মাঝে মাঝে বলেছে স্বামীকে 

—নিজের জমিদারি, ভার নাও, নিজেই দ্যাখো। কোথায় কি মহাল, বিষয়, সম্পত্তি জলকর খাস জমি-বাগান কি আছে সব কাগজপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নাও। নিজেও মাঝে মাঝে মহালে যাও। 

শশীকান্ত কিছুটা আয়েসি ধরনের মানুষ। 

আর তাঁর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। দেহে এর মধ্যেই নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। শশীকান্ত বলে 

—নরহরি তো সবই দেখাশোনা করছে, একেবারে গৌরগত প্রাণ—ধার্মিক মানুষ।

ললিতা চেনে নরহরিকে। 

নরহরি বেশ হিসাবি ব্যক্তি। সেও জানে কর্তা সহজ-সরল মানুষ। তাকে দারুণ বিশ্বাস করে। 

কিন্তু ওই গিন্নিমা লিখাপড়া জানা শহুরে মেয়ে, ও যেন ঠিক কর্তাবাবু যে নরহরিকে এতটা বিশ্বাস করেন এটা ভালো চোখে দেখে না। 

অবশ্য না দেখার কারণ কিছু ঘটেছে, এস্টেটের গোমস্তা হরনাথ লোকটার নজর আছে নরহরির উপর, হরনাথ পাল ললিতার বাপের বাড়ির গ্রামের মানুষ। এমনিতে সৎ আর কাজের লোক। 

ললিতা চেয়েছিল ওকেই নায়েব করে এখানে রাখতে, কিন্তু নরহরি বিশ্বাস আরও গভীর জলের মাছ, সে বুঝেছিল শশীকান্তবাবুর জীবনেই জমিদারি শেষ হয়ে যাবে। তিন পুরুষের পর আর জমিদারি থাকে না। চতুর্থ পুরুষেই জমিদারি ফৌত হয়ে যায়। সুতরাং নরহরিও বুঝেছিল এই পুরুষেই তাকে গুছিয়ে নিতে হবে, তাই জমি-জায়গা—মহাল শশীবাবুর হাত থেকে চলে গিয়ে যেন নরহরির জালেই আটকে যায়। 

নরহরি ওই পথে চলার চেষ্টাই করছে। 

শশীবাবুও তার উপর ভার দিয়েই নিশ্চিন্ত। নগদ আমদানি কিছু দেখাতে পারলেই শশীবাবু খুশি। 

আর নরহরি সামনে সেইটা করে। সেই সঙ্গে নরহরি মনে-প্রাণে ধার্মিক ঈশ্বর নিবেদিত মানুষ বলেই জাহির করে। বলে শশীকান্তকে, 

—কর্তাবাবু নিরামিষ খাই—গৌরের নাম নিয়েই দিনরাত মজে আছি। বিষয় বিষে এতটুকু লোভ আমার নেই। তাঁর দয়াই সম্বল—গৌর হে জয় নিত্যানন্দ গৌরহরি। 

শশীবাবুও ভাবেন এমন দেবতুল্য মানুষ আর হয় না। কিন্তু নরহরি গোপনে দূর-দূরান্তরের মহাল, লাখ লাখ টাকার জলকর বাগান সব বেনামিতে বন্দোবস্ত করে দিয়ে প্রচুর টাকা ঘরে তুলছে, কিছু বেনামদারের আড়ালে নিজেই মালিক সেজে বসেছে। 

.

শশীকান্তবাবু কিছুদিন হল কাশীতে গেছেন—ললিতা গোকুলকে নিয়ে রয়েছে গ্রামের বাড়িতে। গোকুলের স্কুলে ছুটি ছিল না—তাই ললিতা যেতে পারেনি। 

ছোট ছেলেটাকে নিয়ে গ্রামেই রয়েছে। 

গোকুল এমনিতে খুবই চঞ্চল। 

কিন্তু ভুবনবাবুর খুবই অনুরক্ত। 

ভুবনবাবু তাঁর মন্দিরের কাজকর্মের ফাঁকে শশীকান্তের বাড়িও আসেন। ললিতা এই প্রবীণ মানুষটিকে খুবই শ্রদ্ধা করে। দেখেছে ললিতা এই ভুবনবাবু প্রকৃত সজ্জন একটি মানুষ। গোকুল ও ভুবনবাবুকে খুবই ভালোবাসেন। ভুবনবাবু বলেন, 

—কি বন্ধু কেমন আছ? 

গোকুল বলে—তাহলে তুমি আমার বন্ধু? 

—কেন? আপত্তি আছে? 

ভুবনবাবু হাসেন। গোকুলও বন্ধু বলেই ডাকে ভুবনবাবুকে। 

প্রতিদিন সকালে গোকুল নিজেদের বাগানের ফুল তুলে মন্দিরে গিয়ে বন্ধুকে দিয়ে আসে।

ভুবনবাবু বলেন–বন্ধু, তোমার ফুল না পেলে আমার ঠাকুরের পূজা যেন ঠিক হয় না গো।

গোকুল বলে—তাই তো রোজ ফুল দিতে হয় তোমাকে। 

ভুবনবাবু মন্দিরে ভালো প্রসাদ হলে নিজেই নিয়ে যান গোকুলের জন্য। 

–কই গো—আমার বন্ধু কোথায় ললিতা মা? 

ললিতা হাসে—বেশ জপিয়েছে দেখছি গোকুল আপনাকে। 

ভুবনবাবু হাসেন। 

শশীকান্ত বলে—ভুবনদা গোকুলকেই নয় তোমাকেও কৃষ্ণ ভক্ত করে তুলেছেন। বাড়িতে তাই কৃষ্ণ পুজো করার জন্য জেদও ধরেছ। 

ললিতা বলে—অন্যায় তো করছি না। 

ভুবনবাবুও স্বামী-স্ত্রীর কথার মধ্যে বলেন, 

—না-না। পুজো আচ্চা, দেবতার বিশ্বাস এসব ভালো মা। আমাদের ধর্ম-বিশ্বাস ঐতিহ্যকে মানব না? মানতেই হবে। তুমি পুজো করবে মা, ভক্তিভরে ঈশ্বরকে ডাকবে, মনে জোর পারে। সৎপথে চলার অনুপ্রেরণা পাবে। 

তাই ললিতাও বলে স্বামীকে, 

—কাশী থেকে একটা গোপাল মূর্তি কিনে আনবে আমার জন্য? 

হাসেন শশীকান্তবাবু স্ত্রীর কথায়। বলেন, 

—কাশীর কড়িয়াল, বেনারসি শাড়ি, দামি জর্দা না চেয়ে চাইলে কিনা গোপাল মূর্তি। ঠিক আছে তাই আনব 

কাশীতে চলেছেন শশীকান্তবাবু। 

এমনি দিনে গোমস্তা হরনাথ এসে বলে ললিতাকে—মা, বাবুও নেই। শুনলাম নায়েব মশাই নশীপুরের তিনলাখ টাকার জলকর—নয়ছয় করে ইজারা দিয়ে মোটা টাকা কমিশন নিয়েছেন। গোবিন্দপুরের মহাল থেকে তিনসনের খাজনা আদায় করে এস্টেটে দু’সনের খাজনা জমা করেছেন। 

—সেকি! ললিতা অবাক হয়। 

এর আগেও এসব কথা কানে এসেছে ললিতার। শশীবাবুকেও বলেছে, কিন্তু শশীবাবু হেসে উড়িয়ে দেন। 

—ওসব বাজে কথা। নরহরির মতো ধর্মপ্রাণ-নির্লোভ মানুষ হয় না ললিতা। এসব কথা রটায় ওর শত্রুপক্ষ। আমি খাতাপত্র দেখি, এ কাজ ও করতেই পারে না। 

কিন্তু দেখা যায় নরহরির বাড়িটা ক্রমশ বাড়ছে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে। তার সিন্দুকের মধ্যে টাকায় যেন ডিম পাড়ছে। 

এবারও তাই হরনাথ গোমস্তার কথায় বলে ললিতা-কর্তাবাবু এলে বলছি। আপনি আরও খোঁজ খবর রাখুন। 

হরনাথ বলে—রাখছি মা। নরহরি বাবুকে সময়মতো না সামলালে পরে চরম বিপদই হবে। তখন আর করার কিছুই থাকবে না। 

কিন্তু সব শুনেও ললিতার করার কিছুই নেই, কারণ নরহরি বিশ্বাস পাকা হিসাবি লোক, সে এসব কাজ করেছে তার কোনো প্রমাণও নেই। তাই এসব শুনেও চুপ করেই থাকে ললিতা, তবু ভয়ই হয়। 

ওই ফোঁটা তিলক কন্ঠীধারী মানুষটা সে আর বিশ্বাস করতে পারে না। 

নরহরি বিশ্বাস-এর কানেও হরনাথের সম্বন্ধে দু-চার কথা ওঠে। নরহরি বিশ্বাসও মনে মনে তার কর্তব্য ঠিক করে নেয়। 

.

সেদিন সেরেস্তায় হরনাথকে ডাকিয়ে এনেছে নরহরি বিশ্বাস। পদমর্যাদাবলে নরহরি সদর নায়েব আর হরনাথ তার অধীনস্থ কোনো মহালের গোমস্তা মাত্র। 

নরহরি জানে হরনাথ গিন্নিমার প্রিয় পাত্র। তার কানে নরহরির সম্বন্ধে দু’চারটে কথাও সে তুলেছে। সেদিকে না গিয়ে নরহরি বলে—হরনাথ তোমার মহালে আদায় এত কম কেন? 

বকেয়া খাজনার উশুলও দেখছি না। বরং নানা খাতে খরচাই বাড়ছে। কর্তাবাবুকে তো জবাব দিতে হবে আমাকেই। 

হরনাথ বলে—আদায় তো করছি। ওদিকে দু’সাল অজন্মা চলছে গরিব-প্রজা পুরা পুরা পয়সা দেবে কোথা থেকে? 

নরহরি বলে—তাহলে এই মহালে আমি অন্য গোমস্তা দিচ্ছি। তুমি বরং নলপুরের মহালেই যাও। জয় নিতাই— 

—নলপুর! চমকে ওঠে হরনাথ। 

একেবারে মেদিনীপুর-বিহার সীমান্তের দূর বনঢাকা ওই মহাল। মানুষ হাতি সেখানে একসঙ্গে বাস করে। রেল স্টেশন থেকে বহুদূর। একেবারে বনবাসই। 

হরনাথের মনে হয় নরহরি তাকে জেনেশুনেই ওই বনবাসে নির্বাসন দিতে চায়, যাতে তার কীর্তি-কাহিনির কথা প্রকাশ না পায়। 

নরহরি ওই হুকুম দিয়ে নিজেই আসে অন্দর মহলে। ললিতা দরজার আড়ালে থেকে ঝিয়ের মারফত কথা বলে। এই বড় বাড়ির এই নিয়ম। এখানে ঘরের বউ নায়েব গোমস্তার সঙ্গে এইভাবেই কথা বলে। 

নরহরি শোনায়। 

…….কর্তাবাবু কাশী থেকে খবর পাঠিয়েছেন হরনাথের মতো কাজের লোককে নলপুরের জঙ্গল-মহলে পাঠাতে হবে কয়েক মাসের জন্য। তাই তাকে ওখানে যেতে বলেছি মা! 

ললিতা বলে, 

—উনি যখন বলেছেন তখন তাই করুন। কবে ফিরবেন বলেছেন কিছু? 

ললিতার অভিমানই হয়। স্বামী কাশী থেকে নায়েবকে চিঠিপত্র দেন—তাকে দিতে সময় নাই। নায়েব বলে গম্ভীর ভাবে, 

—দু এক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরবেন মা। 

অবশ্য তেমন কোনো খবরই আসেনি। তবু হরনাথকে সরাবার জন্য এসব মিথ্যার অবতারণা নরহরি বিশ্বাস অনায়াসেই করে ললিতার কাছে! 

তার পথের কাঁটাকে সে সরিয়েই দেবে। 

.

ললিতার কিছু করার নেই। হরনাথকে চলে যেতে হলো বন-মহালে। এর কিছুদিন পরই ফেরে শশীকান্তবাবু। ললিতার মনে অনেক প্রশ্ন—অনেক অনুযোগই জন্মেছিল ওই নরহরি বিশ্বাসের প্রসঙ্গে। এর মধ্যে নরহরির বউকেও দেখেছে ললিতা সেদিন ভুবনবাবুর মন্দিরে। 

কি একটা উৎসব উপলক্ষে সেখানে গ্রামের মেয়েরা এসেছে। এসেছে গ্রামের সাধারণ মানুষও। সেদিন প্রসাদের ব্যবস্থাও রয়েছে। 

ললিতা গোকুলও মন্দিরে এসেছে। এসেছে নরহরির স্ত্রী কুন্তীও। অবশ্য এইটি নরহরির তৃতীয় পক্ষ। এর আগে নরহরির দুই স্ত্রীই মারা গেছেন—তারপর আর বিয়েতে মত ছিল না নরহরির। শুধুমাত্র নরহরির পিসিমার আদেশে বংশরক্ষার জন্য নরহরি তৃতীয় পক্ষে মত দিতে বাধ্য হয়েছিল। 

কুন্তীর বয়স তেমন কিছু নয়, তার তুলনায় নরহরি বেশ বয়স্ক। ওই মালা তিলকধারী লোকটা একটা কচি মেয়েকে আবার ঘরে এনেছে। 

ললিতার মনে হয় লোকটা আসলে স্বার্থপর, লোভী; না হলে নরহরি বিশ্বাস জেনেশুনে আবার একটা নিরীহ মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য তার ঘরে আনত না। 

কুন্তী অবশ্য ললিতাকে প্রণাম করেছিল। তাকে সম্মানও দেখিয়েছিল। ললিতা বলে কুন্তীকে

–এসো একদিন আমার বাড়িতে। 

কুন্তী বলে—যাব। 

অবশ্য আসেনি। ললিতার মনে হয়েছিল এতেও নরহরির হাত আছে। ও চায় না তার স্ত্রী অন্য কোথাও আসা-যাওয়া করুক। তাতে হয়তো ওর অনেক গোপন খবরই প্রকাশ হয়ে পড়তে পারে, তাই এই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় নরহরিকে। 

এর কিছুদিন পরই শশীকান্ত বেনারস থেকে ফিরেছিল। 

ললিতার মনে এতদিন স্বামী বাড়িতে না থাকার জন্য অনেক প্রশ্ন, নালিশই মনে জমা হয়েছিল। নরহরি বিশ্বাস সম্বন্ধেও কিছু প্রশ্ন ছিল তার মনে। হরনাথের ওই বদলির আদেশ তাকেও বিচলিত করেছিল। 

কিন্তু শশীকান্ত ফিরতে ললিতা কি খুশিতে যেন ওসব কথা ভুলেই যায়। স্বামীকে কোনদিনই ললিতা নিজের কোনো প্রশ্ন—কোন সমস্যা নিয়ে বিব্রত করেনি, করতেও চায়নি। 

আজও এ নিয়ে কোনো কথা তোলে না। 

শশীকান্ত বেনারস থেকে মূল্যবান অষ্টধাতুর একটা গোপাল মূর্তি এনেছেন।

নরহরিও এসেছে হুজুরের খাস কামরায়। 

ওই মূর্তিটিকে দেখে বলে নরহরি—অনেক দাম। 

—হ্যাঁ, প্রায় পঁচিশ হাজারই লাগল। অষ্টধাতুর মূর্তি। 

ললিতা বলে—এত! 

—হ্যাঁ। তোমার দেবতা—দাম দিয়ে আনব না? এবার মনের সাধে পুজো করো গোপালকে।

নরহরি দেখে মূর্তিটিকে। বলে— 

—জয় নিতাই—জয় গৌর। সুন্দর মূর্তি মা জননী! একেবারে প্রাণবন্ত— 

ললিতা ভক্তিভরে তার ঠাকুরঘরে ওই মূর্তিকে পূজা করে। পূজো অভিষেক এসবও করা হল ঘটা করে। নরহরি নায়েব ধর্মপ্রাণ-ব্যক্তি, সেই-ই তদারক করে এসব করে। 

নরহরি বিশ্বাস-এর নিশ্বাস বায়ুতে, তার দেহের রোমে রোমে যেন কৃষ্ণ বিরাজমান। দিবারাত্রি ওই নাম-জপেই বিভোর হয়ে থাকে নরহরি। 

এর মধ্যে নায়েবির কাজও পুরোদমে চলে। অবাধ্য প্রজাকে শায়েস্তা করতে ওর জুড়ি নেই। তাদের ধরে এনে ওদিকের অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে। নরহরির কিছু বিশ্বস্ত চ্যালাও আছে। 

নরহরি তাদের বলে, 

—কেষ্টার জীব ক’টার সাময়িক দুর্মতি হয়েছে। ওদের একটু সুমতি আনতে হবে। বেশ মেরামত করে দে! দেখিস—যেন জীবহত্যা করিসনি। মহাপাতক হবে। 

অর্থাৎ ওদের পিটিয়েই ঠাণ্ডা করে দেয় নরহরি—ওই পরম বৈষ্ণব যার কাছে হিংসা মহাপাতক।

এই ভাবেই নরহরি নির্দয়ভাবে প্রহার করে অবাধ্য প্রজাদের—যারা তার স্বার্থহানি করে।

গ্রামের বহু লোকই বিপদে পড়ে আসে নরহরির কাছে। নরহরি তখন যেন বিনয়ের অবতার পর দুঃখে পরম দুঃখী একটি সত্তা। 

গ্রামের বহু লোকই বিপদে পড়ে আসে নরহরি কাছে। নরহরি তখন যেন বিনয়ের অবতার পরদুঃখে পরম দুঃখী একটি সত্তা। 

.

কেষ্টচরণ এমনিই বিপদে পড়ে আসে নরহরির কাছে। 

তার মেয়ের বিয়ের সব ঠিক, পাত্রটিও ভালো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা বেঁকে বসেছে দশহাজার টাকা নগদ আরও দিতে হবে। বিপদে পড়েছে কেষ্টচরণ। 

জানে এমন পাত্র হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাবে না। একমাত্র মেয়ে—তাকে সুখী দেখতে চায় কেষ্ট। কিন্তু তিনদিনের নোটিশে এত টাকা কে দেবে তাকে? 

তাই নরহরির কাছেই সে ছুটে আসে। 

—বাঁচান বিশ্বাস মশাই। দশ হাজার টাকা না হলে সর্বনাশ হবে। 

—দশ হাজার! বিশ্বাসও মোচড় দিতে থাকে। বলে—কোথায় পাব এত টাকা এই ক’দিনের মধ্যে? 

কেষ্টচরণ বলে—যা বলবেন করব…..টাকাটা দ্যান! 

নরহরি বলে—দেখি, কাগজপত্র করি। টাকার জোগাড় হলে বন্ধকি দলিলে সই করবি।

—তাই করব। জমি বন্ধকই রাখব। 

কেষ্ট তাতেই রাজি। ওদের রাজি হতেই হয়, আর এমনি বিপদের সময় নরহরি বিশ্বাস তাদের টাকা দিয়ে শেষে ওই জমি-জায়গাই দখল করে নেয়। 

এমনি করে এই অঞ্চলের বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করে নিজের পুঁজিই বাড়িয়ে চলেছে নরহরি। নায়েবি করেও শশীকান্তবাবুর সর্বস্ব গ্রাস করে চলেছে সঙ্গোপনে।

.

কুন্তী এই সংসারে এসেছে কয়েক বছর মাত্র। শান্তিপুরের ওদিকের কোনো গ্রামে ওর বাপের বাড়ি। বাবার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। শান্তিপুরে কোন পাটের মহাজনের গদিতে কাজ করত কুন্তীর বাবা। 

ছাপোষা মানুষ। ওই সামান্য চাকরিতে সংসারের অভাব মিটত না, বেড়েই চলেছিল সমস্যাগুলো। সংসারে দু’বেলায় অনেকের পেটেই অন্ন যোগাতে হতো—তাই মেয়েদেরও ভালো ঘর বরে দেবার সামর্থ্য ছিল না। কুন্তীও ছেলেবেলা থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে মানুষ হয়েছে। তাই হঠাৎ নরহরির মতো মানুষের ঘরে এসে একটু অবাকই হয়েছে। প্রথমে ওই বাপের বয়সি বুড়োকে স্বামী বলে মেনে নিতেই বেধেছিল কুন্তীর। 

কিন্তু তার বাবা গরিব তার কাছে নরহরি বিশ্বাসের মতো জামাই পাওয়া ভাগ্যের কথা। তাই রাজি হয় সে। আর মেয়েকেও বলে—অতবড় একটা লোক যেচে বিয়ে করতে চায়—অমত করিস না মা। আখেরে মঙ্গলই হবে। 

আখেরে কি মঙ্গল হবে তা জানে না কুন্তী, তবে বর্তমানে বাবার সংসারে কিছু মঙ্গল হবে তার এই বলিদানে তা বুঝেছে কুন্তী। তাই বিয়েতে রাজি হতে হয়। 

কিছুটা রাগ-অভিমানই হয় বাবা-মায়ের উপর। বেশ বুঝেছে কুন্তী এই জগৎটা স্বার্থে ভরা। বাবা-মা নিজেদের স্বার্থের জন্যই তাকে এমনি এক বুড়োর হাতে তুলে দিল। কারণ নরহরি নাকি তার বাবাকে খরচাদি বাবদ বেশ কিছু টাকাই দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে তাও জানিয়েছে। 

তাই কুন্তী এসেছিল নরহরির সংসারে। 

মানুষটাকে ও ক্রমশ চিনেছে। যত চিনেছে ততই মনে জন্মেছে নীরব ঘৃণা আর বিরক্তি।

নরহরির টাকা—জমি-জায়গা কোনো কিছুরই অভাব নেই। দু’হাতে রোজগার করে লোকটা। কিন্তু তবুও মনের লোভ-লালসা-নীচতার ঘাটতি নেই। ওই লোভ-নীচতা আরও যেন নানা ভাবেই বেড়ে চলেছে নরহরির। 

কুন্তী দেখেছে সব ব্যাপারগুলো। 

কতজনকে সর্বস্বান্ত করেছে তার ঠিক নেই। অনেকে এসে কাতরস্বরে বলে—ওই জমিগুলো ছেড়ে দ্যান নায়েব মশাই—ওগুলো তো দিইনি। ছেলেপুলে নে পথে দাঁড়াতে হবে। 

কেউ বলে—এত টাকা নিইনি। তিনশো টাকা নেছি—দুবারে দুবারে দুশো টাকা করে দিয়েছি এখন দু’হাজার টাকা হল কি করে? 

—দলিলে তাই আছে। দু-হাজারই নিয়েছিস বাপ। 

—মিথ্যা কথা। কানাই বলে। 

নরহরি বলে—কোর্টে যা বাপ। যা, এখানে ঝামেলা করিস না। 

নরহরি তারও সর্বস্ব দখল করে মিথ্যা দলিল-বলে। 

.

কুন্তী এতদিন নীরবে দেখেছে এসব। গরিবের ঘরের মেয়ে সে। এত প্রাচুর্য দেখেনি, প্রথমে একটু হতভম্ভই হয়ে গেছিল। ক্রমশ সেটা সয়ে যেতে এবার কুন্তী বুঝতে পারে যে এতসব আমদানি এবাড়িতে কোনো দিনই সৎপথে হয়নি। 

এই প্রাচুর্যের পিছনে রয়েছে বেদনাময়—করুণ বহু ইতিহাস। বহু দীর্ঘশ্বাস আর বঞ্চনার পাহাড় জমে আছে এই বিষয়ের সঙ্গে, মিশে আছে বহু বঞ্চিতের দীর্ঘশ্বাস আর অভিশাপ। অভিশাপটার কথা প্রথমে মনে হয়নি কুন্তীর, ওটা মনে হয়েছে বেশ কিছুদিন পর। 

কুন্তী স্বপ্ন দেখেছিল তার সংসারও ফলে-ফুলে ভরে উঠবে। তার কোলে আসবে সন্তান তাকে নিয়ে কুন্তী সব বঞ্চনা ব্যর্থতাকে সহ্য করে নেবে। 

কিন্তু এই ক’বছর পার হয়ে গেছে, কুন্তী আজও মা হতে পারেনি। মা হবার কোনো সম্ভাবনাই বোধহয় তার নেই। 

এবার মনে হয় কুন্তীর, তার কাছে এই সংসারের প্রাচুর্যও আজ অর্থহীন হয়ে গেছে। মা-ই হতে পারবে না সে কোনদিন। এবার ওই অভিশাপের কথাই মনে পড়ে বেশি করে। বহুজনের দীর্ঘশ্বাস আর অভিশাপ রয়েছে এই বাড়িতে। 

দেখেছে কুন্তী তার স্বামী নরহরি বিশ্বাসের ওইসব অত্যাচার আর অন্যায়। বহুজনকে সে বঞ্চিত করেছে নানা কৌশলে। 

বহু নারী-পুরুষ এসে এবাড়িতে নরহরির হাতে-পায়ে পড়ে চোখের জল ফেলে কাতর অনুরোধ করেছে, 

—ওই জমিগুলো নিও না বিশ্বাস মশাই, ছেলেপুলে নিয়ে পথে দাঁড়াতে হবে। তোমার আসল মায় সুদ তো মিটিয়ে দিয়েছি। 

হাসে নরহরি। লোককে বিপদে পড়ে আর্তনাদ করতে দেখলে তার মনে বেজায় আনন্দ হয়। আর ওই এই দুঃখের মূল যে সে নিজে এটা ভেবেও বেশ আত্মতৃপ্তি লাভ করে নরহরি। 

লোকটার হাতে হরিনামের মালা, কপালে তিলক, আর চোখে সেই পৈশাচিক হাসি। বলে নরহরি, 

—সবই তাঁর ইচ্ছা, সুদের সুদ, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ তো দিতে হবে বাবা। জয় নিতাই। তারপরেই গলা নামিয়ে বলে তার অনুচরকে, 

—ওরে বংশীবদন কেষ্টর জীবদের বাড়ি থেকে বের করে দে। হ্যাঁ তো বেশি মারধোর করিস না, প্রয়োজনে ঈষৎ অঙ্গসেবা করে বিদেয় করবি। 

অর্থাৎ এরপর অঙ্গসেবাই শুরু হবে এদের উপর। 

অনেকের হাত-পা-ও ভেঙে যায়, মাথাও ফাটে এবাড়িতে এসে। অবশ্য এ নিয়ে জল বেশিদূর অবধি গড়ায় না। 

কুন্তী দেখেছে ওই ভন্ডামি আর নিষ্ঠুরতা। লোকটা নিজেকে পরম ভক্তিমান বৈষ্ণব বলেই পরিচয় দেয় বাইরে। 

কিন্তু মনে মনে নরহরি একটা লোভী পিশাচ মাত্র। ক্রমশ তার মনটা ঘৃণায় ভরে উঠেছে। কুন্তীর মনের শূন্যতা বেড়েছে ততখানি। 

নরহরি ধূর্ত আর হিসেবি লোক। 

তার কাছে এই হিসাবটা ঠিকই ধরা পড়ে। তাই নরহরি বিশ্বাস তার তৃতীয় পক্ষের এই তরুণী ভার্যার দিকে একটু বেশি নজরই রাখে। পরপর দুজন গত হয়েছে, এই তার শেষ স্ত্রী। এমনিতেই দুজনে আড়ালে নানা কথাই বলে নরহরির স্ত্রী-ভাগ্য সম্বন্ধে 

বেশ জানে নরহরি এবার এই স্ত্রী-রত্নটি টেসে গেলে জীবনে আর কোনো স্ত্রী-রত্নই জুটবে না। কারণ এর মধ্যেই রটে গেছে নরহরি দেবারিগণ—যে কোন স্ত্রীই আসুক না কেন উনি তাকে গ্রাস করবেনই। 

নরহরি এমনিতে দু’হাতে টাকা-জমি-বিষয় সবই রোজগার করে, আর নরহরি জানে রোজগার করা বরং সহজ, কারণ মা লক্ষ্মীর দয়া থাকলে ধন-সম্পদ আসে এসে পড়বে, কিন্তু মা লক্ষী বড়ই চঞ্চলা। তার আসা যাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। আসতেও যতক্ষণ—চলে যেতেও ততক্ষণই। 

ধনসম্পদও হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। তাই মা লক্ষীকে সযতনে আটকে রাখতে হয়, যাতে না চলে যান। নরহরি তাই হাড় কৃপণ—যক্ষের মতো সে ধনসম্পদ আগলে রাখে। প্রাণধরে একটি পাই-পয়সাও বাজে খরচ করে না। কাউকে এক কপর্দক দানও করে না। 

কিন্তু নরহরি কুন্তীর কোনো সাধই অপূর্ণ রাখেনি। শাড়ি-গহনা—তার বিলাস-ব্যসন সবকিছুরই ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু কুন্তীর কাছে ওসবের যেন কোনো প্রয়োজনই নেই। 

নরহরি বলে—শাড়ি-গহনা যা তোমার দরকার তারজন্য খরচা করবে। 

কুন্তীর মনে হয় ওই লোকটার সব টাকাই ওমনি দীর্ঘশ্বাস মাখানো। বলে কুন্তী—ওসবের কোনো দরকার নেই। আমি ভালোই আছি। 

নরহরি দেখছে স্ত্রীকে। 

ওই তরুণী মেয়েটিকে যেন মাঝে মাঝে সে চিনতেই পারে না। কেমন রহস্যময়ী বলেই মনে হয়। 

.

নারী রহস্যময়ীই। শত চেষ্টা করেও তাদের মনের খবর পাওয়া যায় না। দেবতারাও অতীতে নারীদের মনের প্রকৃত খবর জানতে পারেননি, সেখানে মেজবাবু শোভাবাজারের মোনা মিত্তির তো সামান্য মানুষ, তিনি কি করে জানবেন পায়েল-এর মনের খবর। 

পায়েল এখানের নামী-দামি বাইজি। অবশ্য বাইজি বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেইভাবে বাইজির ঠাট-বাট নিয়ে এখন থাকে না পায়েল। 

এককালে কলকাতার নামকরা বাইজি ছিল পায়েল। এখনও তার দেহে যৌবনের অভাব নেই। কলকাতার বাড়ি-ঘর ছেড়ে পায়েল এই দূর শহরের নিভৃতে নিজের বাগান বাড়ির সবুজ পরিবেশেই বেশির ভাগ সময় থাকে। 

কলকাতার সেই জীবন—প্রতি সন্ধ্যায় মুজরো—টাকার আমদানি—কিছু ধনবান—উচ্ছৃঙ্খল মাতালের ভিড়-হল্লা এসব ভালো লাগে না। তাই পালিয়ে আসে এই পরিবেশে পায়েল। 

কলকাতার সেই ধনবান বখাটেদের অনেককেই এড়াতে পেরেছে সে। তারা দু-চার দিন ঘুরেছে পায়েলের পিছনে, তারপর যখন দেখেছে পায়েল ঠিক তাদের পাত্তা দিতে চায় না, তাদের টাকার দিকেও পায়েলের লোভ নাই, তখন তারা নিজেরাই একে একে কেটে পড়ে। তারা জানে ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না। তাদের টাকার জন্যই অন্য অনেক বাইজিরাই ভিড় করে আসবে তাদের চারিপাশে। তাই পায়েলকে ওরা ছেড়ে যায়। 

কিন্তু ছাড়েনি পায়েলকে ওই মোনা মিত্তির 

শোভাবাজার অঞ্চলের কোন বনেদি পরিবারের ছেলে ওই মনমোহন মিত্র। তাদের পূর্বপুরুষ এককালে কোম্পানির আমলে নিমকের একচেটিয়া ব্যবসা করে প্রভূত ধনসম্পদ অর্জন করেছিল। উত্তর কলকাতায় বিশাল এলাকা জুড়ে সেই মিত্তিরদের প্রমোদ-বাগান। এককালে খুবই রমরমা ছিল। 

কিন্তু বংশধররা আর সেই ব্যবসাপত্র—ধন সম্পদকে ধরে রাখতে পারেনি। সবই কর্পূরের মতো উবে গেছে। তবু কলকাতা শহরে কিছু বাড়ি-জমি-জায়গা এখনও রয়ে গেছে। তাই দিয়ে মিত্তির বাড়ির পরিচয়টুকু নিয়ে কোনমতে টিকে আছে। মোনা মিত্তির পায়েলের আসরে আসত—পায়েলের গলায় লখনউ ঘরানার বাইজি ঠুংরির অসলি সমঝদার সে। আর কেন জানে না পায়েলের উপর যেন একটা নেশাই পড়ে গেছে তার। 

পায়েলকে নিরিবিলিতে একান্তে পাবার জন্যই মোনা মিত্তির কলকাতা থেকে এখানে এসে হাজির হয়েছে। 

শহরের বাইরে সুন্দর-সাজানো বাগান, মোনা মিত্তিরের পূর্বপুরুষের মহাল ছিল এককালে এদিকে। সেই মহালে নায়েব-আমলা-পাইক-বরকন্দাজ সবই ছিল। 

আজ সেই মহাল নেই, সেই গৌরবও অস্তমিত। অতীতের সমৃদ্ধির পরিচয় হিসাবে মোনা মিত্তিরের ওই বাগান বাড়িটা টিকে আছে আর ওখানেই নিয়ে এসেছে মোনা মিত্তির ওই পায়েলকে। 

পায়েল এখানে এসে গানের মুজরো বসায় না, সেই সুযোগ আর মানসিকতা এখানে নেই। তবু রেয়াজ করে, মোনা মিত্তির সমাজদারের মত মদের গ্লাসে চুমুক মেরে মাথা নাড়ে। 

পায়েল বলে, এখানে তো মুজরো বসাতে আসিনি, আর ওসব ভালো লাগে না। মিত্তির মশাই—আপনিও কলকাতায় ফিরে যান। এভাবে এখানে বাড়ি-ঘর-সংসার ছেড়ে পড়ে থাকলে লোক যে নিন্দে করবে। 

মোনা মিত্তিরের ঘর সংসার সবই আছে। 

মিত্তির বাড়ির কুমারদের রোজগারের ভাবনা ভাবতে হতো না, এস্টেট থেকে সকলের মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল, তাই খরচার জন্য ভাবতে হয়নি, বিয়েও হয়ে গেছে ছেলেবেলাতেই মোনা মিত্তিরের। 

কিন্তু মিত্তির বাড়ির যুবরাজদের এক ফুলে মন ভরে না। তারা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়। তাই পায়েলের এখানেই পড়ে আছে মোনা মিত্তির, ওর জন্য কলকাতা ছেড়েছে। 

পায়েলের কথায় বলে মোনা মিত্তির, 

—নিন্দে করবে? লোকে? মোনা মিত্তির নিজে যা ভালো বোঝে করে, কারো নিন্দের পরোয়া করে না। পায়েল, এখানেই থাকব। বাড়িতে ফিরে যাব না। সেখানে যাবার মন আমার নেই। 

মোনা মিত্তির যেন গেড়ে বসেছে এখানে। 

বাড়িতে স্ত্রীও রয়েছে। তার কথা স্বামী হয়ে ভাবার প্রয়োজনও বোধ করে না। তার থাকা-খাওয়া-খরচার ব্যবস্থা তো এস্টেট থেকেই করা আছে, সুতরাং পতিদেবতার কোনো আশু প্রয়োজন সেখানে নেই, নেই কোনো কর্তব্যেরও তাগিদ। 

মোনামিত্তির সেটা জেনেই এখানে পায়েলের শ্রীঅঙ্গে যেন এঁটুলির মতো লেপটে লেগে আছে, কাজের মধ্যে মদ্যপানই তার একমাত্র করণীয় কাজ। 

পায়েল বলে—এসব ছাই-পাঁশ আর কত গিলবে, বয়স হচ্ছে, এসব ছাড় এবার, না হলে নানা রোগ তো বাধিয়েছ, ওতেই মরবে। 

মোনা মিত্তির হাসে। বলে সে, 

—মরতে তো একদিনই হবেই পায়েল। 

—তবু মানুষের মতো বাঁচতে সাধ নেই। কি মানুষ গো তুমি মিত্তির মশাই? 

মোনা মিত্তির মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে, 

—আমাকে জ্ঞান দিও না পায়েল। 

.

পায়েলও আর কাউকে জ্ঞান দিতে চায় না। 

অবশ্য পায়েল এতাবৎ কাউকে জ্ঞান দিতে চায়নি। সকলের কাছ থেকে সে কিছু রোজগার করে নিজের ভবিষ্যতের জন্য ব্যবস্থা করতেই ব্যস্ত ছিল। 

তাই টাকা—বিষয়-আশয়ের মোহ তার ছিল। তার জন্য পায়েল জীবনে অনেক কিছুই করতে বাধ্য হয়েছে। 

আজ তার টাকা—গহনা—বিষয়-আশয়ের অভাব নেই। কলকাতা শহরে দু’খানা বাড়ি, তার ভাড়াও কম নয়। এখানের এই বাগান-বাড়িটাও তার হাতেই এসেছে। 

পায়েল তবু যেন খুশি নয়। 

তার মনে জাগে নীরব একটা হাহাকার। এতদিনের অভ্যস্ত ওই ভোগ-লালসার জীবনে একটা বিতৃষ্ণতাই এসেছে পায়েলের মনে। 

কিন্তু এই পাঁকের পরিবেশ থেকে মুক্তির সন্ধান সে আজও পায়নি। 

তাই পায়েল মন্দিরে আসে। 

বৈকাল নামে ছোট নদীর বুকে। কালোজল ভরা জলঙ্গি এঁকে-বেঁকে বয়ে গিয়ে দূরে গঙ্গার জলস্রোতে গিয়ে মিশে গেছে। তার চলমান জীবন যেন গঙ্গার ধারা প্রবাহে আত্মনিবেদন করে অমর শান্তির সন্ধান পেয়েছে। 

পায়েলের মনে হয় ওই ছোট্ট নদীটা তার থেকে অনেক বেশি ভাগ্যবতী। তার চলার শেষ হয়েছে অমৃত যোগে। কিন্তু পায়েলের জীবনে তেমনি কোনো অমৃতের সন্ধান এখনও আসেনি। 

পায়েল ভুবনবাবুর মন্দিরে আসে প্রায়ই। 

বৈকালে এখানে সারা গ্রামের বহু মানুষজন আসেন—নাট-মন্দিরে ভুবনবাবু কোনোদিন শ্রীমদ্ভাগবত, কোনোদিন চৈতন্য-চরিতামৃত পাঠ করেন। সুললিত কণ্ঠে তাঁর পাঠ, ব্যাখ্যা সকলেই মুগ্ধ হয়ে শোনে। এই জগতের দুঃখ-তাপ-সন্তপ্ত পরিবেশ থেকে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পায়।

চৈতন্য চরিতামৃতের ব্যাখ্যা পায়েলও শোনে, সেই পরম করুণাঘন এক মহামানব এই ধরণীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাপিত—পথভ্রান্ত জীবকে সঠিক পথ আর মুক্তির সন্ধান দিতে। 

তাঁর ওই মহামন্ত্র সর্বজীবের চিত্তে এনেছিল পরম আশার সঞ্চার। আজও সেই নাম-গান করে চলেছে পৃথিবীর বহু মানুষ তাদের মুক্তির সন্ধানে। 

সর্বজীবে সেই করুণাধারা আজও প্রবহমান। তাই যেন সকলেই ছুটে আসে মন্দিরে—চৈতন্য প্রেমের করুণাধারায় অভিনিষিক্ত হতে। 

পায়েলও আসে। 

মোনা মিত্তিরের হাঁ-না কিছুই নাই। 

তার কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্বের চেয়ে ওই পায়েলের অস্তিত্ব আর মদের প্রয়োজনটাই সব চেয়ে বেশি। 

পায়েলকে মন্দিরে যাতায়াত করতে দেখে মোনা মিত্তির বলে—হঠাৎ ঠাকুর-ঠুকুর নিয়ে পড়লে যে?

পায়েল বলে—কোনো আপত্তি আছে? 

মোনা মিত্তির বলে—না। ঠাকুর তো পাথরের না হয় কাঠের তৈরি এই যা রক্ষে। ঠিক আছে যাও। পূজা পাঠ করো। তবে জেনে রাখো, ওসব ঠাকুর দেবতা ‘অল বোগাস’ আসলে কিছুই নাই। বুঝলে? 

পায়েল বলে—তুমি ওই বুঝেই থাকো, আমাকে বোঝাতে এসো না বাপু। হাসে মোনা মিত্তির। উল্লাসে জড়িত কণ্ঠে বলে, 

—মোনা মিত্তির সার বুঝেছে পায়েল। তাকে কোনও শালা আর ধাপ্পা দিতে পারবে না। 

.

ভুবনবাবুও লক্ষ্য করেছেন পায়েলকে। 

তার মন্দিরে সকলেরই অবারিত দ্বার। সারা অঞ্চলের মানুষ এখানে আসে। তার পাঠও ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই অঞ্চলের মানুষের মনে একটা কৌতূহল, সাড়া তিনি জাগাতে পেরেছেন। 

চৈতন্যদেবের পূজারি তিনি। 

স্বয়ং কৃষ্ণই কলিযুগে ভক্তরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নবদ্বীপ ধামে। দ্বাপরে যিনি বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ—কলিতে তিনিই নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যরূপে আবির্ভূত। বলেন ভুবনবাবু, 

—দ্বাপরে বৃন্দাবনকে কেন্দ্র করে সব দেবদেবীগণ, সর্বতীর্থ আবির্ভূত হয়ে কৃষ্ণলীলার পরম রূপ দর্শন করেছিলেন, তেমনি কলিযুগেও চৈতন্য লীলা দর্শন করার জন্যই সব দেব-দেবীগণ সর্বতীর্থ নবদ্বীপধামে অবতীর্ণ হয়ে স্ব-স্ব রূপে সেই উত্তম লীলা দর্শন করে ধন্য হয়েছিলেন।

নবদ্বীপ ছিল তখন নয়টি দ্বীপের সমাহার—ভুবনবাবু সেই নবদ্বীপ মহিমা আর চৈতন্য লীলার ব্যাখ্যাও করেন। আজকের মানুষ অনেকেই জানে না সেই লীলা-মাহাত্ম্য, নবদ্বীপ ধাম মাহাত্ম্য। 

তাই তাঁরাও তন্ময় হয়ে শোনে। ভুবনবাবু তন্ময় হয়ে পাঠ করছেন, 

—কদা নবদ্বীপ—বনান্তরেম্বহং
পরিভ্রমণ গৌর কিশোরমদ্ভুতম্।
মুদা নটন্তং নিতরাং সপার্ষদং 
পুরিস্ফুরণ বীক্ষ্য পতামি মূৰ্চ্ছিতঃ।। 

সারা নাটমন্দিরে গ্রামের বহু নরনারী এসে উপস্থিত হয় ভুবনবাবুর মুখের ওই গৌর কথা শুনতে। এসেছে অনেকেই, এক কোণে পায়েলও বসে আছে। তার মনে কি এক আশার আলো। 

ভুবনবাবু নবদ্বীপ মাহাত্মা প্রসঙ্গে বলে চলেছেন, ওই শ্লোকের মর্মার্থ। 

—নিগম যাহারে ব্রহ্মপুর বলি’ গান। 
পরব্যোম শ্বেতদ্বীপে বর্ণয় পুরাণ।।
রসিক পণ্ডিত যাঁরে ‘ব্রজ’ বলি কয়। 
বন্দি সেই নবদ্বীপে চিদানন্দময়।।
কবে আমি নবদ্বীপে ভ্রমিতে ভ্রমিতে।
অন্তদ্বীপ-বন-মাঝে পাইব দেখিতে।।
সপার্ষদে গৌরচন্দ্র-নর্তন-বিলাস। 
দেখি প্রেম মূৰ্চ্ছাবশে ছাড়িব নিশ্বাস।। 

নবদ্বীপের একটি উজ্জ্বল ছবি যেন ফুটে ওঠে ভুবনবাবুর বর্ণনায়। 

বৈকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, আকাশে রং-এর হোলিখেলা—মন্দিরে ঘণ্টা বাজে। ভুবনের কণ্ঠে এক বিচিত্র বিনম্র সুর। 

—কঠিন ঊষর-ক্ষেত্র তোমার আশয়।
ভক্তি কল্প লতাবীজ অঙ্কুর না হয়।।
তবে এক আশা মোর জাগিছে হৃদয়ে।
নবদ্বীপবাসে শোক স্থান না লভয়ে।।
সংসার বাসনার্ণবে আমি নিপীতত।
কাম ক্রোধ আদি নক্রগ্রস্ত অতি ভীত।।
দুর্বাসনা-শৃঙ্খলে আবদ্ধ নিরাশ্রয়। 
গৌরস্থান, দেহ মোর কৃপার আশ্রয়।। 

নবদ্বীপ, সেই পুণ্যতীর্থদেবতার চরণে ভুবনের ব্যাকুল মিনতি যেন সন্ধ্যার আকাশকে বেদনা বিধুর করে তোলে। 

ওই শ্রোতাদের অন্তরেও সেই পুণ্যতীর্থ নবদ্বীপ ধাম সম্বন্ধে একটা বিচিত্র অনুভূতি জাগে। নয়টি দ্বীপ নিয়ে পুণ্যতীর্থ নবদ্বীপ। অন্তদ্বীপ, শ্রীধাম মায়াপুর, সীমন্ত দ্বীপ, গোদ্রুম দ্বীপ, গৌরসুন্দরের মধ্যাহ্ন লীলাস্থল মধ্যদ্বীপ, কোলদ্বীপ, ঋতু, রুদ্র দ্বীপ, মোদদ্রুমদ্বীপ, জহ্নুদ্বীপ, এই সেই নয়টি দ্বীপ যেখানে গৌরসুন্দরের বহু লীলা প্রকটিত হয়েছিল। যেখানে সেই লীলাদর্শন করার জন্য দেবদেবীরা আবির্ভূত হয়েছিলেন। আজও সেই তীর্থ বিরাজমান। সেখানে গৌরসুন্দরের লীলাও প্রকট আর কোনো কোনো ভাগ্যবান তাঁর দর্শনও পায়। 

.

শশীকান্তবাবু এতদিন নরহরিকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে এসেছেন। শশীকান্তের শরীরটা এমনিতেই জীর্ণ, তাই হঠাৎ অসুখে পড়তে সহজেই অসুখটা বেড়ে ওঠে। শরীরে তার রোগ প্রতিরোধ করার শক্তিও সীমিত। 

তাই প্রায়ই বিছানায় পড়ে থাকতে হয় শশীকান্তকে। ললিতাও প্রমাদ গোণে। কারণ নরহরি বিশ্বাস তখন একাই যা করার করছে কাছারিতে। 

জমিদারিও চলে যাচ্ছে—তাই খাস জমি, বাগান-পুকুর এসবই সরকার নিয়ে নেবে। নরহরিই অসুস্থ শশীকান্তকে বলে, 

—বাবু, সব তো যাবেই এমনি, তার চেয়ে ওইসব খাসের জমি বাগান এর মধ্যে প্রজাবিলি করে দিন, যে যা দেয় তাই নিয়েই বন্দোবস্ত করে দিই, নাহলে এটুকুও পাবেন না, সৰ্বস্ব চলে যাবে সরকারের ঘরে। 

ললিতাও রয়েছে স্বামীর রোগশয্যার পাশে। সে শুনছে কথাগুলো। বিষয়-আশয় নিয়ে এতদিন মাথা ঘামায়নি ললিতা—এবার স্বামীর এই শরীরের অবস্থা দেখে সেও ঘাবড়ে গেছে। 

শশীকান্তবাবুও এবার হতাশ হয়ে পড়েছেন। গ্রামের নবীন ডাক্তার পুরনো আমলের ডাক্তার সেও বলে—ওষুধ তো দিচ্ছি শশীবাবু, কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। 

হাসে শশীবাবু। ম্লান হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলে, 

—শরীর এবার জবাব দিচ্ছে ডাক্তার। 

নবীন ডাক্তারেরও তাই মনে হয়, না হলে ওষুধে কোনো কাজ তেমন হচ্ছে না কেন? শশীকান্তবাবু যেন এবার এই পৃথিবী ছেড়ে যাবার দিনই গুনছেন। 

নরহরির কথায় আজ শশীকান্ত বলে, 

—যা ভালো বোঝো করো নরহরি। 

নরহরিও এবার জমিদারির শেষ পর্যায়ের বাকিটুকুকেও লুট করার পথ বের করে জমি-বাগান-পুকুর ব্যবস্থা করছে নানা নামে-বেনামে, কিছু টাকা অবশ্য দিচ্ছে বাবুকে, তবে বেশির ভাগ টাকাই নরহরির পকেটে চলে যায়, দলিলে সই করে শশীবাবু। 

এখন নরহরির মেজাজও বেশ খুশি খুশি। সন্ধ্যায় বাড়িতে তার কীর্তনের জোরও বাড়ছে। নাম-গান নয় যেন হুঙ্কার দিয়ে গর্জন করছে নরহরি। 

কুন্তী সব ব্যাপারটাই দেখে। সে চেনে তার পতিদেবতাকে। যখন কারো সর্বনাশ করে নিজের আয় বাড়ায় তখনই লোকটা হুঙ্কার করে নামগান করে। তার বাজখাঁই গলার গর্জন ওঠে—জয় গৌর—জয় নিতাই- 

কুন্তী বলে—আবার কার সর্বনাশ করলে গো? এত আনন্দ! 

নরহরি বলে—তুমি তো আমার সর্বনাশ করাই দ্যাখো—প্রাণ খুলে ঠাকুরকে ডাকব না? জয় নিতাই—নিতাই হে, পাপী তরাও। 

.

অধ্যায় ১ / ৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন