একদিন অপরাহ্নে – ১

কাসেম বিন আবুবাকার

১.

শরতের অপরাহ্ন। ঘণ্টাখানেক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর সোনালি রোদে এখন চারদিক ঝলমল করছে। আজ শুক্রবার ছুটির দিন। বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়ার পর তনি প্রতিদিনের মতো তাদের বাগানে ছবি আঁকছিল। ছোটবেলা থেকে তার ছবি আঁকার হাত খুব ভালো। কিন্তু পড়াশোনায় তেমন ভালো নয়। প্রতিবছর মোটামুটিভাবে পাস করে। তার মা মুনসুরা বেগমের সেজন্য মেয়ের ওপর খুব রাগ। তিনি বলেন, ছবি আঁকার চেয়ে পড়াশোনায় মন দিলে মেয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারত। সেকথা মেয়েকে অনেকবার রাগা রাগি করে বলেছেন। স্বামীকেও সেকথা বলে মেয়েকে বোঝাতে বলেছেন। তিনি বুঝিয়েছেনও কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

তনির বাবা রুহুল আমিন মাদারীপুর জেলার ধুরাইল গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন গৃহস্থ। ওনাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে বড়। নাম মেহনাজ। ডাক নাম তনি। ছেলে ছোট। নাম রাশেদ। সে ক্লাস এইটে পড়ে। তনি এ বছর ইন্টার পাস করে বি. এ. পড়ছে। তনিদের বাগানটা বেশ বড়। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। নানারকম ফলের গাছ ছাড়াও এক পাশে বেশ কিছুটা জায়গায় দেশি বিদেশি অনেক রকম ফুলের গাছ। ফুল বাগানের কাছে মুখোমুখি দুটো পাকা বেঞ্চ। বেঞ্চ দুটোর মাঝখানে তিন ফুটের মতো ফাঁকা। দুটোর উপরেই পাকা ছাউনি।

তনি আজ বাঘ ও বনমহিষের লড়াই-এর ছবি আঁকছিল। তখন তার কোনো দিকে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ বাঘের মৃদু গর্জনে বাস্তবে ফিরে এল সে। তার মনে হল, ছবির বাঘটাই যেন বনমহিষের সঙ্গে লড়াই করতে করতে গর্জন করছে। প্রথমে একটু ভয় পেলেও মৃদু হেসে ভাবল, ছবির বাঘ বুঝি গর্জন করতে পারে?

এমন সময় ক্যানভাসের পাশে একটা ঊনত্রিশ ত্রিশ বছরের সুদর্শন যুবককে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হয়ে সেও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ ঐভাবে ছিল তা তারা বলতে পারবে না।

প্রথমে যুবকটি মৃদু হেসে বলল, ছবির বাঘও তা হলে মাঝে মাঝে গর্জন করতে পারে?

ছেলেটির কথা শুনে তনি আরও বেশি অবাক হলেও গম্ভীর কণ্ঠে জিঞ্জেস করল, কে আপনি?

মনে হচ্ছে, আপনি আমার ওপর খুব রেগে গেছেন।

হ্যাঁ, তাতে আপনার কি? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

আমার ওপর কেউ রেগে থাকলে আমি তার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিই না।

আপনি কি জানেন, এখানে আসা আপনার উচিত হয় নি?

যুবকটি কিছু না বলে চুপ করে রইল।

তনি রেগে উঠে বলল, কি হল, চুপ করে আছেন কেন?

বললাম না, কেউ রাগ করে কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি উত্তর দিই না? আপনি স্বাভাবিক স্বরে বা হাসি হাসি মুখে যা জিজ্ঞেস করবেন, উত্তর দেব ।

তনি রাগ সংযত করে বলল, ঠিক আছে, এবার বলুন আপনি কে?

আমি গালিব। কয়েকদিন হল মাকে নিয়ে এই গ্রামে এসেছি।

তা এখানে এসেছেন কেন?

আমি গাছপালা ও ফুলের বাগান পছন্দ করি। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এত গাছপালা ও ফুলের বাগান দেখে ঢুকে পড়লাম।

কিন্তু আপনি তো গাছপালা না দেখে আমাকে দেখছিলেন।

গাছপালা দেখতে দেখতে আপনাকে দেখতে পেয়ে আপনাকেও দেখছিলাম।

জানেন না, নির্জনে সাবালিকা মেয়েকে দেখা বা তার কাছে আসা ইসলামে নিষেধ?

তা জানব না কেন? তবে কি জানেন, আপনার মতো অনিন্দসুন্দরী মেয়ে দেখে সে কথা ভুলে গিয়েছিলাম।

এরকম কথা আগে কখনও তনি শুনেনি। মনে মনে খুশি হলেও একটু গম্ভীর স্বরে বলল, এখন নিশ্চয় মনে পড়েছে, কেটে পড়ন তা হলে?

কেটে তো পড়তেই হবে, তবে তার আগে একটা কথা বলতে চাই। অবশ্য আপনি যদি অনুমতি দেন।

বেশ তো বলুন কি কথা বলতে চান?

আপনি কি জানেন, যে কোন প্রাণীর ছবি আঁকা ইসলামে নিষেধ?

হ্যাঁ, জানি।

তবু কেন এরকম ছবি আঁকছেন বলে গালিব ইজেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।

এটা আল্লাহর দেয়া প্রতিভা আর প্রতিভা কোনো বিধি-নিষেধ মানে না।

কথাটা কিছুটা ঠিক হলেও পুরোটা নয়।

বুঝলাম না।

আল্লাহ যে প্রতিভা আপনাকে দিয়েছেন, তা দিয়ে তাঁর সৃষ্টি জগতের প্রাণী ছাড়া অন্য সবকিছুতে বিকশিত করতে পারেন।

যেমন?

যেমন গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, ঝরনা ও অন্যসব প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি আঁকতে পারেন।

তনি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বলল, আপনি বাঘের গর্জন করে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। আর কোনো প্রাণীর ডাক ডাকতে পারেন না কি?

সাধারণত যেসব পশু-পাখির সঙ্গে আমরা পরিচিত, তাদের সবার ডাক ডাকতে পারি। শুধু তাই নয়, তাদের ভাষাও কিছু কিছু বুঝতে পারি।

তনি অবাক কণ্ঠে বলল, ওমা, তাই নাকি?

আমি কখনও মিথ্যা বলি না।

তা হলে শিয়ালের ডাক শোনান তো।

শিয়ালের ডাক এখন ডাকা যাবে না।

কেন?

শিয়ালের ডাক এখন ডাকলে গ্রামের সব কুকুরগুলো আপনাদের বাগানে ঢুকে পড়বে। তার চেয়ে ঘুঘু পাখির ডাক ডাকি, কি বলেন?

বেশ, তাই ডাকুন।

গালিব একটা জামগাছ দেখিয়ে বলল, আপনি ঐ গাছটার দিকে তাকান।

তনি জামগাছের দিকে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, গাছটার কোনো একটা ডালে বসে ঘুঘু ডাকছে।

সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গালিবের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?

দিনাজপুর জেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে।

সেতো বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে। তা এখানে মাকে নিয়ে এসেছেন কেন? আপনার বাবা ……..।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে গালিব বলল, আমরা দুই ভাই ও মা ছাড়া আর কেউ নেই।

আপনার আর এক ভাই কোথায়?

সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে।

মাকে নিয়ে এখানে এসেছেন কেন? বললেন না যে?

গালিব তার কথার উত্তর না দিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

তনি অধৈর্য গলায় বলল, কি হল, কিছু বলছেন না যে? এখন তো আমি রাগের সঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

গালিব কিছু না বলে গেটের দিকে মাথা নিচু করে চলে যেতে লাগল।

তনি রাগত স্বরে বলল, আমার কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন? দাঁড়ান।

গালিব না শোনার ভান করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।

তনি আরও রেগে গিয়ে কটমট করে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ছবি আঁকতে মন বসবে না চিন্তা করে সবকিছু নিয়ে ঘরে চলে গেল।

পরের দিন বাগানে ছবি আঁকতে আসার সময় ভাবল, গালিব যদি আজ আসেন, তা হলে কাল আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করবে। তারপর ইজেল টাঙ্গিয়ে গতকালের ছবিটায় কাজ শুরু করল। সন্ধ্যের আগে ছবির কাজ শেষ করে ফেরার সময় ভাবল, গালিব এলেন না কেন?

প্রায় দশ বার দিন হয়ে যাবার পরও যখন গালিব এল না তখন তনি ভাবল, গালিব এই গ্রামে মাকে নিয়ে এসেছেন বললেন, কোথায় থাকেন জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।

আজ কলেজ ছুটির পর তনির বান্ধবী কণা তাকে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, জানিস, আমাদের পোস্ট অফিসে একজন নতুন পোস্ট মাস্টার এসেছেন। বয়স তেমন বেশি না, দেখতে দারুন। কিন্তু কথাবার্তা শুনে মনে হল একদম হাঁদাকান্ত, কি করে যে পোস্ট মাস্টারের চাকরি পেলেন ভেবে পাচ্ছি না।

তার কথা শুনে তনির মনে হল, কয়েকদিন আগে যে ছেলেটা তাদের বাগানে ঢুকে আলাপ করেছিল সেই ছেলেটা। জিজ্ঞেস করল, পোস্ট মাস্টারের নাম জানিস?

হ্যাঁ, গালিব।

তনি মৃদু হেসে চুপ করে হাঁটতে লাগল।

কণা জিজ্ঞেস করল, কিরে, নাম শুনে হাসলি যে?

তনি বলল, ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। তবে উনি যে পোস্ট মাস্টার হয়ে এসেছেন, তা জানতাম না।

কণা অবাক হয়ে বলল, তোর সঙ্গে পরিচয় হল কি করে?

তনি কয়েকদিন আগে তাদের বাগানে পরিচয় হওয়ার কথা বলে জিজ্ঞেস করল, উনি থাকেন কোথায় জানিস?

কণা বলল, প্রথমে চাচাঁদের বাড়িতে মাকে নিয়ে কয়েকদিন ছিলেন। তারপর চাচাঁদের বাগান বাড়িতে যে পাকা দু’রুমের বাড়ি আছে, সেই বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন।

কিন্তু ওটাতো ভূতুড়ে বাড়ি। আগের পোস্ট মাস্টারকে ভূত গলাটিপে মেরে ফেলেছিল। সেকথা তুইও তো জানিস?

হ্যাঁ, জানি। চাচা ওনাকে সবকিছু খুলে বলেছেন। উনি ভূত-পেত্নী বিশ্বাস করেন না। চাচার কথা শুনে বলেছেন, হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। যার যাতে মৃতু লেখা আছে, তার তাতেই মৃত্যু হবে।

আচ্ছা, ওনার মায়ের সঙ্গে তোর পরিচয় হয়েছে?

হ্যাঁ, হয়েছে।

গালিব সত্যবাদী কিনা জানার জন্য তনি জিজ্ঞেস করল, বাড়ি কোথায় বলেছেন?

হ্যাঁ, তেঁতুলিয়া।

আমাকেও তাই বলেছেন। তা তুই ওনাকে হাঁদাকান্ত বললি কেন? যে লোক। ভূতুড়ে বাড়ি জেনেও সেখানে থাকেন, তিনি হাঁদাকান্ত হতে পারেন না। সেদিন কথা বলে আমার তো সেরকম কিছু মনে হয় নি, বরং খুব চালাক ও বুদ্ধিমান মনে হয়েছে।

কি জানি, আলাপ করে ওনাকে আমার তাই মনে হয়েছে।

কণাদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে পোস্ট অফিস। পোস্ট অফিসের সামনে দিয়ে তাদের বাড়িতে যেতে হয়।

ততক্ষণে তারা পোস্ট অফিসের কাছে চলে এসেছে। তনি বলল, চল না, ওনার সঙ্গে একটু আলাপ করি।

কণা বলল, বেশতো চল।

গ্রাম দেশের পোস্ট অফিস। মাটির দেয়াল, টিনের ছাউনির একটা রুম। একটা টেবিল, দুটো চেয়ার, একটা টুল, বহু পুরনো স্টীলের মরচে পড়া আলমারী ও দুটো কাঠের র‍্যাক। গালিব ও আধা বয়সী পিয়ন আব্দুর রহিম এখানে কাজ করে। আব্দুর রহিম এ পোস্ট অফিসে প্রায় পঁচিশ বছর কাজ করছে। এই গ্রামেরই লোক। ছোট বড় সবাই তাকে রহিম চাচা বলে ডাকে।

কণা ও তনি যখন সেখানে পৌঁছল তার আগে রহিম চাচা চিঠি বিলি করতে চলে গেছে। গালিব একা কাজ করছিল। তাদেরকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আপনারা কেমন আছেন?

তনি সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। আপনি কেমন আছেন?

গালিব বলল, আমিও ভালো। তারপর টুলটা টেবিলের নিচে থেকে বের করে বলল, একজন চেয়ারে ও একজন এটাতে বসুন। বসার পর জিজ্ঞেস করল, দুই সখির একসঙ্গে আসার কারণটা বললে খুশি হতাম।

তনি অবাক হয়ে বলল, আমরা যে দুই সখি, তা জানলেন কি করে?

আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছি, লেগে গেছে। এবার আসার কারণটা বলুন।

তনি বলার আগে কণা বলল, এক সখি আর এক সখির বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিল। আপনি পোস্ট মাস্টার জেনে দেখা করতে এসেছে।

শুনে আনন্দিত হলাম। সেজন্য আপনার সখিকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু আপনাদেরকে আপ্যায়ন করাতে পারছি না বলে আনন্দটা নিরানন্দ লাগছে।

নিরানন্দ লাগবে কেন? এখানে তো আপ্যায়ন করানোর সুযোগ সুবিধে নেই। যাকগে, এবার আসি হলে বলে তনি দাঁড়িয়ে কণাকে বলল, চল যাই।

কণা এতক্ষণ অবাক হয়ে চিন্তা করছিল, গালিব সাহেব কত সুন্দর করে তনির সঙ্গে কথা বলছেন আর তার সঙ্গে কিনা বোকা ও হাঁদাকান্তর মতো কথা বলেন। তনির কথা শুনে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ চল।

পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তনি বলল, তুই বললি কিনা উনি হাঁদাকান্ত, কই, সেরকম কিছু তো মনে হল না?

কণা বলল, হ্যাঁ, এতক্ষণ আমিও তাই ভাবছিলাম। কি জানিস, যতবার আমার সঙ্গে কথা বলেছেন ততবারই হাঁদাকান্তর মতো কথা বলেছেন। কিন্তু এখন তোর সঙ্গে ওনার কথাবার্তা শুনে ভীষণ অবাক হয়েছি। ব্যাপরটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমার মনে হয় উনি তোর সঙ্গে দুষ্টুমি করেছেন।

তোর কথা হয়তো ঠিক; কিন্তু শুধু শুধু আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করবেন কেন?

তনি হেসে উঠে বলল, আবার দেখা হলে সেকথা জিজ্ঞেস করে নিস?

ততক্ষণে তারা কণাদের ঘরে পৌঁছে গেল। তনির কথা শুনে বলল, তাতে করবই। এখন ওনার কথা বাদ দে। তারপর সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোনে এসে উঁচু গলায় বলল, মা, তোমার সই-এর মেয়েকে নিয়ে এসেছি। দু’জনের খানা রেডি কর।

তনির মা মুনসুরা বেগম ও কণার মা মাজেদা বেগম একই গ্রামের মেয়ে। ছোটবেলা থেকে দু’জনের মধ্যে খুব ভাব। তাই তারা তখন থেকে সই পাতিয়েছিল। বড় হয়ে বলাবলি করত, আল্লাহ যদি তাদেরকে দু’জা করত, তা হলে তাদের এই সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকত।

আল্লাহ তাদের আশা সম্পূর্ণ পূরণ না করলেও একই গ্রামের দুই ধনী পরিবারের বৌ হয়েছে। স্বামীরা তাদের সম্পর্কের কথা জেনে তখন থেকে এখন পর্যন্ত সেই সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যবস্থা করেছেন।

ওনাদের মেয়ে কণা ও তনি তাদের মায়েদের মতো যেমন একসঙ্গে লেখাপড়া করছে, তেমনি সইও পাতিয়েছে। সেকথা তাদের মা-বাবা জেনে দুই পরিবারের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। কণার মা বাবা তনিকে ছেলে আমজাদের বৌ করতে চান। তনির কোনো বড় ভাই না থাকায় তার মা বাবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কণাকে ছেলের বৌ করতে পারছেন না। দুই পরিবার একই গ্রামের হলেও দুই প্রান্তে। দূরত্ব এক কিলোমিটার।

মাজেদা বেগম মেয়ের কথা শুনে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ ফেলে বেরিয়ে এলেন।

তনি সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, সইমা কেমন আছেন?

মাজেদা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায়, কপালে ও দু’গালে চুমো খেয়ে বললেন, এতদিন পর সইমার কথা মনে পড়ল বুঝি? তারপর আল্লাহর রহমতে ভালো আছি বলে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা-বাবা ভালো আছেন?

তনি বলল, জি, ওনারা ভালো আছেন। খালুজান কোথায়? উনি কেমন আছেন?

উনিও ভালো আছেন। কামলাদের সঙ্গে মাঠে গেছেন, এখনও ফেরেন নি। যাও মা কণার সঙ্গে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে বস। আমি তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

বিকেলে তনি ফেরার সময় সইমা ও খালুজানকে তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসার কথা বলল। তারপর কণাকে বলল, কাল তুই কলেজ থেকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা সইমাকে বলে যাবি।

ফেরার পথে পোস্ট অফিস বন্ধ দেখে তনি ভাবল, খোলা থাকলে সেদিনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে এলেন কেন জিজ্ঞেস করা যেত।

গ্রামের মাঝখানের পাড়ায় মসজিদ। মসজিদের পাশ দিয়ে রাস্তা। তনি দূর থেকে দেখতে পেল মসজিদের সামনে অনেক লোকের ভীড়। তাদের মধ্যে বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে। মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গালিবকে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে শুনেও দাঁড়ান ঠিক হবে না ভেবে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে আব্বা ঘরে এলে জিজ্ঞেস করল, মসজিদ সামনে কি হয়েছিল?

রুহুল আমিন বললেন, আগে একদিন লুঙ্গী ও পায়জামার ঝুল খাড় গাঁটের নিচে পরা নিয়ে ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল পোস্ট মাস্টারের। আজ আবার পিরানের ঝুল ছোট করে খাড় গাঁটের উপরে করার কথা বলতে ইমাম সাহেব রেগে গিয়ে তর্কাতর্কি করছিলেন। এই ব্যাপার নিয়ে মুসুল্লীদের মধ্যে দুটো দল হয়েছে। একদল বলছে, ইমাম সাহেব আলেম লোক। ওনার চেয়ে কি পোস্ট মাস্টার বেশি জানে? অন্যদল বলছে, পোস্ট মাস্টার আলেম না হলেও ঠিক কথা বলেছেন।

তনি বলল, আমিও তো জানি পুরুষদের খাড় গাঁটের নিচে লুঙ্গী, পায়জামা বা জামা ঝুলিয়ে পরা শরীয়তে নিষেধ। আর মেয়েদের খাড় গাঁটের উপরে পরা শরীয়তে নিষেধ।

রুহুল আমিন বললেন, হ্যাঁ মা, তুই ঠিক বলেছিস। পোস্ট মাস্টারও তাই বলেছেন। কিন্তু ইমাম সাহেব বলছেন, পায়ে মোজা পরা থাকলে লুঙ্গী, পায়জামা ও জামার ঝুল খাড় গাঁটের নিচে পরা জায়েয। আর পোস্ট মাস্টার বলছেন, কোন অবস্থাতেই লুঙ্গী, পায়জামা বা জামার ঝুল খাড়গাঁটের নিচে পরা জায়েয হবে না। এ ব্যাপারে উনি দুটো হাদিস উল্লেখ করেছেন। প্রথম হাদিসটা হল, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলিয়াছেন, “পায়ের গোড়ালীর নিম্নে পায়জামার যে অংশ ঝুলতে থাকে, তা দোযখের অগ্নিতে অবস্থিত।” [বর্ণনায় : হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বুখারী]

দ্বিতীয় হাদিস হল, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি পায়জামা, লম্বা জুব্বা এবং পাগড়ী অহঙ্কার সহকারে দীর্ঘ করে ঝুলাইয়া রাখে, বিচারের দিন আল্লাহ তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবেন না।” [বর্ণনায় : হযরত সালেম (রাঃ)–আবু দাউদ, নেসায়ী, ইবনে মাজা।]

তনি বলল, আপনি কার কথা সাপোর্ট করেন? রুহুল আমিন বলল, পোস্ট মাস্টারের। আমার মনে হয়, উনি ইমাম সাহেবের চেয়ে বড় আলেম।

শেষ-মেস কি ফায়সালা হল?

ফায়সালা হয়নি। গ্রামের পাঁচজন রায় দিয়েছে, দু’জন লোক ঢাকায় গিয়ে মুফতি বোর্ডের কাছ থেকে ফায়সালা নিয়ে আসবে। অবশ্য প্রস্তাবটা পোস্ট মাস্টারই প্রথম দেন।

হ্যাঁ, সেটাই ভালো।

খালেক উজ্জামান মসজিদের মতোয়াল্লী। ওনাদের পূর্বপুরুষরা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। বংশ পরম্পরায় ওনারই মসজিদ পরিচালনা করে আসছেন। পূর্বপুরুষদের মতো এখন আর্থিক অবস্থা না থাকলেও যা কিছু আছে ততেই উনিই গ্রামের মধ্যে সব থেকে অবস্থাপন্ন। উনি দাখিল পাস। সেই বিদ্যা ও আর্থিক অবস্থার কারণে গ্রামের সর্বেসর্বা। গ্রামে আরও যে দু’চারজন অবস্থাপন্ন লোক আছেন, তারা অল্প শিক্ষিত। তা ছাড়া মাদরাসা লাইনেও পড়াশোনা করেন নি। তাই ধর্মীয় ব্যাপারে খালেক উজ্জমান যা বলেন সবাই মেনে নেন। তিনি পোস্ট মাস্টারের কথায় খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

.

অধ্যায় ১ / ১১

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন