ইডিপাস (নাটক)

কবীর চৌধুরী

রাজা ইডিপাস নাটকের কুশীলব

ইডিপাস : থীবির রাজা
ইয়োকাস্তা : ইডিপাসের স্ত্রী
ক্রিওন : ইয়োকাস্তার ভ্রাতা
টাইরেশিয়াস : অন্ধ ভবিষ্যদ্বক্তা জনৈক পুরোহিত
জনৈক বার্তাবহ
জনৈক মেষপালক
জনৈক সহচর
থীবির বয়োজ্যেষ্ঠদের কোরাস
রাজার সহচরবৃন্দ
রানীর সহচরীগণ
থীবির জনগণ

.

দৃশ্যপট : থীবির রাজপ্রাসাদের সম্মুখে, সিঁড়ির উপর এবং সম্মুখ চত্বরে অবস্থিত পূজাবেদিগুলির চারপাশে থীবির বহু নাগরিক দলে দলে বিভক্ত হয়ে বসে আছে, সানুনয় প্রার্থনার ভঙ্গিতে।

[ সহচরবৃন্দ পরিবৃত ইডিপাস মাঝের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। ]

ইডিপাস :

সন্তানগণ, ক্যাডমাসের প্রাচীন বংশের নতুন প্রজন্মের সদস্যরা, এই সানুনয় প্রার্থনার ভঙ্গির অর্থ কী? এই সব শাখা প্রশাখা আর মালা, নগরময় এই ধূপধুনা, ব্যথা প্রশমনের এই সব প্রার্থনা, শোকের এইসব প্রকাশ—কি অর্থ এই সবের? আমার বার্তাবহদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঠিক হবে না বিবেচনা করে সব কিছু জানার জন্য আমি নিজে এখানে এসেছি—আমি, ইডিপাস, যার নাম দূরদূরান্তে সুবিদিত। (পুরোহিতকে লক্ষ্য করে) শ্রদ্ধেয় মহোদয়, বয়সের দাবিতে সকলের হয়ে আপনারই কথা বলা উচিত। কি ব্যাপার?

ভয়ের কিছু ঘটেছে? কিছু চাই আপনাদের? আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমি সাগ্রহে সব কিছু করব। বস্তুতপক্ষে আমি যদি এই রকম একটি সর্বজনীন আবেদনের প্রতি আমার কান বন্ধ করে রাখি তাহলে আমি নিজেকে একজন নিতান্ত হৃদয়হীন ব্যক্তি প্রতিপন্ন করব।

পুরোহিত :

আমার প্রভু, রাজন : আমরা এখানে সমবেত হয়েছি, যেমন আপনি দেখছেন, তরুণ এবং বৃদ্ধরা, কচি বাচ্চা থেকে বয়সের ভারে ন্যুব্জদেহ প্রবীণরা; আর পুরোহিতগণ—আমি জিউসের পুরোহিত—আর আমাদের সেরা যুবকরা। আরো অনেকে বসে আছে বাজারে, সবার হাতে এই রকম বৃক্ষশাখা, আর প্যালাসের জোড়া-বেদি এবং ভবিষ্যৎকথনের পবিত্র অঙ্গারকে ঘিরে ইসমেনুস নদীর তীরে বসে আছে আরো অনেকে।

আপনিও দেখেছেন আমাদের নগরীর দুঃখ-যন্ত্রণা, মৃত্যুর একটা জোয়ারে ধৃত, যা থেকে পালাবার কোনো উপায় নেই—মাটির ফলবান বিকাশের কালে মৃত্যুর এই আবির্ভাব; চারণভূমিতে মৃত্যু; নারীর গর্ভে মৃত্যু; আর মহামারী, একটা অগ্নিদানব নগরীকে খামচে ধরেছে, নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে ক্যাডমাসের বংশকে, নরককে স্ফীত করে তুলছে হাহাকারের প্রাচুর্যে।

আমরা যদি এখন, রাজন, আপনার করুণাপ্রার্থী হয়ে আপনার কাছে এসে থাকি, আমি এবং এই সব সন্তান, তার কারণ এই নয় যে আমরা আপনাকে দেবতাদের সমতুল্য গণ্য করি, বরং আমরা আপনাকে মনে করি মানবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, মরণশীল জগতের সাধারণ কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যেমন, মানুষের চাইতে বড়োর সঙ্গে মানুষের মোকাবেলার ক্ষেত্রেও তেমনি। আমাদের মনে আছে, ক্যাডমাসের এই নগরীতে আপনি তখন নবাগত, আপনিই ওই কুৎসিত মায়াবিনীর বন্দিত্ব থেকে আমাদের মুক্ত করেন। আমাদের কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না, কোনো ইঙ্গিত আমরা আপনাকে দিতে পারি নি, কিন্তু আপনি, আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি, বিধাতার সহায়তায় আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের প্রাণ।

এখন, মহান ও গৌরবদীপ্ত ইডিপাস, আমরা আবার আপনার সহায়তা কামনা করছি। আমাদের মুক্তির একটা পথ খুঁজে বের করুন, দেবতা বা মানুষ-প্রদর্শিত যাই হোক না কেন। আমরা জানি, অতীত প্রয়াসের অভিজ্ঞতা বর্তমান পরামর্শের ক্ষেত্রে শক্তি যোগায়। অতএব, হে মানবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জন, আমাদের নগরীর মধ্যে পুনর্বার প্রাণ ফিরিয়ে আনুন। আপনার গৌরব সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আপনার অধ্যবসায় একবার আমাদেরকে রক্ষা করেছিল। একথা যেন বলা না হয় যে আপনার রাজত্বকালে আমরা ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হয়েছিলাম শুধু নিম্নে পতনের জন্য। রক্ষা করুন, রক্ষা করুন আমাদের নগরী, এবং তাকে নিরাপদ রাখুন চিরদিনের জন্য।

সেদিন যে উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের সৌভাগ্য প্রদান করেছিল আজও আপনি আমাদের সেই পথে নিয়ে যান। আপনাকে যদি আমাদের নৃপতি হতে হয়, এখন আপনি যেমন আছেন, তাহলে জীবন্ত মানুষের নৃপতি হন, শূন্যতার নয়। নিশ্চিতভাবেই প্রাচীর কিংবা (রণ) তরীর মধ্যে কোনো শক্তি নেই যদি না সেখানে মানুষ থাকে, যদি না মানুষের নিঃশ্বাস সেখানে প্রাণ সঞ্চার করে।

ইডিপাস :

হে আমার সন্তানগণ, আমি তোমাদের জন্য গভীর দুঃখ বোধ করছি। বিশ্বাস করো, তোমরা আমার কাছ থেকে কী চাও, তোমরা এখন যে কষ্ট ভোগ করছো, সব আমি জানি। আর এখন তোমরা যে কষ্ট ভোগ করছো তা আমার কষ্টভোগের চাইতে বেশি নয়। তোমাদের আছে নানা দুঃখ, প্রত্যেকের নিজের নিজের দুঃখ, কিন্তু আমার অন্তর বহন করে আমার নিজের দুঃখের ভার, আর সেই সঙ্গে তোমাদের, আমার সমগ্র জনগণের দুঃখের বোঝা। আমি নিদ্রিত নই। আমি ক্রন্দন করছি। অন্তহীন চিন্তার সড়ক দিয়ে আমি পদচারণা করছি।

কিন্তু আমি অলস হয়ে বসে থাকি নি। ইতিমধ্যে আমি একটি কাজ করেছি। আমি আমার আত্মীয়, মেনোকিয়াসের পুত্র ক্রিওনকে অ্যাপোলের পিথিয়ান ভবনে’ পাঠিয়েছি, তিনি জেনে আসবেন আমার কোন কর্ম বা কোন বাক্য তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। আমার হিসাব অনুযায়ী আজই তাঁর ফিরে আসবার কথা। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কেন তিনি এখনো ফিরে আসেন নি।

কিন্তু তিনি আসার পর, এই আমি কথা দিচ্ছি, দেবতা যা চান তাই করা হবে।

পুরোহিত :

উত্তম বলেছেন আপনি।

[ তিনি দূরে একজনকে দেখতে পান। এদিকে এগিয়ে আসছে সে। ]

ওই দেখুন! ওরা হাত নেড়ে দেখাচ্ছে যে ক্রিওন এগিয়ে আসছেন। হ্যাঁ, এই তো তিনি এসে পড়েছেন।

ইডিপাস :

(তিনিও দেখতে পান) আর ওঁর মুখ হাস্যোজ্জ্বল! ও অ্যাপোলো! ওঁর সংবাদ যদি শুভ হয়!

পুরোহিত :

অবশ্যই শুভ হবে। ওঁর মাথায় পাকা রসালো ফলের পত্রপল্লবের মুকুট শোভা পাচ্ছে। একটা নিদর্শন ওটা।

ইডিপাস :

শীঘ্রই আমরা জানতে পারবো। …এখন আমাদের কথা তিনি শুনতে পাবেন। … । রাজকীয় ভ্রাতা আমাদের! কী সংবাদ? ঈশ্বরের কী বার্তা আছে আমাদের জন্য?

[ক্রিওনের প্রবেশ]

ক্রিওন :

সুসংবাদ। মানে, শুভ দেখা দিতে পারে। সব যদি ঠিক মতো চলে তাহলে বেদনাদায়ক বিষয়ের মধ্য থেকেও মঙ্গল বেরিয়ে আসতে পারে।

ইডিপাস :

আর উত্তর? আপনি আমাকে ভয় আর আশার মধ্যে দোলাচলে রাখছেন। কি উত্তর পেয়েছেন?

ক্রিওন :

আপনি চাইলে, সকলের সামনে শুনতে চাইলে, আমি এখানেই আপনাকে বলবো। নইলে চলুন, ভেতরে যাই।

ইডিপাস :

সকলের সামনেই বলুন। এখন আমি আমার নিজের জীবনের চাইতেও তাদের অবস্থা নিয়ে বেশি চিন্তিত।

ক্রিওন :

তাহলে, শুনুন, সুস্পষ্ট আদেশ এসেছে আমাদের প্রভু ফিবাসের কাছ থেকে। আমাদের এখানে একটা অশুচি জিনিস আছে। এখানেই সে জন্মগ্রহণ করেছে, এখানেই বড় হয়েছে, সে আমাদের এই ভূমিকে অশুচি করে দিচ্ছে। তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে, আমাদের দেশকে ধ্বংস করে দেবার জন্য তাকে এখানে রাখা যাবে না।

ইডিপাস :

কি অশুচি জিনিস? কি শুদ্ধি প্রক্রিয়া প্রয়োজন আমাদের?

ক্রিওন :

একটি ব্যক্তির নির্বাসন, অথবা রক্তের বদলে রক্তের মূল্য দান। কারণ রক্তপাতই আমাদের নগরীর সকল বিপদের কারণ।

ইডিপাস :

উনি কোন রক্তের কথা বলছেন? কে মারা গেছেন তার কথা কি উনি বলেছেন?

ক্রিওন :

আপনি আমাদেরকে নেতৃত্ব দিতে আসার আগে আমাদের একজন রাজা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল লেয়াস।

ইডিপাস :

আমি জানি। তবে তাঁকে আমি দেখি নি।

ক্রিওন :

তিনি নিহত হন। আর দেবতার আদেশের সুস্পষ্ট অর্থ হলো, ওই অজানা হত্যাকারীকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।

ইডিপাস :

কিন্তু কোথায় তাকে পাওয়া যাবে? অতো দিন আগের ওই অপরাধের ধূসর চিহ্নাবলি কোথায় আবিষ্কারের আশা করতে পারি আমরা?

ক্রিওন :

দেবতা বলেছেন, এখানেই। অন্বেষণ করলে পাবে, না করলে অনাবিষ্কৃত থেকে যাবে।

ইডিপাস :

কোথায় লেয়াস মৃত্যু বরণ করেন, তাঁর ওই হিংস্র মৃত্যু? তা কি গৃহে, অথবা প্রান্তরে অথবা বিদেশের মাটিতে?

ক্রিওন :

তিনি বলেন যে তিনি তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। তার পর থেকে আমরা আর তাঁকে কখনো দেখি নি।

ইডিপাস :

কোনো খবর পাওয়া যায় নি? কী ঘটেছে তা দেখার মতো এমন কোনো সঙ্গী পাওয়া যায় নি. যার সাক্ষ্য আমরা কাজে লাগাতে পারতাম?

ক্রিওন :

সবাই মারা যায়, কেবল একজন ছাড়া, যে ভয়ে দিশাহারা হয়ে পালিয়ে আসে, আর সে-ও নিশ্চিতভাবে একটা জিনিস ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না।

ইডিপাস :

সেটা কী? আমরা যদি সামান্যতম যোগসূত্র খুঁজে পাই তাহলে ওই একটি সূত্র হয়তো অনেক কিছুর দিকনির্দেশনা দেবে।

ক্রিওন :

ওই লোক বলেছে যে ডাকাত দল, একজন নয়, অনেকজন, রাজকীয় বহরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদেরকে হত্যা করে।

ইডিপাস :

আর কেউ তাদেরকে অর্থ দিয়ে নিয়োজিত না করলে সাধারণ ডাকাতদের পক্ষে ওই রকম দুঃসাহসিক হামলা চালাবার কথা নয়।

ক্রিওন :

একথা উঠেছিল। কিন্তু এরপর যেসব ঝামেলা শুরু হয় তার কারণে কোনো প্রতিহত্তা খুনীদের শাস্তি দেবার জন্য এগিয়ে আসে নি।

ইডিপাস :

কি ঝামেলা? একটি রাজকীয় হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানে বাধা দেবার মতো কোনো ঝামেলা নিশ্চয়ই ঘটতে পারে না?

ক্রিওন :

স্ফিংস তার ধাঁধা দিয়ে আমাদের মনোযোগ অসমাধানযোগ্য রহস্যাবলি থেকে আরো তাৎক্ষণিক বিষয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।

ইডিপাস :

আমি আবার গোড়া থেকে শুরু করব। আমি সত্য ঘটনা আবিষ্কার করব। সকল প্রশংসা ফিবাসের—আর আপনার ভূমিকার জন্য আপনাকেও আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি, মৃতের প্রতি আমাদের কর্তব্য আপনি নির্দেশ করেছেন। ঈশ্বর এবং আমাদের দেশের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে আপনি আমাকে সর্বদা একজন আগ্রহী মিত্র হিসাবে পাবেন। কাজটা আমারও। এই কলঙ্ক থেকে আমি শুধু অন্যদেরকে মুক্ত করব না, আমার নিজেকেও মুক্ত করব। লেয়াসের হত্যাকারী, সে যেই হোক না কেন, সে হয়তো আমার বিরুদ্ধেও তার হাত ওঠাবার কথা ভাবতে পারে। আর তাই লেয়াসের জন্য কিছু করার অর্থ হবে আমার নিজের জন্যও কিছু করা।

এবার, আমার সন্তানগণ, তোমাদের আসন ছেড়ে তোমরা ওঠো। এইসব তরুশাখা সরিয়ে নাও! ক্যাডমাসের সকল লোককে এখানে নিয়ে এসো। তাদের বলো যে এমন কিছুই নেই যা আমি করব না। এটা নিশ্চিত যে ঈশ্বরের সহায়তায় আমরা হয় সফল হবো, নয়তো ব্যর্থকাম।

[ইডিপাস প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলে যান। একজন বার্তাবহ জনগণকে ডেকে আনতে যায়। পুরোহিত অনুগ্রহপ্রার্থীদের বিদায় দেন।]

পুরোহিত :

ওঠো তোমরা। আমরা যা চাইতে এসেছিলাম রাজা তার সব কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখন চলো, যার কাছ থেকে উত্তর এসেছে আমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি নিজে এসে আমাদেরকে এই কঠিন দুঃখযন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা করেন, মুক্তি দেন।

[অনুগ্রহপ্রার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ]

[থীবির প্রবীণদের কোরাস প্রবেশ করে]

কোরাস :

আলোর নগরী থীবিতে পিথীয় স্বর্ণালি ভবন থেকে স্বর্গের উদার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। আতঙ্কে আমার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, কী উচ্চারিত হবে সেই আতঙ্কে। ও ডেলসের ভিষক, শুনুন। কী করবেন আপনি? নতুন কিছু, নাকি চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান বছরের মতো পুরনো জিনিস। বলুন, সোনালি আশার কন্যা! উচ্চারিত হোক মৃত্যুহীন বার্তা। মৃত্যুহীন এথেনা, জিউসের কন্যা, প্রথমে আমরা আবেদন জানাচ্ছি আপনার কাছে। তারপর আপনার ভগ্নি রানী আর্টেমিসের কাছে, যিনি আমাদের নগরীতে সম্রাজ্ঞীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, আর তারপর ধনুকের প্রভু ফিবাসের কাছে। এই ক্ষণে, বহু কাল আগের মতো, আপনারা আবার আপনাদের ত্রিধারা শক্তি প্রদর্শন করুন, রক্ষা করুন আমাদেরকে আগুন আর মহামারীর দুঃখ-যাতনা থেকে এবং পরিশুদ্ধ করে তুলুন আমাদের। অবর্ণনীয় দুঃখ, সর্বত্র রোগব্যাধি সুবিস্তৃত, আরোগ্যের কোনো উপায় নেই আমাদের হাতে, নিষ্ফলা জমিতে যাবতীয় উদ্ভিদ রোগাক্রান্ত, জন্মের ক্ষেত্রেও নিষ্ফল তীব্র যন্ত্রণা। প্রাণের পর প্রাণ দাবানল থেকে উদ্ভূত হয়ে দ্রুত উড়ে যাচ্ছে নিশীথের অন্ধকারে।

বলে শেষ করা যায় না, নগরীর পথে-ঘাটে এখন মৃত্যুর তীব্র দুর্গন্ধ। কেউ কাঁদে না, শিশুরা মরে যায়, সহানুভূতি জানাবার জন্যও কেউ নেই। প্রতিটি বেদিতে মায়েরা নতজানু হয়ে আছে। স্বর্ণালি এথেনা, আমাদের ক্রন্দনে সাড়া দিন। অ্যাপোলো, আমাদের প্রার্থনা শুনুন, আমাদের নিরাময় করুন!

বজ্রের ঝনঝনানি নেই, কিন্তু আমাদের ঘিরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে, মরণ- রাক্ষুসী উড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের চারপাশে। তার অস্ত্রসম্ভারকে ছুড়ে ফেলে দিন সাগরের সুদূরতম কোণে কিংবা বিবর্ণ উত্তর উপসাগরের কোনো অঞ্চলে। রাত্রির যন্ত্রণা নিপীড়িত দিন পর্যন্ত গড়ায়, জিউস, আপনার বজ্র দিয়ে ওইসব চূর্ণ করে দিন, আপনার বিদ্যুৎ-বহ্নি দিয়ে ওই সব জ্বালিয়ে দিন!

লাইসিয়ান, আপনার সোনালি ধনুক দিয়ে তাকে হত্যা করুন। আর্টেমিস, লাইসীয় পর্বতমালার উপর সমুজ্জ্বল, তাকে হত্যা করুন। ব্যাকাস, যে দেবতার নামে আমাদের নাম, মীনাড নৃত্যে যিনি স্বর্ণাভ, ইউই, আপনার অগ্নিময় আলো নিয়ে অগ্রসর হন, মৃত্যু-দেবতাকে, নিষ্ঠুর শত্রুকে, হত্যা করতে হবে, ওই দেবতাকে যাকে আর সব দেবতা ঘৃণা করে।

[রাজপ্রাসাদ থেকে ইডিপাস প্রবেশ করেন। ]

ইডিপাস :

তোমরা আবেদন করেছো এবং তোমাদের আবেদনের উত্তরে তোমরা পাবে সাহায্য এবং নিষ্কৃতি, যদি তোমরা আমার নির্দেশ পালন করো এবং তোমাদের দুর্দশা থেকে মুক্তি পাবার যে নিদান আছে সেই কাজে আমাকে সহায়তা দাও। আমি একজন পরদেশি হিসাবে বলছি, যা শুনেছি তার ভিত্তিতে এবং যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তিতে আমি বলছি, ওই সূত্র ছাড়া আমার অনুসন্ধান কাজে এগিয়ে যাবার মতো আর কিছুই তো আমার হাতে নেই। তাই, তোমাদের মধ্যে নতুন গৃহীত এক নাগরিক রূপে আমি তোমাদের উদ্দেশে, থীবিয়দের উদ্দেশে, এই ঘোষণা দিচ্ছি : তোমাদের মধ্যে যদি কেউ জানো কে ল্যাবডাকাসের পুত্র লেয়াসকে হত্যা করেছে, তাহলে সে এখনি তা পুরোপুরি ঘোষণা করুক, এখনই, আমার কাছে।

[তিনি একটু বিরতি দেন। সবাই নীরব]

আর যদি কারো বিবেক অপরাধের গ্লানি বহন করে তাহলে সে এখন আত্মসমর্পণ করুক, সেক্ষেত্রে তার দণ্ড হবে লঘু। তার শাস্তি নির্বাসন দণ্ডের চাইতে বেশি কিছু হবে না। আর অন্য কোনো ক্ষতি তাকে স্পর্শ করবে না।

[তখনো সবাই নীরব থাকে]

কিংবা, যদি ওই হত্যাকারী বিদেশি কেউ হয় তাহলে তাও প্ৰকাশ করো। তথ্য প্রদানকারীকে আমি পুরস্কৃত করবো, তাছাড়া তোমাদের সকলের সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদও সে লাভ করবে।

[নীরবতা অব্যাহত থাকে]

কিন্তু—তোমরা যদি কেউ কোনো কথা না বলো, ভয়ে, এবং পরে যদি দেখা যায় যে নিজেকে কিংবা অন্য কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করেছো সেক্ষেত্রে তাকে কী শাস্তি দেওয়া হবে তার কথা আমি এখনই উচ্চারণ করছি। সে যেই হোক না কেন, আমার রাজত্বের কোথাও কেউ তাকে আশ্রয় দেবে না, কেউ তার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক রাখবে না। প্রার্থনা অথবা বলিদান অথবা আনন্দময় কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান তার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। পিথীয় দৈববাণীর নির্দেশ অনুযায়ী ওই কলুষিত ও অভিশপ্ত ব্যক্তির জন্য সকল গৃহের দ্বার থাকবে রুদ্ধ। এইভাবেই আমি দেবতা এবং মৃতের প্রতি আমার কর্তব্য পালন করবো। আর আমার আন্তরিক প্রার্থনা, অজানা ওই হত্যাকারী এবং ওই দুষ্কর্মে তার সঙ্গীরা, যদি তেমন কেউ থাকে, তারা যেন তাদের চরম লজ্জাকর ও ঘৃণ্য কর্মের জন্য চিরকাল কলঙ্কের বোঝা বহন করে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যেন তাদের নির্বান্ধব জীবন কাটাতে হয়। আর এই অভিশম্পাত থেকে আমি আমার নিজেকেও অব্যাহতি দিচ্ছি না। আমি যদি স্বজ্ঞানে আমার গৃহে ওই অপরাধী ব্যক্তিকে আশ্রয় দিই তাহলে যেসব অভিশাপ আমি অন্যদের সম্পর্কে উচ্চারণ করেছি তার সব যেন আমার উপরেও বর্ধিত হয়। এখন আমার প্রতি, দেবতার প্রতি, আমাদের যন্ত্রণাপীড়িত দেশের প্রতি তোমাদের কর্তব্যবোধ থেকে তোমাদের দেখতে হবে আমার নির্দেশাবলি যেন যথাযথভাবে পালিত হয়। সত্যি বলতে কি, বিধাতার সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়াই এখনো এখানে যে কোনো শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয় নি তা আমাকে বিস্মিত করে। ওই রকম একজন গুণী ব্যক্তি, তোমাদের রাজা, তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে আরো জোরালো অনুসন্ধান কর্ম পরিচালনা করা উচিত ছিল। সে যাই হোক, আমি এখন তাঁর স্থানে অধিষ্ঠিত, তাঁর শয্যায়, তাঁর স্ত্রী এখন আমার স্ত্রী, নিয়তি ইচ্ছা করলে তাঁর সন্তানরা এখন আমাদের মধ্যে নতুন একটি রক্তের বন্ধন সৃষ্টি করতো, কিন্তু চরম দুর্ভাগ্য আমাদের, ওই বিপর্যয় আমাদের উপর নেমে আসে। তবে এখন আমি তাঁর হয়ে লড়বো, আমার নিজের পিতা হলে যেভাবে লড়তাম ঠিক সেইভাবে, এবং অ্যাগেনরের পুত্র ক্যাডমাস, ক্যাডমাসের পুত্র পলিডোরাস, পলিডোরাসের পুত্র ল্যাবডাকাস এবং ল্যাবডাকাসের পুত্র লেয়াসের হত্যাকারীকে শনাক্ত করার জন্য আমি কোনো প্রয়াস বাদ দেবো না।

এক্ষেত্রে আমার নির্দেশ যারা অমান্য করবে দেবতাদের অভিশাপ তাদের উপর পড়বে। তাদের জমিতে কোনো ফসল ফলবে না, তাদের স্ত্রীরা হবে বন্ধ্যা, এবং এই দুর্দশা, এর চাইতেও বেশি দুর্দশা, তাদের আমৃত্যু তাড়া করবে। আর বাকি সবাই, ক্যাডমাসের যে সব পুত্র আমার পক্ষে আছো, দেবতাগণ আর ন্যায়বিচার যেন সর্বদা তোমাদের পক্ষে থাকে।

কোরাস :

রাজা, আপনি অভিশাপ বাণী উচ্চারণ করেছেন, তার উত্তরে আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে ওই ব্যক্তি আমি নই আর কে ওই ব্যক্তি তাও আমি আপনাকে দেখিয়ে দিতে পারবো না। প্রশ্নটা এসেছে ফিবাসের কাছ থেকে। যদি কেউ পারে তাহলে নিশ্চিতভাবে তিনিই অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারেন।

ইডিপাস :

এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো দেবতার মুখ থেকে কথা বের করে আনা মরণশীল মানুষের সাধ্যাতীত।

কোরাস :

আমার আরেকটা কথা বলার আছে।

ইডিপাস : বলো। একটা কেন, দ্বিতীয়, তৃতীয়, যা তোমার বলার আছে সব বলো। আমি তোমাদের সব কথা শুনবো।

কোরাস :

মহান টাইরেশিয়াসের অবস্থান প্রভু ফীবাসের সব চাইতে কাছে, আমি বলছি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসাবে তাঁর অবস্থানের কথা। আমাদের অনুসন্ধান কর্মে তিনিই আমাদেরকে সব চাইতে বেশি সাহায্য করতে পারবেন।

ইডিপাস :

আমি এটা উপেক্ষা করি নি। তাঁকে আনতে লোক পাঠানো হয়েছে। ক্রিওনও ওই পরামর্শ দিয়েছে। উনি যে এখনো এখানে এসে পৌঁছান নি তাতে আমি অবাক হচ্ছি।

কোরাস :

ওই ঘটনা, অবশ্য, অনেক গুজবের জন্ম দিয়েছিলো। যদিও সবই নিছক গালগল্প।

ইডিপাস :

গুজব? কি গুজব? আমাকে সব কিছু শুনতে হবে।

কোরাস :

তিনি নাকি রাস্তার উপরে পথিকদের হাতে নিহত হন।

ইডিপাস :

আমিও একথা শুনেছি। কিন্তু এর সাক্ষী কোথায়?

কোরাস :

আপনার অভিশাপ বাণী শোনার পর এ বিষয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে হলে তাকে অত্যন্ত সাহসী একজন ব্যক্তি হতে হবে।

ইডিপাস :

যে দুষ্কর্মটি সাধনে সঙ্কোচ বোধ করে নি সে কি কথার ভয়ে ভীত হবে?

কোরাস :

তাকে খুঁজে বের করতে সক্ষম এমন একজন আছেন। ওই ভবিষ্যৎদ্রষ্টাকে এখন নিয়ে আসা হচ্ছে। তাঁর মধ্যেই বাস করে মূর্তিমান সত্য।

[টাইরেশিয়াস প্রবেশ করে, অন্ধ, একজন সহচর তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে।]

ইডিপাস :

টাইরেশিয়াস, আমরা জানি যে আপনার দৃষ্টির অগম্য কিছুই নেই। ঐশ্বরিক কিংবা ইহজাগতিক, স্বর্গীয় এবং পার্থিব, সকল বিদ্যা আপনার করায়ত্ত। চোখে না দেখলেও আমাদের নগরীর অবস্থা আপনি আপনার অন্তর দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন : আমাদের একমাত্র সাহায্যকারী এবং রক্ষক হিসাবে আমরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছি। ওরা হয়তে। আপনাকে বলেছে যে আমরা ফীবাসের কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম এবং তিনি তাঁর উত্তর জানিয়েছেন। আমাদের এই বিপর্যয় থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো লেয়াসের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের হত্যা অথবা নির্বাসিত করা। এখন, মান্যবর, যে জ্ঞান আপনার আয়ত্তাধীন তার সবটুকু প্রয়োগ করতে দ্বিধা করবেন না। এটা আপনার জন্য। এটা থীবির জন্য, এটা আমার জন্য। আসুন, আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। ওই মৃত্যু দ্বারা যা কিছু কলুষিত হয়েছে তার হাত থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন। আমরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছি। সমস্ত শক্তি দিয়ে সঙ্গী মানুষদের সাহায্য করা একজন মানুষের মহত্তম কর্ম।

টাইরেশিয়াস :

নিঃসন্দেহে প্রাজ্ঞ উচ্চারণ, কিন্তু প্রজ্ঞা যখন কোনো কাজে আসে না তখন প্রজ্ঞার অর্থ হলো দুঃখযন্ত্রণা ভোগ করা। আমি এটা খুব ভালো করে জানতাম, তাহলে কেন আমি সে কথা ভুলে গিয়েছিলাম? আমার এখানে আসা কোনোক্রমেই উচিত হয় নি।

ইডিপাস :

মনে হচ্ছে আপনার কাছ থেকে আমরা উৎসাহব্যঞ্জক কিছু পাবো না।

টাইরেশিয়াস :

আমাকে বাড়ি যেতে দিন। তার ফলে আপনার বোঝা বহন করা আপনার পক্ষে সহজতর হবে, আমার পক্ষেও সহজতর হবে আমার বোঝা বহন করা।

ইডিপাস :

সাবধান, মান্যবর। আপনি যদি উত্তর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে আপনি থীবির প্রতি, যে থীবির সন্তান আপনি, বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন না।

টাইরেশিয়াস :

আমি দেখতে পাচ্ছি, মান্যবর, আপনার উক্তিগুলি কোনো শুভ ডেকে আনবে না। তাই আমি আমার নিজের উক্তি সম্পর্কে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করছি।

ইডিপাস :

দোহাই দেবতাদের! যদি আপনি কিছু জানেন তাহলে তা জানাতে অস্বীকার করবেন না! আমরা সবাই আপনাকে মিনতি করছি, আমরা সবাই আপনার অনুগ্রহপ্রাথী।

টাইরেশিয়াস :

আপনারা সবাই চরম বিভ্রান্ত। আমার অন্তরে এবং আপনারও, যে গুরুভার গোপন বস্তু লুকিয়ে আছে আমি তা উচ্চারণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি।

ইডিপাস :

কী? আপনি কিছু জিনিস জানেন, কিন্তু বলবেন না? আপনি আমাদের প্রয়াস ব্যর্থ করে দেবেন, আপনার নগরীকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখবেন?

টাইরেশিয়াস :

আমি আপনাকে রেহাই দিতে চাই, আমার নিজেকেও। আর আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। নিরর্থক হবে তা। আমি আপনাদের কিছুই বলব না।

ইডিপাস :

কিছুই না? উদ্ধত পামর, তোমার কথা শুনে একটা পাথরও রাগে জ্বলে উঠবে। তুমি কি কিছুতেই কোনো কথা বলবে না? তুমি কি শেষ পর্যন্ত তোমার একগুঁয়েমি বজায় রাখবেই?

টাইরেশিয়াস :

আমাকে দোষ দেবেন না। আপনি আগে আপনার নিজের গৃহকে ঠিক করুন।

ইডিপাস :

ওর কথা শোনো তোমরা! এইভাবে রাষ্ট্রকে অপমান করা! একজন ঋষিও এতে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন।

টাইরেশিয়াস :

ক্রোধান্বিত হয়ে যতো তর্জন-গর্জন করতে চান করুন। যা হবার তা হবেই। তবে আমার পুনর্বার মুখ খোলা উচিত হয় নি।

ইডিপাস :

যা হবে তার কথা বলাইতো তোমার পেশা।

টাইরেশিয়াস :

আমি আর কিছুই বলবো না। আপনার যতো খুশি তর্জন-গর্জন করুন।

ইডিপাস :

তাই করবো আমি। এবং আমার যা বলার তা আমি নিঃশঙ্কভাবে বলব। আমি তোমাকে বলছি, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস ওই ষড়যন্ত্রে তোমার একটা ভূমিকা ছিল, নিজের হাতে কাজটা না করলেও তুমি অবশ্যই তার সঙ্গে যুক্ত ছিলে। তোমার যদি দেখার চোখ থাকতো তাহলে আমি বলতাম যে তোমার ওই হাত, একমাত্র তোমার ওই হাতই সব কিছু করেছে।

টাইরেশিয়াস : তাই বলতেন আপনি? তাহলে শুনুন : আপনি যে নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণ করেছেন তা আপনার শিরেই পতিত হয়েছে। আজ থেকে আপনি আর কারো সঙ্গে কথা বলবেন না, আমার সঙ্গে না, অন্য কারো সঙ্গেও না। এই দেশকে যে কলুষিত করেছে আপনিই সেই অভিশপ্ত ব্যক্তি।

ইডিপাস :

কোন সাহসে তুমি একথা বলছো? তোমার কি একটুও লজ্জা নেই? এরকম কথা বলার পরও কি তুমি আশা করছো যে তুমি এর কোনো প্রতিফল পাবে না?

টাইরেশিয়াস :

না, পাবো না। সত্যই আমাকে রক্ষা করবে।

ইডিপাস :

কে এই কাজটা করলো? এটা কোনো দিব্যদৃষ্টি নয়।

টাইরেশিয়াস :

এর শিক্ষা আমি আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনি আমার মুখ থেকে এটা বের করে এনেছেন।

ইডিপাস :

কথাটা আবার বলো। কোনো ভুল যেন না হয়।

টাইরেশিয়াস :

যথেষ্ট স্পষ্ট কি হয় নি? আপনি কি আমাকে আরো প্রলোভিত করতে চান?

ইডিপাস :

আমি কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখতে চাই না। আবার বলো তুমি।

টাইরেশিয়াস :

তাহলে বলছি, যে হত্যাকারীকে আপনি খুঁজছেন সে হত্যাকারী আপনি নিজে।

ইডিপাস :

দ্বিতীয়বার বললে কথাটা। এজন্য তুমি দুঃখ করবে।

টাইরেশিয়াস :

আপনার ক্রোধকে প্রজ্জ্বলিত করতে আপনি কি আরো শুনতে চান?

ইডিপাস :

হ্যাঁ। আরো, আরো উন্মত্ততা। তুমি যা জানো তার সব খুলে বলো।

টাইরেশিয়াস :

আমি জানি, কিন্তু আপনি জানেন না, আপনি আপনার ভালোবাসার পাত্রীর সঙ্গে পাপময় জীবনযাপন করছেন, ওই মিলনের মধ্য দিয়ে আপনি আপনার সর্বনাশ ডেকে আনছেন।

ইডিপাস :

তুমি কি মনে করো কোনো রকম শাস্তির ঝুঁকি ছাড়া তুমি এসব কথা বলে যেতে পারো?

টাইরেশিয়াস :

হ্যাঁ, পারি। সত্যের যদি কোনো ক্ষমতা থাকে তাহলে আমার সত্যই আমাকে রক্ষা করবে।

ইডিপাস :

সত্যের ক্ষমতা আছে, তবে তোমার জন্য নয়। নির্লজ্জ, নির্বোধ, দৃষ্টিহীন, মূর্খ কোথাকার, না, তোমার জন্য নয়।

টাইরেশিয়াস :

তোমার জন্য করুণা হয়। এই যে সব বিদ্রূপ করছো একদিন মানুষ তোমার উদ্দেশ্যেই তা উচ্চারণ করবে।

ইডিপাস :

তুমি বাস করো অন্তহীন রাতের মধ্যে, আমার কিংবা আর যেসব মানুষ আলো দেখতে পায় তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করার সাধ্য তোমার নেই।

টাইরেশিয়াস :

না, আমি তোমার পতন ঘটাবো না। এর ভার অ্যাপোলোর হাতে, তিনিই সে কাজ করবেন।

ইডিপাস :

(তার মনে হয় এর সঙ্গে ক্রিওনের দূতিয়ালির একটা সম্ভাব্য যোগসূত্র আছে।) ক্রিওন! তাহলে কি এই কুচালের পেছনে তোমার নয়, ওর হাতে আছে?

টাইরেশিয়াস :

না, ক্রিওন নয়, আপনার শত্রু আপনি নিজে।

ইডিপাস :

(আপন চিন্তার সূত্র ধরে) ওহ্, ধন-ঐশ্বর্য ও রাজকীয় মর্যাদা, জীবনের দৌড়, বুদ্ধির সঙ্গে বুদ্ধির প্রতিযোগিতা, এসবের সঙ্গে কি ঈর্ষাকে সব সময় জড়িয়ে থাকতেই হবে? ক্রিওন, আমার এতো কালের বন্ধু, আমার সব চাইতে বিশ্বস্ত জন, আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, যে ক্ষমতা এই নগরী স্বেচ্ছায় আমাকে দিয়েছে, আমি নিজে থেকে যা কখনো চাই নি, সেই ক্রিওনকে কি এখন শিকারির মতো সতর্ক পদক্ষেপে আমাকে অনুসরণ করতে হবে, আমার পেছনে লেলিয়ে দিতে হবে এই কুচক্রীকে, জাদুকরী ধোঁকাবাজির কলাকৌশলের এই ফেরিওয়ালাকে, মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে যার চোখ বড় করে খোলা, কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে যে অন্ধ?

[টাইরেশিয়াসকে লক্ষ্য করে] ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষেত্রে তোমার দম্ভের কতোটুকু মূল্য ছিল? যখন ওই কুকুরমুখী ডাইনিটা এখানে বসে ছিল তখন কোথায় ছিলে তুমি? আমাদের জনগণকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তোমার মুখে কি তখন কোনো কথা ছিল? সাধারণ মানুষের পক্ষে ওই ধাঁধার উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু তুমি তো ছিলে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, তোমার তো তার উত্তর দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তোমার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে নি। আমি এসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তোমার জাদুবিদ্যা কোনো কাজে আসে নি। আমি, অজ্ঞ ইডিপাস, আমি এসে ওই ধাঁধাকর্ত্রীর মুখ বন্ধ করে দিই, কোনো পাখি-বিদ্যা দিয়ে নয়, আমার একান্ত স্বাভাবিক বুদ্ধির বলে আমি সত্য অনুধাবন করি। আর ওই মানুষটিকে তুমি এখন ক্ষমতাচ্যুত করতে চাও, আর তোমার আশা যে এইভাবে তুমি ক্রিওনের সিংহাসনের সব চাইতে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে, তাই না? নিরপরাধীকে বলির পাঁঠা বানাবার এই ষড়যন্ত্রের জন্য তোমাকে অনুতাপ করতে হবে। তোমাকে এতো বৃদ্ধ বলে মনে না হলে ইতিমধ্যেই তোমার উপর কঠিন শাস্তি বর্ষিত হতো এবং তখন তুমি তোমার অসৎ কর্মের যথার্থ ফল ভোগ করতে।

কোরাস :

আমাদের মনে হয় আপনারা দু’জনই রাগের মাথায় অনেক কথা বলেছেন। নিঃসন্দেহে এটা ভালো নয়। এখন তো আমাদের সকল চিন্তা একটি কাজেই নিবদ্ধ থাকা উচিত, কেমন করে আমরা দেবতার আদেশ পালন করবো।

টাইরেশিয়াস : আপনি রাজা হলেও, একটা অধিকার, উত্তর দেবার অধিকার, আমাদের সমান করেছে। আর আমি এখন সে অধিকার দাবি করছি। আমি যার সেবা করি তিনি আপনি নন, তিনি লক্সিয়াস। আর আমি ক্রিওনের অনুগ্রহের কাছেও বাঁধা নই। আপনি আমার অন্ধত্বকে ব্যঙ্গ করে আনন্দ লাভ করেছেন। কিন্তু চোখ থাকতেও আপনি কি আপনার অভিশপ্ত জীবন দেখতে পাচ্ছেন না? চোখ আছে, তবু কার সঙ্গে আপনি বাস করছেন তা দেখতে পান না? কার পুত্র আপনি? আমি বলছি, আপনি মহা পাপ করেছেন, আর আপনি তা জানেন না—আপনি এই পাপ করেছেন আপনার আপনজনের বিরুদ্ধে, যারা আছেন এই ধরণীর বুকে এবং কবরে। দ্রুতগতির এবং দু’ধারী এক তরবারি, আপনার মাতার এবং আপনার পিতার অভিশাপ, আপনাকে এক ঝাপ্টায় এদেশ থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তখন আপনার এই স্বচ্ছ দৃষ্টিক্ষম চোখ দুটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে, তখন সর্বত্র আপনার উচ্চ ক্রন্দনরোল শোনা যাবে, সিথেরনের এমন কোনো জায়গা থাকবে না যেখানে আপনার উচ্চ ক্রন্দনের প্রতিধ্বনি উঠবে না। যে মধুর বিয়ের গান আপনাকে সানন্দ অভিনন্দন জানিয়ে গৃহে আবাহন করেছিল, যাকে মনে হয়েছিল আপনার সকল আশার আশ্রয়স্থল, সেখানে আপনি লাভ করবেন চরম দুঃখবেদনা। যখন আপনি জানবেন আপনি কী, যারা আপনাকে বাবা বলে ডাকে তারা আপনার কে হয়, তখন আপনার দুঃখের পরিমাণ কতোখানি হবে তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। ক্রিওনকে এবং আমার কথার জন্য আমাকে আপনি যতো খুশি গালিগালাজ করুন, আপনি এমন তীব্র ঘৃণার শিকার হবেন যেমন ইতিপূর্বে কোনো মানুষ কখনো হয় নি।

ইডিপাস :

আমাকে কি এইসব কথা আরো শুনতে হবে? বেরিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। যাও! তাড়াতাড়ি যাও! যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে যাও! যাও!

টাইরেশিয়াস :

তাই যাবো। আপনার ইচ্ছা আমাকে এখানে ডাকিয়ে এনেছে, আমি স্বেচ্ছায় আসি নি।

ইডিপাস :

আমি যদি জানতাম এই রকম পাগলের প্রলাপ আমাকে শুনতে হবে তাহলে আমি এই কষ্টটুকু করতাম না।

টাইরেশিয়াস :

আপনার কাছে আমি পাগল বলে মনে হতে পারি, কিন্তু আপনার বাবা-মা আমাকে তেমন ভাববেন না।

ইডিপাস :

কি বললে? আমার বাবা-মা? তাহলে কারা আমার জন্মদাতা?

টাইরেশিয়াস :

আজকের এই দিনেই উন্মোচিত হবে আপনার জন্মের কথা, আর আজকের এই দিনই ডেকে আনবে আপনার মৃত্যু।

ইডিপাস :

ওহ্! তুমি কি এখনো তোমার কথাকে দুর্বোধ্য ধাঁধার মোড়কে মুড়ে রাখবে?

টাইরেসিয়াস :

কিন্তু ধাঁধার রহস্য সমাধানে আপনার দক্ষতার জন্যই কি আপনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন নি?

ইডিপাস :

যে গুণের জন্য আমি শ্রেষ্ঠ তুমি তাকেই ব্যঙ্গ করছো?

টাইরেশিয়াস :

সেটাই আপনার দুর্ভাগ্য এবং সেটাই আপনার ধ্বংসের মূলে।

ইডিপাস :

তাতে কি এসে যায়? আমি এদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছি। আমি তৃপ্ত।

টাইরেশিয়াস :

বেশ। আমি এবার যাবো। কোথায় ছেলে? আমার হাত ধরো, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।

ইডিপাস :

আমরা খুব সহজেই তোমাকে বিদায় দিতে পারি। যাও, বালক, ওকে ওর বাড়ি নিয়ে যাও।

টাইরেশিয়াস : আগে আমি আমার সব কথা বলে নিই। আমি আপনার মুখের সামনে বলবো, আপনি আমার কী করবেন তা নিয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্ৰ ভয় নেই।

যে লোকটিকে ধরবার জন্য আপনি আদেশ দিয়েছেন, বিরাট হৈচৈ শুরু করেছেন, লেয়াসের সেই হত্যাকারী এখানেই আছে। লোকে তাকে ভাবে বিদেশি, আমাদের সঙ্গে কিছু কাজ-কারবারের জন্য সে এখানে আছে, কিন্তু অচিরেই দেখা যাবে যে সে জন্মসূত্রে এই থীবিরই সন্তান, আর এই আবিষ্কার তার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। সেখানেও এসেছিল দৃষ্টিক্ষম হয়ে, এখান থেকে বিদায় নেবে দৃষ্টিহীন হয়ে। সম্পদবান এখন, তখন হবে ভিখিরি। লাঠি হাতে, পথ হাতড়াতে হাতড়াতে, সে নির্বাসনে যাবে। ভ্রাতা এবং অচিরেই দেখা যাবে, পিতাও। যুগপৎ। যে সন্তানদের তিনি সযত্নে লালন করেন তিনিই তাদের জনক। যে নারী তাকে জন্ম দিয়েছেন তিনি তার পুত্রও, তার স্বামীও, পিতৃহন্তারক, পিতার স্থান জবরদখলকারীও। এবার ভেতরে যান, কথাটা নিয়ে ভাবুন। আমাকে যদি ভুল প্রমাণিত করতে পারেন তখন আমাকে অন্ধ বলবেন।

[টাইরেশিয়াসের প্রস্থান ]

কোরাস :

ডেলফির পর্বতশিখর থেকে ঐশ্বরিক কণ্ঠস্বর অভিযুক্ত করছে রক্তপাতকারীকে, তাকে, যে অকথ্য কর্মাবলি সম্পাদন করেছে। কে সেই ব্যক্তি! দ্রুতগামী অশ্বের মতো, বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে পালিয়ে যাক এখান থেকে। জিউসপুত্র, তার অগ্নিঅস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, তার বিদ্যুৎত্বহ্নি নিয়ে ওকে ধ্বংস করার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন, আর নির্ভুল পদক্ষেপে ভাগ্যদেবীত্রয় ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে।

ওর গোপন স্থান থেকে ওকে খুঁজে বের করে আনার জন্য তুষারাবৃত ঊষায় সুউচ্চ পারনাসাস থেকে নির্দেশ ঝলসে উঠেছে। কোথায় ও?

বনে অথবা গুহায়, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো এক উন্মত্ত বৃষ, বন্ধুহীন পথে হেঁটে চলেছে, কিন্তু মৃত্যুহীন কণ্ঠস্বরগুলি সারাক্ষণ তার কানে বাজে, ধরণীর হৃৎপিণ্ড থেকে তারা তার বিরুদ্ধে চিৎকার করছে। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা সাংঘাতিক সব কথা বলেছেন। আমরা তাঁর কথা বিশ্বাস করতে পারি না, অস্বীকারও করতে পারি না। সব তমসাচ্ছন্ন। আমাদের ভয় হয়, কিন্তু আমাদের সামনে কী আছে আমরা দেখতে পাই না। ল্যাবডাকাসের বংশ আর পলিবাসের পুত্রের মধ্যে কি কোনো বিবাদ ছিল? ইডিপাসের বিরোধিতা করার মতো এমন কিছু ছিল বলে আমরা কখনো শুনি নি। অনাবিষ্কৃত মৃত্যুটির জন্য ল্যাবডাকাসের বংশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে হবে, এমন কোনো কিছুর কথাও তো আমরা কখনো শুনি নি।

এই ধরণীর সকল গোপন বিষয় জানেন জিউস ও অ্যাপোলো। কিন্তু মরণশীল ভবিষ্যদ্বক্তাদের মধ্যে একজন মানুষ যে আরেকজনের চাইতে বেশি জানে সে কথা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারে না। প্রজ্ঞা সবাইকেই ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে প্রদত্ত হয়। অপরাধ সুপ্রমাণিত হবার আগে আমি কাউকেই দোষী বলতে রাজি নই। তিনি ডানাওয়ালা মায়াবিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন, সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন সকলের স্বর্ণালি অভিনন্দন লাভ করেন তিনি। আর তাই, তিনি শুভ ছাড়া অন্য কিছু, আমি কখনোই ভাবতে রাজি নই।

[ক্রিওনের প্রবেশ]

ক্রিওন :

নাগরিকবৃন্দ। আমি শুনলাম রাজা ইডিপাস আমার বিরুদ্ধে একটা কলঙ্কপূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন। এ আমি সহ্য করবো না। তিনি যদি মনে করেন যে আমি তাঁর কোনো অনিষ্ট সাধন করেছি, এই দুঃসময়ে, আমার কোনো কাজ বা কর্ম দ্বারা, তাহলে আমি আর প্রাণ ধারণ করবো না। এইরকম দুর্নামের কথা শোনার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো।

না, দুর্নামের চাইতেও বেশি। আপনারা, আমার বন্ধুবর্গ, আমার স্বদেশ যদি আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে তা তো একটা চরম মারাত্মক অভিযোগ!

কোরাস :

আমার মনে হয় উক্তিটি অবিবেচনাপ্রসূত, রাগের মাথায় উচ্চারিত হয়েছে।

ক্রিওন :

ভবিষ্যদ্বক্তা আমার প্ররোচনায় মিথ্যা কথা বলেছে, রাজা এই কথা কি বলেছেন?

কোরাস :

হ্যাঁ। কি অভিপ্রায়ে তা আমি বলতে পারবো না।

ক্রিওন :

স্থির, অকম্পিত চোখে বলেছেন? আমার বিরুদ্ধে তিনি কি এই অভিযোগ বিচার-বিবেচনা করে এনেছেন?

কোরাস :

আমার প্রভুর কাজকে আমি ওই রকম খুঁটিয়ে বিচার করি না। কিন্তু ওই যে তিনি আসছেন।

[ইডিপাসের প্রবেশ]

ইডিপাস :

তারপর মহোদয়? কি উদ্দেশ্যে আপনি এখানে এসেছেন? আমার প্রাণের বিরুদ্ধে প্রমাণিত ষড়যন্ত্রকারী, আমার রাজমুকুট ছিনতাইকারী তস্কর, কোন মুখে আপনি আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন? আপনি কি মনে করেন আমি একটা কাপুরুষ, কিংবা একটা গাধা? আপনি কি মনে করেন এই ষড়যন্ত্র লক্ষ করার মতো চোখ আমার নেই, একে প্রতিহত করার মতো বুদ্ধি আমার নেই? আর কী হাস্যকর একটা ষড়যন্ত্র! কোনো বন্ধুবান্ধবের সমর্থন নেই, কোনো অর্থের ব্যবস্থা নেই, তবু রাজা হবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া! রাজত্ব লাভ করা যায় লোকজন আর টাকার থলির সাহায্যে।

ক্রিওন :

এবার আমার উত্তর শুনুন। সবকিছু অবগত হবার পর বিচার করবেন।

ইডিপাস :

আপনার বাগ্মিতা থেকে যে আমি বিশেষ কিছু শিখবো সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।

আপনি আমার সব চাইতে বড় শত্রু, একথা আমি জানি।

ক্রিওন :

প্রথমে, আমি আপনাকে একটা কথা বলছি—

ইডিপাস :

আপনার যা খুশি তাই বলুন, শুধু বলবেন না যে আপনি কপটতাহীন।

ক্রিওন :

আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে আপনার এই একগুঁয়েমির ফলে আপনার কোনো লাভ হবে?

ইডিপাস :

আর আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনি নির্বিবাদে আপনার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাবেন অথচ আপনাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না?

ক্রিওন :

সেটা বিশ্বাস করলে আমি চরম নির্বোধ বলে প্রমাণিত হব। তবু, আমাকে একটা কথা বলুন, আপনার প্রতি আমি কী অন্যায় করেছি বলে আপনার মনে হয়।

ইডিপাস :

আপনিই কি আমাকে দিয়ে ওই ভণ্ড ভবিষ্যদ্বক্তাকে এখানে ডাকিয়ে আনিয়েছিলেন?

ক্রিওন :

হ্যাঁ। প্রয়োজন বোধে আমি আবারও তাই করবো।

ইডিপাস :

আমাকে একটা কথা বলুন … কতোদিন আগে লেয়াস

ক্রিওন :

লেয়াস … কি? আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

ইডিপাস :

লেয়াস নিখোঁজ হয়ে যাবার পর কতোদিন কেটে গেছে?

ক্রিওন :

অনেক দিন। অনেক অনেক দিন।

ইডিপাস :

এই বুড়ো ভবিষ্যদ্বক্তা কি তখনো তার ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছিলো?

ক্রিওন :

হ্যাঁ, আর তখনো তিনি এখনকার মতোই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

ইডিপাস :

সেই সময় ও কি কখনো আমার কথা বলেছিলো?

ক্রিওন :

আমি শুনি নি।

ইডিপাস :

লেয়াসের মৃত্যু সম্পর্কে কি কোনো অনুসন্ধান কর্ম পরিচালিত হয় নি?

ক্রিওন :

হয়েছিলো, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয় নি।

ইডিপাস :

আর প্রাজ্ঞ ওই মানুষটি, তখন কেন সে নীরব ছিল?

ক্রিওন :

যা আমার জানা নেই সে সম্পর্কে আমি কোনো অনুমান করতে চাই না।

ইডিপাস :

একটা কথা আপনি জানেন এবং সেটা জানালে আপনি প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন।

ক্রিওন :

আমি জানলে অবশ্যই আপনাকে তা জানাবো। কী জানি আমি?

ইডিপাস :

এটা, আপনার প্ররোচনা ছাড়া ওই ভবিষ্যদ্বক্তা কখনোই আমাকে লেয়াসের হত্যাকারী বলে উল্লেখ করার সাহস পেতো না।

ক্রিওন :

যদি উনি তা করে থাকেন তাহলে তার কারণ আপনিই সবার চাইতে ভালো জানবেন। কিন্তু এবার আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আপনি যেমন আমাকে প্রশ্ন করেছেন আমিও তেমনি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

ইডিপাস :

করুন। আপনি আমাকে রক্তপাতের অপরাধে অপরাধী প্রমাণ করতে পারবেন না।

ক্রিওন :

আপনি কি আমার বোনের স্বামী?

ইডিপাস :

হ্যাঁ, স্যার, আমি তাই।

ক্রিওন :

আর আপনার শাসনকার্য ও সম্পদের ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে তাঁর সমান অধিকার আছে, ঠিক?

ইডিপাস :

এক্ষেত্রে তিনি যা চাইবেন ন্যায্যতই তিনি তা পাবেন।

ক্রিওন :

আমি কি এক্ষেত্রে এক-তৃতীয়াংশ সম্মানের সমান অধিকারী? হ্যাঁ। আপনার প্রমাণিত শঠতার জন্য তার চাইতেও বেশি আপনার প্ৰাপ্য!

ইডিপাস :

আমি এটা অস্বীকার করছি। আমার মতো আপনিও বিষয়টা বিবেচনা করে দেখুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, একটা মানুষ শান্তিময় জীবন যাপন করছে, রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী সে, কেন সে তার পরিবর্তে একটা স্বস্তিহীন জীবন কামনা করবে? নামে রাজা হওয়া কখনোই আমার উচ্চাশার অংশ ছিল না। রাজার মতো জীবনযাপন করাই ছিলো আমার জন্য যথেষ্ট। আমার মতো পরিমিত একটি মানুষ এর চাইতে বেশি আর কী কামনা করতে পারে?

আমার সকল সঙ্গত অনুরোধ আপনি রক্ষা করেন। অথচ আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম তাহলে আমাকে অনেক বিরক্তিকর কাজ করতে হতো। আমি এখন রাজকীয় সম্মান লাভ করছি, প্রায় রাজার মতো ক্ষমতায় অধিকারী, রাজা হলে এর চাইতে বেশি আমি আর কি পেতাম? বরং অনেক দুঃখভোগের সম্ভাবনা থাকতো। আমি এখনো এতোটা অর্বাচীন হই নি যে আমার পক্ষে অকল্যাণকর সম্মান ও মর্যাদার জন্য আমি লালায়িত হবো। এখন সবাই আমাকে ভালো চোখে দেখে, সকল মানুষের বন্ধু আমি। এমন কি, যারা আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী তারাও প্রথমে আমার খোঁজ করে, তারা জানে যে এই পথেই তাদের ইচ্ছা পূরণ হবে। আমি কি আমার এই জীবন অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে বদলে নেবো? কখনো না। এই পরিস্থিতিতে চরম নির্বোধ ছাড়া কে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? রাজদ্রোহ? না, সে পথ আমার নয়। যতোদূর জানি আমার কোনো বন্ধুরও নীতি তা নয়।

আমাকে পরীক্ষা করতে চাইলে প্রথমে পিথীয় সমাধিমন্দিরে যান, জিজ্ঞাসা করুন আমি যে বার্তা নিয়ে এসেছিলাম তা সত্য কিনা। তারপর ভবিষ্যৎদ্রষ্টার সঙ্গে আমার ষড়যন্ত্র ছিল সেটা প্রমাণ করুন। তারপর আমাকে গ্রেফতার করুন, মৃত্যুদণ্ড দিন। ওই দণ্ডে আপনার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমার কণ্ঠস্বর যুক্ত হবে।

কিন্তু আমার পেছনে আমাকে মিথ্যা সন্দেহে অভিযুক্ত করলে আমি তা কখনোই মেনে নেবো না। একজন ভালো মানুষকে মিথ্যা বদনাম দেওয়া একটা অপরাধ, অন্য অপরাধ হলো হঠকারিভাবে খারাপ মানুষকে ভালো মানুষ মনে করা। আপনি যখন আপনার একজন প্রকৃত বন্ধুকে প্রত্যাখ্যান করেন তখন আপনি আপনার জীবনকে, আপনার প্রকৃত সম্পদকে ছুড়ে ফেলে দেন। সময় আপনাকে সে-শিক্ষা দেবে। কারণ সময়ই প্রমাণ করবে কে সৎ, আর কে পাপী।

কোরাস :

অতি সুন্দর কথা। একজন প্রাজ্ঞ মানুষের উচিত এই সব কথা শোনা এবং সেই মতো চলা। অতি দ্রুত চিন্তা কদাচিৎ নিরাপদ হয়।

ইডিপাস :

শুনুন, বন্ধু, যখন কোনো দ্রুত ষড়যন্ত্রকারী কাজে নেমে পড়ে তখন তার বিরুদ্ধে দ্রুত পাল্টা ষড়যন্ত্র করাই সব চাইতে নিরাপদ হয়। সে তার সুযোগ কাজে লাগাবে, আর আমি কি চুপ করে বসে থেকে আমার সুযোগ হারাবো?

ক্রিওন :

তাহলে আপনি কি করতে চান? আপনি কি আমাকে নির্বাসিত করবেন?

ইডিপাস :

কখনো না। নির্বাসিত করবো না, আমি আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেবো।

ক্রিওন :

আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি তা যদি দেখাতে পারেন—

ইডিপাস :

এখনো আপনি সেই একগুঁয়ে যুক্তি আঁকড়ে ধরে থাকবেন?

ক্রিওন :

কারণ আমি জানি যে আপনি ভুল করছেন।

ইডিপাস :

আমি জানি যে আমি সঠিক।

ক্রিওন :

আপনার নিজের দৃষ্টিতে কিন্তু আমার দৃষ্টিতে নয়।

ইডিপাস :

আপনি একজন দুর্বৃত্ত।

ক্ৰিয়ন :

আপনার যদি ভুল হয়?

ইডিপাস :

রাজাকে তো শাসন করতেই হবে।

ক্রিওন :

না, অন্যায়ভাবে শাসন করলে নয়।

ইডিপাস :

ওর কথা শোনো, থীবি! শোনো, আমার নগরী থীবি!

ক্রিওন :

আপনার? আমারও নয় কি?

কোরাস :

মান্যবররা, মান্যবররা, যথেষ্ট হয়েছে। এই যে রানী ইয়োকাস্তা আসছেন। তিনিই এই বিবাদের সুরাহা করতে পারবেন।

[প্রাসাদ থেকে ইয়োকাস্তার প্রবেশ]

ইয়োকাস্তা :

উচ্চকণ্ঠে এই রকম তর্কবিতর্কের মানে কি, ঝগডুটে পুরুষরা? আমি অবাক হচ্ছি, এই নিদারুণ দুঃখের সময় আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি করতে লজ্জা বোধ করছেন না? ভেতরে চলুন, স্বামী আমার। আর ক্রিওন, তুমি বাড়ি যাও। গুরুত্বহীন সামান্য একটা ব্যাপারকে তুমি অনর্থক বাড়িয়ে তুলছো।

ক্রিওন :

তা নয়, “বোন। তোমার স্বামী নিতান্ত হঠকারিভাবে আমাকে একটা কঠিন দণ্ড দিচ্ছেন, আমাকে বেছে নিতে হবে নির্বাসন অথবা মৃত্যু, দুটোর একটা।

ইডিপাস :

কথাটা ঠিক। আমি আবিষ্কার করেছি যে ও আমার বিরুদ্ধে চতুর ষড়যন্ত্র করছে।

ক্রিওন :

আমি যদি এই জাতীয় কোনো পরিকল্পনা করার অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকি তাহলে বিধাতার অভিশাপ যেন আমার উপর চিরদিনের জন্য নেমে আসে!

ইয়োকাস্তা :

ঈশ্বরের নামে বলছি, ইডিপাস, ওর কথা বিশ্বাস করো। ওর শপথের কথা বিবেচনা করে, আমার এবং অন্য আর যারা এখানে উপস্থিত আছে তাদের কথা বিবেচনা করে, ওর কথা বিশ্বাস করো!

কোরাস :

সম্মত হন, রাজা, সম্মত হন। দয়া প্রদর্শন করুন, আত্মসমর্পণ করতে শিখুন।

ইডিপাস :

কেন তা করবো আমি?

কোরাস :

তার শপথই তার বর্ম হিসাবে বিবেচিত হবে। উনি তো কখনোই আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি।

ইডিপাস :

আপনারা কী বলছেন তা কি আপনারা জানেন?

কোরাস :

জানি আমরা।

ইডিপাস :

আরো একটু বিশদ করে বলুন।

কোরাস :

উনি বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু গুজবের উপর নির্ভর করে, তার কোনো কথা না শুনে, ওই বন্ধুত্ব প্রত্যাখ্যান করা কি ঠিক?

ইডিপাস :

একথা বলে আপনারা কিন্তু আমাকে মৃত্যু অথবা নির্বাসন দণ্ড দিচ্ছেন।

কোরাস :

না, না। কিছুতেই এরকম ভাববেন না। জীবনের প্রভুর নামে বলছি, সূর্যদেবতার নামে বলছি, কখনোই এ চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। আমি ওরকম ভেবে থাকলে বিধাতা এবং মানুষ উভয়েই যেন আমাকে ত্যাগ করে। কিন্তু আমাদের জনগণ যখন বেদনাহত তখন যদি আপনারা, রাজন্যবর্গ, আমাদের যন্ত্রণার মধ্যে নিজেদের দ্বন্দ্বসংঘাত যুক্ত করেন তখন আমার বক্ষ নতুন করে বিদীর্ণ হয়।

ইডিপাস :

ঠিক আছে, তাহলে ওকে যেতে দিন, যদিও এর ফল হয়তো হবে আমার মৃত্যু অথবা অসম্মানের সঙ্গে নির্বাসনে যাওয়া। আমি এই দয়া প্রদর্শন করছি আপনাদের অনুরোধে, ওর কথায় নয়। ওকে আমি ঘৃণা করবো চিরকাল।

ক্রিওন :

ক্রোধের সময় যেমন রূঢ়, দয়া প্রদর্শনের সময়েও তেমনি অনমনীয়। এধরনের প্রকৃতি শুধু আত্মনির্যাতনই ডেকে আনে।

ইডিপাস :

আপনি বিদায় হবেন?

ক্রিওন :

হবো। শুধু আপনিই আমাকে অন্যায়ভাবে বিচার করলেন।

[ক্রিওনের প্রস্থান]

কোরাস :

ভদ্রে, কিছু সময়ের জন্য রাজাকে অন্য দিকে মন দিতে রাজি করান।

ইয়োকাস্তা :

এই গণ্ডগোলটা শুরু হলো কিভাবে?

কোরাস :

নিতান্ত আজগুবি একটা অনুমান থেকে। তারপর ভিত্তিহীন দোষারোপের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।

ইয়োকাস্তা :

একে-অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে?

কোরাস :

ঠিক তাই।

ইয়োকাস্তা :

কি জন্য?

কোরাস :

আর জিজ্ঞাসা করবেন না। আমাদের দুর্ভাগ্যপীড়িত দেশের জন্য যথেষ্ট লজ্জার কারণ ইতিমধ্যে ঘটেছে। এখন এ বিষয়ে আর কোনো কিছু না করলেই সব চাইতে ভালো হবে।

ইডিপাস :

শান্তি স্থাপকের ভূমিকায় আপনার এইসব আবেদন চমৎকার শোনাচ্ছে!

কোরাস :

আমি আবার বলছি, রাজা। আমাদের কথা বিশ্বাস করুন। আমরা কেন আপনার সুরক্ষার হাতকে নির্বোধের মতো দূরে ঠেলে দেবো। ক্রোধবহ্নির কালে আপনার প্রজ্ঞাই তো আমাদের দেশকে বিপদমুক্ত রাখে, আপনিই তো সকল ঝড়ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে আবার আমাদের দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।

ইয়োকাস্তা :

তুমি কি আমাকেও বলবে না? আমাকে বলো, আমি মিনতি করছি, কেন তুমি ওর বিরুদ্ধে এতো তীব্র ঘৃণা পোষণ করছো?

ইডিপাস :

অবশ্যই বলবো। এই সুজনদের চাইতে তুমি আমার অনেক কাছের মানুষ। দোষটা ক্রিওনের, আর আমার বিরুদ্ধে তার এই ষড়যন্ত্রের।

ইয়োকাস্তা :

কি ভাবে? কি অভিযোগ এনেছে ও?

ইডিপাস :

ও বলে যে লেয়াসের হত্যাকাণ্ডের জন্য আমিই দায়ী।

ইয়োকাস্তা :

ও নিজে এটা জানে, নাকি অন্যের কাছ থেকে শুনেছে?

ইডিপাস :

এইখানেই আছে তার চাতুরি। নিজেকে আড়ালে রেখে সে তার হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করছে এক বদমাশ ভবিষ্যদ্বক্তাকে।

ইয়োকাস্তা :

তাহলে এখনই তুমি নিজেকে অপরাধমুক্ত করে নাও। কারণ, আমি তোমাকে বলছি, ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা কোনো মানুষের আয়ত্তাধীন নয়। এর প্রমাণ আছে আমার কাছে। লেয়াসের কাছে এক দৈববাণী এসেছিল, না ফিবাসের কাছ থেকে নয়, তার অমাত্যদের কাছ থেকে, ওই বাণীতে বলা হয় যে তার মৃত্যু ঘটবে তার নিজের সন্তানের হাতে, আমার আর লেয়াসের সন্তানের হাতে। কিন্তু পরিণামে কি ঘটলো? সবাই জানে যে লেয়াস নিহত হন দেশের বাইরে দস্যুদের হাতে, যে স্থানে তিনটি সড়ক এসে মিলিত হয়েছে। আর তার সন্তানের কথা? ওর বয়স তখন তিন দিনও হয় নি। ওর দুই গোড়ালি শক্ত করে বেঁধে, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য, তাকে এক নির্জন পাহাড়ের পাশে ফেলে রাখে লেয়াস (নিজের হাতে নয়, অন্যদের মাধ্যমে)। আর, তাই দেখা গেল যে অ্যাপোলো ওটা চান নি। সন্তান তার পিতাকে হত্যা করে নি। পিতা, তার সকল আশঙ্কা সত্বেও, নিজের পুত্রের হাতে নিহত হন নি। অথচ ভবিষ্যদ্বক্তার সতর্কবাণী তো ছিল ওই রকম! তাহলে, কেন তুমি ওদের কথায় কর্ণপাত করবে? বিধাতা কী চান তা তিনিই তাঁর উপযুক্ত সময়ে আমাদের দেখিয়ে দেবেন।

ইডিপাস :

বউ আমার, তুমি যা বললে তা আমাকে অস্থির করে তুলছে। আমার মন অতীতের পানে, অতীতের দিকে ফিরে যাচ্ছে একটা জিনিস আমাকে বিচলিত করছে …

ইয়োকাস্তা :

কি? কি হয়েছে? তুমি কেন এরকম চমকে উঠলে?

ইডিপাস :

তুমি এই মাত্র বললে না, যেখানে তিনটি সড়ক এসে মিলিত হয়েছে সেখানে লেয়াস নিহত হয়েছেন?

ইয়োকাস্তা :

সেরকমই তো শোনা গিয়েছিলো, আর এখনো সেটাই বলবৎ আছে।

ইডিপাস :

কোথায়! কোন দেশে?

ইয়োকাস্তা :

জায়গাটার নাম ফোকিস। ওখানেই সড়ক বিভক্ত হয়ে গেছে, একটা গেছে ডেলফির দিকে, আরেকটা ডলিয়ার দিকে।

ইডিপাস :

কতোদিন আগের ঘটনা ওটা?

ইয়োকাস্তা :

তোমার রাজত্ব আরম্ভ হবার অল্প কাল আগে এই ঘটনার কথা জানা যায়।

ইডিপাস :

হা ঈশ্বর, তুমি কী করছো আমাকে নিয়ে

ইডিপাস :

কেন, ইডিপাস? কেন তুমি এতো বিচলিত হচ্ছো?

ইডিপাস :

আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করো না, কিন্তু বলো আমাকে, তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, কতো বয়স হয়েছিল তাঁর?

ইয়োকাস্তা :

দীর্ঘদেহী, রূপালি-সাদা চুল, দেহের গড়ন তোমার মতো।

ইডিপাস :

হায়, হতভাগা! আমি কি নিজের অজ্ঞাতে স্ব-অভিশপ্ত?

ইয়োকাস্তা :

রাজা আমার, কি হয়েছে? আমার ভীষণ ভয় করছে।

ইডিপাস :

তাহলে ভবিষ্যদ্বক্তা কি যথার্থই চক্ষুষ্মান ছিলো? এও কি সম্ভব? নিশ্চিত হবার জন্য তুমি আমাকে আরেকটি কথা বলো।

ইয়োকাস্তা :

তোমার কথা শুনে আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আমি যা জানি তার সবই আমি তোমাকে বলবো।

ইডিপাস :

রাজার সঙ্গে কিরকম সহচরবৃন্দ ছিলো? সামান্য দু’একজন, নাকি রাজকীয় ভাবে তাঁর বহু দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে তিনি পথ চলেছিলেন?

ইয়োকাস্তা :

তাঁর সঙ্গে পাঁচ জন ছিলো। একজন অগ্রদূত আগে আগে যাচ্ছিলো। গাড়ি ছিল মাত্র একটি। একমাত্র রাজা ছিলেন ওই গাড়িতে।

ইডিপাস :

হায়! পরিষ্কার, সব কিছু ক্রমেই আরো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে এসব কথা কে বলেছে?

ইয়োকাস্তা :

একটি ভৃত্য। প্রাণ নিয়ে একমাত্র সেই ফিরে আসতে পারে।

ইডিপাস :

ও কি এখনো এই গৃহে কাজ করছে?

ইয়োকাস্তা :

না। ফিরে এসে ও যখন দেখলো যে তার প্রভুর জায়গায় তুমি এখন রাজাসনে অধিষ্ঠিত তখন সে আমার কাছে মিনতি জানায়, সে গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে চায়, শহর থেকে অনেক দূরে। সে মেষ চরাবে। আমি তাকে ছেড়ে দিই। বেচারা! আরো বড় কিছু অনুগ্রহ সে চাইতে পারতো। ও একজন ভালো ক্রীতদাস ছিলো।

ইডিপাস :

ওকে কি অবিলম্বে এখানে হাজির করানো যায়?

ইয়োকাস্তা :

হয়তো তার ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু কেন তুমি ওকে চাইছো?

ইডিপাস :

বউ আমার, আমার ভয় হচ্ছে, আমার ভয় হচ্ছে আমি ইতিমধ্যে বড় বেশি বলে ফেলেছি। আমাকে ওইলোকটির সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

ইয়োকাস্তা :

তো, তার সঙ্গে দেখা করবে তুমি। তবে ইতিমধ্যে তোমার মন যে- দুশ্চিন্তায় এতো ভারাক্রান্ত তার কথা কি আমি শুনতে পারি না?

ইডিপাস :

অবশ্যই শুনবে। আমি যেমন ভাবছি আমার কাহিনী যদি সত্যিই সে রকম হয় তাহলে তুমিই তো সবার আগে শুনবে। শোনো তাহলে।

আমার বাবা ছিলেন কোরিন্থ-এর লোক, পলিবাস। আমার মা একজন ডোরীয়, নাম মেরোপি। দেশে আমি মোটামুটি একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হয়ে উঠি। তারপর একদিন একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো, একটা অদ্ভুত ঘটনা। যদিও আমি হয়তো তার দ্বারা অনাবশ্যকভাবে বেশি পীড়িত হই। একদিন খাবার টেবিলে একটি লোক, প্রচুর সুরা পান করছিলো, লোকটি বলে উঠলো, আমি আমার পিতার সন্তান নই। আমি ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেও তখন চুপ করে থাকি। পরের দিন আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে সত্য ব্যাপারটা কী জানতে চাইলাম। ওরা খুব ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। কে কোন সাহসে এরকম একটা গল্প ছড়াচ্ছে? আমি আশ্বস্ত হই, তবু একটা অস্বস্তি কাঁটার মতো আমার বুকে বিঁধে থাকে। আর এই রকম একটা জিনিস অল্প সময়ের মধ্যেই এক কান থেকে অন্য কানে ছড়িয়ে পড়ে।

তাই, আমার বাবা-মায়ের অজ্ঞাতে, আমি একদিন পাইথোর মন্দির যাই, কিন্তু আমার প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর না পেয়ে আমি নিরাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসি। সেখানে আমি একটা গল্প শুনি, ভয়ঙ্কর একটা গল্প, চরম বেদনার একটা কাহিনী। আমি বিয়ে করবো আমার মাকে, জন্মদান করবো কয়েকটি সন্তান, সমগ্র মানবজাতির জন্য একটা জঘন্য পাপ ওই কাজ, আর আমি হত্যা করবো আমার পিতাকে। একথা শুনে আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই, কোরিন্থ আর আমার মধ্যে বিশাল দূরত্ব গড়ে তুলি, জীবনে আমি কোনোদিন আমার স্বদেশভূমি দেখবো না। আর ওই রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা যেন কিছুতেই ঘটতে না পারে তা আমি সুনিশ্চিত করবো।

ঘুরতে ঘুরতে আমি এক সময় সেই জায়গায় এসে পৌঁছি যেখানে তোমাদের ভূতপূর্ব রাজার মৃত্যু ঘটে। শোনো, বউ আমার, এটাই হলো সত্য ঘটনা। আমি যখন তিন রাস্তার সংযোগস্থলে এসে উপস্থিত হই তখন এক অগ্রদূতের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তার পেছনে ছিল অশ্বচালিত এক শকট, আর একজন মানুষ ছিলেন সেখানে আসীন, তুমি যেমন বর্ণনা করছো ঠিক ওই রকম। অগ্রদূত রূঢ়ভাবে আমাকে পথ ছেড়ে সরে যেতে বলে, আর তার শ্রদ্ধাভাজন প্ৰভু অত্যন্ত কর্কশভাবে ওই আদেশ পুনরুচ্চারণ করে। শকটচালক আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলে আমি তাকে আঘাত করি, কারণ আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। গাড়ি থেকে ঝুঁকে পড়ে বৃদ্ধ এটা লক্ষ করেন, আমি পাশ দিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেন, তারপর শকটচালকের দু’কাঁটার অঙ্কুশটি হাতে নিয়ে আমার মাথায় আঘাত করলেন। ওই হঠকারিতার জন্য তাঁকে চড়া মূল্য দিতে হয়। আমার ডান হাতের এই লাঠি বিদ্যুৎগতিতে তার কাজ করে, আর বৃদ্ধ গাড়ির ভেতর থেকে হুমড়ি খেয়ে সোজা নিচে পড়ে যান। আর ওই দলের প্রতিটি সদস্যকে আমি হত্যা করি।

কিন্তু এখন, ওই অচেনা মানুষটির ধমনীতে যদি লেয়াসের রক্ত প্রবাহিত হয়ে থাকে তাহলে আমার চাইতে হতভাগা মানুষ আর কেউ কি কোথাও আছে, বিধাতা আর মানুষ কর্তৃক আমার চাইতে বেশি ঘৃণিত আর কেউ? আমিই হলাম সেই ব্যক্তি যাকে কোনো বিদেশি অথবা এই দেশের নাগরিক তার গৃহে ডেকে নিয়ে যেতে পারবে না; আমিই হলাম সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে কেউ বাক্যালাপ করতে পারবে না; আমার উপর বর্ষিত হবে সেই অভিসম্পাত যা আমিই উচ্চারণ করেছি। আর তাঁর স্ত্রী! আমার এই হাত যা তাকে হত্যা করেছে সেই হাত স্পর্শ করেছে ওই রমনীকে! এই কি আমার পাপ? আমি কি সাংঘাতিক জঘন্য একটি মানুষ নই? এখান থেকে নির্বাসিত, আর এই নির্বাসন কালে আমার পিতৃভূমি আর গৃহে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত, চিরকাল আমাকে এখান থেকে দূরে থাকতে হবে পাছে আমি আমার মাকে বানাই আমার স্ত্রী আর হত্যা করি আমার পিতাকে আমার পিতা … পলিবাস, … আমার জন্মদাতা। দানবীয়, অশুভ কোনো দেবতা ছাড়া আর কারো পক্ষে কি আমার উপর এই রকম একটা বিপর্যয় টেনে আনা সম্ভব? ওহ, ওহ, স্বর্গের পুণ্য শক্তিসমূহ, দ্রুত ডেকে আনো সেই দিন। ওই রকম কুৎসিত পরিস্থিতি আমার গায়ে কলঙ্কের দাগ কেটে দেবার আগেই আমি যেন এই পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাই, তার আগেই যেন আমার মৃত্যু ঘটে।

কোরাস :

স্যার, সাঙ্ঘতিক এই সব কথা, তবু আমাদের সাক্ষ্যদাতাদের কাছ থেকে পুরো সত্য না জানার পূর্ব পর্যন্ত আশা রাখুন।

ইডিপাস :

সেটাই আমার একমাত্র আশা, এখন ওই মেষপালকের জন্য অপেক্ষা করে থাকা।

ইয়োকাস্তা :

কেন? ওর কাছ থেকে তুমি কি সাহায্য প্রত্যাশা করছো?

ইডিপাস :

এটা, তোমার কাহিনীর সঙ্গে যদি ওর কাহিনী মিলে যায় তাহলে আমি মুক্তি পাবো।

ইয়োকাস্তা :

কোন বিশেষ কথা তুমি ভাবছো? আমি এমন কি বলেছি?

ইডিপাস :

তুমি দস্যুদলের কথা বলেছো। তুমি বলেছো যে কয়েকজন দস্যু তাকে হত্যা করেছে। এখনো যদি সে কয়েকজন দস্যুর কথা বলে, তাহলে তো আমি আর সেই হত্যাকারী নই। একজন তো একজনের বেশি নয়। কিন্তু সে যদি নিঃসঙ্গ একজন মাত্র পথচারীর কথা বলে তাহলে আর আমার কোনো পরিত্রাণ নেই। তখন তার অঙ্গুলি শুধু আমাকেই নির্দেশ করবে।

ইয়োকাস্তা :

কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, সে ওই কথাই বলেছিলো। শুধু আমি নই, নগরীর সবাই তার কথা শুনেছে। এখন ওই কথা সে আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আর সে যদি তার কথার সামান্য অদলবদল করেও সে কখনোই বলতে পারবে না যে লেয়াস সম্পর্কে যে রকম ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তিনি সেই ভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। লাক্সিয়াস বলেছিলেন আমার এক সন্তান তাকে হত্যা করবে। কিন্তু তা তো হয় নি। বেচারা শিশু, সেই বরং মৃত্যুবরণ করে। এই তো ভবিষ্যদ্বাণীর মূল্য! এরপর আমি আর ভবিষ্যদ্বাণী শোনার জন্য দু’পা ফেলে রাস্তার এক পাশ থেকে অপর পাশেও যাবো না।

ইডিপাস :

তুমি ঠিকই বলেছো। তবু মেষপালকটিকে ডাকিয়ে আনা যাক। ওকে আনার জন্য একজন কাউকে পাঠাও।

ইয়োকাস্তা :

এখনই পাঠাচ্ছি। তুমি ভেতরে চলো। তোমার ইচ্ছানুযায়ীই আমি সব কিছু করবো।

[ওদের প্রস্থান]

কোরাস :

আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই, বাক্যে ও কর্মে আস্থা রাখতে চাই সেই “বিধান”-এর উপর, যা কোনো মানুষ কর্তৃক নির্মিত নয়, যা আকাশে লাফিয়ে বেড়ায়, যার আলো কখনো ম্লান হয় না, কখনো নিদ্রামগ্ন হয় না, যার দেবত্ব কালের ঊর্ধ্বে এবং মৃত্যুঞ্জয়ী। অহঙ্কার থেকে জন্ম নেয় অত্যাচারী। অসদুপায়ে অর্জিত ধনরত্ন তাকে স্ফীত করে তোলে, তখন তার পা রাখার ঠাঁই থাকে না, অহঙ্কার তাকে প্রাসাদ শীর্ষ থেকে গহ্বরের তলদেশে নিক্ষেপ করে। নাগরিক কর্তব্যবোধ রহিত উদ্যম কোনো আইনের বিধান মানে না। তবু ঈশ্বর যেন সব কিছু সার্থক করে তোলেন।

যে নিজের স্বেচ্ছাচারী পথে চলে, ন্যায়নিষ্ঠা ও পবিত্র নির্দেশাবলি তাচ্ছিল্যভরে উপেক্ষা করে, সকল পবিত্র জিনিসকে অবজ্ঞা করে, মিথ্যার মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে, সে কি কখনো তার অহঙ্কারের শাস্তি, নিয়তি নির্ধারিত ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে?

যে ন্যায়কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্যায়কে আলিঙ্গন করে তাকে কি কোনো বর্মই ঈশ্বরের তীব্র ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে পারবে? যদি ধর্মের পরিবর্তে অধর্মই প্রশংসা লাভ করে তাহলে পবিত্র সঙ্গীতের মধুর সুরলহরী, বিদায় তোমাকে।

বিদায়, আবীয় এবং অলিম্পিয় পূজাবেদী, বিদায়, ধরণীর অন্তর, অলঙ্ঘ্য সমাধিমন্দির, এই সময়ে যদি তোমার সঙ্কেতসমূহ ব্যর্থ অথবা দ্বিধাগ্রস্ত হয় তাহলে মানুষ আর তোমার ঐশ্বরিক নির্দেশে কর্ণপাত করবে না। জিউস, সর্বাধিপতি, সর্বত্র বিরাজিত, তুমি যদি বেঁচে থাকো তাহলে জেগে ওঠো। প্রাচীন দৈববাণীগুলি দিশাহারা হয়ে গেছে। অ্যাপোলোর নাম অস্বীকৃত হচ্ছে, তার গৌরব মলিন হয়ে পড়ছে, মানবজাতির মধ্যে এখন আর ঈশ্বরপ্রেম বলে কিছু নেই।

[প্রাসাদের ভেতর থেকে ইয়োকাস্তা বেরিয়ে আসে, তার হাতে মাল্যশোভিত একটি তরুশাখা এবং ধূপধুনা।]

ইয়োকাস্তা :

প্রভুগণ, আমি ধূপধুনা ও প্রার্থনার এইসব উপাচার নিয়ে পবিত্র পূজাবেদীতে যাচ্ছি। রাজা নানা রকম উদ্ভট কল্পনায় আক্রান্ত হয়ে অতিশয় বিচলিত হয়ে আছেন, বর্তমানকে অতীতের ঘটনাবলির আলোয় এখন আর সুস্থভাবে বিচার করতে পারছেন না, যেসব কথা তার দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে তোলে, মন দিয়ে শুধু সেইসব কথা শোনেন। তাঁকে আমি কিছুতেই সান্ত্বনা দিতে পারছি না। আলোকদীপ্ত উজ্জ্বল অ্যাপোলো, আপনিই আমার ভবনের সব চাইতে কাছে আছেন, আপনার কাছেই আমি আমার প্রথম প্রার্থনা নিবেদন করছি। এই কদর্য জিনিসটার হাত থেকে আপনি আমাদের রক্ষা করুন, রক্ষা করুন! আমাদের মুখ্য পথপ্রদর্শককে বিচলিত-বিভ্রান্ত দেখে আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত।

[ইয়োকাস্তা পুজাবেদিগুলিতে তার নৈবেদ্য অর্পণ করে] [কোরিন্থ থেকে এক বার্তাবহ এসে উপস্থিত হয়]

বার্তাবহ :

এই যে অচেনা মানুষরা, আমি ইডিপাসের ভবন খোঁজ করছি। আমাকে কি সেখানে, অথবা তিনি এখন কোথায় আছেন জানা থাকলে, তার কাছে নিয়ে যেতে পারবেন?

কোরাস :

এটাই তাঁর ভবন, স্যার; আর তিনি ভেতরেই আছেন। এই ভদ্রমহিলা তাঁর স্ত্রী ও তাঁর সন্তানদের জননী।

বার্তাবহ :

ওই রকম একটি মানুষের উপযুক্ত সঙ্গিনী আপনি, আপনার এবং আপনার গৃহের সকলের মঙ্গল হোক।

ইয়োকাস্তা :

আপনারও মঙ্গল হোক। আপনার সহৃদয় শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি কি কোনো অনুরোধ নিয়ে এসেছেন, নাকি কোনো বার্তা?

বার্তাবহ :

মাননীয়া ভদ্ৰে, আমি আপনার স্বামী ও তাঁর গৃহের সকলের জন্য সুসংবাদ নিয়ে এসেছি।

ইয়োকাস্তা :

কি সংবাদ? আর কার কাছ থেকে?

বার্তাবহ :

কোরিন্থ থেকে। আর এই সংবাদ শুনে আপনি খুশি না হয়ে পারবেন না, যদিও কিছুটা ব্যথিতও হয়তো হবেন।

ইয়োকাস্তা :

কি সেই সংবাদ হতে পারে যার একই সঙ্গে আনন্দিত ও ব্যথিত করবার ক্ষমতা আছে?

বার্তাবহ :

আমাদের জনগণ বলাবলি করছে যে ওরা তাঁকে সমস্ত ভূখণ্ডের, এই সমগ্র যোজকের, রাজা বানাবে।

ইয়োকাস্তা :

তাহলে পলিবাস কি আর রাজা নেই।

বার্তাবহ :

রাজা পলিবাস, ভদ্রে, মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি এখন তাঁর কবরে সমাহিত।

ইয়োকাস্তা :

কি বললে? পলিবাসের মৃত্যু ঘটেছে? ইডিপাসের পিতার?

বার্তাবহ :

ঠিক তাই।

ইয়োকাস্তা :

[একজন সহচরীকে] দ্রুত তোমার প্রভুকে খবর দাও। [সহচরীর প্রস্থান কোথায় গেল দৈববাণী? পাছে তার হাতে মৃত্যু ঘটে সেই আশঙ্কায় ইডিপাস যাকে এতো বছর ধরে এড়িয়ে চলেছে স্বাভাবিক মৃত্যুই হলো তার, ইডিপাসের কোনো হাত ছিল না সেখানে!

[ইডিপাসের প্রবেশ ]

ইডিপাস :

প্রিয় ইয়োকাস্তা, তুমি আবার কেন আমাকে বাইরে ডাকিয়ে আনলে?

ইয়োকাস্তা :

আগে এর কথা শোনো, শোনার পর ওই বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণীগুলির কি হলো তার কথা বলো।

ইডিপাস :

কে এই লোক? আমার জন্য কি সংবাদ এনেছে সে?

ইয়োকাস্তা :

সে কোরিন্থ থেকে এসেছে। তোমার পিতা পলিবাস মারা গেছেন। মারা গেছেন তিনি।

ইডিপাস :

তাই? স্যার, আপনি নিজে বলুন আমাকে

বার্তাবহ :

স্যার, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, সকল মরণশীল মানুষের মতো তিনিও মৃত্যুবরণ করেছেন।

ইডিপাস :

কোনো দুষ্কৃতিকারীর হাতে, নাকি কোনো দুর্ঘটনার ফলে?

বার্তাবহ :

সেই রকম ক্ষুদ্র দুর্ঘটনা যা বৃদ্ধ ব্যক্তিদের চিরনিদ্রার কোলে নিক্ষেপ করে।

ইডিপাস :

বেচারা বৃদ্ধ মানুষটি! আপনি বলতে চান তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাই তো?

বার্তাবহ :

তাই, এবং তাঁর দীর্ঘ জীবনের পরিণতিতে।

ইডিপাস :

তাহলে এই হলো অবস্থা! তাহলে, স্ত্রী আমার, পিথীয় অগ্নি, দৈববাণীসমূহ, ভবিষ্যদ্বাণী করা বিহঙ্গকুল, ঊর্ধ্বে ধ্বনিত চিৎকার—কি হলো তাদের? বলা হয়েছিল আমি আমার পিতাকে হত্যা করবো। এখন তিনি শায়িত তাঁর সমাধিতে, আর আমি আছি এইখানে, যে-আমি কোনো অস্ত্র স্পর্শ করি নি … যদি না বলা হয় যে আমার অনুপস্থিতিজনিত শোক তাকে হত্যা করেছে, অতএব আমিই তাঁর হত্যাকারী। কিন্তু না, দৈববাণীর কথা অনুসৃত হয় নি এবং পলিবাসের মতোই তা এখন মৃত পড়ে আছে।

ইয়োকাস্তা :

আমি কি সব সময় একথাই বলে আসি নি?

ইডিপাস :

তুমি বলেছো, কিন্তু আমার আতঙ্ক আমাকে ভুল পথে চালিত করে।

ইয়োকাস্তা :

আর ওসব কথা ভেবো না।

ইডিপাস :

এখনো আরেকটা বিষয় নিয়ে আমি আতঙ্কের মধ্যে আছি … আমার মা…

ইয়োকাস্তা :

আতঙ্ক? আতঙ্কের সঙ্গে কি সম্পর্ক একটা মানুষের? দৈব আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, ভবিষ্যৎ আমাদের অজানা। সম্ভাব্য সর্বোত্তমভাবে, একটি একটি দিন করে বাঁচাই, সব চাইতে ভালো পন্থা। আর ওই মাতাকে বিয়ে করার ভয়ে ভীত হবার তোমার কোনো কারণ নেই। অনেক মানুষই ওই রকম স্বপ্নতাড়িত হয়েছে। জীবনকে যদি সহ্য করতে হয় তাহলে ওসব কথা ভুলে যেতে হবে।

ইডিপাস :

তিনি যদি মৃত্যুবরণ করে থাকতেন তাহলে তুমি সঙ্গতভাবেই একথা বলতে পারতে। কিন্তু তিনি এখনো জীবিত আছেন, এবং এ অবস্থায়, তুমি যাই বলো না কেন, আমি আমার ভয়ের হাত থেকে মুক্ত হতে পারছি না।

ইয়োকাস্তা :

তোমার পিতার মৃত্যু অন্তত কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে।

ইডিপাস :

হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মা বেঁচে আছেন আমি কিছুতেই নিরাপদ বোধ করতে পারছি না।

বার্তাবহ :

কিন্তু, স্যার, আপনি কোন নারীর কথা বলছেন যার ভয়ে আপনি এখনো ভীত?

ইডিপাস :

কেন? আমি বলছি পলিবাসের স্ত্রী রানী মেরোপির কথা।

বার্তাবহ :

তাঁর কথা? তিনি কিভাবে আপনার জীবনকে বিপন্ন করবেন?

ইডিপাস :

একটা দৈববাণী আছে, স্যার, অতিশয় মর্মান্তিক ধারার।

বার্তাবহ :

একজন ভিনদেশি মানুষের কাছে কি তা বলা যায়?

ইডিপাস :

হ্যাঁ। লাক্সিয়াস বলেছেন যে আমি আমার জননীকে আমার স্ত্রী বানাবো, আমার পিতাকে হত্যা করবো আমার নিজের হাতে, এই সবই পূর্বাহ্নে নিয়তি নির্ধারিত। কোরিন্থ থেকে আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির এটাই কারণ। আর তার ফল আমার জন্য কল্যাণকরই হয়েছে, যদিও অনুপস্থিত পিতা-মাতার স্থান কোনো কিছু দ্বারাই পূরণ সম্ভব নয়।

বার্তাবহ :

ওই ভয়ই কি আপনাকে এতো কাল স্বদেশ থেকে নির্বাসিত করে রেখেছে?

ইডিপাস :

হ্যাঁ। আমার পিতাকে হত্যা না করতে আমি ছিলাম দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ।

বার্তাবহ :

তাহলে আমাকে আপনার ওই শঙ্কা থেকে মুক্ত করতে দিন। আমি এখানে এসেছি আপনার মঙ্গল সাধনের জন্য।

ইডিপাস :

আমার কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে আমি কার্পণ্য করবো না।

বার্তাবহ :

আর সত্য কথাটি বলা হলে আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আমারও মঙ্গল সাধন করবে।

ইডিপাস :

আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন? না, না কখনো না। একই ছাদের নিচে আমার পিতা-মাতার সঙ্গে—

বার্তাবহ :

শুনুন, আপনি প্রবঞ্চনার শিকার হয়েছেন।

ইডিপাস :

কেমন করে? সহৃদয় ভদ্রমহোদয়, ঈশ্বরের দোহাই, বলুন আমাকে।

বার্তাবহ :

এই ভয়, যা আপনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে দিচ্ছে না–

ইডিপাস :

হ্যাঁ, তাই। ফিবাসের বাণী এখনো আমার জন্য সত্য হয়ে উঠতে পারে।

বার্তাবহ :

নিজের পিতামাতার মাধ্যমে আপনার কলুষিত হবার সেই কাহিনী?

ইডিপাস :

হ্যাঁ, স্যার, তাই। সেটাই আমার সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা।

বার্তাবহ :

এই সবই নিরর্থক, স্যার। আপনার যাবতীয় ভয় ভিত্তিহীন, অমূলক।

ইডিপাস :

কেমন করে তা সম্ভব? আমি তো ওদের পুত্র।

বার্তাবহ :

না। পলিবাস আপনার সঙ্গে সম্পর্কিত কেউ নন।

ইডিপাস :

কী বলছেন আপনি? আমার সঙ্গে সম্পর্কিত কেউ নন? পলিবাস আমার পিতা নন?

বার্তাবহ :

না। আমি যেমন আপনার পিতা নই, তিনিও তেমনি তা নন।

ইডিপাস :

কি বলতে চান আপনি? বলুন, সব কিছু পরিষ্কার করে বলুন, স্যার।

বার্তাবহ :

আমি যেমন আপনার পিতা নই, পলিবাসও তেমনি আপনার পিতা নন।

ইডিপাস :

তাহলে কেন সবাই আমাকে তাঁর পুত্র বলে?

বার্তাবহ :

বলছি আপনাকে। আমিই আপনাকে ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম।

ইডিপাস :

তুলে দিয়েছিলেন? তবুও তিনি আমাকে ভালোবাসেন তাঁর আপন পুত্রের মতো?

বার্তাবহ :

আর কোনো পুত্র ছিল না তাঁর

ইডিপাস :

আমাকে কি … কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া যায়, নাকি আমাকে কারো কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়?

বার্তাবহ :

কুড়িয়ে পাওয়া যায়। সিথারনের এক বনানীর গুহায়। আমিই আপনাকে সেখান থেকে তুলে আনি।

ইডিপাস :

আপনি সেখানে কেন গিয়েছিলেন?

বার্তাবহ :

পাহাড়ের বুকে মেষ চরাবার জন্য।

ইডিপাস :

আপনি কি ক্রীতদাসের মতো ভাড়ায় খাটা মেষপালক ছিলেন?

বার্তাবহ :

ঠিক তাই। এবং সৌভাগ্যবশত, আপনার রক্ষাকর্তা।

ইডিপাস :

তার মানে? আমি কি কোনো যন্ত্রণা অথবা বিপদের মধ্যে ছিলাম?

বার্তাবহ :

আপনার গোড়ালির বৈকল্যই সে কথা বলে দেয়।

ইডিপাস :

ওহ্, সেই পুরানো অসুবিধার কথা বলছেন? তার উল্লেখ করা কি খুব প্রয়োজনীয়?

বার্তাবহ :

আপনার দুই গোড়ালি বল্টু দিয়ে আটকানো ছিল। আমি আপনাকে মুক্ত করে দিই।

ইডিপাস :

একথা সত্য। আমার শিশুকাল থেকে আমি ওই কলঙ্কের চিহ্ন বহন করে আসছি।

বার্তাবহ :

আপনার বর্তমান নামের উৎস সেটাই।

ইডিপাস :

হা দেবতাকুল! ওই কাজটি কে করেন? আমার বাবা, না আমার মা?

বার্তাবহ :

তা আমি বলতে পারবো না। যে আপনাকে আমার হাতে তুলে দেয় তাকে জিজ্ঞাসা করুন।

ইডিপাস :

তুলে দেয়? তাহলে আপনি নিজে আমাকে খুঁজে পান নি?

বার্তাবহ :

অন্য একজন মেষপালক আপনাকে আমার হাতে তুলে দেয়।

ইডিপাস :

কে সে? সে কে ছিল, আপনি কি আমাকে তা বলতে পারেন?

বার্তাবহ :

আমার মনে হয় সে লেয়াসের নিজের লোকদের একজন ছিল।

ইডিপাস :

লেয়াসের? আমাদের ভূতপূর্ব রাজার

বার্তাবহ :

হ্যাঁ, সে ছিল রাজা লেয়াসের ভৃত্যদের একজন।

ইডিপাস :

ও কি বেঁচে আছে? আমি কি ওকে একবার দেখতে পারি?

বার্তাবহ : আপনার লোকরা সে কথা ভালো বলতে পারবে।

ইডিপাস :

সুজনবৃন্দ, আপনাদের কেউ কি ওই লোকটির কথা জানেন? যে মেষপালকের কথা ইনি বলছেন তার কথা? কেউ কি তাকে চারণক্ষেত্রে কিংবা নগরীর কোথাও দেখেছেন? যদি এ সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন তাহলে বলুন। রহস্য উদ্ঘাটনের চূড়ান্ত সুযোগ এখন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।

কোরাস :

আমার মনে হয়, আপনি আবিষ্কার করবেন, যে গ্রামাঞ্জলের মানুষটির সঙ্গে আপনি দেখা করতে চেয়েছেন সে ওই একই ব্যক্তি। আমার এ অনুমান ঠিক কিনা সে সম্পর্কে রানীই সব চাইতে ভালো বলতে পারবেন।

ইডিপাস : বউ আমার, যে লোকটিকে আমরা ডেকে পাঠিয়েছি এ কি তার কথাই বলছে?

ইয়োকাস্তা : [আতঙ্কে তার মুখ সাদা হয়ে যায়] ও কার কথা বলছে তাতে কি এসে যায়? এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায় না। … ও তোমাকে কী বলেছে তার কথা ভুলে যাও … এখন সবই নিরর্থক।

ইডিপাস :

কী বাজে কথা বলছো! আমার জন্ম-রহস্য আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এই সূত্র ধরে আমাকে অগ্রসর হতেই হবে।

ইয়োকাস্তা :

না! দোহাই ঈশ্বরের, তুমি যদি বেঁচে থাকতে চাও তাহলে এই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করো। আমি কি ইতিমধ্যে যথেষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করি নিঃ

ইডিপাস :

ভয়ের কিছু নেই। আমি যদি তিন পুরুষের ক্রীতদাসও প্রমাণিত হই, তাহলেও তোমার সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে না।

ইয়োকাস্তা :

তবু এ কাজ তুমি করো না। আমি মিনতি করছি, করো না।

ইডিপাস :

করতেই হবে আমাকে। আমি সত্যকে কিছুতেই অনাবিষ্কৃত রাখতে পারবো না।

ইয়োকাস্তা : আমি জানি আমি ঠিক কথাই বলছি। তোমার মঙ্গলের জন্যই আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

ইডিপাস :

আমার মঙ্গলই বড় বেশি কাল ধরে আমার জুজু হয়ে আছে। হায় দুর্ভাগা! সত্য জানবার জন্য তুমি বেঁচে থেকো না যেন।

ইয়োকাস্তা :

যাও একজন কেউ। ওই মেষপালককে নিয়ে এসো। রানীর জন্মের গৌরব নিয়ে তাঁকে একা থাকতে দাও।

ইয়োকাস্তা :

ওহ্, তুমি শেষ হয়ে গেছো! চরম অভিশপ্ত তুমি! তোমার উদ্দেশে এই আমার শেষ কথা। চিরদিনের জন্য!

[প্রস্থান]

কোরাস :

রানী ওই রকম সাংঘাতিক বিচলিত হয়ে চলে গেলেন কেন? আমার ভয় হচ্ছে তাঁর না-বলা কথা থেকে একটা চরম বিপর্যয় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

ইডিপাস :

যতো কুৎসিতই হোক, সব কিছু উদ্ঘাটিত হোক! যতো জঘন্যই হোক আমাকে আমার জন্মের রহস্য আবিষ্কার করতেই হবে। এই নারী, তাঁর নারীত্বের অহঙ্কারের চাইতে বেশি অহঙ্কার নিয়ে, আমার নিচু ঘরে জন্মগ্রহণের জন্য লজ্জা বোধ করছেন। কিন্তু আমি সৌভাগ্যের বরপুত্র, আমি সকলের কল্যাণ সাধন করেছি, আমি কেন লজ্জার পাত্র হবো? ভাগ্য আমার জননী, ঋতুসকল আমার বোন। আমার উত্থান-পতন তাদের হাত ধরে চলে। ওই ভাবে জন্ম নিয়ে, আমি যা আছি তাই থাকতে চাই, কখনো অন্য কোনো মানুষ হতে চাই না আমি। এবং আমি কে তা আমি জানবোই।

কোরাস :

আমার ভবিষ্যদ্বাণীর দৃষ্টি যদি ভুল না করে তাহলে আগামী কালের চাঁদ ধরণীর সবার কাছে আমাদের প্রভুর জন্মরহস্য উদ্ঘাটন করে দেবে। সিথেরনের নামে পূর্ণ হবে আমাদের সঙ্গীত; আমাদের রাজার পিতা, মাতা ও ধাত্রী ছিলেন তিনি, আর আমাদের মহান রাজাকে ওই বরদানের জন্য আমরা তাঁর প্রশংসা করবো সর্বদা। প্রভু ফীবাস, তোমার ইচ্ছায় এটাই যেন ঘটে।

পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো প্যান-এর প্রেমদৃষ্টিতে প্রতারিত হয়ে কোনো আদিম পরী কি জন্ম দিয়েছিল এই সন্তানকে? কিংবা এই শিশু কি লক্সিয়াসের, প্রোজ্জ্বল ঈশ্বরেরই পুত্র, যে বিচরণ করে সুউচ্চ তৃণভূমির বুকে? সে কি আনন্দ দান করেছিল মিলেনির প্রভুকে? নাকি হেলিকনে ডায়োনিসাস যে পরীর প্রেমে পড়েছিলেন তার কাছ থেকেই তিনি একে গ্রহণ করেন?

ইডিপাস :

প্রবীণবৃন্দ, আমার মনে হয় আমাদের মেষপালককে আমরা এদিকে এগিয়ে আসতে দেখছি। ওকে আমি আগে কখনো না দেখলেও আমার মনে হয় এই হলো সেই ব্যক্তি। সে আর আমাদের করিন্থিয় বন্ধু একই বয়সের। তবে আপনার চেনা চলে আপনি আরো নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেন।

কোরাস :

হ্যাঁ, এই সেই ব্যক্তি, লেয়াসের মেষপালক, তাঁর অধীনস্থ অত্যন্ত ভালো মানুষ একজন।

[কতিপয় সহচর পরিবৃত এক বয়স্ক মেষপালক প্রবেশ করে]

ইডিপাস :

এবার, সুজন করিন্থিয়, প্রথমে আপনার সাক্ষ্য—আপনি কি এই লোকটির কথা বলেছিলেন?

বার্তাবহ :

হ্যাঁ, এই সেই লোক।

ইডিপাস :

আসুন এবার, বৃদ্ধ মেষপালক, দয়া করে আমার দিকে তাকান, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনি কি লেয়াসের অধীনে চাকরি করেছিলেন?

মেষপালক :

হ্যাঁ, প্রভু, এখানেই জন্মেছি আমি, এখানেই লালিত-পালিত হয়েছি। আমাকে ক্রয় করে আনা হয় নি।

ইডিপাস :

কি কাজ করতেন আপনি? কোন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন?

মেষপালক :

আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি কাটিয়েছি একজন মেষপালক হিসাবে, স্যার।

ইডিপাস :

দেশের কোন এলাকায় আপনি বেশির ভাগ সময় কাজ করেছেন?

মেষপালক :

মনে হয়… সিথেরন … কিংবা তার কাছাকাছি কোনো জায়গায়।

ইডিপাস :

এই লোকটিকে আগে কখনো দেখেছেন বলে কি আপনার মনে পড়ে?

মেষপালক :

একে? কোথায় আমি একে আগে দেখবো?

ইডিপাস :

এই লোক, এর সঙ্গে কি আগে আপনার কোথাও দেখা হয়েছে?

মেষপালক :

হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। মনে পড়ছে না, স্যার।

বার্তাবহ :

আমি অবাক হচ্ছি না। দাঁড়ান, আমি ওর স্মৃতি চাঙ্গা করে দিচ্ছি। আমরা, ও আর আমি, যখন সিথেরনে পাশাপাশি ছিলাম, সে সব দিনের কথা ভোলা যাবে না। ওর ছিল দুটি মেষের পাল, আর আমার একটা। বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত তিন বছর আমরা পাশাপাশি মেষ চরিয়েছি, তারপর শীতের সময় আমি আমার পাল নিয়ে চলে যেতাম করিন্থে, আর ও যেতো লেয়াসের ওখানে থীবিতে। তাই না?

মেষপালক :

হ্যাঁ, ঠিক তাই। বহু দিন আগের কথা এটা।

বার্তাবহ :

তো, তোমার কি মনে পড়ে, তুমি একটা ছোট্ট ছেলেকে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলে আমি যেন ওকে আমার নিজের সন্তানের মতো করে লালন-পালন করি?

মেষপালক :

(তার চোখে ভয় ঘনিয়ে আসে) কি বলতে চাও তুমি? আমার মুখ থেকে কী কথা তুমি বের করে আনতে চাও?

বার্তাবহ :

কেন? বন্ধু আমার, এখন এইখানে দাঁড়িয়ে আছে তোমার সেই ছোট্ট ছেলে!

মেষপালক :

আহ্, জাহান্নামে যাও তুমি! চুপ করো এবার!

ইডিপাস :

আহ্! ওকে বলতে দিন। আমার মনে হয় ও আপনার চাইতে বেশি সততার সঙ্গে তার কথা বলছে।

মেষপালক :

কেন প্রভু? আমি কি অপরাধ করলাম?

ইডিপাস :

ওই শিশু সম্পর্কে আপনি সোজাসুজি ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর দেন নি।

মেষপালক :

উনি কী বলছেন বুঝতে পারছেন না। উনি ভুল করছেন।

ইডিপাস :

আপনি স্বেচ্ছায় না বললে আপনাকে বলাতে বাধ্য করতে হবে আমাদের।

মেষপালক :

ঈশ্বরের দোহাই, একজন বুড়ো মানুষকে পীড়ন করবেন না।

ইডিপাস :

কে আছো? ওর দু’হাত বাঁধো!

মেষপালক :

ওহ্ স্যার! এ কি করছেন? আমি আর কী বলবো? আপনি আর কী জানতে চান?

ইডিপাস :

উনি যে ছোট্ট ছেলের কথা বললেন, আপনি কি তাকে এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন?

মেষপালক :

হ্যাঁ, তাই। ওহ্, সেদিনই যদি আমার মৃত্যু হতো!

ইডিপাস :

সত্য কথা যদি না বলেন তাহলে এখনই তা ঘটবে।

মেষপালক :

সত্য কথা বললেই আমার মৃত্যু ঘটবে।

ইডিপাস :

এখনো এড়িয়ে যাচ্ছেন?

মেষপালক :

আমি কি বলি নি যে আমি ওকেই শিশুটি দিয়েছিলাম? আর কি শুনতে চান আপনি?

ইডিপাস :

কোথা থেকে আসে ও? আপনার বাড়ি থেকে, নাকি অন্য কোনো একজনের বাড়ি থেকে?

মেষপালক :

আমার বাড়ি থেকে নয়, আরেকজনের বাড়ি থেকে।

ইডিপাস :

কে ওই লোক? কার বাড়ি?

মেষপালক :

দেবতাদের দোহাই, প্রভু, আর কোনো প্রশ্ন করবেন না।

ইডিপাস :

জবাব দিন! আমাকে আরেকবার কথা বলতে হলে আপনার নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে!

মেষপালক :

ওই শিশু ছিল লেয়াসের গৃহের।

ইডিপাস :

কোনো ক্রীতদাসের ছেলে, নাকি লেয়াসের নিজের?

মেষপালক :

আমাকে কি বলতেই হবে?

ইডিপাস :

হ্যাঁ, আপনাকে বলতেই হবে, আর আমাকেও শুনতেই হবে।

মেষপালক :

ওরা বলেছে, ওই শিশু ছিল লেয়াসের নিজের। আপনার স্ত্রী এ সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেন।

ইডিপাস :

তিনি তাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন?

মেষপালক :

হ্যাঁ, প্ৰভু।

ইডিপাস :

কি উদ্দেশ্যে?

মেষপালক :

ওকে শেষ করে দেবার জন্য।

ইডিপাস :

নিজের গর্ভজাত সন্তানকে?

মেষপালক :

হ্যাঁ, প্ৰভু। লোকে বলে, এর মূলে ছিল একটা অশুভ জাদু।

ইডিপাস :

কি জাদু?

মেষপালক :

ওই শিশু নাকি তার পিতাকে হত্যা করবে।

ইডিপাস :

কিন্তু ওই শিশুকে আপনি এই লোকটির হাতে কেন তুলে দিলেন?

মেষপালক :

আমি প্রাণ ধরে তাকে মেরে ফেলতে পারি নি, প্রভু। আমি ভেবেছিলাম ও শিশুটিকে অন্য কোনো দেশে নিয়ে যাবে, তার নিজের গৃহে নিয়ে যাবে। তাই করে ও, শিশুটির প্রাণ রক্ষা করে ও। কিন্তু এ কী পরিণতি হলো তার! আপনিই যদি সেই লোক হন, তাহলে আপনার আর কোনো আশা নেই!

ইডিপাস :

হায়! সব এখন উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে। কোনো কিছুই আর গোপন নেই। ওহ্ আলো! আর যেন আমাকে কখনো আলোর মুখ দেখতে না হয়। আমার সকল পাপ নিয়ে আমি এখন সবার সামনে উন্মোচিত; পাপের মধ্যে আমার জন্ম, পাপের মধ্যে আমার বিবাহ, পাপের মধ্যে আমি রক্তপাত ঘটিয়েছি।

[প্রস্থান]

[বার্তাবহ এবং মেষপালকও প্রস্থান করে]

কোরাস :

প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ, শেষ পর্যন্ত তাদের যোগফল হয় শূন্য। আমাকে এমন একজন মানুষ দেখান যার মুখ শেষ পর্যন্ত অলীক স্বপ্নে পরিণত হয় নি, যার মুখ শেষ পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে যায় নি এখানেই আছে তার দৃষ্টান্ত, এই যে ইডিপাস, এখানেই আছে সেই যুক্তি যার জন্য আমি মরণশীল কোনো মানুষকে সুখী আখ্যায়িত করবো না।

কী পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে তিনি তার লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হয়েছিলেন, দোহাই জিউসের, অর্জন করেছিলেন প্রতিটি পুরস্কার! একবার তিনি বিধ্বস্ত করেছিলেন পিশাচীকে, তীক্ষ্ণ নখরযুক্ত পায়ের সেই নারীকে। তিনি ছিলেন সকল বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সুরক্ষিত দুর্গ, আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন রাজন। তাঁর নামের মাহাত্ম্যে গর্ববোধ করতো সমগ্ৰ থীবি;

আর এখন, এর চাইতে হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা আর কোথায় আছে? এর চাইতে ভয়ঙ্কর নির্যাতন আর কোন দিকে আছে? ও ইডিপাস, ওই গর্বিত শির! যখন একই বক্ষ ধারণ করে পুত্র এবং পিতাকে তখন কি তা চিৎকার করে তার ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারবে না?

কাল সর্বদ্রষ্টা। আর এখন, যখন আপনি বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা করেন নি তখন কাল আপনাকে খুঁজে পেয়েছে এবং বিচার করেছে সেই বিয়ের প্রহসনের, বধূ-বর-পুত্র! এই হলো আপনার শোকগাথা। লেয়াসের পুত্র, আপনার সঙ্গে আমার কখনো দেখা না হলেই ভালো হতো। গতকাল আপনি ছিলেন আমার ঊষার আলো, আর আজ আমার অন্তহীন অন্ধকারের অমানিশা!

[প্রাসাদ থেকে জনৈক অনুচরের প্রবেশ ]

অনুচর :

থীবি নগরীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ, আপনারা যদি ল্যাবডাকাস বংশের প্রকৃত সন্তান এবং তার প্রতি অনুগত হন তাহলে এখন যেসব জিনিস দেখবেন, যেসব জিনিস শুনবেন, তার জন্য ক্রন্দন করুন। এই ভবনের ভেতরে যেসব চরম গর্হিত কাজ সংঘটিত হয়েছে, যার কথা আপনারা শীঘ্রই অবগত হবেন, সকল ভয়ঙ্কর কার্যাবলীর মধ্যে ভয়ঙ্করতম কাজগুলি, স্বেচ্ছায় যা বেছে নেয়া হয়, তাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে পারবে না ইস্থারের সমগ্র জলরাশি, ফাসিসের সমগ্র জলরাশি।

কোরাস :

আমরা যা জেনেছি, যেসব জিনিস দেখেছি তার জন্য ইতিমধ্যে আমরা যথেষ্ট অশ্রু বিসর্জন করেছি, আর কী বলবেন আপনি?

অনুচর :

প্রথমে, সংক্ষেপে বলছি, রানী মৃত্যুবরণ করেছেন।

কোরাস :

হায়, বেচারী! কি হয়েছিল তাঁর?

অনুচর :

তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আপনারা যারা এ দৃশ্য দেখেন নি, দেখবেন না, তারা কম যন্ত্রণা ভোগ করবেন। কিন্তু আমি দেখেছি এবং আমার স্মরণে তা জেগে থাকবে, আর আমি এখন আপনাদেরকে তাঁর শেষ যন্ত্রণার কথা বলবো।

আপনারা দেখেছেন কী রকম চরম বিচলিত হয়ে তিনি ভেতরে চলে যান। তিনি দ্রুতবেগে সোজা চলে যান তাঁর বিয়ের খাটে, তিনি তখন তাঁর চুলের ভেতরে আটকে ধরেছিলেন তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলি। তাঁর ঘরের ভেতরে ঢুকে তিনি, দীর্ঘকাল আগে মৃত্যুবরণ করা লেয়াসের নাম ধরে বিলাপ করলেন, স্মরণ করলেন সেই পুত্রকে যাকে তিনি অনেকদিন আগে গর্ভে ধারণ করেছিলেন, সেই পুত্রকে যার ঔরসে তিনি জন্ম দেন আরো কয়েকটি সন্তানকে, হতভাগ্য ওই অবৈধ মিলনের কয়েকটি ফসল। তাঁর স্ত্রীত্বের দু’দফা ভ্রান্তির পরিণতি, স্বামী থেকে জন্ম নেয়া স্বামী, সন্তান থেকে সন্তান। এইটুকুই আমরা শুনতে পাই। তাঁর ট্রাজেডি চোখে দেখবার আগেই কর্ণবিদারী চিৎকার করতে করতে রাজা এসে ভেতরে ঢোকেন। তখন আমাদের সকলের চোখ নিবদ্ধ হয় শুধু তাঁর উপর। তিনি আমাদের মধ্যে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে, যান। তিনি চিৎকার করে বলেন, একটা তরবারি, একটা তরবারি! কোথায় সেই স্ত্রী, যে স্ত্রী নয় আমার, সেই জমি যেখানে আমাকে বপন করা হয়েছিল, তারপর যেখান থেকেই আমি ঘরে তুলেছি আমার ফসল! এইভাবে তিনি উন্মাদের মতো চিৎকার করে চলেন। আমরা কেউ কোনো কথা বলতে সাহস করি না। তারপর, যেন কোনো অপদেবতা দ্বারা চালিত হয়ে, রানী যেখানে আছেন সেখানে ছুটে গেলেন তিনি। উন্মত্ত চিৎকার করতে করতে তিনি নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন তালাবন্ধ দরজার বুকে। নিছক গায়ের জোরে কোটরের ভেতর থেকে দরজার হুড়কা বাঁকা করে, হুমড়ি খেতে খেতে, ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন তিনি।

আর আমরা তখন খোলা দরজা দিয়ে দেখলাম একটা পাকানো দোলক, একটা ফাঁস, আর আমাদের চোখের সামনে দুলতে দেখলাম শ্বাসরুদ্ধ এক নারীর মৃতদেহ।

অনুচর :

রাজাও দেখলেন। হৃদয়বিদারক চিৎকার করতে করতে তিনি দড়ি খুলে ওঁকে মেঝেতে শুইয়ে দিলেন। কিন্তু আরো কঠিন দৃশ্য তখনো বাকি ছিল। রানীর পোশাক আটকানো ছিল সোনার পিন দ্বারা। রাজা ওই পিন ওঁর কাপড় থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাঁর বাহু প্রসারিত করে সজোরে নিজের চোখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন ওই পিন, ওই চোখ যেন আর তাঁর লজ্জা, তার অপরাধ, দেখতে না পায়, যা কখনোই দেখা উচিত ছিল না, যাদের দেখার জন্য তিনি সতত উন্মুখ থাকতেন, তাদের যেন আর কখনো দেখতে না হয়, এখন থেকে শুধু রাত্রি ছাড়া আর কিছুই তিনি দেখবেন না এই রকম উন্মত্ত বাক্যাবলি উচ্চারণ করতে করতে তিনি তাঁর চোখের কোটরের মধ্যে ওই পিন ঢুকিয়ে দিতে থাকেন, বারবার, অবশেষে রক্তাক্ত অশ্রু তাঁর শ্মশ্রু বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, ফোঁটা ফোঁটা করে নয়, প্রবল ধারায়, যেন লাল বৃষ্টির এক খাড়া জলপ্রপাত সব কিছু ভিজিয়ে দিয়ে সবেগে নেমে আসে।

এইভাবে পাপ সংঘটিত হয় দু’জন দ্বারা, আর একজনের উপর নয়, দুজনের মাথার উপর নেমে আসে মিশ্রিত দণ্ড। আগেকার সময়ের তাদের দীর্ঘকালীন সুখ অর্জিত হয়েছিল ন্যায়সঙ্গতভাবে, কিন্তু আজ চরম বিপর্যয়, মৃত্যু, ধ্বংস, যতো অশুভ ও অকল্যাণের নাম করা যায় সব এখানে এখন এসে হাজির হয়েছে।

কোরাস :

আর উনি? এখন কেমন আছেন উনি? এখনো কি কষ্ট পাচ্ছেন?

অনুচর :

উনি চিৎকার করে ডাকছেন, কেউ যেন এসে দরজা খুলে দেয়, সমগ্ৰ থীবিকে যেন দেখায় পিতার হত্যাকারীকে, মাতার—ওই অপবিত্র শব্দটি উচ্চারণ করতে দেয় না তার গভীর লজ্জা। নিজের মুখে উচ্চারিত অভিশাপ থেকে এই গৃহকে মুক্ত করার জন্য তিনি অবিলম্বে এদেশ থেকে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু, আহা, বেচারা, তার দেহে কোনো শক্তি নেই এখন, আর তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যও নেই কেউ। এ যন্ত্রণা আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না। আপনারা নিজেরাই যা এখন দেখতে পাবেন। ওই যে, দরজা খুলে যাচ্ছে। হ্যাঁ, আপনারা দেখবেন এক বেদনাময় দৃশ্য, ঘৃণ্য, কিন্তু তা আপনাদের চিত্তে করুণা জাগিয়ে তুলবে …

[ইডিপাসের প্রবেশ, অন্ধ]

কোরাস : আহ্!

এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য সহ্য করা যায় না! এতো জঘন্য বিকৃতি আমি কখনো চোখে দেখি নি আগে। কী অসম্ভব যন্ত্রণা! নিয়তির কোন পিশাচ প্ৰবল দ্রুত আক্রমণের মাধ্যমে আপনাকে এভাবে ধরাশায়ী করলো? ওহ্, আমার মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে! আমার সাহস হচ্ছে না দেখার, আমি আমার চোখ ঢেকে রেখেছি। আমি যা দেখার জন্য উন্মুখ তা আমি সহ্য করতে পারবো না, যা শোনার জন্য আমি উন্মুখ তা শুনতে আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।

ইডিপাস :

ওহ্, অসহ্য এ যন্ত্রণা! আমি কোথায় এখন? এই যে কণ্ঠস্বর বাতাসে ভাসছে তা কি আমার? এ কী নিয়তি হলো আমার?

কোরাস :

অনুচ্চার্য মানুষের কাছে, এতো ভয়ঙ্কর যে চোখে দেখা যায় না।

ইডিপাস :

অসহনীয় এই রাত্রি, যার হাত থেকে মুক্তি নেই, যার শেষে নেই কোনো দিন। শুধু মেঘ, কোনো হাওয়ার সাধ্য নেই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ওহ্, আবার, আবার সেই তীব্র ব্যথা, দেহে এবং আত্মার তমসাচ্ছন্ন স্মৃতিতে সেই পীড়ন।

কোরাস :

এরকম হয়। এই রকম যন্ত্রণা সইতে হয় দু’বার, একবার দেহে, আরেকবার আত্মায়।

ইডিপাস :

আমার আন্তরিক ও চির-বিশ্বস্ত সুহৃদ কি এখনো আমার পাশে আছে? তোমার হাত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে এই অন্ধ মানুষটিকে। এখনো কাছে আছো তো তুমি? তোমার মুখ দেখতে না পেলেও ওই যে কণ্ঠস্বর আমি শুনছি তা তো তোমার।

কোরাস :

ওই চোখ … কেমন করে আপনি আপনার চোখের এই অবস্থা করতে পারলেন? কোন অশুভ শক্তি আপনাকে এ কাজে প্ররোচিত করলো?

ইডিপাস :

অ্যাপোলো, বন্ধুগণ, অ্যাপোলো আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন এই দুঃসহ যন্ত্রণা। তবে তিনি নিজের হাতে এটা করেন নি, আমিই করেছি। সবই যেখানে কদর্য সেখানে কী করবো আমি আমার চোখ দিয়ে?

কোরাস :

সেকথা অস্বীকার করা যায় না।

ইডিপাস :

কোথায় আছে আমার দেখার মতো কোনো সৌন্দর্য? কোথায় আছে দেখবার বা শোনবার মতো সুকুমার কিছু? চলো! আমাকে দ্রুত নিয়ে চলো এ দেশ থেকে। আমার আর কোনো আশা নেই। আমি দেবতাকুলের ঘৃণার পাত্র, আমার মতো এতো অভিশপ্ত আর কেউ কোথাও নেই।

কোরাস :

দু’ভাবে যন্ত্রণাপীড়িত, একবার আত্মায়, আরেকবার দেহে। ওই ধাঁধার উত্তর দেবার জন্য যদি আপনি বেঁচে না থাকতেন তাহলেই ভালো হতো!

ইডিপাস :

যে উপকারীজন আমার পায়ের বন্ধন মোচন করে আমাকে মৃত্যুর পরিবর্তে জীবন দান করেছিলেন আমি তাকে অভিশাপ দিচ্ছি, তা না করলেই ভালো হতো। মৃত্যু আমার ও আমার সকল আপনজনের জন্য একটা আশীর্বাদ হতো।

কোরাস :

আমাদেরও তাই মনে হয়।

ইডিপাস :

এখন আমার নাম পিতার রক্তপাতকারী, মাতার স্বামী। ঈশ্বরপরিত্যক্ত আমি, লজ্জার সন্তান, ভ্রাতা-পুত্রদের জন্মদাতা। ইডিপাসের জন্য কলঙ্কের আর কী অভীধা বাকি থাকলো?

কোরাস :

তবু আমাদের মনে হয় আপনার কাজটি অবিবেচকের মতো হয়েছে। অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে মরণও ভালো ছিল।

ইডিপাস :

আমার কাজটিই যে সর্বোত্তম হয় নি তা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবো না। অন্য কোনো শিক্ষা দেবেন না আমাকে। কবরের ওপারে চক্ষুষ্মান হয়ে কি করে আমি আমার পিতার মুখোমুখি হতাম? কি করেই বা আমি আমার যে দুঃখী জননীর সঙ্গে জঘন্যতম পাপে লিপ্ত হয়েছি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমার দুচোখ দিয়ে তাঁকে দেখতাম? শুধু মৃত্যু দিয়ে ওই পাপের শাস্তি হয় না! যেভাবে আমার সন্তানদের জন্ম হয়েছে তার পরও কী আমি সস্নেহ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাতে পারতাম? ওই মধুর দৃশ্য দেখার জন্য আমি কি আমার চোখ কামনা করতে পারতাম? আমি, থীবির মহত্তম এবং তার সব চাইতে দুঃখী সন্তান, আমি তো নিজেই আমার চোখের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি তার সুউচ্চ মিনার, তার পবিত্র প্রতিমাসমূহ এবং আদেশ দিয়েছি সবাই যেন ওই অপরাধীকে, ওই ক্লেদাক্ত জিনিসটিকে, যাকে দেবতারা অভিশপ্ত ঘোষণা করেছেন, লেয়াসের ওই সন্তানকে, দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। এখন আমি নিজে সেই অভিশপ্ত ব্যক্তি প্রমাণিত হবার পর আমি কি এখন লোকজনের তীব্র দৃষ্টির মুখোমুখি হবার জন্য আমার দৃষ্টিশক্তি কামনা করতে পারি? না! শ্রবণশক্তিও না! যদি ওই পথ রুদ্ধ করবার কোনো উপায় আমার জানা থাকতো তাহলে আমার এই লজ্জাকর শরীরটাকে সম্পূর্ণ শূন্যতার মধ্যে ঢেলে দেবার আগে পর্যন্ত আমি শান্ত হতাম না। তাহলেই শুধু আমি যন্ত্রণার আওতার বাইরে শান্তি লাভ করতাম।

সিথেরন! ধাত্রী-জননী! এই জন্যই কি তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে? পৃথিবীকে আমার জন্মের কথা জানাবার জন্য বাঁচিয়ে না রেখে তুমি কি সেই মুহূর্তে আমাকে মৃত্যুবরণ করতে দিতে পারতে না? করিন্থ এবং পলিবাস, আমার আপতদৃশ্যমান স্বদেশ ও পিতা, তোমরা কি কখনো ভেবেছিলে যে তোমাদের দত্তক নেওয়া পুত্রের কমনীয়তার আড়ালে এই ধরনের একটা কদর্য পচন বেড়ে উঠছে? সকল অশুভ এবং অশুভজাত সব কিছু এখন উন্মোচিত। বনানীর খোলা জায়গায় সড়কের নিঃশব্দ ওই সংযোগস্থল, তিন রাস্তার মিলনস্থলের পাশের ওই ঝোপ, যার জমি আমি সিক্ত করেছি আমার পিতার রক্তে, আমার রক্তে, তারা যা দেখেছিল তাকি তাদের মনে পড়বে? তাদের কি মনে পড়বে কী করবার জন্য আমি এই পথে থীবিতে এসেছিলাম? অজাচারী পাপ! সেইখানে সন্তান উৎপাদন করা যেখানে আমি নিজে উৎপাদিত হয়েছি! পিতা, ভ্রাতা এবং পুত্র; বধূ, স্ত্রী এবং মাতা; একটা উৎকট বিবাহের মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাওয়া! তাবৎ মানবীয় কদর্যতা একটা অপরাধের মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া! অকথনীয় কর্মকা আর আমি ওসব কথা বলবো না। দোহাই ঈশ্বরের, আমাকে এক্ষুনি লুকিয়ে ফেলো! এক্ষুনি দূরে কোথাও নিয়ে চলো। হত্যা করো আমাকে! সমুদ্রের অতল জলে আমাকে ডুবিয়ে মারো! নাও আমাকে (তার হাত হাতড়ে ফেরে, কোরাস আড়ষ্ট হয়ে পেছনে সরে আসে) করুণা করো, আমাকে স্পর্শ করো, নিয়ে যাও আমাকে এখান থেকে। ভয়ের কিছু নেই। আমার নিজের উপরই শুধু আমার শান্তির চাবুকে নেমে আসবে, আর কারো উপরে নয়।

কোরাস :

ওই যে ক্রিওন আসছেন। ওঁর উপরই নির্ভর করবে, কর্মে এবং নির্দেশে, আপনার ইচ্ছার পরিণতি। আপনার জায়গায় তিনি এখন আমাদের একমাত্র রক্ষাকর্তার আসনে প্রতিষ্ঠিত।

ইডিপাস :

ওঁর কাছে আমি কী বলবো? এখন ওঁর কাছে আমার কোন মিনতি সুবিচার লাভ করবে? এখন তো দেখা যাচ্ছে আমি তাঁর উপর চরম অবিচার করেছি।

[ক্রিওনের প্রবেশ]

ক্রিওন :

ইডিপাস, আপনার পতনে আপনাকে বিদ্রূপ করার জন্য আমি এখানে আসি নি। আপনার অপকর্মসমূহের জন্য আপনাকে তিরস্কার করাও আমার উদ্দেশ্য নয়।

বন্ধুগণ, মানবসন্তানদের জন্য যদি নাও হয়, জীবনের প্রভুর জন্য, ঊর্ধ্বাকাশে জ্বলজ্বল করা সূর্যের জন্য আপনাদের শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলুন। কলুষিত মানুষটির এখানে থাকা চলবে না কিছুতেই। মাটি কিংবা বায়ু কিংবা জল কেউ তাকে গ্রহণ করবে না। এখন ওকে ভেতরে নিয়ে যান। রক্তের সঙ্গে সম্পর্কিত তার আপনজন ছাড়া কেউ যেন তার কথা না শোনে, তার এই যন্ত্রণা না দ্যাখে। ধর্মবোধ অন্তত এতোটুকু দাবি করে।

ইডিপাস :

আমার সহৃদয় বন্ধু, আমার মতো একজন মানুষের প্রতি আপনার এই সহৃদয়তা আমার প্রত্যাশার চাইতে বেশি। আমি শুধু আপনার কাছে এখন একটা জিনিস চাইবো, শুধু একটা জিনিস, আমার নয়, আপনার মঙ্গলের জন্য-

ক্রিওন :

কি সেই জিনিস যার জন্য আপনি এতো বিনীত মিনতি করছেন?

ইডিপাস :

আমাকে এই মুহূর্তে এই দেশ থেকে, মানুষের দৃষ্টির আড়ালে দূর করে দিন।

ক্রিওন :

এটা নিশ্চিতভাবে অবিলম্বে করা হতো, কিন্তু আমি দেবতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছি।

ইডিপাস :

তাঁর নির্দেশ কি ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি? পিতৃহন্তারককে, ক্লেদাক্ত জিনিসটাকে মরতে হবে, আর এখন সে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।

ক্রিওন :

তা ঠিক। তবু, ঘটনাবলি বর্তমানে যেভাবে মোড় নিয়েছে তাতে আমাদের আরো সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রয়োজন।

ইডিপাস :

আমার বিধ্বস্ত জীবনের জন্য? এই রকম একজন অভিশপ্ত মানুষের জন্য কি আপনি দেবতার নির্দেশনা চাইবেন?

ক্রিওন :

তাকে বিশ্বাস করবার মতো সুযুক্তি কি আপনি দেখতে পান নি?

ইডিপাস :

পেয়েছি। আর, তাই, আপনার মধ্যে যে শুভ আছে তার কাছে আমার শুধু একটা প্রার্থনা আছে। ওই যে নারী এখন ভেতরে পড়ে আছেন, তার জন্য আপনি যে রকম যোগ্য মনে করেন সেই রকম শেষকৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করুন। তিনি আপনার বোন, আপনি সঙ্গত ব্যবস্থাই করবেন। আর আমার ক্ষেত্রে, আমার জীবন্ত উপস্থিতি দ্বারা আমার পিতৃভূমিকে আর অভিশাপের বোঝা বহন করতে দেবেন না, বরং আমাকে এবার চলে যেতে দিন, আমি এখন থেকে বাস করবো পাহাড়ে, আর মরবো সেখানে। সিথেরন! আমার নামের সঙ্গে চিরদিনের জন্য যুক্ত ওই নাম, আমার জনক-জননী ওই জায়গাকেই আমার মৃত্যুশয্যার জন্য নির্বাচন করেছিলেন, তাঁদের ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে আমি ওখানেই যাবো, ওখানেই মৃত্যুবরণ করবো। কিন্তু আমি জানি, বার্ধক্য কিংবা কোনো ব্যাধি কিংবা সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা আমার মৃত্যু ঘটাবে না, আমাকে তখন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে যেন আরো ভয়ঙ্কর কোনো নিয়তির শিকার আমি হতে পারি। তবে তাই হোক। আর আমার সন্তানরা ছেলেদের নিয়ে আপনি ভাববেন না, ক্রিওন; ওরা যেখানেই যাক নিজেদের জন্য একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। কিন্তু আমার বেচারী মেয়েরা, বাবাকে ছাড়া ওরা এক বেলাও আহার করে নি। আমাদের সব কিছু আমরা একত্রে ভাগ করে নিতাম… ওদের যত্ন নেবেন, ক্রিওন … ক্রিওন … আমি যদি একবার ওদের স্পর্শ করতে পারতাম … কাঁদতে পারতাম… আরেকবার … আপনি তো মহানুভব এবং দয়ালু, আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি শুধু একবার স্পর্শ করবো, আমার তখন মনে হবে আমার যখন চোখ ছিল ওরা যেন সেই সময়ের মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে …

[ইতিমধ্যে দুটি সন্তানকে, ইসমেনি ও আন্তিগনি, মঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছে। তারা এখন ইডিপাসের সামনে দাঁড়ানো।]

একি? আমি কি আমার দুলালীদের কান্নার শব্দ শুনছি? ক্রিওন কি করুণার বশবর্তী হয়ে আমার কাছে ওদের পাঠিয়ে দিয়েছেন? আমার দুলালীরা, ওরা কি এখানে আছে?

ক্রিওন :

হ্যাঁ, ওরা এখন এখানে। আমি ওদের জানিয়েছি। ওদের আপনি যে কতো ভালোবাসতেন, এখনো বাসেন, তা আমি জানি।

ইডিপাস :

এজন্য, ক্রিওন, বিধাতার আশীর্বাদ যেন আপনি লাভ করেন, এবং আপনার পথ যেন আমার চাইতে সুগম হয়।

মেয়েরা, কোথায় তোমরা? এসো, তোমাদের ভাই-এর হাত স্পর্শ করো। এই হাত তার স্বচ্ছ দু’চোখকে অন্ধকার করে দিয়েছে, তোমাদের পিতার চোখকে, যে চোখ ছিল তোমাদের অতি চেনা, যদিও তিনি যখন তোমাদের পিতা হন তখন তিনি তার কিছুই দেখতে পান নি, কিছুই বুঝতে পারেন নি। এখন ওই চোখ তোমাদেরকে দেখতে পায় না, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে তারা অশ্রু বিসর্জন করছে। ভবিষ্যতে, তোমাদেরকে যখন দুনিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, তোমাদের সেই দুঃখভরা দিনগুলির কথা আমি ভাবি। পবিত্র দিবসগুলি, সুমহান দিনগুলি, রাষ্ট্রীয় দিবসগুলি, তোমাদের জন্য সব নিরানন্দ, অন্যরা যখন খেলাধুলা করবে তোমরা বাড়ি ফিরে যাবে বেদনার্ত চিত্তে। আর তোমরা যখন বিয়ের কথা ভাববে, তখন এমন একটি সাহসী পুরুষও কি পাওয়া যাবে যে আমার সন্তানদের গায়ে, সন্তানদের সন্তানের গায়ে জড়ানো কলঙ্কের কালিমা উপেক্ষা করে তাদের বিয়ে করতে রাজি হবে? এমন কোনো অশুভ কি আছে যা আমাদের কপালে জোটে নি? এক পিতা, যে তার পিতাকে হত্যা করেছে, যে তার জন্মশয্যাকে কলুষিত করেছে; উৎপাদন করেছে সেইখানে যেখানে সে নিজে উৎপাদিত হয়েছে। এসব কথাই তো সবাই বলবে তোমাদের সম্পর্কে। তাহলে কোথায় তোমরা খুঁজে পাবে তোমাদের স্বামী? কোথাও পাবে না, কন্যারা আমার। তোমাদের জীবন নিঃশেষিত হবে নিষ্ফলা কুমারীত্বের মধ্যে

মেনোইকিউসের পুত্র, আপনি এখনো রক্তের সম্পর্কে তাদের স্বজন। আপনিই এখন তাদের একমাত্র পিতা। আমরা, যারা তাদের জন্মদাতা, আমরা আর নেই। এই পরিত্যক্ত সন্তানরা যেন গৃহহীন ও স্বামীহীন অবস্থায় পথে পথে ঘুরতে কখনো বাধ্য না হয়। আমি যে রকম দিন দেখবো তাদের যেন তা কখনো দেখতে না হয়। ওদের উপর নজর রাখবেন আপনি। এতো অল্প বয়েসী, এতো নিঃস্ব, আপনি ছাড়া এখন ওদের আর কেউ নেই। আপনি কি আমার অনুরোধ রাখবেন? আপনার হাত দিন, কথা দিন আমাকে।

[ক্রিওন তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন]

বন্ধু আমার!

মেয়েরা, শোনো, অনেক কিছু আছে যা তোমরা বড়ো হবার পর বুঝবে। এখন তোমরা তা সহ্য করতে পারবে না। তবে প্রার্থনা করার সময় একটা জিনিসের জন্য প্রার্থনা করো, তোমরা যেন ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারো, তার চাইতে বেশিও নয়, তার চাইতে কম ও নয়। আর তাহলে তোমরা তোমাদের পিতার চাইতে ভালো জীবন অতিবাহিত করতে পারবে।

ক্রিওন :

অনেক হয়েছে। আপনি কি এখন ভেতরে যাবেন?

ইডিপাস :

আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও আমাকে যেতেই হবে।

ক্রিওন :

সব কিছুর ক্ষেত্রেই একটা মাত্রা আছে।

ইডিপাস :

তাহলে আপনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?

ক্রিওন :

কি প্ৰতিশ্ৰুতি?

ইডিপাস :

আমাকে এখান থেকে দূরে পাঠিয়ে দেবেন।

ক্রিওন :

সেটা ঠিক করবেন দেবতা, আমি না।

ইডিপাস :

আমার পক্ষে কোনো দেবতা কথা বলবেন না।

ক্রিওন :

সে ক্ষেত্রে আপনার ইচ্ছা পূরণ হবে।

ইডিপাস :

আর আপনার অনুমোদন?

ক্রিওন :

আমার যা অজানা সে সম্পর্কে আমি কোনো কথা বলি না।

ইডিপাস :

[সন্তুষ্ট হলেও অনিচ্ছাভরে বললেন] নিয়ে যান আমাকে।

ক্রিওন :

তাহলে যান। [ইডিপাস প্রাসাদ অভিমুখে অগ্রসর হন। তখনো তিনি দুহাতে জড়িয়ে রেখেছেন তাঁর মেয়েদের] তবে আপনার মেয়েদের রেখে যান এখানে।

ইডিপাস :

না! কখনো ওদেরকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না!

ক্রিওন :

আর আদেশ নয়, এখন থেকে শুধু আদেশ পালন করবেন। আপনার রাজত্বকাল শেষ হয়েছে।

[ইডিপাসকে নিয়ে যাওয়া হয়]

কোরাস :

থীবির পুত্রকন্যাগণ, দ্যাখো : ইনিই ছিলেন ইডিপাস, মানবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ; দুরূহতম রহস্যের চাবিকাঠি ছিলো তাঁর হাতে, তাঁর বিপুল সাচ্ছল্যের জন্য সবাই তাঁকে ঈর্ষা করতো। দ্যাখো, দুর্ভাগ্যের কী প্রবল বন্যা তাঁর মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অতএব মরণশীল মানুষকে একটা জিনিস উপলব্ধি করতে হবে : তাকে সব সময় তার শেষ মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে এবং যখন পর্যন্ত না একটি মানুষ শান্তিতে, তার সুখকে সঙ্গে নিয়ে, কবরে প্রবেশ করতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে সুখী বলা যাবে না।

[সবার প্রস্থান]

***

অধ্যায় ১ / ১

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন