রুদ্রনাথ পণ্ডিতের আবির্ভাব

শঙ্কর চ্যাটার্জী

চন্দন শ্রীরামপুরের জি.টি রোড ঘেঁষা বিরাট দোতলা বাড়িটা কিনলো। যে কোনো লোক’ই ওই বাগান ঘেরা বাড়িটাকে এক মুহূর্তে ভালোবেসে ফেলবে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা দুধ সাদা বাড়িটার সামনে বিরাট লন… সেখানে কী নেই! দোলনা, ফোয়ারা, লাল-নীল মাছের চৌবাচ্চা। দেখার মতো সব রকমারি ফুল-ফলের গাছ।

স্ত্রী গার্গী আর ছোট্ট মেয়ে সোমাকে নিয়ে বিরাট গেট দিয়ে চন্দন যখন ওর স্করপিওটা ঢোকালো, তখন বাড়িটা আর আশপাশের পরিবেশ দেখে গার্গীর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “ওয়াও, বিউটিফুল!” ওর চোখে- মুখে খুশি উপছে পড়ছে। সাত বছরের মেয়ে সোমা গাড়ি থেকে নেমে আগে দৌড়োলো দোলনায় দোল খেতে। গেটের সিকিউরিটি গার্ড সালেম ওদেরকে হাত তুলে সেলাম জানালো।

চন্দন ছোটোবেলা থেকে পছন্দ করতো নিরিবিলি পরিবেশে বাগান দেওয়া একটা বাড়ি। ফ্ল্যাট ওর মোটেই পছন্দ নয়, যত স্কোয়ার ফিট হোক না কেন… ওর প্রোমোটারির ব্যবসা এখন রমরমিয়ে চলছে। এ ছাড়া কলকাতা শহরে দুটো পেট্রল পাম্প… ও একমাত্র সন্তান, বাবা- মা আগেই গত হয়েছেন। গার্গীও তাই। ওদের নিজের বলতে একমাত্র মেয়ে সোমা। আজ চন্দনের স্বপ্ন সার্থক। অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিল, অবশ্য বাড়িটা দু’হাত ঘুরে ওর হাতে এলো, সত্তর লাখের বিনিময়ে পুরোনো কোনো কাজের লোককে ও বরখাস্ত করেনি।

প্রায় এক মাস হতে চললো ওরা এখানে রয়েছে। ভগবান দু’হাত ভরে ওদের সব কিছু দিয়েছে। মেয়ে সোমাকে শ্রীরামপুরের একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। এত ঐশ্বর্য, কিন্তু মনে কোনো অহংকার নেই। বরং নতুন প্রতিবেশিদের নিয়ে আনন্দেই দিন কাটাচ্ছে… আশপাশের বাড়ির ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েরা ওদের বাড়ির বড়ো বাগানটায় বিকেলে খেলতে আসে। তাদের মায়েরাও এসে গার্গীর সঙ্গে আড্ডা জমায়। চন্দন সকালে বেরিয়ে সেই রাত্রে ফেরে গাড়ি নিয়ে। গার্গীর বিকেলটা বেশ কেটে যায়, বোর লাগে না।

সেদিন সকালে জল খাবার খেতে খেতে চন্দন কথাটা প্রথম বললো, “দেখো, গৃহ প্রবেশে এখানকার কাউকে বলা হয়নি… না চেনার সুবাদে। তাই ভাবছি, বড়দিন আসছে… এই উপলক্ষ্যে একটা পার্টি দিলে কেমন হয়? ব্যাপারটাতে একটা নতুনত্ব রাখবো। এখানকার সবাইকার কাছে একেবারে আনকোরা বিষয় হবে; যেমন বাইরের দেশে নানা রকম মুখোশ পরে মজা করে… ইউরোপীয় দেশে এর বিরাট চল। বাচ্চা- বড়ো সবাই বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ পরে ভয় দেখানো, নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোড় করে। সন্ধে থেকে রাত ভোর এই পার্টি চলে, হ্যালোইন পার্টি। মানে আমাদের দেশে যাকে বলে ভূত চতুর্দশী, সেই রকম আর কী…”

“এখানকার লোকেরা বুঝবে?” প্রশ্ন করলো গার্গী।

“আরে, ঐসব বলবো নাকি আমরা? বাচ্চাদের সাথে মা-বাবাদেরও ডেকে নেবো আমরা। জাস্ট বলবো, একটু একসঙ্গে সন্ধেটা আনন্দ করবো…” ওর গলায় উৎসাহ।

“আমি রকমারি মুখোশ-চকলেট-রঙিন টুপি-নিউ মার্কেট থেকে কিনে আনবো। বাগানটা বাহারি আলো দিয়ে সাজাবো, মিউজিক বক্স বাজবে। এ ছাড়া রাত্রে জম্পেশ ডিনার। দারুণ জমে যাবে।”

হাততালি দিয়ে ওঠে সোমা, “কী মজা… সত্যি বাপি খুব মজা হবে। তবে আমার জন্যে স্পেশাল ভ্যাম্পায়ারের মুখোশ আনতে হবে।”

“ইয়েস ডার্লিং, তাই হবে…” মেয়ের মাথাটা একটু নাড়িয়ে দেয়। সোমার আনন্দ দেখে গার্গীও নেচে উঠলো। শুরু হয়ে গেলো ফর্দ তৈরি অর্থের সঙ্গে মন যুক্ত হলে কোনো কিছুই আটকায় না।

সোমার বন্ধুদের সঙ্গে গার্জেনরা ব্যাপারটা শুনে খুব আনন্দ পেলো, তার সাথে ঐসব মুখোশ-টুখোশের বিষয়টায়… রোমাঞ্চ বোধ করলো। দিন ঠিক হলো ২৩ সে ডিসেম্বর। প্রায় জনা পঞ্চাশেক অতিথি সমাগম হবে।

ওই বিশেষ দিনটাতে পুরো বাড়ির সাথে বাগানটাও নতুন সাজে সেজে উঠলো। আয়োজন সম্পূর্ণ। সন্ধে থেকে শুরু হলো অতিথি সমাগম। গার্গীর পরনে রংচঙে সালোয়ার আর সোয়েটার। চন্দন কোর্ট- প্যান্ট পরা, পুরোপুরি সাহেব। আর সোমাকে লাগছে একটা ছোট্ট পরী।

হ্যালোইন পার্টি রীতিমতো জমে উঠলো। বাগানের ছোটো ছোটো বাহারি গাছগুলোতে লাল-নীল আলোর মেলা। বড়ো বড়ো রঙিন ছাতার নিচে টেবিল চেয়ার। জলের ফোয়ারাতে আলোর কারসাজি নিমন্ত্রিত সবাইয়ের চোখে তারিফের চিহ্ন। চন্দন আর গার্গীকে নিয়ে ছোটোখাটো ভিড়, কেন না তারাই মধ্যমণি। এবারে এখনো তেমন ঠান্ডা পড়েনি।

বাচ্চাদের মধ্যে চলছিল লুকোচুরি খেলা। সোমা ভ্যাম্পায়ারের মুখোশ পরে একটা পাতা বাহারের গাছের পাশে লুকিয়ে, বন্ধুরা বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ পরে ওকে খুঁজতে ব্যস্ত। সোমা উবু হয়ে বসে ভাবছে, কী বুদ্ধু রে সব… ওর সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে তবু ওকে দেখতে পাচ্ছে না? খানিকটা বসার পর ও ধৈর্য হারালো। দেখলো, বন্ধুরা সব মায়েদের কাছে চলে গেছে। ধুর, ওদের সঙ্গে খেলবে না, অভিমানে সেও ফিরে এলো।

ওদের খেলা বন্ধ দেখে গার্গী হেসে বললো, “ও মা এর মধ্যেই খেলা বন্ধ হয়ে গেলো?” সব বাচ্চারা একসাথে বলে উঠলো, “আন্টি, আমরা সোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথায় যে লুকিয়েছে, কে জানে?”

“আমি সামনেই দাঁড়িয়ে আছি… আর আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না!” পিছনে সোমার অভিমানী গলা।

ওই তো পাতা গাছটার পিছনেই দাঁড়িয়েছিলাম।

ছোটো বন্ধুরা অবাক, ওরা সবাই ওখানেও খুঁজেছে…

এই ছোট্ট ঘটনাটাই আগামী দিনের এক বিপদের আগমন বার্তার ইঙ্গিত ওদের দিয়ে গেলো।

রাত্রে পার্টি থাকার জন্যে উঠতে সকালে দেরি হয়ে গেলো গার্গীর। চন্দন তখনও ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ ঘরের কোণে ছোটো সোমার ছোটো খাটটার দিকে নজর পড়তেই দেখে বিছানাটা খালি। সে কী? মেয়ে গেলো কোথায়? ও তো মা ছাড়া এক পা’ও চলে না! এমন কি বাথরুমে যেতে গেলেও মা কে ডাকে! ঘরের ভেতর বাথরুম তো খালি পড়ে আছে! ধড়ফড়িয়ে উঠে দেখে দরজা ভেজানো। তার মানে এই ঠান্ডায় গরম জামা ছাড়া বাইরে গেছে!

ও লবিতে বেরিয়ে এসে দেখতে পেলো, সোফায় বসে মেয়ে, কালকের সেই ভ্যাম্পায়ার মুখোশটা একমনে দেখছে। এত নিবিষ্ট মনে দেখছে যে, গার্গীর গলা শুনতে পেলো না… এগিয়ে এসে বললো–এই ঠান্ডায় খালি গায়ে বসে কী দেখছিস!

সোমা মুখ না তুলেই বললো―এটা দেখছি…

মুখোশটা তুলে দেখালো। গার্গীর এমনিতেই ঐসব বিদকুটে মুখোশ কোনোদিন ভালো লাগে না।

“ঘরে চল, আগে গরম জামা গায়ে দে!” ওর হাত ধরে ঘরে ঢুকতেই চন্দনের ঘুম জড়ানো গলা শুনতে পেলো।

“কী ব্যাপার! মা মেয়েতে মর্নিং ওয়াক করে এলে? আমাকেও ডাকতে পারতে…” সোমা আদূরে গলায় বললো, “বাপি, কাল পার্টিতে টুম্পাদির সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে। তোমরা ওকে নেমন্তন্ন করোনি বলে খুব কষ্ট পেয়েছে… তবুও এসেছিল।”

ওরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কার কথা বলছে ও! দিদি বলছে! এরকম কোনো বড়ো মেয়েকে ওরা দেখেনি তো!

গার্গী বলে, “কে টুম্পা? কোথায় থাকে? কই আমরা তো দেখিনি!”

সোমা গাল ফুলিয়ে বলে কী করে দেখবে? খেতেই এলো না। কতবার করে বললাম।

চন্দন ভ্রু কুঁচকায়।

—কোথায় গেলো তোর টুম্পাদি?

পাকা গিন্নির মতো মাথা নাড়িয়ে বলে –লাল-নীল মাছের চৌবাচ্চাটার দিকে চলে গেলো… তারপর আর দেখতে পেলাম না।

ওর মুখে দুঃখ। গার্গী অদ্ভুত চোখে বরের দিকে চাইলো। মনে হলো, চন্দন কথাটা আর টানতে চাইলো না।

–মামণি আগে ব্রাশ করে নে… পরে শুনবো।

খ্রিস্ট মাসের জন্যে এখন পুরো সপ্তাহ স্কুল বন্ধ। চন্দন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লো। আটটা বাজতে চললো, বেরোতে হবে। বেরোবার আগে ও বললো, “মামণি, হঠাৎ এইরকম এলোমেলো কথা বলছে কেন, বুঝতে পারছি না। অবশ্য বাচ্চাদের নানা রকম মাথায় খেয়াল চাপে। যাই হোক, এ ব্যাপার নিয়ে তুমি নতুন করে কিছু খোঁচাতে যেও না…”

গার্গী টা টা করে ভেতরে এলো। রান্নার মাসিকে একটু হেল্প করে দিয়ে ওপরে মেয়ের কাছে এলো। সামনের কল্কে ফুলের গাছে বসে একটা কাক, তখন থেকে কা কা করে ডেকেই চলেছে। মেয়েকে পড়তে বসিয়ে গেছিলো। পড়ার ঘরে ঢুকে থমকালো। সোমা একটা সাদা খাতায় একমনে ছবি এঁকে চলেছে… এক কিশোরী মেয়ের ছবি–ফোলা-ফোলা গাল, ছোট্ট কপাল, বড়ো-বড়ো চোখ, মাঝখানে সিঁথি, দু’দিকে বিনুনি করা।

ওর সাত বছরের মেয়ে; যে কোনোদিন গোল্লা’ই ঠিক মতো আঁকতে পারে না, আর সে কিনা আঁকছে এই নিখুঁত সুন্দর ছবি? যা কিনা বড়ো শিল্পীকে হার মানিয়ে দেয়!

অবাস্তব, অসম্ভব, অকল্পনীয়….

বিস্ময়টা এখন ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যেটা হওয়ার বা করার কথা নয়, সেটা যদি আপনার চোখের সামনে ঘটে, স্বাভাবিকভাবে অন্যরকম অনুভূতি মনে দানা বাঁধবে।

গার্গীর মুখ দিয়ে কথা সরছে না। “তুই কী আঁকছিস?” ও মায়ের মুখের দিকে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্যে গার্গীর মনে হলো, ও সোমা নয়, খাতার আঁকা মেয়েটা জ্যান্ত হয়ে বসে আছে… ওই রকম ফোলা- ফোলা গাল, বড়ো-বড়ো চোখ, ছোট্ট কপাল! ভয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিলো। সেই সময় মেয়ের গলা কানে এলো। “মা, আমি টুম্পাদি’কে এঁকেছি।”

রান্নার মাসি সোমার জন্যে গরম দুধ নিয়ে এসে ঢুকলো।

“তাড়াতাড়ি দুধ খেয়ে নিয়ে, পড়ার বই খোলো। আমি ও’ঘর থেকে আসছি।” ওর আঁকা ছবিটা নিয়ে শোবার ঘরে এলো। মোবাইলে ছবিটা তুলে চন্দনকে পাঠিয়ে দিলো। মিনিটের মধ্যে ফোন এলো।

কী ব্যাপার! সকালেই তুমি আঁকতে বসলে নাকি!

রসিকতার সুর, “তোমার ছবি আঁকার হাত এত সুন্দর, জানতাম না!”

—ওটা তোমার মেয়ে এঁকেছে, এইমাত্র…

ও প্রান্ত চুপ। গার্গী জানে, চন্দনও চিন্তা করছে।

–কী হলো চুপ করে গেলে কেন? খাটে বসে পড়ে গার্গী।

–কাকে দেখে আঁকলো? বিস্ময়ের গলা।

–ও বললো, টুম্পার ছবি। আমার কীরকম মনটা ভয় ভয় লাগছে…

–দাঁড়াও বাড়ি যাই। খোঁজ নিচ্ছি, ওই নামে ওখানে কেউ থাকে কি না!

–সে তো হলো… কিন্তু সোমা! যে কিনা একটা সোজা লাইন ও কাটতে পারে না, সে রাতারাতি ওই ছবি এঁকে ফেললো! আশংকার গলা।

–প্লিজ, নার্ভাস হবে না। উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও…

চন্দনের মনের মধ্যেও এক অজানা আশংকার ঢেউ উঠতে চলেছে। বুদ্ধি দিয়ে কিছু ব্যাখ্যা মিলছে না।

ওদের স্নায়ুগুলোর জোর আর একদিনের মধ্যে যে ভাঙতে চলেছে, তখনও বুঝতে পারেনি।

***

বিকেল বেলায় তখন সোমা বন্ধুদের সঙ্গে বাগানে খেলছে, সেইসময় চন্দন কাজ থেকে ফিরলো। এই কয়েক ঘণ্টায় গার্গী ভাবনার সাগরে শুধু সাঁতার কেটেছে। চন্দন ফ্রেশ হয়ে চায়ের টেবিলে বসে বললো, এর মধ্যে আর কিছু ঘটেছে নাকি?

ও ঘাড় নাড়লো।

—মাথায় কিছু আসছে না, আর এসব ব্যাপারে কারো সঙ্গে কথা বলা মানে…

চায়ের কাপে চুমুক দিলো। গার্গী শুকনো মুখে বললো–ওর বন্ধুদের টুম্পার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ কিছু বলতে পারলো না… আচ্ছা এ’বাড়িতে আগে এই নামে কেউ থাকতো না তো?

চন্দন কাপটা টেবিলে রাখলো।

–হঠাৎ এ কথা বলছো কেন? তুমি কি ভূত-প্রেত নিয়ে কিছু ভাবছো নাকি!

গার্গী এই কথাটাই সকাল থেকে ভাবছে।

—এইরকম অনেক ঘটনা কিছু কিছু শুনেছি। আত্মা ভর করা…

–ওহ মাই গড! তুমি তিলকে তাল করছো…

কালকের পার্টির কথা ভুলে গেলে! ওর বন্ধুরা ওকে খুঁজেই পায়নি; এদিকে সোমা বলছিলো, ও পাতাবাহার গাছটার কাছেই ছিল। তাছাড়া ওই যে টুম্পা… সেও নাকি চৌবাচ্চার কাছে গিয়ে মিলিয়ে গেলো!

ভয় মুখের ভাঁজে ভাঁজে জমছে। খালি কাপটা রেখে বললো–বাচ্চাদের গল্প গুলো যদি তুমি সত্যি ভেবে নাও, তাহলে বলার কিছু নেই। চন্দন দাঁড়িয়ে উঠলো। শেষ কথাটা গার্গী ছুঁড়ে দিলো, আর ওইটুকু মেয়েটার আঁকা ছবিটা!

চন্দন কোনো জবাব দিতে পারলো না। কথা পাল্টানোর জন্যে বললো, চলো বাগানে গিয়ে বসি।

ওরা বাগানে আসতেই চোখে পড়লো, বন্ধুরা সোমাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

গার্গী বললো, কী ব্যাপার তোমরা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে কেন?

একটা বন্ধু বললো, আন্টি, সোমা আমাদের একটা কী ভীষণ ভয়ের ম্যাজিক দেখালো…

“ম্যাজিক!” দুজনেই বলে উঠলো। বন্ধুরা বলে উঠলো–এই সোমা আঙ্কেলকে জাদুটা দেখা! ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। গার্গী কৌতূহলবশত ওদেরই প্রশ্ন করলো, “কী ম্যাজিক দেখিয়েছে তোমাদের?”

“ও উল্টোদিকে পা ফেলে ফেলে কেমন হেঁটে দেখালো… আমার ঠাম্মি বলেছিলো, ভূতেরা অমন ভাবে নাকি হাঁটে…

গার্গীর শরীরটা কীরকম শিরশির করে উঠলো। শীতের সন্ধে তাড়াতাড়ি নামছে। বাচ্চাগুলো কেমন যেন ভয় পেয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চলে গেলো। ওরাও ভেতরে চলে এলো। বাড়ি গিয়ে নিশ্চয়ই বন্ধুরা ঘটনাটা বলবে! তারপর? রটতে টাইম লাগবে?

সন্ধের অন্ধকারের সাথে সাথে ওদের এই ছোট্ট সুখী সংসারেও অন্ধকার নেমে আসছে। সকাল থেকে হাসি-খুশি মেয়েটাও কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে।

রাত্রে মেয়ে ঘুমোবার পর গার্গী ফিসফিস করে বললো, কী হবে গো! সারা পাড়া ঢি ঢি পড়ে যাবে… ভূতে ধরা মেয়ে বলে… ওর চোখে জল। চন্দন পারলো না ওর কথার প্রতিবাদ করতে। বিষয়টা গোলমেলে লাগছে। ওর মাথায় এখন ডাক্তার বিজিতা চৌধুরীর নামটা ঘোরাফেরা করতে শুরু করলো। নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞা। কালকেই যোগাযোগ করতে হবে। দরকার হলে কয়েকদিন টালিগঞ্জের পুরোনো ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে হবে। ওখানে কয়েকদিন থাকলে যদি মনের কোনো পরিবর্তন ঘটে!

সকালে চন্দন বেরিয়ে যাবার পর গার্গীর মনে আবার ভয়টা জেগে উঠলো। ব্রেকফাস্টে মেয়েটা প্রায় কিছুই মুখে তুললো না। কার যে অশুভ দৃষ্টি ওর সোনার সংসারে পড়লো? এইসময় পাশের বাড়ি অনিন্দিতা এলো… গার্গীর মুখ ফ্যাকাশে মারলো। যা ভেবেছে তাই… এর মধ্যে তার মানে জানাজানি হতে শুরু করেছে! অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসতে বললো। কিছু এলোমেলো কথার পরই আসল কথাটা পাড়লো, “হ্যাঁ ভাই তোমার মেয়ে নাকি কীসব ভূতের ম্যাজিক শিখেছে! তাতাই গিয়ে বললো।”

গার্গী উত্তর দেবার আগে সোমা বললো, “টুম্পাদি ম্যাজিক জানে…”

অনিন্দিতার অবাক কণ্ঠ কে টুম্পা? দীপাদির মেয়ে? তোমরা ওদের চেনো নাকি!

কী উত্তর দেবে গার্গী ভেবে পাচ্ছে না, আবার মেয়ে না নতুন কিছু বলে বসে! দায়সারা গোছের একটা জবাব দিলো।

“কারো মুখ থেকে শুনেছে বোধহয়!” এর সঙ্গে একটা আশার আলো দেখতে পেলো সে। অনিন্দিতা তার মানে টুম্পা নামক মেয়েটাকে চেনে! জানতে হবে মেয়েটা জীবিত কি না? সোমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “তুই চল, টি ভি চালিয়ে দিচ্ছি, ছোটা ভীম দেখবি। অনিন্দিতা তুমি বসো, কফি আনছি…”

যেভাবেই হোক টুম্পাদের বিষয়ে সব কথা জানতে হবে। ওর মন বলছে, এ থেকেই জানা যাবে পরবর্তী কর্তব্য কী হবে…

কফি খেতে খেতে অনিন্দিতা শুরু করলো টুম্পাদের কথা…

কফিতে চুমুক দিয়ে অনিন্দিতা বললো, “তোমাদের এই বাড়িটাই টুম্পাদের ছিল। টুম্পার সত্মা দীপা, সেই জন্যে স্বামীর সঙ্গে বয়সের অনেক পার্থক্য ছিল। দীপার ছেলের বয়স বড়জোর চার। সেদিক থেকে টুম্পা অনেক বড়ো। প্রায় পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে। দীপার সঙ্গে মেয়ের একদম বনিবনা হতো না। দুজনে’ই বাবাকে নালিশ করতো। বিজনবাবু একদিন আমার স্বামীকে বলেছিল, দ্বিতীয় বিয়ে করাটাই তার জীবনের বিরাট ভুল…” ও কফিতে চুমুক দিলো। গার্গী একমনে শুনছে।

“টুম্পা একা একাই সারাক্ষণ থাকতো, তারপর বাইরে বেরোনো ধরলো। বেপাড়ার সব ছেলে বন্ধু হলো। শুনেছিলাম, নানারকম বাজে নেশা-টেসা করে। কিছুদিনের মধ্যেই পাকা নেশার শিকার হয়ে পড়লো। বিজনবাবুর কথা আর কানে নিতো না। আমাদের এখানকার কাউন্সিলার একদিন ওর বাবাকে ডেকে বললো। সেইদিন বিজনবাবুর রাগ দেখেছিলাম… পাড়ার লোকেরা না ধরলে মেরেই ফেলতো মেয়েকে। বললে বিশ্বাস করবে না, মেয়েকেই সব থেকে ভালোবাসতো ভদ্রলোক।” ও অল্প থামলো।

—তারপর! গার্গী আসল কথাটা শুনতে চাইছে, যার জন্যে তাদের জীবনে এই অশুভ প্রভাব।

—কয়েকদিন সব নীরব, তারপর একদিন রাত্রে একগাদা ঘুমের বড়ি খেয়ে নিলো টুম্পা… আলাদা ঘরে ও থাকতো, কেউ জানতেও পারলো না। সকালে যখন পাড়ার লোক, পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকলো, তখন মরে কাঠ হয়ে গেছে মেয়েটা।

গার্গীর ভয় তিনগুণ বেড়ে গেলো।

“পুলিশি ঝামেলা মিটতেই ওরা ওই আগরওয়ালকে বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গেলো। যাবার সময় কারো সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেনি।” ও উঠে দাঁড়ালো, চলি ভাই, দেরি হয়ে গেলো…

অনিন্দিতা চলে যেতে গার্গীর মনের সন্দেহ এবার ডাল-পালা মেলতে আরম্ভ করলো।

চন্দনের ফোন এলো, শোনো, ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট কাল সন্ধেবেলা পেয়েছি। কিছু গোছগাছ করে রেখো, সকালেই টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে চলে আসবো।

স্বামীর কথায় ও খুব একটা স্বস্তি পেলো না। ওর মন বলছে, এর বিহিত ডাক্তারের দ্বারা হবে না। কিন্তু বললেই মুশকিল।

ওরা সকালে বেরোবার সময় সোমা বললো, “মা আমার মুখোশটা নিলে না?”

“মু-খো-শ! এখন আবার মুখোশ দিয়ে কী হবে!”

মেয়ে বায়না ধরলো।

চন্দন বললো, কোথায় রেখেছো দিয়ে দাও না!

গার্গী খুঁজে ভ্যাম্পায়ারের মুখোশটা আনতে মেয়ের মুখে হাসি ফুটলো। কয়েকদিন পর ওই হাসিটুকু দেখে ওরা তৃপ্তি পেলো। চন্দন এই মুখোশটা আলাদাভাবে ধর্মতলার এক দোকান থেকে এনেছে। গাড়িতে বসেই মুখোশটা পরলো। গার্গী বারণ করতে গিয়েও করলো না, যদি আবার মনমরা হয়ে পড়ে!

গাড়ি ড্রাইভ করছে চন্দন, ওরা পিছন সিটে। দিল্লী রোড ধরলো। হঠাৎ সোমার মিষ্টি গলার স্বরটা অন্য রকম শোনালো, “আমাকে খুব কষ্ট দিতো আমার সৎমা’টা…” ওরা চমকে উঠলো। মুখোশ পরে ও বলে চলেছে খ্যাশখেশে গলায়, “বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে বলতাম, কথা কানেই নিতো না…” চন্দন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। গার্গী সম্মোহিতের মতো বসে।

“কী আবোল-তাবোল বকছিস!” চন্দনের চিন্তিত গলা। সোমার মুখটা মুখোশে ঢাকা, এক নাগাড়ে বলে চলেছে, “একা… আমি একা। আমার পাশে কেউ নেই। খারাপ সঙ্গে পড়ে নেশা ধরলাম, সেখানেও শান্তি নেই… শুধু দুর্ব্যবহার। ভালোবাসা কোথাও নেই… তাই শেষ করে দিলাম নিজেকে।” গার্গীর কানে কথাগুলো লিকলিকে সাপের মতো ঢুকছে। নিজেকে সামলে উত্তেজিত গলায় বললো–এই কী যা-তা বকছিস তুই!

সোমা যেন দম দেওয়া পুতুলের মতো বলে চলেছে।

“একা থাকার কী ভয়ানক যন্ত্রণা, মরে গিয়ে আরও একা… চারিদিকে শুধু কালো তাল তাল অন্ধকার… আমাকে এখান থেকে দয়া করে উদ্ধার করো!” চন্দনের অস্বাভাবিক গলা গার্গীর কানে আছড়ে পড়লো।

“ওকে থামাও!” গার্গী ভাবছে, তার ঐটুকু মেয়ে এইসব কথা কীভাবে বলছে! যার অর্ধেক মানেই ও জানে না। ও সজোরে সোমাকে ঝাঁকিয়ে দিলো

“এই সোমা একদম চুপ কর…” এক ঝটকায় মুখোশটা খুলে দিয়ে ওকে বুকে চেপে ধরলো। ও ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফর্সা মুখটা বুকে গুঁজে দিলো। গার্গী বুঝলো, মেয়ে থরথর করে কাঁপছে। দু’হাত দিয়ে মেয়েকে জাপটে ধরে রইলো। ও ধীরে ধীরে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লো।

দু’জনের মাথায় চিন্তার ভূত ভর করলো। এর থেকে রেহাইয়ের পথ এখনো ওরা খুঁজে পাচ্ছে না। বিজ্ঞান, সভ্যতা, ডাক্তারী সবই কেমন জোলো জোলো লাগছে। গার্গী ভাঙা কণ্ঠে বললো, “তোমার কি মনে হয় ডাক্তার দেখিয়ে মেয়েকে সুস্থ করে তোলা যাবে!” চন্দনের মুখে কোনো ভাষা নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওর চিন্তাধারা সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। ও নিশ্চিত, এতক্ষণ যে কথা বললো, সে সোমা হতে পারে না।

পুরোনো ফ্ল্যাটে বেলার দিকে এসে পৌঁছলো। এখানে দেখা-শোনার জন্যে একটা লোক রেখে গেছিলো। সে রান্না-বান্না করে রেখেছে। পুরোনো জায়গায় এসে সোমাও একটু খুশি।

আজ সন্ধের সময় ডাক্তারের কাছে যাবে। চন্দন ফোন করে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কাজ সারলো। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে শুতে যাবার সময় মেয়ে ফের বায়না ধরলো সেই মুখোশটার জন্যে। কোনো বারণ শুনলো না। মাথার পাশে রেখে তারপর ঘুমোলো।

গার্গী মেয়ের পাশে শুয়ে বললো–আচ্ছা এই মুখোশটার প্রতি ওর এত টান কেন বলো তো!

চন্দন এবার রেগে গেলো, জানি না… আমি তো জ্যোতিষী নই!

জ্যোতিষীর কথায় ওর মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো, রুদ্র মামার নামটা ভেসে উঠলো। দূর সম্পর্কের মামা। বিয়ে-থা করেনি। ঠাকুর-দেবতা- সাধু-সন্ন্যাসী এইসব নিয়ে থাকতো। একদিন বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো। বছর তিনেক পরে খবর পেয়েছিলো, কামরূপের কাছে থাকে। তন্ত্র সাধনার মধ্যে ডুবে গেছে। দাদুর এক বন্ধু খবর এনেছিল। বাড়ির লোকরা গিয়েছিলো ফিরিয়ে আনার জন্যে, আসেনি। তারপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কয়েক বছর আগে চন্দন ব্যবসার কাজে গৌহাটি গেছিলো। রাস্তায় আচমকা দেখা হয়েছিল। চট করে চেনাই যায় না। রুদ্র মামাও চিনতে পারেনি… ও নিজেই পরিচয় দিয়েছিলো। মামা জোর করে ওর আখড়ায় নিয়ে গিয়েছিলো। ফোন নম্বর পর্যন্ত দিয়েছিলো, বলেছিলো, “ভাগ্নে যদি কোনোদিন দরকার পড়ে, এই মামাকে বোলো। যা শুনলাম তাতে দেখছি, তোমার আর আমার নিজের আত্মীয় বলে কেউ নেই।” সেদিন মনে মনে সব বুজরুকি বলে পালিয়ে এসেছিলো। আজ এই বিপদে মনে হচ্ছে, রুদ্র মামা যদি কিছু উপকার করতে পারে! কলকাতায় ফিরে গার্গীকেও মামার কথা বলেছিলো। তারপর চার বছর কেটে গেছে। কোনো যোগাযোগ নেই। জানে না উনি বেঁচে আছে কি না…

কিন্তু দুপুরের ঘটনাটা ওকে বাধ্য করলো, রুদ্র মামার সঙ্গে এখনই যোগাযোগ করতে…

দুপুরে ভাত খেয়ে-দেয়ে ওরা সোমাকে নিয়ে শুলো। কেন না বিকেলের পর ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। শোবার আগে যথারীতি বায়না ধরলো, তার প্রিয় মুখোশটার জন্যে… বাধ্য হয়ে দিতে হলো। মাথার কাছে রেখে তবে ঘুমোলো।

কী ভাবছো! চন্দন নিচু স্বরে প্রশ্ন করে। গার্গীর কপালে চিন্তার বলি রেখা, অনেক কিছু… প্রথম, ও টুম্পা নামটা জানলো কী করে? ওর ছবিটা আঁকলো কীভাবে? বানিয়ে বানিয়ে অত শক্ত কথা কোনোদিন বলেছে!

চন্দন নিজেও এই কথাগুলো ভাবছিলো। এইসময় ওদের কান সজাগ হলো, ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে সোমা কথা বলছে…

“আমি খুব বাজে সঙ্গে পড়েছি। ওরা আমাকে নেশার জিনিস দেয়…. ক্রমশ নেশায় ডুবে যাচ্ছি। বাঁচতে চাই। যদি এই অন্ধকার থেকে উদ্ধার না পাই, এই মেয়েটাকেও আমার কাছে টেনে নোব…” দুজনের মুখ আতঙ্কে নীল হয়ে গেলো। কী শুনছে ওরা? একমাত্র মেয়েকে হারাতে হবে! গার্গীর শরীরটা ভয়ে কাঁপছে। চন্দনও আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। তবে কি বউয়ের কথা ঠিক! ওকে ভূতে ধরেছে?

সোমার সুন্দর মুখে কুটিল হাসি দেখা দিলো। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, চোখের মণি দুটোর জায়গা সাদা ফ্যাট ফ্যাট করছে। গার্গী ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। চন্দন যন্ত্র চালিতের মতো মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে জাগালো। সোমা উঠে বিহ্বল দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুই বুঝতেও পারছে না। গার্গী অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে কোলের কাছে এনে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলো।

ওরা দুজনে’ই বাক রহিত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে গার্গী কথা বললো, “এই মেয়েকে নিয়ে একা একা আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়….” কতখানি অসহায় হলে একজন মায়ের মুখ থেকে এই কথা বেরোয়!

চন্দন মনে মনে কথাটা স্বীকার করে নিলো। বুঝতে পারছে, এখানে কোনো অতীন্দ্রিয় ব্যাপার কাজ করছে। রুদ্র মামার মুখটা আবার মনের মণি কোঠায় ভেসে উঠলো। এইসময় গার্গী বলে উঠলো, তুমি একবার রুদ্র মামার কথা বলেছিলে না!

চন্দন অবাক হয়ে গেলো। এটাকেই তবে টেলিপ্যাথি বলে নাকি!

—আশ্চর্য! আমিও ওঁর কথা ভাবছি…

–তোমার কাছে তো ওনার নম্বর আছে… গার্গীর দেরি সইছে না। চন্দনের চোখ মেয়ের দিকে, ও চোখ পিট্ পিট্ করছে। কিন্তু গভীর শ্বাস পড়ছে। তার মানে ওর শরীরে যে’ই বাসা বেঁধে থাকুক, সে সজাগ, সতর্ক। ও বউয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলো। ও চায় না ওদের কথাবার্তা টুম্পা নামধারী আত্মাটা শুনুক। একটু বাদেই চোখ নড়া বন্ধ হয়ে গেলো। ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে তিনটে বাজছে।

ওরা ডাইনিং রুমে এসে মামার নম্বর মেলালো। গার্গী মনে মনে ঠাকুরকে ডাকছে। ও প্রান্ত থেকে রুদ্র মামার গলার স্বর ভেসে এলো..

“কী ব্যাপার ভাগ্নে, এত বছর পর মামাকে তলব!” চন্দন ফোনটা স্পিকারে ফেললো, যাতে গার্গীও শুনতে পায়

“ভীষণ বিপদে পড়ে ফোন করছি”… চন্দন এখন ভালোমতো বুঝতে পারছে ডাক্তার দিয়ে কিছু হবে না।

এবার পুরো ঘটনাটা ও বলে গেলো। কোনো কথা বাদ গেলে গার্গী পূরণ করে দিচ্ছিলো। ও’প্রান্ত নীরব। কথা শেষ হবার পর গম্ভীর গলা ভেসে এলো, “ভেঙে পড়বি না। তোদের ভাগ্য ভালো, এই মুহূর্তে আমি কাছাকাছি আছি। উত্তরপাড়াতে এক ভক্তের বাড়ি, আছি। কাল সকালেই আমাকে নিয়ে তোর শ্রীরামপুরের বাড়ি চল…” মনে হলো, বুক থেকে একটা ভারী পাথরের বোঝা নেমে গেলো। ওরা যেন ধরেই নিয়েছে, রাহু কাটলো… পাশ থেকে কান্না ভেজা গলায় গার্গী বলে উঠলো–মামাবাবু, আমাদের বাঁচান…

বোধহয় কানে গেলো কথাটা।

“চাঁদু, বউমাকে কাঁদতে বারণ কর…” চন্দনকে ছোটোবেলায় সবাই চাঁদু বলে ডাকতো। “সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা কথা মন দিয়ে শোন, মুখোশটা মেয়ের থেকে দূরে রাখ। কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওটাকেই ওই বিদেহী আত্মা আধার করেছে। আসার সময় মনে করে মুখোশটা নিয়ে আসবি। ওটা দরকার পড়বে। শেষ কথা বলি, আজকের রাতটা সাবধানে থাকবি। কেন না আমাদের থেকে ওদের শক্তি অনেক বেশি। ওরা সব জানতে ও বুঝতে পারে। এমনকি তোর আমার কথাও শুনতে পাচ্ছে… মামা লাইন ছেড়ে দিলো।

এবার চন্দনেরও কীরকম আতঙ্ক হতে লাগলো। হে ঈশ্বর আজকের রাতটা কোনো রকমে পার করে দাও। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আর প্রয়োজন বোধ করলো না। গার্গী ভীত কণ্ঠে বললো– আজকের রাতটা জেগে কাটাবো আমরা। চন্দনও সহমত হলো।

রাতটা কিন্তু ভালোয় ভালোয় কেটে গেলো। ওরা বুঝতে পারলো না, রুদ্র মামার গুণে কি না? বেরোবার আগে মামাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো। মুখোশটা বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। সোমার বায়না ভোলানো হলো ক্যাডবেরি দিয়ে। ওদের বুক দুর দুর করছে… এরপর কী হবে কে জানে? সোমা কিন্তু আজ বেশ চুপচাপ। ঠিকানা অনুযায়ী রুদ্র মামাকে গাড়িতে তুললো। ছ’ফুট লম্বা, সৌম্য, ফর্সা দোহারা চেহারা। কাঁধ পর্যন্ত কাঁচা-পাকা চুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল তিলক।

সোমা একটু উসখুস করে উঠলো। মামাকে গাড়ির সামনের সিটে বসালো চন্দন। একটা কথাও সারা পথে বললেন—না।

বাড়ি ঢুকে শান্তভাবে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ভরাট গলায় বললেন–চলো, ওপরের বাঁ দিকে ছোটো ঘরটাতে। ওটাই ছিল টুম্পার ঘর… ওরা হতবাক হয়ে গেলো। তার মানে সোমার পড়ার ঘরটাকে বলছেন! কিন্তু উনি জানলেন কীভাবে! কোনোদিন তো আসেননি! ওদের অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, অবাক হবার কিছু নেই… এত বছরের সাধনার ফল।

গার্গী বললো–আপনি কিছু আগে খেয়ে নিন!

–এক বিন্দু জলও নয়। আমাদের দেরি করা ঠিক হবে না…

ওরা সোমাকে নিয়ে নির্দিষ্ট ঘরে এলো। মেঝেতে একটা বড়ো শতরঞ্চি বিছানো হলো। তার ওপর কাঁধের ভারী ঝোলাটা রাখলেন।

–তোমরা ছাড়া ঘরে কেউ না ঢোকে। মুখোশটা আমার হাতে দাও। আমার নাতনিকে সামনে বসাও…

গার্গীর মনের ভয় পুরোপুরি যায়নি

–মামা, মেয়ের কিছু হবে না তো?

ঝোলা থেকে একটা বড়ো তামার কৌটো, ছোটো একটা ঘট, শেষে বার করলেন একটা মড়ার মাথার খুলি, কপালের হাড়ে লাল সিঁদুরের লেপন। সোমাও অবাক চোখে দেখছে। কৌটো থেকে কালো মলমের মতো বার করে সবার কপালে তিলক পরিয়ে দিলেন।

“এটাই তোমাদের রক্ষা তিলক। কোনোমতেই অনুভূতির স্বীকার হবে না। এখনও বুঝতে পারছি না, অতৃপ্ত আত্মা কী চায়! সত্যি যদি মুক্তি চায়, কাজ সহজ হবে… অন্য কোনো মতলব থাকলে…” কথা অসমাপ্ত রাখলেন।

সোমা আর মামার সামনে রয়েছে ওই মুখোশটা… যেন মামাবাবুকে ড্যাবড্যাব করে দেখছে। রুদ্র মামা চোখ বন্ধ করে ডানহাতের মাঝখানের আঙুল দিয়ে মুখোশটার কপালে রেখে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। চন্দন দেখলো, সোমা বসে বসে ঢুলছে। গার্গীও দেখছে, মেয়েটার মুখটাতে একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। ও ভয়ে পাশে বসা চন্দনের হাতে হাত রাখলো।

ধীরে ধীরে সোমার মুখটা ছবিতে আঁকা টুম্পার মুখ ধারণ করছে। সেই ফোলা ফোলা গাল, মোটা ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছে। ওরা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। রুদ্রবাবু চোখ খুলে সোমা ওরফে টুম্পার দিকে তাকালেন। কী মর্মভেদী দৃষ্টি! ওই সৌম্য মানুষটাও এই ক’মিনিটে বদলে গেছে। কঠিন মুখটা ক্রমশ কঠোর আকার ধারণ করছে।

“আমি আর একা এই… কানে তালা লাগানো নিস্তব্ধতায় থাকতে পারছি না…” গোঙানীর মতো শব্দ গুলো বেরিয়ে এলো।

জলদগম্ভীর স্বরে উনি বললেন, “আত্মহত্যা মহাপাপ, তার ফল ভোগ করতেই হবে…” ছোট্ট সোমার মুখে রাজ্যের বীভৎসতা ।

“বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, মরে শান্তি পাবো…”

–“এই ছোটো মেয়েটাকে ধরলি কেন?” সোমার চোখের মণি দুটো বন বন করে ঘুরছে। গার্গীর মনে হচ্ছে, ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।

“ছোটো বয়স, তাই নরম মন, রাশ হালকা। সুবিধে হলো! আদরের এক মেয়ে, ভাবলাম, ভয় দেখালে আমার মুক্তির ব্যবস্থা করবে…” বিশ্রীভাবে হাসলো। চন্দনও সহ্য করতে পারছে না। ভূতের ভয়ঙ্কর সিনেমার থেকেও ভয়ের।

“আমি মুক্তির ব্যবস্থা করে দোব। কিন্তু কথা দিতে হবে, যতক্ষণ না মুক্তি পাচ্ছিস, এই মুখোশটার অন্তরালে থাকতে হবে…” কোনো উত্তর নেই। এক মিনিট অপেক্ষার পর ধমকে উঠলেন মামাবাবু, “কী হলো জবাব দিচ্ছিস না কেন!” হয়তো ঠিক করতে পারছে না… এবার নাকি সুরে উত্তর এলো, “ঠকাবে না তো! বেঁচে থাকতেও কেউ আমার জন্যে কিছু করেনি…” চোখ দুটো একটু নরম হচ্ছে।

–আমি তান্ত্রিক হিসেবে কথা দিচ্ছি। নাহলে আমার তন্ত্র সাধনাই বৃথা হবে।

–বেশ, কীভাবে আমায় মুক্তি দেবে?

ও নিশ্চিত হতে চাইছে।

–তোর আত্মা এই মুখোশের আধারে ঢুকলেই এই মুখোশ নিয়ে কামরূপে রওনা হবো, সেখানে গিয়ে তন্ত্র সাধনার দ্বারা নির্দিষ্ট মার্গে তোকে মুক্তির পথে পাঠিয়ে দেবো।

মিনিটের মাথায় সোমা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো।

রুদ্র মামা দু’হাত দিয়ে মুখোশটা সাবধানে তুলে ঝোলায় পুরলেন। ওরা দেখলো, মুখোশটা একটু ভারী, যেন রক্ত-মাংসের সত্যিকারের মুণ্ডু। দাঁড়িয়ে উঠে মামা বললেন, “আমার নাতনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। চাঁদু তুই আমাকে টিকিট কেটে কামরূপ এক্সপ্রেসে চড়িয়ে দে। যত তাড়াতাড়ি পারি ওকে মুক্তির হদিস দিতে হবে। কেন না কখন মতি ঘুরে যাবে জানি না…”

গার্গী আর চন্দন মেয়ের কথা চিন্তা করে কিছু বলতেও পারলো না। চন্দন গাড়ি বার করলো। যাবার আগে রুদ্র মামা বলে গেলেন, “আমি কোনোদিন সময় পেলে আসবো। তবে ওই ঘরটা গঙ্গাজল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দেবে। আর তোমরা গঙ্গা জল মাথায় দিয়ে স্নান করে নিও…” ওদের গাড়ি বেরিয়ে গেলো।

সোমা মিষ্টি গলায় বললো, “উনি কে মা!” গার্গী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বললো, “ওটা তোমার মামা দাদু”…

সমাপ্ত

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন