গুটুরাম গুপচাঁই
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাছেলেটার নাম বাচকু। ছেলেটা পড়ার সময় খেলবে। খেলার সময় আঁক কষবে। আর সন্ধান পেলেই কারও বাগানে ঢুকে পড়বে। আমটা, কলাটা পেড়ে খাবে। তা, সেদিন হয়েছে কী, কার-না-কার বাগানে ঢুকে ফড়িং ধরছিল। শরতের রোদ, ঝলমল করছে। আকাশের মেঘ, ধবধব করছে। গাছে গাছে ফড়িং ফরফর করে উড়ছে, বসছে। আর যেই-না বাচকু ধরবে বলে হাত বাড়াচ্ছে অমনিই ফড়িং ফুড়ুৎ।
এমন সময় হল কী, একটা ফুড়ুৎ-ফড়িং ধরতে গিয়ে বাচকু পড়ল একটা অদ্ভুতুড়ের সামনে। কে রে ওটা অদ্ভুতুড়ে, দেখতে কালো কুচকুচে? তার অ্যাত্তো বড়ো মুখখানা। পেটফোলা ঠিক হাঁড়িখানা। চারখানা ঠ্যাং বেঁটকুলে। হাঁটছে কেমন হেলেদুলে!
কী জানি বাবা কে এটা! ভালুকের মতো দেখতে কুকুরটা, না কুকুরের মতো দেখতে ভালুকটা! বাচকু তো দেখে থ! দেখো সক্কালবেলা বাগানে ঢুকে কেমন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! না, এঁকে হোঁতকাও বলা যাবে না, হোঁদলও না। মোটকাও বলা যাবে না, কোঁতকাও না। ইনি যেন গুটুরাম গুপচাঁই!
হ্যাঁ, হঠাৎ এই নামটাই বাচকুর মাথায় কিলবিলিয়ে উঠেছে। উঠতেই বাচকু নিজের মনে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে তার মুখের সামনে হাজির। তালি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে গুটুরামবাবু, গুপচাঁই গুপচাঁই করে এখানে ঘুরঘুর করা হচ্ছে কেন?’
গুটুরাম কোনো উত্তরই দিল না। আরে বাবা, সে তোমার মতো কথা বলতে পারলে তবে তো উত্তর দেবে? তাই সে বাচকুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার একটুখানি ল্যাজটা টুকটাক করে নাচাতে লাগল।
বাচকু আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বলি মহাশয়, অমন পিটপিটিয়ে দেখছেন কী? কামড়াবেন? না, গুঁতোবেন?’
ওমা! হঠাৎ হল কী, বাচকুর কথা শেষ হতেই সেই গুটুরামবাবু ঝপ করে পেট ঠেকিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর মাটির ওপর গড়গড়িয়ে দু-দুবার গড়াগড়ি খেয়ে নিল। খেয়ে নিয়ে, উটের মতো পিঠ উঁচিয়ে তুড়তুড়ি কাটতে লাগল।
বাচকু ভাবল, ভালো রে ভালো, গুটুরাম কি তাহলে পিঠে বসতে বলছে? এই কথা ভাবতে ভাবতেই বাচকু গুটুরামের মুখের সামনে উবু হয়ে বসল। ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মহাশয়ের কি আমার ঘোড়া হবার ইচ্ছে হয়েছে?’
গুটুরাম এবার ঠ্যাং তুলে লাফ দিল—থপাস থপাস! লাফাতে লাফাতে সিধে ঢুকে পড়ল বাচকুর দু-পায়ের মধ্যিখানে। বাচকুও ধুপ করে তার পিঠের ওপর বসে পড়ল। পিঠের ডাইনে-বাঁয়ে পা ঝুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাট-হ্যাট’।
অমনি সেই মোটা পেট গুটুরাম বাচকুকে পিঠে নিয়ে গুপচাঁই-গুপচাঁই করতে করতে ছুটতে লাগল। আর বাচকু ‘কোথা যাই’ ‘কোথা যাই’ করতে করতে দুলতে লাগল।
দুলতে দুলতে চোখের পলকে বাগান পার। বাগান পেরিয়ে সামনে দিঘি। দিঘি গেল, বন পড়ল। বন পেরিয়ে মাঠ পড়ল। মাঠ ডিঙিয়ে ‘গুটুগাঁই আর ছুটে যাই’ করতে করতে গুটুরাম কোথায় যে হুস করে হাজির হল বাচকু বুঝতেই পারল না। বাচকুর চোখ থেকে চেনা রাস্তাটা হারিয়ে গেল। চেনা চেনা মুখ হারিয়ে গেল। চেনা চেনা বাড়ি-ঘর হারিয়ে গেল। ইশকুল হারিয়ে গেল। অঙ্কের খাতা হারিয়ে গেল। ইতিহাসের বই হারিয়ে গেল। মাস্টারমশাই হারিয়ে গেলেন। মনে মনে এবার ভূগোলে-পড়া দেশগুলো সে মজাসে দেখে বেড়াবে গুটুরামের পিঠে বসে। যাই বলো আর তাই বলো গুটুরামের পিঠটা কিন্তু ভারি মোলায়েম। রাত্তিরবেলা ঘুম পেলে মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ো, বুঝবে আরাম কাকে বলে। দুর, শিমুলতুলোর বালিশ কোথায় লাগে! এমনকী পাশের বালিশের মতো জড়িয়ে তুমি যদি ঘুমিয়ে পড়ো, আহা কী আরাম! বেঁচে থাকো বাবা গুটুরাম!
অবিশ্যি কেউ তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না। গুটুরামও বাঁচবে না। সেও একদিন চোখ বুজবে। তাকেও একদিন ভাগাড়ের পাড়ে পড়ে পচতে হবে। ইস! কী যাচ্ছেতাই গন্ধ!
ব্যাস! যেই বাচকু গন্ধ বলে নাক সিঁটকেছে, অমনি গুটুরাম থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনের দুটি ঠ্যাং আকাশে তুলে মেরেছে এক ঝটকা। আর দেখতে হয়। বাচকু গুটুরামের পিঠ থেকে মাটিতে মেরেছে ডিগবাজি—ধপাস! পটকা ফটাস!
ফেলে দিয়ে গুটুরামের কোনো গ্রাহ্যই নেই। বেমালুম গটমট করে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল! বাচকুর দিকে একবার ফিরেও তাকাল না।
বাচকু কিন্তু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল হাঁদার মতো সেইদিকে। জানতেও পারল না, বাচকুকে পিঠে চাপিয়ে নিজের পিঠটি চুলকিয়ে নিয়েছে। পিঠে যে তার একটি ফুসকুড়ি হয়েছিল। যা জ্বালাচ্ছিল ক-দিন। আজ বাঁচা গেল। আহ! আরাম কাকে বলে!