বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
    অশান্ত সন্তান ওগো, বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদীমাতা।
    কাল বৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতে রক্তপুঞ্জ তব
    উত্তাল ঊর্মির তালে-বক্ষে তবু লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব
    উদ্যত ফণার নৃত্যে আষ্ফালিত ধূর্জটির কন্ঠ-নাগ জিনি,
    ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী।
    স্পর্শে তব পুরোহিত, ক্লেদে প্রাণ নিমেষেতে উঠিত সঞ্চারি,
    এসেছিলে বিষ্ণুচক্র মর্মন্তুদ–ক্লৈব্যের সংহারী।
    ভেঙেছিলে বাঙালির সর্বনাশী সুষুপ্তির ঘোর,
    ভেঙেছিলে ধূলিশ্লিষ্ট শঙ্কিতের শৃঙ্খলের ডোর,
    ভেঙেছিলে বিলাসের সুরাভান্ড তীব্র দর্পে, বৈরাগের রাগে,
    দাঁড়ালে সন্ন্যাসী যবে প্রাচীমঞ্চে-পৃথী-পুরোভাগে।
    নবীন শাক্যের বেশে, কটাক্ষেতে কাম্য পরিহরি
    ভাসিয়া চলিলে তুমি ভারতের ভাবগঙ্গোত্তরী
    আর্ত অর্স্পশ্যের তরে, পৃথিবীর পঞ্চমার লাগি;
    বাদলের মন্দ্র সম মন্ত্র তব দিকে দিকে তুলিলে বৈরাগী।
    এনেছিলে সঙ্গে করি অবিশ্রাম প্লাবনের দুন্দুভিনিনাদ,
    শানি-প্রিয় মুমূর্ষৃর শ্মশানেতে এনেছিলে আহব-সংবাদ
    গান্ডীবের টঙ্কারেতে মুহুর্মুহু বলেছিলে, আশি আমি আছি!
    কল্পশেষে ভারতের কুরুক্ষেত্রে আসিয়াছি নব সব্যসাচী।
    ছিলে তুমি দধীচির অস্থিময় বাসবের দম্ভেলির সম,
    অলঙ্ঘ্য, অজেয়, ওগো লোকোত্তর, পুরুষোত্তম।
    ছিলে তুমি রূদ্রের ডম্বরুরূপে, বৈষ্ণবের গুপীযন্ত্র মাঝে,
    অহিংসার তপোবনে তুমি ছিলে চক্রবর্তী ক্ষত্রিয়ের সাজে-
    অক্ষয় কবচধারী শালপ্রাংশু রক্ষকের বেশে।
    ফেরুকুল-সঙ্কুলিত উঞ্ছবৃত্তি ভিক্ষুকের দেশে
    ছিলে তুমি সিংহশিশু, যোজনান্ত বিহরি একাকী
    স্তব্ধ শিলাসন্ধিতলে ঘন ঘন গর্জনের প্রতিধ্বনি মাখি।
    ছিলে তুমি নীরবতা-নিষ্পেষিত নির্জীবের নিদ্রিত শিয়রে
    উন্মত্ত ঝটিকাসম, বহ্নিমান বিপ্লবের ঘোরে;
    শক্তিশেল অপঘাতে দেশবক্ষে রোমাঞ্চিত বেদনার ধ্বনি
    ঘুচাতে আসিয়াছিলে মৃত্যুঞ্জয়ী বিশল্যকরণী।
    ছিলে তুমি ভারতের অমাময় স্পন্দহীন বিহ্বল শ্মশানে
    শবসাধকের বেশে-সঞ্জীবনী অমৃত সন্ধানে।
    রণনে রঞ্জনে তব হে বাউল, মন্ত্রমুগ্ধ ভারত, ভারতী;
    কলাবিৎ সম হায় তুমি শুধু দগ্ধ হলে দেশ-অধিপতি।
    বিবিবশে দূরগত বন্ধু আজ, ভেঙে গেছে বসুধা-নির্মোক,
    অন্ধকার দিবাভাগে বাজে তাই কাজরীর শ্লোকে।
    মল্লারে কাঁদিছে আজ বিমানের বৃন্তহারা মেঘছত্রীদল,
    গিরিতটে, ভূমিগর্ভ ছায়াচ্ছন্ন-উচ্ছ্বাসউচ্ছল।
    যৌবনের জলরঙ্গ এসেছিল ঘনস্বনে দরিয়ার দেশে,
    তৃষ্ণাপাংশু অধরেতে এসেছিল ভোগবতী ধারার আশ্লেষে।
    অর্চনার হোমকুন্ডে হবি সম প্রাণবিন্দু বারংবার ঢালি,
    বামদেবতার পদে অকাতরে দিয়ে গেল মেধ্য হিয়া ডালি।
    গৌরকানি- শঙ্করের অম্বিকার বেদীতলে একা
    চুপে চুপে রেখে এল পূঞ্জীভূত রক্তস্রোত-রেখা।

    টীকা