Chapter Index

    ভেড়া পাহারা দিত এক কুকুর। তার মালিক ছিল বড় খারাপ। কুকুরটাকে উপোস করিয়েই রেখে দিত। কুকুর বেচারা আর সহ্য করতে পারলে না। মালিককে ছেড়ে চলল। রাস্তায় এক চড়াই পাখির সঙ্গে দেখা। চড়াই বললে—ভায়া, এত মন-মরা দেখি?

    কুকুর বললে—কি করি? খিদে পেয়েছে অথচ খাবার কিছু নেই।

    চড়াই বললে—তবে ভায়া আমার সঙ্গে চলো শহরে—তোমার খাবার আমি জুটিয়ে দেব।

    কাজেই তারা চলল একসঙ্গে শহরে। যখন দুজনে কসাই-এর দোকানের সামনে এলো, চড়াই কুকুরকে বললে—একটু দাঁড়াও; তোমার জন্যে এক টুকরো মাংস নিয়ে আসি। বলে দোকানে গিয়ে উড়ে বসল। চারিদিকে চেয়ে যখন দেখল কেউ তাকে দেখছে না তখন শানের উপর যে বড় মাংসর টুকরোটা পড়ে ছিল সেটাকে ঠোঁট দিয়ে তোলবার চেষ্টা করতেই মাংসটা গড়িয়ে নীচে পড়ে গেল। কুকুরও অমনি সেটা মুখে করে তুলে এক কোণে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলল।

    চড়াই বললে—এবার এসো আমার সঙ্গে আরেক দোকানে। সেখান থেকে আরেক টুকরো এনে দিলে তোমার পেট ভরে যাবে।

    দ্বিতীয় মাংসের টুকরোটা খাবার পর চড়াই জিজ্ঞেস করল—কি ভায়া, যথেষ্ট হয়েছে?

    কুকুর বললে—মাংস যথেষ্ট খেয়েছি, কিন্তু এখনও রুটি পাইনি।

    চড়াই বললে—তা-ও দেব। এসো আমার সঙ্গে।

    বলে তাকে নিয়ে গেল এক রুটিওয়ালার দোকানে। সেখানে গিয়ে দুটি গোল গোল রুটি ঠুকরে ঠুকরে মাটিতে ফেলে দিল। কুকুর বললে—এতে পেট ভরল না, আরো হলে হত।

    চড়াই তাকে আর একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে আরো কিছু রুটি ঠেলে ফেলে দিল।

    চড়াই এবার বললে—কি কুকুর ভায়া, যথেষ্ট হয়েছে?

    কুকুর জবাব দিলে—হয়েছে। এবার চলো শহরের বাইরে একটু হাওয়া খাওয়া যাক।

    বড় রাস্তা ধরে দুটিতে তখন চলতে লাগল। সেদিন ছিল গরম। কিছু দূর গিয়ে কুকুর বললে—বড় ক্লান্ত বোধ হচ্ছে। একটু ঘুমোই।

    চড়াই বললে—বেশ তো ঘুমোও না! ততক্ষণ আমি গাছের ডালে বসে থাকব।

    কুকুর রাস্তায় শুয়ে খুব ঘুমিয়ে পড়ল। কুকুর যখন ঘুমোচ্ছে সেই সময় এক গাড়িওয়ালা তিন ঘোড়ার এক গাড়ি হাঁকিয়ে আসছিল। গাড়িতে দু’ পিপে সরাব। চড়াই দেখল যে গাড়িওয়ালা কুকুরকে দেখেও তার গাড়ি সরাচ্ছে না। যে চাকার দাগের মধ্যে কুকুরটা শুয়ে ঠিক সেই দাগ দিয়েই গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।

    চড়াই চেঁচিয়ে বললে—গাড়িওয়ালা, ওখান দিয়ে গাড়ি চালিও না। আমার কথা শোনো, নইলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।

    গাড়িওয়ালা খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল—কপালে দুঃখু আছে! কী আমার মহারাজ এলেন! বলে চড়াৎ চড়াৎ করে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে কুকুরের দিকে ছুটিয়ে দিল গাড়ি। কুকুর মরে গেল।

    চড়াই বললে—আমার ভাইকে তুমি মেরে ফেললে! এর ফলে তোমার গাড়ি ঘোড়া সব যাবে।

    গাড়িওয়ালা বললে—গাড়ি যাবে ঘোড়া যাবে বটে! তুই এক পোঁটকা চড়াই আমার কী করতে পারিস? বলে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।

    চড়াই উড়ে গিয়ে গাড়ির নীচে লুকোলো। তার পর ঠোকরাতে লাগল পিপের ছিপিতে। ঠুকরে ঠুকরে ছিপিটাকে বার করে দিতেই সরাব গড়িয়ে পড়তে লাগল মাটিতে। গাড়িওয়ালা সামনে থাকায় কিছু টের পেল না। কিন্তু একবার যখন সে পিছন ফিরে তাকিয়েছে, দেখল গাড়ির পিছন দিয়ে টপ্‌ টপ্‌ করে কি পড়ছে। গাড়ি থামিয়ে দেখল একটা পিপে খালি হয়ে গেছে।

    গাড়িওয়ালা বলল—কপালই আমার খারাপ।

    চড়াই উড়তে উড়তে বলল—এখনও যথেষ্ট খারাপ হয়নি। বলে উড়ে গিয়ে বসল একটা ঘোড়ার মাথায়। বসেই ঘোড়ার চোখ খুঁটে বার করে দিল। গাড়িওয়ালা দেখতে পেয়ে তার কুড়ুল বার করে ছুঁড়ে মারল চড়াইয়ের দিকে। চড়াই উড়ে পালাল আর কুড়ুল গিয়ে লাগল ঘোড়ার মাথায়। তার ঘায়ে ঘোড়া পড়ল মারা।

    গাড়িওয়ালা বললে—নাঃ কপালটা নেহাতই খারাপ দেখছি।

    চড়াই বললে—এখনও কপাল যথেষ্ট খারাপ হয়নি।

    গাড়িওয়ালা দু-ঘোড়া নিয়ে যখন গাড়ি চালিয়ে চলল, চড়াই আবার গাড়ির নীচে ঢুকে দ্বিতীয় পিপেটার ছিপি ঠুকরে ঠুকরে খুলে ফেলল। সমস্ত সরাব গড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে। গাড়িওয়ালার যখন সেটা নজরে পড়ল সে আবার বলল—নাঃ কপালটা সত্যিই খারাপ।

    চড়াই বললে—যথেষ্ট খারাপ এখনও হয়নি। বলে উড়ে গিয়ে দ্বিতীয় ঘোড়ার মাথায় বসে তার চোখটাও খুবলে নিল। গাড়িওয়ালা ছুটে গিয়ে তার কুড়ুল বার করে চড়াইকে মারতে যেতেই চড়াই তো উড়ে পালাল, ঘোড়াটাই পড়ল মারা।

    গাড়িওয়ালা বললে—কপাল সত্যিই মন্দ।

    চড়াই বললে—এখনও যথেষ্ট মন্দ হয়নি। বলে তৃতীয় ঘোড়ার মাথায় বসে তার চোখটাও খুবলে নিলে। গাড়িওয়ালা রাগে অন্ধ হয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে চড়াইকে কুড়ুল দিয়ে মারতেই চড়াই ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল। ঘোড়াটি পড়ল কাটা।

    গাড়িওয়ালা বলল—আমার কপালটা একেবারেই খারাপ দেখছি।

    চড়াই বললে—এখনও যথেষ্ট খারাপ হয়নি। এবার তোমার বাড়িতে তোমার কপাল পুড়বে।

    গাড়িওয়ালাকে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে রাগে বিরক্তিতে পূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে হল। বৌকে বলল—ওঃ আজ যা লোকসান হয়েছে কহতব্য নয়। সমস্ত সরাব পড়ে গেছে। তিনটে ঘোড়াই মরেছে।

    বৌ বললে—হায় হায়। শোনো গো, এদিকে আবার বাড়িতে এমন বজ্জাত একটা পাখি ঢুকেছে যে কি বলব। পাখিটা করেছে কি, দুনিয়ায় যত পাখি আছে সব কটাকে ডেকে এনে আমাদের গোলায় এসে পড়ে যত শস্য খেয়ে ফেলছে।

    গাড়িওয়ালা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গিয়ে দেখল হাজারে হাজারে পাখি গোলায় ঢুকে সব শস্য খেয়ে ফেলেছে। চড়াই বসে আছে তাদের মাঝখানে।

    গাড়িওয়ালা বললে—ওঃ আমার কপাল কী খারাপ!

    চড়াই বললে—এখনও যথেষ্ট খারাপ হয়নি গাড়িওয়ালা। তোমার জীবনই যায় কি না দেখ। বলে উড়ে পালাল।

    গাড়িওয়ালার সব গেল। রাগে দুঃখে তিক্ত হয়ে সে নীচে নেমে গিয়ে উনুনের ধারে বসল। চড়াই জানলার বাইরে বসে বলল—গাড়িওয়ালা, তোমার প্রাণই যায় কি না দেখ।

    গাড়িওয়ালা কুড়ুলটা তুলে চড়াইয়ের দিকে ছুঁড়ে মারলে। তাতে জানলাটাই ভাঙল—পাখির কিছু হল না।

    চড়াই তখন ভিতরে এসে উনুনের উপর বসে বললে—গাড়িওয়ালা, তোমার প্রাণই যায় কি না দেখ।

    গাড়িওয়ালা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উনুনটাকে দু টুকরো করে ভেঙে ফেললে। চড়াই যেমনি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাতে লাগল গাড়িওয়ালারও যা কিছু আসবাব ছিল—আয়না, বেঞ্চি, টেবিল, শেষে ঘরের দেওয়াল পর্যন্ত টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল। কিন্তু পাখির গায়ে একটি আঁচড়ও লাগল না। শেষে হঠাৎ সে পাখিটাকে খপ করে ধরে ফেললে।

    গাড়িওয়ালার বৌ বললে—দাও ওটাকে মেরে ফেলি।

    গাড়িওয়ালা বললে—না, তাহলে তো ওকে দয়া দেখানো হবে। একে মারতে হবে অনেক বেশী কষ্ট দিয়ে। বলে সে গোটা পাখিটাকে গিলে খেয়ে ফেলল। পাখি এদিকে তার পেটের মধ্যে উড়ে বেড়াতে লাগল। গলা দিয়ে বেরিয়ে তার মুখের মধ্যে এসে গলাটি বাড়িয়ে বললে—দেখো গাড়িওয়ালা এবার তোমার প্রাণই না যায়!

    গাড়িওয়ালা কুড়ুলখানা তার বৌয়ের হাতে দিয়ে বললে—দাও তো পাখিটার মুণ্ডু উড়িয়ে।

    বৌ তাক করে চালালো কুড়ুল। কিন্তু পাখির গলায় না লেগে কুড়ুল গিয়ে পড়ল গাড়িওয়ালার মাথায়। তাতেই মরল গাড়িওয়ালা।

    চড়াই উড়ে পালিয়ে গেল।

    টীকা