Chapter Index

    এক ছিল আশ্চর্য বাজনদার। সে যখন তার বেহালা তুলে নিয়ে বাজাতো, যে-ই শুনুক সে-ই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতো। বাজনদার একদিন একা বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আর নানা বিষয় ভাবছে। ভাবতে ভাবতে তার ভাবনা প্রায় ফুরিয়ে গেল। তখন সে বললে— এই বনের মধ্যে একা চলেছি, সময় আর কাটে না। দাঁড়াও একটি ভালো সঙ্গীকে ডেকে আনি। বলে তার বেহালা কাঁধে নিয়ে বাজাতে শুরু করে দিল। বেহালার সুর গাছে গাছে ধ্বনিত হয়ে এগিয়ে চললো। একটু পরেই বন জঙ্গল ভেদ করে বেরিয়ে এল এক নেকড়ে বাঘ।

    বাজনদার বলল— এ যে দেখছি নেকড়ে বাঘ, একে নিয়ে কি করব!

    কিন্তু নেকড়ে এগিয়ে এসে বললে— দেখুন বেহালা-বাজিয়ে, আপনি বড় সুন্দর বাজান। আমাকে শিখিয়ে দেবেন?

    বাজনদার বলল— এ আর শক্ত কি? আমি যা বলি কর।

    নেকড়ে বললে— ছাত্র যেমন তার শিক্ষকের কথা শোনে আমিও তেমনি আপনার বাধ্য হব।

    বাজনদার তখন তাকে নিয়ে কিছুদূরে গিয়ে দেখলে একটা বুড়ো ফাঁকা ওক গাছের গুঁড়ির গায়ে মস্ত একটা ফাটল। বাজনদার বললে— শোন, যদি বেহালা বাজানো শিখতে চাও তো সামনের পা দুটো এই ফাটলের মুখে রাখো।

    নেকড়ে পা রাখতেই বাজিয়ে করলো কি, একটা পাথর তুলে নিয়ে নেকড়ের পায়ের উপর এমন বাড়ি মারল যে তার পা এঁটে গেল ফাটলের মধ্যে। নেকড়ে বন্দী হল।

    বাজনদার বলল— যতক্ষণ না আমি ফিরি এখানেই থাকো। এই বলে চলে গেল।

    কিছুদূর যাবার পরেই তার ফের একঘেয়ে লাগতে লাগল। সে ভাবল, সময় যে আর কাটে না। একজন সঙ্গী পেতে হবে। দেখি।

    এই ভেবে সে তার বেহালা বার করে আবার বাজাতে আরম্ভ করলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল এক শেয়াল বনের মধ্যে বেরিয়ে তার দিকে আসছে। বাজনদার বলল— এ যে দেখছি শেয়াল। শেয়ালের সঙ্গে আমার কি বা দরকার?

    শেয়াল তার কাছে এসে বলল— দাদা, আপনার বাজনার হাত বড় চমৎকার। আমাকে শেখাবেন?

    বাজনদার বলল— এ আর শক্ত কি? আমি যা বলি শুধু তাই করো, তাহলেই শিখতে পারবে।

    শেয়াল বললে— আপনি আমার গুরু। গুরু যা বলবেন ছাত্র তাই করবে।

    বাজনদার তখন বললে— এসো আমার পিছনে পিছনে।

    কিছুদূরে গিয়ে তারা এক রাস্তায় পৌঁছল। তার দু-ধারে গাছের ঘন ঝোপ। বাজিয়ে সেখানে এসে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গাছগুলোকে লক্ষ করতে লাগল। ডান দিকে ছিল একটা হেজেল বাদামের গাছ, তার একটা ডাল প্রায় মাটির কাছ পর্যন্ত নুয়ে পড়েছে। বাজনদার তার এক পা দিয়ে সেই ডালটা মাটিতে চেপে ধরল। তারপর অপর পাশ থেকে আর একটা গাছের ডাল নুইয়ে অন্য পায়ে চেপে ধরল।

    —এসো তো শেয়াল ভায়া, এবার তোমার প্রথম শিক্ষা হোক। যদি শিখতে চাও, তোমার সামনের বাঁ পা এগিয়ে দাও।

    বলতেই শেয়াল তার বাঁ পা এগিয়ে দিলে আর বাজনদার সেটা শক্ত করে বাঁদিকের ডালে বেঁধে ফেলল।

    —এবার তোমার ডান পা এগিয়ে নিয়ে এস দেখি।

    শেয়াল তার ডান পা এগিয়ে ধরতেই বাজিয়ে সেটা ডান দিকের ডালে বেঁধে ফেলল।

    তারপর যখন সে দেখল দুটো পা-ই শক্ত করে বাঁধা হয়েছে সে ডাল দুটো ছেড়ে দিল। আর অমনি গাছের শাখা সোজা উঠে গেল আকাশে। দু-পা ফাঁক করে শেয়াল শূন্যে ঝুলতে লাগল।

    বাজনদার বলল— আমি যতক্ষণ না ফিরি এইখানে অপেক্ষা কর। বলে নিজের পথ ধরল।

    চলতে চলতে সময় আর কাটে না। বাজনদার বলল— বনের পথে সময় বড় ধীরে কাটছে। আর একজন সঙ্গী দেখা যাক। বলে বেহালা তুলে আবার সে বাজাতে শুরু করল। বনের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলল তার প্রতিধ্বনি।

    একটি ছোট্ট খরগোস ছুটতে ছুটতে এসে হাজির।

    বাজনদার বললে— এ যে দেখছি খরগোস। খরগোসে আমার কি হবে?

    খরগোস বললে— বাজনদার দাদা, আপনি বড় সুন্দর বেহালা বাজান। আমায় শিখিয়ে দেবেন?

    বাজনদার বললে— এ আর শক্ত কি? আমার কথা যদি শোন, চট্‌পট্‌ শিখে যাবে।

    খরগোস বললে— ছাত্ররা যেমন গুরুর কথা শোনে আমিও তেমনি আপনাকে মান্য করব।

    তারা কিছু দূর গিয়ে এক খোলা জায়গায় এক পাইন গাছ তলায় এসে পৌঁছল। বাজনদার খরগোসের গলায় একটি লম্বা দড়ি বেঁধে দড়ির অপর অংশ গাছের গুঁড়িতে বেঁধে দিল। তারপর বলল— এবার চট্‌পট্‌ গাছের চারিদিকে কুড়ি পাক ঘোরো তো।

    খরগোস সঙ্গে সঙ্গে তার আদেশ পালন করতে লেগে গেল। কুড়ি পাক হতে না হতেই খরগোস গাছের গুঁড়ির গায়ে লেপটে গেল। বাজনদার তাকে সেখানে শক্ত করে বেঁধে বললে— যতক্ষণ না আমি ফিরি, এইখানে থাকো।

    ইতিমধ্যে নেকড়ে তার পা টানা-হ্যাঁচড়া করে গুঁড়ি কামড়ে প্রাণপণে মুক্ত হবার চেষ্টা করে চলেছে। শেষে অনেক কষ্টে ছাল-চামড়া তুলে রক্তপাত করে সে ফাটল থেকে পা বার করে ফেলল। রাগে ফুলতে ফুলতে সে চললো বাজনদারের খোঁজে— তাকে পেলেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। শেয়াল তাকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলল— নেকড়ে ভায়া, আমাকে বাঁচাও। দেখ বাজনদার আমার কী দুর্দশা করে গেছে।

    নেকড়ে গাছের ডাল টেনে নামিয়ে শেয়ালের পায়ের বাঁধন কেটে দিলে। তখন দুজনে চললো বাজনদারের উপর প্রতিশোধ তুলতে। কিছুদূরে গিয়ে পাওয়া গেল খরগোসকে। তখন খরগোসকেও মুক্ত করে তারা একত্রে চললো শত্রুর খোঁজে।

    বাজনদার পথ চলতে চলতে আবার তার বেহালা বাজাতে আরম্ভ করেছে। এবারে তার ভাগ্য ভালো। বাজনার শব্দ গিয়ে পৌঁছল এক গরীব কাঠুরের কানে। সঙ্গে সঙ্গে সে তার কাঠ কাটা ফেলে কুড়ুল বগলে করে এগিয়ে এল বাজনদারের কাছে।

    বাজনদার বললে— এতক্ষণে একজন উপযুক্ত সঙ্গী পাওয়া গেল। মানুষ— জন্তু নয়। বলে সে এমন সুন্দর করে তার বেহালা বাজাতে লাগল যে কাঠুরে সেখানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনছে। হঠাৎ দেখে যে এক নেকড়ে, এক শেয়াল আর এক খরগোস আসছে। তাদের এগোনোর ভঙ্গীটা কাঠুরের ভাল লাগল না। মনে হল এদের কোনো কুমতলব আছে। সে তখন তার কুড়ুল উঁচিয়ে বাজনদারকে পিছন করে দাঁড়ালো। তার ভঙ্গী দেখে মনে হল যেন বলছে— বাজনদারের দিকে যদি এক পা এগোতে চাও, আমার এই ধারালো কুড়ুল আছে।

    কাঠুরের মূর্তি দেখে জন্তুরা ভয়ে বনের মধ্যে ছুটে পালালো।

    টীকা