ধনী কৃষকের গল্প
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক ছিল ধনী কৃষক। সে একদিন তার গোলাবাড়িতে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখছিল আর ভাবছিল— কতই না আমার সম্পত্তি! শস্য ক্ষেত ভরা শস্যে। গাছ ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। গত বছরের শস্যে গোলা উপচে পড়ছে। গোয়ালে কত দুধালো গরু। আস্তাবলে ভালো ভালো ঘোড়া।
সব দেখে সে বসত বাড়িতে ফিরে এল। ফিরে এসে তাকালো তার লোহার সিন্দুকের পানে। যখন সে তার এই এত সঞ্চিত ধনের কথা মনে মনে বিচার করছে ঠিক তখনই কে যেন দ্বারে আঘাত করল। কিন্তু বাড়ির দরজায় নয়—মনের দরজায়।
ঠিক মনে হল কে যেন তার মনের দরজায় ঘা দিচ্ছে। একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে শুনতে পেল ভিতর থেকে কে বলছে— এত যে তুমি সোনা দানা জমিয়েছ তা দিয়ে কোনো ভাল কাজ করেছ? গরীবদের দিকে একবারও তাকিয়েছ? ক্ষুধার্তের মুখে কোনোদিন অন্ন তুলে দিয়েছ? যা পেয়েছ তাতেই কি তুমি সন্তুষ্ট, না আরও চাও?
কৃষকের মন ভয়ে ভয়ে সাড়া দিল এই বলে— আমি ছিলুম কঠিন, নির্দয়; আমার কোনো আত্মীয়ের জন্যে আমি ভালো কাজ করিনি। ভগবানের কথা কোনোদিন ভাবিনি; শুধু ভেবেছি কেমন করে আমার ধন আরো বাড়াবো। সারা দুনিয়া যদি আমার হাতের মুঠোয় আসতো তাহলেও আমি আরো চাইতুম।
এই সব চিন্তা যতই তার মনে উঠতে লাগল তার হাঁটু দুটো কাঁপতে লাগল। সে আর দাঁড়াতে পারল না— বসে পড়ল। সেই সময় আবার কে তার দ্বারে আঘাত করল। এবারে আর মনের দরজায় নয়— ঘরের দরজায়।
কৃষক বললে— ভিতরে এস। দরজা খুলে দেখল এক দরিদ্র প্রতিবেশী। মস্ত বড় পরিবার তার সবাইকে পেট ভরে খেতে দিতে পারে না।
গরীব প্রতিবেশীটি জানতো যে এই কৃষক যেমন ধনী তেমনি কঠিন। এর কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। কিন্তু ছেলে-মেয়েরা উপোসী কাজেই চেষ্টা করতেই হবে। তাই সে বললে— প্রতিবেশী মহাশয়, আমি জানি যে আপনি দান করতে বা ধার দিতে একেবারেই ভালবাসেন না। কিন্তু আজ আমি আপনার কাছে এসেছি ডুবন্ত মানুষ যেমন করে ভেসে যাওয়া খড়ের মুঠিও আঁকড়ে ধরে তেমনি ভাবে। আমার ছেলে-মেয়েরা উপোসী। আমায় চার ধামা গম ধার দেবেন?
ধনী কৃষক তার প্রতিবেশীর দিকে তাকালো। এই প্রথম তার মনে একটা দয়ার রশ্মি জেগে তার মনের তুষারকে গলিয়ে ফেললে।
—দেখ প্রতিবেশী, তোমায় আমি চার ধামা গম ধার দিতে পারব না। কিন্তু তোমায় আমি আট ধামা গম দান করতে পারি এক শর্তে।
—কি শর্তে?
—তোমায় শপথ করতে হবে যে আমি মারা গেলে আমার কবরে তিন রাত তুমি পাহারা দেবে।
গরীব চাষীটি শুনে একটু ভয় পেল। ব্যাপারটা তার ভাল লাগল না। কিন্তু বর্তমানে তার যা অবস্থা সে যে-কোনো শর্তেই রাজি হত। কাজেই সে অঙ্গীকার করে গমের ধামা নিয়ে বাড়ি গেল।
ধনী কৃষকের বোধ হয় একটা পূর্ববোধ হয়েছিল যে তার কি হতে চলেছে; কারণ তিন দিন পরে সে হঠাৎ মারা গেল। কেউ তার জন্যে চোখের জল ফেলল না। তার কবর হয়ে গেলে গরীব চাষীর তার অঙ্গীকারের কথা মনে পড়ে গেল। একবার ভাবলে, কি হবে গিয়ে? তারপর ভাবলে— লোকটি আমায় দয়া দেখিয়েছেন; আমার ক্ষুধার্ত সন্তানদের মুখে রুটি দিয়েছেন। তা ছাড়া আমি যে শপথ করেছি তা আমায় রাখতেই হবে।
রাতের অন্ধকার নেমে আসতেই সে গির্জের কবরখানায় গেল। গিয়ে সমাধির ধারে বসে পড়ল। চারিদিক নীরব; চাঁদের পাঙাশে আলো কবরের উঁচু উঁচু পাথরগুলোর উপর এসে পড়েছে; শুধু মাঝে মাঝে প্যাঁচার ডাক গোরস্থানের নীরবতা ভঙ্গ করছে। সারা রাত কাটিয়ে সে কোনো রকম বিপদের মধ্যে না পড়েই সূর্য উঠবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেল। এমনি করে দ্বিতীয় রাত্রিও নির্বিঘ্নে কেটে গেল।
তৃতীয় সন্ধ্যায় তার কেমন একটা পূর্ববোধ হল যে এবার কিছু ঘটবে। সেদিন গির্জেতলায় ঢুকেই সে দেখতে পেল একজন লোক দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে যাকে সে এর আগে কখনও দেখেনি। লোকটা বুড়োটে, মুখে কাটার দাগ, তীক্ষ্ণ সূচের মতো চোখ।
চাষী চেঁচিয়ে বলল— কি চাই তোমার এখানে? এই নির্জন গির্জেতলায় রাত্রিবেলা তোমার ভয় নেই?
লোকটা জবাব দিলে— কিছুই আমার চাই না; কাউকেই আমার ভয় নেই। আমি হচ্ছি সেই যে গল্পে-পড়া সেই ছেলের মতো, যে ভয়ের কাঁপুনি শিখতে বেরিয়ে পড়েছিল, আর অনেক অসুবিধের মধ্যে পড়েও ভয়ের কাঁপুনি শিখতে পারেনি, শুধু লাভের মধ্যে রাজকন্যা আর অনেক ধনরত্ন লাভ করেছিল, তার মতো। আমি হচ্ছি চিরকেলে গরীব। ছুটি পাওয়া সৈনিক। গির্জেয় এসেছি আর কোথাও আমার রাত কাটাবার স্থান নেই বলে।
চাষী বললে— বেশ, তোমার যদি ভয় না থাকে তাহলে আমার সঙ্গে বসে আজকের রাতের মতো এই কবরটা পাহারা দাও।
সৈনিক বলল— অনায়াসে। পাহারা দেওয়াই তো আমার পেশা। ভালই হোক মন্দই হোক, যা-ই আজ আমাদের ভাগ্যে ঘটুক, তোমার সঙ্গে আমি ভাগাভাগি করে নেব।
তখন তারা দুজনে কবরের ধারে গিয়ে বসল। মাঝরাত পর্যন্ত সব চুপচাপ। তারপরই একটা তীক্ষ্ণ শিষ শোনা গেল— যেন বাতাস কেটে আসছে। পাহারাদার দুজন হঠাৎ দেখতে পেল তাদের সামনে স্বয়ং শয়তান নিজ মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে।
শয়তান চেঁচিয়ে উঠলো— দূর হও হতভাগারা! এই কবরে যে আছে সে হচ্ছে আমার। আমি তাকে নিতে এসেছি। এখুনি যদি তোমরা সরে না পড় তো তোমাদের ঘাড় মটকে দেব।
সৈনিক বলল— দেখুন মহাশয়, আপনি আমার কাপ্তেন নন যে আপনার হুকুম আমি শুনব। তা ছাড়া ভয় কাকে বলে এতদিনেও আমি জানিনি। কাজেই আপনি এখান থেকে সরে পড়ুন— আমাদের যতক্ষণ ইচ্ছা আমরা এখানে থাকব।
লোক দুটির দৃঢ়তা দেখে শয়তান ভাবল, এ দুটো হা-ভাতেকে কিছু সোনা দিয়ে অনায়াসে বশ করা যাবে। সে একটু নম্র হয়ে বললে— আচ্ছা ভাইরা, এক থলে সোনা দিলে তোমরা কবর ছেড়ে চলে যাবে?
সৈনিক বলল— বাঃ এইবার আপনি বেশ ভদ্রভাবে কথা বলছেন। কিন্তু এক থলি সোনাতে কি হবে? আমার এই বুটখানার মধ্যে যত সোনা ধরে যদি ভরে দিতে পারেন তাহলে আমরা রাজি হই।
শয়তান বললে— আমার কাছে তো অত সোনা নেই। তবে কাছের শহরে একজন পোদ্দার আছে। মোটা সুদ খেয়ে সে অনেক টাকা করেছে। আমার বিশেষ বন্ধু। তার কাছে ধার চাইলে আমায় নিশ্চয় দেবে।
বলেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। সৈনিক অমনি তার পা থেকে বুটটা খুলে চাষীকে বললে—দেখ না এবার শয়তান প্রভুকে কেমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাই। তোমার ছুরিখানা একবার দাও তো বন্ধু।
ছুরি দিয়ে সে জুতোর সোল্টা কেটে তার উপরাংশটা নিকটস্থ সমাধি শিলায় ঝুলিয়ে দিল। শূন্য জুতোর খোলটা লম্বা লম্বা ঘাসের উপর লটপট করতে লাগল।
সৈনিক বললে— এবার আসুক শয়তান ব্যাটা।
একটু অপেক্ষা করতেই হাতে এক থলি সোনা নিয়ে ভদ্রমহোদয় উপস্থিত হলেন।
সৈনিক বুট জুতোর কাছে তাঁকে নিয়ে গিয়ে বললে— ঢালুন এবার। দেখে তো মনে হচ্ছে যথেষ্ট সোনা আনেননি।
শয়তান সব সোনাটুকু ঢেলে দিতে বুটের মধ্যে দিয়ে তা ঘাসের উপর গিয়ে পড়ল। বুট যেমন খালি ছিল তেমনি রয়ে গেল।
সৈনিক বলল— বোকাবাবু, আপনাকে বললুম এতটুকুতে হবে না। যান আরও নিয়ে আসুন।
ঘাড় নাড়তে নাড়তে শয়তান বুড়ো চলে গেল। তারপর এক ঘণ্টা পরে ফিরল বগলের তলায় মস্ত এক ঝোলা নিয়ে।
সৈনিক বললে— এবারে মনে হচ্ছে তবু খানিকটা ভালো। তাহলেও ওতে বুট জুতো ভরবে না বলেই আমার মনে হয়।
টুং টাং করে সোনা পড়তে লাগল বুটের ভিতরে, কিন্তু জুতো যেমন খালি ছিল তেমনিই রয়ে গেল।
তখন শয়তান জুতোর মধ্যে উঁকি মেরে ব্যাপারটা বুঝল। চেঁচিয়ে বললে—ওঃ কি বজ্জাত তোরা!
সৈনিক আরো চেঁচিয়ে বললে— বজ্জাত বলছেন কাকে? আমাদের কি আপনার মতো পায়ে ক্ষুর আছে নাকি? আর আপনিই বা হঠাৎ এমন কৃপণ হলেন কেন? যান আরও সোনার টাকা নিয়ে আসুন, নইলে আমাদের মধ্যে যা শর্ত হয়েছে তা টিকবে না।
শয়তান আবার ছুটল। এবার তার আরও দেরি হল। শেষে অনেকক্ষণ পরে দেখা গেল তার কাঁধে একটা মস্ত ভারি বস্তা, তার ভারে সে নুয়ে পড়ছে। বস্তা খালি করে সে সমস্ত বুটের মধ্যে ঢেলে দিল; কিন্তু বুট যেমন খালি ছিল তেমনিই রয়ে গেল। এই দেখে ভীষণ রেগে সে সৈনিকের হাত থেকে জুতোটা ছিনিয়ে নিতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় সূর্যের প্রথম রশ্মি আকাশ চিরে বেরিয়ে এল। আর এক বিকট চিৎকার করে শয়তান পালিয়ে গেল। গরীব বেচারারা বেঁচে গেল।
চাষী বললে— এসো এবার সোনাটা দুভাগে ভাগ করি।
কিন্তু সৈনিক বললে— না। আমার অংশ গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দাও। আমি তোমার সঙ্গে তোমার বাড়ি যাবো আর যা বাকি রইল তাই দিয়ে আমাদের জীবনের শেষ দিন অবধি সুখে কেটে যাবে।