Chapter Index

    চতুরা এল্‌সি

    কর্তা-গিন্নীর একমাত্র মেয়ে। মেয়ে বলতে তাঁরা অজ্ঞান। তাঁরা ভাবতেন এমন চতুর মেয়ে সারা দুনিয়ায় নেই। মেয়ের নাম রেখেছিলেন চতুরা এল্‌সি। একদিন এল্‌সির বাবা গিন্নীকে ডেকে বললেন— আমাদের মেয়ের তো বয়েস হল, এবার ওর বিয়ে দেওয়া যাক।

    গিন্নী বললেন— দেওয়া তো উচিত। দেখ কে ওকে চায়।

    কিছুদিনের মধ্যেই হান্‌স্‌ নামে একটি ছেলে হাজির। সে এসে বললে— আপনাদের মেয়েকে যদি দেন আমি বিয়ে করতে রাজি আছি। তবে আমার একটি শর্ত আছে।

    —কি শর্ত?

    —আপনারা এল্‌সিকে যত চতুর বলছেন, যদি দেখি সে অত চতুর নয় তাহলে কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করব না।

    বাবা বললেন— কোনো ভাবনা কোরো না। এল্‌সি মায়ের মাথাটি একটি রত্ন।

    গিন্নী বললেন— বিশ্বাস করো বাবা, আমাদের মেয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হাওয়া বয়ে যায় সেই বাতাস চোখে দেখতে পায়। কড়িকাঠে মাছি হেঁটে গেলে তার শব্দ কানে শুনতে পায়। এমনি আমাদের এল্‌সি।

    কিন্তু এল্‌সি যে কত কুঁড়ে, কি রকম কর্মবিমুখ তার কিছুই বললেন না।

    যাই হোক ছেলেটিকে একদিন নেমন্তন্নে ডাকা হল। সবাই মিলে বসলেন ডিনার টেবিলকে ঘিরে। খুব খাওয়া-দাওয়া চলছে সেই সময় গিন্নী বললেন— এল্‌সি যাও তো মা মাটির নিচের ঘরে। সকলের জন্যে এক জগ বিয়ার নিয়ে এস।

    চতুরা এল্‌সি দেয়াল থেকে জগটা তুলে নিয়ে মাটির নিচের ঘরে নেমে গেল। চতুর বলে জগের ঢাকনা খুলে টেবিলে রেখে দিয়ে গেল যাতে সময় বাঁচে। নিচের ঘরে পৌঁছে এল্‌সি বীয়ারের পিপের কাছে একটা চেয়ার টেনে বসালো যাতে নীচু হয়ে জগ ভরতে ভরতে পিঠে ব্যথা না হয়ে যায়। তারপর সেই চেয়ারে জগ বসিয়ে পিপের ছিপি খুলে দিল। তাই দিয়ে সরু ফিতের মতো বিয়ার গড়িয়ে পড়তে লাগল। এল্‌সি দাঁড়িয়ে রইল অধৈর্য হয়ে।

    দাঁড়িয়ে রইল বটে কিন্তু তার চোখ ঘুরতে লাগল চারিদিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল তার ঠিক মাথার উপরে একটা আলগা কড়িকাঠ। রাজমিস্ত্রী ছাদ সারাতে এসেছিল, সে ঐ আলগা কড়িটা ভুল করে ফেলে চলে গেছে।

    তখন চালাক এল্‌সির শুরু হল কান্না। হাপুস নয়নে কাঁদে আর বলে, হান্‌স্-এর সঙ্গে তার বিয়ে হলে দুজনের মধ্যে একজন কড়িকাঠ পড়ে মারা যাবে। কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে কাঁদতে বেচারা একেবারে থকে গেল। উপরের ঘরে যাঁরা বীয়ারের জন্যে বসে ছিলেন, তাঁরা বসেই রইলেন। শেষে আর থাকতে না পেরে ঝিকে ডেকে বললেন— যা তো দেখে আয় এল্‌সি কি করছে! এত দেরি হচ্ছে কেন?

    ঝি গিয়ে দেখে পিপের সামনে বসে এল্‌সি আকুল হয়ে কাঁদছে।

    ঝি বললে, এল্‌সি, কাঁদ কেন?

    এল্‌সি উত্তর দিলে— ঐ দেখ মাথার উপরে কি! আজকের দিনে মাথার উপর আলগা কড়িকাঠ দেখলুম, এ বিয়ে হলে আমারই মাথায় কড়িকাঠ ভেঙে পড়বে। হায় হায় আমার কি হবে?

    এই বলে সে আবার কাঁদতে বসল।

    ঝি বললে— এত বোঝো তুমি এল্‌সি? তুমি তো ভারি চালাক!

    বলে ঝি-ও প্রভুকন্যার দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে পা ছড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলে।

    ঝি আর ফেরে না। কি ব্যাপার দেখার জন্যে কর্তা তাঁর ছোকরা চাকরকে পাঠিয়ে দিলেন। ছোকরা গিয়ে যখন শুনল এল্‌সি-র মাথার উপর কত বড় বিপদ ঝুলছে সে-ও কাঁদতে শুরু করে দিলে। অবশেষে গেলেন কর্তা-গিন্নী নিজেরা। তাঁরা চতুরা এল্‌সির গল্প শুনে, মাথার উপর কড়িকাঠ দেখে আর সবারই মত গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে দিলেন।

    সকলের একসঙ্গে কান্নার শব্দ এত বেড়ে উঠল যে হান্‌স্ কিছু বুঝতে না পেরে ভাবল, যাই গিয়ে একবার দেখে আসি কি হল!

    নিচের ঘরে গিয়ে সে দেখল প্রত্যেকে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদছে—মনে হলো যেন কার গলার কত জোর তারই প্রতিযোগিতা চলেছে। হান্‌স্‌ চেঁচিয়ে বলল— কি সর্বনাশটা হয়েছে শুনি!

    এল্‌সি বললে— ঐ দেখ উপরের ঐ আলগা কড়িকাঠটা। ওটা দেখেই আমি বুঝেছি যে আমাদের যদি বিয়ে হয় তাহলে ঐ কড়িকাঠ পড়ে তুমি মারা যাবে। কারণ তুমি যখন এখানে পিপে থেকে বিয়ার নিতে আসবে ওটা তোমার মাথার উপর পড়ে যেতে পারে তো? এই জন্যেই আমরা সবাই কাঁদছি।

    হান্‌স্‌ বলল— বুঝলুম তুমি মস্ত চতুর এল্‌সি, কারণ আমার ভালোর জন্যে তুমি নিজে কেঁদেছ, আর সবাইকে কাঁদিয়েছ। এখন আমার সংসারের জন্যে ঠিক তোমারই মতো চতুরা একজন স্ত্রী আমার দরকার।

    বলে সে এল্‌সির হাত ধরে উপরের ঘরে নিয়ে গেল। তারপর ডিনারের টেবিলে সবাই ঘিরে বসতে বেশ আনন্দে কেটে গেল সন্ধ্যাটা।

    এর কিছুদিন পরেই তাদের বিয়ে হয়ে গেল।

    এখন চতুরা এল্‌সি ছিল বড়ই কর্মবিমুখ। কাজের নামে তার গায়ে জ্বর আসত। বিয়ের পর কয়েক সপ্তাহ তাদের পুরো আলস্যে কেটে গেল। তারপর একদিন হান্‌স্‌ বললে— দেখ বৌ, এবার আমার রোজগারপাতির জন্যে বেরুতে হরে। তুমি যদি আমাদের ভুট্টা ক্ষেতে গিয়ে পাকা ভুট্টাগুলি কেটে আনতে পারো তাহলে তা গুঁড়িয়ে কিছু ময়দা করবো রুটির জন্যে। পারবে?

    এল্‌সি বললে— নিশ্চয় হান্‌স্‌, তুমি যদি বলো তো পারব না কেন?

    পরদিন সকালবেলা হান্‌স্‌ তার কাজে বেরিয়ে যেতেই তার বৌ বেশ করে এক হাঁড়ি সুস্বাদু ঝোল রাঁধতে বসল। ঝোল রেঁধে বাটিতে ভরে নিয়ে চললো ক্ষেতে। ক্ষেতে পৌঁছে ঝোলের বাটিটা আলের উপর রেখে নিজে পাশে বসে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো— আগে কি করব? একটু ঘুমিয়ে নেব না খেয়ে নেব? ঠিক আছে, আগে খেয়েই নেওয়া যাক।

    বলে সে সেই জাম-বাটির এক বাটি ঝোল চেটেপুটে শেষ করে ফেলল। ভারি সুস্বাদু ঝোল। অনেক কিছু তরকারি মাংস পড়েছিল তাতে। পেটটি ভরতেই ঘুমটি পেয়ে গেল। তখন সে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলে— আগে কি করব? আগে ভূট্টা কাটব না আগে একটু ঘুমিয়ে নেব? ঠিক আছে, বরং কাজ শুরু করবার আগে একটু ঘুমিয়েই নেওয়া যাক।

    বলে ক্ষেতের মধ্যে একটু জায়গা করে নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে একবার চোখ বুজল। সঙ্গে সঙ্গে গভীর ঘুমে অচৈতন্য। হান্‌স্‌ বাড়ি ফিরে দেখে কেউ কোথাও নেই। রাতের খাবারও কেউ তৈরি করেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল কিন্তু এল্‌সি ফিরল না।

    হান্‌স্‌ বলল— ওঃ, কি চতুরা এল্‌সি! এত কাজ করছে যে বাড়ি ফিরে খাবার কথাই ভুলে গেছে।

    কিন্তু যখন অন্ধকার হয়ে এল, তবুও এল্‌সি ফিরল না তখন হান্‌সের ভাবনা হল। সে চলল তাকে খুঁজতে— আর দেখতে কত ভুট্টা সে কেটেছে। ক্ষেতে পৌঁছে দেখল ভুট্টার গাছে কেউ হাতই দেয়নি। চতুরা এল্‌সি কোথায় গেল খুঁজতে খুঁজতে শেষে দেখল যে সে ভুট্টা গাছের তলায় গভীর ঘুমে অচৈতন্য।

    হান্‌স্‌ দৌড়ে গিয়ে একটা পাখিধরা জাল নিয়ে এল— তার গায়ে ছোট ছোট ঘণ্টা বাঁধা। জালটা এনে সে বৌ-এর গায়ে বিছিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। বৌ যেমন ঘুমোচ্ছিল, তেমনি ঘুমোতে লাগল। হান্‌স্‌ বাড়ি এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে নিজের কাজ নিয়ে পড়ল। বাটালি, র‍্যাঁদা, পেরেক আর হাতুড়ি বার করল, তারপর তাই দিয়ে একটা চেয়ার বানাতে বসে গেল। দেখে মনে হল চতুরা এল্‌সি বলে যে তার কোনোদিন কোনো বৌ ছিল, তা-ই সে জানে না।

    অবশেষে যখন চতুরা এল্‌সির লম্বা ঘুম ভাঙল সে জেগে দেখল চারিদিক অন্ধকার। চোখ কচলাতে কচলাতে তার মনে পড়ল কোথায় সে এসেছিল। তখন সে উঠে দাঁড়ালো বাড়ি ফেরবার জন্যে। এক পা ফেলতেই ঘণ্টাগুলো বেজে উঠল। আবার এক পা ফেলে, আবার ঘন্টা বাজে। ঘণ্টার শব্দ শুনে বেচারা এমন ঘাবড়ে গেল, এমন ভয় পেয়ে গেল যে সে-ই যে সত্যিকার চতুরা এল্‌সি কি না তা-ই সে বুঝতে পারল না।

    সে বললে— হায় হায়, আমি কি আমি, না আমি অন্য কেউ?

    এ প্রশ্নের জবাব মিললো না। সন্দেহ নিয়ে অনেকক্ষণ সে দাঁড়িয়ে রইল। শেষে তার মাথায় এক বুদ্ধি এল। সে বললে— রোসো, বাড়ি গিয়ে হান্‌স্‌কে জিজ্ঞেস করব আমি কি আমি-ই না অন্য কেউ। ও ঠিক জানবে।

    যদিও অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল তাহলেও খুঁজে বাড়ির রাস্তা বার করতে তার খুব দেরি হল না। যত দৌড়োয় তত ঘণ্টি বাজে। ঘণ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে বাড়ি পৌঁছে দেখে সামনের দরজায় খিল দেওয়া।

    জানলায় ধাক্কা দিয়ে এল্‌সি ডাকল— হান্‌স্‌, এল্‌সি কি বাড়ি আছে?

    —হ্যাঁ বাড়ি আছে।

    শুনে এল্‌সির তো ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে।

    সে বললে— তবে তো আমি চতুরা এল্‌সি নই। কি হবে?

    সে এক দরজা থেকে আর এক দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেড়াতে লাগল। কিন্তু প্রতিবেশীরা ঘণ্টার শব্দ শুনে ভূতের ভয়ে কেউ দরজা খুললো না। যারা উঁকি মেরে দেখল তারাও জালে-ঢাকা এল্‌সিকে চিনতে পারলে না।

    দ্বার থেকে দ্বারে ঘুরে হতাশ হয়ে বেচারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। সেই থেকে চতুরা এল্‌সির কথা আর কেউ কোনোদিন শোনেনি।

    গ্রামের লোক এল্‌সির কথা উঠলে বলত— চতুরা হওয়ার চেয়ে পরিশ্রমী হওয়া ভালো।

    টীকা