হুতুম-থুমো
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাহুতুম-থুমো
এক সময় এক মায়াবী ছিল, সে মায়াবলে গরিব মানুষের চেহারা ধরে বাড়ি-বাড়ি ভিক্ষে করত আর সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ধরে নিয়ে পালাতো। কোথায় যে তাদের নিয়ে যেত কেউ জানতে পারত না, কারণ তাদের আর দেখতে পেত না কেউ। একদিন সেই মায়াবী এক বাড়ির দরজায় গিয়ে হাজির হল। সেই বাড়িতে ছিল তিনটি সুন্দরী মেয়ে। মায়াবী চেহারা করেছিল গরিব রোগা ভিখারীর মতো। পিঠে ছিল তার একখানা ঝুড়ি যাতে করে ভিক্ষা-সামগ্রী বয়ে নিয়ে যেতে পারে। সে এসে একমুঠো খাবার ভিক্ষে করল। একটুকরো রুটি হাতে বড় মেয়েটি বেরিয়ে আসতেই মায়াবী শুধু একবার তাকে একটু ছুঁলো। সঙ্গে-সঙ্গে কী হয়ে গেল, মেয়েটি লাফিয়ে ঢুকে পড়ল ঝুড়ির মধ্যে। সে অমনি লম্বা-লম্বা পা ফেলে সরে পড়ল সেখান থেকে। সোজা গিয়ে হাজির হল অন্ধকার বনের মাঝখানে তার বাড়িতে। বাড়িটি ঐশ্বর্যে ভরা। মেয়েটি যা কিছু চায় সব সে তাকে দিল। তারপর বললে—দেখ সোনা, আমার সঙ্গে তুমি সুখে থাকবে। যা চাইবে সবই তোমায় এনে দেব। এইভাবে কিছুদিন কেটে গেলে একদিন মায়াবী এসে বললে–আমায় একবার দূরে যেতে হবে। কিছুদিন তুমি একা থাকবে। এই রইল বাড়ির চাবি। বাড়ির যেখানে খুশি যে ঘরে খুশি তুমি যেতে পারো শুধু একটি ঘর ছাড়া। এই ছোট্ট চাবিটি হচ্ছে সেই ঘরের। ও ঘরে তুমি কখনো যেয়ো না, গেলে মরতে হবে। তারপর তাকে একটি ডিম দিয়ে বললে—ডিমটি সাবধানে রেখো। সব সময় নিজের কাছে যেন থাকে। যদি হারাও তো তোমার খুবই বিপদ হবে।
মেয়েটি ডিম আর চাবি নিয়ে বললে যে সে তার আদেশ প্রতিপালন করবে। মায়াবী চলে যেতে মেয়েটি সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখল—সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ঘরে ঘরে রূপো আর সোনা বোঝাই—এমন কোথাও দেখেনি। শেষে সেই নিষিদ্ধ ঘরের সামনে এসে সে হাজির হল। ভাবল পেরিয়ে যাই, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারল না। সে চাবিটার দিকে ভাল করে দেখল। চাবির মধ্যে কোন বিশেষত্ব নেই। অন্য চাবিরই মতো। চাবিটা নিয়ে তালার গর্তে লাগিয়ে একটু ঘোরাতেই দরজাটা ঘটাং করে খুলে গেল। কিন্তু ভিতরে গিয়ে সে যে দৃশ্য দেখল তাতে করে তার গা হিম হয়ে গেল। ঘরের ঠিক মাঝখানে রক্তে ভরা একখানা টব, তার মধ্যে টুকরো টুকরো মানুষের দেহ। পাশেই একটা মস্ত কাঠের কুঁদো, তার পাশে চকচকে একখানা কুড়ুল। দেখে মেয়েটি এমন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল যে তার হাতের ডিমটি পড়ে গেল টবের মধ্যে। ডিমটা তুলে নিয়ে সে রক্ত ধুয়ে ফেলল, কিন্তু ধোবার পরই আবার তাতে রক্তের চিহ্ন দেখা দিল। ধুয়ে মুছে কিছুতেই সে আর রক্তের চিহ্ন তুলতে পারল না।
কিছুদিন পরেই মায়াবী ফিরে এল। এসেই সে জিজ্ঞেস করলে চাবি আর ডিমের কথা। মেয়েটি জিনিসদুটি যখন ফিরিয়ে দিতে গেল তার হাত কাঁপতে লাগল। মায়াবীও ডিমের উপর লাল রঙ দেখে বুঝলে যে সে রক্তের ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল। মায়াবী বললে—আমার বারণ সত্ত্বেও তুমি ওঘরে গিয়েছ। এবার তোমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমায় ও ঘরে যেতে হবে। তোমার জীবনের আর কোন আশা নেই। বলে তার চুল ধরে টানতে টানতে তাকে সেই কাঠের কুঁদোর উপর ফেলে তার মাথা কেটে ফেললে। দেহটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ঘরের মেঝে রক্তে ভাসিয়ে দিলে। তারপর টুকরোগুলোকে তুলে টবের মধ্যে ফেলে দিল।
মায়াবী বললে—এবার যাব মেজ মেয়েটাকে আনতে। বলে ভিখারী সেজে সেই বাড়িতে গিয়ে ভিক্ষে চাইল। মেজ মেয়ে এক টুকরো রুটি নিয়ে এল। ঠিক বড় বোনকে যেমন করে নিয়ে গিয়েছিল, একেও একবার একটু ছুঁয়েই ধরে নিয়ে পালালো। মেজ বোনেরও বড় বোনেরই মত কপাল। বন্ধ ঘরে কী আছে তারও এমনই জানতে ইচ্ছে হল যে আর থাকতে পারল না—সেই রক্ত-ভরা ঘরের দরজা খুলল। মায়াবী ফিরে এসে তাকে ধরে কেটে ফেললে। তারপর সে ধরে নিয়ে এল ছোট বোনকে। কিন্তু ছোট বোন ছিল চালাক চতুর। মায়াবী যখন তার হাতে চাবি আর ডিম দিয়ে চলে গেল সে করল কী, খুব সাবধানে ডিমটিকে সরিয়ে রেখে দিলে। তারপর সারা বাড়ি খুঁজে দেখল। শেষকালে নিষিদ্ধ ঘরে গিয়ে ঢুকল। সেখানে গিয়ে যা দেখল তাতে তার চক্ষুস্থির! টবের মধ্যে তার দুই দিদিই টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে। সে দিদিদের দেহের টুকরোগুলি একটি একটি করে তুলে নিয়ে মাথা, গা, হাত, পা সব যে-যার জায়গায় লাগালো। সব টুকরোগুলি লাগানো হতেই তারা আস্তে আস্তে নড়তে লাগল; তারপর জোড়া লেগে গেল একের সঙ্গে আরেক। দু-বোনই চোখ মেলে উঠে দাঁড়ালো। তখন তিন বোনের যা আনন্দ—এ ওকে জড়িয়ে আদর করতে লাগল।
মায়াবী ফিরে এসেই বললে—দেখি চাবি আর ডিম! ডিমে কোন রক্তের দাগ নেই দেখে সে বললে—পরীক্ষায় তুমি সফল হয়েছ—তুমিই আমার বৌ হবে। এই বলতেই ছোট বোনের উপর মায়াবীর সব ক্ষমতা লোপ পেল। উল্টে মেয়েটি যা বলতে লাগল তাই করতে সে বাধ্য হল।
মেয়েটি বললে—বেশ, তুমি তাহলে প্রথমে আমার বাবা-মার কাছে একঝুড়ি সোনা নিয়ে যাও। নিজের পিঠে করে নিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে আমি বিয়ের আয়োজন করছি।
দিদিদের একটি ছোট ঘরে সে লুকিয়ে রেখেছিল, সেখানে গিয়ে সে বললে—এইবার তোমাদের আমি উদ্ধার করব—তার সময় হয়েছে। হতভাগাটা নিজেই পিঠে করে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে। বাড়ি পৌঁছেই তোমরা আমাকে উদ্ধার কবার জন্যে লোক পাঠিয়ো কিন্তু। বলে দুই দিদিকে সে একটা ঝুড়ির মধ্যে পুরে সোনা দিয়ে তাদের ঢেকে দিল যাতে উপর থেকে দেখা না যায়। তারপর সে মায়াবীকে ডেকে বললে—যাও এই ঝুড়ি নিয়ে। আমি কিন্তু জানলা দিয়ে দেখব রাস্তায় তুমি জিরোচ্ছ কি না।
মায়াবী পিঠে ঝুড়ি তুলে বেরিয়ে পড়ল পথে। ঝুড়িটা এত ভারি যে তার কপাল দিয়ে ঘাম ঝরে ঝরে মুখের উপর পড়তে লাগল। সে একটু জিরোবার চেষ্টা করতেই ঝুড়ির মধ্যেকার একটি মেয়ে বলে উঠল—জানলা দিয়ে সব দেখতে পাচ্ছি! তুমি জিরোবার চেষ্টা করছ। যাও এগিয়ে শিগগিরই! একটু দাঁড়ালেই ঐ বাক্য। কাজেই তার আর জিরোনো হল না। হাঁপাতে হাঁপাতে কোঁকাতে কোঁকাতে সে সোনা-ভরা ঝুড়িতে দুই মেয়েকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দিলে। এদিকে মায়াবীর বাড়িতে ছোট বোনটি বিয়ের খাওয়ার সব আয়োজন করে ফেললে। মায়াবীর যত বন্ধু ছিল তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিল। তারপর সে একটা দাঁত-বার-করা মাথা নিয়ে তাতে গয়না পরালো, ফুলের মালা দিল; তারপর তাকে নিয়ে বাড়ির উপরতলার এক জানলায় বসিয়ে দিলে। এইসব করে সে এক পিপে মধুর মধ্যে ডুব দিয়ে নিল, তারপর ছুরি দিয়ে পালকের বিছানা কেটে তাতে গড়াগড়ি দিল। বেশ করে গড়িয়ে নিতে তার চেহারা হল হুতুম-থুমোর মতো—একেবারে চেনবার জো নেই। তারপর বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
পথে বিয়ের নেমন্তন্নিদের সঙ্গে দেখা। তারা জিজ্ঞেস করলে—
—হুতুম পাখি, হুতুম পাখি, কোথা থেকে এলে?
—দেখতে পাবে আমার বাসা একটু দূরে গেলে।
—বিয়ের কনে বল দেখি করছে এখন কী?
—উপর তলা নিচের তলা ধুচ্ছে বাড়িটি।
ঐ দেখ ঐ জানলা দিয়ে মারছে কেমন উঁকি।
শেষে পথে তার মায়াবীর সঙ্গে দেখা। আস্তে আস্তে পথ হেঁটে সে ফিরছিল। আর সবার মতো সে-ও জিজ্ঞেস করলে—
—হুতুম পাখি, হুতুম পাখি, কোথা থেকে এলে?
—দেখতে পাবে আমার বাসা একটু দূরে গেলে।
—বিয়ের কনে বল দেখি কাছে এখন কী?
—উপর তলা নিচের তলা ধুচ্ছে বাড়িটি।
ঐ দেখ ঐ জানলা দিয়ে মারছে কেমন উঁকি।
মায়াবী উপর দিকে তাকিয়ে দেখল সাজানো সেই মড়ার মাথাটা। দূর থেকে ভাবল ঐ বুঝি তার কনে। সে তার দিকে হাত নাড়ল। কিন্তু মায়াবী আর তার অতিথিরা সবাই যখন বাড়ি গিয়ে ঢুকল তখন মেয়েটির ভাইরা আর আত্মীয়েরা এসে হাজির হল সেখানে। তারা বাড়ির দরজা সব বন্ধ করে দিল যাতে কেউ না পালাতে পারে। তারপর দিল আগুন লাগিয়ে। তাইতে মায়াবী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা পুড়ে মরল।