পাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাপাতালরাজের মাথায় তিন সোনার চুল
এক ছিল গরিব মেয়ে। তার একটি ছেলে হল। তাই দেখে সবাই বললে—চোদ্দ বছর বয়সে এ রাজার মেয়েকে বিয়ে করবে। এখন হল কি, এর কিছুদিন পরেই রাজা এলেন সেই গ্রামে। কিন্তু সেখানে রাজাকে কেউ চিনত না। রাজা যখন গ্রামের লোকদের জিজ্ঞেস করলেন গ্রামের খবর কী, তারা জবাব দিলে মাথায় জড়ুল নিয়ে একটি ছেলে জন্মেছে। এমন ছেলের কপাল খুব ভাল হয়। অনেকে বলছে চোদ্দ বছর বয়স হলে সেই ছেলে রাজার মেয়েকে বিয়ে করবে।
রাজা ছিলেন নিষ্ঠুর। ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তিনি রেগে গেলেন। তিনি সেই গরিব বাপ-মার কাছে গিয়ে বন্ধুভাবে বললেন—তোমরা গরিব, ছেলে মানুষ করা তোমাদের পক্ষে শক্ত। ছেলেটিকে আমায় দাও, আমি ওকে মানুষ করব। প্রথমে তারা রাজি হল না বটে, কিন্তু যখন তিনি একথলি সোনার মোহর বার করে দেখালেন, তারা ভাবল—কপালী ছেলে, এর যা হবে সবই ভালোর জন্যে। ভেবে তারা রাজি হয়ে ছেলেটিকে দিয়ে দিলে।
রাজা একটি বাক্সের মধ্যে ছেলেটিকে শুইয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে এক গভীর নদীর ধারে এসে হাজির হলেন। নদীর জলে বাক্সটি ফেলে দিয়ে ভাবলেন—অ-চাওয়া বরের হাত থেকে আমার মেয়েকে বাঁচালুম!
বাক্সটি কিন্তু ডুবল না। নৌকোর মত ভাসতে লাগল—একফোঁটা জল ঢুকল না তার মধ্যে। রাজধানী থেকে দু-মাইল দূরে ভেসে গিয়ে উঠল এক চাকি-কলের কাছে। কলওলার এক ছোকরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। সে আঁকশি বাড়িয়ে বাক্সটাকে টেনে নিয়ে ভাবলে, মস্ত ধন-সম্পত্তি পেয়েছি। বাক্স খুলে দেখে ছোট্ট একটি ছেলে হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করছে। সে বাচ্চাটিকে নিয়ে গেল কলওলার বৌ-এর কাছে। তারা বাচ্চাটিকে দেখে খুশি হল। তাদের নিজেদের ছেলেপিলে ছিল না। তারা বললে—ভগবান একে আমাদের দিয়েছেন! সেই থেকে কুড়োনো ছেলেকে তারা নিজেদের ছেলের মতো করে মানুষ করতে লাগল। ছেলেও ক্রমে-ক্রমে বেড়ে উঠল।
একদিন হল কি, সেদিন বিষম ঝড়। ঝড়ের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রাজা চাকি-কলে এসে পৌঁছলেন। সেখানে দেখলেন, একটি লম্বা, সুন্দর মতো ছেলে। রাজা বললেন—এ ছেলেটি কি তোমাদের?
তারা বললে—না, ও কুড়িয়ে পাওয়া। চোদ্দ বছর আগে এক বাক্সের মধ্যে নদীর জলে ভেসে এসেছিল। কলের ছোকরা ওকে টেনে তুলেছিল।
রাজা বুঝলেন—এ সেই সৌভাগ্যবান ছেলে ছাড়া আর কেউ নয়। একেই তিনি ছুঁড়ে জলে ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি চাকিওলাকে বললেন—দেখ ভালমানুষের পো, রানীর কাছে আমি একটি চিঠি পাঠাতে চাই, এই ছেলেটি নিয়ে যেতে পারবে? দু-মোহর বকশিস দিচ্ছি।
চাকিওলা বললে—মহারাজের যেমন হুকুম! বলে ছেলেটিকে তৈরি হতে বললে।
রাজা রানীকে একটি চিঠি লিখলেন। তাতে লিখলেন—এ ছেলেটি চিঠি নিয়ে পৌঁছলেই একে মেরে পুঁতে ফেলবে। আমি ফেরার আগেই যেন কাজ সারা হয়।
ছেলেটি চিঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল; কিন্তু কিছুদূর গিয়ে তার পথ হারিয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা গিয়ে পৌঁছল প্রকাণ্ড এক বনে। অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেল একটি ছোট্ট আলো। সেইদিকে এগিয়ে গিয়ে পৌঁছল এক কুটিরের কাছে। কুটিরে ঢুকে দেখল—আগুনের ধারে এক বুড়ি একা বসে আছে। ছেলেটিকে দেখে সে চমকে উঠে বললে—কোথা থেকে আসছ তুমি? কোথায় যাবে? ছেলেটি বললে—চাকি-কল থেকে আসছি আমি, রানীর কাছে যাব এই চিঠি নিয়ে। কিন্তু আমার পথ হারিয়ে গেছে, তাই আজকের রাতটা এখানে থাকতে চাই।
বুড়ি বলল—আহা রে! তুমি কি সোজা জায়গায় এসেছ বাছা! তুমি এসেছ ডাকাতের আড্ডায়! ডাকাতরা ফিরলে তোমায় কি আস্ত রাখবে?
ছেলেটি বললে—আসুক তারা। আমার ভয় নেই। কিন্তু আমি এত ক্লান্ত যে আর এক পাও চলতে পারছি না। বলে একটা বেঞ্চিতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়েই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
একটু পরেই ডাকাতরা এল। এসে রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলে—ছেলেটা শুয়ে আছে, কে? বুড়ি বললে—আহা, বেচারা বনে পথ হারিয়ে ফেলেছে। আমার মায়া করল বলে ওকে ঢুকতে দিয়েছি। ও রানীর কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাচ্ছে।
ডাকাতরা চিঠিটা খুলে পড়ল। দেখল তাতে লেখা আছে, ছেলেটা পৌঁছলেই তাকে মেরে ফেলা হবে। পাষাণ-হৃদয় ডাকাতদের মন গলে গেল। ডাকাতদের সর্দার চিঠিটা ছিঁড়ে আরেকটা লিখলে। তাতে লিখল—ছেলেটি পৌঁছলেই রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিতে।
ছেলেটি সকাল অবধি বেঞ্চিতে পড়ে ঘুমোলো। উঠলে ডাকাতরা তার হাতে চিঠি দিয়ে তাকে রাজবাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিল।
রানী চিঠি পেয়ে চিঠি পড়ে রাজা যেমন চেয়েছিলেন তাই করলেন। বিয়ের মস্ত ভোজের আয়োজন করলেন। রাজার মেয়ের সঙ্গে কপালী ছেলের বিয়ে হয়ে গেল।
কিছুদিন পরে রাজা ফিরলেন তাঁর প্রাসাদে। ফিরে দেখলেন, বহুকালের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়েছে। কপালী ছেলের সঙ্গেই তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তিনি বললেন—কেমন করে হল? আমি তো চিঠিতে অন্য রকম হুকুম দিয়েছিলুম!
রানী তাঁকে চিঠি দেখালেন। বললেন—নিজেই দেখুন মহারাজ, কী লিখেছেন! রাজা চিঠি পড়ে বুঝলেন তাঁর চিঠি বদলে দিয়েছে কেউ। ছেলেটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর প্রথম চিঠির কি হল? কেনই বা সে চিঠি বদল করল?
কিন্তু ছেলেটি বললে—আমি কিছুই জানি না। নিশ্চয় তাহলে রাত্রে বনের মধ্যে যেখানে আমি ঘুমোচ্ছিলুম কেউ বদলে দিয়েছে।
রাজা রেগে উঠে বললেন—তুমি যা চাও তাই পাবে, এমন ভেবো না। আমার কন্যাকে যে বিয়ে করবে তাকে পাতাল-রাজের মাথা থেকে তিনটি সোনার চুল তুলে এনে দিতে হবে। যা চাইছি নিয়ে এস, তবেই তুমি আমার মেয়েকে পাবে।
রাজা ভাবলেন এইভাবেই তিনি কপালী ছেলেকে চিরকালের মতো দূর করে দেবেন। কিন্তু সে বললে রাজাকে—সোনার চুল আমি নিয়ে আসব। পাতাল রাজাকে আমার ভয় নেই। বলে বিদায় নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল পথে।
যেতে যেতে সে পৌঁছল গিয়ে এক বড় শহরে। শহরের ফটকে ছিল প্রহরী; সে জিজ্ঞেস করল—তোমার পেশা কী? তুমি কি জান? ছেলেটি বললে—আমি সব জানি। প্রহরী বললে—তবে আমাদের একটা উপকার করতে হবে। আমাদের হাটতলার ঝরনায় সবসময় সরাব বইত। এখন শুকিয়ে গিয়ে তাতে জলও বয় না। কেন এটা হল বলতে পার? ছেলেটি বললে—আগে আমাকে ফিরতে দাও। তারপর জবাব পাবে।
তারপর সে আরও কিছুদূরে গিয়ে আর এক শহরে এসে হাজির হল। সেখানকার দ্বাররক্ষীও জিজ্ঞেস করলে, কী তার পেশা? কি সে জানে? ছেলেটি বললে—আমি সব জানি। দ্বাররক্ষী বললে—তবে, আমাদের একটি উপকার করতে হবে। আমাদের শহরে এক গাছ আছে তাতে সব সময় সোনার আপেল ফলত। এখন তাতে পাতাও হয় না। কেন এমন হল বলতে পারো? ছেলেটি বললে—আগে আমি ফিরে আসি, তারপর জবাব পাবে।
তারপর চলতে চলতে সে এক মস্ত চওড়া নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল। মাঝি তাকে জিজ্ঞেস করলে, কী তার পেশা? কী সে জানে? ছেলেটি বললে—আমি সব জানি। মাঝি বললে—তবে আমার একটা উপকার করবে? কেন আমি চিরকাল যাত্রী নিয়ে এপার ওপার করছি কিন্তু কিছুতেই ছুটি পাচ্ছি না, বলতে পারো? ছেলেটি বললে—আমি আগে ফিরে আসি, তারপর তোমায় বলব। ততক্ষণ অপেক্ষা কর।
নদী পার হয়েই সে দেখল পাতালপুরীর দরজা। ভিতরটা ভুষো কালির মতো কালো। পাতাল-রাজ বাড়ি ছিলেন না, কিন্তু তাঁর ঠাকুমা বড় এক আরাম-কেদারায় বসে ছিলেন। ঠাকুমা বললেন—কী চাও তুমি? ঠাকুমাকে দেখে তার খারাপ লোক বলে মনে হল না। ছেলেটি বললে—আমি পাতাল-রাজের মাথা থেকে তিনটি সোনার চুল নিতে এসেছি। না পেলে আমার বৌকে আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবে। বুড়ি বললে—তুমি তো বড় সহজ জিনিস চাইছ না ছোকরা? পাতাল-রাজ ফিরে এসে তোমায় যদি দেখেন, তোমার প্রাণ নেবেন—জানো? তবে, তোমায় দেখে আমার মায়া হচ্ছে। দেখি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি কি না।
বুড়ি তাকে পিঁপড়ে করে দিল। বললে—আমার কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে লুকিয়ে থাক। ঐখানেই তুমি নিরাপদে থাকবে। ছেলেটি বললে—তা না হয় হল। কিন্তু আমার এ ছাড়া তিনটে প্রশ্ন আছে, তার জবাব নিয়ে যেতে হবে। আমি জানতে চাই, একসময় এক ঝরনা দিয়ে সরাব বইত, এখন কেন সেটা শুকিয়ে গেছে? জানতে চাই, এক গাছে একসময় সোনার আপেল হত, এখন তাতে পাতাও কেন হয় না? আর জানতে চাই, একজন মাঝিকে কেন সব সময় নৌকো নিয়ে এপার ওপার হতে হয়, কেন সে ছুটি পায় না?
বুড়ি বললে—এসব বড় কঠিন প্রশ্ন। যাই হোক এখন চুপ করে থাকো। আমি যখন নাতির মাথা থেকে তিনটে সোনার চুল ছিঁড়ব সেই সময় নাতি কী বলে ভাল করে শুনো।
সন্ধে হতে পাতাল-রাজ বাড়ি ফিরলেন। ভিতরে ঢুকেই তিনি লক্ষ করলেন, বাতাস অপবিত্র হয়েছে। তিনি বললেন—মানুষের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি, কিছু একটা গোল হয়েছে এখানে! বলে মাথা নিচু করে এ-কোণ ও-কোণ খুঁজতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেলেন না। ঠাকুমা বকতে লাগলেন। বললেন—এখনি সব ঝাঁট দিয়েছি, গোছ-গাছ করে রেখেছি, আর তুমি সব উল্টোপাল্টা করছ! সব সময় তোমার নাকে মানুষের গন্ধ লেগে আছে! বস এখন খেতে!
খাওয়া-দাওয়া সেরে পাতালরাজের ঘুম পেয়ে গেল। তিনি ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ফোঁ-ফোঁ করে নাক ডাকতে লাগল। বুড়ি তখন একটি সোনার চুল দু-আঙুলে টিপে ধরে পটাং করে মাথা থেকে ছিঁড়ে নিলে।
পাতালরাজ বলে উঠলেন—ওঃ, করছ কী ঠাকুমা? ঠাকুমা বললেন, আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে তোমার চুল চেপে ধরেছিলুম। পাতালরাজ বললেন—কী স্বপ্ন দেখেছ? —স্বপ্ন দেখলুম এক হাটতলায় এক ঝরনা। তার থেকে সরাব বেরোতো; এখন আর জলও বেরোচ্ছে না। একেবারে শুকিয়ে গেছে। এর কারণ কী? পাতালরাজ বললেন—ওহো, ওরা জানে না তাই। ঝরনার নিচে যেখানে ফোকর, সেইখানেই পাথরের তলায় এক কোলা ব্যাঙ বাসা বেঁধেছে। ব্যাঙকে মেরে ফেললেই আবার সরাব ঝরবে।
বলেই পাতালরাজ আবার ঘুমিয়ে পড়ে নাক ডাকাতে লাগলেন। তাঁর নাসিকা-গর্জনে জানলাগুলো পর্যন্ত কাঁপতে লাগল। বুড়ি তখন আরেকটি সোনার চুল ছিঁড়ে নিলে। পাতালরাজ রেগে উঠে বললেন—কী করছ কী? ঠাকুমা বললেন—কিছু মনে করিস নে বাবা, স্বপ্ন দেখতে দেখতে তোর চুল টেনে ফেলেছি। পাতালরাজ বললেন—আবার কী স্বপ্ন দেখলে? ঠাকুমা বললেন—স্বপ্ন দেখলুম, এক রাজ্যে এক আপেল গাছ ছিল, তাতে একসময় সোনার আপেল ফলত। কিন্তু এখন তাতে পাতাও হয় না। এর কারণ কী? পাতালরাজ বললেন—ওঃ ওরা যদি জানত! এক ইঁদুর ঢুকে গাছের শিকড় কাটছে। ইঁদুরটাকে মেরে ফেললেই আবার সোনার আপেল হবে। তবে, খুব বেশিদিন দেরি করলে আবার গাছ শুকিয়ে মরে যাবে। যাই হোক তোমার স্বপ্ন নিয়ে আর আমায় বিরক্ত কোরো না! আবার যদি আমার ঘুম ভাঙাও তো মারব ঘুষি!
ঠাকুমা নাতিকে আবার ঘুম পাড়ালেন। আবার তাঁর নাক ডাকতে লাগল। তখন তিনি আবার একটি সোনার চুল ধরে পটাং করে ছিঁড়ে নিলেন। পাতালরাজ লাফিয়ে উঠে গর্জন করতে লাগলেন। সত্যিই হয়ত ঠাকুমাকে ধরে মার দিতেন, কিন্তু ঠাকুমা বলে-কয়ে তাকে শান্ত করলেন। বললেন—খারাপ স্বপ্ন এলে কি তাকে আটকানো যায়? পাতালরাজের আবার ঔৎসুক্য হল। বললেন—কী স্বপ্ন?—স্বপ্ন দেখলুম, এক মাঝিকে কেবলই এপার থেকে ওপারে নৌকো নিয়ে যেতে হচ্ছে। যতই অনুযোগ করুক না কেন, তার কাজ আর শেষ হচ্ছে না, সে-ও ছুটি পাচ্ছে না। এর কারণ কী? পাতালরাজ বললেন—ওটা একটা গাধা! যখন কেউ খেয়া পার হতে চাইবে তখন যাত্রীর হাতে দাঁড়টা তুলে দিলেই তো হল! তাহলেই ওর ছুটি। ঠাকুমার তিনটি চুল তোলা হয়ে গিয়েছিল, তিনটি প্রশ্নেরও জবাব পেয়েছিলেন। কাজেই পাতালরাজকে আর বিরক্ত না করে তাকে তিনি সকাল অবধি ঘুমোতে দিলেন।
পাতালরাজ যখন বেরিয়ে গেলেন, ঠাকুমা তাঁর কাপড়ের ফাঁক থেকে পিঁপড়েকে বার করে তাকে আবার মনুষ্য-মূর্তি দিলেন। বললেন—এই নাও তোমার তিনটি সোনার চুল। পাতাল-রাজ যা বলেছেন তা নিজের কানেই শুনেছ তো? ছেলেটি বললে—শুনেছি। মনেও রাখব। ঠাকুমা বললেন—যা চেয়েছিলে পেলে। এবার ঘরে যাও। ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে চলল।
নদীর ধারে মাঝির কাছে এসে যখন সে পৌঁছল, তখন মাঝিকে তার জবাব দেবার কথা। কিন্তু সে বললে—আগে আমায় পার করে দাও; তারপর বলে দেব কেমন করে তুমি ছুটি পাবে। ওপারে পৌঁছে সে বললে—এরপর যে পার হতে আসবে তার হাতে দাঁড় তুলে দিও, তাহলেই তোমার ছুটি।
ফিরতে ফিরতে যে শহরে গাছে ফল হচ্ছিল না, সেই শহরে এসে ছেলেটি পৌঁছল। দ্বাররক্ষী বললে—জবাব এনেছ ভাই? ছেলে বললে—গাছের শিকড় খাচ্ছে এক ইঁদুর। তাকে মেরে ফেল, তাহলেই সোনার আপেল ফলবে। দ্বাররক্ষী তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দু-গাধা বোঝাই করা সোনা দিলে। ছেলেটি গাধা নিয়ে চলল।
শেষে ঝরনা শুকিয়ে গেছে যে শহরে সেইখানে এসে সে পৌঁছল। প্রহরীকে বললে—ঝরনার নিচে পাথরের তলায় এক ব্যাঙ বসে আছে। তাকে ধরে মেরে ফেল, তাহলেই ঝরনা থেকে যত সরাব চাও, বেরোবে। প্রহরী তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরো দু-গাধা বোঝাই সোনা দিল।
তারপর ছেলেটি ফিরে এল তার স্ত্রীর কাছে। তাকে দেখে আর যা-যা হয়েছে শুনে খুব খুশি হল। রাজা যা চেয়েছেন, পাতালরাজের তিনটি চুল, তাই নিয়ে সে গেল রাজার কাছে। রাজা যখন দেখলেন এ ছাড়া সে চার গাধা বোঝাই সোনা এনেছে, তিনি খুব খুশি হলেন। বললেন—সব শর্তই তুমি পূরণ করেছ। আমার মেয়ে এখন তোমার। কিন্তু বল তো জামাই-বাবাজী, এত সোনা তুমি কোথায় পেলে? এ যে সাত রাজার ধন। ছেলেটি বললে—এক নদী পার হয়ে গিয়েছিলুম আমি। তারই ওপারে বালির বদলে ছিল সোনা। রাজা বললেন—আমি গেলে আমিও পাব? ছেলেটি বললে—যত চান তত পাবেন। নদীর ধারে একজন মাঝি আছে, তাকে বলবেন ওপারে নিয়ে যেতে। ওপারে গিয়ে বস্তা-বোঝাই করে সোনা নেবেন।
লোভী রাজা তখনই বেরিয়ে পড়লেন। নদীর কাছে এসে মাঝিকে ডাকলেন নদী পার করে দিতে। মাঝি তাঁকে নিয়ে খেয়ায় উঠল। তারপর যখন ওপারের কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন রাজার হাতে দাঁড় দিয়ে মাঝি লাফিয়ে নেমে পড়ল। সেই থেকে রাজা নিজের পাপের ফলে খেয়া বাইতে লাগলেন। এখনও কি তিনি বাইছেন? হ্যাঁ, যদি আর কেউ তাঁর হাত থেকে দাঁড় না নিয়ে থাকে তাহলে এখনও।