চাকিওলার চাকর আর তার বেড়াল
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাপুরোনো এক চাকি-কলে থাকত এক চাকিওলা। তার স্ত্রীও ছিল না, ছেলেপিলেও ছিল না। তিন ছোকরা ছিল তার সহকারী। তারাই তার বাড়ির কাজ, কলের কাজ সব করত। ছোকরারা কয়েক বছর তার সঙ্গে কাজ করবার পর চাকিওলা তাদের ডেকে একদিন বললে—আমি বুড়ো হচ্ছি। শিগগিরই দেখবে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে আমায় চুল্লির পাশে সময় কাটাতে হচ্ছে। বলি শোন—তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে ভালো একটি ঘোড়া নিয়ে এসে আমায় দিতে পারবে তাকেই আমি চাকি-কলটি দিয়ে দেব। তার বদলে আমি যতদিন বেঁচে থাকি আমাকে শুধু খোরপোষ দিলেই চলবে।
সবচেয়ে ছোট যে সহকারী সে ছিল নেহাত বালক। আর দু-জন ভাবত, ওটা একেবারে বোকা। তাদের হিংসে হল, এই বোকা বালকটাই শেষে চাকি-কলটা না পেয়ে যায়। তারা ভাবলে একে কোনরকমে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। যাই হোক তিনজনে বেরোলো একসঙ্গে ঘোড়া খুঁজতে। কিন্তু শহরের বাইরে পৌঁছতেই বড় দু-জন ছোটটিকে বললে—বোকা হান্স, তুই বরং এখানেই থাক্। সারা জীবন ধরে খুঁজলেও তুই কখনই একটা ঘোড়া বার করতে পারবি না।
কিন্তু হান্স তাদের সঙ্গ ছাড়ল না, চলল। যখন রাতের অন্ধকার নেমে এল তারা এসে পৌঁছল এক গুহার কাছে। তারপর গুহার মধ্যে শুয়ে তিনজনে ঘুমিয়ে পড়ল। বড় দু-জন করল কি, যখন দেখল হান্স ঘুমিয়ে পড়েছে, আস্তে আস্তে উঠে পড়ে যত জোরে পারলে ছুট দিলে। হান্স পড়ে রইল একা।
ভোর বেলা হান্সের ঘুম ভাঙল। সে দেখলে সে একটি গভীর গর্তের মধ্যে শুয়ে আছে। চারিদিকে চোখ মেলে দেখলে, কাছেপিঠে কেউ নেই। সে বলে উঠল—আরে! কোথায় আমি?
তারপর গর্ত থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে ভাবতে লাগল—বনের মধ্যে ওরা আমায় একা ফেলে চলে গেল, এখন কী করে আমি ঘোড়া খুঁজে পাই?
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে হান্স যখন হাঁটছিল সেই সময় ছোট একটি ডোরাকাটা বেড়াল তার কাছে এসে খুব মিষ্টি করে বললে—হান্স, তোমার কোন উপকার করতে পারি?
হান্স বললে—তুমি ছোট্ট বেড়াল আমার কী উপকার করবে?
বেড়াল বললে—কী তুমি খুঁজছ আমি জানি। সুন্দর একটি ঘোড়া খুঁজছ। এস তাহলে আমার সঙ্গে। তুমি হবে আমার বীর, সাত বছরের মতো। সাত বছর পরে আমি তোমায় এমন একটি ঘোড়া দেব যার চেয়ে সুন্দর ঘোড়া পৃথিবীতে কোথাও নেই।
হান্স ভাবল—এ তো চমৎকার বেড়াল! যাই হোক, দেখা যাক এ যা বলছে তা সত্যি কি না।
বেড়াল হান্সকে নিয়ে এক জাদু-করা প্রাসাদের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। সেখানে চাকর-বাকর সবই বেড়াল। হান্সের পায়ে-পায়ে তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।
সন্ধ্যাবেলা বেড়াল-কর্ত্রী আর হান্স যখন খেতে বসল, তিনটি বেড়াল এল বাজনা বাজাতে। একটি বাজালো বেহালা আর একটি বাঁশি, আর তিনেরটি গাল ফুলিয়ে শিঙেয় ফুঁ দিতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে অন্য বেড়ালেরা এসে টেবিল পরিষ্কার করে দিয়ে গেল।
কর্ত্রী বেড়াল বললে—এস হান্স, একবার নাচ হবে। তুমি কি আমার সঙ্গে নাচবে?
হান্স বললে—না, আমি পুসি মেনির সঙ্গে নাচতে পারব না। কখনও নাচিনি।
বেড়াল বললে—বেশ তো তাতে আর কী? তুমি তাহলে যাও ঘুমোও গিয়ে।
অন্য বেড়ালেরা এসে হান্সকে শোবার ঘরে নিয়ে গেল। একজন তার পা থেকে জুতো খুলে দিলে, আরেকজন মোজা। তারপর যেই সে বিছানার মধ্যে সেঁধোলো অমনি ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে তারা চলে গেল। হান্সকে ঘুম থেকে ওঠালো, বিছানা থেকে তুললো। একজন তার পায়ে মোজা পরিয়ে দিল, আরেক জন তার মুখ ধুয়ে দিল, আরেক জন ল্যাজ দিয়ে মুছিয়ে দিল তার মুখ।
হান্স বললে—তোয়ালেটা ভারি নরম। বলে সকালের খাবার খেতে চলে গেল।
বেড়ালেরা রোজ কাঠ কাটত টুকরো করে। এর জন্যে তাদের ছিল রূপোর কুড়ুল, রূপোর গোঁজ আর সোনার ছোরা। প্রথম-প্রথম হান্সের কোন কাজ ছিল না। সে বাড়িতেই থাকত, ভাল-ভাল খাবার খেত। তার সঙ্গী ছিল শুধু ডোরাকাটা বেড়াল আর তার অনুচরেরা।
শেষে একদিন বেড়াল এসে হান্সকে বললে—তোমায় কাজ দিচ্ছি। যাও আমার মাঠে। সেখানে গিয়ে ঘাস কেটে বিচালি তৈরি কর। এই নাও রূপোর কাস্তে আর সোনার শান-পাথর। দেখো যে এগুলি হারিও না!
হান্স চলে গেল ঘাস কাটতে। ঘাস কাটা শেষ করে, বেড়াল যেমন বলেছিল, বিচালি নিয়ে কাস্তে আর শান-পাথর হাতে করে বাড়ি ফিরল। বললে—এইবার আমি কি আমার পুরস্কার পাব?
বেড়াল বললে—না, আরও কাজ আছে। বাইরে গিয়ে দেখবে কাঠ আছে, ছুতোরের সবরকম যন্ত্র আছে—সব রূপোর তৈরি, বাড়ি তৈরি করবার সবরকম মালমশলা আছে। আমার জন্যে একটি বাড়ি তৈরি করে দাও।
হান্স কাজ আরম্ভ করে দিলে। বাড়ি তৈরি করা শেষ করে সে বেড়ালের কাছে গিয়ে বললে—তুমি যা যা বলেছ সব আমি করে দিয়েছি। কিন্তু এখনও ঘোড়া পাইনি।
ইতিমধ্যে সাত বছর কেটে গেল। কাজেই বেড়াল হান্সকে জিজ্ঞেস করলে—ঘোড়া দেখতে চাও?
হান্স বললে—দেখব বই কি।
বেড়াল তখন হান্সকে নিয়ে গেল এক দরজার কাছে। দরজা খুলতেই দেখা গেল ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বারোখানি ঘোড়া। যেমন গর্বিত তাদের চেহারা তেমনি তেজী। গা তাদের আয়নার মতো চক্চক্ করছে। হান্সের মন আনন্দে নেচে উঠল।
ঘোড়া দেখার পর বেড়াল তাকে প্রাসাদে নিয়ে গেল। তাকে ভাল করে খাওয়ালো। খাইয়ে বললে—এখনও তোমায় আমি ঘোড়া দিচ্ছি না। বাড়ি যাও এখন। তিন দিন পরে আমি নিজে নিয়ে আসব তোমার কাছে।
এই বলে বেড়াল তাকে বিদায় দিল। বেড়াল নিজে এগিয়ে এসে পথ দেখিয়ে দিল কোন্ দিক দিয়ে গেলে চাকিওলার বাড়ি পড়বে।
যতদিন হান্স বেড়ালের বাড়িতে ছিল, বেড়াল তাকে একটিও নতুন কাপড় দেয়নি। সঙ্গে যে পোশাক এনেছিল তাই পরেই তাকে থাকতে হত সর্বক্ষণ। তার গায়ে ছিল এক খাটো কোট, পরতে পরতে সেটা শতচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। হান্স বাড়ি পৌঁছে দেখল, অন্য দু-জন ছোকরা ঘোড়া নিয়ে ফিরে এসেছে আগেই। ঘোড়াদুটি দেখতে সুস্থ সবল হলেও একটি ছিল খোঁড়া অন্যটি কানা।
তারা হান্সকে দেখে বললে—কই হান্স, তোমার ঘোড়া কোথায়?
সে জবাব দিলে—তিন দিন পরে এসে পৌঁছবে।
অন্য দু-জন হাসতে হাসতে বললে—পৌঁছবে তো বটেই। এখান দিয়ে অনেক ঘোড়া যায়, তার মধ্যে থেকে একটা ভাল দেখে ধরে নিয়ো।
হান্স কোন জবাব না দিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল। চাকিওলা তাকে দেখে বলে উঠল—এইরকম ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরে তুমি আমাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসবে না। এখানে যদি এখন কেউ আসেন, তুমি থাকলে আমাদেরই লজ্জা করবে। বলে তার হাতে একপাত্র খাবার দিয়ে বললে—যাও বাইরে গিয়ে খাওগে।
রাত্রিবেলায় অন্য দু-জন সহকারী হান্সকে তাদের সঙ্গে শুতে দিল না। কাজেই হান্স বেচারা বেরিয়ে গিয়ে মুরগির ঘরে খড়ের উপর শুয়ে রইল।
তিন দিনের দিন সকালে সকলে ঘুম থেকে ওঠবার একটু পরেই ছ-ঘোড়ার এক জমকালো গাড়ি তাদের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘোড়াগুলি যেমন সুন্দর তেমনি চটপটে। হান্স প্রাসানে যেমন দেখেছিল ঠিক তেমনি। ঘোড়ার সাজ রোদে চকচক করছে। গাড়ির সঙ্গে অনেক চাকর-বার, অনুচর। তাঁদের মধ্যে একজন লাগাম ধরে একটি অপূর্ব ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এল। এইটিই হান্সের ঘোড়া।
গাড়ি থামতেই এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা গাড়ি থেকে নামলেন। হান্স যে ডোরাকাটা বেড়ালের সঙ্গে সাত বছর থেকে তাকে জাদুবন্ধন থেকে উদ্ধার করেছিল ইনি সেই। রাজকন্যা চাকি-কলে ঢুকে কলওলাকে জিজ্ঞেস করলেন—আপনার সবচেয়ে ছোট সহকারীটি কোথায়?
চাকিওলা বললে—তাকে এখন কল-বাড়িতে আসতে দিতে পারব না। তার পোশাক পরিচ্ছদ ছিঁড়ে-খুঁড়ে গেছে। সে বাইরে মুরগি-ঘরে।
রাজকন্যা বললেন—বেশ, তাহলে আমিই তাকে নিয়ে আসছি। তাঁর চাকরদের ডাকলেন। চাকরেরা হাতে জমকালো পোশাক নিয়ে রাজকন্যার পিছনে পিছনে চলল। রাজকন্যা মুরগির ঘরের কাছে এসে চাকরদের বললেন—তোমরা এই পোশাক নিয়ে হান্সকে গিয়ে বল সে যেন তার ময়লা ছেঁড়া কাপড় ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে এই নতুন পোশাক পরে।
হান্স নতুন পোশাক পরতে তাকে দেখতে রাজপুত্রের চেয়েও সুন্দর হল।
ইতিমধ্যে রাজকন্যা চাকি-কলে ফিরে গিয়ে বললেন—অন্য দু-জন সহকারী যে ঘোড়া এনেছে দেখি?
দেখলেন একটি কানা, একটি খোঁড়া।
তিনি তখন চাকরদের হুকুম দিলেন হান্সের ঘোড়া নিয়ে আসতে। উঠোনে ঘোড়া আসতে চাকিওলা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। রাজকন্যা বললেন—এই ঘোড়াটি আপনার ছোট সহকারীর জন্যে।
চাকিওলা বললে—তাহলে সে-ই চাকি-কল পাবে।
রাজকন্যা বললেন—না, তার দরকার হবে না। আপনি কল এবং ঘোড়া দুই-ই রাখতে পারেন।
হান্স সেই সময় ঝলমলে পোশাক পরে হাজির হতে রাজকন্যা তাতে তাঁর গাড়িতে বসিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।
প্রথমে তাঁরা গেলেন হান্স রূপোর যন্ত্র দিয়ে যে ছোট্ট বাড়িটি করেছিল তার কাছে! সে বাড়ি এখন প্রকাণ্ড প্রাসাদ হয়ে সোনায় রূপোয় ঝলমল করছে। তারপর তাদের বিয়ে হল। হান্স এত বড় লোক হয়ে গেল যে তার আর কোন অভাব রইল না।