সাত-সাবাড়ে দর্জির গল্প
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাসাত-সাবাড়েস দর্জির গল্প
একদিন এক গ্রীষ্মের সকালে এক দর্জি তার জানলার ধারে বেঞ্চির উপর বসে সেলাইয়ের কাজ করছে, সেই সময় এক বুড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল।
বুড়ি চেঁচাচ্ছিল—ভাল জেলি বিক্রি! ভাল জেলি বিক্রি!
চিৎকার শুনে দর্জির মনটা বেশ খুশি হল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকল—ও ভালমানুষের ঝি! কিছু বেচবে তো এদিকে এস।
গরিব বুড়ি তার ভারি বোঝা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে দর্জির সামনে তার শিশিগুলি মেলে ধরল। দর্জি একের পর এক প্রত্যেকটা শিশি দেখল, ঢাকা খুলল, নাকের কাছে এনে শুঁকল।
তারপর সে বললে—জেলি দেখে মনে হচ্ছে ভালই। বেশ, তাহলে এক তোলা করে চার রকম জেলি চার তোলা দাও! আচ্ছা দাঁড়াও, সবসুদ্ধ বরং আধ পোয়াই দিও।
বুড়ি ভেবেছিল কত বড়ই না একজন খদ্দের! যাই হোক, দর্জি যা চেয়েছিল তাই দিয়ে গজর-গজর করতে করতে সে চলে গেল।
দর্জি বললে—জেলিই চাইলুম এতক্ষণ আমি। জেলি খেলে গায়ে জোরও যেমন হয়, বুদ্ধিও তেমনি বাড়ে! বসে আলমারি থেকে রুটি বার করে বড় এক টুকরো কেটে নিয়ে তাতে জেলি মাখিয়ে পাশে রাখল। তারপর যেমন সেলাইয়ের ফোঁড় দিচ্ছিল দিয়ে চলল। ইতিমধ্যে জেলির মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। ঘরে ছিল একঝাঁক মাছি। তারা সেই গন্ধে উড়ে এল জেলি খাবার লোভে।
দর্জি বললে—কে তোমাদের ডেকেছে এখানে? বলে রবাহূত অতিথিদের তাড়িয়ে দিলে। কিন্তু মাছিরা দর্জির ভাষা বুঝল না, তারা পালালো না তো বটেই, বরং আরো বড় দল বেঁধে ফিরে এল। তখন দর্জি আর সহ্য করতে না পেরে চুল্লির উপর থেকে একটা ছেঁড়া ঝাড়ন টেনে নিলে।
—এইবার দেখ্ মজা! এই বলে সেই ঝাড়ন ঘুরিয়ে মাছিদের পেটাতে লাগল। নির্দয়ভাবে পেটাতে লাগল। হত্যাকাণ্ড শেষ হলে সে গুনে দেখল, সাতটি মাছি পড়ে রয়েছে।
নিজের বীরত্বে নিজেই অবাক হয়ে দর্জি বললে—এ বড় কম কথা নয়! সারা শহরকে এ খবর জানাতে হবে!
কাজেই সে বেশ বড় দেখে একটা কোমর-বন্ধ কেটে ফেলল। সেটাকে সেলাই করে তার উপরে বড়-বড় অক্ষরে লিখে দিল—‘এক ঘায়ে সাতটা সাবাড়।’
দর্জি বললে—শহর বললুম? শহর কী, সারা পৃথিবী জানবে এই কথা! বলে আনন্দে তার বুক কাঁপতে থাকল।
দর্জি কোমরে কোমরবন্ধটা জড়িয়ে ভাবল, এবার দুনিয়া ঘুরতে বেরোই, কারণ তার বীরত্বের পক্ষে ছোট্ট কারখানাটি যেন বড়ই ছোট। সারা বাড়িতে খুঁজে দেখল সঙ্গে করে দরকারি কি কি নিয়ে যাওয়া যায়; কিন্তু সব খুঁজে পেল শুধু একটু পুরোনো পনির। সেটাই সে পকেটে পুরে নিল। দরজা থেকে বেরিয়ে দেখল, ঝোপের মধ্যে একটা পাখি আটকা, সেটাকে ধরে সে তার পকেটে চীজের সঙ্গে রেখে দিলে। তারপর বীরদর্পে বেরিয়ে পড়ল।
পথ গিয়ে উঠল এক পাহাড়ে। যখন সে পাহাড়ের চুড়োয় গিয়ে পৌঁছল, দেখল সেখানে এক ভীষণাকার দৈত্য বসে।
দর্জি নির্ভয়ে তার কাছে গিয়ে তাকে ডেকে বললে—শুভদিন, বন্ধু! ওখানে বসে বসে তুমি শুধু দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখছ! আমি চলেছি আমার ভাগ্য অন্বেষণে। তুমি আসবে নাকি আমার সঙ্গে?
দৈত্য দর্জির দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে বললে—দূর, তুই তো একটা হা-ঘরে, টিংটিংয়ে জন্তু!
দর্জি বললে—তা হতে পারে। বলে তার কোট খুলে তার কোমরবন্ধটা দৈত্যকে দেখালো। বললে—পড়ে দেখ এবার আমি কী!
দৈত্য পড়ে দেখল—এক ঘায়ে সাতটা সাবাড়! দৈত্য ভাবলে দর্জি একসঙ্গে সাতটা মানুষ মেরেছে। কাজেই তার খানিকটা ভক্তি হল; কিন্তু মনে মনে ভাবলে, একে বাজিয়ে দেখতে হবে। সে একটা পাথর তুলে নিয়ে দু-হাতে সেটাকে এমন জোরে পিষল যে তার থেকে জল বেরোতে লাগল।
দৈত্য বললে—এটা করতে পার? এত জোর আছে তোমার গায়ে?
দর্জি বললে—ও তো ছেলে-খেলা! বলে সে তার পকেট থেকে পনিরের টুকরোটা বার করে দু-হাতের মধ্যে ফেলে তার থেকে ঘোল বার করে দিলে।
দর্জি বললে—এবার?
দৈত্য সত্যিই ভেবে পেল না কী বলবে। সে বিশ্বাসই করতে পারেনি ঐটুকু একটা মানুষ ওটা করতে পারবে। তখন দৈত্য একটা পাথর তুলে নিয়ে এমন জোরে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল যে দৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে গেল সেটা।
—এবার কর দেখি ভায়া ওটা, দেখি!
দর্জি বললে—ভালই ছুঁড়েছ। কিন্তু পাথরটা পৃথিবীতে এসে পড়েছে। আমি একটা ছুঁড়ব যা কোনদিনই আর ফিরে আসবে না। বলে সে তার পকেট থেকে পাখিটা বার করে আকাশে ছুঁড়ে দিলে। পাখিও যখন দেখল ছাড়া পেয়েছে, সে ডানা মেলে সেই যে উড়ে গেল, আর ফিরে এল না।
দর্জি বললে—ওটা কেমন লাগল বন্ধু?
দৈত্য বললে—ছুঁড়তে তুমি পার বটে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবার দেখা যাক তুমি বইতে পার কেমন।
দর্জিকে নিয়ে দৈত্য গেল এক জায়গায়, সেখানে প্রকাণ্ড এক ওক গাছ মাটিতে পড়ে ছিল। দৈত্য বললে—তোমার গায়ে যদি জোর থাকে, এস আমার সঙ্গে, এটাকে ঘাড়ে করে জঙ্গলের বাইরে নিয়ে চল।
দর্জি বললে—নিশ্চয়ই! তুমি গুঁড়ির দিকটা কাঁধে নাও, আর আমি এই যেদিকটা চওড়া বেশি সে দিকটা কাঁধে নিচ্ছি।
দৈত্য গুঁড়িটা নিজের কাঁধে চড়ালো আর দর্জি গিয়ে বসল পিছনদিকের এক ডালে। দৈত্য সামনে ছিল বলে দেখতে পেল না দর্জি কী করছে। সে সমস্ত গাছটা আর তার সঙ্গে দর্জিকেও বয়ে নিয়ে চলল। দর্জি শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে চলল, যেন কত সহজে একটা ভারি বোঝা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বোঝাটাকে আধ পথ নিয়ে দৈত্য যখন আর পারে না সে ক্লান্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল—আমি ছেড়ে দিচ্ছি!
দর্জি ডাল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল। তারপর দু-হাতে গাছটাকে জড়িয়ে ধরে, যেন কতই বইছে এই ভাব দেখিয়ে বললে—দেখছ তো, এত বড় হয়েও তুমি একটা গাছ বইতে পারো না!
দু-জনে মিলে তখন কিছুদূরে গিয়ে এক চেরি গাছের কাছে এসে হাজির হল। গাছের সবচেয়ে উপরের ডালে ছিল সবচেয়ে পাকা চেরি। দৈত্য সেই ডাল ধরে নুইয়ে দর্জির হাতে দিয়ে বললে—পেড়ে খাও। কিন্তু দর্জির গায়ে কি আর অত জোর আছে? দৈত্য যেই ডাল ছেড়ে দিল অমনি দর্জি ডালের সঙ্গে লাফিয়ে উঠল গাছের চুড়োয়, তারপর শূন্যের মধ্যে দিয়ে একেবারে গাছের ওপারে। দৈত্য বললে, কী ব্যাপার? এই সামান্য একটা ডাল ধরে থাকবার জোরও তোমার গায়ে নেই?
দর্জি বললে—জোর থাকবে না কেন? এক ঘায়ে যে সাতটাকে মেরেছে তার পক্ষে এ আর কী? শিকারীরা ঝোপ থেকে গুলি ছুঁড়ছে দেখে আমি এক লাফ দিয়ে গাছটাকে টপ্কে গেলুম। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে তুমিও লাফিয়ে দেখাও না!
দৈত্য লাফাবার চেষ্টা করল; কিন্তু অর্ধেকটা লাফিয়ে গাছের ডালে আটকে ঝুলতে লাগল। দর্জি আর-একবার জিতল।
দৈত্য বললে—তুমি যখন এতই সাহসী, দাদা, এস না আমাদের আড্ডায় গিয়ে আজ রাতটা কাটাবে!
দর্জি বললে—বেশ। বলে, চলল তার পিছু পিছু। যখন দৈত্যের আড্ডায় এসে তারা পৌঁছল, সেখানে তখন আগুনের ধারে আরো অনেক দৈত্য বসে ছিল। তারা সবাই তাকে স্বাগত জানালো।
দৈত্য তাকে একটা বিছানা দেখিয়ে দিল শুতে। কিন্তু অত বড় প্রকাণ্ড বিছানায় কেমন করে আরাম করে শোবে? সে বিছানা থেকে নেমে এক কোণে গিয়ে শুয়ে রইল। মাঝরাত হতেই দৈত্য উঠল। উঠে হাতে একটা লোহার ডাণ্ডা নিয়ে এক ঘায়ে বিছানাটাকে শুদ্ধু ভেঙে দু-টুকরো করে দিল। ভাবল ওতেই পুঁচকে গঙ্গাফড়িংটা শেষ হয়ে গেছে। খুব ভোরে উঠে দৈত্যেরা সব বনে গিয়েছিল। তারা ভুলেই গিয়েছিল দর্জির কথা। যখন তারা দেখল বহাল তবিয়তে দর্জি তাদের দিকে আসছে, তারা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ভাবলে দর্জি তাদের মেরে ফেলতে আসছে। যে যেদিকে পারল দৌড়ে পালালো।
কাজেই দর্জি এগিয়ে চলল, যেদিকে তার নাক যায় সেদিকে। অনেক দূর যাবার পর সে এসে পৌঁছল এক রাজপ্রাসাদের উঠোনে। সেখানে এসে তার এমন ক্লান্তি বোধ হল যে সেইখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তারা সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তার কোমরবন্ধের লেখা পড়ল—এক ঘায়ে সাতটি সাবাড়!
তারা ভাবলে—বা রে, এখন দেশে শান্তি। এ সময় উনি এক বড় বীর এসে হাজির হলেন?
তারা রাজাকে খবর দিল। তারা ভাবলে, যদি দেশে যুদ্ধ বাধে তাহলে এমন একজন বীরের কত মূল্য! এঁকে কোনমতেই চলে যেতে দেওয়া উচিত হবে না। রাজা তাঁর মন্ত্রীদের ডেকে পাঠালেন, এক দূতকে পাঠিয়ে দিলেন দর্জির কাছে, যাতে দর্জি জেগে উঠলেই তাকে রাজার সৈন্যবিভাগে কাজ করবার আবেদন জানানো হয়। দূত দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না দর্জি জেগে ওঠে। দর্জি আলস্য ভাঙতে ভাঙতে যখন চোখ খুলল,দূত জানালো রাজার আর্জি।
দর্জি বললে—ঐ জন্যেই তো আমার এখানে আসা। আমি তৈরি আছি রাজার চাকরিতে ঢোকবার জন্যে।
মহা সম্মানে দর্জি রাজকর্মে নিযুক্ত হল। তাকে আলাদা একটা বাড়ি দেওয়া হল তার বসবাসের জন্যে। কিন্তু আর সব সৈন্যদের এটা মোটেই পছন্দ হল না। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে লাগল—কী করা যায়? ওর সঙ্গে যদি ঝগড়া বাধানো যায় তাহলে তো এক এক ঘায়ে আমাদের সাতটা করে সাবাড় করবে। তাতে আমাদের খুব সুবিধে হবে না।
তখন তারা ঠিক করল রাজার কাছে গিয়ে জানাবে যে তারা সবাই চাকরিতে ইস্তফা দিতে চায়।
তারা বললে—যে এক চড়ে সাতটাকে মারতে পারে তার অধীনে কাজ করতে হবে আমরা কোনদিন ভাবিনি।
শুধু একজনের জন্যে সমস্ত বিশ্বস্ত অনুচরদের হারাতে হবে ভেবে রাজা দুঃখ পেলেন। রাজার মনে হল, লোকটা না এলেই ভাল হত। কী করে এখন একে তাড়ানোই বা যায়? তাকে চাকরি থেকে জবাব দিতেও রাজার ভয়—পাছে সে রাজ্যের সবাইকে মেরে নিজেই সিংহাসনে চড়ে বসে। অনেকক্ষণ ধরে রাজা ভাবলেন, শেষে এক বুদ্ধি মাথায় এল।
দর্জিকে ডেকে পাঠিয়ে তিনি বললেন—দেখ, তুমি যখন এত বড় যোদ্ধা, তোমার কাছে আমার একটি প্রস্তাব আছে। আমার রাজ্যে বনের মধ্যে দুটি দৈত্য আছে, তারা ডাকাতি করে, খুন করে, আগুন লাগিয়ে অনেক ক্ষতি করেছে রাজ্যের। কেউ ভয়ে তাদের কাছে এগোতে চায় না। তুমি যদি এই দুই দৈত্যকে লড়াইয়ে হারিয়ে তাদের মাথা কেটে ফেলতে পারো তাহলে আমার একমাত্র কন্যার সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব। আমার অর্ধেক রাজত্বও তুমি যৌতুক পাবে। যাও, একশো ঘোড়সওয়ার দিচ্ছি তোমার সঙ্গে।
দর্জি ভাবল—আমার মত লোকের এই ভো দরকার। সুন্দরী রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজ্য রোজ-রোজ তো পাওয়া যায় না।
সে রাজাকে বললে—নিশ্চয়! দৈত্যদের আমি ঠিক হারিয়ে দেব। তার জন্যে আবার একশো ঘোড়সওয়ারের কী প্রয়োজন? যে এক ঘায়ে সাতটাকে সাবাড় করতে পারে তার কাছে দুটো আর কী?
তবুও রাজা একশো ঘোড়সওয়ার তার সঙ্গে দিলেন। দর্জি তাদের নিয়ে চলল।
বনের ধারে এসে তারা যখন পৌঁছল, সে ঘোড়সওয়ারদের বললে—তোমরা এখানে থাক। আমি বনে যাচ্ছি দৈত্যদের আক্রমণ করতে।
বলে সে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ডাইনে দেখে, বাঁয়ে দেখে, এমনি করতে করতে শেষে দেখতে পেল দুই দৈত্যকে। তারা এক গাছতলায় পড়ে ঘুমোচ্ছে, আর এমন নাক ডাকাচ্ছে যে গাছের ডালপালা পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছে। দর্জি করল কি, তার দু-পকেটে পাথরের নুড়ি ভরে গাছে চড়ল, তারপর যে ডালটা দৈত্যদের ঠিক উপরে ঝুলছিল তাতে গিয়ে শক্ত হয়ে বসল। তারপর পকেট থেকে পাথর বার করে একটা দৈত্যের বুকের উপর টুপ-টুপ করে ফেলতে লাগল।
দৈত্য অনেকক্ষণ ধরেই বুঝতে পারেনি যে কী হচ্ছে। শেষে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে তার সঙ্গীকে ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলে—মারছ কেন?
অন্য দৈত্যটা বললে—স্বপ্ন দেখছ নাকি? আমি আবার তোমায় ছুঁলুম কখন? বলে তারা আবার ঘুমোতে লাগল। তখন দর্জি অন্য দৈত্যটার বুকের উপর একটা ঢেলা ফেলল।
সে চেঁচিয়ে বললে—ওটা আবার কী হল? কী দিয়ে মারছ আমাকে?
প্রথম দৈত্য বললে—আমি আবার তোমায় মারলুম কখন?
খানিকক্ষণ তারা ঝগড়া করল। এদিকে দু-জনেরই চোখ ঘুমে ভরে আসছে, কাজেই তারা আবার চোখ বুজল। দর্জি তখন আবার তার খেলা নতুন করে আরম্ভ করলে। সে ভারি দেখে একখানা পাথর তুলে প্রথম দৈত্যের বুকের উপর ফেলে দিলে।
সে লাফিয়ে উঠে বলল—নাঃ, আর সহ্য করবো না। বলে প্রায় পাগলের মতো তার সঙ্গীকে এমন এক ঘা কষালো যে গাছটা পর্যন্ত থর-থর করে কেঁপে উঠল। অন্য দৈত্যও ছেড়ে কথা কইল না। তারপর দুজনের মধ্যে এমন মারামারি লেগে গেল যে তারা বড়-বড় গাছ উপড়ে পরস্পরকে আক্রমণ করল। মারামারি করতে করতে দু-জনেই মরে পড়ে গেল মাটিতে। তখন দর্জি নেমে এল গাছ থেকে।
সে বললে—ওঃ, খুব বেঁচে গেছি! ভাগ্যিস যে গাছটায় আমি বসে ছিলুম সেটাকে উপড়ে ফেলেনি! তাহলে এক গাছ থেকে আর এক গাছে আমায় কাঠবেড়ালির মত লাফালাফি করতে হত!
তারপর সে তার তরোয়াল বার করে দুটো দৈত্যের বুকেই কয়েক ঘা করে কোপ বসিয়ে দিলে। শেষে ঘোড়সওয়ারদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল—কাজ ফর্সা। দুটোকেই শেষ করে দিয়েছি। উঃ, যা লড়তে হয়েছিল! ব্যাটারা আত্মরক্ষা করবার জন্যে কত গাছ যে উপড়েছে। কিন্তু তাতে কোন ফলই হয়নি। এক ঘায়ে সাতটাকে সাবাড় করি আমি, ওরা তো দুটো!
ঘোড়সওয়ার জিজ্ঞেস করলে আপনার—চোট-টোট লাগেনি তো?
দর্জি বললে—বিন্দুমাত্র না। আমার একটা চুল পর্যন্ত নষ্ট হয়নি।
ঘোড়সওয়ারদের তবু বিশ্বাস হল না। তারা ঘোড়ায় চড়ে বনে গিয়ে ঢুকল। ঢুকে দেখল সত্যিই দত্যি দুটো রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। তাদের চারিদিকে ওপড়ানো গাছ।
দর্জি ফিরে গিয়ে রাজাকে বললে—যা বলেছেন এবার তা দিন! কিন্তু রাজার ক্ষোভ হল, কেন তিনি অঙ্গীকার করতে গিয়েছিলেন? তাই তিনি বললেন—দেখ, আমার মেয়ে আর অর্ধেক রাজ্য পেতে হলে তোমায় আরো এক বীরত্বের কাজ করতে হবে। বনের মধ্যে এক শিংওয়ালা ঘোড়া আছে, সে বড় ক্ষতি করে বেড়ায়। তাকে ধরে দিতে হবে।
দর্জি উত্তর করল—দুই দৈত্যকে যে ভয় করে না, সে আবার শিংওয়ালা ঘোড়াকে ভয় করবে? এক ঘায়ে আমি সাতটা মারি, বুঝলেন মহারাজ?
একটা দড়ি আর একটা কুড়ুল নিয়ে সে বনে গিয়ে ঢুকল। যারা তার সঙ্গে এসেছিল তাদের বনের বাইরে দাঁড়াতে বলল। বেশি দূরে যেতে হল না। শিংওয়ালা ঘোড়া বেরিয়ে এসে এমন তাড়া করল তাকে যে মনে হল এখুনি শেষ করে দেবে।
দর্জি বললে—আস্তে ভায়া, আস্তে। যত তাড়াহুড়ো করবে তত গতি কম হবে। বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। যখন শিং উঁচিয়ে ঘোড়া খুব কাছে এসে পড়ল অমনি দর্জি চুপিসাড়ে এক গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। শিংওয়ালা ঘোড়া যত জোরে পারে গাছে মারল এক গুঁতো। গাছের গুঁড়ির মধ্যে তার শিং এমন ঢুকে গেল যে সে আর বার করতে পারলে না। ধরা পড়ে গেল সেইখানেই।
গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে দর্জি বললে—এইবার তো তোমায় পেয়েছি! ঘোড়ার গলায় দড়ি বেঁধে কুড়ুল দিয়ে তার শিং কেটে ফেলল। তারপর সবাইয়ের সঙ্গে শিংওয়ালা ঘোড়া নিয়ে রাজার কাছে গেল।
রাজা কিন্তু তাতেও তাকে পুরস্কার দিতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন—বিয়ের আগে আরও এক কাজ তোমায় করতে হবে। বনের মধ্যে এক বুনো বরা আছে—সে বড় ক্ষতি করে বেড়ায়, তাকে ধরে এনে দিতে হবে। সঙ্গে যাবে শিকারীদের দল।
দর্জি বললে—বেশ, তাই। এ তো ছেলেখেলা।
সর্জি কিন্তু বনের মধ্যে শিকারীদের নিয়ে গেল না। শিকারীরাও তাতে খুশি হল, কারণ এর আগে বরা তাদের এমন তাড়া করেছিল যে বরাকে আবার ঘাঁটাবার তাদের কারুর ইচ্ছে ছিল না।
বরা যেই-না দর্জিকে দেখা অমনি তার চকচকে দাঁত উঁচিয়ে ফেনায়িত মুখে তার দিকে তাড়া করে এগিয়ে এল তাকে পেড়ে ফেলবার জন্যে। ক্ষিপ্র দর্জি অমনি একটি ছোট্ট গির্জের দরজা দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে তাড়াতাড়ি পিছনের জানলা টপকে বাইরে পালিয়ে এল। আর তার পিছনে তাড়া করে বরাও যেই-না গির্জের ভিতরে ঢোকা, দর্জিও বাইরে থেকে দিল দরজা বন্ধ করে। বরার মতো অত বড় জন্তুর পক্ষে জানলা টপকে পালানো অসম্ভব—কাজেই সে বন্দী হয়ে গেল।
দর্জি তখন শিকারীদের ডেকে পাঠিয়ে বললে—তোমরা নিজেরা এসে বরার বন্দীদশা দেখে যাও। তারপর সে রাজার কাছে গেল। এবার রাজা চান বা না চান তাঁকে মেয়ে আর অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দিতে হল। কিন্তু তখনও রাজা জানতেন না, এই বীর সামান্য একজন দর্জি মাত্র। জানলে তাঁর আরো খারাপ লাগত।
জাঁকজমকে বিয়ে হয়ে গেল। দর্জি হল রাজা।
একদিন রাত্রে রাজকন্যা শুনতে পেলেন তাঁর স্বামী ঘুমের মধ্যে বলছেন—এই ছোকরা, আমার আংরাখাটা তৈরি করে ফেল আর পাজামাটায় তাপ্পি দে। নইলে আমার গজ দিয়ে তোকে ঠেঙাবো।
রাজকন্যা বুঝলেন নিচু জাতের লোকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। দর্জি ছাড়া কিছু নয়। পরদিন সকালে বাবাকে গিয়ে সব বলে বললেন—এর হাত থেকে আমায় উদ্ধার কর বাবা!
রাজা বললেন—কিছু ভেবো না, আজ রাত্রে তোমাদের ঘরের দরজা খোলা রেখো। আমার রক্ষীরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। সে ঘুমোলেই তাকে বেঁধে নিয়ে চলে যাবে। তারপর তাকে জীবনের পরপারে চালান করে দেবে।
রাজকন্যা নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু রাজার জল-বেহারা সব শুনছিল। সে গিয়ে চুপিচুপি দর্জিকে সব জানিয়ে দিলে।
দর্জি বললে—দাঁড়াও, এটা বন্ধ করতে হচ্ছে।
রাত্রে সে রোজ যেমন শোয় তেমনি শুলো। রাজকন্যা যখন ভাবলেন সে ঘুমিয়েছে তিনি উঠে দরজা খুলে দিয়ে আবার বিছানায় এসে শুলেন। দর্জি এতক্ষণ, শুধু ভান করছিল। এইবার সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল যাতে সবাই শুনতে পায়।
—এই ছোকরা, আমার আংরাখা তৈরি করে ফেল আর পাজামাটায় তাপ্পি দে! নইলে আমার গজ দিয়ে তোকে ঠেঙাবো! সাতটাকে এক ঘায়ে আমি ঘায়েল করেছি, দুটো দত্যি মেরেছি, শিংওয়ালা ঘোড়া আর বুননা বরা ধরে দিয়েছি, আর ভাবছিস দরজার বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের ভয়ে আমি কাঁপব?
যেই না বলা অমনি রক্ষীরা ভয়ের চোটে কে যে কোথায় ছিটকে গেল তাদের আর পাওয়া গেল না।
কাজেই সেই থেকে দর্জি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত রাজা হয়েই রইল।