Chapter Index

    এক ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। তাঁদের কোন ছেলেপুলে হয়নি। তাঁদের বাড়ির পিছনের দেয়ালে ছিল একটি জানলা। সেই জানলা দিয়ে দেখা যেত চমৎকার একটি বাগান, সুন্দর ফুলে আর গাছে ভরা। কিন্তু বাগানটি ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, কারণ সেই বাগানের মালিক ছিল এক ডাইনি—সবাই তাকে ভয় করে চলত।

    স্ত্রীটির একদিন মনে হল, এইবার তাঁর ছেলেপুলে হবে। সেদিন তিনি তাঁদের সেই জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, একটি ছোট্ট ক্ষেত চমৎকার নটেশাকে ভরা। এত টাটকা, এত সবুজ তার পাতাগুলি যে তাঁর ভারি ইচ্ছে হল খেতে। যত দিন যায় খাবার ইচ্ছে ততই বাড়ে। কিন্তু যখন তিনি বুঝলেন সেই নটেশাক পাবার কোন উপায়ই নেই, তখন থেকে তাঁর মুখ শুকিয়ে যেতে লাগল, তিনি ফ্যাকাসে হয়ে যেতে লাগলেন, রোগা হয়ে যেতে থাকলেন। স্বামী দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে বললেন—কী তোমার কষ্ট বল!

    স্ত্রী বললেন—হায়রে! আমাদের বাড়ির পিছনের ঐ বাগানের নটেশাক যদি আমি খেতে না পাই তাহলে আমি মরে যাব!

    স্বামী মনে মনে ভাবলেন—স্ত্রীকে মরতে দেবার আগে আমারই উচিত ঐ নটেশাক নিয়ে আসা—তাতে যা হয় হোক। এই ভেবে সন্ধের আবছা আলোয় তিনি পাঁচিল টপকে ডাইনির বাগানে গিয়ে পড়লেন। তারপর তাড়াতাড়ি একগোছা নটে তুলে ফিরে এলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে। স্ত্রী তখন নটেশাক রান্না করে লোভীর মতো খেয়ে ফেললেন। কিন্তু খাবার ফলে তার পরদিন তাঁর লোভ তিনগুণ বেড়ে গেল। যতক্ষণ না তাঁর স্বামী আরো কিছু নটে তুলে এনে দেন ততক্ষণ তাঁর মন কিছুতেই শান্ত হয় না। কাজেই আবার সন্ধ্যার আবছা আলোয় তিনি বেরোলেন। কিন্তু পাঁচিল টপ্‌কে ভিতরে ঢুকেই দেখলেন, ডাইনি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখে ভয় পেয়ে গেলেন।

    ডাইনি চটে গিয়ে বললে— কী সাহস তোমার! চোরের মতো আমার বাগানে ঢুকে নটেশাক চুরি করছ? বুঝবে এর ফল!

    তিনি বললেন—মা গো! দয়া করুন আমায়! নেহাত দরকার পড়েছে বলেই আমি এখানে এসেছি। জানলা দিয়ে আমার স্ত্রী আপনার নটেশাক দেখতে পায়। দেখে তার এত লোভ হয় যে একটু যদি খেতে না পায় তো মরেই যাবে!

    শুনে ডাইনির রাগ পড়ল। সে বললে—তুমি যা বলছ তাই যদি হয় তাহলে যত খুশি নটেশাক নিয়ে যেতে পার। কিন্তু একটি শর্তে। তোমার স্ত্রীর কোলে যে শিশুটি জন্মাবে তাকে আমায় দিয়ে দিতে হবে। আমি তাকে তার নিজের মায়ের মতো করে মানুষ করব।

    ভয়ে সে সবকিছুতেই রাজি হয়ে গেল। আর যখন বাচ্চাটি জন্মালো, ডাইনি এল, এসে তার নাম দিল নটুরানী। তারপর তাকে নিয়ে চলে গেল।

    নুটুরানীর মতো সুন্দরী মেয়ে কেউ ছিল না। যখন তার বারো বছর বয়েস হল, ডাইনি তাকে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে একটা বুরুজের উপর বন্ধ করে রেখে দিল। বুরুজে উঠবার কোন সিঁড়িও ছিল না, কোন দরজাও ছিল না। শুধু অনেক উঁচুতে দেয়ালের গায়ে কাটা ছিল একটি ছোট জানলা।

    ডাইনির যখন উপরে উঠবার দরকার হত সে বুরুজের নিচে দাঁড়িয়ে বলত—নুটুরানী, নুটুরানী চুল মেলে দাও।

    নুটুরানীর ছিল সোনার সুতোর মতো অপূর্ব লম্বা চুল। ডাইনির গলা শুনতে পেলেই নুটুরানী তার বিনুনি জানলার আংটায় জড়িয়ে নিচে ঝুলিয়ে দিত। বিশ হাত নিচে গিয়ে পড়ত সেই বেণী। ডাইনি তাই ধরে উপরে উঠে আসত।

    তারপর বছর-দুই কেটে গেছে; সেই সময় একদিন এক রাজপুত্র ঘোড়ায় করে বনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সেই বুরুজের কাছে এসে হাজির হয়েছেন। তাঁর কানে গেল এক অপূর্ব গানের সুর। রাজপুত্র থেমে গেলেন শুনতে। নুটুরানীর একা থাকতে যখন আর ভাল লাগত না সে এমনি করে গান গেয়ে সময় কাটাতো। রাজপুত্র ভাবলেন, যাই ওর কাছে। কিন্তু বুরুজে ঢোকবার কোন দরজা খুঁজে পেলেন না।

    তিনি ঘোড়ায় চেপে বাড়ি ফিরে গেলেন বটে, কিন্তু গানের সুর তাঁর প্রাণে এমনই বেজেছিল যে তাঁকে রোজই একবার করে বনে ফিরে আসতে হত সেই সুর শোনবার জন্যে। একদিন তিনি যখন একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছেন, হঠাৎ দেখলেন এক ডাইনি বুরুজের কাছে এসে ডাকল—নুটুরানী, নুটুরানী চুল মেলে দাও।

    নুটুরানী অমনি তার বিনুনি ঝুলিয়ে দিল আর তাই ধরে উঠে গেল ডাইনি।

    রাজপুত্র ভাবলেন—ঐ যদি হয় উপরে ওঠবার সিঁড়ি, তাহলে আমিও চেষ্টা করে দেখব।

    পরদিন যখন সবে অন্ধকার হতে আরম্ভ করেছে, তিনি বুরুজের কাছে গিয়ে ডাক দিলেন—নুটুরানী, নুটুরানী, চুল মেলে দাও।

    বেণী এসে পড়ল আর রাজপুত্র তাই ধরে উঠে গেলেন।

    নুটুরানীর হল বেজায় ভয়, কারণ সে এর আগে কখনও পুরুষ মানুষই দেখেনি; কিন্তু রাজপুত্র তার সঙ্গে মিষ্টি করে কথা কইতে লাগলেন। তিনি বললেন যে তার গান শুনে তাঁর মন এত নাড়া পেয়েছিল যে যতক্ষণ না তিনি তাকে দেখেন তাঁর মনে শান্তি ছিল না। শুনে নটুরানীর ভয় ভেঙে গেল। রাজপুত্র যখন তাকে বললেন তিনি তাকে বিয়ে করতে চান, নুটুরানী ভাবলে এই সুন্দর ছেলেটি তার বুড়ি মায়ের চেয়ে নিশ্চয় তাকে বেশি ভালবাসবে। তাই সে বললে—আচ্ছা। বলে তার হাত রাজপুত্রের হাতে রাখল। তারপর সে বললে—তোমার সঙ্গে তো আমি যাব, কিন্তু কেমন করে এ বুরুজ থেকে নামব তা আমি তো জানি না! এবার থেকে যখনই তুমি আসবে, সঙ্গে করে খানিকটা রেশম নিয়ে এস। তাই দিয়ে আমি সিঁড়ি বুনব। সিঁড়িটি যখন যথেষ্ট লম্বা হবে, তাই বেয়ে নিচে নেমে আসব। তখন তোমার ঘোড়ায় চড়িয়ে তুমি আমায় নিয়ে যেয়ো।

    সেই থেকে ব্যবস্থা হল যে রাজপুত্র প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার কাছে আসবেন, কারণ ডাইনি আসত দিনের বেলায়। ডাইনি কিছুই জানতে পারল না। তারপর হঠাৎ একদিন নুটুরানী বলে ফেলল—আচ্ছা বলো তো মা, উপরে ওঠবার সময় তুমি এত ভারি ঠেক কেন? কই রাজপুত্র যখন ওঠেন এত ভারি ঠেকে না তো?

    —ওরে হতভাগী! কী বলছিস তুই? আমি ভাবছি তোকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি, এদিকে তুই আমায় সব দিক দিয়ে ঠকিয়েছিস?

    রাগের চোটে বুড়ি নুটুরানীর চুলের বিনুনি বাঁ হাতে করে মুঠিয়ে ধরল আর ডান হাতে করে এক কাঁচি দিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করে কেটে দিল সেই বিনুনি। তারপর নিষ্ঠুরভাবে নুটুরানীকে টানতে টানতে গভীর বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল।

    নুটুরানীকে তাড়িয়ে দিয়ে ডাইনি সেদিন সন্ধ্যায় নুটুরানীর বেণী জানলার আংটায় বেঁধে রাখলে। তারপর নিজে লুকিয়ে রইল বুরুজের ঘরে। রাজপুত্র এসে যখন ডাকলেন—নুটুরানী নুটুরানী, চুল মেলে দাও—ডাইনি বেণী ঝুলিয়ে দিল। তাই বেয়ে উঠে দেখেন, তাঁর নুটুরানীর বদলে রক্তবর্ণ চোখ করে দাঁড়িয়ে আছে এক ডাইনি।

    ডাইনি খনখনে সুরে বলে উঠল— পাখির খোঁজে এসেছ? পাখি আর বাসায় নেই। সে আর গানও গাইবে না, তাকে বেড়ালে ধরে নিয়ে গেছে। সেই বেড়াল তোমারও চোখ খুবলে নেবে। নুটুরানী হারিয়ে গেছে। তাকে কোনদিন আর তুমি দেখতে পাবে না।

    রাজপুত্র দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। হতাশায় তিনি জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়লেন। তিনি মারা গেলেন না বটে, কিন্তু যেখানে তিনি পড়লেন সেখানকার কাঁটার খোঁচায় তাঁর দুই চোখ নষ্ট হয়ে গেল। অন্ধ হয়ে তিনি বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। খাবার মধ্যে জুটল শিকড়-বাকড় আর ক্ষুদে-ক্ষুদে ফল। নুটুরানীর জন্যে শুধু কাঁদেন আর কাঁদেন। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে কয়েক বছর পরে অবশেষে তিনি হাজির হলেন যেখানে নুটুরানী মহা কষ্টে মহা দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছে। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ভারি চেনা কার গলার শব্দ। সেইদিকে এগিয়ে গেলেন। নুটুরানী তাঁকে দেখেই চিনতে পারল। সে রাজপুত্রের গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। নুটুরানীর চোখের দু-ফোঁটা জল রাজপুত্রের অন্ধ চোখদুটির উপর এসে পড়তেই তিনি দৃষ্টি ফিরে পেলেন।

    রাজপুত্র তখন নুটুরানীকে নিয়ে রাজ্যে ফিরলেন। তারপর তাঁরা সুখে সাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিলেন বহু দিন বহু বছর।

    টীকা