দুই পথিকের গল্প
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাপাহাড় আর উপত্যকা কখনো একসঙ্গে মেলামেশা করে না। কিন্তু মানুষের বেলা তা নয়। দুষ্টু লোক আর ভালো লোক একসঙ্গে জুটে যায়। এইভাবেই একবার এক মুচির সঙ্গে এক দর্জির পথে আলাপ হল। দর্জিটি ছিল দেখতে সুন্দর, সব সময় ফুর্তি আর মজা নিয়েই আছে। সে দেখল একজন লোক রাস্তা দিয়ে তার দিকে আসছে। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ দেখে বুঝল যে সে মুচি। তাই সে একটা গান ধরলে—
ঐ দেখ চামড়ার জোড়,
দু-চারটে দিয়ে দাও ফোঁড়
সুতো ধরে দাও কসে টান,
হাতুড়ি চালাও আর প্রাণ খুলে গেয়ে চল গান।
মুচি ঠাট্টা-টাট্টা পছন্দ করত না। এমন একটা মুখ করল যেন ভীষণ টক কিছু খেয়েছে আর এমনভাবে এগিয়ে এল যে মনে হল দর্জির টুঁটি টিপে ধরতে চাইছে। কিন্তু দর্জি হাসতে হাসতে তার ঝুলি থেকে সরাবের বোতল বার করে বললে—এই নাও ভাই, একটু সরাব খেয়ে নাও। তোমায় তো গালাগাল দিইনি! রাগ হজম হয়ে যাবে।
মুচি বেশ কয়েক ঢোক সরাব খেয়ে নিতেই তার রাগটা চলে গেল। তার মুখের ভাব শান্ত হয়ে এল। দর্জির হাতে বোতলটা ফিরিয়ে দিয়ে বললে—তেষ্টা পেলে কি আর মেজাজ ভালো থাকে ভাই? তেষ্টা মিটলে তবেই না ভালো করে কথা বলা যায়! তা, আমরা কি এবারে একসঙ্গে পথ চলব?
দর্জি বললে—বেশ, তবে ভেবে দেখ, আমি এখন যাব কোনো বড় শহরে যেখানে কাজের অভাব নেই।
মুচি বললে—আমিও ঠিক ঐরকম একটা জায়গা খুঁজছিলুম। ছোট-খাটো গ্রামে রোজগার করবার কিছু নেই—লোকে সেখানে খালিপায়ে হাঁটে।
এই হয়ে গেল বন্ধুত্ব। দু-জনে চলল একসঙ্গে।
দুজনেরই হাতে অজস্র সময়, কিন্তু হাত খালি। তারা শহরে পৌঁছে সদাগরদের কাছে তাদের নমস্কার জানিয়ে এল। দর্জির ফুর্তিভরা চেহারা, লাল টুকটুকে গাল আর প্রাণখোলা কথা শুনে সবাই তাকে পছন্দ করলে। কিছু-কিছু কাজও দিলে। মুচির সঙ্গে যখন তার আবার দেখা হল তখন দর্জির পয়সার থলিই অনেক বেশি ভারি। বদমেজাজি মুচি মুখ বেঁকিয়ে ভাবলে—যে যত বড় ঠগ তার কপাল তত ভালো। কিন্তু দর্জি হাসতে লাগল, গান গাইতে লাগল আর সে যা পেয়েছিল তার সবই বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে নিলে।
দু-জনে কিছুদিন একসঙ্গে হাঁটবার পর তারা এক প্রকাণ্ড বনের ধারে এসে পৌঁছল যার মধ্যে দিয়ে রাজধানীতে পৌঁছবার রাস্তা গেছে। বনের মাঝ দিয়ে দুটি পায়ে-চলা পথ, তার মধ্যে একটি সাত দিনের রাস্তা, অন্যটি দু-দিনের। কিন্তু এদের দু-জনের কেউই জানত না কোন্টি ছোট। তারা এক ওক গাছের নিচে বসে পরামর্শ করতে লাগল, কী করা যায়! কেমন করে ঠিক করা যায়, কোন্টি কোন রাস্তা? বড় রাস্তার জন্যে বেশি রুটি লাগবে, ছোট রাস্তার জন্যে কম। মুচি বললে—ঝাঁপ খাবার আগে ভালো করে দেখে নেওয়া ভালো। আমি সঙ্গে করে সাত দিনের রুটি নেব।
দর্জি বললে—বল কী ভাই! সাত দিনের বোঝা পিঠে করে কি গাধার মতো হাঁটতে হবে? ঘাড় ফিরিয়ে কিছু দেখাই যাবে না যে! আমি ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখব, আর নিজেকে কোন কষ্ট দেব না। আমার পকেটে যা কড়ি আছে তা গ্রীষ্মকালেও যেমন শীতকালেও তেমনি। কিন্তু রুটির বেলা তো তা নয়। রুটি গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যায়, তার উপর হয়তো ছাতাও পড়ে। তাছাড়া ছোট রাস্তাটা পাব না এটা ভাবছিই বা কেন? দু-দিনের রুটি নিচ্ছি—ও-ই যথেষ্ট। দু-জনেই নিজের নিজের রুটি কিনে নিজের নিজের ভাগ্য-পরীক্ষা করতে ঢুকল গিয়ে বনে।
ঠিক যেন গির্জের ভিতরের মত বনটা নিঃশব্দ! একটু বাতাস নেই, ঝর্নার ঝর-ঝর নেই, পাখির গান নেই, ঘন পাতায় ঢাকা ডালপালার মধ্যে সূর্যের আলো,প্রবেশ করে না। মুচি একটি কথাও বললে না। দারুণ ভারি ভারি রুটির বোঝায় তার পিঠ নিচু হয়ে গেল। তার গোমড়া মুখের দু-ধার দিয়ে ঘাম ঝরে পড়তে লাগল। দর্জির এদিকে ভারি ফুর্তি। সে নেচে বেড়াতে লাগল, পাতা ছিঁড়ে ভেঁপু বাজাতে লাগল, গান গাইতে লাগল আর ভাবলে—আমায় যদি এমনি দেখেন তো ভগবান নিশ্চয়ই খুশি হবেন।
এমনিভাবে দু-দিন গেল। তিন দিনের দিনও বন শেষ হল না। দর্জি তার সব রুটি খেয়ে ফেলেছিল, তাই তার মনের ফুর্তি গেল অনেক কমে। দর্জি কিন্তু ভয় পেল না। সে ভগবানের উপর আর নিজের কপালের উপর বিশ্বাস রাখলে। তিনদিনের দিন সন্ধেবেলা সে খিদে পেটে নিয়ে একটা গাছের তলায় শুয়ে পড়ল। তার পরদিন যখন উঠল তখনও তার পেটে খিদে রয়েছে। এইভাবে চারদিনের দিন কেটে গেল। মুচি যখন একটা ভাঙা গাছের গুড়ির উপর বসে তার রুটি গ্রাসের পর গ্রাস গিলতে লাগল, দর্জি শুধু বসে বসে দেখল। এক টুকরো রুটি চাইলে মুচি বিদ্রূপ করে হেসে বললে—তুমি তো এতকাল ফুর্তি করে কাটিয়েছ। এখন একবার দুঃখ কাকে বলে একটু বোঝে না! যেসব পাখি খুব সকালে গান গায় বিকেলে তারা ধরা পড়ে বাজের হাতে। মুচি কোনো দয়াই দেখালো না। পাঁচ দিনের সকালে দর্জি বেচারা আর উঠে দাঁড়াতে পারল না, এত দুর্বল হয়ে পড়ল যে একটি কথাও কইতে পারল না। তার গালদুটি সাদা হয়ে গেল, চোখ দুটি লাল। তখন মুচি বললে—আজ তোমায় আমি এক টুকরো রুটি দিতে পারি কিন্তু তার বদলে তোমার ডান চোখটা আমি উপড়ে নেব।
দর্জি বেচারার এ ছাড়া আর বাঁচবার কোনো পথ ছিল না। সে একবার দু-চোখ দিয়ে কেঁদে নিলে তারপর চোখ তুলে ধরলে আর সেই পাষাণ-হৃদয় মুচি একখানা ধারালো ছুরি বার করে তার ডান চোখটা উপড়ে নিলে।
দর্জির মনে পড়ল একবার যখন সে রান্নাঘর থেকে চুরি করে খাচ্ছিল তার মা কী বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—যা পাও খাও, যে শাস্তি প্রাপ্য তা মাথা পেতে নাও। সেই মহামূল্য রুটিটুকু খেয়ে সে উঠে দাঁড়ালো আর তার দুঃখের কথা ভুলে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলে যে একটা চোখ দিয়েই যথেষ্ট দেখা যাবে। কিন্তু ছ-দিনের দিন আবার তার খিদে চাড়া দিয়ে উঠল আর তার কলজে পর্যন্ত কুরে কুরে খেতে লাগল। সন্ধের দিকে একটা গাছের নিচে সে পড়ে গেল, আর সাতদিনের সকালে দুর্বলতার জন্যে সে আর উঠতেই পারল না—মরবার আর দেরি রইল না। মুচি তখন বললে—আমি তোমায় দয়া করে আর একবার রুটি দেব। কিন্তু অমনি নয়। তোমার অন্য চোখটাও তুলে নেব।
দর্জি তখন ভাবলে জীবনে সে কত বেপরোয় ছিল। ভগবানের কাছে মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আর বললে—যা করতে চাও কর। যা আমায় সইতে হবে তা আমি সইব। কিন্তু মনে রেখো, আমাদের ভগবান শুধু যে চুপটি করে দেখেন তা নয়। একদিন সময় আসবে যখন তুমি আমার সঙ্গে যে অসৎ ব্যবহার করলে যা তোমার কাছ থেকে আমি আশা করিনি, তার প্রতিফল ফলবে। আমার সময় যখন ভালো ছিল,যা পেয়েছি তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। আমার পেশাই এমন যে একটি ছুঁচের ফোঁড় আর-একটি ছুঁচের ফোড় থেকে একটুও তফাত হবে না। যদি আমার চোখ না থাকে আর যদি আমি সেলাই করতে না পারি তাহলে আমায় ভিক্ষা করে খেতে হবে। যাই হোক কানা করে এখানে একা ফেলে চলে যেও না। গেলে আমি না খেয়ে মারা যাবো।
মুচি দয়ামায়ার লেশ না দেখিয়ে তার ছুরি বার করে দর্জির বাঁ চোখ উপড়ে তুলে নিলে। তারপর তাকে একটুকরো রুটি খেতে দিয়ে একটা লাঠি বাড়িয়ে দিল। সেই লাঠি ধরে দর্জি চলল মুচির পিছনে পিছনে।
সূর্য অস্ত গেলে তারা বন থেকে বেরোলো। বেরিয়েই দেখল মাঠের মাঝখানে ফাঁসিকাঠ। মুচি, সেই ফাঁসিকাঠের কাছে দর্জিকে নিয়ে গিয়ে সেইখানে তাকে একলা ছেড়ে নিজের পথে চলে গেল। ক্লান্তিতে, যন্ত্রণায় আর খিদের জ্বালায় বেচারা সেইখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। সারা রাত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। যখন ভোর হচ্ছে তখন সে উঠল, কিন্তু বুঝতে পারল না কোথায় সে রয়েছে। দুটো দেহ ফাঁকিকাঠে ঝুলছে আর প্রত্যেকের মাথায় একটা করে কাক বসে। তাদের মধ্যে একটা ঝুলন্ত দেহ হঠাৎ কথা বলতে আরম্ভ করলে। বললে—ভায়া, জেগে আছ হে?
—হ্যাঁ জেগে আছি।
—শোন তবে বলি। রাত্রে যে শিশিরের ফোঁটা আমাদের গা থেকে গড়িয়ে পড়েছে তাই দিয়ে চোখ ধুলে কানা মানুষ চোখ ফিরে পায়। কানারা যদি এটা জানত তাহলে কত লোক দৃষ্টি ফিরে পেত ভাবো তো ভায়া!
দর্জি এই কথা শুনে তার রুমাল বার করে ঘাসের উপর চেপে ধরল। রুমাল শিশিরে ভিজে যেতে সে তার চোখের গর্তদুটো তাই দিয়ে ধুয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসিকাঠে ঝোলা মানুষটা যা বলেছিল তাই হল, দর্জির চোখের গর্তে আবার একজোড়া নতুন চোখ গজালো। একটু পরেই সে দেখলে পাহাড়ের পিছনে সূর্য উঠছে। তার সামনে পড়ে রয়েছে মস্ত শহর—রাজধানী। বিরাট তার ফটক, কত যে মিনার আর চুড়ো তার ঠিক নেই। গাছের প্রত্যেকটি পাতা সে দেখতে পেল, পাখিরা উড়ে যাচ্ছে তা দেখতে পেল, বাতাসে ফড়িং নাচছে তা-ও দেখল। সে পকেট থেকে একটা ছুঁচ বার করে দেখল যে আগেকারই মত সে সুতো পরাতে পারছে। তার মন আনন্দে নেচে উঠল। ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে তার ঝুলিটা পিঠে তুলে নিয়ে নিজের সব কষ্ট ভুলে আবার পথ চলতে লাগল গান গেয়ে গেয়ে আর শিস দিয়ে দিয়ে।
প্রথমেই তার চোখে পড়ল, মাঠের মাঝখানে একটা খয়েরি রঙের ঘোড়ার বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে তার কেশর চেপে ধরে তার পিঠে চড়ে শহরে নিয়ে যেতে যাচ্ছে সেই সময় ঘোড়ার বাচ্চা বললে—আমায় দয়া করে ছেড়ে দিন। এখনও আমি বাচ্চা, আপনার মত হালকা মানুষকেও পিঠে করলে আমার পিঠ ভেঙে যাবে। যতদিন না আমার গায়ে জোর হয়, আমায় ছেড়ে দিন। হয়ত একদিন আসবে যখন আপনাকে আমি আপনার দয়ার দান ফিরিয়ে দিতে পারব।
দর্জি বললে-যাও পালাও। এখনও তোমার পা টলে দেখছি। বলে তাকে ছেড়ে দিতেই সে পিছনের দু-পা তুলে আনন্দে নেচে, বেড়া আর খাদ টপকে পালিয়ে গেল।
দর্জির পেটে আগের দিন থেকে তখন পর্যন্ত কিছুই পড়েনি। সে বললে—রোদের আলোয় আমার চোখ ভরছে কিন্তু পেট তো ভরছে না। এবার প্রথমেই যা আমার চোখে পড়বে তা যদি পুরো খাবার সামিল না-ও হয় তাহলেও আমার হাতে তার নিস্তার নেই। সে দেখলে মাঠের উপর দিয়ে গম্ভীরভাবে পা ফেলে ফেলে এক সারস তার দিকে এগিয়ে আসছে।
—দাঁড়াও, দাঁড়াও। এই বলে দর্জি গিয়ে তার পা চেপে ধরলে।
—কেমন খেতে তোমায় তা জানি না। কিন্তু আমার যা খিদে পেয়েছে তাতে আর বাছ-বিচার করবার সময় নেই। তোমার মাথাটা কেটে তোমায় রোস্ট করতে হবে।
সারস বললে—না না, তা কোরো না। আমি বড় পবিত্র পাখি। মানুষ আমায় দিয়ে কত উপকার পায়। কেউ আমার ক্ষতি করে না। আমাকে ছেড়ে দাও। প্রাণে মেরো না। হয়ত আমি তোমার উপকারে আসতে পারি।
দর্জি বললে—আচ্ছা, যাও লম্বা-ঠেঙো। বলে তাকে ছেড়ে দিল।
সারস উঠে দাঁড়িয়ে তার লম্বা লম্বা দুটো পা ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে শূন্যে উড়ে চলে গেল।
দর্জি মনে মনে বললে—খিদে তো ক্রমেই বাড়ছে, পেট ক্রমেই খালি হচ্ছে। এবারে আমার হাতে যদি কেউ ধরা পড়ে তো তার হয়ে গেছে!
সেই সময় তার চোখে পড়ল একজোড়া বাচ্চা হাঁস পুকুরের জলে সাঁতার কেটে তার দিকে আসছে।
—ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছ তোমরা! বলে সে একটা হাঁসের বাচ্চাকে ধরলে। বাচ্চার গলাটা মুচড়ে দিতে যাচ্ছে সেই সময় শরবনের মধ্যে লুকোনো এক বুড়ি হাঁস প্যাঁক-প্যাঁক করে বিষম চিৎকার করে উঠল। ঠোঁট হাঁ করে সে তার দিকে সাঁতার কেটে আসতে লাগল। বললে—আমার বাচ্চাকে ছেড়ে দাও!
হাঁস বললে—মনে কর দেখি, তোমাকে যদি কেউ ধরে নিয়ে সাবাড় করে দেয় তোমার মায়ের মনে কী হবে?
দর্জি বললে—আর চেঁচাতে হবে না। তোমার বাচ্চা তুমি ফেরত নাও! এই বলে সে বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিল।
পিছন ফিরে সে দেখলে সে একটা বুড়ো গাছের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে,তার গুঁড়িতে প্রকাণ্ড এক কোটর—তার মধ্যে মৌমাছিরা ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। দর্জি বললে—ঐখানে আমি আমার সৎকর্মের পুরস্কার পাব। মধু খেয়ে আমি বল ফিরে পাব। কিন্তু সে কাছে যেতেই রানী মৌমাছি বেরিয়ে এসে তাকে শাসালেন—তুমি যদি আমার প্রজাদের গায়ে হাত দাও, আমার চাক ভাঙো, তাহলে আমাদের হুল তোমার গায়ে দশ হাজার আগুনে পোড়া ছুঁচের মত ফুটবে। আর যদি তুমি আমাদের শান্তিতে থাকতে দিয়ে নিজের পথে চলে যাও তাহলে পরে কোনো সময়ে আমরা তোমার উপকার করব।
দর্জি দেখল এখানেও কিছু পাওয়া যাবে না। —তিনটে থালা খালি আবার চতুর্থ থালাতেও কিছু নেই—এ কী রকম ভোজ? এই বলে সে তার উপোসী পেট নিয়ে কোনরকমে দেহটাকে টানতে টানতে শহরে গিয়ে পৌঁছল। তখন ঠিক বারোটা বাজছে আর সরাইয়ে খাবার তৈরি। দর্জি গিয়েই খেতে বসে গেল। পেট ভরলে সে বললে—এইবার আমি কাজে যাব। শহরে গিয়ে দর্জির দোকানে সে সহজেই একটা কাজ পেয়ে গেল। তার হাত ছিল খুব ভালো, তাই দেখতে দেখতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। সবাই চাইত তাদের নতুন কোটটা এই নতুন দর্জিকে দিয়ে করিয়ে নিতে। প্রতিদিন তার খ্যাতি বেড়ে চলত। শেষে রাজা তাকে রাজবাড়ির দর্জি হিসেবে নিযুক্ত করলেন।
ঠিক সেই দিন তার বন্ধু মুচি সে-ও রাজবাড়ির মুচি নিযুক্ত হল। মুচি দেখল, দর্জি। তার উপর তার আবার একজোড়া ভালো চোখ হয়েছে। দেখে তার মনে খোঁচা লাগল। মুচি ভাবলে—ও আমার উপর প্রতিশোধ নেবার আগেই ওকে ফাঁদে ফেলতে হবে।
সন্ধেবেলায় যখন কাজ শেষ হল, অন্ধকার করে এল, সেই সময় মুচি চুপিচুপি রাজার কাছে গিয়ে বললে—মহারাজ! এই দর্জি খালি বড়াই করে। ও বলছে যে রাজবংশের যে সোনার মুকুট পুরাকালে হারিয়ে গিয়েছিল তা ও এনে দিতে পারে।
রাজা বললেন—তাহলে আমি খুব খুশি হই। বলে তার পরদিন সকালে দর্জিকে ডেকে পাঠালেন। আর বললেন রাজবংশের পুরাকালের মুকুট তোমায় উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে আর যদি না পার তাহলে শহর ছেড়ে চলে যেও।
দর্জি ভাবলে—ওঃ, দুষ্ট লোক যা পায় তার চেয়েও বেশি ফিরিয়ে দেয়। রাজা যদি মনে করেন, যা কেউ পারে না তাই আমায় করতে হবে তাহলে বেশ, কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার কী, আজ এখনই আমি শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। সে তার পুঁটলি বেঁধে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু সিংদরজা পেরিয়ে তার মনে বড় দুঃখ হল শহর ছেড়ে চলে যেতে। যে শহরে তার ভাগ্যের এত উন্নতি হয়েছে তাকে ছেড়ে কেমন করে সে যায়? সে আস্তে আস্তে সেই পুকুরের কাছে গিয়ে হাজির হল যেখানে তার হাঁসদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সেই যে বুড়ি হাঁস যার বাচ্চাকে সে ছেড়ে দিয়েছিল সে তখন পাড়ে বসে ঠোঁট দিয়ে তার পালক সাফ করছে। হাঁস তাকে দেখেই চিনতে পারল। জিজ্ঞেস করল—মাথাটি নিচু করে অমন মুখ ভার করে চললে কোথায়? দর্জি বললে—আমার ভাগ্যে কী ঘটেছে তা বললে তুমি অবাক হবে না। এই বলে দর্জি যা হয়েছে সব বললে।
হাঁস বললে—এই? এ হলে তো আমরাই তোমায় সাহায্য করতে পারি। পুরাকালের মুকুট এই জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। পুকুরের নিচে এখনও আছে। আমরা তুলে এনে, দিচ্ছি। তুমি তোমার ঝাড়ন পাড়ে বিছিয়ে বসে থাকো একটু। বলে সে তার বারোটি বাচ্চাকে নিয়ে জলে ডুব মারল আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে উঠে এল জলের উপর তাই দুই ডানা বিছিয়ে। ডানার উপর সোনার মুকুটটি। বারোটি বাচ্চা গোল হয়ে ঘিরে ঠোঁট দিয়ে সেটিকে ধরে সাঁতার কাটতে কাটতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। পাড় অবধি সাঁতরে এসে তারা ঝাড়নের উপর মুকুটটিকে বসিয়ে দিলে। কী সুন্দর যে সেই মুকুট কেউ কল্পনাই করতে পারে না। তার উপর রোদ পড়ে লক্ষ-লক্ষ পদ্মরাগ মণির মত জ্বলে উঠল। দর্জি তার ঝাড়নের চার কোণ একসঙ্গে বেঁধে রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজা ভারি খুশি হয়ে দর্জির গলায় একটি সোনার হার ঝুলিয়ে দিলেন।
মুচি যখন দেখল প্রথম কোপটা লাগল না তখন সে আবার এক দুর্বুদ্ধি বার করলে। রাজাকে গিয়ে বললে—মহারাজ, দর্জি আবার বড়াই করতে শুরু করেছে। আস্পর্ধা দেখুন—বলছে, মোম দিয়ে আপনার এই সুন্দর প্রাসাদের একটা নকল তৈরি করতে পারে। যেখানে যা কিছু আছে সব।
রাজা দর্জিকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর প্রাসাদের একটা অবিকল ছাঁচ মোম দিয়ে তৈরি করতে হুকুম দিলেন। বললেন, যেখানে যা আছে—বাইরে হোক, ভিতরে হোক, আলগা হোক, আটকানো হোক সব চাই। যদি না পারো, যদি একটি পেরেকও এদিক-ওদিক হয়, তাহলে সারা জীবন তাকে মাটির নিচের বন্দীশালায় বন্দী থাকতে হবে।
দর্জি ভাবলে—শর্তগুলো ক্রমেই খারাপ হচ্ছে দেখছি। তার পুঁটলি পিঠে ফেলে সে বেরিয়ে পড়ল। যেতে যেতে সেই কোটরওয়ালা গাছের কাছে এসে মাথাটি নিচু করে বসল। মৌমাছিরা তাকে দেখতে পেয়ে বেরিয়ে এল। রানী মৌমাছি জিজ্ঞেস করলেন—তোমার কি ঘাড়ে ব্যথা হয়েছে নাকি? মাথা অমন নিচু করে রেখেছ কেন?
দর্জি বললে—হায় কপাল—ঘাড় ব্যথা হবে কেন? অন্য কিছু হয়েছে যাতে আমার মন খারাপ। বলে রাজা তাকে যা করতে বলেছেন মৌমাছিদের বললে।
মৌমাছিরা নিজেদের মধ্যে গুন-গুন করে কথাবার্তা আলোচনা শুরু করে দিলে। রানী মৌমাছি বললেন—এখন বাড়ি যাও। কাল ঠিক এই সময়ে এসো। সঙ্গে একটা বড় চাদর এনো। কোন ভাবনা কোরো না।
দর্জি ঘরে ফিরে গেল আর মৌমাছিরা দলে-দলে উড়ে চলল রাজপ্রাসাদের দিকে। জানলা দিয়ে গলে ভিতরে ঢুকে তারা প্রত্যেক ঘরে কী আছে, প্রত্যেক কোণে কী আছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তারপর ফিরে গিয়ে তারা এক মোমের প্রাসাদ গড়া শুরু করে দিলে। এমন তাড়াতাড়ি কাজ হতে লাগল যে কেউ দেখলে মনে করত মোমের প্রাসাদটা বুঝি মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠছে। সন্ধের মধ্যে সব তৈরি। পরদিন সকালে দর্জি যখন এল তখন সেখানে রাজপ্রাসাদের একটি সুন্দর মোমের ছাঁচ দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেয়ালের গায়ে একটি পেরেক কিংবা ছাদের একটি টালিও ভুল হয়নি। ভারি পেলব, ভারি নরম। বরফের মতো সাদা, মধুর মতো মিষ্টি গন্ধ। দর্জি সাবধানে সেটিকে তার চাদরে বেঁধে রাজার কাছে নিয়ে গেল।
রাজার মুখে কথা সরে না। তিনি সেটি নিয়ে তাঁর প্রাসাদের সবচেয়ে বড় হল-ঘরে সাজিয়ে দিলেন। আর দর্জিকে পুরস্কার দিলেন মস্ত একটা পাথরের বাড়ি।
মুচি কিন্তু ছেড়ে দিল না। আবার সে রাজার কাছে গেল। গিয়ে বললে—মহারাজ, রাজবাড়ির উঠোনে তো কোন ফোয়ারা নেই। দর্জি এই শুনে বড়াই করে বলেছে যে উঠোনের ঠিক মাঝখান দিয়ে সে ফোয়ারা উঠিয়ে দেবে। এক-মানুষ সমান উঠবে জল, আর তা হবে স্ফটিকের মতো।
রাজা দর্জিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন—তুমি যেমন বলেছ সেইমত কালকের মধ্যে যদি আমার উঠোনের মধ্যে ফোয়ারা উঠিয়ে না দিতে পার তাহলে জল্লাদ তোমার মাথা কেটে ফেলবে।
দর্জি বেচারা আর অপেক্ষা না করে সিংদরজা পেরিয়ে চম্পট দিলে—কারণ এবার জীবন-মৃত্যু সমস্যা। চোখ দিয়ে টস্-টস্ করে জল ফেলতে ফেলতে মহা দুঃখভরে যখন সে চলেছে সেই সময় সেই-যে ঘোড়ার বাচ্চা যাকে সে ছেড়ে দিয়েছিল সে মস্ত বড় খয়েরি রঙের ঘোড়াটি হয়ে তার সামনে লাফিয়ে এসে দাঁড়াল।
ঘোড়া বললে—তুমি যে উপকার করেছিলে তা শোধ দেবার সময় আমার এসেছে। তোমার কী দরকার তা আমি জানি, এখনই সাহায্য পাবে। চড়ো আমার পিঠে—তোমার মতো দুটোকে নিয়ে আমি এখন ছুটতে পারি। শুনে দর্জির সাহস ফিরে এল। একলাফে সে ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়ল আর ঘোড়া ছুটল সবেগে শহরের দিকে। একেবারে প্রাসাদের উঠোনের মাঝখানে। বিদ্যুতের মতো ঘোড়া তিন পাক ঘুরে এল। তিনবারের বার ঘোড়া ভীষণ তেজে মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাজ পড়ার এক প্রবল শব্দ। উঠোনের মাঝখানকার এক চাংড়া মাটি বিষম বেগে কামানের গোলার মতো আকাশে লাফিয়ে উঠে প্রাসাদ পার হয়ে চলে গেল। ঠিক তার পরেই এক জলের ফোয়ারা উঠল। ঘোড়ার পিঠে মানুষ চড়ে থাকলে যত উঁচু হয় তত উঁচু। ফটিকের মতো পরিষ্কার—তার উপর রোদের আলো পড়ে নাচতে লাগল। রাজা তাই দেখে আশ্চর্য হয়ে উঠে দাঁড়ালেন আর এগিয়ে গিয়ে সকলের সামনে দর্জিকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করলেন।
কিন্তু দর্জির কপালে সুখ বেশিদিন রইল না। রাজার অনেক মেয়ে ; প্রত্যেকটি মেয়ে অপরটির চেয়ে সুন্দর। এদিকে রাজার কোনো ছেলে নেই। হিংসুটে মুচি আবার রাজার কাছে গিয়ে বললে, মহারাজ, দর্জি এখনও তার দর্প ছাড়েনি। সে বড়াই করে বলেছে সে ইচ্ছে করলেই মহারাজের জন্যে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি খোকা নিয়ে আসতে পারে।
রাজা দর্জিকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন—তুমি যদি ন-দিনের মধ্যে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে আমাকে একটি খোকা এনে দিতে পারো, তাহলে আমার বড় মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব।
দর্জি ভাবলে—পুরস্কারটা তো মস্ত। পুরস্কারের জন্যে খুবই চেষ্টা করা দরকার। কিন্তু চেরি ফলগুলি গাছের বড্ড উপরে। ফল পাড়তে গাছে চড়লে ডাল ভেঙেই না পড়ে যাই।
সে বাড়ি গিয়ে তার কাজের টেবিলের উপর পা গুটিয়ে বসে ভাবতে লাগল, কী করা যায়! শেষে ভেবে বললে—কিছুই করা যাবে না। বরং চলে যাই এখান থেকে। এখানে কোনমতেই শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না। পুঁটলিটি বেঁধে সিংদরজার দিকে চলল। মাঠে পৌঁছে তার পুরোনো বন্ধু সারসের সঙ্গে দেখা। সারস তার দিকে এগিয়ে এসে বললে—পিঠে দেখছি ঝুলি। শহর ছেড়ে যাচ্ছ? কেন, কী ব্যাপার?
দর্জি তখন তাকে বললে, রাজা কী চেয়েছেন।
—এ তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়! কাজেই আমার ভাগ্যই খারাপ।
সারস বললে—এই? এর জন্যে তোমার মাথার চুল পাকতে দিও না। আমি তোমায় সাহায্য করব। বহুকাল ধরে আমি কাঁথায় করে মানুষের বাচ্চা নিয়ে শহরে দিয়ে আসছি। কাজেই এবার একটা রাজার বাচ্চা কুয়ো থেকে তুলে শহরের রাজবাড়িতে পৌঁছে দেওয়া আমার পক্ষে একটুও শক্ত হবে না। বাড়ি গিয়ে স্থির হয়ে বোসো। আজ থেকে ন-দিনের দিন রাজপ্রাসাদে গিয়ে থেকো। আমি আসব।
দর্জি বাড়ি গেল। ন-দিন পরে যখন সময় হল তখন গেল রাজবাড়িতে। একটু পরে উড়তে-উড়তে সারস এসে জানলায় ঠোঁট দিয়ে টোকা দিলে। দর্জি জানলা খুলতেই লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে সারস শ্বেত পাথরের মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে এগিয়ে এল। তার ঠোঁটে একটি শিশু। স্বর্গের দেবদূতের মতো সুন্দর। রানীর দিকে তার ছোট-ছোট হাত বাড়িয়ে। সারস তাঁর কোলে খোকাটিকে নামিয়ে দিতেই রানী তাকে আদর করে চুমু খেলেন আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। উড়ে চলে যাবার আগে সারস তার পিঠ থেকে একটি ছোট থলি নামিয়ে রানীর হাতে দিয়ে চলে গেল। তার মধ্যে রঙিন লজঞ্চুস ভরা ছোট ছোট কাগজের মোড়ক ছোট ছোট রাজকন্যাদের জন্যে। বড়-রাজকন্যা লজঞ্চুস পেলেন না, পেলেন ফুর্তিবাজ দর্জিকে তাঁর বর হিসেবে। দর্জি বললে—আমার মনে হচ্ছে আমিই সবচেয়ে বড় পুরস্কার পেলুম।
বিয়ের উৎসবে দর্জি যে জুতো পরে নাচবে সেই জুতো মুচিকেই করে দিতে হল। তারপরে মুচির উপর হুকুম হল শহর ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যেতে। বনের দিকে যেতে যেতে পথে পড়ল সেই ফাঁসিকাঠ। রাগে দ্বেষে আর সারাদিনের গরমে ক্লান্ত হয়ে সেইখানেই সে শুয়ে পড়ল। যখন সে চোখ বুজে ঘুমোতে যাবে, কাকা দুটি ফাঁসি কাঠে ঝোলা মানুষ দুটির মাথা থেকে উড়ে এসে মুচির চোখ দুটি খুবলে তুলে নিলে। চোখের যন্ত্রণায় পাগল হয়ে সে বনের মধ্যে ছুটতে লাগল। হয়ত এতদিনে না খেতে পেয়ে মরেই গেছে। কারণ কেউ আর তাকে দেখেনি, তার কথা শোনেওনি।