Chapter Index

    অনেক কাল হয়ে গেল—প্রায় দু-হাজার বছর আগের কথা। সেই সময় একটি লোক ছিলেন মস্ত ধনী। আর ছিলেন তাঁর এক পরম ধার্মিক স্ত্রী। তাঁদের কোন ছেলেপুলে ছিল না। তাঁদের বড় ইচ্ছে সন্তান হোক। দিনরাত ভগবানের কাছে তাই প্রার্থনা করতেন কিন্তু তবু তাঁদের কোল খালিই পড়ে থাকত। তাঁদের বাড়ির সামনের উঠোনে ছিল জুনিপার গাছ। একদিন শীতের সময় গিন্নিটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খাবেন বলে একটি আপেল কাটছেন, কাটতে কাটতে তাঁর হাত কেটে গেল আর তাই থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল বরফের উপর। তিনি সেই রক্তের ফোঁটার দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন—হায়! আমার যদি একটি সন্তান থাকত যে রক্তের মতো লাল আর বরফের মতো সাদা! এই বলতেই তাঁর মন হঠাৎ আনন্দে ভরে গেল। তাঁর মনে হল, তাই হতে চলেছে।

    এক মাস হয়ে যেতে বরফ গলে গেল। দু-মাস যেতে চারিদিক সবুজ হয়ে উঠল। তিন মাসে মাটি ফুলে ভরে গেল। চার মাস যেতে বনের গাছপালা ঘন হয়ে উঠল। সবুজ ডালপালার গায়ে পাতার মধ্যে কোন ফাঁক রইল না। পাখির গানে বন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল, গাছ থেকে ফুল ঝরে-ঝরে মাটিতে পড়ল। পাঁচ মাস গেলে তিনি জুনিপার গাছের তলায় এসে দাঁড়ালেন। জুনিপারের মিষ্টি গন্ধে তাঁর বুক নেচে উঠল, তিনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। আনন্দ রাখার আর জায়গা রইল না। ছ-মাস কেটে যেতে ফলগুলি বড় বড় হয়ে উঠল। গিন্নিটিও একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলেন। সাত মাসে তিনি জুনিপার গাছের ছোট-ছোট ফলগুলি পেড়ে লোভীর মত খেলেন। খেয়ে তাঁর শরীর খারাপ লাগল, মনে দুঃখের ছোঁয়া লাগল। আট মাসে তিনি স্বামীকে ডেকে কেঁদে বললেন—আমি যদি মরি, আমায় জুনিপার গাছের তলায় পুঁতে রেখো। তারপর তিনি বেশ শান্ত হলেন, সুখী হলেন। আর এক মাস পরে তাঁর একটি সন্তান হল বরফের মত সাদা, রক্তের মতো লাল। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর এত সুখ হল যে তিনি মারা গেলেন।

    তাঁর স্বামী তাঁকে জুনিপার গাছের নিচে কবর দিলেন। দিয়ে অধৈর্য হয়ে কাঁদতে লাগলেন। একটু পরে তিনি শান্ত হলেন ; কাঁদলেও তা সহ্য হল ; আর তারও কিছুদিন পরে তিনি আর-একটি বিয়ে করলেন।

    নতুন বৌয়ের হল একটি মেয়ে। প্রথম বৌয়ের ছিল ছেলে—বরফের মতো সাদা, রক্তের মতো লাল। নতুন বৌ যখন তাঁর মেয়ের দিকে তাকালেন তাঁর মন স্নেহে ভালোবাসায় ভরে গেল। কিন্তু তারপর যেই তিনি ছেলেটির দিকে তাকালেন, তাঁর মনে হল যেন বুকে একটা ছুরি এসে বিঁধল। তিনি বুঝলেন সে তাঁর মেয়ের পথের বাধা। সব সময় তাঁর চিন্তা হল কী করে তাঁর মেয়ে তার বাপের সমস্ত সম্পত্তি পেতে পারে। ভাবতে ভাবতে তাঁর মন কুচিন্তায় ভরে গেল। তিনি ছেলেটির উপর রাগ করতে থাকলেন, চড়চাপড় প্রায়ই মারতে লাগলেন। ছেলেটি শেষে সারাদিন ভয়ে-ভয়ে কাটাতে লাগল। ইস্কুল থেকে ফেরবার পর বাড়িতে সে শান্তিতে থাকতে পেত না।

    একদিন নতুন গিন্নি উপরে তাঁর নিজের ঘরে গেছেন, তাঁর ছোট্ট মেয়েটিও গেছে। মেয়েটি বললে—মা, আমায় একটা আপেল দাও না!

    —এই নাও দিচ্ছি। বলে তার মা সিন্দুক খুলে একটি সুন্দর আপেল দিলেন। সিন্দুকের ডালাটি ছিল প্রকাণ্ড আর ভারি। তাতে মস্ত একটা লোহার তালা ঝোলানো।

    ছোট মেয়েটি বললে—মা, দাদাকে একটা দেবে না?

    শুনে গিন্নি রেগে গেলেন। বললেন—হ্যাঁ, যখন সে ইস্কুল থেকে ফিরবে।

    সেই সময় জানলা দিয়ে যেই না দেখা ছেলেটি ইস্কুল থেকে ফিরছে, তিনি মেয়ের হাত থেকে আপেল কেড়ে নিয়ে বললেন—তোমার দাদার সামনে তুমি আপেল খাবে না। বলে আপেলটি সিন্দুকে পুরে সিন্দুকের ঢাকা বন্ধ করে দিলেন।

    ছেলেটি ঘরে ঢুকতে গিন্নির মাথায় শয়তানি চাপল। তিনি মিষ্টি করে ছেলেটিকে বললেন—একটি আপেল খাবে বাছা? ছেলেটি বললে—হ্যাঁ, খাবো মা, দাও। গিন্নি বললেন—তবে এসো আমার সঙ্গে। বলে সিন্দুকের দরজা খুলে ধরে বললেন—নিজে একটা বেছে নাও। ছেলেটি ঘাড় নিচু করে যেই একটা ফল নিতে যাবে অমনি তিনি করলেন কী—দুম্‌ করে সিন্দুকের ভারি ঢাকা ফেলে দিলেন, আর বেচারির মাথাটি কেটে আপেলের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

    গিন্নির তখন বেজায় ভয় হল। তিনি ভাবতে লাগলেন কী করে লোকেদের বিশ্বাস করানো যায় যে কাজটা তিনি করেননি। উপরে গিয়ে তাঁর আলমারির টানা দেরাজ খুলে একটি সাদা রুমাল বার করলেন। মুণ্ডটি নিয়ে গলার উপর বসালেন। রুমাল দিয়ে এমন করে ঢেকে দিলেন যাতে কিছুই দেখা না যায়। তারপর তাকে দরজার সামনে একটি চৌকিতে বসিয়ে তার হাতে একটি আপেল দিয়ে দিলেন।

    মারলিন্‌খেন রান্নাঘরে এসে মাকে বললে—মা, দাদা দরজার কাছে বসে আছে। তার মুখটা একেবারে সাদা। তার হাতে একটা আপেল। আমি আপেলটা চাইলাম কিন্তু দাদা কোনো উত্তর দিল না। আমার কিরকম ভয় করল।

    গিন্নি উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে একপাত্র গরম জল নাড়ছিলেন, তিনি বললেন—তোমার দাদার কাছে ফিরে যাও। যদি সে যখন কথার উত্তর না দেয় তার গালে এক থাপ্পড় মারবে।

    কাজেই মারলিন্‌খেন তার কাছে গিয়ে বললে—দাদা, আপেলটা দাও। কিন্তু সে কোনো উত্তর দিলে না, মারলিন্‌খেন মারল তার গালে এক থাপ্পড়। অমনি তার মাথাটা গড়িয়ে পড়ল। মারলিন্‌খেন তাই দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে বললে—মা, আমি দাদার মুণ্ডু খসিয়ে দিয়েছি! এই বলে সে কী কান্না! কেউ তাকে শান্ত করতে পারে না।

    মা বললেন—মারলিন্‌খেন, তুমি করলে কী! কিন্তু চুপ করে থাকো, কাউকে কিছু বোলো না। কী আর করা যাবে, আমি ওকে দিয়ে কালো পুডিং বানিয়ে দিচ্ছি। বলে গিন্নি ছেলেটিকে কাঠের উপর ফেলে কুচি-কুচি করে কেটে হাঁড়িতে চড়িয়ে কালো পুডিং রেঁধে ফেললেন। মারলিন্‌খেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল আর তার এত চোখের জল হাঁড়ির মধ্যে গিয়ে পড়ল যে আর নুন দেবার দরকার হল না।

    তারপর বাবা বাড়ি ফিরলেন। খেতে বসে বললেন—খোকা কোথায়? মা প্রকাণ্ড একথালা কালো পুডিং নিয়ে এসে পরিবেশন করলেন। মারলিন্‌খেন শুধু কাঁদতে লাগল। বাবা আবার বললেন—খোকা কোথায়?

    মা বললেন—ও, সে গেছে অনেক দূরে তার মায়ের ঠাকুর্দার কাছে। সেইখানেই কিছুদিন থাকবে।

    —কী করতে গেল সেখানে? আমার কাছ থেকে তো কই বিদায় নিয়ে গেল না!

    —ও, সে যেতে চাইল। আমায় জিজ্ঞেস করলে দেড় মাসের মতো সেখানে থাকতে পারবে কী না। সেখানে ওর বেশ ভালোই যত্ন হবে।

    —না, আমার কেমন খারাপ লাগছে। আশা করি কিছু মন্দ হবে না। আমার কাছ থেকে ওর বিদায় নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। এই বলে তিনি খেতে আরম্ভ করে বললেন—মারলিন্‌খেন, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার দাদা নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তারপর তিনি বললেন—বাঃ, গিন্নি কী চমৎকার রেঁধেছ! আমায় আর-একটু দাও। যত তিনি খেতে লাগলেন ততই আরো চাইতে লাগলেন। শেষে বললেন—আরো দাও, আরো দাও। তোমরা এর কিছুই পাবে না। —কেমন যেন মনে হচ্ছে সবটাই আমার! এইভাবে তিনি কালো পুডিং খেয়েই চললেন আর হাড়গুলি টেবিলের তলায় ফেলতে লাগলেন। সমস্তটা যখন খাওয়া হয়ে গেল মারলিন্‌খেন তার নিজের আলমারির কাছে গিয়ে সব-নিচের দেরাজ থেকে তার সবচেয়ে ভালো রেশমের রুমাল বার করে টেবিলের তলা থেকে সব হাড়গুলি কুড়িয়ে সেই রুমালে বেঁধে ফেলল। তারপর দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। অমনি জুনিপার গাছটি নড়ে উঠল। তার ডালপালা একবার ফাঁক হতে লাগল আবার বন্ধ হতে থাকল—ঠিক যেন কে আনন্দে হাততালি দিচ্ছে। সেইসঙ্গে মনে হল যেন গাছ থেকে একটা কুয়াসা উঠছে। কুয়াসার ঠিক মাঝখানে যেন একটা আগুন। সেই আগুন থেকে একটি সুন্দর পাখি উড়ে বেরিয়ে গেল মিষ্টি সুরে গান করতে করতে। পাখিটি যেই আকাশে উড়ে মিলিয়ে গেল অমনি জুনিপার গাছ আগে যেমন ছিল তেমনি হয়ে গেল আর মারলিন্‌খেনের হাতে দেখা গেল রুমাল বা হাড় কিছুই নেই। মারলিন্‌খেনের মন কিন্তু আনন্দে আর খুশিতে ভরে উঠল—যেন তার দাদা তখনও বেঁচে রয়েছে। সে নাচতে নাচতে বাড়িতে ঢুকে বসে গেল তার খাবার খেতে।

    কিন্তু পাখিটি উড়তে উড়তে এক স্যাকরার বাড়িতে গিয়ে বসে গান গাইতে লাগল—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,
    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।
    মারলিন্‌খেন বোন ভালো
    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,
    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    স্যাকরা তার দোকানে বসে সোনার চেন তৈরি করছিল, সেই সময় তার ছাদ থেকে পাখির গান কানে এল। তার মনে হল, ভারি সুন্দর গাইছে তো! সে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু যেই চৌকাঠ পার হতে যাবে অমনি তার পা থেকে একটা চটি খুলে পড়ে গেল। কিন্তু সে এক পায়ে চটি আর এক পায়ে শুধু মোজা পরে রাস্তার মাঝ অবধি চলে গেল। তার কোমরে গামছা বাঁধা, এক হাতে সোনার চেন অন্য হাতে সাঁড়াশি। রাস্তায় রোদ পড়ে চক্‌চক্‌ করছে। সে সোজা এগিয়ে গিয়ে পাখির কাছে দাঁড়িয়ে বললে—পাখি, কী সুন্দর তুমি গাও! আর-একবার ঐ গানটি গাও তো! পাখি বললে—না। কিছু না দিলে অমনি-অমনি আমি দু-বার গান গাই না। সোনার চেনটা আমায় দিয়ে দাও, তাহলে আমি আবার তোমার জন্যে গাইব।

    স্যাকরা বললে—এই নাও সোনার চেন। আর-একবার গাও তাহলে সেই গানটা। তখন পাখিটি উড়ে এসে তার ডান পায়ে করে সোনার চেনটি নিয়ে স্যাকরার সামনে বসে গেয়ে চলল—

    মা-টি মেরে মেরে ফেলে বেশ,
    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।
    মারলিন্‌খেন বোন ভালো
    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,
    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    তারপর পাখিটি এক মুচির দোকানে গিয়ে তার ছাদে বসে গাইল—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,
    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।
    মারলিন্‌খেন বোন ভালো
    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,
    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    মুচি শুনে গায়ের কোট ফেলে রেখেই বাইরে ছুটে এল। ছাদের দিকে তাকালো। পাছে রোদের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় তাই হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে বললে— পাখি, কী সুন্দর গাও তুমি! তারপর সে তার দরজার দিকে ফিরে বললে—মুচি-বৌ বাইরে এস। একটি পাখি এসেছে। দেখ কী সুন্দর সে গায়! তারপর সে তার ছেলেদের ডাকল, তার সাকরেদদের ডাকল, আর সব ছেলেমেয়েকে ডাকল। তারা সবাই রাস্তায় এসে ঘাড় উঁচু করে পাখিটিকে দেখতে লাগল। তার লাল আর সবুজ পালক দেখতে লাগল। সোনার গলা দেখতে লাগল। তারার মতো তার চোখ দেখতে লাগল। মুচি-বৌ বললে—পাখি! আর-একবার সেই গানটি গাও। পাখি বললে—না। অমনি-অমনি আমি দু-বার গান গাই না। কিছু দিতে হবে।

    মুচি বললে—বৌ, যাও তো ছাদের ঘরে। উপরের তাকে একজোড়া লাল জুতো আছে। নিয়ে এস।

    মুচি-বৌ গিয়ে জুতো নিয়ে এল। মুচি বললে—এই নাও। আবার সেই গানটা গাও। পাখিটি উড়ে এসে তার বাঁ পায়ে করে জুতোটি নিয়ে উড়ে গিয়ে ছাদে বসল আর গান ধরল—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,
    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।
    মারলিন্‌খেন বোন ভালো
    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,
    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    গান গাওয়া শেষ হয়ে গেলে সে উড়ে চলে গেল । ডান পায়ে তার সোনার চেন, বাঁ পায়ে জুতোজোড়া। উড়ে অনেকদূর গিয়ে সে বসল এক চাকী-কলে। চাকী-কলে চাকা চলেছে—কিলিপ্‌ কেলাপ্‌ খিলিপ্‌ খেলাপ্‌ কিলিপ্‌ কেলাপ্‌, আর কলের কুড়িজন মজুর পাথর কাটছে খট্‌ খটাস্ কট্‌ কটাস্‌ খট্‌ খটাস্। পাখি উড়ে গিয়ে কলের সামনে এক লেবুগাছে বসে গাইলে—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,

    অমনি একজন মজুরের কাজ বন্ধ হয়ে গেল।

    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।

    আর দু-জন মজুর কাজ ফেলে শুনতে লাগল।

    মারলিন্‌খেন বোন ভালো

    আরো চার জনের কাজ বন্ধ।

    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—

    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,

    আটজন মজুর তখনও হাতুড়ি নিয়ে কাজ করছে।

    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে

    পাঁচজন।

    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—

    শুধু একজন।

    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    সে-ও কাজ বন্ধ করে গানের শেষটা শুনলে। সে বললে—পাখি! কী সুন্দর গাও তুমি! আমাকেও শোনাও গানটা। গাও আর একবার আমার জন্যে।

    পাখি বললে—না। অমনি-অমনি দু-বার আমি গান গাই না। জাঁতাকলের পাথরটা আমায় দাও, তাহলে আমি গাইব।

    সে বললে—পাথরটা যদি একলা আমার হত তোমায় দিয়ে দিতুম।

    আর সকলে বললে—ও যদি আর-একবার গায় আমরা সবাই মিলে ওকে পাথরটা দিয়ে দেব।

    পাখি তখন নিচে নেমে এল আর কুড়ি জন মজুর লোহার ডাণ্ডার চাড় দিয়ে পাথরটাকে ঠেলে তুললে। পাখি পাথরের গর্তের মধ্যে দিয়ে মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে গলায় পাথরটা পরে নিলে ঠিক যেন ছোট্ট একটি গলাবন্ধের মতো। তারপর উড়ে গিয়ে গাছে বসে গাইতে লাগল—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,
    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।
    মারলিন্‌খেন বোন ভালো
    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,
    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    গান শেষ করে সে ডানা মেলল। ডান পায়ে তার সোনার চেন, বাঁ পায়ে জুতো আর গলায় জাঁতাকলের পাথর। তারপর সে উড়ে চলে গেল অনেক দূরে তার বাবার বাড়িতে।

    ঘরে তার বাবা, মা আর মারলিন্‌খেন বসে খাচ্ছেন। বাবা বললেন—আজকে আমার মনটা কেমন হাল্কা লাগছে। কেমন আনন্দ হচ্ছে।

    মা বললেন—আমার কিন্তু বড় অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন একটা বড় ঝড় আসছে!

    মারলিন্‌খেন বসে বসে শুধু কাঁদতে লাগল। সেই সময় পাখিটি উড়ে এসে ছাদে বসল।

    বাবা বললেন—সত্যিই আমার এত আনন্দ হচ্ছে! বাইরে রোদের আলো কী সুন্দর! মনে হচ্ছে যেন কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে এখনই আমার দেখা হবে।

    গিন্নি বললেন—আমার কিন্তু মনে কেমন উদ্বেগ হচ্ছে। আমার দাঁত কাঁপছে ঠক্‌-ঠ্‌ক! মনে হচ্ছে আমার শিরার মধ্যে আগুন ঢুকেছে! বলে গা থেকে জামা খুলে ফেললেন। মারলিন্‌খেন এক কোণে বসে তার খাবার থালা সুমুখে রেখে কেঁদেই চলল। পাখিটি উড়ে এসে জুনিপার গাছে বসে গাইল—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,

    গিন্নি অমনি তাঁর কানে আঙুল দিলেন, চোখ বুজে ফেললেন যাতে কিছু দেখতে বা শুনতে না হয়। কিন্তু তাঁর কানের মধ্যে ঝড়ের মত কিসের গর্জন শোনা যেতে লাগল আর চোখ যেন বিদ্যুতের ঝিলিকে পুড়ে যেতে লাগল।

    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।

    কর্তা বললেন—গিন্নি, কী সুন্দর পাখিটি! এমন মিষ্টি করে গাইছে! রোদের তাপ আজ কী মধুর, আর কোথা থেকে যেন দালচিনি বনের সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে!

    মারলিন্‌খেন বোন ভালো

    মারলিন্‌খেন তার হাঁটুতে মাথা রেখে অঝোর ঝরে কেঁদে চলল। বাবা বললেন—আমি বাইরে গিয়ে কাছ থেকে দেখব পাখিটিকে। মা বললেন—ওগো যেও না, যেও না! আমার মনে হচ্ছে সারা বাড়ি কাঁপছে! বাড়িতে যেন আগুন লেগেছে! কিন্তু বাবা বাইরে বেরিয়ে গিয়ে পাখিটিকে দেখতে লাগলেন।

    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,
    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    বলে পাখিটি সোনার চেনটি ফেলে দিল। আর সেটি ঠিক গিয়ে পড়ল কর্তার গলায়। গলার মাপের সঙ্গে চেনের মাপ একেবারে মিলে গেল। তিনি তখন বাড়ির ভিতরে গিয়ে বললেন—দেখ কী সুন্দর পাখি, কেমন চমৎকার সোনার চেন, আমায় উপহার দিয়েছে! কিন্তু গিন্নি ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ঘরের মেঝেয় তিনি পড়ে গেলেন। মাথা থেকে টুপি খুলে পড়ে গেল। তখন পাখিটি আবার গাইল—

    মা-টি মোরে মেরে ফেলে বেশ,

    —ওঃ! মাটির তলায় হাজার হাত নিচে গিয়ে যদি লুকোতে পারতুম যাতে ওটা আর শুনতে না হয়!

    বাবা মোরে খেয়ে করে শেষ।

    গিন্নি আবার পড়ে গেলেন যেন মড়ার মতো!

    মারলিন্‌খেন বোন ভালো

    মারলিন্‌খেন বললে—যাই আমি গিয়ে দেখি পাখিটি আমায় কিছু দেয় কি না! বলে সে বাইরে বেরিয়ে গেল—

    হাড়গুলি তুলে নিয়ে গেল—
    মুড়ে নিয়ে রেশমি রুমালে,

    গেয়ে পাখিটি মারলিন্‌খেনের কাছে জুতোজোড়া ফেলে দিলে।

    জুনিপার তলেতে দাঁড়ালে
    যা ঘটে না ঘটিল তাহাই—
    পাখি রূপে উড়ি আমি তাই।

    মারলিন্‌খেনের মনটা হাল্কা হয়ে গেল, তার ফুর্তি ফিরে এল। সে পায়ে নতুন লাল জুতোজোড়া পরে বাড়ির চারিদিকে নেচে বেড়াতে লাগল।

    মারলিন্‌খেন বললে—যখন বাইরে বেরোচ্ছিলুম তখন কত আমার মন খারাপ ছিল। যখন ফিরলুম, মন একেবারে ভালো হয়ে গেছে। ভারি সুন্দর পাখিটি—কেমন চমৎকার জুতো দিল আমায়!

    গিন্নি লাফিয়ে উঠলেন। তাঁর মাথার চুল সব খাড়া হয়ে উঠল। তিনি বললেন—আমার মনে হচ্ছে প্রলয় আসছে! আমিও বাইরে যাব, গিয়ে দেখব আমার মন ভালো হয়ে যায় কি না! বলে তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অমনি ধপাস্‌ করে এক শব্দ। পাখি জাঁতাকলের পাথর গিন্নির মাথায় ফেলে দিলে। আর তার চাপে তিনি থেঁতলে গেলেন।

    বাবা আর মারলিন্‌খেন শব্দ শুনে বাইরে গিয়ে দেখলেন, সেখান থেকে ধোঁয়া আর আগুনের শিখা বেরোচ্ছে লক্‌লক্‌ করে। আগুন আর ধোঁয়া মিলিয়ে যেতেই দেখা গেল, মারলিন্‌খেনের ছোট্ট দাদাটি সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    তারা তিন জনে হাত-ধরাধরি করে মনের সুখে বাড়ির মধ্যে ঢুকে খেতে বসে গেল।

    টীকা