Chapter Index

    এক গরিব কাঠুরে তার স্ত্রী আর তিন মেয়েকে নিয়ে এক নিরালা বনের ধারে ছোট একটি কুটিরে থাকত। একদিন সকালবেলা যখন সে কাজে যাচ্ছে তার স্ত্রীকে বললে— দুপুরে আমার খাবার নিয়ে বড়খুকিকে বনের মধ্যে পাঠিয়ে দিও। যাতে তার পথ হারিয়ে না যায়, আমি একথলি বজরা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, সেগুলি রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়ে যাব।

    সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে, বনের চুড়োয় পড়েছে তার কিরণ, সেই সময় বড়খুকি বড় একজগ সূপ আর তার সঙ্গে কিছু রুটি নিয়ে বাবাকে খাওয়াতে চলল। কিন্তু চড়াই পাখি আর ফিঞ্চ্‌ পাখি আর যত রাজ্যের পাখি তারা সব বজরা খেয়ে ফেলেছিল। খুকি তাই পথ খুঁজে পেল না।

    যেতে যেতে যেতে যেতে সূর্য গেল ডুবে। রাত নেমে এল। কোথাও সে আশ্রয় পেল না। অন্ধকারে গাছের ঝরঝর শব্দ আর রাতের প্যাঁচার চ্যাঁচানি শুনে বেচারি খুকিটির বড় ভয় করতে লাগল। সেই সময় হঠাৎ সে দেখতে পেল গাছের মধ্যে দিয়ে দূরে কিসের একটা আলো মিট্‌-মিট্‌ করছে। সে ভাবলে— ওখানে নিশ্চয় মানুষ আছে। ওরা নিশ্চয় আমায় রাতে থাকবার জন্যে আশ্রয় দেবে।

    সে তখন আলোর দিক লক্ষ করে চলতে লাগল। একটু পরেই এসে পৌঁছল একটা বাড়ির কাছে, তারই জানলা দিয়ে আলো আসছিল।

    দরজায় ধাক্কা দিতে এক কর্কশ গলার শব্দ শোনা গেল— ভিতরে এস। খুকিটি একটি সরু অন্ধকার হলে ঢুকে একটি ঘরের দরজায় টোকা দিলে। সেই একই গলা শোনা গেল– ভিতরে এস। দরজা খুলে সে দেখে একজন বুড়ো মানুষ একটা টেবিলের সামনে বসে রয়েছে। থুতনিটা হাতের উপর রাখা। সাদা দাড়ি প্রায় মাটি পর্যন্ত লুটোনো। উনুনের কাছে তিনটি প্রাণী শুয়ে আছে, একটি মোরগ, একটি মুরগী আর একটি ছিটওয়ালা গরু। মেয়েটি তার বিপদের কথা বুড়ো লোকটিকে বলে জিজ্ঞেস করলে, একরাতের মত সে আশ্রয় পেতে পারে কি না। বুড়ো লোকটি তার কথার জবাব না দিয়ে জন্তুগুলির দিকে ফিরে বললে—

    মুরগী মোরগ ছিটে গরু সোনা,
    বল ওকে রাখব কি রাখব না?

    জন্তুগুলি আওয়াজ করে জানান দিলে যে হ্যাঁ, ওকে রাখা যেতে পারে। বুড়োলোকটি বললে— বেশ তবে থাকো। এখানে তুমি সবকিছুই পাবে। যাও রান্নাঘরে গিয়ে আমাদের জন্যে কিছু রান্না কর তো।

    মেয়েটি দেখল, ঘর-ভর্তি নানা জিনিস। সে বেশ ভালো করে রান্না করল। তারপর টেবিলে খাবার সাজিয়ে বুড়োর সঙ্গে বসে পেট ভরে খেল। কিন্তু একবারও সে জন্তুগুলির কথা ভাবল না। যখন তার খাওয়া হয়ে গেল সে বললে— আমি এবার জিরোতে চাই। বিছানাটা কোথায়? তার উত্তরে শোনা গেল—

    নিজের পেটটি ভরলে তুমি মেয়ে,
    অবোধ জন্তুগুলির দিকে দেখলে নাকো চেয়ে!
    বিছানা তো পাতা,
    দাও এলিয়ে মাথা,
    কিন্তু কোথায় কাটবে তোমার রাত্রি জানো না তা!

    মেয়েটি কথাগুলি শুনেও শুনল না। বুড়ো তাকে উপরে যেতে বললে। সেখানে দুটি ঘর আছে। প্রত্যেক ঘরে একটি করে বিছানা। বুড়ো বললে— বালিস ঝেড়ে বিছানা তৈরি করে রেখো। মেয়েটি তাড়াতাড়ি উপরে উঠে গেল। নিজের বিছানাটা করল আর বুড়োর কথা না ভেবেই নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল অঘোরে। একটু পরে বুড়ো নিজের ঘরে এসে দেখে তার বিছানা করা হয়নি। সে খানিক মাথা নাড়ল, তারপর যেখানে মেয়েটি ঘুমোচ্ছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল। সেই ঘরের মেঝেতে এক চোরা দরজা ছিল, সেই দরজা খুলে খাটশুদ্ধ মেয়েটিকে মাটির নিচের ঘরে নামিয়ে দিয়ে চোরা দরজা বন্ধ করে দিলে।

    এদিকে কাঠুরে বেশ দেরি করে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরল। ফিরে এসে কাঠুরেনীকে বকতে লাগল সারাদিন তাকে উপোস করিয়ে রেখেছে বলে। কাঠুরেনী বললে— আমি তো বড়খুকির হাতে খাবার দিয়ে পাঠিয়েছিলুম। নিশ্চয় পথ হারিয়েছে। এখনও সে ফিরে আসেনি— কাল ফিরবে হয়ত।

    পরদিন দিনের আলো ফোটবার আগেই কাঠুরেকে বনে যেতে হল। সে বৌকে বলে গেল মেজমেয়ের হাতে তার দুপুরের খাবার পাঠিয়ে দিতে।

    —এবারে একথলি তিসির বিচি নিয়ে যাব। বিচিগুলি বজরার চেয়ে বড়। রাস্তায় ছড়িয়ে দিলে দেখতে পাবে— আর পথ হারাবে না।

    কিন্তু দুপুরে মেজমেয়ে যখন বাপের খাবার নিয়ে বেরোলো সে দেখল একটিও তিসির বিচি পড়ে নেই। বনের পাখিরা আগের দিনেরই মতো খুঁটে খেয়ে ফেলেছে। সেও সারাদিন ঘুরে মরল, শেষে সন্ধের সময় সেই বুড়োর বাড়িতে গিয়ে রাতের খাবার আর আশ্রয় পেল। সেও জন্তুদের খাওয়ানোর কথা ভাবল না, বুড়োর বিছানা করার কথাও ভাবল না। কাজেই রাত্রে সে যখন ঘুমিয়ে পড়ল বুড়ো এসে মেঝের চোরা দরজা খুলে মাটির নিচের ঘরে তাকে নামিয়ে দিলে তার দিদিরই মতো।

    তৃতীয় দিন সকালে কাঠুরে তার স্ত্রীকে বললে— আজ আমার খাবার নিয়ে ছোটখুকিকে পাঠিয়ে দিও। ও বেশ বাধ্য আর লক্ষ্মী। ওর দিদিদের মতো ও পথ হারাবে না। দিদি দুটো মৌমাছিরা চাক বাঁধবার সময় যেমন চারদিকে উড়ে বেড়ায় তেমনি উড়তে ভালোবাসে।

    কাঠুরেনী কিন্তু রাজি হল না। সে বললে— না, দুটি মেয়ে যখন গেছে তখন আমি যেটিকে সবচেয়ে ভালোবাসি তাকেই বা হারাবো কেন?

    কাঠুরে বললে— ভয় পেও না, ছোটখুকি রাস্তা হারাবে না। ওর বেশ বুদ্ধি, বেশ জ্ঞান। তাছাড়া এবারে আমি একবস্তা মটর নিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে দেব। তিসির বিচির চেয়ে অনেক বড়, এগুলো ঠিক থাকবে।

    কাজেই পরদিন কাঠুরেনী অনেক উপদেশ দিয়ে অনেক সাবধান করে দিয়ে ছোট মেয়েকে বনে পাঠিয়ে দিল। মেয়েটি হাতে একটি ঝুড়ি নিয়ে চলল। কিন্তু তাকে পথ দেখাবার মতো একটি মটরও পড়ে ছিল না। বনের ঘুঘুতে এসে সব খেয়ে গেছে। কোথায় যে আসল পথ সে খুঁজে পেল না। পথ হারিয়ে তার ভারি খারাপ লাগতে লাগল। সে ভাবল যদি এমনি করে রাত হয়ে যায় তার বাবা বেচারা আবার উপোস করে থাকবেন, আর সারা রাত সে বাড়ি ফিরে না গেলে তার মা কত ভাববেন। তবু রাত হয়ে গেল, আর সে গাছের ফাঁকে দেখতে পেল একটা আলো। সেই আলো দেখে সে-ও তার দিদিদের মতো বনের সেই বাড়িতে এসে উপস্থিত হল। ভিতরে গিয়ে সে এক রাতের মতো আশ্রয় চাইল। সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো তার জন্তুদের দিকে ফিরে বললে—

    মুরগী মোরগ ছিটে গরু সোনা,
    বল ওকে রাখব কি রাখব না?

    জন্তুরা বললে— হ্যাঁ। ছোটখুকি অমনি উনুনের কাছে গিয়ে মোরগ মুরগীর গায়ে হাত বুলিয়ে দিল আর ছিটে গরুর শিঙের মাঝখানে হাত ঘসে দিল। বুড়ো যখন তাকে রান্না করতে বললে, সে চট্‌ করে বেঁধে ফেলল কিন্তু টেবিলে খাবার সাজিয়ে সে বললে— জন্তুদের না খাইয়ে আমি কিন্তু এই ভালো ভালো খাবার খাব না। ওদের আগে খাইয়ে আসি।

    এই বলে সে যবের দানা এনে মুরগিদের সামনে ছড়িয়ে দিল আর এক আঁটি মিষ্টি খড় গরুর সামনে ধরলে।

    —এইগুলি ততক্ষণ খাও তোমরা, আমি বরং তোমাদের জন্যে কিছু জল আনিগে।

    বলে সে মস্ত একপাত্র জল নিয়ে এল। মোরগ আর মুরগী লাফিয়ে তার কানায় গিয়ে বসে ঠোঁট ডুবিয়ে মাথা উঁচু করে পাখিরা যেমন করে জল খায় তেমনি করে জল খেতে লাগল, তার ছিটে গরু চোঁ-চোঁ করে অনেকক্ষণ ধরে জল টেনে নিল। জন্তুদের খাওয়া হয়ে গেলে মেয়েটি টেবিলে গিয়ে বসল আর বুড়োর খাওয়া হয়ে যাবার পর যা বাকি ছিল তাই খেল। একটু পরে মুরগী-মোরগ ডানার নিচে মাথা লুকিয়ে ফেললে আর গরু তার চোখ পিট-পিট করতে লাগল। মেয়েটি বললে— ঘুমোতে গেলে হয় না?

    বুড়ো বলে উঠল—

    মুরগী মোরগ ছিটে গরু সোনা,
    বল ওকে শুতে দেব কি না?

    তারা সঙ্গে সঙ্গে বললে—

    শুতে দাও, মেয়েটি যে ভালো
    আমাদের কেমন খাওয়ালো।

    মেয়েটি উপরে উঠে বিছানা ঝেড়ে দুটো বিছানাই করল। একটু পরে বুড়ো নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তে প্রায় তার পা অবধি তার সাদা দাড়িতে ঢেকে গেল।

    মেয়েটি মাঝরাত পর্যন্ত বেশ শান্তিতে ঘুমোলো কিন্তু তারপর এক অদ্ভুত আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে গেল। বাড়ির যতগুলো কোণ সব যেন মচ-মচ ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করে উঠল। দরজাগুলো খুলে গিয়ে দুমদাম করে দেওয়ালে পড়তে লাগল। বরগাগুলো মনে হল যেন মড়-মড় করে ভেঙে পড়ছে। সিঁড়িখানা উল্টে যাচ্ছে। শেষে একটা প্রচণ্ড শব্দ— মনে হল ছাদ আর দেওয়াল সমস্ত একসঙ্গে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। তারপরে সব চুপচাপ।

    মেয়েটি এত ভয় পেয়েছিল যে নড়তেও পারল না। সমস্তটা এত তাড়াতাড়ি হল যে তার নড়বার সময়ও ছিল না। যখন সে দেখল তার নিজের কিছুই হয়নি, বিছানায় বেশ আরামেই শুয়ে আছে তখন সে নিশ্চিন্ত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

    সকালবেলা রোদের উজ্জ্বল আলোয় তার ঘুম ভেঙে গেল আর সে যা দেখল তাতে তার মুখে আর কথা সরল না। সে শুয়ে রয়েছে একখানা চমৎকার ঘরে— চারিপাশের জিনিস-পত্র আসবাব যেন রাজবাড়ির মত। রেশমের উপর সোনার ফুলের কাজ দিয়ে চারিদিকের দেয়াল ঢাকা। হাতির দাঁতের পালঙ্ক। লাল মখমলে ঢাকা বিছানা। বিছানার কাছে চৌকিতে তার পায়ের মাপে একজোড়া মুক্তো-বসানো জুতো।

    মেয়েটি ভাবলে সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। অবাক হয়ে যখন সে ভাবছে সেই সময় কায়দা-দুরস্ত পোশাক পরা তিনটি চাকর ঘরে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে কী হুকুম করে?

    সে বললে— আমি কিছুই চাই না। তোমরা যাও। আমি উঠে বুড়ো লোকটির সকালের খাবার রান্না করব আর পোষা জন্তুগুলিকে খাবার দেব।

    তাড়াতাড়ি পোশাক পরে সে বুড়োর ঘরে গেল। গিয়ে অবাক হয়ে দেখল সেখানে বুড়োর বদলে একটি অচেনা ছেলে ঘুমোচ্ছে। সে যখন অবাক হয়ে ভাবছে এই সুপুরুষ ছেলেটি এখানে কোথা থেকে এল, ছেলেটি জেগে উঠে বললে— চলে যেও না। আমি রাজার ছেলে। এক দুষ্ট ডাইনি মন্ত্র পড়ে আমাকে দাড়িওয়ালা বুড়ো বানিয়ে দিয়েছিল। আমার প্রাসাদকে করে দিয়েছিল কাঠের কুটির আর আমার চাকরদের মোরগ মুরগী আর ছিটে গরু। যতদিন না কোন দয়ালু মেয়ে এখানে আসে যার মানুষের উপরেও যেমন ভালোবাসা| জীবজন্তুদের উপরেও তেমনি, মানুষকেও যেমন খাওয়াতে ভালোবাসে জীবজন্তুকেও তেমনি, ততদিন ডাইনির মন্ত্র কাটবে না। তুমিই হচ্ছ সেই মেয়ে। কাল মাঝরাতে আমরা যখন ঘুমোচ্ছিলুম, তোমারই দয়ায় আমাদের উপর থেকে ডাইনির শাপ কেটে যাচ্ছিল। তাই পুরোনো কাঠের বাড়ি আবার হয়েছে রাজপ্রাসাদ। জন্তুদের চেহারা বদলে আবার তারা আমার পুরোনো তিন চাকর হয়ে গেছে। এবার আমি তোমার বাপ-মাকে আনতে পাঠাই। তোমায় আমি বিয়ে করতে চাই। তাঁরা আমাদের বিয়েতে উপস্থিত থাকুন।

    সে বললে— কিন্তু আমার দিদিরা কোথায়?

    রাজপুত্র বললেন— তাদের আমি মাটির নিচের ঘরে বন্দী করে রেখেছি। কাল আমি তাদের খনিতে কাজ করতে পাঠিয়ে দেব। যতদিন পর্যন্ত না তারা শিখতে পারে মানুষের সঙ্গেও যেমন ভালো ব্যবহার করা দরকার জন্তুরাও তেমনি দয়ামায়ার ভালবাসার পাত্র, ততদিন শিখুক।

    টীকা