Chapter Index

    সোনার পাহাড়ের রাজা

    এক বণিকের ছিল একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। দুজনেই ছিল খুব ছোট। ভাল করে হাঁটতেই শেখেনি। বণিকের দু-দুটো দামি দামি মাল-বোঝাই জাহাজ সমুদ্রে গিয়েছিল। সেবারকার বাণিজ্যে অনেক লাভ হবার কথা। বণিক যখন লাভের আশায় বসে আছেন ঠিক সেই সময় খবর এল যে দুটো জাহাজই ডুবে গেছে। কাজেই বড়লোক হওয়া তো ঘুচেই গেল, বণিক প্রায় সব হারিয়ে একেবারে গরিব হয়ে পড়ল। রইল তার শুধু শহরের কাছে একটি ক্ষেত। দুঃখের কথা ভুলতে সে ক্ষেতের ধারে চলে যেত। একবার যখন সে ক্ষেতে পায়চারি করছে হঠাৎ একটি ছোট্ট কালো বামন কোথা থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলে—

    —তোমার এত দুঃখ কিসের?

    বণিক বললে— তুমি যদি আমায় সাহায্য করো তো বলি।

    বামন বললে— বলা তো যায় না, হয়ত সাহায্য করতে পারতেও পারি।

    তখন বণিক বললে যে তার সমস্ত সম্পত্তি জাহাজডুবি হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তার ঐ জমিটুকু ছাড়া আর কিছু নেই।

    বামন বললে— ভেবো না। আজ যখন তুমি বাড়ি যাবে তখন প্রথমেই যে তোমার পায়ে ঘেঁসে দাঁড়াবে তাকে যদি বারো বছর পরে আমায় এনে দাও তাহলে তুমি যত সোনা চাও পাবে।

    বণিক ভাবলে, বাড়িতে ঢুকলে তো কুকুরটা পায়ের কাছে এসে গা ঘসে। ছোট ছেলেটার কথা তার একবার মনেও হল না। সে বামনের কাছে একটা খত লিখে দিয়ে শিলমোহর মেরে বাড়ি চলে গেল।

    যেই সে বাড়ি পৌঁছল অমনি তার কচি ছেলে টল-টল করে এসে বাপের পা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

    তখন বণিকের টনক নড়ল। মনে পড়ে গেল তার অঙ্গীকারের কথা। মনে পড়ে গেল কী দিয়ে দিতে সে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সিন্দুক খুলে যখন সে দেখলে যে সোনা-টোনা কিচ্ছু নেই তখন ভাবলে ওটা তাহলে বামনের একটা পরিহাস। মাসখানেক পরে সে একদিন ঘরের মাচায় উঠেছিল কিছু পুরোনো টিন পাড়তে বিক্রি করবার জন্যে। সেখানে দেখে, মেঝের উপর সাজানো থরে-থরে সোনা। তারপর দেখতে দেখতে তার অবস্থা ফিরে গেল। আবার বেচা-কেনা শুরু করে দিলে। সে আগের চেয়েও বড়লোক হয়ে গেল। তার আর কোনো দুঃখ রইল না।

    ইতিমধ্যে ছেলেটি বড় হয়ে উঠল। ছেলেটি যেমন হল চালাক-চতুর, জ্ঞান-বুদ্ধিও হল তার তেমনি। কিন্তু বারো বছর যতই এগিয়ে আসতে থাকল বণিক ততই মনমরা হয়ে পড়তে লাগল। মুখ দেখেই তার বোঝা যেত যে মনের মধ্যে কি হচ্ছে। একদিন তার ছেলে জিজ্ঞেস করলে, তার কী হয়েছে। কিন্তু বাবা কিছুই বললেন না। ছেলেও এদিকে নাছোড়বান্দা। শেষে বণিক সব কথা খুলে বললে। বণিক বললে যে তখন বুঝতে পারিনি কী বলছি। একবোঝা সোনার বদলে নিজের ছেলেকে এক কালো বামনের হাতে তুলে দেব বলে লিখে দিয়েছি। এইবার তার যাবার সময় প্রায় হয়ে এল।

    তখন তার ছেলে বললে— বাবা, ভয় পেও না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বেঁটে বামন আমার কিছুই করতে পারবে না।

    বারো বছর পরে যেদিন সময় হল সেদিন ছেলে পুরোহিতের আশীর্বাদ নিয়ে বাপের সঙ্গে মাঠে গেল।

    মাঠে দাঁড়িয়ে ছিল সেই কালো বামন। সে এগিয়ে এসে বাপকে বললে— তুমি যা দেবে অঙ্গীকার করেছিলে তা এনেছ?

    বণিক চুপ করে রইল। কিন্তু ছেলে বললে— কী চাও তুমি?

    বামন বললে— তোমার বাপের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। তোমার সঙ্গে তো হচ্ছে না।

    ছেলে বললে— তুমি আমার বাবাকে বেজায় ঠকিয়েছ। তাঁর খত আমাকে ফিরিয়ে দাও।

    বামন বললে— কক্ষনো না। আমার হক আমি ছেড়ে দেব নাকি?

    এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে কথা-কাটাকাটি হল। শেষে ঠিক হল, ছেলে যখন আর বাপের সম্পত্তি নয়, আবার শত্রুর হাতেও সে নিজেকে ছেড়ে দিতে রাজি হচ্ছে না, তাহলে এক কাজ করা যাক। এক স্রোতস্বিনী নদীতে গিয়ে সে নৌকোয় উঠুক আর তার বাবা তাকে ঠেলে দিক স্রোতের মুখে। ছেলে ভেসে যাক স্রোতে।

    ছেলে বাপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকোয় গিয়ে উঠল। তার বাবা ঠেলে দিলেন। ছেলেকে চিরদিনের মতো হারালেন এই ভেবে তিনি বাড়ি গিয়ে দুঃখের সাগরে মগ্ন হলেন। নৌকোটি ডুবল না, ভেসে চলল স্রোত বেয়ে। ছেলেটি চুপটি করে বসে রইল তার মধ্যে। অনেক দূরে গিয়ে নৌকোটি শেষে এক অজানা চড়ায় ঠেকে গেল।

    ছেলে ডাঙায় নেমে দেখতে পেলে, কাছেই একটি সুন্দর রাজপ্রাসাদ। সেইদিকে এগিয়ে সে প্রাসাদের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। এ-ঘরে ঢোকে, ও-ঘরে ঢোকে, সব ঘর দেখে খালি। যেন এক জাদু-করা পুরী। শেষে সব-শেষের ঘরে এসে দেখে, এক সাপ। সাপটা একবার কুণ্ডলী পাকাচ্ছে আবার কুণ্ডলী খুলে ফেলছে।

    সাপটি আসলে ছিল এক জাদু-করা কন্যা। ছেলেটিকে দেখে সে খুশি হয়ে বললে— আমার রক্ষাকর্তা, এতদিনে তুমি এলে? আমি বারো বছর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। সমস্ত রাজ্য জাদু-মগ্ন হয়ে আছে, তুমি তাকে উদ্ধার কর।

    ছেলেটি বললে— কেমন করে আমি উদ্ধার করব?

    সাপ বললে— আজ রাত্রে বারো জন শিকল-পরা কালো মানুষ আসবে। তারা এসে তোমায় জিজ্ঞেস করবে, এখানে তুমি কী করছ? কিন্তু তারা যাই বলুক আর তাই করুক তুমি একটি কথাও বোললা না। তারা তোমায় যন্ত্রণা দেবে, মারবে, চিমটি কাটবে কিন্তু তুমি কোনো কথা বোলো না। বারোটার সময় তাদের চলে যেতে হবে। দ্বিতীয় রাত্রে আরো বারো জন আসবে। তৃতীয় রাত্রে চব্বিশ জন। এরা তোমার মাথা কেটে ফেলবে। কিন্তু বারোটার পর তাদের কোন জাদু খাটবে না। আর যদি সহ্য করে থাকো, একটি কথাও না কও তাহলে আমি রক্ষা পাব। তখন আমি তোমার কাছে আসব, ছোট একটি শিশিতে করে জীবন-বারি এনে তোমার উপর ছড়িয়ে দেব। অমনি তুমি প্রাণ ফিরে পাবে। আগেরই মতো স্বাস্থ্য ফিরে পাবে।

    ছেলেটি বললে— এতে যদি তোমার উদ্ধার হয়, আমি খুশি হয়েই এসব করব।

    সাপ যেমন যেমন বলেছিল ঠিক তেমনি হল। কালো মানুষরা তার মুখ থেকে একটি কথাও বার করতে পারলে না। তৃতীয় দিন রাত্রে সাপ হয়ে গেল এক সুন্দরী রাজকন্যা। রাজকন্যা জীবন-বারি নিয়ে এসে ছেলেটিকে বাঁচালেন। তারপর রাজকন্যা তার গলা জড়িয়ে ধরে তাকে আদর করলেন। সমস্ত রাজপুরী জেগে উঠল। চারিদিকে আনন্দের স্রোত বইতে লাগল।

    ছেলেটির সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল। সে হল সোনার পাহাড়ের রাজা।

    দুজনে পরম সুখে দিন কাটাতে লাগলেন। কিছুদিন পরে তাঁদের একটি সুন্দর ছেলে হল।

    আট বছর কেটে যাবার পর রাজার মন উদাস হল। তিনি তাঁর বাবার কথা, দেশের কথা ভাবতে লাগলেন। দেশে ফেরার কথা রানীকে বলতে রানী রাজি হলেন না।

    রানী বললেন— তুমি যদি সোনার পাহাড় ছেড়ে দেশে যাও তাহলে আমার বিপদ হবে।

    কিন্তু রাজার মন শান্ত হয় না। তিনি রানীকে কেবলই দেশে যাবার কথা বলেন। শেষে আর না পেরে রানী রাজি হলেন।

    যেদিন রাজা যাবেন সেদিন রানী তাঁকে একটি কামনা-আংটি দিয়ে বললেন— এই আংটিটি নাও, নিয়ে তোমার আঙুলে পর। তুমি যেখানে যেতে চাও এই আংটির কাছে বললেই সে তোমায় নিয়ে যাবে। কিন্তু কথা দাও, কামনা-আংটির কাছে কখনও তুমি বলবে না তোমার রানীকে এদেশ থেকে নিয়ে যেতে তোমার বাবার কাছে?

    রাজা বললেন— বেশ, কথা দিলুম। বলে আঙুলে আংটি পরলেন। পরে তিনি তাঁর পুরোনো দেশে, যে শহরে তাঁর বাবা আছেন সেইখানে যেতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন যে তিনি শহরের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর পোশাক-আশাক দামি হলেও এমনই বিদেশী ঢঙের যে সান্ত্রীরা তাই দেখে তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দিল না। তখন তিনি কাছেই যে পাহাড় ছিল তাতে গিয়ে উঠলেন। সেখানে রাখালদের সঙ্গে তাঁর দামি কাপড় বদল করে শহরে এসে ঢুকলেন। এবারে আর বিদেশী বলে কেউ তাঁকে আটকালো না। রাস্তায়ও কেউ তাঁর দিকে তাকালো না।

    তাঁর বাবার বাড়িতে পৌঁছে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা তাঁকে চিনতে পারলেন না। তিনি বললেন— তাঁর এক ছেলে ছিল বটে কিন্তু সে অনেক দিন আগে মারা গেছে। তবে, গরিব রাখালটিকে দেখে তাঁর মায়া হল। বললেন— একে ভাল করে খাইয়ে দাও।

    রাখালের পোশাক পরা ছেলে বললে— আমি সত্যি বলছি আমিই আপনাদের ছেলে। আমার গায়ে কি কোন চিহ্ন নেই যা দেখে আপনারা নিতে পারবেন?

    তার মা বললেন— আমাদের ছেলের ডান বাহুর নিচে একটি ছোট্ট লাল জরুলের দাগ ছিল।

    ছেলেটি তখন ডান হাতের আস্তিন গুটিয়ে ফেললে। দেখা গেল হাতের নিচে একটি ছোট্ট লাল জরুলের দাগ। সে তখন বললে— সে হচ্ছে সোনার পাহাড়ের রাজা। এক রাজকন্যাকে সে বিয়ে করেছে। তাদের সাত বছরের একটি ছেলে আছে।

    বাবা বললেন— রাজা বটে! ছেঁড়া ময়লা রাখালী পোশাক পরে এসে বলছে আমি রাজা!

    এই শুনে ছেলেটির হল ভারি রাগ। তার মাথা গরম হয়ে গেল। সে তার আংটি ঘুরিয়ে বললে— আমার রানী আর ছেলে এখানে আসুক! একবার ভেবেও দেখলে না সে কী প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল। রানী আর রাজপুত্র তখনই সেখানে এসে হাজির হলেন। এসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন— হায় রাজা, কেন তুমি তোমার শপথ ভাঙলে? আমি বড়ই কষ্ট পেলুম!

    রাজা বললেন— কাজটা আমি না-ভেবে করেছি। কিন্তু আমার কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। এই বলে তিনি রানীকে শান্ত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

    রানী মুখে শান্ত হলেন বটে কিন্তু মনে মনে তিনি প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবতে লাগলেন।

    তারপর দুজনে বেড়াতে বেরোলেন শহরের বাইরে। রাজা বললেন— দেখ রানী, এই সেই ক্ষেত। এই হল ক্ষেতের ধারের স্রোতস্বিনী নদী। এই নদী বেয়ে আমি সোনার পাহাড়ে গিয়েছিলুম। তারপর তিনি বললেন —আমি ক্লান্ত বোধ করছি। একটু জিরোবো।

    রানী বসলেন। রাজা তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন চোখ বুজে। যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন অমনি রানী তাঁর হাত থেকে আংটিটা খুলে নিলেন আর আস্তে আস্তে কোল থেকে মাথা নামিয়ে রেখে দিলেন। পায়ের জুতোজোড়া খুলে রেখে রানী ছেলেকে কোলে নিয়ে আংটিকে বললেন —আমাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে চল। রাজা জেগে দেখলেন, তাঁকে ফেলে রেখে রানী ছেলে নিয়ে পালিয়ে গেছেন। রানী নেই, রাজপত্র নেই, আংটি নেই ; শুধু পড়ে আছে রানীর একজোড়া জুতো।

    তিনি বললেন—এখন আর বাপ-মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে আমার কোনো লাভ নেই। তাঁরা বলবেন আমি জাদুকর, ভোজবাজি দেখিয়ে বেড়াই। আমাকে আমার নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে হবে।

    এই বলে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। যেতে যেতে এক পাহাড়ের কাছে এসে হাজির। সেখানে দুই দৈত্যে বিষম ঝগড়া লেগেছে। তাদের পৈতৃক সম্পত্তি তারা কিছুতেই নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিতে পারছে না। তাঁকে পথ দিয়ে যেতে দেখে দৈত্যেরা ডাকল। বললে—দৈত্যের চেয়ে মানুষের বুদ্ধি বেশি। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি আমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে পারবে ভাই?

    রাজা বললেন— কী সম্পত্তি?

    তারা বললে— একখানা তলোয়ার। এ তলোয়ার হাতে নিয়ে কেউ যদি বলে— আমার মাথা রইল আর সব মাথা গেল— তাহলে সেখানকার সব মাথা একসঙ্গে কাটা পড়বে। দ্বিতীয় সম্পত্তি একখানা জোব্বা। সেটা পরলেই অদৃশ্য হওয়া যায়। তৃতীয় সম্পত্তি একজোড়া জুতো। পরলে যেখানে খুশি এক নিমেষে যাওয়া যায়।

    রাজা বললেন— সম্পত্তিগুলি আমার হাতে দাও। একবার পরখ করে দেখে নিই গুণগুলি ঠিক আছে কি না।

    তারা তাঁকে জোব্বাটা দিল। জোব্বা পরতেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। জোব্বা খুলে নিজের চেহারায় ফিরে এসে তিনি বললেন— হ্যাঁ, এটা ঠিক আছে। এবার তলোয়ারটা দেখি?

    তারা বললে— তলোয়ার দিই কি করে? তলোয়ারের গুণ পরীক্ষা করতে গেলে তো আমাদেরই দুটো মাথা কাটা পড়বে!

    শেষকালে অনেক তর্ক-টর্ক করে তারা এই শর্তে তলোয়ারটা দিল যে রাজা একটা গাছের উপর পরীক্ষা করবেন। তিনি তাদের কথামতো গাছের উপর পরীক্ষা করতেই যেমন খড় কেটে যায় তেমনি প্রকাণ্ড গাছটা তলোয়ারের ঘায়ে কুচ্‌ করে কেটে গেল।

    তখন তিনি জুতোজোড়া চাইলেন। কিন্তু তারা বললে— জুতোজাড়া দিই কী করে? জুতো পরে তুমি যদি বল পাহাড়ের মাথায় যেতে চাই তাহলে তুমি তো চলেই গেলে কত দূর। আমরা কি এখানে শূন্য হাতে দাঁড়িয়ে থাকব?

    তিনি বললেন— না, আমি তা করব না।

    কাজেই তারা তাঁকে জুতোজোড়াটাও দিলে। যখন তিনি তিনটে জিনিসই হাতে পেলেন, তাঁর রানী আর ছেলের জন্যে মন কেমন করে উঠল। তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল— হায়, আমি যদি এখন সোনার পাহাড়ে যেতে পারতুম! বলবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৈত্যদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন। দৈত্যদের আর পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ করা হল না।

    তিনি রাজপ্রাসাদের কাছে আসতেই গান-বাজনার শব্দ শুনতে পেলেন। বাঁশি বাজছে, বেহালা বাজছে, লোকজন হৈ-হৈ করছে। লোকের মুখে শুনলেন যে তাঁর রানী আবার এক বিয়ে করবেন, তারই এই আয়োজন।

    তাঁর ভয়ানক রাগ হল। তিনি বললেন— আমি যখন ঘুমোচ্ছিলুম আমায় ফেলে পালিয়ে গেছে। তার উপর আবার এই!

    জোব্বাটা গায়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে তিনি প্রাসাদের ভিতর ঢুকলেন। তারপর হল-ঘরে গিয়ে দেখেন, মস্ত টেবিল বিছানো হয়েছে। তাতে থরে-থরে দামি-দামি সরাব সাজানো। অতিথিরা হাসছে, কথা কইছে, রঙ্গ করছে আর খাচ্ছে। রানী সকলের মাঝখানে জমকালো পোশাক পরে সিংহাসনে বসে আছেন। মাথায় রাজমুকুট।

    রাজা গিয়ে রানীর পিছনে দাঁড়ালেন। কেউই তাঁকে দেখতে পেল না। যেই রানী একটুকরো মাংস তাঁর থালায় রাখলেন অমনি রাজা সেটা তুলে খেয়ে ফেললেন। যেই রানীর গেলাসে সরাব ভরা হল অমনি রাজা গেলাসের সরাব খালি করে দিলেন। রানীর থালায় রানীর গেলাসে যা কিছু দেওয়া হল সমস্তই উড়ে যেতে লাগল। রানী কিছুই খেতে পেলেন না। শেষে রানী ভয় পেয়ে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা গেলেন পিছনে-পিছনে।

    রানী নিজেকে নিজে বললেন— এখনও কি দৈত্যের জাদু কাটেনি? আমার সত্যিকারের রক্ষাকর্তা কি আসেন নি?

    রাজা রানীর গালে এক চড় মেরে বললেন— তোমার সত্যিকারের রক্ষাকর্তা তোমার সামনেই রয়েছে! তার সঙ্গে তুমি যেমন ব্যবহার করেছ তা সে ভোলেনি!

    এই বলে জোব্বা খুলে তিনি আবার দেখা দিলেন। তারপর হল-ঘরে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন— বিবাহ উৎসব বন্ধ হল। আসল রাজা ফিরে এসেছেন।

    রাজা রাজন্য জমিদার পারিষদ যাঁরা হাজির ছিলেন তাঁরা হাসতে লাগলেন, ঠাট্টা করতে লাগলেন। ভাবলেন, এটা আবার কে?

    রাজা বললেন— তোমরা এখান থেকে যাবে, কি যাবে না?

    তারা তখন রাজাকে ধরবার চেষ্টা করতেই রাজা তাঁর তলোয়ার হাতে করে বললেন— আমার মাথা রইল, আর সব মাথা গেল!

    বলতেই সবার মাথা কাটা পড়ল। আর তিনিই রইলেন সোনার পাহাড়ের একমাত্র রাজা, একমাত্র প্রভু, একমাত্র অধীশ্বর।

    টীকা