Chapter Index

    রাত্তিরে কেউ ঘুমোবে না ভেবেছিল, কিন্তু এক সময়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। কে যে আগে ঘুমিয়েছে, কে পরে ঘুমিয়েছে, তার ঠিক নেই। বিমানদা। আর রণবীর ভট্টাচার্যের মধ্যে কী নিয়ে যেন তর্ক বেধেছিল, এই পর্যন্ত সন্তুর মনে আছে। তারপর এক সময় ঘুমে চোখ টেনে এসেছিল তার।
    সূর্যের প্রথম আলো চোখে লাগবার সঙ্গে সঙ্গে সন্তুই প্রথম জেগে উঠল। ধড়মড় করে উঠে বসে সে দেখল, বিমানদা আর রণবীর ভট্টাচাৰ্য ঘুমিয়ে আছেন। এক মাদুরে। একটু দূরে সেই হাত-পা-বাঁধা লোকটি। লঞ্চের রেলিং ঘেঁষে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে পুলিশ কনস্টেবলটি।
    ঘুম ভাঙার পর চোেখ কচলে সন্তু বুঝতে পারল, রাত্তিরে অন্তত তিনটে ব্যাপার ঘটেনি। বৃষ্টি আসেনি, বাঘ আসেনি, চোর-ডাকোতও আসেনি। তারপরেই সন্তুর মনে পড়ল কাকাবাবুর কথা। কাকাবাবু কোথায়? সিঁড়ির কাছে ডেকের ওপরেই উপুড় হয়ে শুয়ে সে উঁকি মোরল গোপন কুঠুরিটার মধ্যে। প্রথমে সে কাকাবাবুকে দেখতে পেল না। অমনি তার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। কাকাবাবু কোথায় গেলেন! হাঁচোড়-প্যাচোড় করে সে দ্বিতীয় সরু সিঁড়িটা দিয়ে নেমে এল গোপন কুঠুরিতে।
    একটা খাতা কোলের ওপর নিয়ে কাকাবাবু বসে আছেন এক কোণে। তাঁর মাথাটা বুকের ওপর ঢলে পড়েছে। তিনিও ঘুমোচ্ছেন। পাশে তাঁর টর্চটা গড়াচ্ছে। কাকাবাবুর সারা মুখে ফোঁটা ঘাম।
    সন্তু কাকাবাকুকে জাগাল না। সে পা টিপে টিপে উঠে এল ওপরে।
    ডেকে দাঁড়িয়ে সন্তু আকাশ দেখতে লাগল।
    একটু দূরে হেলে-পড়া অন্য লঞ্চটাতেও কোনও জাগরণের চিহ্ন নেই। কিন্তু নদীর বুকে কয়েকটা নৌকো চলেছে পাল তুলে। মনে হয়, সেগুলো সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। আকাশের পূর্বদিকে লাল আভা। মেঘ কাটিয়ে এক্ষুনি সূর্যকে দেখা যাবে। কাল রাত্তিরে গা ছমছম করছিল, এখন চারদিকে কেমন পবিত্র পবিত্ৰ ভাব!
    একটু বাদেই নীচে থেকে কাকাবাবুর ডাক শোনা গেল, সন্তু! সন্তু!
    সন্তু তাড়াতাড়ি নেমে এল নীচে।
    কাকাবাবু বললেন, এত সরু সিঁড়ি দিয়ে আমার উঠতে অসুবিধে হচ্ছে, তুই ওপর থেকে আমার একটা হাত ধর তো। ক্রাচ দুটোও ওপরে রেখে দে।
    এই সিঁড়িটায় কোনও রেলিং নেই। তাই কাকাবাবু ক্রাচ ছাড়াই সন্তুর একটা হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সেই লোকটার জ্ঞান ফিরেছে?
    ঘুমুচ্ছে এখনও। আমি দেখলুম। নিশ্বাসের সঙ্গে ওর বুক ওঠা-নামা করছে।
    আর কেউ জাগেনি?
    না।
    ডেকের ওপর উঠে এসে কাকাবাবু হাত-পা বাঁধা লোকটার পাশে বসে প্রথমে তার নাকের নীচে হাত দিলেন। তারপর তার বাঁ হাতটা তুলে নিয়ে একটুক্ষণ নাড়ি দেখে বললেন, সবই তো প্ৰায় স্বাভাবিক দেখছি। ওর আর প্রাণের ভয় নেই। থাক, আর একটু ঘুমোক।
    এই সময় রণবীর ভট্টাচাৰ্য একটু চোখ খুলে বললেন, ভোর হয়ে গেছে? এটা রোদ্দুর না জ্যোৎস্না?
    সন্তু ফিক করে হেসে ফেলল।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আমি কিন্তু ঘুমোইনি, সবে মাত্র একটু চোখ বুজেছি। এর মধ্যেই রোদ উঠে গেল? চা কোথায় চা? সেপাই!
    রেলিং-এ ভর দিয়ে যে কনস্টেবলটি ঘুমোচ্ছিল, সে এই হাঁক শুনে হাত-পা ছড়িয়ে জেগে উঠল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল একটা।
    চা বানাতে বলো শিগগির! সকালে চা না খেয়ে আমি কথাই বলতে পারি না।
    কনস্টেবলটি অন্য লঞ্চটির দিকে ফিরে মুখের পাশে দু হাত দিয়ে চ্যাঁচাল, এ মইধর! এ কাশেম! সাহেব চা চাইছেন। চা বানাও।
    ওপাশ থেকে মহীধরের উত্তর ভেসে এল, জাল নেই!
    কনস্টেবলটি কচুমাচু মুখ করে বলল, স্যার, চা কী করে হবে, জল ফুরিয়ে গেছে?
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য উঠে বসে বললেন, অ্যাঁ? বলে কী? এত বড় নদীর ওপরে ভেসে আছি, তাও বলে কিনা জল নেই?
    স্যার, এই নদীর পানি ভীষণ নোনা। মুখে দেওয়া যায় না?
    তা হলে কী হবে? চায়ের পাতা আছে, চিনি আছে, তবু চা তৈরি করা যাবে না জলের অভাবে, এ কথা কেউ শুনেছে কখনও? অথচ এত জল চারদিকে!
    সন্তু বলল, ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়ার, নট এ ড্রপ টু ড্রিংক!
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, হুঁ, তুমি এটা জানো? জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত মোর হয়েছে বিকল? কুচু পরোয়া নেই, এই নোনতা নদীর জলেই চা বানাতে বলো! লেবু আছে, লেবু?
    লেবুও পাওয়া গেল না। নোনতা জলে এমন এক বিতিকিচ্ছিরি চা তৈরি হয়ে এল, যা কাকাবাবু এক চুমুক দিয়ে সরিয়ে রেখে দিলেন। সন্তুর তো বমি এসে যাচ্ছিল। বিমানও সেই চা খেতে পারল না। শুধু রণবীর ভট্টাচার্য সবটা শেষ করে তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, আঃ! তবু তো চায়ের গন্ধটুকু আছে! এবারে বলুন, কাকাবাবু, আর নতুন কিছু জানতে পারলেন?
    কাকাবাবু বললেন, চমকপ্ৰদ নতুন কথা জানতে পেরেছি। গোপন ঘরটায় ইংগামার স্মেল্ট-এর একটা ডায়েরি আছে, টর্চের আলোয় আমি তার খানিকটা পড়ে ফেলেছি। টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে বলে আমি শুধু তার শেষ অংশটাই পড়েছি আগে। স্মেল্ট সাহেব প্রথম ডাকাতদলের হাতে মারা যাননি।
    তার মানে?
    সাহেব বুদ্ধিমান ছিলেন যথেষ্ট। যখন-তখন ডাকাতদের আক্রমণ হতে পারে ভেবে তিনি অত্যন্ত কৌশলে লঞ্চের মধ্যে ওই গোপন ঘরটি বানিয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত মূল্যবান জিনিসপত্র ওই ঘরেই থাকত। বিপদ দেখলেই তিনি ওই ঘরে ঢুকে পড়তেন। যাই হোক, সংক্ষেপে বলি, দেড় মাস আগে স্মেন্ট জাপানের এক বন্দর থেকে রসদ সংগ্রহ করেছেন। তারপর ভেসে বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর লঞ্চের ইঞ্জিনটা খারাপ হয়ে যায়। এই সব লঞ্চে সাধারণত ওয়ারলেস সেট থাকে, বিপদে পড়লে কাছাকাছি জাহাজদের উদ্দেশ্যে এস-ও-এস পাঠানো হয়। কিন্তু স্মেল্ট পৃথিবীর কোনও মানুষের কাছ থেকে সাহায্য ভিক্ষা করবেন না বলে ওয়ারলেস সেট রাখেননি।
    আশ্চর্য মানুষ। তারপর?
    লঞ্চটা আপনমনে ভাসছিল। ভাসতে ভাসতে সেটা এদিকে এসে পড়ে। কম্পাস ও ম্যাপের সাহায্যে স্মেল্ট এই জায়গার অবস্থানও বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন যে, এটা ইণ্ডিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল। ক্যালকাটা পোর্ট কাছাকাছি হবে, সেখানে ইঞ্জিন সারিয়ে নেওয়া যাবে। ইন্ডিয়া হিন্দুদের দেশ, হিন্দুরা অতি শান্তিপ্রিয়, ভদ্র ও নিরীহ জাতি। হিন্দু মানে কিন্তু হিন্দু জাতি নয়। ওই সব দেশের লোকেরা সব ভারতীয়কেই হিন্দু মনে করে। এর দু দিন পরেই অবশ্য স্মেল্ট-এর অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। তিনি লিখেছেন, সন্ধের অন্ধকারে একদল হিন্দু ডাকাত তাঁর লঞ্চ আক্রমণ করে। ডাকাতদের লঞ্চের ওপরে উঠতে দেখেই তিনি খাওয়ার টেবিল ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে তাঁর গোপন কুঠুরিতে ঢুকে পড়েন। সেখানে বারো ঘন্টা ছিলেন। এই লেখার তারিখটা সাতদিন আগের।
    তারপর?
    তারপর আর কিছু লেখা নেই। এর পরের অংশটা আমাদের অনুমান করে নিতে হবে। বারো ঘন্টা লুকিয়ে থাকার পর স্মেল্ট নিজেই বোধহয় বাইরে বেরিয়েছিলেন। দৈবাৎ সেখানে দ্বিতীয় ডাকাতদলটি তক্ষুনি এসে পড়ে আর স্মেল্টকে খুন করে। কিংবা দ্বিতীয় ডাকাতদল গোপন কুঠুরির দরজা নিজেরাই আবিষ্কার করে সেখান থেকে স্মেলটকে টেনে বার করে আনে। স্মেল্ট নিজের কাছে কোনও অস্ত্র রাখতেন না।
    গোপন কুঠুরির মধ্যে ধস্তাধস্তির চিহ্ন আছে।
    সেটা স্মেল্টের সঙ্গেও হতে পারে। কিংবা ডাকাতরা নিজেদের মধ্যেও করতে পারে। সিন্দুকের জিনিসপত্র দেখেই সেই লোভে ডাকাতরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। তার প্রমাণ তো এই একজন।
    এই লোকটাকে এখন জাগানো যাক। এর পেট থেকে সব কথা বায় করতে হবে।
    সন্তু বলল, আমি লোকটাকে একবার চোখ পিটপিট করতে দেখেছি।
    রণবীর ভট্টাচার্য লোকটির বুকের ওপর ডান হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, এই, তোর খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। ফেনাভাত খাবি?
    লোকটি কোনও সাড়া দিল না।
    বিমান বলল, ওর চোখে জলের ঝাপটা দিলেই ও চোখ খুলবে। নদীর জল তুলে আনব?
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সে সব কিছু লাগবে না। আমি ঠিক তিন গুনব, তার মধ্যে যদি ও কথা না বলে, তা হলে ওকে চ্যাংদোলা করে ফেলে দেব নদীতে। ওর তো মরে যাবারই কথা ছিল, আমরা শুধু শুধু কষ্ট করে ওকে বাঁচাব কেন, যদি না ও আমাদের সাহায্য করে। এক-দুই-তিন?
    লোকটি চোখ মেলে কোনও রকমে চি টি করে বলল, বাবু! আমি কথা কইতে পারতেছি না! মাথায় বড় ব্যথা! একটু পানি দ্যান।
    তোর নাম কী?
    কালু শেখ!
    তোর এই অবস্থা করেছে কে?
    হা-রু- দ-ফা-দা-র।
    এবারে আবার তার মাথাটা ঢলে পড়ল, চোখ বুজে গেল।
    বিমান বলল, লোকটার সত্যিই কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আর বেশি প্রেশায় দিলে তার ফল খারাপ হবে।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, থাক তা হলে। গোসাবায় নিয়ে গিয়ে খানিকটা চিকিৎসা করার পর আবার জেরা করা যাবে। একজনকে যখন পেয়েছি, তখন ধরা পড়বে সব কটাই।
    কাকাবাবু বললেন, শুধু হারু দফাদারকে আর ধরতে পারবে না।
    কেন? ওঃ হে! এ নামটা শোনা-শোনা মনে হচ্ছে…সেই নদীতে যে লাশটা ভাসছিল…বুকে ছোরা বেঁধা।
    সেই দৃশ্যটা মনে পড়তেই সন্তু চোখ বুজে ফেলল। ইশ, কীভাবে মানুষ মরে!
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, সে-ব্যাটাকেও কেউ খতম করে ফেলেছে। এই সব চোর-ডাকাতদের এই তো হয়। অন্যদের মেরে ধরে যে-সব টাকা-পয়সা নিয়ে আসে, তা নিজেরাও ভোগ করতে পারে না। নিজেরাও আবার মারামারি করে মরে।
    বিমান মুখ তুলে বলল, ওই যে একটা লঞ্চ আসছে।  রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, এবারে আমার খোঁজে। সত্যিই এসেছে। চলুন এখন ফিরে যাওয়া যাক। ভদ্রগোছের এক কাপ চা না খেলে। এরপর আমার মাথা ধরে যাবে! কাকাবাবু, আর তো এখানে কিছু করার নেই, কী বলুন?
    কাকাবাবু চুপ করে রইলেন।
    তৃতীয় লঞ্চটিতে রয়েছেন আকবর খান আর প্রশান্ত দত্ত। দুজনেই বসেছিলেন সারেঙ-এর ক্যাবিনে। সেই লঞ্চটি কাছে এসে লাগতেই দুই পুলিশের অফিসার বেরিয়ে এলেন।
    আকবার খান দারুণ চিন্তিতভাবে বললেন, কী ব্যাপার স্যার। কাল রাত্রে ফিরলেন না, কোনও খবরও দিলেন না? আমরা এমন অ্যাংজাইটিতে ছিলাম…সারারাত ভাল করে ঘুমোতেই পারিনি।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য চওড়াভাবে হেসে বললেন, বাঃ বেশ, বেশ! রাত্তিরবেলা আমরা ডাকাতের হাতে খুন হতে পারতাম কিংবা বাঘের পেটে চলে যেতে পারতাম, তোমরা খোঁজ নিতে এলে সকালে।
    আকবর খান একটু অপ্ৰস্তুত হয়ে বললেন, কী করব, আপনারা ফিরবেন। বলে আমরা রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর-
    তারপর ডাকাতের ভয়ে আর অত রাত্তিরে এলে না, তাই তো? পুলিশ ফোর্সও যদি ডাকাতের ভয় পায়-
    না, স্যার, সেজন্য নয়। বোটের সারেঙকে আর তখন খুঁজে পাওয়া গেল না। সে তার গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারপর তাকে ডেকে আনতে আনতেই ভোর হয়ে গেল-
    যাক গে, যা হয়েছে বেশ হয়েছে।  তোমাদের লঞ্চে চা বানানোর জল আছে তো?
    পুলিশের লঞ্চে অনেক কিছুই মজুত থাকে। সবাই মিলে এবার চলে আসা হল সেই লঞ্চে। হাত-মুখ ধুয়ে ভাল চায়ের সঙ্গে ওমলেট আর টোস্টিও খেয়ে নিল সবাই। — *
    এরই মধ্যে পুলিশের লঞ্চের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল দ্বিতীয় লঞ্চটাকে। তারপর পুলিশের লঞ্চ চালু করে দু-তিনবার টান দিতেই মহীধর সারেঙ-এর লঞ্চ চড়া ছেড়ে ভেসে পড়ল জলে। এবারে সেই দড়ি দিয়েই বিদেশি লঞ্চটাকে বেঁধে দেওয়া হল পুলিশের লঞ্চের সঙ্গে। ডাকাতদের সেই খালি নৌকোটাকেও বেঁধে দেওয়া হল এর পেছনে।
    সবই ঠিকঠাক। এবারে ফেরার পথে রওনা দিলেই হয়।
    স্পিডবোটে যে-কজন এসেছিল, তারাই আবার বসেছে। স্টার্ট দেবার আগে রণবীর ভট্টাচাৰ্য জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু, আপনি এখনও গম্ভীর হয়ে আছেন, কিছু বলছেন না যে? ব্যবস্থাটা আপনার পছন্দ হয়নি? এখানে আর কিছু করার আছে?
    কাকাবাবু বললেন, নাঃ, আর কী করার থাকতে পারে! তবে, মনটা এখনও খচখচ করছে। ইংগামার স্মেল্ট-এর মৃতদেহটার কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। ধরে যদি কোনও উপায়ে তিনি এখনও বেঁচে থাকেন?
    এর পরেও তিনি বেঁচে থাকতে পারেন? লঞ্চটায় কি আরও কোনও গোপন কুঠুরি আছে আপনি বলতে চান?
    না, তা নেই। সেটা ভাল করেই দেখেছি। তবু স্মেল্ট-এর মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়নি বলে মন কিছুতেই মানছে না।
    তা হলে আপনি এখন কী করতে চান?
    এখান থেকে সমুদ্র তো খুব বেশি দূরে নয়, একবার সমুদ্রের মুখ পর্যন্ত ঘুরে এলে হয় না? ওর ডেডবডিটা যদি সমুদ্রে ভেসেও যায়, আবার ফিরে আসতে পারে। সমুদ্র কোনও কিছু একেবারে নিয়ে নেয় না, ফিরিয়ে দেয়।
    সে রকম ফিরে পাওয়ার আশা কিন্তু খুবই কম।
    তা হলেও একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? ওরকম একটা মানুষের দেহ হাঙরে-কুমিরে ছিঁড়ে খাবে? যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে আমরা সসম্মানে কবর দিতে পারি।
    কিন্তু কাকাবাবু, উনি তো সমুদ্রের বুকেই মরতে চেয়েছিলেন!
    তার মানে তুমি আর সময় নষ্ট করতে চাও না। ঠিক আছে, ফিরেই চলো।
    না, না, আমি সে-কথা বলিনি! সমুদ্রের মুখটা ঘুরে আসতে আসতে কতক্ষণই বা লাগবে! অন্য একটা লঞ্চও আমাদের সঙ্গে চলুক। আমরা নদীর দুদিক দেখতে দেখতে যাব। বলা যায় না, নদীর ধারে কোনও ঝোপঝাড়ের মধ্যে ডেডবডিটা আটকে থাকতেও পারে?
    রণবীর ভট্টাচার্য সেইমতন আদেশ দিলেন। পুলিশের লঞ্চটা থেকে দড়ি খুলে ফেলা হল। সেটা চলল। নদীর বাঁদিক দিয়ে। আর নদীর ডান দিক দিয়ে চলল স্পিডবোটটা। ডান দিকেই জঙ্গল বেশি ঘন। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল নদীর পাড়, কোথাও ঝোপ নেমে এসেছে জলের মধ্যে, সেখানে খুব কাছে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল স্পিডবোটটাকে।
    এক ধরনের হলদে হলদে ছোপ-লাগা সবুজ ঝোপের দিকে আঙুল উঁচিয়ে রণবীর ভট্টাচাৰ্য সকৌতুকে বললেন, এই সব ঝোপের মধ্যে সাধারণত বাঘ লুকিয়ে থাকে। খুব ভাল ক্যামুফ্ল্যাজ হয়। এগুলোকে বলে হেঁতাল। তাই না হে কাশেম, ঠিক বলিনি?
    কাশেম বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার
    এখন একখানা বাঘ ঝপাৎ করে আমাদের উপর লাফিয়ে পড়লে তারপর আমাদের লাশ খুঁজতে আসতে হবে অন্য লোককে। হা-হা-হা।
    কাকাবাবু, কিন্তু এইসব কৌতুকে একটুও অংশগ্রহণ করছেন না। তাঁর মুখখানা থমথমে।
    বিমান হঠাৎ বলল, নদীর মাঝখানে অতগুলো গাছ কেন? আমরা ওদিকটা দেখব না?
    সবাই একসঙ্গে বাঁদিকে ঘাড় ফেরাল। নদীর মাঝখানে শুধু গাছ নয়, আট-দশখানা ঘরও রয়েছে। রীতিমতন একটা দ্বীপ। ওরা কেউ সেদিকে এতক্ষণ তাকায়নি, দ্বীপটা অনেকখানি পার হয়ে এসেছে।
    কাশেম বলল, এই দ্বীপটা ছ বছর হল জেগেছে স্যার। লোকে এটাকে বলে মনসা দ্বীপ। বড্ড সাপ ছিল ওখানে। এখন জেলেরা থাকে।
    কাকাবাবু বললেন, ওই দ্বীপের কাছে চলো।
    দ্বীপটির আকার অনেকটা ওল্টানো মাটির প্রদীপের মতন। মাথার দিকটা একেবারে সরু, সেখানে শুধু বালি। কাছাকাছি আসতে দেখা গেল, সেই বালির ওপর দিয়ে একটা আট-ন বছরের নেংটি পরা ছেলে কী একটা বড় জিনিস টানতে টানতে নিয়ে চলেছে।
    আরও কাছে যেতে বোঝা গেল, সেটা একটা লোহার চেয়ার।
    কাকাবাবু রণবীর ভট্টাচার্যের সঙ্গে চোখাচোখি করলেন। রণবীর ভট্টাচাৰ্য শিস দিয়ে উঠে বললেন, হোয়াট এ লাকি ব্রেক! জেলেদের গ্রামে ডেক-চেয়ার। কাকাবাবু, আপনি কি ম্যাজিক জানেন? কিংবা আপনার ইনটুইশান এত স্ট্রং!
    স্পিডবোটটা থামতেই ছেলেটা ভয় পেয়ে ছুটে পালাতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিমান লাফিয়ে নেমে গিয়ে ছেলেটাকে ধরল। অমনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল ছেলেটা।
    রণবীর ভট্টাচার্য নেমে গিয়ে ছেলেটার কাছে গিয়ে বললেন, এই ভয় নেই তোর। আমরা ছেলেধরা নয় রে। তোর বাবা কোথায়?
    ছেলেটার কান্না শুনে দুজন বউ বেরিয়ে এল খড়ের চালাঘর থেকে। ভদ্রলোকদের দেখেই তারা ছুটে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল। তারপর একপাশ ফিরে ঘোমটায় মুখ ঢেকে তাদের মধ্যে একজন বলল, পুরুষ মানুষরা কেউ ঘরে নেই, মাছ ধরতে গেছে, আপনারা কে?
    রণবীর ভট্টাচার্য এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই চেয়ারটা কার?
    একজন বউ বলল, কী জানি! কেউ এখানে ফেলে দিয়ে গেছে! এই নকু, এদিকে চলে আয়!
    নকু সেই বাচ্চা ছেলেটার নাম। সে বিমানের হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য মোচড়া-মুচুড়ি করছে।
    বিমান তাকে জিজ্ঞেস করল, এই চেয়ারটা কোথায় পেয়েছিস রে?
    ছেলেটা উঁ-উঁ করতে লাগল শুধু।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য এগিয়ে গেলেন ঘরগুলোর দিকে। তিন-চারটে ঘরের মাঝখানে একটা বড় খড়ের গোলা।
    একজন বউ ঘোমটায় পুরো মুখ ঢেকে রণবীর ভট্টাচার্যের একেবারে কাছে চলে এসে বলল, পুরুষরা কেউ নেই, আপনারা বিকালে আসবেন!
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য মাটি থেকে একটা বাখারি কুড়িয়ে নিয়ে সেইখড়ের গাদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। একটা শক্ত কিছুতে বাখারিটা লাগল। তিনি বাখারি দিয়ে সেখানকার খড় পরিষ্কার করতে করতে বললেন, জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখবার জন্য খড়ের গাদা খুব ভাল জায়গা। আরও কটা চেয়ার রয়েছে দেখছি, আর একটা ডায়নামো! এগুলো কে রেখে গেছে?
    বউটি বলল, আমরা জানি না গো বাবু, কারা যেন ফেলে রেখে গেছে। রাতের বেলা ফেলে দিয়েছে এখানে।
    তারপর তোমরা এখানে লুকিয়ে রেখেছ?
    আমরা কিছু জানি না।
    রণবীর ভট্টাচার্য চেঁচিয়ে বললেন, কাকাবাবু, এখানে অনেক মালপত্র পাওয়া গেছে।
    কাকাবাবু স্পিডবোট থেকে নামেননি। তিনি বললেন, পুরো দ্বীপটাই সার্চ করা দরকার।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য মুখ তুলে দেখলেন, বা দিক দিয়ে পুলিশের লঞ্চটা অনেকটা এগিয়ে চলে গেছে।
    ঠিক আছে, ব্যস্ততার কিছু নেই। লঞ্চটা ফিরে আসুক, এখানে পুলিশ পোস্টিং করিয়ে দেব।
    আরও কয়েকজন মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি খুবই বাচ্চা ছেলেমেয়ে মায়েদের আঁচল জড়িয়ে জুলজুল করে দেখছে। এইসব অচেনা লোকদের।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, দেখলে মনে হয় একটা শাস্তশিষ্ট গ্ৰাম। অথচ এখানেও খুনে-ডাকাত রয়ে গেছে।
    বিমান বলল, হয়তো সত্যিই ডাকাতরা চেয়ার-টেয়ারগুলো ফেলে গেছে। এই দ্বীপে। এরা লোভ সামলাতে পারেনি, তাই লুকিয়ে রেখেছে। এই ছেলেটাই ধরিয়ে দিল। ও যদি একটা চেয়ার নিয়ে খেলা না করত, আমরা সন্দেহ করতুম না। ছেলেটাকে ছেড়ে দেব?
    কাকাবাবু বোটের উপর থেকে বললেন, না, ওকে ছেড়ে না, ওকে ধরে রাখো।
    তারপর কাকাবাবু হাতছানি দিয়ে রণবীর ভট্টাচার্যকে কাছে ডেকে কানে কানে ফিসফিস করে কী যেন বললেন।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক বলেছেন, তা তো করতেই হবে?
    আবার তিনি ঘরগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ওগো মেয়েরা, আপনারা শুনুন! আপনাদের এখানে চোরাই মাল রয়েছে, পুলিশে আপনাদের ধরবে। এইসব মালপত্তর কে এখানে এনেছে, তার নামটা বলে দিন, তাহলে আপনারা ছাড়া পাবেন। নইলে সক্কলকে পুলিশ চালান করে দেবে!
    মেয়েরা কেউ কোনও কথা বলল না।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য আবার বললেন, আপনারা যদি সত্যি কথা না বলেন, তাহলে আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এই ছোট ছেলেটি চোরাইমাল সমেত হাতে-হাতে ধরা পড়েছে। সুতরাং একে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। একে নিয়ে চললুম।
    তিনি এসে ছেলেটির আর-একটা হাত ধরে বললেন, চলুন, বিমানবাবু, ছেলেটাকে বোটে নিয়ে চলুন!
    দুজনে মিলে ছেলেটাকে উঁচু করে তুলে ধরলেন। ছেলেটা দুপা ছুঁড়ে চ্যাঁচাতে লাগল প্ৰাণপণে। মহিলারা ছুটে এল সবাই। তারা সবাই মিলে চিৎকার করে কী বলতে লাগল, তা বোঝাই গেল না।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, উঁহু, সরকারি কাজে বাধা দেবেন না। এ ছেলে চোরাইমাল সঙ্গে রেখেছে, একে থানায় নিয়ে যেতেই হবে?
    ছেলেটা কান্না থামিয়ে হঠাৎ বলল, আমায় ছেড়ে দাও গো, বাবু! এই সব জিনিস হারু দফাদার ফেলে গেছে!
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আবার সেই হারু দফাদার! এ ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে মনে হয়।
    মহিলারা এবার বলল, হ্যাঁ গো, বাবু! ও ঠিক বলেছে, এসব হারু দফাদার ফেলে গেছে। সে আমাদের এ দ্বীপের কেউ নয়। সে অন্য জায়গায় থাকে।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য ছেলেটিকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, যা!
    স্পীডবোটের কাছে এসে কাকাবাবুকে বললেন, ঘুরে-ফিরে সেই হারু দফাদারের নামই আসছে। সে-ই মনে হচ্ছে পালের গোদা। কিন্তু সে তো খতম হয়ে গেছে। সুতরাং তার ওপরেও একজন আছে।
    কাকাবাবু বললেন, ছোট সাধুর কাছ থেকেই বাকি খবর জানতে হবে। আমার কাছে একটা লোকের ছবি আছে, সেও যদি এই ব্যাপারে জড়িত থাকে, তা হলে কিছু আশ্চর্য হব না।
    ছবি! আপনার কাছে?
    ক্যানিং আসবার পথে একটা লোকের ছবি তুলে রেখেছি। আমার ক্যামেরায়। লোকটির যে-রকম পালাবার গরজ ছিল, তাতে বেশ সন্দেহ হয়।
    আসবার পথে সেই গোরুর গাড়ির সঙ্গে জিপের দুর্ঘটনার কথাটা কাকাবাবু সংক্ষেপে জানালেন। তারপর বললেন, লোকটির যে-রকম চোট লেগেছে, তাতে সহজে হেলথ সেন্টার থেকে পালাতে পারবে না?
    চলুন তাহলে পুলিশের লঞ্চটাকে ধরা যাক। এদের এই দ্বীপে নৌকো নেই একটাও, এরা এর মধ্যে পালাতে পারবে না কেউ।
    সবাই উঠে পড়ার পর স্পিডবোটটা সবে মাত্র ছেড়েছে, অমনি বিমান বলে উঠল, এ কী, সন্তু কোথায়? সন্তু?
    কাকাবাবু বললেন, থামাও! থামাও!
    সন্তু কোথায় গেল?
    সঙ্গে-সঙ্গে দূর থেকে সন্তুর গলা শোনা গেল, কাকাবাবু! কাকাবাবু! তারপরেই একটা গুলির শব্দ! সেই আওয়াজটার যেন প্ৰতিধ্বনি গেল নদীর দুপাড় থেকে।
    দুএক মুহূর্ত সবাই থমকে থাকবার পরই বিমান লাফিয়ে নেমে পড়ে ছুটিল আওয়াজ লক্ষ করে।
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আপনি দাঁড়ান! আমি আগে যাচ্ছি, আওয়াজটা রিভলভারের!
    কাকাবাবু নেমে পড়লেন স্পিডবোট থেকে। চোখ দুটো জ্বলছে। সন্তু কখনও বিপদে পড়লে তাঁর মুখের চেহারা সাংঘাতিক হয়ে যায়। সন্তুকে কেউ মারলে তাকে তিনি পাগলা কুকুরের মতন গুলি করতেও দ্বিধা করবেন না।
    নরম বালির ওপর কাকাবাবুর ক্রাচ বসে যাচ্ছে, তবু তিনি যতদূর সম্ভব এগোতে লাগলেন তাড়াতাড়ি।
    গুলির শব্দ শুনে মহিলারা সবাই দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেছে। দুতিনজন ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। যে-ছেলেটা প্ৰথমে ডেকচেয়ার নিয়ে খেলছিল, সে হঠাৎ দৌড়ে এসে একটা ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওইদিকে?
    কাকাবাবু সেদিকে আর একটু এগিয়ে দেখলেন, সেই ঘরটার দুপাশে বিমান আর রণবীর ভট্টাচাৰ্য দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে পেছন দিকে উঁকি দিচ্ছে।
    কাকাবাবুঘরটার কাছে এসে ডাক দিলেন, সন্তু! সন্তু!
    কোনও সাড়া এল না।
    কাকাবাবু রিভলভার হাতে নিয়ে বিমানের পাশে এসে দাঁড়ালেন। বিমান ফিসফিস করে বলল, সন্তু ঠিক আছে, কিছু হয়নি।
    কাকাবাবু উঁকি দিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। মাটির মধ্যে একটা লম্বা গর্ত, সেই গর্তের মধ্যে একজন মানুষ। লোকটির একটা হাত রয়েছে গর্তের বাইরে, সেই হাতে একটি রিভলভার। গর্তটা থেকে খানিকটা দূরে রয়েছে একটা কালো মাটির হাঁড়ি। কিন্তু সন্তুকে দেখা গেল না।
    কাকাবাবু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু কোথায়?
    বিমান বলল, আমি দেখলুম, সন্তু ইচ্ছে করে গড়িয়ে গড়িয়ে জলের দিকে চলে গেল। গুলি লাগলেও মারাত্মক জখম হয়নি।
    গর্তের লোকটার মাথায় টাকা। চোখ দুটো ভয় পাওয়া জন্তুর মতন গোল হয়ে গেছে। ঘন ঘন মাথা ঘুরিয়ে সে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হাতের ভর দিয়ে গর্ত থেকে ওঠবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
    কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, রণবীর, তুমি ওদিক থেকে এগোও, আমি এদিক থেকে আসছি। এই লোকটা গুলি করার জন্য হাত তুললেই ওর মাথায় দুজনে এক সঙ্গে গুলি করব।
    ওদিক থেকে রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, অত কথার দরকার কী! আগেই ওর মাথার খুলটা উড়িয়ে দিই না?
    বলেই রণবীর আকাশের দিকে রিভলভারের মুখ করে ট্রিগার টিপলেন। পর পর দুপার।
    সেই শব্দ হওয়া মাত্র লোকটা হাত দিয়ে মাথা চাপা দিল। সে বোধহয় ভাবল, তার মাথা ফুটো হয়ে গেছে। তারপর যখন বুঝল, সেরকম কিছু হয়নি, তখন মুখ তুলতেই দেখল, তার সামনে তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের দুজনের হাতে রিভলভার।
    লোকটা ফুঁপিয়ে যুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
    লোকটার হাতের রিভলভার একটা লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, বিমানবাবু, ধরুন তো, এ হারামজাদাকে টেনে তুলি গর্ত থেকে।।
    কাকাবাবু দেখলেন, কুড়ি-পঁচিশ গজ দূরে জলে গা ড়ুবিয়ে বসে আছে সন্তু। এবারে সে ছুটে এল এদিকে।
    হাসি-ঝলমলে মুখে সন্তু বলল, আমার কিন্তু একটুও লাগেনি। আমি খুঁজতে-খুঁজতে এসে দেখি, এখানে একটা কালো হাঁড়ি, সেটা একটু একটু নড়ছে। আমি হাঁড়িটা টেনে সরিয়ে দিতেই লোকটা গুলি করল। কিন্তু আমি ওর পিছন দিকে ছিলুম তো, তাই ঠিক টিপ করতে পারেনি।
    কাকাবাবু বললেন, তুই হাঁড়িটা না সরিয়ে আমাদের খবর দিলি না কেন?
    সন্তু উত্তর না দিয়ে দুষ্ট-দুষ্ট হাসল।
    রণবীর আর বিমান টানাটানি করে টাকমাথা লোকটাকে ওপরে তুলে ফেলল। তারপর দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, ইশ! এর কী অবস্থা?
    লোকটির পেটে একটা বিরাট ক্ষত। একটা ব্যাণ্ডেজ পর্যন্ত করেনি। কী খানিকটা মলম সেখানে মাখিয়ে রেখেছে, সেইজন্য ক্ষতিটা বীভৎস দগদগে দেখাচ্ছে!
    লোকটা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে।
    কাকাবাবু বললেন, তোমার এই অবস্থা কে করেছে?
    লোকটা বলল, আমি আর বাঁচব না গো, বাবু, বাঁচব না। আমায় তোমরা মেরে ফেলো! আমি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।
    কাকাবাবু বললেন, কেন বাঁচবে না? আমরা তোমার চিকিৎসা করবে। স্পিডবোটে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যাব। তুমি সেরে উঠবে।
    লোকটা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে তাকাল কাকাবাবুর দিকে। তারপর অদ্ভুত করুণ গলায় বলল, আমায় বাঁচাবেন? ও বাবু, আমি যে মহাপাপী! আমি যে কালু শেখকে হাত মুখ বেঁধে ফেলে এসেছি! আমি যে…আমি যে…
    তুমি সেই সাহেবকেও মেরেছ? লঞ্চে যে সাহেব ছিল?
    না, না, বাবু, সেই সাহেবকেও আমি মারিনি। মা কালীর দিব্যি, সে সাহেবকে আমি মারিনি।
    কে মেরেছে সাহেবকে?
    বাবু, আমাকে একটা গুলি করে মেরে ফেলে দ্যান। আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না।
    না, তোমাকে আমরা বাঁচাব। ধরো, একে তোলো, স্পিডবোটে নিয়ে চলো!
    রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, এই, তুই হারু দফাদারের দলে ছিল না? তাকে কে মেরেছে?
    লোকটি এবারে খানিকটা দম নিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, তারে মেরেছি আমি। সেই কুত্তার বাচ্চা নিমকহারাম, সে ছিল আমার প্রাণের বন্ধু, এক সাথে কত কাজ করেছি, আর সেই হারু দফাদার কিনা আচমকা আমার পেটে গুলি চালালে! আমিও তারে ছাড়ি নাই, বাবু! বদলা নিয়েছি। ছুরির এক কোপে তার কলজে ফাঁসিয়ে দিয়েছি।
    লোকটা এর পর দারুণভাবে হাঁপাতে লাগল।
    কাকাবাবু আঙুল দিয়ে তার থুতনিটা উঁচু করে ধরে তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এবারে সত্যি কথা বলে তো? সেই সাহেবকে কে মেরেছে? তুমি না হারু দফাদার?
    লোকটা আস্তে আস্তে বলল, মা কালীর কিরে, বনবিবির কিরে, আমি তারে মারিনি! হারুও তারে মারেনি। কালু শেখ তারে জড়িয়ে ধরেছিল, কিন্তু ছুরি মারবার আগেই সাহেব জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে!

    টীকা