Chapter Index

    তিনদিন পরেই তার পাওয়া গেল, জোসেফ কলকাতায় আসছে সিঙ্গাপুর থেকে
    দিন দুয়েকের মধ্যেই এবং ওই দিনই ডি’সিলভার সন্ধান পাওয়া গেল।

    অস্ট্রেলিয়ার বন্দরে এম. এস. বাটোরি জাহাজে সে ছিল। অস্ট্রেলিয়া
    সরকার তার কলকাতায় আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।

    পরের দিন ডি’সিলভাও এসে পৌঁছাল।

    ডি’সিলভাকে রঘুনাথনের ফটো দেখানো হল, কিন্তু ফটো দেখে সে বললে তার
    সঙ্গে গিয়ে ইউসুফ মিঞাকে ময়নাটা বিক্রি করেছিল সে ওই লোক নয়।

    কিরীটী প্রশ্ন করল, তবে সে লোকটা কোথায়?

    সে তো হুজুর
    কলকাতাতেই থাকে।

    কলকাতায় থাকে?

    আজ্ঞে।

    কোথায় থাকে কলকাতায় জান?

    খিদিরপুরের এক বস্তীতে। তার নাম রতিলাল-জাহাজের মাল খালাস করে।

    তারপর কিরীটীর প্রশ্নের উত্তরে যা বললে ডি’সিলভা, রতিলালকে ডি সিলভা অনেক দিন আগে
    থাকতেই চেনেতার বস্তীর বাসায় সেবার গিয়ে তার ঘরে ওই ময়নাটা সে দেখতে পায়। রতিলাল
    বলে, জাহাজের মাল খালাস করতে করতে খাঁচাসমেত ঐ পাখীটা সে দেখতে পায়। পাখীটা রবিন
    রবিন বলে ডাকছিল।

    পাখীটা দেখেই চিনতে পারে ডি’সিলভা পাখীটা মূল্যবান। সে-ই তখন
    রতিলালকে বলে, পাখীটা বেচলে সে অনেক টাকা পাবে। আর সে যদি চায় তো ডি’সিলভা পাখীটা
    বিক্রী করে দিতে পারে।

    রতিলাল সম্মত হয়—তখন ডি’সিলভা তাকে নিয়ে ইউসুফের কাছে যায়।

    ইউসুফ পাখীটার দাম পাঁচশো টাকা দিতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত
    হাজার টাকায় পাখাটী ইউসুফ কিনে নেয়।

    তারপর?

    তারপর আর আমি কিছু জানি না হুজুর, তবে রতিলাল আমাকে পাখীটা হাজার টাকায় বিক্রী
    করে দেওয়ার জন্য একশো টাকা দিয়েছিল।

    কিরীটী অতঃপর মিঃ লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন একবার রতিলালের
    ওখানে যাওয়া যাক এখুনি!

    তখুনি ওরা জীপে করে রওনা হল রতিলালের সন্ধানে।

    রতিলাল তার ডেরায় ছিল।

    সুলতান যেমন বর্ণনা দিয়েছিল, রতিলালকে দেখতে ঠিক তেমনই। তার জন্ম
    জানা গেল পেগুতে।

    তার মা ছিল বর্মী এবং বাপ ছিল এক পাঞ্জাবী।

    মোচির মাইনে সে কাজ করত। চুরির ব্যাপারে তার চাকরি যায়। তারপর সে
    জাহাজের খালাসী হয়ে কলকাতায় চলে আসে।

    তার কাছে আরও একটা কথা জানা গেল।

    যেদিন সে ইউসুফকে ময়নাটা বিক্রী করে আসে, সেইদিনই সন্ধ্যার দিকে
    এক সাহেব খোঁজ করতে করতে তার ডেরায় আসে পাখীটার সন্ধানে।

    তারপর?

    আমি বলে দিলাম, পাখীটা ইউসুফ মিঞাকে বিক্রী করেছি। শুনে সে চলে
    গেল।

    কিরীটীর পরামর্শে রতিলালকে লালবাজারে নিয়ে আসা হল।

    থি’বর ফটো তাকে দেখানো হল।

    ফটোটা দেখেই রতিলাল বললে, ওই লোকটাই পাখীর সন্ধানে তার কাছে গিয়েছিল।

    একজন সার্জেন্ট এসে ঘরে ঢুকে স্যালুট দিল মিঃ লাহিড়ীকে, স্যার!

    ইয়েস!

    মিঃ জোসেফ বলে এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

    নিয়ে এস এই ঘরে।

    জোসেফ এসে ঘরে ঢুকল।

    বয়েস হয়েছে লোকটার। মাথার চুল প্রায় অর্ধেক পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।

    মিঃ লাহিড়ী?

    আমিই লাহিড়ী। বলুন!

    আমার মুক্তোগুলো পাওয়া গিয়েছে?

    পেয়েছি, বারোটা।

    ব্লু কুইন?

    সেটাও পাওয়া গিয়েছে।

    আঃ, আপনি আমাকে নিশ্চিত করলেন।

    কিন্তু আর মুক্তোগুলোর কোন সন্ধান এখনও করতে পারিনি।

    না পেলেও ক্ষতি নেই-ব্লু কুইন পাওয়া গিয়েছে তাতেই আমি খুশি। ভাল
    কথা, আমার স্ত্রী কোথায় জানেন? গ্রাণ্ডে খোঁজ করেছিলাম কিন্তু তারা বললেন কয়েকদিন
    আগেই নাকি সে হোটেল ছেড়ে চলে গিয়েছে।

    মিঃ জোসেফ?

    কিরীটীর ডাকে ওর মুখের দিকে তাকাল জোসেফ।

    দেখুন তো এই ফটোটা—এই লোকটাকে আপনি চেনেন?

    থি’বর ফটোটা এগিয়ে দিল কিরীটী জোসেফের সামনে।

    এ কি! এ ফটো আপনি কোথায় পেলেন? জোসেফ বলে ওঠে।

    চেনেন ফটোর লোকটিকে?

    নিশ্চয় চিনি—এ তো থি’ব।

    কতদিন পরিচয় আপনার সঙ্গে থি’বর?

    তা বছর দুয়েক তো হবেই-সিঙ্গাপুরেই ও থাকে—আমার বাড়িতে কতদিন
    এসেছে।

    আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও ওর আলাপ ছিল?

    ছিল বৈকি। অনেক দিনের আলাপ ওদের-রেঙ্গুন থেকেই।

    লোকটা কি করত সিঙ্গাপুরে?

    ওরও জুয়েলারী ব্যবসা ছিল; কিন্তু ওর সম্পর্কে এত কথা জিজ্ঞাসা
    করছেন কেন?

    কারণ আমাদের ধারণা–

    কী?

    ওরই পরামর্শে রঘুনাথন আপনার ভৃত্য, মুক্তোর হারটা চুরি করেছিল।

    সর্বনাশ! কি বলছেন আপনি?

    তাই।

    রঘুনাথনও ধরা পড়েছে নিশ্চয়ই?

    না। যতদূর মনে হচ্ছে সে হয়ত আর বেঁচে নেই!

    বেঁচে নেই?

    না। থি’বই সম্ভবত-হয়তো তাকে হত্যা করেছে।

    বলেন কি?

    আরও একটা দুঃখের সংবাদ আছে মিঃ জোসেফ।

    দুঃখের সংবাদ?

    হ্যাঁ, আপনার স্ত্রী বেঁচে নেই।

    মা’থিন নেই?

    অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে ওঠে জোসেফ।

    না, তাকে ঐ থি’বই হত্যা করেছে।

    সংক্ষেপে মিঃ লাহিড়ীই তখন সেদিনকার জাহাজের কেবিনের ঘটনাটা বিবৃত
    করেন।

    জোসেফ ব শুনে যেন গু হয়ে বসে থাকে।

    তার দু চোখের কোলে জল টলমল করতে থাকে।

    ব্যাপারটা মোটামুটি অতঃপর সব বোঝা গেলেও, থি’ব কিন্তু কিছুই
    স্বীকার করল না। সে যেমন চুপ করে ছিল তেমনই চুপ করে রইল।

    জোসেফ মুক্তোগুলো আইডেনটিফাই করার পর মুক্তোগুলো তাকে ফিরিয়ে দেওয়া
    হল।

    সেদিন সন্ধ্যায় কিরীটীর গৃহে তার বাইরের ঘরে বসে ওই মুক্তো-চুরির
    কাহিনীই কিরীটী বলছিল।

    মিঃ লাহিড়ী প্রশ্ন করেন, কিন্তু আপনি জেনেছিলেন কি করে যে পরের
    দিন জাহাজেই মা’থিন ও থি’ব যাচ্ছে রেঙ্গুনে?

    কিরীটী বললে, সেরাত্রে মা’থিনের অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার
    মধ্যেই আমি টিকিট দেখতে পাই জাহাজের একটা খামের মধ্যে টিকিটটা ছিল-খামের উপরে লেখা
    ছিল, মিসেস থি’ব-আর জাহাজের ডিপারচারের তারিখ ও সময় লেখা ছিল। তারপর মা’থিনের মুখে
    সব কথা শুনে আমার ধারণা হয়, মা’থিনই মিসেস থি’ব পরিচয়ে রেঙ্গুনে পালাচ্ছে। কিন্তু
    একটা ব্যাপারে মনের মধ্যে আমার খটকা ছিল তখনও।

    কী?

    মা’থিনও কি তবে ঐ চুরির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট? থি’ব নামটা কোন
    বর্মীর-মনে হয়েছিল বুড়ো জোসেফকে ছেড়ে হয়ত মা’থিন থি’বর সঙ্গে পালাচ্ছে। কিন্তু পরে
    মা’থিনের চোখে জল দেখে বুঝতে পেরেছিলাম ধারণাটা আমার ভুল। মা’থিন সত্যি-সত্যিই তার
    স্বামীকে ভালবাসত—আর তার জন্যই সে মুক্তোগুলো উদ্ধারের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

    তারপর?

    তারপরও আমার ধারণা যে মিথ্যা নয়, সেটা তো প্রমাণই হয়ে গেল, যখন থি’ব
    মা’থিনকে হত্যা করল আমাদের চোখের সামনে। এবং তার শেষ কথাগুলোও তাই প্রমাণ করেছে। থি’বই শেষ পর্যন্ত মুক্তোগুলো হাতিয়েছে জানতে পেরে সে হয়ত
    থি’বর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিল এবং রেঙ্গুন পর্যন্ত তার সঙ্গে যাবার জন্য
    প্রস্তুত হয়েছিল।

    যদিও সঠিকভাবে কিছুই জানা গেল না, তাহলেও কিরীটীর অনুমান যে
    মিথ্যা নয় তাই আমাদের সকলের মনে হয়।

    টীকা