Chapter Index

    রাত তখন তিনটে পঁয়ত্রিশ।

    বাইরে তখনও বৃষ্টি ঝরছে-তবে খুব প্রবল বর্ষণ নয়। আকাশ কালির মত কালো।

    হাত মুখ ধুয়ে চায়ের টেবিলে এসে দেখি চা ও প্রাতঃরাশ ইতিমধ্যেই
    কৃষ্ণা প্রস্তুত করে ফেলেছে।

    কিরীটী তখনও টেবিলে এসে পৌঁছয়নি। একটু পরেই কিরীটী ঘরে এসে ঢুকল
    একেবারে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েই। গরম গরম ওমলেট ও টোস্ট শেষ করে চায়ের কাপে
    যখন আমরা চুমুক দিচ্ছি, নীচে লাহিড়ী সাহেবের জীপের ফন শোনা গেল।

    ভদ্রলোক খুব পাংচুয়াল, এসে গেছেন। কিরীটী বলে।

    আমি কোন জবাব দিই না। চায়ের কাপটায় চুমুক দিতে থাকি।

    কৃষ্ণা!

    কী?

    জংলী হীরা সিংকে তুলে দিয়েছে তো গাড়ি বের করবার জন্য?

    হ্যাঁ।

    তোর গাড়িতে যাবি নাকি? প্রশ্নটা আমিই করি কিরীটীকে।

    হ্যাঁ।

    তবে লাহিড়ী সাহেবকে জীপ আনতে বললি?

    প্রথমতঃ জীপ গাড়িটাই তো একটা মার্কামারা গাড়ি, তার উপরে পুলিসের
    জীপ! আমরা আমার গাড়িতেই যাব।

    নীচে নেমে এসে দেখি লাহিড়ী সাহেব জীপ থেকে নেমে সিগারেট টানছেন।
    পাশেই কিরীটীর গাড়ি দাঁড়িয়ে।

    সুপ্রভাত।

    কিরীটীই প্রথমে স্বাগত জানায়।

    সুপ্রভাত।

    লাহিড়ী সাহেব?

    বলুন।

     আপনার জীপ আমাদের ফলো
    করবে একটু দূরত্ব রেখে।

    সেইমত ব্যবস্থা হল, লাহিড়ী কোন প্রতিবাদ জানালেন না।

    ট্রামরাস্তায় এসে আমাদের গাড়ি পড়ল। যতদূর দৃষ্টি চলে একেবারে
    জনহীন রাস্তা। ঝিরঝির বৃষ্টি যেন একটা কুয়াশার পর্দার মত থিরথির করে কাঁপছে। পথের
    দুপাশে ইলেকট্রিক আলোগুলো ঝাপসা-ঝাপসা মনে হয়।

    হীরা সিং?

    জী সাব্‌!

    গাড়ি চালাতে চালাতেই সাড়া দিল কিরীটীর ডাকে হীরা সিং।

    আউটট্রাম ঘাট চল।

    নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল হীরা সিং।

    বুঝতে পারলাম প্রশ্ন না করেও, গতরাত্রে কিরীটী ফোনে যে
    রেঙ্গুনগামী জলযান জাহাজটির কথা বলেছিল লাহিড়ীকে এবং যেটা আজই প্রত্যুষে ছাড়বার
    কথা, সেই জাহাজেই আমরা চলেছি।

    কিরীটী কিছু একটা মনে মনে স্থির করেছে।

    একবার আড়চোখে অন্ধকারে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম, কিন্তু বোঝবার
    উপায় ছিল না কিছু তার মুখের দিকে চেয়ে।

    রাত প্রায় চারটে বাজে। হু-হু করে ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া চলমান গাড়ির জানলা-পথে। আমাদের
    চোখেমুখে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। ডানদিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বাঁয়ে রেস কোর্স-দেখতে
    দেখতে মিলিয়ে যায় আমাদের চোখের সামনে।

    গাড়ি একটু পরেই আউটট্রাম ঘাটের সামনে এসে দাঁড়াল। সকলে গাড়ি থেকে
    নামলাম। বিরাট জাহাজের মাস্তুলের লাল নীল বাতি চোখে পড়ে। জেটির মুখেই জলপুলিসের
    অফিসার মিঃ সুন্দরম দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিরীটী ও লাহিড়ীকে দেখে বললেন, গুড মর্ণিং।

    লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করলেন, সব ঠিক আছে তো মিঃ সুন্দরম?

    হ্যাঁ।

    ক্যাপ্টেন?

    তাকে আগেই সংবাদ দিয়েছি, তিনি জাহাজে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

    চলুন তাহলে জাহাজে যাওয়া যাক।

    সুন্দরমের কথা মিথ্যা নয়, ক্যাপ্টেন মিঃ বার্টন ডেকের উপরেই দাঁড়িয়ে
    আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

    সাদা নেভি ড্রেস পরিহিত দীর্ঘকায় পুরুষ মিঃ বার্টন।

    রাতের আকাশে শেষ অন্ধকারে আলোর ছোপ ধরেছে-বৃষ্টি তখনও ঝিরঝির করে
    পড়ছে।

    লাহিড়ী জিজ্ঞাসা করেন, কোন্ কেবিন?

    চোদ্দ নম্বর কেবিন। মিঃ বার্টন জবাব দিলেন।

    এমবারকেশন কখন শুরু হবার কথা? কিরীটী প্রশ্ন করে।

    ভোর পাঁচটা থেকে। আর ঘণ্টা দেড়েক আছে বাকি।

    চলুন তাহলে আমরা চোদ্দ নম্বর কেবিনেই যাই লাহিড়ী সাহেব!

    চলুন। লাহিড়ী বলেন।

    ক্যাপ্টেন বার্টনই আমাদের চোদ্দ নম্বর কেবিনের দিকে নিয়ে চললেন।
    সিঁড়ি দিয়ে আমরা দোতলায় উঠলাম। লাউঞ্জ ডেক পার হয়ে সরু প্যাসেজের মধ্যে গিয়ে
    প্রবেশ করলাম।

    শেষ প্রান্তের ডান দিকের কেবিনটাই চোদ্দ নম্বর কেবিন। কেবিনের
    দরজায় কার্ড ঝুলছে দেখলাম একটা।

    মিঃ ও মিসেস থি’ব।

    ক্যাপ্টেনের কাছেই কেবিনের চাবি ছিল। তারই সাহায্যে কেবিনের দরজা
    খুলে কেবিনের মধ্যে আমরা চারজন প্রবেশ করলাম। আমি, কিরীটী, লাহিড়ী ও ক্যাপ্টেন।

    আপনারা তো মিঃ লাহিড়ী এই কেবিনেই এখন থাকবেন? ক্যাপ্টেন প্রশ্ন
    করলেন।

    হ্যাঁ মিঃ বার্টন, আপনি যেতে পারেন এখন। তবে একটা কথা, আমরা না
    বলা পর্যন্ত জাহাজ ছাড়বেন না।

    না না, ছাড়ব না।

    ঠিক আছে, তাহলে আপনি এখন যেতে পারেন।

    ক্যাপ্টেন বার্টন কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন।

    লাহিড়ী এবারে কিরীটীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মিঃ রায়, এবারে
    অন্ততঃ আপনার এই বিচিত্র অভিযানের রহস্যটা যদি খুলে বলেন–

    বলছি, কিন্তু মিঃ জোসেফকে যে কলকাতায়ে পাঠিয়ে দেবার জন্য
    সিঙ্গাপুর পুলিসকে একটা ওয়ারলেস মেসেজ পাঠাতে বলেছিলাম, পাঠিয়েছেন তো?।

    হ্যাঁ,
    কাল রাত্রেই মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে। এবারে কিছু আলোকসম্পাত করুন!

    মিঃ জোসেফের যে মূল্যবান ও রেয়ার পার্সগুলো খোয়া গিয়েছে তার মধ্যে
    সবচাইতে মূল্যবান ও পৃথিবীর অন্যতম রেয়ার যে মুক্তোটা তার নাম হচ্ছে ব্লু কুইন।

    ব্লু কুইন!

    হ্যাঁ। তার ওজন হবে প্রায় দেড়শ গ্রামের উপর। ঐ মুক্তোটি সম্পর্কে
    একটি কিংবদন্তী আছে।

    কি রকম?

    খুব lucky ঐ মুক্তোটি—অর্থাৎ যার কাছে ঐ মুক্তোটি থাকবে, ভাগ্য
    তাকে চারদিক থেকে ঐশ্বর্য এনে দেবে।

    এ কাহিনী আপনি কোথায় শুনলেন?

    ম্যাডাম মা’থিনের মুখেই শুনেছি। তিনিই আমাকে বলেছিলেন কথাটা আমার
    সঙ্গে দেখা করতে এসে।

    তাই বুঝি?

    হ্যাঁ।
    জোসেফ তার স্ত্রীকে তার বার্থ-ডেতে রেয়ার মুক্তোগুলো দিয়ে মালা করে দিয়েছিল, তার
    মধ্যস্থলে লকেটের মত ছিল ঐ মুক্তোটি-রু কুইন মালা চোর বিশেষ করে ঐ রুকুইনের লোভেই
    মালাটি চুরি করেছিল।

    কে সে?

    কালো পাখী রঘুনাথন। তাহলে সেই রঘুনাথনই— হ্যাঁ, তবে শেষ পর্যন্ত
    সে সেটি হজম করতে পারবে না। কেন?

    কারণ সে এখনও বুঝতে পারেনি যে তার প্রেমই তার গলায় ফাঁস হয়ে এঁটে
    বসতে চলেছে।

    প্রেম?

    হ্যাঁ।

    তাহলে এর মধ্যে নারীও আছে?

    আছে বৈকি। আর নারী একজন ছিল বলেই শেষ পর্যন্ত আমরা হয়ত মুক্তোগুলো
    উদ্ধার করতে পারব।

    কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন, ঐ মুক্তোর মালার সঙ্গে ইউসুফ মিঞার
    হত্যার ব্যাপারটা জড়িয়ে আছে।

    মিথ্যে আমি বলিনি লাহিড়ী সাহেব, ঠিকই বলেছি। কালো পাখীটাই ইউসুফের
    মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে তার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছিল।

    কালো পাখী।

    সেই ময়নাটার কথা ভুলে গেলেন?

    না ভুলিনি, কিন্তু সেই ময়নার সঙ্গে ইউসুফের মৃত্যুর কী সম্পর্ক তা
    তো বুঝতে পারছি না! লাহিড়ী ববেন।

    মুক্তোর মালাটা রঘুনাথন চুরি করে মালা থেকে সম্ভবত মুক্তোগুলো
    খুলে ফেলে।

    কেন?

    কিরীটী বলে, তার কারণ মালার সব মুক্তোগুলোই সমান মূল্যের ছিল না।
    তার মধ্যে যে মুক্তোগুলোর দাম বেশি, সেগুলো ঐ রু কুইনের সঙ্গে ময়নার খাবারের সঙ্গে
    মিশিয়ে রঘুনাথন সম্ভবত ময়নাকে খাইয়ে দেয়।

    বলেন কি?

    আমার অনুমান তাই।

    তারপর?

    রঘুনাথন দলে নিশ্চয়ই একা ছিল না—আর ঐ ধরনের চুরির ব্যাপারে
    সাধারণতঃ একাধিক লোকই থাকে। সেই কারণেই বিশেষ করে রঘুনাথনকে হয়ত ঐ বিশেষ পন্থাটা
    নিতে হয়েছিল, তার ভাগিদারের হাত থেকে কিছু দামী মুক্তো অন্ততঃ সরিয়ে ফেলবার জন্য।
    তবে নিঃসন্দেহে যে পদ্ধতিটা সে মুক্তোগুলো সরিয়ে ফেলবার জন্য গ্রহণ করেছিল সেটা
    সত্যিই অভিনব তো বটেই, সেই সঙ্গে রঘুনাথনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিরও পরিচয় তা থেকে আমরা
    পাই।

    লাহিড়ী প্রশ্ন করেন ঐ সময়, কিন্তু ওই ভাবেই যে রঘুনাথন কিছু দামী
    মুক্তো সরিয়েছিল, আপনি অনুমান করলেন কি করে?

    অনুমান করেছি দুটো ঘটনা থেকে।

    কোন্ দুটো ঘটনা?

    প্রথম ঘটনাটা হচ্ছে, মুক্তোর মালাটি অদৃশ্য হওয়াতে সঙ্গে সঙ্গে
    রঘুনাথন ও সেই অত্যাশ্চর্য ময়না পাখীটিরও অন্তর্ধান–

     দ্বিতীয়?

    দ্বিতীয় হচ্ছে, সেই পাখী কিনে ইউসুফ মিঞাকে মৃত্যুবরণ করতে হল
    বলে। ইউসুফের মৃত্যুর ব্যাপারটা ভেবে দেখুন-হত্যাকারী একাই একজন বা একাধিক থাকুক
    সেরাত্রে নিশ্চয়ই এসেছিল পাখীটা সরিয়ে নেবার জন্য। হয়ত ইউসুফ মি জেগে উঠে বাধা দেয়—যার
    ফলে তাকে নৃশংসভাবে খুন হতে হয়।

    কিন্তু আপনার অনুমানই যদি সত্য হয় মিঃ রায়-রঘুনাথন পাখীটা বেচবে
    কেন?

    রঘুনাথন বেচেছে কে বললে আপনাকে? সুলতানের মুখে, পাখীটা যে বেচতে
    এসেছিল, তার চেহারার যে বর্ণনা আমরা পেয়েছি, তার সঙ্গে রঘুনাথনের চেহারার মিল তো
    আমরা পাইনি।

    তবে? কে এসেছিল পাখী বেচতে?

    রঘুনাথন নয়-তৃতীয় কোন ব্যক্তি যে পাখীর পেটে ঐ মুক্তো আছে নিশ্চয়ই
    জানত না।

    তাই যদি হয় তো সে পাখীটা পেল কোথা থেকে? রঘুনাথন কি পাখীটাকে
    প্রহরায় রাখেনি?

    নিশ্চয়ই রেখেছিল।

    তবে?

    সে ব্যাপারটা জানতে হলে আমাদের ডি’সিলভাকে প্রয়োজন। কারণ ডি’সিলভার
    সঙ্গেই সে লোকটা ইউসুফ মিঞার কাছে পাখীটা বেচতে গিয়েছিল। কিন্তু আর না-চুপ-ওরা বোধ।
    হয় এসে গেছে-পায়ের শব্দ পাচ্ছি!

    সত্যিই প্যাসেজে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।

    কুইক-দরজার দুপাশে সব সরে দাঁড়ান! কিরীটী চাপা গলায় নির্দেশ দিল।

    সঙ্গে সঙ্গে আমরা দরজার দুপাশে—একদিকে কিরীটী ও অন্যদিকে আমি ও
    লাহিড়ী সরে দাঁড়ালাম। একটু পরেই দরজা খুলে গেল কেবিনের।

    প্রথমে একজন দামী সুট পরিহিত পুরুষ ও তার পশ্চাতে এক বর্মিনী নারী
    কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করল। এবং তারা কিছু বোঝবার আগেই চকিতে কিরীটী ওদের সামনে এগিয়ে
    কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিল, মিঃ থি’ব, কোন রকম পালাবার চেষ্টা করো না বা গোলমাল করো
    না, পুলিস কমিশনার মিঃ লাহিড়ী তোমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন।

    টীকা