Chapter Index

    ভিতরে প্রবেশ করে সুইটের সিটিং রুমেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে মুখোমুখি
    হলাম।

    ভদ্রমহিলা সত্যিই সুন্দরী—দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত নিঃসন্দেহে।

    বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। রোগা পাতলা গড়ন। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল
    গৌর। পরনে বর্মিনীদের ধরনে একটি দামী সিল্কের লুঙ্গি ও গায়ে আন্দির ফুলহাতা জামা।
    মুখের গড়ন ঠিক বর্মিনীর মতই।

    পাতলা একটা প্রসাধনের ছাপ মুখে। মাথায় বিরাট একটি প্যাগোড়া খোঁপা।
    দু হাতে তিনগাছা করে হীরকখচিত চুড়ি, গলায় হীরার কণ্ঠি, কানে হীরার দুল। উজ্জ্বল আলোয়
    হীরকখণ্ডগুলি যেন ঝিলিক হানছিল।

    গুড ইভনিং—আসুন মিঃ রায়, আপনার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছিলাম। কথাটা
    বলে। মহিলা আমার দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় কিরীটীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

    আমার বন্ধু-সহকারী—সুব্রত রায়।

    মহিলা প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে বললেন, আপনারা দুজনেই রায়?

    হ্যাঁ। হাসল জবাবে কিরীটী।

    বসুন।

    মুখোমুখি দুটো সোফায় আমরা বসলাম। মহিলাও বসলেন মুখোমুখি।

    বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, তাই না?

    হ্যাঁ।
    কিরীটী জবাব দিল।

    বৃষ্টি দেখে ভাবছিলাম বোধ হয় আসতে পারবেন না!

    কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এ সময় বৃষ্টি তো হবেই-মনসুন–

    উনি যখন আপনার সহকারী—আমরা নিঃসংকোচেই কথাবার্তা বলতে পারি মিঃ রায়,
    তাই তো?

    হ্যাঁ।

    মালা!

    মহিলার ডাকে ভিতরের ঘর থেকে একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের বর্মী তরুণী
    বের হয়ে এল।

    ইয়েস ম্যামু—

    বুঝলাম মালা ঐ মহিলার পরিচারিকা।

    মালাও দেখতে সুন্দরী এবং পরিচারিকা হলেও তার বেশভূষা দামী এবং
    চোখে-মুখে প্রসাধনের চিহ্ন সুস্পষ্ট।

    মালা, ড্রিঙ্কস্! কি দেবে বলুন মিঃ রায়-হুইস্কি?

    আনুন।

    আমার কাছে কিন্তু সব রকম ড্রিঙ্কসই আছে-অন্য কিছু যদি

    না, হুইস্কিই
    আনতে বলুন।

    বলা বাহুল্য ইংরাজীতেই কথাবার্তা চলছিল। ভদ্রমহিলা চমৎকার শুদ্ধ
    ইংরাজী বলেন।

    মালা চলে গেল।

    আরও আধঘণ্টা পরে। দ্বিতীয় রাউণ্ড ড্রিঙ্কস চলেছে তখন। দেখলাম
    ভদ্রমহিলা বেশ ভালই ড্রিঙ্কস করতে অভ্যস্ত।

    কিছুক্ষণ নানা ধরনের কথাবার্তার পর হঠাৎ একসময় ভদ্রমহিলা বলেন,
    মিঃ লাহিড়ী বলছিলেন, আপনি ঠিকই আমার হারটা উদ্ধার করে দেবেন।

    কিরীটী কোন জবাব দেয় না।

    মহিলা আবার বলেন, আমি যখন আমার স্বামীকে বললাম, এ আর কারও কাজ নয়-ওই
    রঘুনাথনেরই কাজ আর সে হারটা চুরি করে সোজা ইণ্ডিয়াতেই এসেছে, জোসেফ কি বলেছিল
    জানেন?

    কি?

    বলেছিল তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জেনো সে হার আর কোনদিনই ফিরে পাওয়া
    যাবে না। কারণ রঘুনাথনকে কোনদিনই আর trace করতে পারবে না। আচ্ছা মিঃ রায়–

    বলুন?

    একবার ওর দেশে গিয়ে খোঁজ করলে হত না?

    একটা কথা মিসেস জোসেফ–

    কি বলুন তো?

    ওই রঘুনাথনের কোন ছবি আপনার কাছে আছে?

    ছবি? You mean, Photo?

    হ্যাঁ।

    আমার album-এর মধ্যে থাকতে পারে। Yes-হ্যাঁ, মনে পড়েছে-আমার
    পাখীটার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ও যখন একদিন পাখীটাকে খাওয়াচ্ছিল আমি পাখীটার একটা
    ফটো নিয়েছিলাম—বোধ হয়
    সেটা আমার album-এ আছে।

    রঘুনাথনই কি পাখীটাকে খাওয়াত নাকি?

    হ্যাঁ। পাখীটা ওকে খুবই ভালবাসত। বেশীক্ষণ ওকে না দেখতে পেলেই
    পাখীটা চেঁচাত নাথন নাথন করে।

    তাই বুঝি?

    হ্যাঁ। সামনে এলে চুপ করত।

    মিসেস জোসেফ!

    বলুন?

    Album কি আপনার সঙ্গে আছে?

    হ্যাঁ।

    একবার দেখতে পারি album-টা?

    আনছি আমি।

    মহিলা উঠে গেল এবং একটু পরেই সুদৃশ্য চামড়ার দামী একটা অ্যালবাম
    হাতে ঘরে এসে ঢুকলেন।

    এই যে—

    মহিলা নিজেই পাতা উলটে ফটোটা বের করে দিলেন।

    কিরীটী হাতে নিয়ে অ্যালবামের ফটোটা দেখতে লাগল। আমিও দেখি। হঠাৎ
    চোখ তুলতেই নজরে পড়ল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মালা।

    মালার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে সরে গেল চট করে দরজার আড়ালে।

    এই ফটোটা আমি নিতে পারি?

    নিশ্চয়ই-খুলে নিন না।

    কিরীটী অ্যালবাম থেকে ফটোটা খুলে নিল। পোস্টকার্ড সাইজের সিপিয়া
    প্রিন্টিং করা ফটোটা। খুব ভাল উঠেছে ফটোটা।

    পাখীটার ক্লোজ-আপে ফটোটা তোলায় রঘুনাথনের মুখটাও স্পষ্ট উঠেছে।
    রঘুনাথন বোধ হয় ফটো তোলার সময় যে ফটো তুলছিল তার দিকেই তাকিয়ে ছিল।

    মহিলা আবার বললেন, জোসেফ আমাকে ইণ্ডিয়াতে আসতে দিতে চায়নি—একপ্রকার
    জোর করেই আমি চলে এসেছি-কারণ হারটার সঙ্গে আমার একটা সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে ছিল—

    কি রকম? কিরীটী প্রশ্ন করে।

    জোসেফ আমার স্বামী হলেও বলব, মানুষ বড় কৃপণ-প্রকৃতির।

    তাই বুঝি?

    হ্যাঁ। হাত দিয়ে তার কখনও একটা পয়সা গলে না। তবু গতবছর আমাদের
    ম্যারেজঅ্যানিভারসারি ডে-তে সে ওই পার্লের হারটা আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল—আর আমাদের
    এগার বছরের ম্যারেড লাইফে ওই প্রথম তার বিবাহ বার্ষিকীতে মূল্যবান প্রেজেন্ট
    আমাকে। যার দাম কমপক্ষেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা!

    কিন্তু তাই যদি বলেন তো—

    কিরীটী মুখের কথা শেষ হল না, মা’থিন বললেন, বুঝতে পেরেছি, আপনি
    আমার এ হীরার সেটটার কথা বলছেন তো?

    হ্যাঁ–মানে–

    কিন্তু ওই সেটটা জোসেফের দেওয়া নয়।

    যদি কিছু মনে না করেন তো–

    মনে করবার কিছু নেই মিঃ রায়-মা’থিন হাসলেন। হেসে বললেন, এটা আমার
    বাবার বিয়েতে দেওয়া উপহার।

    কিন্তু মনে হচ্ছে ও হীরাগুলো নকল নয়—অনেক দাম হবে।

    আমার বাবার আমিই একমাত্র সন্তান। বাবারও জুয়েলারীর ব্যবসা
    আছে-রেঙ্গুনের একজন ধনী নামকরা জুয়েলার আমার বাবা।

    একটা কথা বলব মিসেস জোসেফ?

    বলুন?

    অ্যালবামের প্রথম পাতাতেই যে ফটোটা দেখলাম আপনার পাশে—তিনি নিশ্চয়ই
    আপনার স্বামী?

    হ্যাঁ, আমার স্বামী। তাহলেও আমিই কিন্তু প্রথম পক্ষ। আমাদের
    দুজনার মধ্যে বয়সের পার্থক্য অনেক। প্রায় বাইশ বছর।

    বাইশ বছর!

    হ্যাঁ। যখন আমাদের বিয়ে হয় আমার বাইশ আর আমার স্বামীর চুয়াল্লিশ-rather
    he was an old man at that time. বাবার এতটুকুও ইচ্ছা ছিল না আমাদের বিয়ের
    ব্যাপারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মত দিতে হয়েছিল আমার একান্ত ইচ্ছা দেখে।

    বলতে বলতে একটু থামলেন মা’থিন। হাতের গ্লাসটা তার শূন্য হয়ে গিয়েছিল,
    একটা বড় পেগ গ্লাসে ঢেলে সোড়া মিশিয়ে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন আবার মা’থিন,
    জোসেফ দামী ও রেয়ার জুয়েলসের সন্ধানে বলতে গেলে সারা পৃথিবীটা ঘুরেছিল তার দীর্ঘ
    বাইশটা বছর-জীবনের বিচিত্র তার সে অভিজ্ঞতা। মধ্যে মধ্যে সে রেঙ্গুনে আসত, আমাদের
    মার্চেন্ট স্ট্রীটের বাড়িতে থাকত। ওই আসা যাওয়াতেই তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

    মা’থিন আবার থামলেন।

    তারপর?

    রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বাইরের ঘরে বসে বসে জোসেফ তার জীবনের
    অভিজ্ঞতার কথা-নানা ধরনের দামী-রেয়ার জুয়েলসের বিচিত্র সব কাহিনী আমাকে শোনাত।
    গল্প

    উপন্যাসের চাইতেও সে-সব রোমাঞ্চকর। আমি অদ্ভুত একটা thrill যেন
    অনুভব করতাম। সেই সব কাহিনী জোসেফের মুখে শুনতে শুনতে। একটু একটু করে তার প্রতি আমি
    আকৃষ্ট হই-হয়ত সমস্ত ব্যাপারটা আপনাদের কাছে absurd—অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু
    তবু আমি যেন কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করতাম, আর সেই আকর্ষণই আসলে তার প্রতি অনুরক্ত
    করে তোলে ক্রমশঃ।

    আমি বললাম ঐ সময়, rather interesting!

    মা’থিন বলতে লাগলেন, ও কয়েকদিন পরে চলে যেত, আমি কিন্তু ওর পথ চেয়ে
    থাকতাম। আবার কবে আসবে! লুকিয়ে আমি অবশেষে ওকে পত্র লেখা শুরু করি। ওর জবাব আসত
    আমার এক বান্ধবীর ঠিকানায়। বলতে পারেন ঐ চিঠি লেখালেখির মধ্যে দিয়েই আমাদের
    পরস্পরের মধ্যে নিবিড় এক ভালবাসা গড়ে ওঠে।

    তারপর?

    তারপর আর কি, একদিন আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বাবা-মা প্রথমটায় খুব
    আপত্তি করেছিল, কিন্তু আমার জেদের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হল। চলে এলাম স্বামীর
    সঙ্গে সিঙ্গাপুরে….কিন্তু বিয়ের পর পাচটা মাসও গেল না, আমার ভুল ভেঙে গেল।

    ভুল!

    তাই বলব-ভুলই। কারণ দেখলাম আমাদের গৃহে যখন সে গিয়ে অতিথি হত,
    তখনকার আলাপ-আলোচনা ও পরবর্তীকালে চিঠিপত্রের
    লেনদেনের ভিতর দিয়ে যে আলাপ-আলোচনা আমাদের হয়েছে সেটা জোসেফের চরিত্রের একটা দিক
    মাত্র এবং সেটা তার চরিত্রের আদৌ আসল দিক নয়।

    কি রকম?

    জিজ্ঞাসা করলাম আমিই মা’থিনের মুখের দিকে তাকিয়ে।

    যদিও ইতিমধ্যে আমরা—আমি বা কিরীটী দুটো পেগের বেশী খাইনি, মা’থিন
    কিন্তু ছটা পেগ শেষ করে সপ্তম শুরু করেছিলেন।

    লিকারের প্রভাবে তখন তার মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। চোখের তারা দুটো চক
    করছে। বেশ নেশা হয়েছে—আর হবারই কথা।

    অনর্গল সে বকে চলেছে। নেশার প্রভাবে মানুষ এমনিই হয়—বল্লাহীন হয়ে
    পড়ে।

    হাতের গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে মা’থিন বললেন, মানুষটা দেখলাম
    জীবনে দুটি বস্তুই ভালবেসেছে—আর তা হচ্ছে ঐসব জুয়েলস ও অর্থ। তার মনের সমস্ত
    কোমলতা-সেন্টিমেন্ট-আশা-আকাঙক্ষা সব যেন ঐ নীরস পাথরগুলো এবং অর্থকে ঘিরেই।
    অবিশ্যি। সে যে আমাকে কোনরকম অবহেলা বা অযত্ন করত তা নয়—কিন্তু একজন অল্পবয়সী
    যুবতীর পক্ষে তার কি মূল্য বলুন-স্বামীর অবহেলা বা অযত্ন তবু সহ্য হয়—কিন্তু
    ক্যালাসনেস সহ্য হয় না!

    মা’থিন আবার থামলেন।

    একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, আমি যেন দিন-কে-দিন হাঁফিয়ে উঠতে
    লাগলাম। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে আর টিকতে পারতাম না-আমি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে শুরু
    করলাম। ক্লাবে পার্টিতে যোগ দিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। অবশেষে ড্রিঙ্ক করতে শুরু
    করলাম।

    আপনার স্বামী জানেন না এসব?

    সব জানে। কিন্তু সে কখনও আজ পর্যন্ত আমার কোন ব্যাপারে ইন্টারফিয়ার
    করেনি। সেই থেকে গত কয় বছর ধরে সে আছে তার জুয়েলস আর অর্থ নিয়ে, আর আমি আছি আমার নিজস্ব
    জীবন নিয়ে। গত বছর আমাদের ম্যারেজ-অ্যানিভারসারিতে আমি বলেছিলাম, আমাকে তো আজ
    পর্যন্ত কিছুই প্রেজেন্ট করলে না—এবারে এমন কিছু দাও যাতে অন্তত মনে হয় আমারও একটা
    প্রয়োজন তোমার জীবনে আছে।

    তারপর?

    ও বললে, কি চাও বল?

    যা চাই
    প্রাণে ধরে দিতে পারবে তো।

    পারবো-বল।

    তোমার সিন্দুকের মধ্যে একবার একটা বাক্সে তুমি কতকগুলো সেরা মুক্ত
    দেখিয়েছিলে-ঐ মুক্তোগুলো দিয়ে আমাকে একটা হার করে দাও।

    বেশ–দেব। বললে জোসেফ।

    সেই মুক্তো দিয়েই বোধ হয় হারটা তৈরী হয়েছিল?

    হ্যাঁ।

    কিন্তু এক কথায় মুক্তোগুলো তিনি আপনাকে প্রেজেন্ট করে দিলেন, আশ্চর্য
    লাগছে। প্রথমটায় আমারও তাই মনে হয়েছিল, পরে মনে হল ওই মুক্তোগুলো সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে জোসেফ সংগ্রহ করেছিলো–ওগুলো সে বেচত না।
    অনেক টাকার অফার পেয়েও কখনও বেচেনি।

    কেন?

    সত্যিই আশ্চর্য ছিল যেন সেই মুক্তোগুলো। সাদা মুক্তোগুলোর ভেতর
    থেকে যেন অদ্ভুত দ্যুতি বের হত—কোনটা নীল—কোনটা গোলাপী—কোনটা কমলালেবুর রঙ-জোসেফ
    বলত ওই ধরণের মুক্তো একই প্রকারের ও একই সাইজের বেশী হয় না। অত্যন্ত রেয়ার
    স্পেসিমেন সেগুলো। তাই ওর ওই মুক্তোগুলোর প্রতি একটা অদ্ভুত মমতা ছিল-প্রাণে ধরে
    কখনো বেচতে পারেনি। কিন্তু আমাকে দিলে সেগুলো বেচাও হল না, ঘরের জিনিস ঘরেই রইল
    তার চোখের সামনে-আমাকেও উপহারের সান্ত্বনা দেওয়া হল-তাই বোধ হয় সেগুলো দিয়ে আমাকে
    একটা হার করে দিতে তার আপত্তি হয়নি।

    মুক্তোর হারটা চুরি যাবার পর নিশ্চয়ই তাহলে আপনার স্বামীর খুব
    লেগেছে?

    শুধু লাগেনি মিঃ রায়, ও যেন পাগল হয়ে গিয়েছে মুক্তোর হারটা হারিয়ে
    যাওয়ায়। খায় না দায় না কোথায়ও বের হয় না—এমন কি ব্যবসা পর্যন্ত গুটিয়ে বসে আছে সেই
    অবধি।

    স্বাভাবিক। বলি আমি।

    ছাব্বিশ বছর ধরে একটা একটা করে মুক্তোগুলো সে সংগ্রহ করে আগলে
    রেখেছিল যখের ধনের মত-কাজেই বুঝতে পারছেন সেই মুক্তোগুলো ওইভাবে চুরি যাওয়ায় তার
    মনের অবস্থা কি হতে পারে! সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, এখন আমার মনে হচ্ছে যদি
    মুক্তোগুলোর ওপরে লোভ না করতাম তবে তো সে আমাকে দিত না আর সেগুলোকে অমন করে
    হারাতেও হত না। সব কিছুর জন্য আজ তাই আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে প্রতি
    মুহূর্তে। আমি যেন কিছুতেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না।

    মা’থিনের চোখের কোল দুটো জলে ভরে আসে। নেশায় রক্তিম চোখ দুটো জলে
    টলমল করতে থাকে। আর এও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, মুখে ওই মহিলা একটু আগে যাই
    বলুক-ওর স্বভাবে-চরিত্রে যতই অসামঞ্জস্য থাক, ও ওর স্বামী জোসেফকে সত্যিই ভালবাসে।
    আর হয়ত নিজেও সে কথাটা নিজে জানে না।

    কথা বলা বোধ হয় শেষ হয়ে গিয়েছিল মা’থিনের, সে অতঃপর কেমন যেন ঝিম
    দিয়ে বসে থাকে।

    রাত বেশ হয়েছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত তখন প্রায় সোয়া
    এগারোটা। বাইরে এখনও বৃষ্টি পড়ছে কিনা কে জানে।

    শীততাপনিয়ন্ত্রিত হোটেলের ঘরের মধ্যে বসে সেকথা
    জানবারও উপায় ছিল না।

    কিরীটীও চুপচাপ বসে।

    তার বসবার ভঙ্গির মধ্যে শীঘ্র ওঠবার কোন লক্ষণই যেন পরিলক্ষিত হয়
    না।

    ঘরের মধ্যে আমাদের তিনজনকে ঘিরে একটা স্তব্ধতা থমথম করছে।

    হঠাৎ কিরীটীই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললে, আচ্ছা মিসেস জোসেফ, আপনার
    যে হারটা খোয়া গিয়েছে তার মধ্যে কতগুলো মুক্তো ছিল বলতে পারেন?

    ওই মুক্তোর মালার মধ্যে যে মুক্তোর কথা একটু আগে বলেছি সব তা ছিল
    না।

    তবে?

    রেয়ার ও মূল্যবান মুক্তো ছিল গোটা-কুড়িক—তার মধ্যে ব্ল কুইন
    মুক্তোটি ছাড়াও গোটা এগারোর দাম সব চাইতে
    বেশী—অন্তত বিশ হাজার তো তার দাম হবেই। বাকিগুলো ছিল যদিও আসল মুক্তো, তাহলে অত
    দামের নয়।

    আর কতগুলো মুক্তো ছিল?

    বোধ হয় সব সমেত আটচল্লিশটা। কিন্তু ও কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন মিঃ
    রায়?

    কারণ মুক্তোগুলো সব হয়ত পারব না আমরা শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করতে।

    পারা যাবে না?

    না। কারণ আমার অনুমান–

    কী?

    মুক্তোর মালাটা যে চুরি করেছে সে সঙ্গে সঙ্গেই হার থেকে মুক্তোগুলো
    খুলে ফেলেছে। কেন–ও কথা বলছেন কেন?

    যেহেতু চোরের ঐ মালার মধ্যে সত্যিকারের আসল ও রেয়ার যে মুক্তোগুলো
    ছিল সেগুলোর উপরেই লোভ ছিল। সে হয়ত তাই মালাটা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মালা থেকে
    সে মুক্তোগুলো খুলে নিয়েছে—আর সব মুক্তোগুলোও হয়ত একজনের কাছে নেই।

    কি বলছেন আপনি মিঃ রায়?

    মুক্তোগুলো লুকিয়ে রাখতে হলে সেটাই প্রকৃষ্ট উপায়। আচ্ছা যে বিশেষ
    মুক্তোগুলোর। কথা একটু আগে আপনি বললেন তার এক-একটির সাইজ কি রকম হবে?

    কম-বেশী এক একটা মটরের আকার হবে।

    আচ্ছা মিসেস জোসেফ, আজ রাত অনেক হল, এবারে আমরা উঠব।

    সে কি, এত রাত্রে কিছু না খেয়ে যাবেন?

    আজ নয়—যদি আপনার মুক্তোগুলো উদ্ধার করতে পারি তাহলে একদিন সে ভোজ
    খাওয়া যাবে।

    সে রাত্রের মত অতঃপর আমরা বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

    টীকা