Chapter Index

    প্রিয়তোষই লেটার-বকস্ থেকে পরের দিন বিটের পিওনের সাহায্যে চিঠিটা
    সংগ্রহ করে এনেছিল।

    অবনী চিঠিটা পেয়েই কিরীটীকে ফোনে সংবাদ দিয়েছিল।

    একটা চিঠি পাওয়া গিয়েছে কিরীটীবাবু।

    কিরীটী ঐসময় কৃষ্ণার সঙ্গে বসে দাবা খেলছিল।

    মনটার মধ্যে তখনও দাবার ছকটা ও দাবার খুঁটিগুলোই ঘোরাফেরা করছিল।

    বলে, চিঠি!

    হ্যাঁ।

    কার?

    মিত্ৰাণীর।

    মিত্ৰাণী চিঠি দিয়েছে নাকি!

    না না–

    তবে?

    সে লিখেছিল একজনকে।

    কাকে?

    সঞ্জীব দত্তকে। আপনি আসুন একবার।

    এতক্ষণে যেন কিরীটী তার নিজের মধ্যে ফিরে আসে। মনোযোগী হয়ে ওঠে।
    বলে, মিত্ৰাণী মানে সেই সুশান্ত চ্যাটার্জির শ্যালিকা?

    হ্যাঁ।

    আসছি আমি।

    কিরীটী ফোনটা নামিয়ে রাখল।

    আর দেরি না করে জামাটা কোনমতে গায়ে চড়িয়ে তখুনি সোজা থানায় চলে
    আসে। প্রিয়তোষ তখনও তার কথা ফলাও করে অবনীকে বলছিল। কিরীটীকে থানায় প্রবেশ করতে
    দেখে সে থেমে যায়।

    এই যে আসুন-শেষ পর্যন্ত আপনার ফাঁদে পা দিয়েছেন দেবী—

    হাসতে হাসতে অবনী বলে।

    কই, দেখি কি চিঠি?

    খোলা চিঠিটা কিরীটীর হাতে এগিয়ে দেয় অবনী মিত্র।

    সযত্নে জলের সাহায্যে চিঠিটা খুলে ফেলেছিল অবনী মিত্র।

    খাম থেকে চিঠিটা টেনে বের করে কিরীটী।

    উপরে সঞ্জীব দত্তর নাম-ঠিকানা থাকলেও ভিতরে চিঠিতে কোন সম্বোধন
    নেই। এক সংক্ষিপ্ত চিঠি :

    তোমার ব্যাপার কি সত্যিই বুঝতে পারছি না।

    রাগ করেছ নাকি? নাকি খুব কাজে ব্যস্ত! কুড়ি-পঁচিশ দিনেরও বেশী হয়ে
    গেল একটিবার দেখা করবারও সময় পেলে না?

    আমার বিপদটা কি তুমি বুঝতে পারছ না? সত্যি সর্বক্ষণ আমার বুকটা কাঁপছে ভয়ে আর দুশ্চিন্তায়। কি
    হবে বুঝতে পারছি না। দারোগাবাবু বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছেন।

    আরও কি সেদিন বলে গেছেন জান? কুন্তদি নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি। তাকে
    হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে জামাইবাবুরও চোখের দৃষ্টি, কথাবার্তা ইদানীং যেন
    কেমন মনে হচ্ছে।

    লক্ষ্মীটি, চিঠি পাওয়া মাত্রই তুমি এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

    দরজায় টোকা দিলেই দরজা খুলে দেব।

    আমি জেগেই থাকব।

    ইতি—তোমার মিতুয়া

    কিরীটী বার-দুই চিঠিটা আগাগোড়া পড়ল। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে
    অবনী মিত্রের দিকে তাকাল।

    চিঠিটা কোথায় পেয়েছেন?

    প্রিয়তোষ এনেছে, তবে আর বলছি কি! ভাগ্যে আপনি বাড়িটার ওপর
    সর্বক্ষণ ওয়াচ রাখতে বলেছিলেন! অবনী মিত্র পরিতৃপ্তির হাসি হাসেন।

    কোথায় পেলেন, প্রিয়তোষবাবু? কিরীটী প্রিয়তোষের মুখের দিকে তাকায়।

    ওদের কোয়ার্টারের কাছে ঠিক রাস্তার মোড়ে যে লেটার-বক্সটা আছে, কাল
    একসময় মিত্ৰাণী দেবী এসে তার মধ্যে চিঠিটা ফেলে দেয়। আজ সকালে চিঠিটা পিওনের
    সাহায্যে হাতিয়েছি।

    হুঁ!
    কিরীটী কি যেন ভাবছে।

    কি ভাবছেন মিঃ রায়?

    কিরীটী সে কথার জবাব না দিয়ে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, বেলা
    সোয়া আটটা-চলুন—উঠুন–

    উঠব।

    হ্যাঁ, চলুন একবার ঘুরে আসি।

    কোথায়?

    সুশান্ত চ্যাটার্জির কোয়ার্টারে।

    যাবেন?

    হ্যাঁ, চলুন।

    .

    ওরা আর দেরি করে না। অবনী মিত্রের জীপেই দুজনে বের হয়ে পড়ে। ওরা
    যখন সুশান্ত চ্যাটার্জির কোয়ার্টারের সামনে এসে জীপ থেকে নামল, নটা বাজতে তখনও
    মিনিট কুড়ি বাকি।

    কলিং বেল টিপতেই একটু পরে দরজাটা খুলে গেল।

    সামনে দাঁড়িয়ে মিত্ৰাণী। তার চোখে-মুখে যেন রাত্রি-জাগরণের একটা বিষণ্ণ
    ক্লান্তি। মিত্ৰাণী ওদের ঐ সময় দেখে যেন একটু অবাকই হয়।

    কিরীটীই প্রশ্ন করে, সুশান্তবাবু বাড়িতে আছেন?

    হ্যাঁ।

    কি করছেন তিনি?

    ওরা ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

    দুজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দুটো চেয়ার অধিকার করে বসে।

    কি করছেন তিনি?

    কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

    ঘুমোচ্ছেন বোধ হয়।

    এখনও ঘুমোচ্ছন?

    কিরীটীর প্রশ্নে মিত্ৰাণী মাথাটা নীচু করে। কোন জবাব দেয় না।

    রাত্রে ডিউটি ছিল বুঝি মিঃ চ্যাটার্জির? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

    না।

    তবে এমনি বেলা পর্যন্তই ঘুমোন নাকি উনি?

    সে প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে মিত্ৰাণী বলে, আমি ডেকে দিচ্ছি
    তাকে।

    মিত্রাণী ভিতরের দিকে পা বাড়ায়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে বাধা দেয়।
    বলে, শুনুন শুনুন, ব্যস্ত হবেন না, একটু পরে তাকে ডাকলেও চলবে।

    মিত্ৰাণী তাকায় কিরীটীর মুখের দিকে।

    বসুন, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

    মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে আছে।

    বসুন!

    মিত্ৰাণী কিন্তু বসে না। দাঁড়িয়েই থাকে।

    রাহুল কোথায়?

    স্কুলে গেছে।

    আর ভয় পায়নি তো?

    ভয়!

    হ্যাঁ, আমার মনে হয় কোন কারণে ভয় পেয়েই বোধ হয় ওর হঠাৎ সেদিন জ্বর
    হয়েছিল।

    ভয় কেন পাবে?

    পেতেও তো পারে। যেমন ধরুন আচমকা কাউকে জানালার ধারে অন্ধকারে দেখে
    হঠাৎ ঘুম ভেঙে–

    মিত্ৰাণী কিরীটীর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তখনও।

    যাক সে কথা। সেদিন আপনি আমাদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন,
    দুর্ঘটনার দিন রাত্রে তৃতীয় কোন ব্যক্তি আপনার শোবার ঘরে আসেনি!

    হ্যাঁ।

    কিন্তু, যদি বলি আপনি deliberately-ইচ্ছা করেই মিথ্যা কথা বলেছেন?

    মিথ্যা!

    হ্যাঁ, মিথ্যা—আপনি মিথ্যা বলেছেন।

    আমি–

    শুনুন মিত্ৰাণী দেবী, আমি জানি সে-রাত্রে কেউ আপনার ঘরে এসেছিল;
    আবার আমি জিজ্ঞাসা করছি-এখনও বলুন, কে তৃতীয় ব্যক্তি সে-রাত্রে আপনার ঘরে এসেছিল?

    কিরীটীর কণ্ঠস্বর কঠিন তীক্ষ্ণ, চোখের দৃষ্টি যেন অন্তস্তল ভেদ
    করে যাচ্ছে।

    কিরীটীর কণ্ঠস্বর—বিশেষ করে অন্তর্ভেদী কিরীটীর চোখের সেই দৃষ্টি
    সহসা মিত্ৰাণীকে যেন কেমন বিবশ করে দেয়।

    বলুন, কে এসেছিল?

    মিত্ৰাণী যেন পাথর।

    সঞ্জীব দত্ত এসেছিল, তাই না?

    না, না–

    জানেন—একটু থেমে কিরীটী বলে, শুনুন মিত্ৰাণী দেবী, সত্যকে আপনি
    চাপা দিয়ে রাখতে পারবেন না, প্রকাশ তা পাবেই। সূর্যের আলোকে চাপা দেওয়া যায় না,
    এখনও বলুন—এখনও স্বীকার করুন সে রাত্রে কে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?

    মিত্ৰাণী যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। কোন সাড়া নেই, কোন শব্দ নেই তার
    মুখে। ওষ্ঠে এতটুকু কুঞ্চনও নেই। দু-চোখে ভাষাহীন বোবা দৃষ্টি।

    এখনও বলুন মিত্ৰাণী দেবী, কে এসেছিল আপনার ঘরে সে-রাত্রে? এখন না
    বললেও জানবেন—আজ হোক কাল হোক সব বলতে আপনাকে হবেই। কিরীটী বলতে থাকে, স্বীকার
    আপনাকে করতেই হবে, নচেৎ অবনীবাবু আপনাকে আপনার বোন শকুন্তলা দেবীর হত্যাপরাধে
    গ্রেপ্তার করবেন।

    হত্যাপরাধে।

    হ্যাঁ, শকুন্তলা দেবী যে সে-রাত্রে বিষ খেয়ে অত্মহত্যা করেননি,
    সে-কথা আপনি জানেন।

    আমি বিশ্বাস করি না সে-কথা।

    বিশ্বাস না করলেও তাই সত্য বলে জানবেন। তিনি আত্মহত্যা করেননি।
    তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা-খুন করা হয়েছে।

    না,
    না–

    হ্যাঁ, তাকে হত্যা করা হয়েছে-নিষ্ঠুর, নৃশংস হত্যা। এখনও বলুন,
    সে-রাত্রে আপনার জামাইবাবু ছাড়াও তৃতীয় ব্যক্তি কে আপনার ঘরে এসেছিল? বলুন?

    কিরীটীর কণ্ঠস্বর, তার চোখের ধারালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মিত্ৰাণীকে
    যেন কেমন বিবশ করে দেয়।

    টীকা