Chapter Index

    দুপুরের
    ট্রেনেই কিরীটী কলকাতা ফিরে এল।

    ঐদিনটা শনিবার থাকায় অফিসের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সত্যশরণ তার ঘরেই
    ছিল।

    কিরীটীকে তার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সত্যশরণ কিরীটীর ঘরে এসে ঢুকল। কিরীটী জামার গলার বোতামটা
    খুলছে তখন।

    কিরীটী!

    কে, সত্যশরণ,
    এসো এসো

    গিয়েছিলে কোথায়?

    এই কলকাতার বাইরে একটু
    কাজ ছিল—

    এদিকে পাড়ার ব্যাপার শুনেছো তো সব?

    না,
    কি বল তো?

    আজ সকালে যে আবার একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে এই পাড়ায়!

    বল কি?
    কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী সত্যশরণের
    দিকে ফিরে তাকায়।

    জামার বোতাম আর খোলা হয় না।

    হ্যাঁ, এবারে অবিশ্যি একেবারে ট্রাম-রাস্তার উপরে ঐ যে মোড়ে
    চারতলা ব্যালকনীওয়ালা লাল বাড়িটা আছে, তারই বারান্দার নীচে মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবারে।

    বল কি?
    বাঙ্গালী?

    হ্যাঁ।

    এবং পোশাক দেখে মনে হয় বেশ ধনীই লোকটা ছিল। বাঁ হাতের দুই আঙুলে
    দুটো ধীরে-বসানো সোনার আংটি ছিল

    কিরীটী রীতিমত উৎসাহী হয়ে ওঠে। তারপর?

    তারপর
    আর কি! পুলিস এসে মৃতদেহ রিমুভ করে—

    মৃতদেহের গলায় তেমনি সরু
    কালো দাগ ছিল?

    সরু
    কালো দাগ!

    কথাটা সত্যশরণ
    বুঝতে না পেরে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

    হ্যাঁ।

    তা তো জানি না ঠিক।

    ওঃ

    হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কথাটা বলে কিরীটীও বেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল।

    সত্যশরণ
    জিজ্ঞাসা করে, মৃতদেহের
    গলায় কি সরু
    কালো দাগের কথা বলছিলে কিরীটী?

    কিরীটী অগত্যা যেন কথাটা খোলাখুলি ভাবে না বলে একটু ঘুরিয়ে বলে, সংবাদপত্রে তোমরা
    লক্ষ্য করেছে কিনা জানি না, এর আগের আগের বার মৃতদেহের description প্রসঙ্গে
    প্রকাশিত হয়েছিল মৃতদেহের
    গলায় একটা সরু
    কালো দাগের কথা। তা পুলিস
    কাউকে arrest করেছে নাকি?

    না।
    তবে আশেপাশের বাড়ির লোকদের অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শুনলাম।

    মৃতদেহ
    প্রথম কার নজরে পড়ে?

    তা ঠিক জানি না।

    সন্ধ্যার দিকেই কিরীটী থানায় গেল বিকাশের সঙ্গে দেখা করতে।

    বিকাশ তখন ঐ এলাকারই একটা মোটর-অ্যাকসিডেন্টের রিপোর্ট নিচ্ছিল।
    কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললে, এই যে কিরীটী, এসো বসো, এই রিপোর্টটা শেষ করে নিই
    কথা আছে।

    রিপোর্ট শেষ করে ঘর থেকে সকলকে বিদায় করে দিয়ে বিকাশবাবু, বললেন, শুনেছো নাকি তোমাদের
    পাড়ার সকালের ব্যাপারটা?

    সকালের ট্রেনেই কলকাতার
    বাইরে একটু
    গিয়েছিলাম। এসে শুনলাম।

    আমি তো ভাই আজকের ব্যাপারে একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি। এই কয় মাসে
    চার-চারটে মার্ডার
    একই এলাকায় বলে একটু
    থেমে যেন দম নিয়ে আবার বললেন, বড় সাহেবের সঙ্গে আজ তো একচোট হয়েই গিয়েছে।
    Inefficient, অমুক-তমুক, কত কি ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে যাচ্ছেতাই করে বললেন অফিসের
    মধ্যে।

    কিরীটী বুঝতে পারে অফিসে বড়কর্তার কাছে মিষ্টি মিষ্টি বেশ দুটো
    কথা শুনে বিকাশ বেশ একটু
    চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সত্যই তো, একটার পর একটা খুন হয়ে যাচ্ছে অথচ আজ পর্যন্ত তার কোন
    কিনারা হল না!

    কিরীটী হাসতে থাকে।

    বিকাশ বলে, তুমি হাসছ রায়—

    ব্যস্ত হয়ে তো কোন লাভ নেই। ব্যাপার যা বুঝছি, বেশ একটু জটিলই। সব কিছু গুছিয়ে
    আনতে একটু
    সময় নেবে। কিরীটী আশ্বাস দেয়।

    বিকাশ কিরীটীর শেষের কথায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু বুঝতে পেরেছো নাকি?

    না,
    মানে

    দোহাই তোমার, যদি কিছু বুঝতে পেরে থাকে তো সোজাসুজি বল। আমি ভাই
    সত্যিই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

    সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তাড়াহুঁড়োর ব্যাপার তো নয় ভাই এটা। খুব ধীরে ধীরে
    এগুতে হবে।

    তারপর
    আবার জিজ্ঞাসা করে কিরীটী বিকাশকে, হ্যাঁ ভাল কথা মৃতদেহের identification হয়েছে?

    না,
    কই আর হলো! এখন পর্যন্ত কোন খোঁজই পড়েনি।

    মৃতদেহ তো মর্গেই
    এখনো আছে তাহলে?

    হ্যাঁ। কাল পোস্টমর্টেম হবে।

    মৃতদেহের
    আশেপাশে বা মৃতদেহে এমন কিছু
    নজরে পড়েছে তোমার suspicion হওয়ার মত, বা কোন clue?

    না, তেমন কিছু নয়—তবে কাল শেষরাত্রে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে
    সেই বাড়ির ব্যালকনির ধার ঘেষে গাড়ির টায়ারের দাগ পাওয়া গিয়েছিল রাস্তায়।

    আর কিছু?
    মানে মৃতদেহের জামার পকেটে কোন কাগজপত্র বা কোন রকমের ডকুমেন্ট বা

    না।

    মর্গে গিয়ে একবার মৃতদেহটা দেখে আসা যেতে পারে?

    তা আর যাবে না কেন!

    আজ এখনি?

    এখুনি!

    হ্যাঁ।

    বিকাশবাবু
    কি একটু
    ভেবে বললেন, বেশ চল।

    দুজনে থানা থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ময়নাঘরে এলেন।

    ময়নাঘরের ইনচার্জ ডোমটা ময়নাঘরের সামনেই একটা খাটিয়া পেতে শুয়ে
    ছিল। ইউনিফর্ম পরিহিত বিকাশকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল।

    আজ সকালে শ্যামবাজার থেকে যে লাশটা এসেছে সেটা দেখবো, ভিতরে চল।

    কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে ডোমটা দরজা খুলতেই একটা উগ্র ফর্মালীন ও অনেকদিনের
    মাংসপচা চামসে মিশ্রিত গন্ধ নাসারন্ধ্রে
    এসে ঝাপটা দিল।

    হলঘরটা পার হয়ে দুজনে ডোমের পিছনে পিছনে এসে ঠাণ্ডাঘরে প্রবেশ
    করল।

    একটা স্ট্রেচারের উপরে সাদা চাদরে ঢাকা মৃতদেহটা মেঝেতেই পড়েছিল।

    ডোমটা চাদরটা
    সরিয়ে দিল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক।

    মুখটা যেন কালচে মেরে গিয়েছে। নিখুতভাবে দাড়ি-গোঁফ কামানো। ডান
    গালের উপরে একটা মটরের মত কালো আঁচিল।

    পরিধানে ফিনফিনে আন্দির পাঞ্জাবি ও সরু কালোপাড় মিহি মিলের ধুতি।

    আন্দির জামার তলা দিয়ে নেটের গেঞ্জি চোখে পড়ে।

    কিরীটী নীচু
    হয়ে দেখলে, গলায় আধ ইঞ্চি পরিমাণ একটা সরু
    কালো দাগ গলার সবটাই বেড় দিয়ে আছে।

    চোখ দুটো যেন ঠেলে কোটর থেকে বের হয়ে আসতে চায়, চোখের তারায়
    সাব-কনজাংটাইভ্যাল হিমারেজও আছে।

    মুখটা একটু
    হাঁ করা;
    কষ বেয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত কালচে রক্তের ধারা জমাট বেধে আছে।

    মৃতদেহ উল্টেপাল্টে দেখল কিরীটী, দেহের কোথাও সামান্য আঘাতের
    চিহ্নও নেই।

    স্পষ্টই বোঝা যায় কোন কিছু
    গলায় পেচিয়ে শ্বাসরোধ করেই হত্যা করা হয়েছে।

    ডান হাতের উপরে উল্কিতে A ইংরাজী অক্ষরটি লেখা। কিরীটী উঠে দাঁড়াল, চলুন বিকাশবাবু, দেখা হয়েছে।

    মর্গ থেকে বের হয়ে কিরীটী আর বিকাশবাবুর সঙ্গে গেল না। বিকাশবাবুর ভবানীপুরের দিকে একটা
    কাজ ছিল, তিনি ভবানীপুরগামী ট্রামে উঠলেন।

    কিরীটী শ্যামবাজারগামী ট্রামে উঠল।

    রাত বেশী হয়নি। সবে সাড়ে আটটা।

    কলকাতা শহরে গ্রীষ্মরাত্রি সাড়ে আটটা তো সবে সন্ধ্যা!

    ট্রাম
    থেকে নেমে কিরীটী সোজা একেবারে অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁয় এসে উঠলো।

    এক কাপ চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিতে হবে।

    রেস্তোরাঁ তখন চা-পিপাসীদের ভিড়ে বেশ সরগরম।

    কিরীটী একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। একপাশে নিত্যকার মত ছোট একটা
    টেবিল নিয়ে কাউন্টারের মধ্যে বসে আছেন অন্নপূর্ণা
    হোটেল ও রেস্তোরাঁর আদি ও অকৃত্রিম একমাত্র মালিক ভূপতিচরণ।

    রেস্তোরাঁটায় পাড়ার ছেলেদেরই বেশী ভিড়। নানা আলোচনা চলছিল
    খদ্দেরদের মধ্যে চা-পান করতে করতে ঐ সময়টায়।

    হঠাৎ কানে এলো কিরীটীর, তার ডান পাশের টেবিলে চারজন সমবয়সী ছোকরা
    চা-পান করতে করতে সকালের ব্যাপারটাই আলোচনা করছে।

    কিরীটী উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

    লাচুলওয়ালা
    পাঞ্জাবি ও সার্টের কমবিনেশন জামা গায়ে ৩০।৩২ বৎসরের একটি যুবক তার পাশের যুবকটিকে বলছে, তোদের বাড়ি তো একেবারে সাত নম্বর
    বাড়ির ঠিক অপজিটে, আর তুই তো শালা রাত্রিচর, তোরও চোখে কিছু পড়েনি বলতে চাস ফটকে?

    সম্বোধিত ফটিক নামধারী যুবকটি
    প্রত্যুত্তরে বলে, একেবারে যে কিছুই দেখিনি মাইরি তা নয়, তবে ধেনোর নেশার চোখে খুব
    ভাল করে ঠাওর হয়নি।

    কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় শিকারী বিড়ালের কানের মত সতর্ক সজাগ হয়ে
    ওঠে।

    ধেনো! বলিস কি ফটকে! তোর তো সাদা ঘোড়া চলে না রে!

    ফটিক তার বন্ধু
    রেবতীর কথায় ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে থাকে। বোঝা যায় কথাটা তার মনে লেগেছে। তারপর বলে, কি করি ভাই! জানিস
    তো অভাবে স্বভাব নষ্ট। গত মাস থেকে মা আর দুশোর বেশি একটা পয়সা দেয় না। শালা দুশো
    টাকা মাসের পনের তারিখেই ফুটুস
    ফুঁ!
    তাই ঐ ধেনোই ধরতে হয়েছে। কাল রাত্রে নেশাটাও একটু বেশী হয়েছিল

    মুখবন্ধ
    ছেড়ে ব্যাপারটা বল তো! রেবতী বলে ওঠে।

    তখন বোধ করি ভাই সাড়ে তিনটে হবে। নেশাটা বেশ চড়চড়ে হয়ে উঠেছে—

    ফটিকের শেষের কয়েকটা কথা কিরীটী শুনতে পেল না, কে একজন খরিদ্দার
    চপের কিমার মধ্যে নাকি কাঠের গুঁড়ো পেয়েছে, সে চেচাচ্ছে, বলি ওহে বংশীবদন! আজকাল কিমার বদলে স্রেফ বাবা
    কাঠের গুঁড়ো চালাচ্ছ?
    ধর্মে সইবে না বাবা, ধর্মে সইবে না। উচ্ছন্নে যাবে।

    ভূপতিচরণ হোটেলের মালিক হন্তদন্ত হয়ে প্রায় এগিয়ে
    এলেন, কি বলছেন স্যার! অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁর প্রেস্টিজ নষ্ট করবেন না!

    খানিকটা গোলমাল ও হাসাহাসি চলে। হোটেলের সবেধন নীলমণি ওয়েটার
    বংশীবদন একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মত। ফটিক তখন বলছে, এক পসলা তার আগে বৃষ্টি হয়ে
    গিয়েছে। জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দিব্যি ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে দেখলাম পূর্বদিক থেকে একটা গাড়ি এসে
    দাঁড়াল–তারপর
    সেই গাড়ি থেকে একজন লোককে দেখলাম কি একটা ভারী মত জিনিস ধরে গাড়ি থেকে রাস্তায়
    নামিয়ে রাখল। তবে শালা গাড়িটা যখন চলে যায় না তখন দেখছি গাড়িটা একটা ট্যাক্সি

    বলিস কি ফটকে! ট্যাক্সি!

    হ্যাঁ। আর এ পাড়ারই ট্যাক্সি।

    মাইরি!

    তবে আর বলছি কি! W. B. T. 307। গঙ্গাপদর
    সেই কালো রঙের চকচকে প্রকাণ্ড ডিসোটো ট্যাক্সি গাড়িটা

    তারপর?

    তারপর
    আর কিছু জানি না বাবা। কোথায় মাঝরাতে কে কি করছে না করছে জেনে লাভ কি! সোজা গিয়ে
    বিছানায় লম্বা। ঘুম ভাঙল আজ সকালে প্রায় আটটায়, তখন আমার বোন চিনুর কাছে শুনি আমাদের বাড়ির
    সামনে নাকি হৈ-হৈ কাণ্ড! সাত নম্বর বাড়ির করিডরের সামনে কাল একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে।
    পুলিস
    এসেছে—সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল গত রাত্রির কথা। তাড়াতাড়ি উঠে আগে শালা জানালাটা
    বন্ধ করে দিলাম। তবু,
    কি বেটারা রেহাই দেয়! ধাওয়া করেছিল আমার বাড়ি পর্যন্ত। বললে, সামনের বাড়িতে থাকেন,
    দেখেছেন নাকি কিছু?
    স্রেফ বলে দিলাম—মাল টানা অভ্যাস আছে মশাই। অত রাত্রে কি আর জ্ঞানগম্যি থাকে!

    কথাটা শেষ করে শ্রীমান ফটিক বেশ রসিয়ে রসিয়ে আবার হাসতে লাগল।

    কিরীটীরও মনে পড়ে ন্যায়রত্ন লেনের মোড়ে অনেক দিন ওর নজরে পড়েছে ঝকঝকে ডিসোটো ট্যাক্সি গাড়িটা।
    নম্বরটা যার W. B. T. 307।

    ড্রাইভিং সীটে মোটা কালোমত যে লোকটাকে বসে বসে প্রায়ই ঝিমুতে দেখা
    যায়, তার বসন্তের ক্ষতচিহ্নিত গোলালো মুখখানাও কিরীটীর মানসনেত্রে উঁকি দিয়ে গেল ঐ
    সঙ্গে।

    ডিসটো ট্যাক্সি গাড়ি, W. B. T. 307

    গাড়ির কথাটা ও নম্বরটা বার বার কিরীটীর মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে
    থাকে।

    এই পাড়ায় গত কয়েক মাস ধরে যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আজ পর্যন্ত চারচারটি রহস্যময় মৃত্যু কেবলমাত্র লাশের মধ্যে
    প্রমাণ রেখে গিয়েছে, ঐ W. B. T. 307 নম্বরের গাড়ির সঙ্গে কি তার কোন যোগাযোগ আছে?

    পরের দিনও সন্ধ্যার পর কিরীটী আবার থানায় গেল।

    বিকাশ একটা জরুরী কাজে যেন কোথায় বের হয়েছিলেন, একটু পরেই ফিরে এলেন।

    কিরীটীকে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, এই যে কিরীটী! কতক্ষণ?

    এই কিছুক্ষণ। তারপর
    ময়না-তদন্ত হল?

    বিকাশ বসতে বসতে বললেন, হ্যাঁ, ময়না-তদন্তও হয়েছে—লোকটার
    identityও পাওয়া গিয়েছে।

    পাওয়া গিয়েছে নাকি?

    হ্যাঁ। লোকটার নাম অরবিন্দ দত্ত। এককালে চন্দননগরের ঐ দত্তরা বেশ বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ ছিল। এখন অবিশ্যি
    পড়তি অবস্থা। তিন ভাই-বীজেন্দ্র, মহেন্দ্র, অরবিন্দ। ঐ মানে অরবিন্দই ছোট সবার।

    হ্যাঁ, তা লোকটার স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল ইত্যাদি কোনকিছু খোঁজখবর
    পেলে?

    পেয়েছি, আর সেইখান থেকে মানে বীজেন্দ্রবাবুর ওখান থেকেই আসছি। বীজেন্দ্রবাবু আজ বছর দশেক হল আলাদা হয়ে
    পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ হিসাবে কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের বাড়িখানা নিয়ে বসবাস করছেন।

    তা বীজেন্দ্রবাবুর
    সংবাদ পেলে কি করে?

    সেও এক আশ্চর্য ব্যাপার!

    কি রকম?

    সেও এক ইতিহাস হে! বলে বিকাশ বলতে শুরু করেন, বলেছি তো বীজেন্দ্রবাবুরা চন্দননগরের বাসিন্দা।
    বছর আষ্টেক আগে বীজেন্দ্রবাবুদের
    এক বিধবা বোন ছিলেন সুরমা। সেই বোন ও দুই ভাই মহেন্দ্র ও অরবিন্দ কাশী যান। কাশীতে
    দত্তদের একটা বাড়ি আছে বাঙালীটোলায়। তাঁরা গিয়েছিলেন মাস দুই কাশীতে থাকবেন বলেই।
    মধ্যে মধ্যে তাঁরা ঐভাবে এক মাস কাশীর বাড়িতে গিয়ে নাকি কাটাতেন। যা হোক সেবারে
    চার মাস পরে দুই ভাই তাঁদের স্ত্রী পুত্র
    নিয়ে যখন ফিরে এলেন সুরমা
    ফিরল না তাঁদের সঙ্গে। ফিরে এসে ওঁরা রটালেন সুরমা নাকি কাশীতে হঠাৎ দুদিনের জ্বরে মারা গিয়েছে। কিন্তু
    আসল ব্যাপারটা তা নয়—সুরমা মরেনি, গৃহত্যাগ করেছিল এক রাত্রে।

    বীজেন্দ্রবাবু,
    বললেন নাকি ও-কথা?

    হ্যাঁ, শোন–
    বললাম তো একটা গল্প! অরবিন্দ মধ্যে মধ্যে কলকাতায় এসে দাদার এখানে উঠতেন। দু-চার
    দিন থেকে আবার চলে যেতেন। শুকনো জমিদারীর কোনরূপ আয় না থাকলেও অরবিন্দবাবুর অবস্থাটা কিন্তু ইদানীং বছর
    আষ্টেক মন্দ যাচ্ছিল না। বরং বলতে গেলে বেশ একটু অর্থসচ্ছলতাই ছিল তাঁর। যাহোক যা বলছিলাম,
    এবারে অরবিন্দবাবু,
    গত শনিবার মানে প্রায় আটদিন আগে কলকাতায় আসেন চন্দননগর থেকে। এবং অন্যান্য বারের
    মত দাদার ওখানেই ওঠেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার
    হঠাৎ রাত্রি দেড়টায় বাড়ি ফিরে দাদা বীজেন্দ্রবাবুকে ডেকে বলেন, সুরমার খোঁজ তিনি পেয়েছেন। এবং তখনই তিনি তাঁর
    দাদাকে সুরমা সম্পর্কে
    আট বছর আগেকার সত্য কাহিনী খুলে বলেন। বীজেন্দ্রবাবু এর আগে আসল রহস্যটা সুরমা সম্পর্কে জানতেন না।

    তারপর?

    তারপরের
    ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত –

    কি রকম?

    বৃহষ্পতিবার
    রাত্রের পর শেষ দেখা হয় অরবিন্দবাবুর সঙ্গে বীজেন্দ্রবাবুর শুক্রবার সকালে। তারপর আর দেখা হয়নি। এবং রবিবার সকালের ডাকে
    একখানা খামের চিঠি পান বীজেন্দ্রবাবু।

    চিঠি! কার?

    সুরমা দেবীর।

    কি চিঠি?

    এই দেখ সে চিঠি, বলতে বলতে বিকাশ চিঠিটা বের করে কিরীটীর হাতে
    দিলেন। খামের উপরে ডাকঘরের ছাপ আছে। শ্যামবাজার পোস্টঅফিসের ছাপ।

    কিরীটী ছেড়া খাম থেকে ভাঁজকরা চিঠিটা টেনে বের করল। সংক্ষিপ্ত চিঠি।

    শ্রীচরণেষু বড়দা,
    ছোটদা মারা গিয়েছেন। তাঁর
    মৃতদেহ বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে পুলিস মর্গে চালান
    দিয়েছে। সৎকারের
    ব্যবস্থা করবেন। ইতি
    আপনাদের
    হতভাগিনী বোন সুরমা

    একবার দুবার তিনবার কিরীটী চিঠিটা পড়ল।

    সুরমা গৃহত্যাগিনী
    বোন মৃত
    অরবিন্দ দত্তের! কিন্তু সে অরবিন্দর মৃত্যু সংবাদ জানলে কি করে?

    নিশ্চয়ই অকুস্থানে সুরমা
    উপস্থিত ছিল, না হয় তার জ্ঞাতেই সব ব্যাপারটা ঘটেছে। অন্যথায় সুরমার পক্ষে ঐ ঘটনা
    জানা তো কোনমতেই সম্ভবপর নয়। লাশ পাওয়া গিয়েছে শ্যামবাজারেই।

    চিঠির ওপরে ডাকঘরের ছাপও শ্যামবাজারের। তবে কি পলাতকা সুরমা শ্যামবাজারেই কোথায়ও
    আত্মগোপন করে আছে!

    কিরীটীর চিন্তাসূত্রে বাধা পড়ল বিকাশের প্রশ্নে, কি ভাবছ কিরীটী?

    কিছু না। হুঁ,
    ময়না-তদন্তের রিপোর্ট কি?

    Throttle করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি কিরীটী,
    বীজেন্দ্রবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পরে থেকে সমস্ত ব্যাপারটা যেন আরো গোলমেলে হয়ে
    যাচ্ছে।

    কিরীটী বলে, কিছু clue তো আমাদের হাতে এসেছে। এইবার তো মনে হচ্ছে
    আমরা তবু
    এগুবার পথ পেয়েছি।

    কি বলছো তুমি কিরীটী?

    আমি তোমাকে আরো একটা clue দিচ্ছি—এই অঞ্চলে একটা ডিসোটা ট্যাক্সি
    গাড়ি আছে। নম্বরটা তার W. B. T. 307। ট্যাক্সিটার ওপরে একটু নজর রাখ। হয়তো আরো এগিয়ে যেতে পারবে।

    বিকাশ যেন বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান, কি বলছো তুমি!
    ট্যাক্সির ড্রাইভার গঙ্গাপদ
    যে আমার বেশ চেনা লোক হে? অনেকবার আমার প্রয়োজনে ভাড়ায় খেটেছে। তাছাড়া গঙ্গাপদ লোকটাও
    spotless, ওর সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন রিপোর্টই তো পাইনি।

    কিন্তু সেইটাই বড় কথা নয় বিকাশ। মৃদু হেসে কিরীটী বলে।

    কিন্তু, বিকাশ তবু
    ইতস্তত করতে থাকেন।

    বললাম তো, প্রদীপের নীচেই বেশী অন্ধকার। যাহোক আজ উঠি–আবার দেখা হবে।

    কিরীটী আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এলো।

    টীকা