১১. আকাশের বুকে ভোরের আলো
নীহাররঞ্জন গুপ্ত দ্বারাভাল
করে আকাশের বুকে ভোরের আলো তখনও ফুটে
ওঠেনি। অত্যাসন্ন প্রত্যূষের চাপা রক্তাভায় পূবের আকাশটা কেমন রহস্যময়
হয়ে উঠেছে, খোলা জানলা-পথে জলো হাওয়া কেমন শীত-শীত বোধ হওয়ায় কিরীটীর ঘুমটা ভেঙে
গেল। কিরীটী শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল। আলনা থেকে জামাটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে
কিরীটী ঘরের দরজা
খুলে বাইরের বারান্দায় বের হয়ে এল। এ বাড়ির কারোরই এখনও নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। সিঁড়ি-পথ
অতিক্রম করে কিরীটী সোজা বাইরে চলে এল সদর দরজা খোলা দেখে। প্রমোদভবন থেকে সোজা যে রাস্তাটা
দুপাশের ঝাউবিথীর মধ্যখান দিয়ে সামনের সড়কে গিয়ে মিশেছে কিরীটী সেই রাস্তাটা ধরেই
এগিয়ে চলল। হাওয়ায় ঝাউগাছের চিকন পাতাগুলি এক প্রকার সোঁ সোঁ শব্দ তুলেছে। এত
সকালে প্রমোদভবনের সদর দরজাটা
খোলা দেখে কিরীটী ভেবেছিল হয়ত চাকরবাকরদের মধ্যেই কেউ ইতিমধ্যে উঠেছে, কিন্তু
ঝাউবীথির মাঝখান দিয়ে পথটা ধরে খানিকটা এগিয়ে যেতেই তার সে ভুলটা ভেঙে গেল।
অল্পদুরে একটি নারীমূর্তি
ধীরপদে
এগিয়ে চলেছে। এত সকালে এই পথ দিয়ে হেঁটে
চলেছে কে! সবিতা দেবী নাকি? কিন্তু নারীমূর্তিটির
চলবার ভঙ্গী দেখে কিরীটী বুঝতে পারে সে সবিতা নয়। তবে কে? কিরীটী একটু দ্রুতই পা চালিয়ে চলে। ভোরের অস্পষ্ট আলোয়
অগ্রগামী নারীমূর্তিকে
কিরীটী অনুসরণ করতে
করতেই দেখে পরিধানে তার আকাশ-নীল রংয়ের একটা শাড়ি এবং মাথার চুল লম্বা বেণীর আকারে
পৃষ্ঠোপরি
দোদুল্যমান। পায়ে বোধ হয় চপ্পল
সু, চলার ভঙ্গী ও চাল-চলন
দেখে মনে হয় সেও তারই মত প্রাতঃভ্রমণে বের
হয়েছে হয়ত।
অনেকটা কাছাকাছি হতে এবং দুজনের মধ্যে
ব্যবধান কমে আসতেই তাকাল। এবং সঙ্গে সঙ্গে উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো।
কিরীটী এতক্ষণে চিনতে পারে, অগ্রগামিনী আর কেউ নয়, সবিতার গত সন্ধ্যায়
বিদেশাগত মামার মেয়ে কল্যাণী।
কল্যাণী একটু
বিস্মিত দৃষ্টিতেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিরীটীও তাকিয়ে ছিল কল্যাণীর মুখের দিকেই।
পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি এখনো এবং কল্যাণী ইতিপূর্বে
কিরীটীকে না দেখলেও কিরীটী গত সন্ধ্যাতেই দরজার
ফাঁক দিয়ে কল্যাণীকে দেখেছিল, তাতেই তার কল্যাণীকে চিনতে কষ্ট হয়নি।
কিরীটীই প্রথমে হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলে, সুপ্রভাত, আপনিই বোধ
হয় কল্যাণী দেবী!
কল্যাণী তার সম্পূর্ণ অপরিচিত কিরীটীর মুখে তার নিজের নামোচ্চারণ শুনে কতকটা বিস্ময়ের
সঙ্গেই যেন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না
ঠিক!
আমার নাম কিরীটী রায়। কিরীটী স্মিতকণ্ঠে জবাব দেয়।
ও, আপনিই কিরীটীবাবু! সবিতাদি কাল রাত্রে আপনার কথা বলছিল বটে।
নমস্কার।
বেড়াতে বের হয়েছেন বুঝি?
হ্যাঁ। নতুন জায়গায় আমার তেমন ঘুম হয় না। সারাটা রাত বিছানার উপরে
ছটফট করে ভেরের দিকে আর শুয়ে থাকতে ভাল লাগলো না। তাই বের হয়ে পড়লাম। পাঞ্জাবের রুক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে আমরা
পরিচিত, বাংলাদেশের এই শ্যামল রূপটি
ভারী ভাল লাগছে।
দুজনেই আবার তখন পাশাপাশি চলতে শুরু করেছে সামনের দিকে। চলতে চলতেই কিরীটী
কল্যাণীর কথার প্রত্যুত্তর দেয়, হ্যাঁ, এমন দেশটি আর কোথাও গেলে পাবেন না। বলতে
গেলে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম ভারতের সর্বত্রই আমি পর্যটন করেছি, কিন্তু বাংলার
মাটিতে ও আকাশে যে মিষ্ট শ্যামল একটি অখণ্ড পরিপূর্ণতার সন্ধান পাই এমনটি আর কই
চোখে তো আমার পড়ল না।
হয়ত আপনার কথাই সত্যি মিঃ রায়। বাংলাদেশের মেয়ে হলেও জন্ম আমার
পাঞ্জাবে এবং বলতে গেলে এই আমার বাংলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়।
যত দিন যাবে দেখবেন এ দেশকে আপনার আরো বেশী করে ভাল লাগবে। ঋতুতে
ঋতুতে আকাশে ও মাটিতে এর পরিবর্তন রংয়ের খেলা যেমন অপূর্ব তেমনি সুন্দর। এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় যেন সৌন্দর্য ছড়িয়ে
আছে। যাকে নিত্য দেখেও আশ মেটে না।
পুব আকাশে একটু
করে দিনের আলো যেন পাপড়ির মত দল মেলেছে।
রাস্তাটা নির্জন। ছোট ছোট লাল কাঁকর ছড়ানো রাস্তাটায়। জমিদারেরই
তৈরী রাস্তাটা। গতরাত্রের বৃষ্টিতে রাস্তাটা এখনো ভিজে আছে। রাস্তার দুপাশে খোলা
মাঠ—যেন সবুজ দুখানা
চাদর দুদিকে
বিছানো। ক্রমে একথা সেকথার মধ্যে দিয়ে দুজনার মধ্যে আলাপটা আরো বেশ জমে ওঠে।
কিরীটীর কল্যাণীকে বেশ লাগে। মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। বাংলার বাইরে পাঞ্জাবে মানুষ
বলেই হয়ত কল্যাণীর স্বভাবে, কথাবার্তায় ও চালচলনে একটা সাবলীল গতি রয়েছে।
বাংলাদেশের ঐ বয়েসী মেয়েদের মত লজ্জা বা আড়ষ্টতা এর চরিত্রের মধ্যে কোথাও নেই।
কল্যাণীর চরিত্রে ও কথায়বার্তায়
যে একটা সহজ সরলতা তাই নয়, তার দৈহিক গঠন ও স্বাস্থ্যের মধ্যেও একটা সুস্থ ও সহজ
সৌন্দর্য আছে। রূপ
বলতে যা বোঝায় কল্যাণীর তা না থাকলেও
চেহারায় একটা সৌন্দর্য আছে—গায়ের রং কালোই কিন্তু তথাপি সেই কালোর মধ্যে এমন একটা
স্নিগ্ধকর শ্যামল লাবণ্য আছে যেটা অতি সহজেই যেন অন্যের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
চোখমুখের গঠনটিও কল্যাণীর ভারী চমৎকার। বাঁকানো ধনুকের মত ভ্রূ, ঘন আঁখিপল্লব, সজল
স্নিগ্ধ দুটি চোখের তারা। পাতলা দুটি ওষ্ঠ। বাম গালের উপরে একটি তিল মুখের
সৌন্দর্যকে যেন অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। কথায় কথায় চমৎকার হাসে কল্যাণী। এবং সেই
হাসিটি যেন সমস্ত চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
মেয়েটির কথাবার্তার মধ্যেও যেন একটা কৌতুকপ্রিয়তা বিদ্যমান।
সবিদি ও সত্যজিৎবাবুর
মুখেই শুনেছিলাম আপনি নাকি একজন সাংঘাতিক বাঘা ডিটেকটিভ মিঃ রায়!
বাঘা ডিটেকটিভ! আর কি শুনেছেন বলুন তো মিস সান্যাল? হাসতে হাসতেই কিরীটী
কল্যাণীকে প্রশ্ন করে।
আরো কত কি! সব কি ছাই মনে আছে? বলতে বলতে হঠাৎ কল্যাণী প্রশ্ন করে, আচ্ছা
মিঃ রায়, সত্যিই কি আপনার মনে হয় আপনি পিসেমশাইয়ের হত্যাকারীকে ধরতে পারবেন?
রাস্তার একপাশে একটা বড় আকারের পাথর পড়েছিল। কিরীটী পাথরটার দিকে
এগুতে এগুতে কল্যাণীকে সম্বোধন করে বলে, আসুন
মিস সান্যাল, ঐ পাথরটার উপরে কিছুক্ষণ বসা যাক।
বেশ তো! দু
জনে পাথরটার উপরে গিয়ে বসল।
পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে একটা সিগার সেটা থেকে টেনে
নিতে নিতে কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে স্মিতভাবে
প্রশ্ন করে, ধুমপান করতে পারি?
আপত্তি নেই আপনার?
Oh Surely, not at all!-মৃদু
হাস্য-তরল কণ্ঠে কল্যাণী জবাব
দিল।
সিগারটার দেয়াশলাই জালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে নিঃশব্দে গোটা দুইতিন
টান দিল কিরীটী। কল্যাণী পাথরটার সামনে থেকে একটা ঘাসের শীষ টেনে ছিড়ে দাঁত দিয়ে
কাটতে লাগল অন্যমনস্ক ভাবে।
হঠাৎ কিরীটী আবার কথা শুরু করে, হ্যাঁ, কি যেন বলছিলেন আপনি মিস সান্যাল! হত্যাকারীকে
ধরতে পারবো কিনা, তাই না?
হ্যাঁ, জানেন আমি একজন ডিটেকটিভ বইয়ের খুব ভক্ত! ঐসব তদন্তের
ব্যাপারে আমার ভারী interest লাগে, ছোটখাটো সব অদ্ভুত সুত্র ধরে হত্যাকারীকে খুঁজে
বের করা ভারী শক্ত কাজ, না?
তা একটু
শক্ত বইকি। চোখ থাকলে
এবং ইংরাজীতে যাকে আমরা সাধারণতঃ
common sense বলি একটু
প্রখর থাকলেই
যে কোন রহস্যের solution-এ আসতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
তবে সকলে
পারে না কেন?
কিরীটী কল্যাণীর কথায় এবারে হেসে ফেলল এবং হাসতে হাসতে বলে, আসল
ব্যাপারটা কি জানেন? ধরুন
আপনাকে একটা সাধারণ
উদাহরণ
দিই। বলুন তো সবিতা দেবীর বাড়িতে একতলা থেকে দোতলায় উঠতে কটা সিঁড়ি
আছে?
কটা সিঁড়ি! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল কল্যাণী কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, বলুন
না। আপনি কতবার ঐ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করেছেন কাল থেকে?
তা কাল রাত্রে বারচারেক এবং আজ সকালে একবার।
পাঁচবার। তাহলে বলুন
ঐ সিঁড়ি দিয়ে আপনি ওঠা-নামা করেছেন এবং দেখেছেনও সিঁড়িগুলো কেমন, না?
হ্যাঁ।
তাহলে বলুন
কটা সিঁড়ি আছে?
এই পঁচিশ-ত্রিশটা
হবে বোধ হয়।
উহু,
একত্রিশটা সিঁড়ি আছে। তবেই দেখুন
একই সিঁড়ির পথে আপনি ও আমি দুজনাই
ওঠা-নামা করেছি। আমি সিঁড়ি-পথ দিয়ে আপনার মত কেবল ওঠা-নামাই করিনি, প্রথমবারেই
ওঠবার সময় চারিদিকে ভাল করে সিঁড়িগুলোর অবস্থা দেখে মোট কতগুলো সিঁড়ির ধাপ আছে তাও
গুনে নিয়েছি! এই হয়। আপনারা, কেবল সাধারণ লোকেরা দেখেনই, you only see but I observe!
এইখানেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে তফাৎ। আমি বাড়িটার উপরতলার যাবতীয় খুটিনাটি সব বলতে
পারি। চলুন রোদ চড়ে উঠেছে। এবারে ফেরা যাক।
চলুন।
দুজনে উঠে আবার প্রমোদভবনের দিকে চলতে শুরু করে।
কিরীটী এক সময় আবার পথ চলতে চলতেই কল্যাণীকে সম্বোধন করে বলে, কথা
হচ্ছিল আমাদের হত্যাকারীকে ধরতে পারবো কিনা? ধরতে পারবোই তবে বর্তমানে এখন আমার
কেবল চারিদিক দেখবার ও কান পেতে শোনবার পালাই চলেছে। এরপর যা দেখবো শুনবো সব কিছু তার ভাবতে হবে এবং ভাবতে ভাবতেই আমার চোখের
সামনে ক্রমে সব রহস্যের কুয়াশা ভেদ করে আলো ফুটে উঠবে যখন, তখনই আপনাকে আমি বলতে
পারবো কবে ঠিক হত্যাকারীর কিনারা আমি করতে পারবো। তার আগে নয়।
আমাকে আপনার এই রহস্যের অনুসন্ধানের ব্যাপারে সহকারিণী করে নেবেন
মিঃ রায়?
বেশ তো। সহকারী যদি সত্যিকারের সহকারী হয় তাহলে কাজ করবার মধ্যেও
যে একটা আনন্দ আছে।
কিরীটী হাসতে হাসতেই জবাব
দেয়।
কিন্তু আমার সাহচর্য যদি আপনার কাজে বিঘ্ন ঘটায়?
বিঘ্ন
ঘটাবে কেন?
আপনার মনে যদি আমাকে আমার কাজে সত্যিকারের সাহায্য করবার ইচ্ছা থাকে তাহলে কি আর
আপনি বিঘ্ন
ঘটাবেন?
চলতে চলতে দুজনে প্রায় তখন প্রমোদভবনের মধ্যে এসে গিয়েছে। দুর
থেকে দেখা গেল নায়েব গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর পাশে লক্ষ্মীকান্ত দারোগা।
দুজনেরই দৃষ্টি
একই সঙ্গে অদূরে
গেটের সামনে দণ্ডায়মান লক্ষ্মীকান্ত
সাহা ও নায়েবের উপরে পতিত হল।
নায়েবের পাশে ঐ ভদ্রলোকটি কে মিঃ রায়? কল্যাণী কিরীটীকে প্রশ্ন করে।
চিনতে পারা তো কষ্ট নয় ভদ্রলোকটিকে মিস সান্যাল! কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।
আপনি চেনেন না নাকি ওঁকে?
না,
তবে ভদ্রলোকের বেশভূষা দেখে অনায়াসেই একটা অনুমান করে নিতে পারা যায় চেয়ে দেখুন।
ভদ্রলোকের পরিধানে খাকি প্যান্ট ও খাকি হাফসাট।
তার থেকে কি প্রমাণ হলো?
প্রমাণ হচ্ছে এই যে, ভদ্রলোক বোধ হয় এখানকার থানা অফিসার, পুলিসের লোক।
বেশ তো আপনার যুক্তি! খাকি জামাকাপড় পরলেই পুলিসের লোক হবে নাকি? মিলিটারীর কোন লোকও তো
হতে পারে?
এক্ষেত্রে তা নয় তার কারণ
দুটো, এক নম্বর হচ্ছে মিলিটারী ড্রেস ঠিক অমনটি হয় না, দ্বিতীয়তঃ এই রকম জামায় ঐ পোশাক
কেউ পরলে সে পুলিসের লোক হওয়ারই বেশী সম্ভাবনা
কথা বলতে বলতে ওরা দুজনে প্রায় লক্ষ্মীকান্ত সাহা ও নায়েবের একেবারে
কাছাকাছি ততক্ষণে এসে পড়েছে। নায়েব কথা বললেন কিরীটীকে সম্বোধন করে, এই যে মিঃ
রায়, আসুন।
বেড়াতে বের হয়েছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ।
আপনার জন্যেই ইনি অপেক্ষা করছেন। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি এখানকার থানা
ইনচার্জ লক্ষ্মীকান্ত
সাহা। আর এর কথা আপনাকে গতকাল আমি জানিয়েছিলাম চিঠি দিয়ে, ইনিই শ্রীযুক্ত কিরীটী
রায়।
নমস্কার। লক্ষ্মীকান্ত
কিরীটীকে নমস্কার জানায়।
নমস্কার। কিরীটী প্রতিনমস্কার জানাতে জানতে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে
তেরচাভাবে কল্যাণীর দিকে সকৌতুকে তাকায়।
কাল বসন্তবাবুর চিঠিতে আপনার এখানে আসবার সংবাদ পেয়েই আপনার সঙ্গে
আলাপ করার লোভটা সম্বরণ
করতে পারলাম না, মিঃ রায়। ছুটে এসেছি।
ধন্যবাদ। মৃদু
নম্র কণ্ঠে কিরীটী জবাব
দেয়।
ওঁর মুখেই শুনলাম চৌধুরী মশাইয়ের মেয়ে নাকি তাঁর বাপের হত্যারহস্যের
কিনারা করতে আপনাকে এখানে ডেকে এনেছেন। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন?
না,
এই তো সরে দিন দুই
মাত্র এখানে এসেছি, এখনও তো সব চারিদিক ভাল করে দেখাশোনা করার সুযোগ পাইনি।
দেখাশোনা আর কি করবেন! লাশও তো সৎকার করে ফেলা হয়েছে। লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন।
তা তো ফেলতেই হবে, বাসি মড়া ঘরের মধ্যে রেখে আর লাভ কি বলুন?
মিথ্যে কেবল দুর্গন্ধ ছড়াবে বই তো নয়! কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
তাহলে আর দেখবেন কি?
যে কোন হত্যার ব্যাপারেই মৃতদেহটা তো শেষ পরিচ্ছেদ মাত্র লক্ষ্মীকান্তবাবু।
প্রশ্নের অঙ্কের উত্তরমালা ছাপার অক্ষরে একটা সংখ্যাত্তর মাত্র। কিন্তু উত্তরটা
জানলেই তো আর অঙ্কটা কষা যায় না। কি বলেন? হাসতে হাসতে কিরীটী কথাটা বলে।
কিরীটীর হেয়ালি ভরা কথাগুলোর সঠিক অর্থ একেবারেই লক্ষ্মীকান্তর হৃদয়ঙ্গম হয় না। তথাপি
সে জবাব
দিতে পশ্চাৎপদ হয় না।
তা যা বলছেন, তবে কি জানেন মিঃ রায়, ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে বেশ
একটু
জটিলই।
কেন বলুন তো?
কারণ
এখানকার কোন স্থানীয় লোকই চৌধুরী মশাইকে হত্যা করেনি
তাই বুঝি!
নিশ্চয়ই, সে সম্পর্কে কোন ভুলই নেই। Some outsiders—আর আপনি কি
মনে করেন খুন করার পর আর সে বেটা এ সহরের চতুঃসীমানায় আছে? সঙ্গে সঙ্গেই পগারপার হয়েছে।
হ্যাঁ।
তা হলেই বুঝুন।
নচেৎ আমিই কি এত সহজে হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম নাকি! এতক্ষণে বেটাকে নিয়ে হাজতে
পরতাম না!
চলুন
না, ভিতরের ঘরে বসেই কথাবার্তা হবেখন। কথাটা বললেন নায়েব।
তাই চলুন। লক্ষ্মীকান্ত জবাব
দেন।
নায়েব বসন্ত সেনেরই আহ্বানে
অতঃপর সকলে
বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে নায়েবের কক্ষমধ্যেই এসে চকূলেন।
বসুন
দারোগা সাহেব, কিরীটীবাবু, বসুন। মা-লক্ষী, তুমিও বোস। সম্ভ্রমপূর্ণ কণ্ঠে বসন্ত
সেন সকলকেই বসবার জন্য আহ্বান
জানালেন।
সকলে উপবেশন
করে।
একটু
চা হবে তো দারোগা সাহেব? লক্ষ্মীকান্তর
মুখের দিকে তাকিয়ে বসন্ত সেন প্রশ্ন করলেন।
চা! তা না হয় আনান!
বসন্ত সেন বোধ হয় চায়ের যোগাড় দেখতেই অন্দরের দিকে চলে গেলেন।
কল্যাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে এবার লক্ষ্মীকান্তই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে
তো চিনতে পারলাম না? আপনি?
কল্যাণী বোধ করি নিজের পরিচয়টা নিজেই দিতে যাচ্ছিল, কিরীটী বাধা
দিয়ে বললে, উনিও এখানে নবাগতা, মাত্র গতকাল সন্ধ্যায় এসে পৌঁছেছেন। সবিতা দেবীর মামাতো বোন। কল্যাণী সান্যাল।
মামাতো বোন! কই মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরীর কোন শ্যালক আছেন বলে তো সেদিন সবিতা দেবী কিছু বললেন না?
এবার জবাব
দিল কল্যাণী নিজেই, মামাতো বোনই বটে, তবে তাঁর সঙ্গে ঠিক রক্তের কোন জোরাল সম্পর্ক
নেই। আমার বাবা নিত্যানন্দ সান্যাল পিসিমার দূরসম্পর্কীয় পিসতুত ভাই। এবং শুনেছি
আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুরমার কাছেই নাকি তিনি মানুষ। আমাদের বাড়ি থেকেই পিসিমার বিবাহ হয়েছিল।
বেশ সহজ পরিষ্কার কণ্ঠে কল্যাণী লক্ষ্মীকান্তকে কথাগুলো বলে গেল।
কল্যাণীর জবাব
দেবার ভঙ্গী ও কথার চমৎকার বাঁধুনি
কিরীটীকে কল্যাণীর প্রতি শ্রদ্ধান্বিতই করে তোলে। সংক্ষেপে সে লক্ষ্মীকান্তর যাবতীয় প্রশ্নেরই তখন
উত্তর দিল।
লক্ষীকান্ত
দারোগাও কল্যাণীর জবাবে তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না।
এমন সময় দেওয়ান বসন্তবাবু,
আবার ঘরের মধ্যে ফিরে এলেন।
নায়েবকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখে লক্ষ্মীকান্ত তাঁকেই এবারে প্রশ্ন
করলেন, সেই ছোকরাটি, সত্যজিৎ না কি নাম, চৌধুরী মশাইয়ের বন্ধুপুত্র— চলে গিয়েছেন নাকি?
না,
তিনি এখনো এখানেই আছেন। তাঁকে ডাকবো নাকি?
না,
ডাকতে হবে না। হ্যাঁ ভাল কথা কিরীটীবাবু, আপনার পরিচয় হয়নি সেই ছেলেটির সঙ্গে?
কিরীটী মৃদু
হেসে জবাব
দেয়, হ্যাঁ, তা হয়েছে বৈকি। কেন বলুন তো!
না, তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম, ছেলেটিকে আপনার কেমন বলে মনে হয়?
চমৎকার! A perfect gentleman!
ভৃত্য একটা ট্রেতে করে চার পেয়ালা চা নিয়ে কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ
করল।
তিনিই বোধ হয় সবিতা দেবীকে পরামর্শ দিয়ে আপনাকে এখানে আনিয়েছেন।
কিরীটী এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পারে, হঠাৎ তার সত্যজিৎ সম্পর্কে
ঐ ধরনের প্রশ্নটা করবার উদ্দেশ্য কি। লক্ষ্মীকান্তর
সঙ্গে দুএকটি কথা বলবার পরই কিরীটী লক্ষ্মীকান্ত-চরিত্র
সম্পর্কে কতকটা আন্দাজ করে নিতে পেরেছিল এবং এটাও সে বুঝতে পারছিল, স্পষ্টাস্পষ্টি
ভাবে না জানালেও লক্ষ্মীকান্ত
তার এখানে আগমনটা বিশেষ সুনজরের
সঙ্গে গ্রহণ করতে পারেননি। এ জগতে একশ্রেণীর লোক আছে যারা নিজেদের অধিকারের সীমানা
বা চৌহদ্দির
মধ্যে তৃতীয় কোন ব্যক্তির মাথা গলানোটা আদপেই ভাল দৃষ্টিতে বা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে
পারে না। কিরীটী মনে মনে একটু
হাসে এবং অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্তর
প্রশ্নের জবাব
দেয়।
কতকটা তাই বটে, আবার সম্পূর্ণ
সেটা না-ও বটে। কারণ
সবিতা দেবীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেই বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, কারো কথা চট করে যে
মাথা পেতে মেনে নেবেন ঠিক সে শ্রেণীর মেয়ে তিনি নন।
লোকচরিত্র সম্পর্কেও তো দেখছি বেশ আপনার অভিজ্ঞতা আছে কিরীটীবাবু!
হ্যাঁ, লোকচরিত্র নিয়েই যখন কারবার করতে হয়, সে সম্পর্কে একটুআধটু জ্ঞান না থাকলে কি করে চলে বলুন? কিন্তু সেকথা যাক, লক্ষ্মীকান্তবাবু। আপনি অনুগ্রহ করে আমার
সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এতে যে কি আনন্দিত হলাম! আপনিই এলেন, নচেৎ গতকালই ভাবছিলাম
আপনার সঙ্গেই যে সর্বাগ্রে আমার একবার দেখা করা প্রয়োজন–
কেন বলুন তো?
বলতে গেলে আপনিই তো এই শহরের দণ্ডমুখের খোদ মালিক। তাছাড়া মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে
যা কিছু
investigation তো আপনার দ্বারাই হয়েছে। কাজেই এর রহস্যের তদন্তে নামতে হলে আপনার
সাহায্য ও উপদেশটাই তো সবপ্রথম কথা।
কিরীটীর কথা বলবার ভঙ্গিতে কল্যাণী এমন কি বসন্ত সেন পর্ন্তত ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে
পারে না। কিরীটীর গণনায় ভুল হয়নি। সাপের মুখে
ধুলো পড়ার মতই কাজ হলো, লক্ষ্মীকান্তর
চক্ৰ গুটিয়ে এলো। বিনয় বিগলিত কণ্ঠে লক্ষ্মীকান্ত জবাব
দিলেন, হেঁ! হেঁ! কি যে বলেন আপনি কিরীটীবাবু? তবে হ্যাঁ, কেসটা জটিল
হলেও আমার দিক থেকে যথাসম্ভব সাহায্য আপনি পাবেন।
পাবো বলেই তো আশা করে আছি। নচেৎ কোন দুঃসাহসে এ কেসটা আমি হাতে নিয়েছি
বলুন তো?
কিন্তু দারোগা সাহেব, এদিকে চা যে জুড়িয়ে গেল! কথাটা বললে কল্যাণী।
ওঃ, হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক ঠিক। লক্ষ্মীকান্ত হাত বাড়িয়ে ট্রে থেকে
একটা কাপ নিতে নিতে বললেন, এ কি, তিন কাপ চা যে!
কথাটার জবাব
দেয় কিরীটীই, একটা কাপ ঐ সঙ্গে হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে নিতে, নায়েব মশাইয়ের বোধ হয়
চা তেমন চলে না!
এবারে জবাব
দিলেন নায়েবই, হ্যাঁ। এ-যুগের লোকদের মত চা-টা তেমন আমার ঠিক সহ্য হয় না। কিরীটীবাবু,
ঠিকই বলেছেন।
চা খান না! আশ্চর্য তো! কথাটা বললেন লক্ষ্মীকান্ত।
না। সকালে বিকালে চায়ের বদলে আমি এক লাস করে দুধ পান করি।
হ্যাঁ, ওঁর আমাদের মত বোধ হয় অসার বস্তুতে তেমন পক্ষপাতিত্ব নেই।
উনি একেবারে খাঁটি ও সার বস্তুরই প্রিয়। হাসতে হাসতেই কিরীটী কথাটা উচ্চারণ করে এবং হাসতে হাসতেই
কথাটা বললেও, আড়চোখে বসন্ত সেনের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে কিরীটী ভোলে না। নায়েবের
চোখের তারা দুটো যেন বারেকের জন্য একবার ঝিকিয়ে উঠে আবার স্বাভাবিক শান্ত হয়ে গেল, সেটুকুও
তার নজর এড়ায় না।
বাইরে এমন সময় চটিজুতোর শব্দ শোনা গেল। এবং সেই সঙ্গে গলাও শোনা
গেল, বসন্ত ভায়া, কোথায় হে?
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই
দৃষ্টি যুগপৎ খোলা-পথের
দিকে পতিত
হয়।
এই যে সান্যাল মশাই আসুন।
আসুন-আমি
এই ঘরেই আছি। উদার কণ্ঠে আহ্বান
জানালেন বসন্ত সেন।