Chapter Index

    সত্যজিৎই
    প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললে, চৌধুরী মশাইয়ের মৃতদেহও ঐ বকুলতলাতেই পাওয়া গেছে, তাই না?

    হ্যাঁ।

    এবং মৃতদেহ প্রথমে দেখতে পান বসন্তবাবুই না?

    হ্যাঁ।

    আচ্ছা কানাইয়ের মা, তোমার মার মৃত্যু ও তোমার বাবার মৃত্যু এ দুটো ব্যাপার তোমার
    কি বলে মনে হয়?

    আজ্ঞে দাদাবাবু,
    আমি তো বলেছিই আমার মনে হয় এ দুটোই কোন অপদেবতার কাজ।

    কেন বল তো?

    কানাইয়ের মা অতঃপর কেমন যেন একটু ইতস্ততঃ করতে থাকে।

    কি যেন বলতে চায়, অথচ ঠিক বলতে সাহস পাচ্ছে না। সঙ্কোচ বোধ করছে।

    বল না কি বলতে চাও?
    কেন তোমার মনে হয় এ অপদেবতার কাজ?

    দেখুন দাদাবাবু,
    এ বাড়িটাই ভাল না!

    বাড়িটা ভাল না?

    আজ্ঞে। আমি অনেকদিন টের পেয়েছি এ বাড়িটার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন
    অপদেবতা ভর করে আছে।

    অপদেবতা ভর করে আছে?
    কি পাগলের মত যা-তা বকছ
    কানাইয়ের মা!

    হ্যাঁ বাবু,
    ঠিকই বলছি। নানা রকমের শব্দ রাত্রে অনেক সময় এ বাড়িতে শোনা যায়। অনেক রাত্রে ঘুঙুরের শব্দও শুনেছি।

    চকিতে সত্যজিতের প্রথম রাত্রির কথা মনে পড়ে যায়।

    সেই মিষ্টি নূপুরের
    আওয়াজ! সেই নূপুরের
    আওয়াজকে অনুসরণ
    করে তার সিঁড়িপথে নিচে নেমে যাওয়া!

    সেও তো জাগ্রত অবস্থাতেই সুস্পষ্ট সেই নূপুরের আওয়াজ শুনেছিল!

    সে কাউকে দেখতে পায়নি বটে তবে স্পষ্ট কি সে শোনেনি কে যেন নূপুর পায়ে তার ঘরের মধ্যে চলে
    বেড়াচ্ছিল!

    তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, মিলিয়ে গেল একটু একটু করে সেই নূপুরের মিষ্টি আওয়াজ।

    তাছাড়া তার ঘরের ওপাশের দরজাটাও
    তো খোলা
    দেখতে পেয়েছিল।

    তবে কি কানাইয়ের মা যা বলছে তাই ঠিক? সত্যি এ বাড়িতে কোন অপদেবতা আছে?

    রাত্রের অন্ধকারে চারিদিক নিঝুম হয়ে এলে, সবাই গাঢ় ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলে
    অশরীরী কেউ এ বাড়ির কক্ষে কক্ষে অলিন্দে প্রাঙ্গণে সিঁড়িপথে নূপুর পায়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে
    বেড়ায়!

    কানাইয়ের মা আবার বলে, লোকে বলে আজও নাকি বৌরাণীর প্রেতাত্মা এই
    বাড়ি ছেড়ে যায়নি! সে-ই নাকি আজও নিষুতি
    রাতে ঘুঙুর পায়ে ঘুরে
    ঘুরে বেড়ায়!

    বৌরাণী! বৌরাণী আবার কে? কথাটা বলে বিস্মিত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সত্যজিৎ কানাইয়ের
    মার দিকে।

    তাও জাননি! বৌরাণীর নামেই তো এই এত বড় বাড়ি তৈরী হয়েছিল গো। ঐ
    বিলের জলেই তো বৌরাণী ড়ুবে মরেছিল গো। তাই তো লোকে ঐ বিলকে আজও বলে বৌরাণীর বিল!

    এবারে সত্যজিৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় সবিতার দিকে।

    সবিতাই এবারে অনুচ্চারিত প্রশ্নের যেন জবাব দেয়, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি বটে। তবে আমি কখনো
    কোন আওয়াজ বা শব্দ নিজের কানে শুনিনি।

    আপনার বাবার কাছে কোনদিন কিছু
    এ সম্পর্কে শুনেছেন মিস চৌধুরী?

    না। বাবা আমাকে কখনো কোনদিন আমাদের বংশের কোন কথা বা গল্প বলেননি।
    বরাবরই লক্ষ্য করেছি, বাবা যেন ওসব ব্যাপারে অদ্ভুত একটা সংযম রক্ষা করে চলতেন। বহুদিন মনে পড়ে, বাবাকে দেওয়ালে
    টাঙানো মার এনলার্জড ফটোটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি কিন্তু একটা
    দিনের জন্যেও বাবা আমার সঙ্গে মার কোন কথাই আলোচনা করেননি। এখন অবশ্য
    বুঝতে পারছি কেন তা করেননি।

    রাত্রি শেষ হয়ে পূর্ব দিগন্তে প্রথম আলোর রক্তিম ইশারা যেন দেখা
    দিয়েছে।

    খোলা জানলা-পথে সেই রক্তিম আলোর আভাস যেন ওদের অন্তরকে পর্যন্ত
    এসে স্পর্শ
    করে গেল।

    কানাইয়ের মাকে বিদায় দিয়ে সত্যজিৎ সবিতাকেও যেন একপ্রকার ঠেলেই
    তার ঘরে পাঠিয়ে দিলে, অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে।

    সারাটা রাত্রি জাগরণের পর সত্যজিতের নিজের চোখ দুটোও জ্বালা করছিল। সে ছাদে এসে
    দাঁড়াল।

    চাপা লালচে আলোয় সমস্ত প্রকৃতি যেন সারা রাত্রির অন্ধকারকে অতিক্রম
    করে রক্তিম চক্ষু
    মেলে সবে তাকাচ্ছে।

    প্রভাতী বায়ুতরঙ্গে
    বিলের বুকে ক্ষুদ্র
    ঢেউগুলো ছন্দের আলপনা বুনে
    চলেছে।

    দূরে
    নজরে পড়ল সেই দ্বীপটা।

    দূর
    থেকে দ্বীপের গাছপালাগুলো তখনও খুব স্পষ্ট মনে হয় না। যেন একটা অস্পষ্টতার কুয়াশায়
    ঘোমটা টেনে রহস্যে ঘনীভূত হয়ে আছে।

    ঐ দ্বীপের মধ্যেই একদিন রহস্যজনকভাবে সবিতার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল,
    আবার দীর্ঘ উনিশ বছর বাদে ঐ দ্বীপের মধ্যেই একদা প্রত্যুষে পাওয়া গেল সবিতার পিতা
    মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃতদেহ।

    উনিশ বছর পূর্বে যে হত্যাকাণ্ড (?) সংঘটিত হয়েছিল এবং উনিশ বছর
    পরে মাত্র কয়েকদিন আগে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল, আছে কি তার মধ্যে কোন যোগাযোগ!
    দুটি হত্যাকাণ্ডই কি একই সূত্রে গাঁথা, না একের সঙ্গে অন্যের কোন সম্পর্ক নেই!

    ক্ষণপূর্বে
    কানাইয়ের মার বর্ণিত অতীতের সুদীর্ঘ কাহিনী হতে এইটুকু অন্ততঃ বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে
    একটা মস্ত বড় রহস্য জড়িয়ে আছে এবং যে রহস্যের মূলটা হয়ত বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।

    কিন্তু কে করবে সেই অতীতের যবনিকাকে উত্তোলন?

    কেমন করে উদঘাটিত হবে সত্যিই কোন অতীত রহস্য যদি এই হত্যাকাণ্ডের
    মূলে থাকেই, সেই অবশ্য প্রয়োজনীয় সত্যটুকু!

    অতীতের কথা কানাইয়ের মা যতটুকু জানত বলেছে।

    আর এ বাড়িতে বহুদিনকার
    পুরাতন লোক কে আছে?
    বনমালী। আর আছেন এদের নায়েব বসন্ত সেন।

    কিন্তু বসন্ত সেনের মুখ থেকে কি কোন কথা বের করা যাবে?

    বিশেষ করে পরশু
    রাত্রের আলোচনার ব্যাপারে তিনি যেন একটু
    তার উপরে অসন্তুষ্টই হয়েছেন বলে ওর ধারণা।

    এক্ষেত্রে কোন কথাই হয়ত তিনি বলবেন না।

    কিন্তু কেনই বা বলবেন না, পরক্ষণেই মনে হয় কথাটা সত্যজিতের, তার
    উপরে অসন্তুষ্ট হয়েছেন তো কি!

    মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপারে তাঁরও তো কম interest থাকবার
    কথা নয়! আর কেবল interestই বা কেন, কর্তব্যও তো একটা আছে। এবং সব কিছুর উপরে নায়েব
    বসন্ত সেনের এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা!

    আত্মীয় বন্ধু বা অভিভাবক
    বলতে সবিতা দেবীর একমাত্র উনিই—বসন্ত সেন।

    নিকটতম আত্মীয়ের পর্যায়েই আজ উনি সবিতা দেবীর পড়েছেন।

    হ্যাঁ, তাঁকেই আরো ভাল করে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে অতীতের কোন
    কথা যা হয়ত একমাত্র উনি ব্যতীত আর কেউই জানেন না।

    তাছাড়া একবার ঘুরে দেখে আসতে হবে বৌরাণীর বিলের ঐ দ্বীপটি।

    ঐ দ্বীপই হচ্ছে অকুস্থান।

    মনের মধ্যে সহসা কেমন যেন একটা অদ্ভুত প্রেরণা ঐ মুহূর্তেই অনুভব করে সত্যজিৎ।
    বৌরাণীর বিলের ঐ দ্বীপটা যেন অদ্ভুত ভাবেই ওর মনকে আকর্ষণ করতে থাকে।

    সত্যজিৎ আর দেরী করে না।

    মস্ত বড় একটা প্রাঙ্গণ পার হয়ে একটা সরু অন্ধকার অলিন্দ মত, সেই অলিন্দেরই শেষপ্রান্তে যে দরজাটা সেটা খুলতেই সত্যজিতের
    চোখে পড়ল, বিলের জলে বড় বড় পাথর ফেলে, মাটি ও কাঁকর বিছিয়ে পায়ে চলা রাস্তাটা
    বরাবর দ্বীপের সঙে
    গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে।

    এটি যেন প্রমোদভবন ও দ্বীপের সংযুক্ত একটি সেতু।

    রাস্তাটি জল থেকে মাত্র হাতখানেক উঁচু।

    বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো, দুদিকটা ক্রমশঃ ঢালু হয়ে জলের মধ্যে নেমে গিয়েছে।

    দীর্ঘ কয় বৎসরের জলের স্পর্শে পাথরগুলোর বুকে সবুজ শ্যাওলার একটা আস্তরণ পড়েছে। যেন সবুজ মখমলের একখানা কাপেটকে কে
    বিছিয়ে দিয়েছে রাস্তাটার দুধারে।

    এই জায়গাটায় বিলের জল খুব গভীর বলে মনে হয় না। কাকচক্ষুর মত পরিষ্কার জল যেন
    টলটল করছে।

    রাস্তাটার দু পাশে বড় বড় বুনো ঘাস গজিয়েছে, আর তার মধ্যে মধ্যে
    একপ্রকার জলজ কাঁটালতা।

    ছোট্ট ছোট্ট লাল ফল সেই কাঁটা লতায় ফুটে আছে। ঘন সবুজের মধ্যে সেই
    লাল ফুলগুলো
    যেন রক্তপ্রবালের মত জ্বলছে।

    সত্যজিৎ পথ অতিক্রম করে দ্বীপে এসে উঠল। ত্রিভুজাকার দ্বীপটি।

    পথটা এসে যেখানে দ্বীপটায় শেষ হয়েছে, সেই মুখেই একটা আমলকী গাছ, ভোরের
    আলো আমলকী গাছের চিকণ পাতার উপরে বড়ে যেন পিছলিয়ে যাচ্ছে।

    একটা দোয়েল আমলকী গাছটার ডালে বসে শিস দিচ্ছে।

    সামনেই ডানহাতে একটা বাঁশঝাড়। বাতাসে বাঁশঝাড়টা আন্দোলিত হয়ে কটকট
    শব্দ তুলছে।

    দ্বীপের মধ্যে পায়ে-চলা একটা পথ ছিল বটে এককালে, তবে এখন বহুদিনের যত্ন ও সংস্কারের
    অভাবে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঘন আগাছায় সে পাথর আর চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যায় না।

    চারিদিকে ঘন সন্নিবেশিত গাছপালা অদ্ভুত একটা আলোছায়ার রহস্য দিয়ে
    ঘেরা। মধ্যে মধ্যে বায়ুর
    তাড়নায় বৃক্ষের
    পত্র ডালপালা আন্দোলিত হয়ে রহস্যময় এক শব্দতরঙ্গের সৃষ্টি করছে।

    মনে হয় কারা যেন চাপা গলায় ফিসফিস করে কি বলতে চায়।

    অদ্ভুত একটা শিহরণ
    সর্বাঙ্গে অনুভব করে সত্যজিৎ।

    অস্পষ্ট অনুচ্চারিত কার সাবধানবাণী যেন বলছে, এগিয়ো না! এগিয়ে না! ওখানে মৃত্যু! ওখানে
    বিভীষিকা!

    তবু
    এগিয়ে চলে সত্যজিৎ।

    আরো কিছুটা অগ্রসর হবার পর গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে নজরে পড়ে দ্বীপের
    মধ্যস্থিত বিরাম কুটীর।

    কুটীরের ঠিক পশ্চাতেই একটা প্রকাণ্ড বকুল বৃক্ষের তলায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সত্যজিৎ।

    এই সেই বকুল বৃক্ষ।

    এরই তলায় উনিশ বছর আগে একদিন নিরুদ্দিষ্টা হেমপ্রভার গলিত মৃতদেহটা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী দেখতে পেয়ে থমকে
    দাঁড়িয়েছিলেন বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে।

    আর দীর্ঘ উনিশ বছর পরে মাত্র সাতদিন আগে এই বকুল বৃক্ষের তলাতেই নায়েব বসন্ত
    সেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনিও কি বিস্ময়ে নির্বাক হয়েছিলেন?

    আশ্চর্য! উনিশ বছরের হলেও এই একই বৃক্ষতলে স্বামী ও স্ত্রীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর নির্মম পরিহাস!

    ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর
    শ্বাসরোধ
    করে মৃত্যু ঘটানো হয়েছে।

    পরিষ্কার সহজ কথায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

    কে হত্যা করল এমন করে স্বামী ও স্ত্রী–মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও হেমপ্রভাকে।

    একই লোকের হাতে কি স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিহত হয়েছেন!

    কিন্তু এই বা কেমন? একই দিনে তো সেই সময় দুজনকেই হত্যা করা চলতে
    পারত?

    একজনকে হত্যা করবার পর দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে আর একজনকে হত্যা
    করবার কারণটা
    কি! প্রয়োজন কি ছিল এই দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে প্রতীক্ষা করবার!

    তবে কি একই হত্যাকারী দুজনকে হত্যা করেনি? দুজন হত্যাকারী দুজনকে হত্যা করেছে? হত্যাকারী দুজন!

    হত্যার কারণ উভয় ক্ষেত্রেই কি এক, না বিভিন্ন! বিভিন্ন কারণ হলেও অকুস্থান সেই বকুল বৃক্ষতল হল কেন?

    একটার পর একটা চিন্তা সত্যজিতের মাথার মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরতে
    লাগল।

    দুটি হত্যাই একই সূত্রে
    গাঁথা, না একটির সঙ্গে অন্যটির আদৌ কোন সম্পর্ক নেই! সম্পূর্ণ বিভিন্ন! কেবল ঘটনাচক্রে দুটি
    হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটা অদ্ভুত পারম্পর্য এসে গিয়েছে মাত্র!

    জট পাকিয়ে গিয়েছে দুটি হত্যা-রহস্য একত্র।

    হত্যা-রহস্য দুটি যতই পাক খেয়ে খেয়ে জট পাকিয়ে তোলে, সত্যজিতের
    মনের মধ্যে কেমন যেন একটা জিদ চেপে যায়।

    মীমাংসা যতই সুদূরপরাহত
    বলে মনে হয়, মনের মধ্যে ততই যেন আরো তীব্র করে ও একটা রহস্যের হাতছানি অনুভব করে।

    কানাইয়ের মা যে বলতে চায় এর মধ্যে কোন অপদেবতার কাণ্ডকারখানা আছে,
    তা ও বিশ্বাস করে না এবং যুক্তি দিয়েও মানতে পারে না।

    অশিক্ষিতা কানাইয়ের মার কাছে যেটা সম্ভবপর বলে মনে হয়েছে,
    সত্যজিতের কাছে সেটা একেবারে সম্ভবপর বলে মনে হয় না।

    মনে হয় একটিবার কলকাতায় যেতে পারলে বোধ হয় ভাল হতো। সেখানে গিয়ে
    কোন ভাল ডিটেকটিভের সন্ধান করে তাকে যদি এই কাজে নিযুক্ত করা যেত, হয়ত সহজেই এই
    রহস্যের মীমাংসায় পৌঁছনো যেত।

    ভাবতে ভাবতে সত্যজিৎ দ্বীপের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। দ্বীপের
    মধ্যে যে বিরাম কুটীর, সেটা একটা একতলা পাকা বাড়ি।

    রৌদ্র বৃষ্টি দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটাকে পুড়িয়েছে ও ভিজিয়েছে। বাড়িটার
    আসল রং কবে পড়ে ঝলসে
    ধুয়ে মুছে গিয়েছে।

    দেওয়ালের গায়ে ছাদের কার্নিশে ধরেছে ফাটল আর সেই ফাটলের মধ্যে নির্বিবাদে বেড়ে
    উঠেছে বট-অশ্বত্থের
    গাছগুলো।

    জানলার কবাটগুলো কোনটা কবজার সঙ্গে ঝুলছে, কোনটার একটা পাল্লা বন্ধ করা, কোনটার দুটো
    পাল্লাই হা-হা-করছে খোলা। মধ্যে মধ্যে হাওয়ার মরিচা-ধরা কবজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ শোনা
    যায়। রং চটে গিয়েছে।

    চারিদিকেই একটা হতশ্রী অযত্ন অবহেলার ছবি।

    বাড়িটার চতুষ্পার্শ্বে
    এককালে যে চমৎকার একটি ফুলের
    বাগান ছিল, বিগত দিনের সেই সৌন্দর্য-সৃষ্টির ক্ষয়িষ্ণু চিহ্ন আজও চারিদিকে ছড়িয়ে আছে,
    দৈন্য অবহেলায় বুনো
    আগাছায় সমাকীর্ণ হয়ে।

    সেই গোলাপ, গন্ধরাজ, যুঁই,
    চামেলীর সমারোহ কাঁটালতা ও বুনো ফুলের পর্যাপ্ততায় লজ্জায় যেন মুখ ঢেকেছে।

    এই হয়ত সেই চৌধুরীদের নন্দনকানন। চৌধুরীবাড়ির আদরিণী বিলাসিনী
    বধুদের অলক্তরাগরঞ্জিত চরণের নূপুরনিক্বণে অতীতে হয়ত একদিন এই নন্দনকানন
    শব্দমুখরিত হয়ে উঠত।

    অন্তঃপুরের সলজ্জ বধূটি হয়ত এখানে আপন খেয়াল-খুশিতে অবাধ
    স্বচ্ছন্দ গতিতে ঘুরে বেড়িয়েছে।

    কখনো হয়ত কোন ফুলগাছের সামনে দাঁড়িয়ে ডাল থেকে ফুলটি ছিড়ে আপন
    কবরীতে লীলাভরে গুঁজে দিয়েছে।

    আজ তারা কোথায়?

    এই ভগ্ন বিরাম কুটীরের কক্ষের বায়ুতরঙ্গে কি তাদের দীর্ঘশ্বাস শোনা
    যায়?

    সম্মুখে ছোট অপরিসর একটি বারান্দা এবং বারান্দার সামনেই পর পর
    তিনখানা ঘর।

    পর পর তিনটি ঘরের মধ্যেই গিয়ে প্রবেশ করল সত্যজিৎ। ঘরের মেঝেতে
    একপর্দা ধুলো জমে আছে। কতদিন এখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি কে জানে!

    টীকা